দ্বিতীয় বর্ষ ।। দ্বাদশ ওয়েব সংস্করণ ।। উৎসব সংস্করণ ।। ১০ আশ্বিন ১৪২৮ ।। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১


উৎসব আমাদের যাপনেরই একটা অঙ্গ। আমরা প্রতিদিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে থাকতে কত না সুখ দুঃখের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলি একটা নিশ্চিত খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যের দিকে। যে লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে আমাদের কত আয়োজন, কত পরিকল্পনা, কত হিসেব নিকেশ, কত দুঃখ যন্ত্রণা, রাগ-হিংসে-বিষাদ, মান-অভিমান-প্রেম। অথচ সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর সব কিছুই মিথ্যে হয়ে যায়। হয়ে যায় সমস্ত পরিকল্পনা, সমস্ত হিসেব নিকেশের বাইরের জিনিস। 
          এই সমস্ত কিছু বুঝেও জীবনকে যাপন করতে হয় আমাদের। আমাদের আমার আমার ভেবেই থাকতে হয় পার্থিব বিষয় বস্তুগুলোকে। আর জীবনকে যাপন করতে গিয়েই প্রয়োজন পড়ে নানা হৈ হুল্লোড়, উৎসব অনুষ্ঠানের। অরন্ধনের এবারের ওয়েব সংস্করণ তাই উৎসবেরই নামে সেজে উঠলো। সমৃদ্ধ হলো বেশ কিছু গুনীজনের লেখাতে। তাঁদের ভাবনাতে।
           এবারের ছবি প্রদর্শ-শালাতে প্রখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পী সন্তোষ রাজগড়িয়া মহাশয়ের ছবি রাখতে পেরে আমরা ধন্য। ওঁনার আলোকচিত্র পেতে আমাদের সাহায্য করেছেন আরেক আলোকচিত্র শিল্পী শুভাশিস গুহ নিয়োগী মহাশয়। ওঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। 
           আমাদের প্রিয় পত্রিকা অরন্ধনের উৎসব সংস্করণ যেহেতু আগেভাগেই বেরোচ্ছে তাই অরন্ধনের সঙ্গে যুক্ত সকল কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, শুভানুধ্যায়ী এবং পাঠকদের উৎসবের আগাম শুভেচ্ছা জানাই আমরা। আপনারা সকলেই ভালো থাকুন। উৎসবের দিনগুলো সুন্দরভাবে কাটুক আপনাদের।


উত্তম মাহাত, সম্পাদক





_____________________________________________
অরন্ধন উৎসব ওয়েব সংস্করণে যাঁরা লিখছেন
_____________________________________________

 তপন পাত্র / দুর্গা দত্ত / অর্ণব চৌধুরী / শুভাশীষ ভাদুড়ী / মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া / তৈমুর খান / সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় / সুদীপ চট্টোপাধ্যায় / স্বাগতা দাশগুপ্ত / সুদীপ্ত চক্রবর্তী / শীর্ষা / ডরোথী দাশ বিশ্বাস / সেলিম মন্ডল / হাবিবুর রহমান এনার / সায়ন্তন ধর / সৌরভ লায়েক / অগ্নি রায় / গৌতম রায় / বিউটী সান‍্যাল / সন্দীপ মুখোপাধ্যায় / মহিউদ্দিন সাইফ / দীপ্তিশিখা  দাস / পল্লব গোস্বামী / সুজন পণ্ডা / সুপ্রিয় দেওঘরিয়া / শিমুল আজাদ / সুমন বন্দ্যোপাধ্যায় / 
_____________________________________________



শাক্তপদে পারিবারিক সমাজজীবন


                     তপন পাত্র
               
                
           বাংলার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর "আমরা" কবিতায় বলেছেন ---
           "দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি,
             আকাশে প্রদীপ জ্বালি,
            আমাদের এই কুটীরে দেখেছি ,
             মানুষের ঠাকুরালি।"
        
                কথাটি বাঙালি পরিবারে এবং এই বাংলার সমাজ জীবনে সর্বাংশে সত্য । কেননা বাংলার আকাশ , বাতাস , মাঠ-ঘাট-প্রান্তর , কুটীর , রাজপথ সাধনার ধন প্রাণের দেবদেবীকে কল্পরাজ্যের স্বর্গে থাকতে দেয় নি , নামিয়ে এনেছে ধুলো ধূসরিত মর্ত্যের ধুলায় । তাই বাংলার সমস্ত ধর্মীয় সাহিত্যের মতো শাক্ত সংগীতেও সমসাময়িক পারিবারিক জীবন তথা সমাজ জীবন তথা মাতা-কন্যার সম্পর্কের বা বাৎসল্য রসের বিশেষ ছায়াপাত আমরা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করি ।আরও পড়ুন






আড়বাঁশি : একত্রিশ

দুর্গা দত্ত

বৃষ্টিরাতের ভিজে কথাদের ভিড়ে
একটি ধ্বনির তুমুল অহঙ্কার
তোমাকে আমাকে ভাসিয়ে দেয় যে রোজ
শব্দের স্রোতে আকাশও দুর্নিবার

চাও বা না-চাও ধ্বনি ভেজে সারারাত
বানভাসি মেঘ প্রতিদিন আসে যায়
তোমার আমার ঘরদোর ভাসে মেঘে
বৃষ্টির বীজ আমাদের সব গানে...

আমাদের দেখে মাটিতে বৃষ্টি বীজ
ডালপালা নিয়ে ঘরসংসারে মাতে --
তুমি আমি দূরে, আরও সরে যাই দূরে
দেখি , চরাচরে ময়ূরকণ্ঠী আলো ...

বৃষ্টিরাতের ভিজে কথাদের ভিড়ে
তুমি আমি আর নেই সেই তুমি আমি
আমাদের কথা প্রতি উদ্ভিদে ফোটে
আমাদের কথা নিয়েছে পদ্মমূল ...

আমাদের কথা আমাদের আর নেই
আমাদের ঘর হাওয়ায় যায় যে উড়ে
আমাদের গান ঘুমন্ত পাখি জানে
বৃষ্টির বীজে আমরা যে বাঁচি রোজ





বিস্ময়

অর্ণব চৌধুরী

আর কাকে হতে হবে অমর অক্ষয়
এ সভ্যতা লকলকে, সারাদিন ভয়
সারিসারি মানুষের রতিময় চোখ
গাছে গাছে লেখা থাকে ‘ যাত্রা শুভ হোক’!

সুগন্ধী মেখেছ মেয়ে, চোখ ক্যামেরায়
পিছনে লোকনাথ বাবা, দুবাহু বাড়ায়
পিতা কি কন্যার ঠোঁটে ঢেলে দেয় বিষ
পিতা কি পুত্রের চোখে জাগে অহর্নিশ!

কেন তবে হতে হবে তোমাকে অক্ষয়
কালবেলা আছড়ে পড়ে ঘুম ঘন হয়
রান্না ঘরে তোলা থাকে কাদের সংসার
গঙ্গার বাতাস ঢোকে, চোখে কাঁটাতার—

আর কিছু নেই শুধু সন্ধ্যা নামে ধীরে
একরাশ পাতা ঝরে এখন শরীরে





অনাথ

শুভাশীষ ভাদুড়ী

জিভের এই নাচনকোঁদন,
স্বাদগন্ধ, ভ্রমে একাকার,
মুখ-চোরা, কিছু তাই বোঝাতে পারি না

কেটে রাখা ফল যেন
টুকরো দিনমান, কেউ
কাঁসার সরায় রেখে
সাজিয়ে দিয়েছে

মাছি উড়ে-উড়ে বসে,
শব্দ করে, থালার ওপর

এক-জীবন ফলের আশায়,
এক জীবনে কর্মে লাগে ঘোর




পরীর উল্কি আঁকা হাত

মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া


সে কী বালকের মতো কান্না ভাবো
ছুটি শেষে যেতে হবে বলে
লাল শাদা রঙে কেঁদে ফ্যালে হাতভর্তি চুড়িরাও
আঁচলে ঢেকে রাখি চোখের  রঙিন খাম
ফৌজী চিঠি এলে চাঁদের এই টাঁড়
মেঘে মেঘে ফেটে যায় তুলোট হাওয়ায়
উড়ে যাবে বলে চাপা দিই ঠিকানা
চিঠিতে ভরে রাখি নুড়ি পাথরের আত্মা
চুল বাঁধতে গিয়ে ভাবো একবার 
 দাঁতে চেপা কাঠের কাঁকোই জিজ্ঞেস করে বসে
দেশ গাঁওয়ের মধ্যে এমন পোস্টাপিস নেই কিনা
হাতের উল্কি আঁকা পরী জেগে ওঠে যেন রসিয়া!
ঘুম নিয়ে খেলা করে খুব
আদর ইচ্ছে নিয়ে চোখ মটকায় রাত
বাঁজাডাঙা তালগাছে বিদ্যুৎ চমকালে 
ঝাক ঝাঁক হাঁসের মতো আলোয়
চিঠিখানা বার করি আর
নীল বরফের রোদ লাগে অতদূর বার্চের বনে
কার্তুজ ও টুপি থেকে ছিটিয়ে পড়েছে উল্কি
কাটা হাত হালকা ডানার মতো দৌড়ে আসে
আমাকে জানাও রাত, চিঠির উত্তর দাও সত্ত্বর
বলো নুড়ি পাথরের আত্মা,বলো নীল বরফের দেশ,
ফেটে যাওয়া মাইন বলো,রক্ত চোঁয়ানো ডানায়
তখনও কি মেঘ লেগে আছে...?

                     




তৈমুর খানের এক গুচ্ছ কবিতা

বিক্রিয়া

 
সব বিস্ময়গুলি এখন তোমার জলাশয়ে মৎস্য
সব কল্পনাগুলি এখন তোমার আকাশের চাঁদ
সব উপলব্ধিগুলি এখন তোমার বাগানের ফুল ফল

আমি বেড়াতে আসা পাখি
বাংলা ভাষার ঠোঁটে ঠুঁকরে ঠুঁকরে দেখি
 স্বাদ-বিষাদের আদিম রসায়ন

চিকন মাজা ডুবিয়ে দাও জলে
মাজার নিচে খাঁজ
আমার আত্মহত্যা লুকিয়ে আছে ওখানেই

জলের উপর চাঁদের ছায়া
ভেসে ওঠে পরকীয় সমাজ



দ্বিতীয় বিবাহ

 
মিছিল এগিয়ে চলেছে
শুধু রথতলায় থেমে আছে কাহিনি
কাহিনির উল্টোদিকে আমাদের বাজার
বাজারে পতাকা উড়ছে
নবীনে-প্রবীণে সম্মোহন কিনছে রোজ

আহা যুবতী সম্মোহনের খোলা পোশাক
সমস্ত শরীরময় কুশলী ইঙ্গিত
মিছিল
     রথতলা
        কাহিনি 
             বাজার
সবাই ঝুঁকে আছে দ্বিতীয় বিবাহের দিকে







চোরাবালি

সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়


যাকে তুমি আজীবন রেখে দাও আলোমায়া বাঁকে 
সে তোমাকে প্রতিদিন সযত্নে ফাঁকি দিয়ে থাকে 

যে তোমাকে ভাসিয়েছে উথালপাথাল নীল জলে 
তুমি তাকে ছুঁতে চেয়ে পড়ে আছো বনবীথিতলে

যে তোমার জলছবি, যার মুখ আজ যেন ভয়
জেনে রেখো, এ ভ্রমণে সে তোমার চোরাবালি হয়।






সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের চতুর্দশপদী কবিতা


ছায়া

দিনের তৃতীয় দেহ তোমার পায়ের কাছে প'ড়ে 
তুমি তাকে আলগোছে তুলে, দিলে স্তন, পরমায়ু 
যা ছিল অনন্তে, তার ক্ষুদ্র কণা বাসনার তোড়ে 
তোমাকে দেখায় স্মৃতি, দেখায় কীভাবে খরবায়ু

তামাম শরীরে এসে দিয়েছিল অগ্নিশিহরণ 
যতেক দীক্ষিত হলে সেই, আর তূণ থেকে তীর 
তুলে নিয়ে, কী নিপুণ, বোঝালে আঘাত—প্রিয় রণ 
ভালোবেসে ফুটে থাকে গূঢ় চেতনায়, যে অস্থির

দেহখণ্ড—ভ্রূণ, নিজে গভীরতা বুঝে ভাসমান 
কবোষ্ণ তরলে, সেই বুঝি উঠে এল দিন শেষে 
অবোধ অপত্য হয়ে—আর তুমি বুকে নিয়ে প্রাণ 
দিলে তাকে, দিলে মন, সে যেন কখনও দীন বেশে

আর না বিরহে ঘোরে পথে পথে, অথবা বিষাদে 
যেন না সূর্যাস্তে একা—প্রেমহীন, নারীহীন কাঁদে



প্রচ্ছায়া

স্বরবর্ণে আত্মাহুতি—নরবর্ণে কামকলাবেশ 
ব্যাধিলব্ধ কায়া আর যে কবন্ধ ছড়ায় আবেশ 
আমি তার লিপিকার, আমি তার বিরহ দর্পণ 
গণ্ডুষে শোণিত নিয়ে প্রতিজন্ম করেছি তৰ্পণ

বাজাও মরমি দেহ, তুলে দাও যতেক প্রহরা 
ফেরি করি জনে জনে ষড়রিপু, আমি হরকরা 
হয়েছি কখনও মাটি কখনও-বা জলসম ব্যথা 
শ্রাবণ এনেছি বুকে মুছে দিয়ে লাজ বিহ্বলতা

যদিও ঘরোয়া হলে, হলে খুব স্মৃতির বান্ধব
বারোমাস্যা বুঝে নিয়ে শান্ত করো যা-কিছু জান্তব 
জান কি গোপনে থাকে—যাকে বলে ফল্গুধারা নদী 
সঠিক সংকেত পেয়ে কোনওদিন জেগে ওঠে যদি

স্বরবর্ণে সামাজিক, নরবর্ণে কুলধর্মনাশ 
মৃদঙ্গে কবন্ধ নাচে, বোল ওঠে–এসো সর্বনাশ




উপছায়া

হাহাকার সুরলগ্নে জাত হাহাকার ভীষণ উদ্ধৃত 
ফুটেছে দেহের শাখে রক্তচাঁপা সর্বনাশা ভ্রম
জরাকাব্যে লেখা হল যারা সব কামযুদ্ধরত 
তাদের বাসনা খুলে দেখতে পাই মৃত্যুপারঙ্গম

কে এক জরতীপ্রাণ অলোকনয়নে ভেসে থাকে 
চিদাকাশে অগণন ছিন্ন শির তারকা উদ্ভাসে 
জ্বলে নিভে, অট্টহাস্যে আমাদের জড়ায় বিপাকে 
দ্বিবিধ প্রহারগুলি অতিশয় মুগ্ধতা-সুবাসে

টোনা করে, কালাজাদু, অকম্পিত কালের বিবর 
যতেক আকাশবস্তু ঘুরে চলে আমার সকাশে 
সৃষ্টি-লয়, শুরু-শেষ, নাদব্রহ্ম, গুরুলঘু স্বর 
ধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনি—জড় থেকে জীবের প্রকাশে

বাক্যহারা, মুগ্ধ আমি—হাঁটু মুড়ে হাত পেতে থাকি 
আত্মদেহে জন্ম নিই একইসঙ্গে—অনেক, একাকী




মুকুন্দর পাঁচালি

(ঋণ: ব্যাধখন্ড, মহাশ্বেতা দেবী)

স্বাগতা দাশগুপ্ত


শ্যাওড়া, ছাতিম আর চালকুটো অলক্ষুণে গাছ 
শিউলি-ছায়ায় ঘেরা দাওয়া, ধান-চাল-মাষকলাইয়ে ভরা সংসার 
গভীর রাতে তালপাতায় আঁচড় কাটে কিশোর হাত 
দুর্দিনে ছেড়ে আসা ভিটে আজও স্মৃতিতে প্রখর 
পড়ন্ত রোদে চোখ মোছে সন্তানহারা দামিন্যা গ্রাম

তালপাতার পুঁথি বুঝি অপেক্ষায় চেয়ে আছে পথ 
কী লেখা হবে তাতে? কার কথা? কাদের? কাদের? 
মাটি, জল, হাওয়া, গাছ--- মনে মনে লেখা আছে সব 
হাতে শব্দ না এলে শান্তি নেই তবু 
কালি, কলম আর মন যদি বশে না আসে, শান্তি কোথায়!

দীনে তারো, মা অভয়া! প্রাচীন তেঁতুল গাছ ছায়া দেয়
কল্পনা বাস্তবে ভর করে পাঞ্চালী লেখা হবে ঠিক 
সহায় চন্ডীর সন্তান বনের আখেটিয়া ব্যাধ 
মাংস, পাখ, চাম, ধুনো, মধু, পরবে যাদের জীবন 
কী শেখা শেখাল ওরা তোমায়, শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ?

জীবনের কোন পাঠ? মৃত্যুর কেমন নিয়ম? 
নগর বড়ো হলে বসত ছেড়ে যাওয়া খেড়িয়াশবর
অভয়ার কোন বাণী মনে রেখে খুঁজে নেয় অন্য বিজুবন? 
সাক্ষী আছে বনস্পতি, শিলাই নদী, হাতি, বাঘ, আরণ্য সন্তান
প্রাচীন তালপত্রে লিখে যান মুকুন্দরাম...





বালকের বাড়ি

সুদীপ্ত চক্রবর্তী


সেইসব স্যাঁতস্যাঁতে কলাবতী বন
লাল হলুদ ফুল
রাতের জানালা জুড়ে
শত সহস্র ব্যাঙের চিৎকার

ভোরের শুরুতে, টানা বর্ষায় 
স্বচ্ছ্ব পুকুর জোড়া ব্যাঙাচীর ডিম 
দুহাতে সরিয়ে
সাঁতার কাটছি আজ

চিৎ সাঁতারে ভেসে আছে
লিঙ্গ ও নাসিকা যুগল 
পাকা জাম গাছ থেকে
কালো জাম ঝরে পড়ে

স্যাঁতস্যাঁতে জীবনের জল 
বেগুনী হয়
জাম ফাটে, ডিম ফাটে 
কলাবতী বনে অচেনা ভ্রমর এসে বসে

তোষক ও জাজিমের মাঝে 
সাপটি নিশ্চিন্তে ঘুমায়





দাহপত্র

শীর্ষা

১. 
নিঃস্তব্ধ সন্ধ্যা হয়ে ভেসে যাই 
দূরে – আমরা। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা
পিচরঙা ব্লেডের মতো সন্ধ্যার কালো 
আচমকা জাপটে ধরে চিরে ফেলে আমাদের 
সুফলা শহর; তুমি নির্দ্বিধায় বলো নম্রতাহীনতার গল্প,
অবিনাশ রাত্রির গল্প  

২. 
যেখানে পতঙ্গমৃত্যু সেখানেই দীপ জ্বলে 
ওঠে – এভাবে দীপ জ্বালতে জ্বালতে তুমি
এগিয়ে যাচ্ছ যুধিষ্ঠিরের পদচিহ্নে, আর শতসহস্র
মৃত্যুবরণ করেও আমি তোমার 
নিছক সারমেয় হয়ে উঠতে পারছি না

৩.
তোমার মুক্তি ওইখানে – ঠিক ওই হিমালয়ের কোল ঘেঁষে
বসে থাকা সন্ন্যাসকুটিরে, মন-মধু-মায়া
ফেলে মোক্ষের পরচুলা পরে বসে আছে
তোমার মুক্তি, দ্যাখো, আমি তার 
দুধ-ফল-রুদ্রাক্ষ কুড়িয়ে আনা একান্ত 
সহকারী; অমৃতের ভাঁড়ারে যার 
প্রবেশ নিষেধ

৪.
তবে কি এভাবেই অকথ্য রাত্রিযাপন?
কৃষ্ণ-জন্মাষ্টমী দিয়ে বানানো জীবন –
এতটাই কালো, এতটাই পাথুরে থাকবে?
বনে মাঠে গাছে ফুলে যে চঞ্চল
মায়ার ভ্রমর, তারও রঙে কলঙ্কছোপ!
জ্বলে যায়, পুড়ে যায়, নিভে 
যায় অনন্ত শোক – ঘৃতাহুতি শেষে
হাসে সন্তোষমুখ; আদিম অমৃতভাবে
কেঁদে চলে সুপ্রাচীন মায়াকাঠ বাঁশি






ডরোথী দাশ বিশ্বাসের এক গুচ্ছ কবিতা

১.
নেই পিছুটান...


আকাশ বনানী জল মাটির সংসার,
দিঘল দিনমান, দিগন্ত ডোবে না ...
পত্রহীনা শীর্ণ শাখা, তবু স্থিতিস্থাপক,
কে ঐ দোলায় বসে বোনে স্বপ্নজাল ?

নেই এখানে ঝরাপাতার ফিসফাস,
জাদুমন্ত্রে কোলাহলও পোষ মেনেছে,
বলাকার কাছে শেখা এ বিরল ধ্যান,
মুক্ত এ প্রকৃতিও রচে অন্তরাল।

মুক্ত মন এই উদার আকাশে
ছড়িয়ে দেয় যত নিরুদ্ধ বিষাদ,
নীল জলে স্পন্দিত বেদনা যত
ভাসিয়ে আনে রোজ চন্দনসকাল।



২.
এক ছিলো শৈশব...


এক ছিলো শৈশব, ভীষণ রঙীন!
আপন মনেতে তার কাটে সারাদিন।

সারাদিন ঘরে বসে ভালো তো লাগে না,
মেঘ এসে জানালায় কেন ধরা দেয় না!

কিভাবে যে কেটে যায় ভাদ্রের বেলা,
মেঘ আর রোদ্দুরে লুকোচুরি খেলা।

বৃষ্টি এলো যেই নিবিড়ধারায় -
শিশুটির মন আর ঘরেতে না রয়।

গাছের গুঁড়িটি পড়ে আছে যেখানে
বৃষ্টিতে মাখতে সে আসে সেখানে

আকাশের পাখি নয়, আছে পোষ মানা,
শিশুটির পায়ে পায়ে ঘোরে দুটি ছানা।

ঝুম ঝুম বর্ষাতে হাওয়া অবিরল,
কচুপাতা ছাতাতে শিমুল তুলোর বল।

শিশু ভেজে রিমঝিম জলীয় রেখায়
মানবিক হতে তারে কে বলো শেখায় ?আরও পড়ুন





সেলিম মন্ডলের কবিতা

বেঁটে মানুষের গল্প


একজন বেঁটে মানুষ আরেকজন বেঁটে মানুষের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে
ভুল যায়— সাদা বরফের মাথায় ছুরি রেখে
কেউ কেউ গড়িয়ে দিচ্ছে লাল আপেলের সমগ্র 

বেঁটে মানুষের আঙুলে বেঁটে মানচিত্র এঁকে
বলা হল— এবার তুমি ভ্রমণ করো
সেই বেঁটে মানুষ হয়ত ভ্রমণ করবে ঠিকই, কিন্তু
মানচিত্রে কখনো সে জুতোর দাগ লাগতে দেবে না

বেঁটে মানুষের মাথায় চাঁদ উঠলেও অমাবস্যা মনে হয়
বাড়ি-ঘর-গাছপালা-গাড়ি-ঘোড়া এতটা মাথার ওপর চেপে থাকে
বেঁটে মানুষকে আরও ঝুঁকে থাকতে হয়




সাঁতার

সাঁতার জানি না
ডুব দিতে গিয়েও মনে হয়: গলা ডুববে না

নদীর বয়ে যাওয়া দেখি
লাশের ভেসে যাওয়া দেখি

সাঁতার জানলেও ডুবুরির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায় না

নদী ভালোবাসলে মাছ ভালোবাসতে হয়
সহ্য করতে হয় কাঁটার শাসন

সাঁতার ভুলে যাওয়া মানুষের পিঠে জড়ুল থাকতে পারে

দেশের জড়ুল, মানচিত্রের জড়ুল

নৌকো সাঁতার শিখলে মানুষ জলে নামবে না
নৌকোর মধ্যে আঁকবে নিজের মুখ

মুখ ভেসে যাবে দূরদেশ...

পারাপারের কাছে সাঁতার চেয়েছে ঠিকানা

চিঠি ভিজে গেছে

চিঠির অক্ষরগুলো ধ্যাবড়ে গেছে গোটা গোটা হয়ে...




ঋণ


কিছুই লেখা হবে না
খামতি দিয়ে মোছা হবে আয়ু

এত জলজাহাজ চেপে ভ্রমণ করেছ
ভুলে গেছ, সমুদ্র আঁকা জাহাজগুলি আর ফেরেনি

একেকটা পথ রাতের নাভির মতো

নাড়ির টানে, কীভাবে লিখবে বংশানুক্রমিক হিসেবের ঋণ
এঁকে বেঁকে পাতা পেরিয়ে চলে গেছে বহু, বহুদূর...





হাবিবুর রহমান এনারের কবিতা

১.
এখনকে ভুলে যেওনা


আমারও ছিলো...আনন্দের মুহূর্ত 
যদি ফিরে যেতে পারি... চেষ্টা করব যেন 
আমার থাকে ক্যাবল- ভালো মুহূর্তগুলো

যদি তুমি না জানো
...কী করে জীবন গড়ে উঠে 
তবে কখনো 
এখনকে ভুলে যেওনা...হারিয়ে ফেলো না?



২.
দূরতর


অহেতু
দেখা-শোনা করি তোমার

দূরতর
এমনকি, পদ্মা
অথবা অস্তমিত সূর্য হতেও দূরে-বহু দূরে

তোমার সেই নিঃসঙ্গতা... তোমারই রহস্য!



৩.
ভুলে আছি


ভুলে আছি- ভুল করে আছি...

ভুল করে ভুলে আছি বহু বহু কাল, 
বলো...কতো ভুল করা যায় বা যাবে?

আহা-
কোনো আলিঙ্গন আজও বাকি রয়ে গেছে?

শেষ বিদায়ের আগে দেখা করে যাব... 
হে- সুনিশ্চিত তোমার সঙ্গে দেখা করে যাব,
তুমি তো তা জানতেও পারবে না।



৪.
স্বপ্নগুলো


একদা
পদ্মার পার ঘেঁষে...
যেখানে উঠান ছিলো- যাকে আর দেখে না তার চোখ

আজ
এখানে ফুটপাত...
যে স্থানে অপেক্ষা করে থাকে তার আশা- যাকে ঘিরে আছে স্বপ্নের দুর্ভেদ্যতা; সীমা নেই যার বিমূর্ত ভবিষ্যৎ

এমন করে আমরা যা ভাবছি তা-ই সে ভাবতে থাকবে

চোরের মতো- আমরা ভাগাভাগি করে নিচ্ছি-তাদের রাত্রি কিংবা দিবসের...স্বপ্নগুলো!






সায়ন্তন ধরের তিনটি সনেট
 
১.
বর্ষা রাতে

ঘন মেঘে ঢেকে গেলো রাতের আকাশ,
চাঁদ তারা কেউ নেই, আঁধার এ সভা।
মেঘেদের বুক চিরে বিদ্যুতের প্রভা-
শনশন বয়ে যায় উন্মত্ত বাতাস।
গাছেরা দোলায় মাথা ফেলছে নিঃশ্বাস,
মেঘেদের গায়ে এক মোহময়ী আভা-
বৃষ্টিজলকণা ঘিরে বাড়িয়েছে শোভা,
আঁধার হলেও তার অপূর্ব প্রকাশ।

একটানা জল ঢেলে মেঘ ক্ষীণকায়-
ছেড়েছে মাটিও তার সিক্ত সোঁদা গন্ধ,
নতুন প্রাণের কথা রটে চারিদিকে-
সবুজ ধানের চারা অঙ্কুরিত হয়।
সৃষ্টি চলতেই থাকে, হয়নাকো বন্ধ-
প্রকৃতি সেজেছে আজ নতুন আঙ্গিকে।


২.
উদ্বাস্তু

ঐ দেখো কারা যায় কাতারে কাতারে -
চোখে মুখে ক্লান্তিছাপ নয় প্রাণবন্ত,
জন্মভিটে ছেড়ে সব ভীষণ উদ্ভ্রান্ত,
ঠিকানা বদলে যায় রাতের আঁধারে।
নীরব মিছিল চলে ফুটপাথ ধরে,
নদী বন মাঠ ধরে এ চলা অনন্ত,
দীন দরিদ্রের সাথে চলেছে সম্ভ্রান্ত,
সাক্ষ্য শুধু রয়ে যায় লৌহ কাঁটাতারে।

রাতের আঁধার কেটে আসবে সুদিন,
উদ্বাস্তু শিবির হবে নতুন ঠিকানা,
চাই বস্ত্র বাসস্থান একমুঠো ভাত,
মেঘ বৃষ্টি বাতাসের কাছে যত ঋণ-
ধীরে ধীরে শোধ হবে যত লেনাদেনা,
ফুটবে ভোরের আলো ফুরোলে এ রাত।
 

৩.
আষাঢ় দিনেতে আজ

দিগন্তের ছাই রঙ গোলাপী আভায়-
উদ্ভাসিত হল যেই পাখির কুজনে
সচকিত শিশু মন চোখ মেলে চায়,
ধূপধুনো মিশে যায় ভোরের আজানে।

বেগুনী বর্ণে শোভিত এ নহে গোলাপ,
ভোরের ম্লান আলোয় রুয়েলিয়া ফোটে।
বাতাসেরা পত্রবৃন্তে জমায় আলাপ,
সোনা রোদ গায়ে মেখে প্রজাপতি জোটে।

স্লেট রঙা ক্যানভাসে কিছু পেঁজা তুলো
শুষে নিয়ে জলকণা হারায় আদল।
নজর মাটিতে রেখে ওড়ে চিল গুলো-
আষাঢ় দিনেতে আজ ঘনায় বাদল।

সাড়ে ছ'টার ভোঁ বাজে কাজ করো মন,
সাজাও যতনে আজ আপন আপণ।





সৌরভ লায়েকের কবিতা


১.
সে


সে এল 
       সব খেয়ে গেল

খেয়ে গেল
    আমাদের ঐতিহ্যের অতীত
                  বর্তমান
                        ভবিষ্যতের সমূহ সম্ভাবনা

সে এল
       সব খেয়ে গেল
                আমাদের গ্রাম
                                শহর
                     আস্ত গোটা দেশ

সে এল 
      সব খেয়ে গেল
      তবু তার মন ভরল না

কেননা
      আমাদের চিন্তা
      আমাদের ভাবনা কে সে খেতে পারেনি ।


২.
জীবন জীবিকা
                    

একটি গ্রাম থেকে
                   একটি মফঃস্বল
                             একটি শহর

তোমার জন্য ছড়িয়ে দিলাম

আহরণের খুদ

যাও
       খুঁটে খাও

যাও 
      ছুটে খাও






অক্ষয় মাফলার তোমার

অগ্নি রায়


এক

এমনই সম্মোহক আলো আসঙ্গ বিধুর,

জন্ম তারার কাছে পাওয়া যতটুকু গান,

বারান্দায় এসেছিলে সঙ্গে নিয়ে আমূল বৈরাগ

স্কার্ফে যা লেগেছিল ধুল পরিমাণ,

বিয়োগব্যথার মতো হাহাকার, পত্রবিরহিত,

হিমকথাকলিটুকু শুধু লিখে রাখো স্থানীয় মর্মরে

 

দুই

পিকনিক থেকে উড়ে যায় টায়ার সঙ্গীত,

আমাদের বিভ্রান্ত করেছিল মায়াবী ফসল,

কুয়াশার কোর্টে কবে যেন ঝরে গেছে র‌্যাকেটের শ্রম

আজ শুধু হারজিত জমে জমে তীব্র শ্বাসভার,

জানি, এক মাঘে পালাবে না পিকনিক, শীতের বিষাদ     

 



তিন

ক্রস ও কাঁটার মাঝে সম্বলহীন ঝুলে আছো

না বোনা নক্সার হৃদয়, আজ অনুমেয় শূন্যতা।

গত মরশুমে কিছু অনাদায়ী কথা 

গলার কাঁটা হয়ে গেলে, তাকে টনসিল বলে ডেকো।

বসন্তের দিকে যে চলে গেল আজ, তার পথজুড়ে

পড়ে থাক অক্ষয় মাফলার তোমার





শিশির আসে

গৌতম রায়


শিউলি জানে শিশিরের মানে
সারা রাত শিশির স্নানে
ধন‍্য হয় ফুলেল জীবন
সকাল আসে শিউলি-আগমনী
গায়ে দিয়ে
শিশির স্নাত ঘাসে পা ফেলে ফেলে
মায়ের কাছে যাওয়া
সারা পথ আমন-আতর বিছানো
ঢাকে ঢাকে বোধন গেয়ে যায় সবুজরোদ

ঘরামি জানে শিশির মিত্রতা
কংক্রিটের দেওয়াল তুলে
সারারাত শিশির নির্ঘুম পরিব্রাজক
ভেট দেয় প্রাণ প্রতিষ্ঠা দেওয়াল,
এ দেওয়ালে নোনাজল ভালোবাসা কর্ণিক কারিকুরি মিশে 
জেগে থাকে বাংলার হর্ষবিষাদ 
একচালা হরগৌরী পরিবার

শিশির আসে  শিশির আসে
প্রতীক্ষায় বসে থাকে 
আমাদের ভেতর আবহমান গঙ্গা ছুতার ।






প্রেমের আগল

বিউটি সান্যাল


খিড়কি খুলে দেখো এখনো আঁধার কাটেনি।
ক্লান্তিরা এখনো পিছু ছাড়েনি।
চারিদিকে শুধু বিষন্নতার ঘোলাটে বাতাস।
অবসাদগ্রস্ত মানুষগুলোর আঁখি স্থির।
অবক্ষয়িত সমাজ যেনো দন্ত বিকশিত করে হাসছে।
মানুষ আজ মানুষের গন্ধ চেনেনা,
এতোই তার দম্ভের আস্ফালন।
মানুষ আজ কাঁদছে,
তুমি মানুষ হয়ে,মানুষের দিকে হাতটা বাড়াও।
কিছুনা হোক চেতনাটাকে আমাদের জাগিয়ে রাখতে হবে।
যে করেই হোক বাঁচাতে হবে বিবেক।
একটা চৈতন‍্য একটা বিবেকের আজ বড় প্রয়োজন।
যারা কিনা গোটা সংঙ্কীর্ন সমাজটাকে টেনে তুলবে।
বাঁধবে ভালোবাসার বাঁধনে,
দেখবে মায়ার দৃষ্টিতে,
খুলবে প্রেমের আগল।






ক্ষয়

সন্দীপ মুখোপাধ্যায়


দিনরাত পরিশ্রম করে
বিশ্বদেব কর্মকার 

সারাদিন আগুনের সাথে কাজ 
লোহা পুড়িয়ে পুড়িয়ে 
বিশ্বদেব নিজেও পুড়ছে প্রতিদিন

প্রতিদিন দিন- যাপন 
প্রতিদিন তপ্ত লোহা 

প্রতিদিন ক্ষয়ে যাওয়া
দিন আনি দিন খাই
বিশ্বকর্মা বিশ্বদেব কর্মকার ।






মহিউদ্দিন সাইফের কবিতা

১.
নাচের আসরে


তাঁর সাথে ইচ্ছে ক'রে নাচি।
মূর্ছনার কূট।
আমি একা নই,
কার্ত্তিকের ফসল, শিশির, বাতাস তুঘলকি
সব দুহাত তুলে নাচে
আর যাত্রা করে ভেঙে ভেঙে অতিবিন্দুর দিকে।

হাতে অজ্ঞেয় একতারা
রোদের আশ্লেষ ছিঁড়ে বাউল আসে, বর্ণবিভাস।
নির্ভার গলা সাইঁজিনি মধুর।

মাটির গন্ধ নাচায়, থানকুনি,
জলের ওপর শোয়া আকাশ
সুনীল পুঁটিমাছ, আনন্দমগন।

নদী থেকে এক আইবুড়ি সাঁওতালনী উঠে আসে,
গায়ে ঝিলিক দেয় জামপাতার দ্যুতি।
পিছু পিছু ঝামা ইঁটের সুরত কুমার কুৎসিত।

সাইঁজিনি আরও গভীর হয়ে এল।
হাতে হাত রেখে নেচে চলেছি,
ঘূর্ণ্যমান দেহ পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে, তৈজস
আমাদের হুঁশ যাচ্ছে ক্ষয়ে।


২.
পুরনো বইয়েদের সাথে


পুরনো বইয়েদের সাথে গল্প করতে গিয়ে দেখলাম
আমার অনেককিছুই মনে পড়ছে না।
ওরা উল্টে পাল্টে দেখাচ্ছে
পৃষ্ঠা, পংক্তি, চওষট্টি দল।

বিধ্বস্ত স্মৃতিচূর্ণগুলি মুঠো মুঠো তুলে দেখাচ্ছে অন্বয়দাগ,
তুলে আনছে এখানে ওখানে রাখা মরা পাতা
শুকনো ফুল, গুনগুন রঙিন পালক।
কচি হাতে লেখা এক কিশোরীর অচ্ছোদ চিঠি :
রোদে-খাওয়া মেঘের মতো বিকৃত।

নিজের নিজের অর্থ আর স্বাবয়ব নিয়ে
মিশি-রাত্রি থেকে উঠে আসছে জটায়ু, মহেশ, শংকর
একটি তসবিঅলা অতন্দ্র বুড়ো
অন্য জাহানের দিকে মুখ।

সবাই এ-ওর স্মৃতিচিহ্নগুলি ছুঁইয়ে বলছে -
"দ্যাখো, আমাকে মনে পড়ে কিনা!"
সবাইকে চিনে ফেলার লোভ হচ্ছে খুব।







যে চলে যায়

                 দীপ্তিশিখা দাস
                

যে চলে যায় সে আর ফেরে না ।
 যার যাওয়ার ছিল তার যাওয়ার খবরেইবা কতজনের ছিল জানা? 
 
       তবু সে থাকে ,তার হাঁটা ,তার কথা বলা ,তার প্রেমের কাহিনী, সবথেকে যায় কোন অসম্পূর্ণ গল্প হয়ে। 
        
    যতদিন বেঁচে আছি, বেঁচে আছে বুকের মাঝে আরেকটি মুখ, 
তাকে সহস্রাব্দ বাঁচিয়ে রাখবো         
শিরায় শিরায় ..... 

          রক্ত কথা বলে যাবে.... 
 তাকে ডাকবে প্রতিদিন । 
প্রতি রাতে তাকে জড়িয়েই হয়তো স্বপ্ন থাকবে অনেক অনেক । 

চলে যাওয়া তো সহজ নয় !! 

বিচ্ছিন্ন শাখা নদীর কান্না গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে আছড়ে পড়ে। 
দিনে দিনে যত মৃত্যু , ততই তো মরে চলে প্রেম । 
সেইসব লুকিয়েই বেঁচে ছিল ভালোবাসা ।।

      আমার কান্নাও বাঁচতে চায় রাত শাসনে ভীত ঘুম ভাঙা দোয়েলের জন্যে ;
যে প্রেম মত্ত হয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে ছিল চিলেকোঠায়....।






পল্লব গোস্বামীর কবিতা

১.
কালাশৌচ
=======

ঘি দিয়ে ভাজা হয় শেষ অস্থিটুকু ,
শূদ্র স্মৃতি ছাই হয়ে ছিঁড়ে যায় ! 

            প্রিয় কান্নার কাছে ,
হোম ও  হবিষ্যান্ন 
কার পিতৃঋণ বেশি ? 

ব্রহ্মচর্যে প্রশ্ন রেখো না।

মনুস্মৃতি মগজে জ্বেলে 
                আজ আমি 
  মাথাফাঁকা হয়ে গেছি দ্যাখো ...

অনুরোধের রোদে,তুলসীগাছ ঝিমায় ...
             দুধ ও জলে ,
কে যেন চেখে দেখে -

এক প্রণত প্রেতের পিন্ডদান !


২.
খেলনাবাক্স ও কাবুলিওয়ালার দেশ
============================

ছেলেবেলার খেলনা বাক্সের ভেতরে আমি জীবন খুঁজছিলাম
ঝুঁকে পড়ছিলো 
ভেজানো কিশমিশের মতো চাঁদ থেকে 
রুপোর জলধরা আলো 

আমাদের নিজেদের তৈরী ঝুলন পূর্ণিমার বাগানে নিজেরাই নিরুদ্দিষ্ট আমরা
আমার হাতের পাশে প্লাস্টিকের উট ; হাতি -ঘোড়া , দলমোরগ 
শরীরী ঝর্ণার পাশে অনন্ত লুলি মাছ 

একটা অনাবিল রাত ক্রমশ বদলে যাচ্ছিল
আমরা বরফে বরফ ঘষে লাল আঙুর খাচ্ছিলাম
সাদা আকাশের মতো জোব্বার ভেতর থেকে খুঁজে নিচ্ছিলাম,পেস্তা আমন্ড 

তারপর শ্যাওলা সাজানো পাহাড়ে শুরু হল যুদ্ধ
কী আশ্চর্য ভাবে,একটা কবরের মতো বাক্সের ভেতর ঢুকে গেল - গোটা একটা কাবুলিওলার দেশ 





উজ্জ্বল গরাই-এর গুচ্ছ কবিতা

১.
উৎসব

কিছু কিছু চলে যাওয়া চলে যাওয়া হোক
দু'দন্ড পাশে বসি এসো আয়োজন

উৎসব আসলে তো জমে থাকা শোক
ফুরোলেই সেও একা আমারই মতন ।


২.
প্যান্ডামিক

এমন অবিশ্বাসী বসন্তে তিল দেখিও না আর

ক্রমশ মুখোশ দেখে দেখে প্রজাপতি ভুলে গেছে রং !

আমি যুদ্ধ ফেরত সৈনিক বলছি
তোমার চোখের চেয়ে বিধ্বংসী কিছু নেই !


৩.
বৃষ্টিতে...

তারপর আকাশ দেখতে দেখতে
তুমি এলে বারান্দায় ।
ততক্ষণে বিকেলের বৃষ্টিতে
ভেসে গেছে
একটি মেয়ের নখ , একটি কদম ফুল ,
আনকোরা বিষণ্ণ বাঁশি কার ...

তুমি তাদের গল্প শুনেছিলে , কদম চাওনি !


৪.
গ্ৰাম

দশক পূর্ব গ্রামের মতো তোমার চোখ
তোমার চোখে দশক পূর্ব গ্রামের মায়া

তিনবেলা মাটি কেটে 
যার ঘরে নবান্ন আজ
তার আয়োজন তোমার স্নিগ্ধ মুদ্রায়

খড়ছাওয়া দাওয়ায় বসে যে মা 
শাক পাতে ভাত বেড়েছে
তার উষ্ণতা তোমার গায় ।

দশক পূর্ব গ্রামের মতো তোমার চোখ
তোমার চোখে সহস্র প্রাচীন
মুগ্ধ যুবকের আশ্রয়



৫.
প্রেমে পড়বি ?

এই অন্ধকার, বুনো পায়রার ঝিম
শীতের মরা মেঘের মতো
বিষন্নলীন

ওই স্নিগ্ধ মেয়ে, প্রেমে পড়বি ?
কাঁদিনি কতদিন !




বড় সাধ হয়

সুজন পণ্ডা


আমাকে শিখিয়ে দাও, 
কীভাবে পায়ে পায়ে এই অন্ধকার;
এই মহাসিন্ধুর মত অন্ধকার পার হয়ে যায়
কোনো প্রেমিক নাবিক। 
ভাটায় ক্লীব জল যান,
জীর্ণ ক্ষেত খামার--পড়ে থাক
সব যন্ত্রণা জাতকের চিহ্ন 
সব অসহায় বিষাদ। 

তোমার আলিঙ্গনে পাকা ধানের সুখ, 
তোমার বুকের গন্ধ মাখা ভোর ;
বড় সাধ হয়
কোনো জানলা ভাঙ্গা রোদে
স্থানচ্যূত হই.. 
পাখির ডানার মত হালকা 
অথচ প্রত্যয়ী সেই সাধ.. 

শিখিয়ে দাও কিভাবে 
সাদায় সাদা এই কাশবন
নদীর স্রোতের মত এই কাশ বন চিনে নেয়
আশ্বিনের সহোদর


তোমার দুই হাতের সান্ত্বনা পেলে
কান্নায় কান্নায় ধাতস্হ হয় 
মৃতবৎসা হরিণীর উদভ্রান্ত চোখ।






সহজের যাত্রা

সুপ্রিয় দেওঘরিয়া


শিউলি পড়ছে টুপ টাপ। শিশির পড়ছে নি:শব্দে।
রাত্রি নামছে ধীরে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার গুন গুন।মালতি লতা ঘুমিয়েছে।
হেমন্ত দুয়ারে,শরতের মাঝ।
লাল মাটির দেয়ালে চালগুঁড়ির আলপনা।
ভালোবাসার উঠোনে মায়ের ঘুমপাড়ানি গান।
সুড়ঙ্গ দিয়ে হেঁটে যায় জটিল শব্দেরা।
তারা রাতবিরেতের পান্তা ভাত,কচিবাদামের গন্ধ, লাল আলুর শেকড়ের গন্ধ পার করে
অন্ধকারে ঝিম মেরে বসে আছে।
শব্দেরা বোধের ভেতর খিল খিল করে হেসে ওঠে,
তারা শিউলির রঙ মাখতে চায়,
কাঁচা হলুদের ডোরে বাঁধতে চায় তাদের শরীর।
শিউলি পড়ে টুপটাপ।
কোমল গান্ধারের মোলায়েম প্রলেপে 
রাতের গভীরে শিশিরের সঞ্চার হয়,
শিশিরের মতো নীরবে কথারা সহজ হয়।
জটিলের থেকে সহজের যাত্রা ক্রমশ
জ্ঞান চক্ষুতে ফুটে ওঠে, 
যেন এক স্নিগ্ধ আলোর আভা।





প্রত্নযাত্রার জীবনানন্দ : প্রসঙ্গ অগ্ৰন্থিত কবিতা


শিমুল আজাদ


'এই কবিতাগুলির পরিবেশ প্রকৃতি অনেক বেশি ছড়ানো, প্রাথমিক স্তরগুলির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।'
-এ যাবত জীবনানন্দ দাশের সব কটি কাব্যগ্রন্থের কম-বেশি আলোচনা ও মূল্যায়ন হয়েছে। অপ্রকাশিত লেখার উল্লেখযোগ্য মূল্যায়ন হয় নি। প্রকাশিত লেখার পাশাপাশি অপ্রকাশিত লেখার মূল্যায়ন বা আলোচনা ভিন্ন স্বাদ ও বৈচিত্র্যের দাবি রাখে। -এক্ষেত্রে কবি জীবনানন্দ দাশের ৪০টি অপ্রকাশিত কবিতা তাঁর অন্যান্য কবিতার মতো সমৃদ্ধ-সন্তাপে উষ্ণতা ছড়ায়। মহাকবিতার আলোড়ন টের পাওয়া যায়। সৃষ্টির রূপ-বৈচিত্র্য বৈভবে- মানবাত্মার জয়-পরাজয়-তৃষ্ণা, হাহাকার-আকুতি-প্রচেষ্টা কর্মময় উদ্ভাস জেগে ওঠে। পৃথিবীর রঙ-গন্ধ-বিভা-আলোড়নে আলোড়িত, প্রাণিত কন্ঠস্বর, গন্ধগাথা ঐতিহাসিক রূপ-নির্মাণে- ব্যক্তির সামষ্টিক পদযাত্রা ধ্বনিত হয়। কবি প্রত্নরাখালের মতো সভ্যতা- সংস্কৃতির আদি- অকৃত্রিম সত্তায় ডুব দেন; অন্বেষণ করেন প্রকৃতির রূপ-রীতি, কাঠামো, পরকাঠামো।আরও পড়ুন





গ্ৰামীণ যাত্রাশিল্প--সঙ্কট ও সংশয়ের দোলাচল

সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়




'তফাৎ যাও, তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায় '_মেহের আলীর এই সংলাপে গ্রাম-গ্রামান্তরে রঙ্গমঞ্চ আজ আর সেভাবে আলোড়িত হয়ে ওঠে না। 'অচল পয়সা'র চাঁদু মাস্টারের প্রতিবাদ সেভাবে আর ভাষা খুঁজে  পায় না।প্রচারের আড়ালে-আবডালে ভিখারী ঈশ্বর হাহাকার করে কেঁদে উঠলেও,সে কান্না হাইটেক শ্রোতাদের কানে ধ্বনিত হয় না। একে একে নিভে যাচ্ছে স্পটলাইট। থেমে যাচ্ছে আবহসংগীত। অন্ধকার মঞ্চের এক কোণে দাঁড়িয়ে একা একা রং তুলছে চরিত্র। এক গভীর সংকট ও সংশয়ের দোলাচলে আজ গ্রামীন যাত্রা শিল্প। গ্রামীণ শব্দটা অর্থের সংকোচন ঘটালেও ইচ্ছা করেই ব্যবহার করা হয়েছে। আরও পড়ুন



______________________________________________

ঔপন্যাসিক দীপংকর রায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস-- 
"জলশ্যাওলার বিরহকথা" - এবার তৃতীয় পর্ব
_______________________________

জলশ্যাওলার বিরহকথা

দীপংকর রায়


লেখা প্রসঙ্গে লেখার অন্তর্যামীর প্রশ্ন :  


      কী ঢ্যামনা লেখক, কি হচ্ছে টা কি, ঢ্যামনামি আরম্ভ করলে তো? এতক্ষণ তো বেশ ছিলে, বেশ তো এপাশ ওপাশ করছিলে, মরা দিনের কথা নিয়ে একটা গল্প বানানোর বাঁধা রেওয়াজের মধ্যেই ঘুরছিলে বেশ, কিন্তু এসব আবার কি আরম্ভ করলে বলো তো? বেশ তো পুচকেপাচকা শালা-শালিগুলোকে নিয়ে রসের গল্প বানাতে গিয়ে বুঝি মনে পড়ে গেল, না----- তাদের ওই অবিবাহিত মাসিটার কথা-----, ওই যে গায়, পেয়ে গেছ বুঝি? গায় যদিও সত্যিই ভালো, কিন্তু তাতে হল টা কি ? সেই তো ধরে রাখতে পারে না-- একটুতেই মুষড়ে পড়ে বিয়ের চিন্তায় । তোমার প্রশ্ন জাগে না, ওর এইসব অনিশ্চয়তা বোধ নিয়ে? শিল্পী মন এত সংসারমুখিন হবে কেন? টোকা দিয়ে দেখনি তা তো না , দেখেছ , কিছুই ছাড়নি । সে পরীক্ষাতেও তো তোমার কত বর্ষা , গ্রীষ্মের দুপুর, শীতের বিকেল-সন্ধ্যা করে দেখা আছে। শুনেছ তার একে একে কত পর্ব-কথা! কী সমাধানে এসেছ তাতে; আসনি কি, এই একাকীত্ব বোধ, এই লম্বা টানা বারান্দাওয়ালা বাড়িটার চারপাশে ঘের দেওয়া পাঁচিলের ভেতরে, বাড়ির পেছনের পুকুরের পাড়ে, কীভাবে একটি কলেজ-ইউনিভার্সিটি করা মেয়ে, ঘরে বসে বসে এইসব টানটান উত্তেজনাময় প্রকৃতির রঙ্গরসে সাড়া না দিয়ে, খালি খালি শুধু রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে, তার প্রেমময় আবেগ নিয়ে, একবারও একজন দেহসঙ্গীর কথা ভাববে না, তা কি হয়? আরও পড়ুন





                    আমাদের বই













সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের প্রাচীন দুর্গার ছবি : সন্দীপ কুমার
যাত্রার ছবি : সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়
দুর্গার ছবি : তপন পাত্র
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com



মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। নাচনী শিল্পীদের আলোক-চিত্র ।। সন্দীপ কুমার