প্রথম বর্ষ ।। নবম ওয়েব সংস্করণ ।। ২১ অগ্ৰহায়ণ ১৪২৭

এমনিতেই পড়ানো হয় না স্কুলে। সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের দশা দেখলে চোখে জল আসবে। তারপর করোনা সঙ্কট। প্রায় বছর খানেক বন্ধ স্কুলগুলো। যার ফলে রিডিং পড়তেও ভুলে গেছে গ্ৰামাঞ্চলের ছেলে মেয়েরা।
              হাট বাজার খোলা। গাড়ি ঘোড়া চলছে। মিটিং মিছিল চলছে। সরকারি সমস্ত অফিস চলছে। সবার সঙ্গে সবার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে খোলাখুলি। অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো বন্ধ রয়েছে রহস্য জনক ভাবে। করোনা কি কেবল মাত্র স্কুলের মাধ্যমে ছড়ায়? স্কুলে না গিয়েও বাড়ির কারোর দ্বারা বাহিত হয়ে সেই ছেলে মেয়েদের কি করোনা হওয়া সম্ভবই না? যদি না থাকে আলাদা কথা। তবে হওয়ার সম্ভাবনা যদি থাকে তাহলে স্কুল গুলো খুলে দেওয়াই উচিত হবে বলে মনে হয়। রাজনীতির গেঁড়াকলে কত আর পিষ্ট হবে মানুষ?


উত্তম মাহাত, সম্পাদক





_____________________________________

আমাদের অনিকেত বন্ধুদের একজন সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সদ্য মাতৃহারা হয়েছেন। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমাদের নেই। তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে আমাদের সমবেদনা জানাই।
_____________________________________



ইতু : মিত্র ও মৃত্তিকার মহাসঙ্গম

তপন পাত্র


পুরুলিয়ার বহিরাবরণের অন্তরালে আনন্দ বিজড়িত অফুরন্ত প্রাণশক্তি ফল্গুনদীর মতো সতত প্রবহমান । দারিদ্র তার পোশাকে , চেহারায় অন্তরে লোকসংস্কৃতির বনমালা । এই ব্রহ্ম-ধূসর ভূগোলসীমায় প্রাণশক্তির সুন্দর ও স্বতঃস্ফুর্ত বহিঃপ্রকাশ এর বিভিন্ন উৎসব , পা'লপরব , মেলা ও গাজনগুলি । স্বতোৎসারিত প্রাচীন পূজা পার্বণগুলির বেশির ভাগেরই মূল কথা উৎপাদনের জন্য আরাধনা , সন্তান-সন্ততিদের দুধে ভাতে রাখার মনোবাসনা । তাই যেমন ভাদু , টুসু , জাওয়া , জিতা , করম , বাঁদনা , ইঁদ্ , ছাতা আর চড়ক তেমনি ইতুও ।
পুরুলিয়ার বিভিন্ন জাতির অনেক পরিবারেই সারা অঘ্রাণ মাস জুড়ে চলে এই ইতু পূজা । তবে অন্যান্য পালা-পার্বণগুলিতে তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের অগ্রাধিকার, ইতুর বেলায় উচ্চবর্ণের প্রাধান্য।
কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন ইতু পূজার শুভারম্ভ । স্থানীয় মানুষজন বলেন "ইতি" বা "ইরতি" । এটি সম্পূর্ণরূপেই গৃহস্থ মেয়ে ও বধূদের ব্রত , এয়োতিদের ব্রত । গবেষকরা বলেছেন, "নারীব্রত" । কুমারী মেয়েরা এবং এয়োতিরা সৌভাগ্য কামনায় এই ব্রত পালন করে । কুমারীদের প্রার্থনা ---ভালো বর । আর এয়োতিদের প্রার্থনা সন্তান ও সমৃদ্ধি ।
পূজার সূচনার দিন সৌভাগ্য কামনায় ঘট প্রতিস্থাপন করা হয় । মেয়েদের বিশ্বাস ইতুলক্ষ্মীর পূজা করলে অর্থের অভাব দূর হয় । গৃহস্থের কল্যাণ হয় । সৌভাগ্যের উদয় হয় । বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই পূজার প্রচলন ।
এখন প্রশ্ন হলো এই ইতু পূজা কী ? কী , কী প্রয়োজন এই পূজায় এবং কীভাবে হয় এই পূজা ?
ইতু পূজা হল সূর্য পূজা , আবার লক্ষ্মী পূজাও । সূর্যের অন্য নাম মিত্র । এই "মিত্র" থেকে এসেছে "মিতু" , "মিতু" থেকে "ইতু" । মূলত বৈদিক দেবতা বা দেবী এই মিত্র বা ইতু ।
অঘ্রাণ মাসের সূর্যের নাম "মিত্র" বা "রবি" । এই কারণে অঘ্রাণ মাসেই রবিবার গুলোতে ইতুর পূজা হয় । প্রাচীনকালে পারস্য দেশেও একসময় ইতু পূজা হ'ত । তখনই কুমারীরা পতিলাভের আশায় আর বিবাহিতারা সাংসারিক মঙ্গল কামনায় সূর্য পূজা করত । পরবর্তীকালে শাক্তধর্মের প্রভাবে "ইতু" ক্রমশ দেবতা থেকে দেবী -তে পরিণত হন । "মিত্র" সূর্য দেবতা , "ইতু" শস্য দেবী । এই কারণে ইতু পূজা মানে লক্ষ্মী পূজা ।
        ইতু পূজার জন্য প্রয়োজন মাটির সরা , ছোট মঙ্গলঘট , ধান , হলুদ , কচু গাছ , মান গাছ , মটর , সর্ষে , কলমি লতা , শুশনি শাক , ফুল , দূর্বা , বেলপাতা , তিল , হরিতকী , ধূপ , নৈবেদ্য , কুল , আতপ চাল , কলাই ভাজা , পঞ্চ শস্য , ধানের শীষ , আম ডাল , গুঁজা ও তিসির গাছ বা ফুল ইত্যাদি ।
            কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন জলাশয় থেকে পাঁক তুলে এনে একটি মাটির সরাতে সেই পাঁক রাখা হয় । কেউ কেউ অবশ্য পাঁকের বদলে গোবর মাটি রাখেন । সরাটি ও মঙ্গল ঘটটি লাল ও সাদা রংয়ের কালি বা রং দিয়ে সাজানো হয় । ফুল আঁকা হয় , আলপনার মতো ছবি আঁকা হয় । সাধারণত ঘটটিতে পাঁক ও জল দিয়ে একটি পঞ্চপত্র যুক্ত আমডাল রাখা হয় । তার সাথে স্থাপন করা হয় কলমীলতা , শুশনি শাক , ধান গাছ , গুঁজা ও তিসি গাছ ইত্যাদি । 
            ঘটের ভিতরে রাখা হয় একটি হরিতকী ‌। আর সরার ভিতর গোবর মাটি অর্থাৎ উর্বর মাটি রাখা হয় , তাতে গম , ছোলা , ধান , মটর , তিল , তিসি , গুঁজা প্রভৃতি শস্যবীজ ও তৈলবীজ ব্যপন করা হয় । সরা ও ঘটের গায়ে তেল , সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয় । পঞ্চশস্য নির্দিষ্ট স্থানে রেখে অর্থাৎ বাড়িতে কুলদেবতার মন্দির থাকলে মন্দিরের কলঙ্গায় আর না থাকলে গৃহস্থের তুলসীথানে পঞ্চশস্য রেখে তার উপর সরা ও ঘট স্থাপন করা হয় । 
            পুরুলিয়ার বাইরেও এই পূজার প্রচলন আছে । কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলের সাথে এই অঞ্চলের ইতু পূজার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পার্থক্যটি হল সর্বত্র ইতু পূজা হয় শুধু রবিবার , কিন্তু পুরুলিয়ায় সারা অঘ্রাণ মাসের রবি ও বৃহস্পতিবার ইতু পূজা হয় । রবিবার সূর্যজ্ঞানে পূজা আর বৃহস্পতিবার মা লক্ষ্মী জ্ঞানে পূজা । বৃহস্পতিবার কে এই অঞ্চলের মানুষ লক্ষ্মী বার বলে থাকেন ।
             সারা অঘ্রাণ মাসের প্রতি সপ্তাহে দু'দিন এই পূজা করে নারীরা । পূজার দিনগুলি ব্রতকিরিণীরা নিরামিষ ভোজন করেন । সকালে স্নান ক'রে পূজা সেরে ফলাহার করেন । দুপুরে ভাত এবং সেদ্ধ তরকারি , তেল-হলুদ ছাড়া রান্না । রাতে রুটি , সবজি ; জুটলে মিষ্টি ।
             প্রথা মেনে পুজা সাঙ্গ ক'রে বাড়ির , কোথাও কোথাও বা সারা পাড়ার মেয়েরা গোলাকারে ব'সে ইতু লক্ষ্মীর ব্রত কথা শোনেন । সকলের হাতে আটটি আতপ চাল ও আটটি দূর্বা ধরা থাকে । শুরু হয় ব্রত কথা : ---

     "অষ্ট চাল অষ্ট দূর্বা ধ'রে,   
    ইতু কথা শোনো প্রাণভরে।"

        ---ব্রত কথাটি দ্বিপদী ছন্দে রচিত ; ঠিক রচিত বলা যায় না । কারণ এটি বংশানুক্রমে শ্রুত হয়ে আসছে । যাইহোক , ব্রতকথাটির অতি সংক্ষেপে গদ্যরূপ এইরকম :---
           একদা একটি গ্রামে একজন ব্রাহ্মণ ও এক ব্রাহ্মণী বাস করতো । তারা ছিল বেজায় গরিব । ভিক্ষা করে তাদের দিনাতিপাত হ'ত । তাদের দু'টি কন্যা ছিল , নাম -- উমনো আর ঝুমনো । একদিন ভিখারি ব্রাহ্মণের খুব পিঠে খাবার সাধ হ'ল । বহু কষ্টে ভিক্ষা করে সে পিঠার প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি জোগাড় করলো । সন্ধ্যায় এনে তা ব্রাহ্মণীকে দিল । আর বললো , তার খুব শখ সে পিঠে খাবে , কিন্তু এই পিঠের ভাগ কেউ পাবে না । এই ব'লে ব্রাহ্মণ পাশের ঘরে বিশ্রাম করছে , কিন্তু ধ্যান তার সেই পিঠাতে । একটু পরে ব্রাহ্মণী পিঠা বানাতে শুরু করলো। একটি করে পিঠা করে আর এক একবার ছ্যাঁক্ ক'রে শব্দ হয় । ব্রাহ্মণ ছ্যাঁকগুলি গুনতে থাকে ।
           অল্পক্ষণ পর খাবার পালা । ব্রাহ্মণী পাথরের থালায় পিঠে সাজিয়ে ব্রাহ্মণ কে ডাকলো । ব্রাহ্মণ গুনে গুনে পিঠে খায় , শেষে দেখে দুটো পিঠে কম । ব্রাহ্মণী ভেবে ছিল দুই মেয়েকে যে দুটো পিঠে খেতে দিয়েছে, তা হয়তো ব্রাহ্মণ বুঝতে পারবে না । কিন্তু ব্রাহ্মণ তা বুঝতে পেরে রেগে আগুন । ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণীকে বললো -- ওই মেয়েদের তো আমি পেট ভরে খেতে দিতে পারছি না , তাই কিছুদিনের জন্য ওদের মাসি বাড়িতে রেখে আসি । ওখানে অন্তত দুটি পেট পুরে খেতে পাবে । আর আদরও পাবে ---এই বলে দুই কন্যাকে নিয়ে ব্রাহ্মণ বেরিয়ে পড়ে । পথে বনের মধ্যে একটি গাছের তলায় বিশ্রাম নেয় । মেয়ে দু'টি ঘুমিয়ে পড়ে , ব্রাহ্মণ তাদের ছেড়ে পালিয়ে যায় । ঘুম ভাঙতেই তো মেয়ে দু'টি দিশেহারা ! প্রথমে "বাবা -- বাবা -- --" করে চিৎকার করে , পরে সত্য বিষয়টি অনুমান করতে পারে । বিপদের মুখে পড়ে তারা দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে হাঁটছে আর হাঁটছে । একদিন পর হাঁটতে হাঁটতে এক ব্রাহ্মণ বাড়ির সামনে উপস্থিত হয় । ওই বাড়ির গিন্নি মেয়ে দু'টিকে দেখে তাদের বিপদের বিষয়টি অনুমান করতে পারে । সব শুনে গিন্নি তাদের ইতু ব্রতপালন করতে বলে । নিষ্ঠা সহকারে সারা অঘ্রাণ মাস ইতু ব্রত পালন ক'রে তারা ভালো বর লাভ করে আর তাদের মা-বাবার সংসারেও সৌভাগ্য - সমৃদ্ধি নেমে আসে ।
             ব্রতটির মূল উদ্দেশ্য ব্রত কথাটিতে অনেকটাই সুস্পষ্ট । মিত্র পূজা বা সূর্য পূজা বা ইতুলক্ষ্মী পূজার মূল লক্ষ্য ভালো বর এবং সাংসারিক সুখ-সমৃদ্ধি । সামাজিক দিক থেকে তাই-ই । কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে ইতু পূজার ভাবনা আরো গভীর । সূর্য পূজার অর্থ সৃষ্টির উৎসের পূজা । বিজ্ঞানও বলে উৎপাদন এবং জীবদেহের সকল শক্তির মূলাধার সূর্য । সূর্য ও মৃত্তিকার পরম মিলনেই সকল কিছুর উদ্ভব । কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় মানুষের জীবনযাপনের প্রধানতম অবলম্বন কৃষি উৎপাদন । শস্য তো দু'রকম ---খারিফ শস্য এবং রবি শস্য । খারিফ শস্যের সঙ্গে কৃষিদেবী ভাদুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক । আর রবিশস্যের প্রাচুর্যের দিনে টুসু । কিন্তু টুসুর আগের মাসে ইতু । ইতু পূজার মধ্য দিয়ে শস্যবীজ ও তৈলবীজ সংরক্ষণের বিষয়টিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে । রবিশস্যের গুরুত্ব যে কতোখানি , তাও ধ্বনিত হয়েছে এর বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে ।
             অঘ্রাণ সংক্রান্তির রাতে ইতুলক্ষ্মীর শেষ পূজা গাঁদা ফুল আর এসকা পিঠা অথবা পুর পিঠা দিয়ে । ভোরবেলায় পুকুরে , দিঘিতে , নদী অথবা যে কোন জলাশয়ে ভাসান । পুরুলিয়ায় এর নাম "ছটমকর" । ইতু ভাসানে জলাশয়ে যে সকল শস্য গাছ , ফুল , পত্র পল্লব ভাসিয়ে দেওয়া হয় জল থেকে সেগুলি কেড়ে এনেই সন্ধ্যাবেলা টুসু পাতা । অর্থাৎ টুসু পূজার সূচনা ‌ । এককথায় ইতু-র যেখানে বিসর্জন , টুসুর সেখানেই আবাহন । ইতু বিসর্জিত হয় আর পুরুলিয়ার কনকনে বাতাসে ভেসে ওঠে চির চেনা সেই সুমিষ্ট সুর --- " আ'সচে মকর দু'দিন সবুর কর . . . "




যৌথতা ভেঙ্গে যায় (ষষ্ঠ কিস্তি)

নির্মল হালদার


জোনাকিরা ছটফট করে। নেমে আসছে আঁধার। যেতে হবে। জলদি যেতে হবে। কী করছে এখন বাবুই পাখিরা?
              জোনাকিরা না গেলে বাবুইয়ের বাসায় কে জ্বালাবে আলো?
              আমাদের প্রকৃতির মধ্যেও যৌথতা আছে। যুথবদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকা। আর বেঁচে থাকার নাম, জীবন। যে জীবন সাদা রাস্তায় কালো রাস্তায় অনন্তকাল বইছে। এই বহমানতা , প্রাণের প্রকাশ।
              নদী একা একা বইছে । এ যেমন সত্য তেমনি নদী শস্যশ্যামল করে যায় তার দুপারের জমি। সেও জানে, সকল প্রাণের আনন্দই আকাশ বাতাস মাটিকেও মধুময় করে। সকল প্রাণের আনন্দই, ভালবাসার দিকে যায়। কারোর কোনো বিচ্ছিন্নতা প্রকৃতি সইতে পারে না। কারণ একটাই, প্রকৃতি সকলের জন্যই উদার। মানুষও হয়ে উঠবে উদার।
            একা একা বাঁচবো না, সবাইকে নিয়ে সবার জন্য বাঁচবো।
            ‌ মেঘ এসেছে। বৃষ্টিও আসবে। আমার জন্য নয়। সবার জন্যেই। সবাইকে ভালো রাখবে বলেই মেঘ-বৃষ্টির আগমন। চাষবাস। ফসল ফলানোর আনন্দ। আমি যে চাইছি, কাঁসাইয়ের দিকে যেতে। সেই পথেই তো আমার বন্ধুর বাড়ি।
              বিশুর সঙ্গে কারণে অকারণে আমার ঝামেলা হয়েছে অনেকবার। পরদিনই ফোন করেছি, চলে আয়। আমি ছেড়ে থাকতে চাই না। সেও আমাকে ছেড়ে থাকেনি।
             একবার সুবুর সঙ্গে রাতভর ঝামেলা। বোতল ভাঙ্গাভাঙ্গি। আমার হাত-পা কেটে গেছিল। সকাল হতেই, তাকে ফোন। আয়রে, টেটব্যাক নিতে হবে। এই আমি কীভাবে আর  ছেড়ে থাকি তাকে ? আমাকে তো ছেড়ে যায়নি আমার আকাশ। বাতাসের বন্ধুত্ব থেকেও আমি বাদ যাইনি। যতদূরেই রাঙা হয়ে উঠুক ফুলফল আমাকে ডাকবেই। আর তুই আমাকে না ডাকলে আমি মনমরা হয়ে উঠি। না--ডাকলে কেন বলছি, ডাকে না। একদম না।
             সম্পর্ক কী খড়ির দাগ? মুছলেই উঠে যাবে?যৌথতা শব্দটি বাদ দিলেও আমি বলতে চাই, জীবন একটাই। এই এক অনেকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমগ্র হয়ে থাকতে চায়। ভালোবাসতে চায় আকাশ ভরা সূর্য তারা।
             রাস্তায় মরে পড়ে থাকা একটি কাকের কাছে ছুটে আসে অজস্র কাক। আমি এখনো জ্যান্ত হয়ে চ্যাং মাছের সঙ্গে খেলা করছি জলে জলে। আমার সঙ্গে খেলা করবে না আমার বন্ধুরা?



দুর্গা দত্তের কবিতা

উড়ো খৈ : বত্রিশ

ব্যূহগাথা
------------


ঘুমিয়ো না সুভদ্রা 
আর একটু চোখ খুলে থাকো 
আর একটু বাকি আছে ব্যূহকথা, শেষভাগ, শোনো--
প্রবেশের খুঁটিনাটি, সজ্জানীতি, ঢালবর্ম, সমর কৌশল
সবকিছু শুনিয়েছি। চক্ররীতি,গুরুমুখী বিদ্যার জগৎ
প্রবেশের সব কিছু , গলি ঘুঁজি , চোরা গোপ্তা পথ
কীভাবে সামলে সুমলে বুক চিতিয়ে পা ফেলতে হয়--
সবকিছু শুনিয়েছি , আর একটু চোখ খুলে থাকো।

ঘুমিয়ো না সুভদ্রা ! 
তোমার চোখের কোলে ঘুমঘুম কালি। 
অবসন্ন বিকেলের রাঙা আলো 
শান্ত সুর গর্ভিনীর মুখে । নিশ্চিন্ত তোমার উষ্ণ শ্বাস--
কী অপূর্ব এ আলোর স্নেহ-স্নিগ্ধ গর্বিত ভূমিকা ! 
আর একটু জেগে থাকো , শোনো ধনি! অপূর্ব-জননী ! 

কীভাবে কেমন করে ভেদ করে যেতে হবে 
শস্ত্রময় পথে ঘাটে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরা
চক্রে চক্রে গাঁথা সব ব্যূহ  --
কীভাবে কেমন করে বিপ্রতীপ চোখে চোখ রেখে  
পুষে রাখতে হবে দীপ্র আগুনের প্রতিটি নিঃশ্বাস--
কীভাবে কেমন করে অনিবার্য নিত্য ব্যূহভেদ , 
ওঠা-পড়া, ছিন্ন-ভিন্ন , ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে ইতিহাস --
ভূমণ্ডলে প্রতি জীব-যাপনের সারাৎসার এই ব্যূহভেদ।
প্রত্যেকেই ঘামে রক্তে নোনাজলে শেখে 
ব্যূহের ভেতরে ব্যূহ ভেদ করবার কৃত্য বিধি--
বাঁচে-মরে-হারে-জেতে স্বপ্ন বোনে পাথর ফাটিয়ে
ব্যূহের ভেতরে আনে অন্ধভেদী আলো ও আকাশ
ক্ষাত্রবুদ্ধি , কৃষিকাজ , ঘাস মাটি জল , বিষামৃত --
গর্ভ থেকে কেউ শিখে আসেনা এসব --

শুনছো ! সুভদ্রা ধনি ! 
গর্ভে শুধু অন্ধকার, আলোহীন জল --
গর্ভে কোনো পাঠশালা নেই ...

অতুল গর্ভিনী তুমি , 
নিশ্চিন্তে ঘুমোও এইবার।

তোমার সুস্মিত মুখে খেলা করছে 
বিকেলের আলো...



শ্রাবনী পূর্ণিমার চাঁদ

তন্ময় সরকার


একটা মানুষ এক জীবনে কতবার
শ্রাবনী পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে পায় !

ভাবতে ভাবতে বাস থেমে যায় ।
চেন টেনে এক পাগল থামিয়ে দেয় ট্রেন ।
স্টিমারের তেল শেষ হয়ে গিয়ে সে 
স্থির হয়ে যায় মাঝনদীতে ।
আর দামী গাড়ি থেকে নেমে তুমি উপরে তাকাও ।

সবাই তোমরা চাঁদের খোঁজে আকাশের দিকে চাও !

যারা শ্রাবনী পূর্ণিমার চাঁদ দেখেনি কখনও
তাদের সবাই বোধহয় বোঝে না ।

প্রতিটা মানুষের মাথার উপরে একটা করে
ব্যক্তিগত মেঘ থাকে ।

একখণ্ড মেঘ 
দেড় ফুট বাই আড়াই ফুট ।

তোমাদের আপন চন্দ্রাবরন ।



উজ্জ্বল রায়ের কবিতা

অন্যপথ

১.
এ পথের প্রান্তে যমুণা ও কংসাবতী একাকার হয়েছে।বিস্তীর্ণ পাশে তীর্থ অভিমুখী বাউল যাত্রা। 
বাউলের কণ্ঠ ধরে মারাং বুরু ব্রজের হরি হয়ে উঠেছেন ক্রমশঃ। কেবল যমুনা গর্ভ জানে নির্জলা কাসাইয়ের মৌরলা জলের গভীরে কখন চতুর্ভূজ মৎস রূপ হয়েছেন। এ পথের প্রান্তে সে লিপির আখর ক্রমশঃ গােপন হয়েছে একদিন। তারই খোঁজে বৈরাগীর পায়ে পায়ে ধূলায় ঢেকেছে গােধূলি আকাশ।

২.
অনন্ত আকাশ আর তার নীচে অহর্নিশি নামগান।
প্রেমাতুর শ্রমণের অশ্রুভার গভীরতর হয়। মুহূর্তে
নৃত্যরত করতাল গােপিনী সঙ্গ করে যমুনার ঘাটে।
ছাে-এর ধামসা থেকে ব্রজের শ্রীখােলে মানব চরিত
থেকে হরি কীর্তনের বােল। এই পথ ধরে চলে যেতে
গিয়ে ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে আসে কংসাবতীর কুল।



বিপুল চক্রবর্তীর কবিতা

১.
পুরনো তোমাকে


হেমন্তের হলুদ বিকেলে
মনে অতি-মারীর ধকল

পাঠিয়েছ সবুজ আঁজির
সত্যি নয়, ছবি সে, নকল।

তবু তার কী আকুল ডাক
ভেসে যায় আমার সকল।

মনে পড়ে পুরনাে সে দিন
হারিয়ে, হারায় না সে সুখ

মনে পড়ে কত পথ-হাঁটা
কত স্বপ্ন--- কত ভুলচুক

মনে পড়ে পুরনাে তােমাকে
সবুজ পাতার মতাে মুখ...


২.
আগুন

শরীরের ডালপালায়
আগুন জ্বালিয়ে
ডেকেছিল 
সে

চারদিকে রাত্রি, শীত --
আগুন পোহাবে ?
ডেকেছিল
সে

তার কাছে যাওয়া হয়নি
সে পুড়েছে একা একা
আমিও একাই
পুড়েছি


৩.
হালফিলের রোজনামচা


সকাল আসে, সকাল বাজে বেদনাঘন সুরে 
পেরিয়ে সাঁকো কেউ-না-কেউ নীলাম্বরপুরে 

চ'লে যাচ্ছেন 

কখনও তিনি বন্ধুর মা, কখনও তিনি কবি 
কখনও তিনি সংসারী, বা, কখনও ভেরবী 

চ'লে যাচ্ছেন 

হয়তো তাঁর যাওয়ার কথা, বয়স হয়েছিল 
হয়তো তাঁর বাঁচার কথা, মড়ক টেনে নিল

চ'লে যাচ্ছেন 

মৃত্যু যেন কাছেই খুব ডাকতে থাকা কুবো 
ভীত সবাই, নিদ্রাহীন : "সকাল হোক শুভ" 

ব'লে যাচ্ছেন 
ব'লে যাচ্ছেন 
বলে যাচ্ছেন... 



গুপ্ত আন্দোলন

অমিত সাহা

কৌশলের কাছে গিয়ে দেখি 
একটি পায়রাও নেই! 
বিস্ময় বাঁচানো গুহা, 
শেয়ালের নীল রঙে আকাশ পাগল...

প্রতিটি পাথর যেন গুপ্ত আন্দোলন! 

শেয়াল আয়নায় মুখ দেখতে গিয়ে টের পায় 
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সর্বনাশের ভ্রুকুটি

কয়েকটি পাথরকথা...
সিদ্ধান্তে বিস্ময় থাকা ভালো 
সব ভুল, ভুল নয় 
সব ঠিক, ঠিক নয়... 

সব ভুল, ঠিক হয় 
সব ঠিক, ভুল হয়... 

অলক্ষ্যে আলেখ্য এঁকে 
ফিরে গেল মেঘাতুর সৌদামিনী...



পাপিয়া ঘােষালের কবিতা

হেমন্তিকায়


এদিকের পশ্চিমি শীত
ইদানিং আলাে গিলে নিচ্ছে

ও দিকে মােরগের ডাক
জেগে আছে হেমন্তিকায়
আমাদেরই সাবলীল পুরুলিয়ায়

দুদিকেই অক্লান্ত করােনা
দুপ্রান্তেই জল্পনা যন্ত্রনা

মৃত্যু মাড়িয়ে
মৃত্যু পুড়িয়ে
মৃত্যু আঁচড়িয়ে
ধান জন্মায়
শিশির কাঁদে আজও
ভােরের অপেক্ষায়



শহরতলির নিশীথ শোভা

সায়ন্তন ধর             
          
রাত এগারোটায় রাতের খাবার খেয়ে উঠে বিছানা করে শোওয়ার উদ্যোগ করতে গিয়ে দেখলাম, ঘুম আসছে না। ভাবলাম ছাদে একটু পায়চারি করে আসি। যেই ভাবা সেই কাজ, ছাদে এলাম। অনতিদূরে শতাব্দীপ্রাচীন বটগাছটা দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। কিয়ৎকাল তাকিয়ে থেকে একটা অন্যরকম অনুভূতি মনটাকে নাড়া দিয়ে গেলো। আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। বৈশাখ পড়তে না পড়তেই নিম্নচাপে তাপমাত্রা একধাপে প্রায় সাত ডিগ্রী কমে গেছে। সকালে বেশ ঠান্ডাই ছিলো। ছিটেফোঁটা বৃষ্টিও হয়েছে। তারপর গোধূলিলগ্নে আকাশকে মেটে সিঁদূর রঙে রাঙিয়ে দিয়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। ঠান্ডাটা আরো বেড়ে গেলো। বৃষ্টির সাথে শিল পড়াটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালেও আজ কিন্তু শিল পড়েনি। বৃষ্টি ধরে যাবার পর একটানা ব্যাঙেদের ঐকতানের সাথে মিলেছে ঝিঁঝিঁদের অবিশ্রান্ত কনসার্ট। সাকসেশানে মজে যাওয়া দীঘিতে জোনাকিদের দীপাবলী। বটগাছ নিয়ন আলোতে দৃশ্যমান। সেই আলোয় পাগল হয়ে, আর বুঝি বা সদ্য বৃষ্টি শেষে মাটির সোঁদা গন্ধে মাতাল হয়ে কিছু ফড়িং ও পতঙ্গ আলো ঘিরে নৃত্যরত। নিয়নের আলোয় জেগে আছে দু'চারটে বুলবুল,ফিঙেও। ইলেকট্রিকের তারে বসে পতঙ্গ শিকারের সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় আছে তারা। জলজ বাতাসে ভেসে আসছে জুঁইফুলের সুবাস। একটু শীত শীত করছিলো, সেটা উপেক্ষা করে আমার শহরের নিশীথ শোভা আজ উপভোগ করবো ঠিক করলাম। কিছুদিন আগেও এই সময়ে অনেক বাড়ীতেই আলো জ্বলতো। পি.এইচ.ই - র কলের পাড়ে চার পাঁচজন মিলে আড্ডা দিত। খেলা প্রসঙ্গে বেশী আলোচনায় মেতে থাকতো, গলিতেই স্বল্প পরিসরে ব্যাটমিন্টন, ক্রিকেট খেলতো। কিন্তু এখন খেলা বন্ধ। তবে এখনো নিয়মিত আড্ডা দিলেও তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যায়। সন্ধ্যার পর পরই ফাঁকা পড়ে থাকে আড্ডাস্থল। বাড়িগুলিও বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে ডুবে যায়। স্ট্রীটলাইট ও নিয়ন আলোয় দীর্ঘ গলিপথ খাঁ খাঁ করে। আকাশে এখনো মেঘ আছে।
শহরের উচ্চ বাতিস্তম্ভের রোশনাই মেঘে প্রতিফলিত হয়ে গাঢ় নীল আভা ছড়িয়ে পড়েছে আকাশ জুড়ে। পাশের আপনজালা আইপোমিয়া,সন্ধ্যামালতী,ও অক্সালিসের জঙ্গলে একটু সরসর খসখস শব্দ হলো। হয় তো সাপ বেজীতে যুদ্ধ চলছে। দূরে পাহাড়পুরের আসাম রোড দিয়ে ছুটে যাওয়া পণ্যবাহী ট্রাকগুলির একটানা শব্দ ভেসে আসছে। এই শব্দটা বেশ লাগে আমার। কল্পনায় মনে হয় যেন সেই শব্দকে অনুসরণ করে পাঞ্জাব বা নাগাল্যান্ড চলে যাই। বেশ কিছুক্ষণ পরপর শোনা যাচ্ছে ট্রেনের হুইসল্। এখন সব ট্রেনই পণ্যবাহী। তারা আর কোন স্টেশনে দাঁড়ায় না। দূর থেকে দূরান্তে পৌঁছে দেবে প্রয়োজনীয় রসদ। ভিজে গলিপথ নিয়ন আলোয় চিকচিক করছে। দু'পাশে অট্টালিকার সারি কেমন যেন চুপ করে আছে। প্রতিটি দেওয়ালে যেন অনেক দুঃখ জমে আছে। ডোরাক,রেশমী কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে সামনের চাতালটায়। ডাহুক থেকে থেকে ডেকে উঠছে। দীঘির আশেপাশে কোন এক নাম না জানা রাতচরা পাখি কিছুক্ষণ পরপর ডেকে যাচ্ছে, ঠিক যেন মনে হচ্ছে কেউ যেন উলুধ্বনি দিচ্ছে। দূরে সেগুনগাছটায় কুব্ কুব্ শব্দে ডেকে উঠলো প্যাঁচা। থেকে থেকে পাখিদের ডানা ঝটপটানির শব্দ। আকাশে এখন দামিনীর খেলা। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঝলসে উঠছে থেকে থেকে। গমগম শব্দে ডাকছে মেঘ। হাওয়ার জোর বাড়ছে ক্রমাগত। ঝড় এলো বলে ! টিনের চালে দু'এক ফোঁটা বৃষ্টিকণা যেন জলতরঙ্গে সুর তোলার মতো টুংটাং শব্দ তুলছে। ঠান্ডা লেগে যাবার ভয়ে নীচে নামবো ভাবছি, এমন সময় চারদিক যেন ঝলসে উঠলো, পরক্ষণেই প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়লো কাছেই কোথাও। কিছু পাখি ডানা মেলে উড়লো, আবার ফিরে আসলো নীড়ে। শুনতে পেলাম একটা পাখি একটানা শিষ দিচ্ছে। ভাবলাম দোয়েল হবে। কিন্তু ইলেকট্রিক তারের দিকে চোখ পড়তেই দেখি, একটা ফিঙে। ফিঙে যে শিষ দেয় জানতাম না। হয় তো সে তার সঙ্গীকে ডাকছে, ক্যালেন্ডারে বসন্ত শেষ, তবু কোকিলরা রয়ে গেছে। অবিরাম "পিউ কাহা" "পিউ কাহা" - বলে ডেকে চলেছে। হাওয়া মেঘ উড়িয়ে নিয়ে গেলো, গর্জন হলেও বর্ষণ আর হলো না। দূরে বটগাছ পেরিয়ে রাজবাড়ির মনসা মন্দিরের আলো চোখে পড়ছে, দেখা যাচ্ছে সিংহদুয়ারের চূড়া।স্টেডিয়ামের আলোয় দক্ষিণের আকাশ সাদা হয়ে আছে। পূবের আকাশ যেন একটু হাল্কা গোলাপী রঙ ধরেছে।এই মায়াময় রাত কেটে গেলে আবার একটা নতুন দিন আসবে। মেঘ কেটে গিয়ে দু'একটা তারা যেন ঘুম ঘুম চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। পরক্ষণেই দেখি তারা যেন জারুলের তামাটে পাতায় জমাট নিটোল বৃষ্টিকণা হয়ে হাসছে। ঘুম পাচ্ছে, ঘুম ঘুম চোখে অনেক ভালোলাগা নিয়ে নেমে এলাম, স্বপ্নে আরো কিছু দেখতে হবে যে। ভোর হতে আর বেশী বাকি নেই। ঘড়িতে তখন তিনটে। শুনেছি ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। স্বপ্ন দেখছি, আসাম রোড দিয়ে পর পর ছুটে চলেছে দূর পাল্লার নাইট বাস, ওভারটেক করছে পণ্যবাহী ট্রাকগুলিকে। আলো ঝলমলে সুসজ্জিত রোড স্টেশনে প্যাসেঞ্জার ট্রেন হল্ট করছে দু'মিনিটের জন্য। দূরে কোন বাড়ি থেকে ভেসে আসছে কোন পরীক্ষার্থীর পড়ার আওয়াজ। নতুন সূর্যোদয়ে কেটে যাচ্ছে দীর্ঘ কোন বিষণ্ণতা।



           ছবি : সায়ন্তন ধর



মায়া

তনুশ্রী চন্দ্র 

গনগনে উনুনের পাশে রাশি রাশি পোড়া কাঠ ।গোবিন্দ-ভোগ চালটা মাটির হাঁড়িতে  ছেড়ে দিয়ে  হাতা দিয়ে সমানে নাড়তে থাকে  মায়া। ওর হাতের লাল কাঁচের চুড়ির ঠুনঠান শব্দ ভেঙে চুরমার করছে চারিদিকের নিস্তব্ধতা । এক মিষ্টি  গন্ধে  ভরে গেছে চতুর্দিক। সদ্যস্নাতার চুল বেয়ে তখনও টুপটাপ  ঝরে পড়ছে জল  । মাথা নিচু করে এক মনে রেঁধে চলেছে ঠাকুরের ভোগ । কোমরে জড়ানো আঁচলে বাঁধা চাবির গোছাটা পিঠে ধুপ করে ফেলে মায়া  বলে উঠলো ----  দোলাতে শুয়ে বিশ্রাম করে  নাও, কতদূর থেকে এসেছো।  ক্লান্ত লাগছে নিশ্চয়।
            কি জানি, কেন মন সায় দিল না । মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন তোলপাড় করে যাচ্ছে। আলগা সিঁথিতে  লাল টুকটুকে  সিঁদুরের রেখা  বারবার নজর কাড়ছে।  উজ্জ্বল  মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘোর লেগে গেছিল ।  মনে মনে বললাম পায়েসের   মিষ্টি গন্ধ ছাপিয়ে তোমার চারিদিকে আর একটা গন্ধ ঘিরে  রেখেছে মায়া, যেমন ফুলের গন্ধের আকর্ষণে মৌমাছি ছুটে আসে ঠিক তেমনই যেন আমাকে বিবশ করেছে তোমাকে ঘিরে রাখা মোহিনী রূপের গন্ধ। দু' বছর আগেও  যাকে খুঁজে পায়নি মনের আনাচে কানাচে, আজ কোথা থেকে এমন মায়া নামক হৃৎস্পন্দনের উদয় হলো। নীরবে এসে বুকের মাঝে করাঘাত করে বলছে অনেক কিছু পাওয়ার বাকি রয়ে  গেছে এখনও । 
             অনিচ্ছা সত্বেও দোলায় শুয়ে চোখ বন্ধ করি। ঘুমের নাম নেই । দু'বছর পর পৈতৃক ভিটের  টানে গ্রামে ফেরা । রাধামাধব মন্দিরের পাশে  হঠাৎ মায়ার সাথে দেখা । চোখের সামনে  মায়ার মুখটা বারবার ভেসে উঠছে ।  দু'পাশে  বিনুনি করা  ফ্রক পরা মেয়েটি কবে যৌবনে পা দিয়েছিল বুঝিনি। নাকে নোলক দুলিয়ে বলতো--- বিশুদা   এবার পুজোয়  কিন্তু  আমাদের বাড়ি ভোগ খেতে আসতে হবে । তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছি ---- যা! তোরা খাওয়াবি তো সেই ছ্যাঁচরা , আলুর দম ।  আমি বরং   রায় বাবুদের পুজোর পোলাও খেয়ে আসব। 
            ফ্রক পরা মেয়েটি বিমর্ষ  না হয়ে বলে ---- কি যে বলো বিশুদা, ওই ছ্যাঁচরার  স্বাদের কাছে মণ্ডা  মিঠাই ফিকে পড়ে যায়, তা জানো?  
 ---- যা যা তুই বরং খাস, আমি যাব না। 
            মায়ায় চোখের কোণায় জল দেখেও না দেখার ভান করেছি কতবার। 
            কখন চোখ লেগে গেছিল। আচমকা ডাকে চমকে উঠি--- বলি ঘুমোলে নাকি?  
             বুকের মধ্যে ধড়াম করে ধাক্কা খেল যেন। মায়া, হাতে কাঁসার  থালায় সদ্য বানানো লুচি, আলুর দম  থেকে ধোঁয়া উঠছে তখনও। তখনও ঘোর কাটেনি আমার। চোখ বন্ধ করেই হেসে বললাম---- না না একটু স্বপ্ন দেখছিলাম আর কি!
             থালাটা পাশের উঁচু বেদিতে রেখে  মায়া  বলল ----- ও  জেগে স্বপ্ন দেখার অভ্যাস এখনও যায়নি  তাহলে ? 
             চমকে উঠে বসলাম ----- তোমার মনে আছে মায়া?
              মায়া আক্ষেপের সুরে বলল ----- তা থাকবে না, সে ছেলেমানুষি কি ভোলা যায় ?  
----- ছেলেমানুষি বলছো কেন মায়া? আমার স্বপ্নই কিন্তু আজ  আমায় উন্নতির শীর্ষে  পৌঁছতে  সাহায্য করেছে।
              উঠোনে দড়িতে মেলা কাপড় তুলতে তুলতে মায়া  বলল ----- তাই ?  তাহলে তোমার  সব স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বলো ?  
              লম্বা শ্বাস নিয়ে এক ঝটকায় উঠোনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে  তৃপ্তির সুরে  বলে উঠলাম---- হ্যাঁ তা হয়েছে। কে না চায় বলো এমন  আরামের জীবন?
                বারান্দায় দড়িতে কাপড় গুছিয়ে রাখতে রাখতে  অস্ফূট স্বরে  বলল মায়া -----তাহলে তখন  অমন  হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে কি এতো দেখছিলে ?  আর বিভোর হয়ে এখনই বা কি এমন ভাবছো ? 
              বুঝতে পারলাম  মায়ার চোখ  কিছুই এড়ায়নি । আজ  আর নিজেকে লুকিয়ে লাভ নেই। তাই নির্লজ্জের মতো বলে ফেললাম---- তাহলে এটাও বুঝেছো  নিশ্চয়, কেন দৃষ্টির পরিবর্তন ?  
            মায়া এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে  উচ্চস্বরে হেসে  উঠল ----- তাই ?  মন পড়তে পারো বুঝি ?  
               তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল----- সেই বিশুদাকে কবেই হারিয়ে ফেলেছি । 
                মায়ার চোখে চোখ রেখে বললাম ----- কেন?  খুব কি  পরিবর্তন দেখছ ?  
               ঠিক সেই সময়  ধুতি  পাঞ্জাবি পরা এক অপরিচিত পুরুষ এসে মায়ার পাশে দাঁড়ালো । কপালে তিলক গলায় তুলসির মালা। মায়াকে  কোমল স্বরে বলে উঠলো----  অতিথির সেবা করে এসো।  কীর্ত্তনের সময় হয়েছে। 
                 মায়া ঘাড় নেড়ে সায় দিল। আমার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন----  মহাশয় কিছু লাগলে বলবেন। আজ রাতটা এখানেই থেকে গেলে আমরা খুশি হবো। 
                 উনি চলে যেতেই  মায়া দালানে টাঙানো খঞ্জনিটা পেড়ে নিল ।  গলায় নামাবলীর  চাদরটা  পরিপাটি করে জড়িয়ে নিল। এতক্ষণ দেখিনি মায়ার গলায় একই রকম তুলসির মালা। ধীর পায়ে  এগোতে  গিয়ে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে কিছু ভাবল তারপর পিছন ফিরে বলল ----- বিশুদা, আজ আরও  পরিণত হয়েছে মায়া । স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাক করতে জানে।  সে আর পিছন ফিরে তাকায় না ।
            যেমন এসেছিল তেমনই  চলে গেল । ওর কথাগুলো  যেন  চারিদিকে  বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে  ধাক্কা খেতে লাগলো বুকে। মনে পড়ে গেল দু'বছর আগে এই মায়া পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলেছিল---- বিশুদা, যাবার আগে আর একবার ভালো করে ভেবে দেখো।  তুমি কিন্তু সব ছেড়ে যাচ্ছ। 
               নির্লিপ্তের মতো  সেদিন বলেছিলাম ---- ভুল করছো মায়া,  ছেড়ে কিছু যাচ্ছি না। বরং নিয়ে যাচ্ছি,  আমার স্বপ্নের সাফল্য ।
              না! পিছন ফিরে তাকাবার মতো মানসিকতা  সেদিন  আমার ছিল না । চোখে নতুন স্বপ্ন। একদিন নিজের  আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নকে পূরণ  করতে  ওর ভালবাসাকে  তাচ্ছিল্য করে অবহেলায় পায়ে মাড়িয়ে  চলে গেছিলাম বিলেতে। এক মুহুর্তও না ভেবে সুটকেসটা হাতে নিয়ে হনহন করে স্টেশনের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম।  
               পৈতৃক ভিটেয় যাবার ইচ্ছেটা  কোথায় যেন পদপৃষ্ট হলো। ওর কথাটা বুকে গিয়ে বিঁধে আমায় নতুন করে শিক্ষা দিয়ে বলে গেল যে, চাইলেই সব কিছু হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় না। হয়তো আজ আমি এরই যোগ্য ।


                                আমাদের বই




সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ- ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল- uttamklp@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪