প্রথম বর্ষ ।। চতুর্দশ ওয়েব সংস্করণ ।। ২ ফাল্গুন ১৪২৭


জীবনের আরেকটা বসন্তে পা রাখলাম আমরা। পা রাখলাম আরেকটা পুষ্প শোভিত পৃথিবীর দিকে।সমস্ত দুঃখ ভুলে আরেকটা আনন্দঘন মুহূর্তের দিকে পা বাড়ালাম অনায়াসে।
            প্রকৃতির এই নিদারুণ টান থেকে পিছু ছাড়াতে পারে না কোনো গতি। সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলি ফুটে ওঠা ফুলের দিকে, দোলের রঙে রাঙা কারো কারো দুলের দিকে, কোনো কোনো ভুলের দিকে। যে ভুল না করলে স্বার্থক হয় না জীবন।
             প্রকৃতির অপরূপ পরিদৃশ্যকে জীবনের অঙ্গ করে নিলে হালকা হয় মন। সমস্ত চাপ থেকে মুক্ত হয়ে সম্ভব হয় ডানা মেলা। সম্ভব হয় এক আকাশ থেকে আরেক আকাশের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সম্ভব হয় বদ্ধ মনকে মুক্ত করা। যার জন্য অপেক্ষা করি আমরা।
               তাই, বসন্ত শুধুমাত্র ফুল আনে না, আনে আমাদের মুক্তি। আমাদের আনন্দ। সেই কারণেই প্রতিটা বসন্তের দিকে চেয়ে থাকি আমরা। 


উত্তম মাহাত, সম্পাদক
_________________________________



নাচনি : উপেক্ষিতা, শিল্পে ও সমাজে

                    তপন পাত্র
______________________________________________


        লোকমুখে একটি শব্দবন্ধ উচ্চারিত হ'তে শোনা যায় মাঝে মাঝেই । শব্দবন্ধটি হল --"শব্দব্রহ্ম" অর্থাৎ শব্দরূপ বা শব্দাত্মক ব্রহ্ম । এই শব্দ এক বিচারে নাদ্ বা ধ্বনি আর একদিক থেকে ইংরেজিতে যাকে বলে "Word" , সেই অর্থবোধক ধ্বনির শক্তি ; অভিধা, লক্ষণা, ব্যঞ্জনা প্রভৃতি শব্দের অর্থবোধিকা বৃত্তি। উভয়ার্থেই শব্দ ব্রহ্মস্বরূপ । কথাটি ধ্রুব । 
           কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "পুনশ্চ" কাব্যগ্রন্থের 'ছেলেটা' কবিতার নাম-না-জানা ছেলেটার কথা একবার স্মরণ করুন । সে নাম-গোত্র-পরিচয়হীন, সে দুষ্টু , পাজি, বদমা'শ, তার বেড়ে ওঠা একটি আগাছার মতো; নিজের বলতে কেউ নেই তার, পরের ঘরে মানুষ, সে উপেক্ষা ও অবহেলার পাত্র, তার বাহ্যিক দস্যিপনার কারণে প্রতিবেশীদের তার প্রতি একটা "দূর- দূর- করা" ভাব ---এইসব এবং আরো কিছু অধিক দুর্ভাগ্যজনক বৈশিষ্ট্য বুঝিয়ে দেবার জন্য কবি "ছেলে" শব্দটির পাশে "টা" নির্দিষ্ট সূচক প্রত্যয়টি বসিয়ে দিলেন । "টি" বসিয়ে দিলে মানেটা যেত বদলে । সে হয়ে উঠতো অতি আদরের, স্নেহের ও গর্বের এক কৃতী সন্তান । কিন্তু শব্দের কী অনির্বচনীয় মহিমা !

       তেমনি "নৃত্যশিল্পী"বললে আমাদের মনে যে শ্রদ্ধা মিশ্রিত একটি সংস্কৃত , সুরুচিপূর্ণ ভাবনার জন্ম নেয় "নাচনি" বললে তা সম্পূর্ণ বিপরীতার্থক হয়ে দাঁড়ায় । আর ঝাড়খন্ড-মানভূম-পুরুলিয়ার এক বিশেষ শব্দোচ্চারণ প্রবণতা অনুসারে যদি শব্দের আদি অক্ষর "দন্ত-ন" -কে "ল"উচ্চারণ করা হয় তাহলে তো কথাই নেই, নাচনি হয়ে যায় "লাচনি" ! উপেক্ষা ও অবজ্ঞা টি তখন একেবারে কানায় কানায় , ষোল কলা পূর্ণ হয়ে ওঠে ।
             
           আমাদের সমাজে নারী তো নারী-ই । হাড়-মাংস শিরা-উপশিরা ও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে এক অতুলন হৃদয় নিয়ে গড়া মানবী তো আর গোলাপ নয় যে তাকে যে নামেই ডাকো, সে গোলাপ । পুরুষশাসিত সমাজে নারীর স্বল্প খুঁতকেও বড়ো করে দেখা হয় , পুরুষের বেলায় সমদোষ এড়িয়ে যাওয়া হয় । এই সমাজে অন্ধছেলে পদ্মলোচন হলেও কানা মেয়ে হয়ে যায় "কানি-মাগি" ।

       কিন্তু যুগে যুগে নারীর নিজস্ব চিন্তা-ভাবনায় নিজের ভিতর একটা অহংকার ও আত্মবিশ্বাস এবং জিদ জেগে থাকে । অতি সুপ্রাচীনকাল এবং অর্বাচীনকালেও নারী চরিত্রের অহংকারের একটি বিশেষ দিক একই রকম থেকে গেছে । এই বিশেষ দিকটির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি । আজও যে-কোনো নারী কোনো না কোনো ভাবে বা কলায় নিজেকে প্রকাশ করতে চায় , অন্যের চোখে আকর্ষণীয়া রূপে উপস্থাপন করতে চায় । "নাচনি" অভিধেয় নৃত্যশিল্পীরাও এর ব্যতিক্রম নন বরং পেশাগত কারণেই পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন , তা যেমন দেহ সম্পদের আবেদনে তেমনি কণ্ঠ সম্পদের লালিত্য ঝংকারে, অঙ্গ সঞ্চালন রূপ নৃত্যকলাতেও ।

                   একটি অতিব সাধারণ সজ্জায় সজ্জিত মঞ্চে ঢোল, মাদল , সানাই মন্দিরা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের সুর ও তালের ছন্দে ঝুমুর গানের প্রথম কলিটি ধরে গাইতে থাকে আর গানের অন্তর্নিহিত বক্তব্যটি উপস্থাপনের তাগিদেই কখনো ঘাগরা ধরে, কখনো রুমাল বা ওড়না উড়িয়ে নেচে চলেন নাচনি । সঙ্গীত ও নৃত্য শিল্পের অঙ্গনে এর শিল্পসুষমা, কলাগুণ আদৌ উপেক্ষার পঙ্কিল দৃষ্টিতে দেখার মতো নয় । তবুও বিভিন্ন কারণে নাচনি নামে চিহ্নিত এই নর্তকী সম্প্রদায় ভারতীয় নৃত্য শিল্পের আঙিনায় আজও নন্দিত নয় বরং ব্রাত্য এবং নিন্দিত ।

    এই শিল্পীদের জীবন স্নিগ্ধ-মধুর কি না জানি না, তবে বেদনাবিধুর নিঃসন্দেহে । এঁদের না আছে স্বামী, না সংসার সুখ । আছে শুধু উন্মুক্ত নৃত্যাঙ্গন । আছে শুধু রসিক । সে-ই রক্ষক । নাগর । জীবনে তাঁদের সন্তান কাম্য নয় , তবু কেউ কেউ মা হন সন্তান প্রতিপালন করেন ।

         অন্যান্য শিল্পীর মতো কোন নারীই বালিকাবেলায় বা কৈশোরে নাচনি হবার স্বপ্ন দেখেন না । গতানুগতিকতায় পথভ্রষ্ট নারী ঘটনাচক্রে পৌঁছে যান এই শিল্পের অন্ধকার জটিল অঙ্গনে ।
        
           এই শ্রেণীর অসংখ্য নৃত্য শিল্পীর সাথে কথা বলে জানা যায় বেশ কিছু কারণে এঁরা এই পথে আসতে বাধ্য হয়েছেন । যেমন --- অপরিণত বয়সে প্রেমে উন্মত্ত হয়ে প্রেমিকের হাত ধরে বেরিয়ে অসহায়ভাবে পথভ্রষ্ট মেয়ে ফিরে যান বাপের বাড়িতে । সেখানে আর তাঁর ঠাঁই হয় না । কেউ আবার সমাজের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যক্তির কামনার শিকার হয়ে জাত কুল খোয়াতে বাধ্য হয়ে শেষে এই পথ বেছে নেন । কখনো কখনো লোভী, বোকা, অশিক্ষিত ও অসহায় পিতা-মাতা নবযৌবন সম্পন্না কন্যাকে অল্প টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছেন রসিকের কাছে । তুলনামূলকভাবে কোন উচ্চবর্ণের পুরুষ নিম্নবর্ণের কোন নারীর ইচ্ছায় অথবা প্রলোভন দেখিয়ে বা ফুসলিয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গসুখ লাভ করে এবং সেকথা যখন লোক জানাজানি হয়ে যায়, তখন ওই নিম্নবর্ণের মেয়েটির বাড়ির পুরুষেরা প্রতিবেশীদের ও স্বজাতিদের সহযোগিতা নিয়ে সেই পুরুষটির বাড়ির কোন রমণীর সম্ভ্রম, ইজ্জত নষ্ট করে জোরপূর্বক । তখন সেই অসহায় নারীর আর ঘরে জায়গা হয় না । দুঃখ-যন্ত্রণার স্রোতে ভাসতে ভাসতে এই সর্বহারা রমণী একসময় এই শিল্প পথে চলে আসেন । আবার নাচনিদের মধ্যে যাদের ছেলে মেয়ে জন্ম নেয়, সেই মেয়েরও ভবিষ্যৎ এই নৃত্যশিল্প । তাঁর সাধারণ সামাজিক বিবাহ হয় না । এছাড়া ডাইনি প্রথা, বহু বিবাহ প্রথার সামাজিক স্বীকৃতি, ধনী-জমিদার-ভূমিজদের রক্ষিতা রাখার অসামাজিক সামাজিক রীতিনীতিও এই নৃত্যশিল্পীদের এ পথে আসার এক-একটা বড়ো কারণ ।

            তবে এই নৃত্যশিল্পী ও শিল্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এ অনেক পুরানো দিনের ঘটনা । হয়তো রূপে-রসে, গুণে-মহিমায় কালে কালে ক্রমশই কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটেছে । নাচনিরা যে গানের তালে সুরে নৃত্য পরিবেশন করেন, তার নাম ঝুমুর । এই সকল ঝুমুরের প্রধান উপজীব্য রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা, দেহতত্ত্ব ও সৃষ্টিতত্ত্ব । আমরা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনার বর্ণনায় পাই চৌষট্টি পাপড়ির পদ্মদলমন্ডলে নৃত্য করে চলে ডোমনি । আর পদ গুলি গীত করেন কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ প্রমূখ । 
          
                আবার গীতগোবিন্দের জয়দেব পদ্মাবতীর কথা যদি স্মরণ করি তাহলে জয়দেব রসিক আর পদ্মাবতী হলেন নাচুনি বা নাচনি । কবি জয়দেব, রসিক জয়দেব গান ধরেছেন আর সেই গানের সুর ও তালের ছন্দে ছন্দে নেচে চলেছেন পদ্মাবতী । যদি চন্ডীদাস-রজকিনীর কথা ভাবি তাহলে চন্ডীদাস রসিক আর নাচনি হলেন রজকিনী । রসিক-নাচনিদের আখ্যানের সাথে এই সমস্ত আখ্যানের বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই । কিন্তু যুগে যুগে তথাকথিত সমাজের তথাকথিত সংস্কৃত মানুষের কাছে এরা সকলেই অপাংক্তেয় , একঘরে, জাতিচ্যুত ।

                 একদিক থেকে সাধক-সাধিকার নৃত্য-গীতযুক্ত সাধন পদ্ধতির ক্রমবিবর্তনের ফলে যেমন এই শিল্পের সূচনার ইঙ্গিত মেলে অপরদিকে তেমনি দাসী আট্যমের দেবদাসী প্রথা, রাজদাসী প্রথা এবং বাদশাহী আমলের বাইজিদের অনুকরণেও এই নৃত্য শিল্পচর্চার বিকাশ অসম্ভব কিছু নয় ।

       সময়ের সাথে সাথে নাচনিদের মধ্যে আবার দু'টি শ্রেণীবিভাগও হয়ে যায় । এক ধরণের নাচনি নাচকে বলা হয় বৈঠকি রীতির নাচনি নাচ, যে নাচ মূলত রাজা-রাজড়াদের অথবা জমিদার'দের পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত পালিত হয়েছে । এর নামকরণ হয়ে গেছে খেমটি নাচ বা বাঈনাচ । এক্ষেত্রে ঝুমুর উন্নত পর্যায়ের। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে থাকে হারমোনিয়াম, ডুগি-তবলা, ফুলট ,কর্ণেট ইত্যাদি বাঁশি । আধুনিক কালে কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতিও ব্যবহৃত হচ্ছে । এই বাঈজিরা নৃত্যের সময় সাধারণত শাড়ি পরে থাকে অত্যন্ত রুচিপূর্ণ ভাবে । এঁদের নাচ "সরু তালের" বা "সূক্ষ্ম তালের নাচ" নামেও পরিচিত ।
            আর দ্বিতীয় শ্রেণীর নাচের নাম ধুমড়ি বা খেদা বা মোটা তালের নাচ । এক্ষেত্রে প্রধান বাদ্যযন্ত্র ঢোল ও ধমসা । ঝুমুর হয় তুলনামূলকভাবে একটু স্থূলরুচির , আদিরসাত্মক। এই ধুমড়িদের পরনে থাকে চোস্ত পায়জামা, সায়া , ব্লাউজ , রঙিন ঘাগরা আর কোমরে চটকদার ফেটি । দু'হাতে থাকে দু'টি রুমাল মাথায় ফিতে দিয়ে তৈরি ফুলের মতো করে সাজানো খোঁপা । গলায় ঝলমলে নকল অলংকার। হাতে রঙিন চুড়ি ।
      
            এই দুই শ্রেণীর নাচনি-ই হাতে মুখে উগ্র রং মেখে দেহশ্রীকে যথাসাধ্য আকর্ষণীয় করে সাজিয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জীবনের সৌন্দর্য তাঁদের কতটুকু ? সে খবর কে রাখেন ? কারা রাখেন ? বাংলা কথাসাহিত্যের দিকে নজর দিলে দেখি, নাচনি হিসাবে যাঁদের জীবনালেখ্য রচিত হয়েছে, তাঁরা আবার সেখানে বারবণিতা রূপে চিত্রিত হয়েছেন, দেহোপজীবিনী রূপে বর্ণিত হয়েছেন । এতে হয়তো কুরুচিপূর্ণ পাঠকের মনোরঞ্জন করা গেছে , কিন্তু নাচনিদের প্রকৃত জীবন কথা চিত্রিত হয়নি , সস্তায় বাজিমাত করার স্বার্থে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটে গেছে । কোন কোন পাঠক বলতে পারেন , সাহিত্য সংবাদ নয় , রচিত হয় আপন মনের মাধুরী মিশায়ে , সে ক্ষেত্রে আমি একটা কথাই বলবো, সাহিত্য তো সমাজের দর্পণ, তবে তাকে বিকৃত করার হীন প্রয়াস কেন ? বিশেষ করে এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে ! আবার এই সমাজের এক শ্রেণীর সমাজসেবী , উন্নয়নকামী রাজনীতিকরা সর্বহারাদের উত্তরণের উদ্দেশ্যে গ্রামে-শহরে-নগরে-বন্দরে দেওয়াল লিখন করেছেন, করছেন । তাঁরাও কি জানেন এই বাংলায় প্রকৃত সর্বহারা কারা ? প্রকৃতই সর্বহারা হলেন নাচনি শ্রেণী, এঁদের জন্য কোন দেওয়াল লিখন নেই, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার মতো কোন দেওয়ালও নেই । 

           নাচনিদের স্বামী নেই, রসিক আছে । বিবাহ নেই শাঁখা-সিঁদুর আছে । তারা স্ত্রী নন, রক্ষিতা । তাঁদের মিলন আছে, কিন্তু সন্তান কামনা থাকতে নেই । রসিকের কাছে জীবনযাপন শুরু হবার প্রথমেই হাতুড়ে ডাক্তার কিংবা বৈদ্য , কবিরাজকে দিয়ে শিকড়-বাকড়ের ঔষধ খাইয়ে তাদের বন্ধ্যাকরণের চেষ্টা করা হয় । তবুও সৌভাগ্য নয় দুর্ভাগ্যবশত কেউ কেউ মা হন । এই মায়ের অভিশাপ দ্বিগুণ হয়ে বর্ষিত হয় সন্তান-সন্ততিদের ওপর । ছেলে হলে সমাজে তার ডাকনাম হয় "লাচনির ব্যাটা" আর মেয়ে হলে সে "লাচনির মিঞা"। নাচনির মেয়ের সামাজিক বিবাহ হয় না । তার শরীরে যৌবন আসতে আসতেই সেও চলে যায় , বলা ভাল তাকে চলে যেতে হয় কোনো রসিকের হাত ধরে । আবার রসিকের অত্যাচারে , অযোগ্যতায় তাকে হয়তো একাধিকবার রসিক বদলাতে হয় । আর "লাচনির ব্যাটা"? ... তার দুর্ভাগ্যও কম নয় । তার জন্য সুস্থ সামাজিক জীবন অপেক্ষা করে না । তাকে অবিবাহিত থাকতে হয় অথবা অন্য কোন নাচনির মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেলে তার সাথে বিয়ে হয় । কেউ কেউ বাউল জীবন বেছে নেয় । সে জীবনে কারো কারো সাধন সঙ্গিনীও জুটে যায় । এক কথায় এই পথের সকলেরই জীবন পূর্ণ নিশ্চিত , ভয়ঙ্কর কণ্টকাকীর্ণ ।

           নাচনিদের শিল্পীজীবন আজও উপেক্ষিত । সামাজিক জীবন ততোধিক উপেক্ষিত, বঞ্চিত । অথচ অদ্ভুত জীবনীশক্তি তাঁদের, অসাধারণ তাঁদের প্রেমের গভীরতা । তাঁরা অনেক সময় তাঁদের রসিকের সামাজিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত স্ত্রীর ছেলে-মেয়ের অর্থাৎ সতীনের ছেলে মেয়ের দেখাশোনা করেন, মাতৃস্নেহে তাদের লালন পালন করেন । কোন কোন রসিকর দু' নৌকায় পা দিয়ে হয়ে ওঠে সর্বস্বান্ত , আত্মহত্যার দিকে পা বাড়াতে যায় ; সে সময় শক্ত হাতে সবদিক সামলায় এই নাচনী। এই সংসার-উপেক্ষিতা পালা-পার্বনে নাচের আসর পেলে, নৃত্যের মধ্য দিয়ে হাট উদ্বোধনের ডাক পেলে, কারও বিবাহ বাড়িতে নৃত্য প্রদর্শনের সুযোগ পেলে ছুটে যায় । দুটো পয়সা রোজগার করে । রসিকের সংসারের ও নিজের অর্থাভাবের কারণে অনেক সময় কাঁচা রসের চটুল ঝুমুর গান গেয়ে , এমনকি প্রয়োজনে সমসাময়িক কিছু সস্তা হিন্দি গান গেয়ে ও নেচে অতিরিক্ত ফেরি পাবার বাসনা লালন করে । সাধারণত বর্ষাকালে নাচের আসরের সুযোগ থাকে না । তখন এই শিল্পী শিল্পসত্তা বিসর্জন না দিয়ে ঝুমুর গান গাইতে গাইতে মাঠে মাঠে বীজ বোনে, ধান লাগায়, ধান কাটে , ধান ঝাড়ে দিনমজুর কামিনের কাজ করে । এত যাঁদের ত্যাগ , যাঁদের গান শুনলে, নাচ দেখলে অভিজাত পরিবারের শুধু পুরুষ নয় , বিবাহিত অবিবাহিত যুবতি সহ বৃদ্ধাদের মনোরঞ্জন হয়, এমনকি তারা রাধা-কৃষ্ণ প্রেমে মাতোয়ারা হয়, তাদের কিন্তু নাচনীদের ছুঁলে জাত যায় , নাচনিরা জলছুঁত । 

        এই সমাজে নাচনীদের মতো উপেক্ষিতা মনে হয় দেহোপজীবিনীরাও নয়। নাচনিরা হাটে-বাজারে লুঠ হয়ে যায়, এক রসিক গায়ের জোরে ছাড়িয়ে নেয় অন্য রসিকের নাচনি , নাচনির বাপের বাড়ির লোক তাদের মেয়ের কথা উঠলে বলে " ও নাচনি , ও কে না-চিনি "! এই নাচনির রসিক যদি কোন কারণে মারা যায়, তবে রসিকের পুত্রসম ভাইপোর নজর পড়ে তার কাকা বা খুড়ার রক্ষিতা নারী অর্থাৎ মাতৃসমার প্রতি ; অনেক ক্ষেত্রে সেই ভাইপোই হয়ে যায় তখন তার রসিক । সাধারণ দু'চার পয়সার সস্তা দর্শক-শ্রোতাও নাচনির নাচ দেখে , গান শুনে ঢোক গিলতে থাকে , মদমত্ত হয়ে ফেরি গাঁথার অছিলায় শরীর ছোঁয়ার বাসনা লালন করে , কেউ কেউ আবার নিষ্ঠুর চিত্তে সেফটিপিন দিয়ে টাকা গাঁথতে গিয়ে চামড়ায় সেফটিপিন ফুটিয়ে দেয় । সে এক অদ্ভুত পাশবিক উল্লাস ! আর সবচেয়ে করুণ অবস্থা নাচনির শেষ বয়স ! যে নৃত্যশিল্পী একদিন নাচের আসরে নোটের পর নোট উপহার, উপঢৌকন পেয়েছেন, ফুলের মালা তাঁর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে সম্ভ্রান্ত পুরুষ , কেউ বা প্রীতি ভরে পরিয়ে দিয়েছে সুরঝংকারমুখরিত কন্ঠে নকল সোনার মালা শেষ জীবনে তাঁকেই ভিক্ষা করে ফিরতে হচ্ছে দুয়ারে দুয়ারে অ্যালুমিনিয়ামের সাতত্যাপড়া বাটি হাতে নিয়ে । আর অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা হয় না । মৃত্যু হলে তার জন্য কোন শ্মশান থাকে না । শ্মশানে বয়ে নিয়ে যাবার জন্য চারজন মানুষ ও একটি সাধারণ বাবুই দড়ির খাটিয়া থাকেনা । তাঁর পায়ে খড়ের দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে কোন ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসা হয় । হায় সভ্যতা ! আমরা ইচ্ছে করে নাচি, মেয়েদের নাচাই , আমাদের আপন কোন মেয়ে প্রখ্যাত অভিনেত্রী বা নর্তকী হয়ে ওঠার জন্য যতো কম পোশাকই পরুক বা পোশাকের বালাই নাই-ই রাখুক তাতে আমরা লজ্জা পাই না, আমাদের কৌলিন্য নষ্ট হয় না , কিন্তু যাঁরা রুচিপূর্ণ পোশাক পরে হাজার হাজার মানুষকে দিয়ে যায় পবিত্র আনন্দ , শুনেছি নাকি আনন্দই ব্রহ্ম, তাহলে এই আনন্দদায়িনীদের জীবন এতো নিরানন্দঘন কেন ? কে দেবে তার উত্তর ? সমাজ-সংসার-সরকার-ইতিহাস নিরুত্তর ! অথচ এই শিল্পীদের শিল্পচর্চার মূলাধার ঝুমুর গাওয়া কি সহজ ? আজ থেকে বাইশ বছর আগে প্রশ্ন করেছিলাম আমার মাতৃসমা সিন্ধুবালা দেবীকে । তিনি তৎক্ষণাৎ আমার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে তাঁর জাদুকন্ঠে গেয়ে উঠেছিলেন রাইরাজেনের লেখা একটি ঝুমুর গানের প্রথম কলি ---

 "সুর স্বর তাল মান লয় ভাব রসজ্ঞান
        রাগ রাগিনী আছে ভারী।
গলার স্বর চাই মিষ্টি চাই ভাব-ভঙ্গি দৃষ্টি
           সম মাত্রা চাই বরাবরই
           ঝুমুর গাওয়া বড়ি ঝকমারি..."





টুং টাং

নির্মল হালদার


সজনে ফুল এসেছে। শাদা শাদা শান্তির মতো। কোমল।

কোমলতা বাজার থেকে ক্রয় করতে হয়। সজনে ফুল ১৫ টাকায় একশো। ক্রয় করতে হয়। সজনে ফুলের কোমলতা ক্রয় করতে হয়।

সব কিছুই কিনতে কিনতে আমাদের মন সয়ে গেছে। হয়তো দেখা যাবে আমরা ক্রয় করছি কারোর সময়। কেউ আমাকে সময় দিয়ে টাকা চাইছে। কেন না,
তার সময়ের মূল্য আছে।

আমার তো সঙ্গী-সাথী চাই। কে এসে আমাকে সঙ্গ দেবে? সুধা দেবে? আমাকে কিনতেই হবে, অন্য কারোর সময়। এখানে দর করা চলবে না। যা চাইবে দিতে হবে।

আমার রুচি মত পছন্দসই পাবো না, যা সামনে আসছে তাই আমাকে কিনে নিতে হবে। অবশ্যই তাকে কেনার মত আমার ক্ষমতা নেই। শুধুমাত্র তার সময়কে কিনতে চাই।

সময় কিনতে পারো কিন্তু পছন্দ করার সুযোগ থাকছে না। আমাকে দোকানদার ধরিয়ে দিয়েছে একটি মুদ্রিত কাগজ। যে কাগজে নাম ও ফোন নাম্বার আছে। কোনো ছবি নেই। আমাকে তাই যেকোনো একটি নাম্বারে ফোন করে ডাকতে হবে আমার সময়কে।
এখানে বলা ভালো, আমি সময় কিনছি। কোনো মানুষের রূপ রস গন্ধ কিনছি না। ফোন করতেই, যে এসে সামনে দাঁড়াবে কাটাতে হবে তার সঙ্গে সময়।

যদি দেখা যায় সে বৃদ্ধ , কথা বলতে হবে। বাতিল করা যাবে না। যদি দেখা যায় একজন আমার কাছে এসেই শুরু করলো , একটি তর্কের বিষয়। আমি কী তাকে এড়িয়ে যেতে পারবো? যদি বলি, একটা গাছের কথা বলুন, যে গাছটি বসন্তের কথা বলবে। যে গাছটি তারুণ্যের কথা বলবে। যে গাছটি প্রেমের কথা বলবে।তিনি শুনবেন না নিশ্চয়ই। ফলে, আমার মানসিকতার সঙ্গে বেশিরভাগ সময় মিলছে না। কথা বললে, কোনো ছন্দ নেই। বরং হোঁচট খেতে খেতে রক্তপাত।কেউ দেখতে পাবে না।

আমার গোপন যন্ত্রণা আমাকে লুকিয়ে রাখতে হবে। আমাকে ফোন করতে হবে যেকোনো একটা নাম্বারে-------আমার পছন্দ বলে কিছু থাকছে না। আমাকে সইতে হবে ঘোর দুঃসময়। সময় কিনতে গিয়ে দুঃসময়। সময় কেনার টাকা জলে যাবে।
অথবা ছাই হয়ে উড়তে উড়তে আমার সঙ্গে রসিকতা করবে। অথবা বলা যায়, টাকা দিয়ে সময় কিনে আরো বেশি একা হয়ে গেলাম। আমার সামনে যিনি বসে আছেন তিনি অবশ্যই একজন মানুষ। তাকে আমি জিজ্ঞেস করতে পারি কী, আপনার কী নিঃসঙ্গ বোধ আছে?

একেক সময় মনে হয়, নিঃসঙ্গতা কারোর কারোর জীবনে বিফলতা বৈকি। ব্যর্থতা বৈকি।

ব্যর্থতা কিংবা বিফলতা যাই হোক, সজনে ফুলের কোমলতা বাজার থেকে কিনে আত্মপ্রসাদ
পেয়েছি অবশ্যই। কিন্তু কেন কিনবো?

গাছ থেকে ফুল পেড়ে গাছকে একলা করার অর্থ, গাছের অভিশাপ আমাকে পেতেই হবে। গাছ তার নিজের জায়গা থেকে ফুল-ফলের সৌরভ ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকুক। এক জীবন। যে জীবনের নাগাল পেতে আমার চাই অনেকগুলো জীবন।



গানের বেলায়

সন্দীপ মুখোপাধ্যায়


সন্ধে, পুরনো দোতলা বাড়ির একতলার ঘর, হারমোনিয়ামের সুর, মা-র মধুর গলা। অনিল জ্যাঠার সঙ্গে মা গলা মেলাচ্ছে। পাশে বাবা তবলা নিয়ে। আমার খুব ছোটবেলা এ-ভাবেই গান শুনতে শুনতে কিশোর বেলাকে স্পর্শ করলো। মা-র গানের চর্চা কমে এল। ইস্কুলে যেতে হয়। মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম টেনে, আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে কিংবা ফাগুনের নবীন আনন্দে। ইস্কুলে বসন্ত -উৎসব। আমিও একটু আধটু হারমোনিয়ামে কেদারা আর পিলু। ততদিনে বাড়িতে বিদ্রোহ বাধিয়ে ছোটমামা নিয়মিত গান শিখতে শুরু করলো। মা-কে বলতো, জানিস চিণ্ময় লাহিড়ীর কাছে যাই। কী তান! সেখানে কি হল শুনলাম এবার গুরু বদলেছে। বীরেশ রায়। আমাদের গ্রামের আর এক গান-পাগল কেবুকাকা বলল, বীরেশ বাবু তো গিরিজাশংকরের ঘর। আমি চুপ শ্রোতা। ইলেভেনে পড়ি। বাবা অফিস ফেরত বিরাট রেডিও আনল।

আর পায় কে! সকালে ছোটখ্য়ালে রাগ চেনা। পরেই কোনদিন কানন সাহেব, উমা দে, সন্তোষ বাঁড়ুজ্জের সেতার। দুপুরে আবার হয় খ্য়াল নয় সরোদ,সেতার। শনিবারে অল ইণ্ডিয়া প্রোগ্রাম। পারভিন সুলতানার গলায় বাপ-ছেলের মারুবেহাগ শোনা। রেডিওতেই ভীষ্মদেব, জ্ঞান গোঁসাই, তারাপদ চক্রবর্তী শোনা। ভোলা গেল না আর জ্ঞান গোঁসাই-এর বেহাগে আমায় বলো না ভুলিতে বলো না। বড়ে গোলাম আলির রেকর্ডে দেশীটোড়ির মুনওয়া লাজারে। এইভাবে একদিন ছোট মামার সঙ্গে তানসেন মিউজিক কনফারেন্স। আমীর খাঁ-র গান। শুরু হল আর এক মোড় বদল। গানের সে রাস্তায় সুর কানে চলেছি।

তবু আবার গানের ভেলায় সেই সবুজ বালকবেলায় ফিরতে ইচ্ছে করে। কলকাতার কনফারেন্স মনে পড়িয়ে দেয় ধীরেন দাদুর বাড়ির গানের আসর। ধীরেন দাদু বাবার বন্ধু মিনুকাকার বাবা। গানরসিক। তিনি মা-কে বলতেন,ঐ বাতায়নে মোরটা একটু গাও তো। মা গাইতেন, বাতায়নে মোর মাধবী গো। পরে বড় হয়ে অনেক খুঁজেছি কার লেখা, কার সুর। অজয় ভটচায্যি? হিমাংশু দত্ত? না,পাই নি। বিমান মুকুজ্জে থাকলে হয়তো জানা যেত। কে একজন খুব গলা খেলিয়ে খেয়াল গাইতেন। বাবা বলতেন, দাদা, মালকোষটা জমিয়েই গান। এভাবেই গান শুনতে গায়কদের নাম শোনা, বসন্ত্, খাম্বাজ, দরবারী এইসব শব্দগুলো বড় কাছের হয়ে গেল।




মেঘলা বিকেল

গণপতি


ঘন কালো মেঘে পুরো আকাশ চেয়ে আছে। মনে হয় এই বুঝি ঝেঁপে বৃষ্টি নেমে এল। আমার অফিসের পিছনের দিকটা থেকে অযোধ্যার রেঞ্জটা অনেকটা বোঝা যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে বেশ সুন্দর লাগে --দিগন্ত রেখা জুড়ে নীল পাহাড়ের বেড়া। অনেকেই বলে পুরুলিয়া তো রুখা সুখা মাটির দেশ, কি আর আছে এখানে?
প্রকৃতিতে পুরুলিয়া ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ বিশেষ। স্বাভাবিক ভাবেই এখানকার এলাকা এবড়ো খেবড়ো, ছোট পাহাড় আর টিলাতে ভর্তি। চাষবাস যে খুব একটা হয় , তাও ঠিক নয়। রয়েছে কয়েকটা ছোট নদী, যেগুলি বছরের অর্ধেকই শুকনো থাকে। এতো প্রতিকুলতা সত্ত্বেও পুরুলিয়ার জনজীবন বেশ মসৃণ কারন এখানকার মানুষজন কষ্টসহিষ্ণু এবং সাদামাঠা জীবনযাত্রাতেই বিশ্বাসী।
হরিকাকা এখনো বলেন পুরুলিয়ার লোক লইড়তে জানে, মরার আগে মরে নাই। এ বছর যে এখনো অব্দি ভালো বৃষ্টি হয়নি , বীজ তলা প্রায় জ্বলে গেছে, তাও বিশ্বাস টলেনি। দুই ছেলেই গেছে দক্ষিনে , ঠিকাদারের হয়ে কাজ করতে। এই বুড়ো বয়সেও হাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন ক্ষেতে। বলে ওঠেন এই জীবনে কত খরা, অনাবৃষ্টি দেখেছি, এ আর নতুন কি। পুরুলিয়ার লোক কবে আর সুখে ভাত খাঁয়েছে! হামদেরকে কষ্ট কর‌্যেই খ্যেতে হবেক।
হরিকাকার কথা শুনে জীবন বিজ্ঞানের ডারউইনের অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামের কথা মনে পড়ে। ডারউইনের তত্ত্ব প্রমাণের এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর আছে কি?
কল্পনায় দেখতে পাই আকাশ ঝেঁপে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। ক্ষেত, মাঠ খালবিল সব জলে টইটম্বুর। ক্ষেতের আল বেয়ে হরিকাকা কাঁধে হাল নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন তার জমিটির দিকে। আলের কাদায় ফুটে ওঠা হরি কাকার পায়ের ছাপ যেন দিক নির্দেশ করছে --এক অনন্ত যাত্রাপথের দিকে।


ছবি : সন্দীপ কুমার


২০২০

বিশ্বম্ভর নারায়ণ দেব


মানুষের বড়ো দুঃসময় এখন
আমাদের ঘাড়-উঁচু পরম্পরার মাথায় চড়ে
সংসদীয় ত্রাসের মহিমা গাইছে
শব্দের অসতর্ক বিচ্ছুরণ।
বুকের ভেতর কোনো গন্ধ-পুষ্পের
স্তব নেই রয়েছে শবাধার
অতিমারির আহ্লাদে যখন কাঁসর ঘন্টা বাজে
বেদম হাততালি দেয় রাক্ষস সমাজ।
তারা ভাবে চরম গর্জনই তাদের পরম অর্জন
সৃষ্টি আনন্দমাত্র ধ্বংসমাত্রই বিষাদের
প্রাণ ধারণের গ্লানিপথ পেরিয়ে
জীবনকে রক্ষা করি, চলো
সৃষ্টিকে রক্ষা করি
মানুষের অসহায়তার পাশে ধূপ জ্বালিয়ে দিই

যে ভুমায় কবি নেই সেই ভুমা অশুদ্ধ
সে ভুমা স্বল্পপ্রাণ বৃদ্ধ হ'য়ে পড়ে।



ডরোথী দাশ বিশ্বাসের কবিতা

১.
তুই ও কবিতা...


আমার কবিতা না কি
বসে আছে রাজসিংহাসনে,
তুই তার উঠোন
ভরে দিস শত ফুলে।
কবিতাকে উপহার দিস
সোনার জরির কারুকাজ
যে চন্দ্রাতপ টাঙিয়ে দিয়েছিস
তাও নক্ষত্রখচিত আজ।
আমি তো শুধু সৃষ্টি করি কাঠামো,
বড়ো একরোখা মানসিকতায়,
তুই করিস অলঙ্করণ
পেলব হাতে সংসার সামলে।
নিজস্ব নির্মাণের নেশায় বুঁদ আমি,
করিনি কখনো তোর কদর।
বিষন্ন বিকেলে উচ্চহাস্যে
গিঁট খুলি, গিঁট দিই নদীর চাদরে,
রঙচটা সূর্যটা তাই দেখে
মুখ টিপে হাসে।
আজ যখন দেখি মনের দেওয়াল ভাঙা,
চলে গেলি তুই,
অহংঙ্কারী আমি, তখনও বসে বসে
শুধু রঙ বদলে যাই।

কে সত্য,কে সঠিক,তুই না আমি -
শুধুই ভেবে যাই।


২.
প্রশ্নবোধ ছেড়ে বিস্ময়বোধ...


না না, শত শত আলোকবর্ষ দূরে
দুর্গম অরণ্য পাহাড়ে আর নয়।
পর্ণমোচী অরণ্যে এখন পাতা ঝরার পালা।
বনস্থলী যতই কাঁপুক অভিমানে,

গাঁয়ের বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত,বিশাল বৃক্ষ,পুকুরঘাট,নিকোনো উঠোন,লতার দোলনা,তুলসীমঞ্চ,সন্ধ্যাপ্রদীপ
এ সকল গার্হস্থ্য পঙক্তিগুলি
অবকাশযাপনে সরিয়ে রেখে
যাত্রা করো সমুদ্র অভিমুখে।

তাতে তোমার প্রিয়তমা নদীটাকে পেরোতেই হবে।
তা হোক।

সে যে তোমার অনেক কাছে,
জলে জলে মিশে যাওয়া।

সাঁতার জানা আছে,
খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে না নিশ্চয়ই।

নইলে মনপাখা তো আছেই,
কল্পনার দুধসাদা পক্ষীরাজও ছিলো জানি।
সেটা সুযোগ বুঝে সক্রিয় হয়ে উঠতে বাধা কি!
চাইলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য আর একবার না হয় শিল্প হয়ে ওঠো ...

সবে তো মাঘের চতুর্থ দিবস!
বসন্ত আসতে এখনো যে বাকি।
ইউফরবিয়া পালচেরিমায়
লাল রঙ ধরতে এখনো অনেক দেরি।
ততোদিনে ...
হ্যাঁ,ততোদিনে
অতলান্ত হৃদয়ের সকল রহস্য উন্মোচিত না হলে
হে সাগরিকা,
তুমিও নবীনাই থেকে যেতে পারো চিরকাল!


৩.
তুমি আমি সে...


অবশেষে তুমি আমি সে,
তিনজনেই যে যার ঘরে ফিরে আসি।
পিছনে পড়ে থাকা শূণ্য রঙ্গমঞ্চে আঁধার নেমে আসে,

বাতি জ্বলছে,নিভছে।
অনবরত বাতি জ্বালানো,নেভানো দেখছি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
আশ্চর্য! তার সাথে সুন্দর তাল মিলিয়ে চলছে সে।
পথ ভুলে সে পথে এসে পড়লে আজকাল রোজই এই এক দৃশ্য চোখে পড়ে।
যতক্ষণ অজানার অদৃশ্য ঘেরাটোপ সরবে না,
ততক্ষণ জানার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তোমাকে তাড়া করে ফিরবে।

সেই ভালো,
স্বভাব ঘরকুনো আমি,
আমার জানালা ঘেঁষে ঘোড়ানিমের ডালে
দোল খায় বুলবুল,
গামারির কোলে শীতে কাবু কোকিল,
সূর্য ডুবলে শুরু হয় রিনরিন শব্দ তুলে দল বেঁধে বালিহাঁসের উড়ে চলা।

এসব দেখতে কিন্তু ক্লান্তি আসে না কখনো।

এটুকু বুঝেছি,
ভালোবাসা একদিন অনিবার্যভাবে হারিয়ে যায়,অজানা ঠিকানায়,
কষ্ট হলে কষ্ট গিলতে জানতে হয়!!



বিপুল চক্রবর্তীর কবিতা


১.
ভাতের দিব্যি


না থাক ও-হাতে দলীয় পতাকা
না থাক ও-হাতে হেঁসাে
নেমে এসাে তুমি, ভাতের দিব্যি
রাস্তায় নেমে এসাে

রাস্তা তােমাকে রাস্তা দেখাক---
জ'মে-থাকা যত শােক
রাস্তার বাঁকে খুঁজে পাক সাথি
রাস্তায় দেখা হােক

না থাক ও-মুখে শেখানাে বুলিটি
হােক ভাষা হােক অন্য
মিছিলে মিলুক এই মহাদেশ---
সকলের ভাষা অন্ন

ধানের দিব্যি--- গমের দিব্যি ---
নামাে রাস্তায়, নামাে
বণিক জানুক, মরেনি মানুষ
আছে তার সংগ্রামও

পুরুত-মােল্লা-নেতারা জানুক
এ দেশ তাদের নয়
বহু বর্ণের শােণিতে ও ঘামে
আমাদের পরিচয়

ধ্বংস করতে এই দেশ, যারা
উদ্যত, কাড়ে গ্রাস
বজ্রের মতাে নেমে এসাে, গাও
তাদের সর্বনাশ


২.
দিনের স্লোগান লিখি


জলকামান বাঁধবে কী রে
পাঁচটি নদী বেঁধেছি শিরে

সঙ্গে আরও আসছে নদী
ছাড়তে হবে তােদের গদি

ফলায় মাঠে আহার যারা
তারাই নদী, পাহাড় তারা

অনেক হ'ল—এবার তবে
তােদের গদি ছাড়তে হবে

স্লোগান ওঠে : দিল্লী ঘেরাে
কেউ যাবে না ঘরে ফেরত

ঘিরছে দেশ: সাগর, নদী
ছাড়তে হবে তােদের গদি

    

______________
অনুবাদ কবিতা
______________


রিচার্ড গার্সিয়া'র কবিতা

কৌশিক চক্রবর্তী


রিচার্ড গার্সিয়া'র (জ. ১৯৬১) কবিতার বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গিয়ে মহামান্য ওক্তাভিও পাজ বলেছিলেন তিনটে শব্দ ---- অনুভূতি, মিতকথন আর সুর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোয় ১৯৬১ সালে জন্মানাে কবি রিচার্ড গার্সিয়া প্রথম তারুণ্যেই লিখতে শুরু করলেও, তাঁর প্রথম কবিতা পুস্তিকা “নির্বাচিত কবিতা" প্রকাশিত হল কবির ৩১ বছর বয়সে, ১৯৭২ সালে। কিন্তু ঠিক এর পরপরই তিনি লেখা থেকে দূরে সরে গেলেন। শীতঘুমে থাকা এই সময়েই তাঁর হাতে এসে পৌঁছল কবি ওক্তাভিও পাজ এর একটা চিঠি। রিচার্ড গার্সিয়া আবার যেন বা নতুন করে জেগে
উঠলেন। কবিতার পাশাপাশি ব্লিচার্ড গার্সিয়া গদ্যও লেখেন। ইতিমধ্যেই প্রকাশিত তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতাবই - যার মধ্যে দ্য ফ্লাইং গার্সিয়া (১৯৯১), রেঞ্চো নােটোরিয়াস (২০০১), দ্য পার্সিসটেন্স অফ অবজেক্টস (২০০৬) পাঠকমহলে সমাদৃত। তাঁর সাম্প্রতিককালের লেখাকে তিনি বলছেন "প্রােজ- পােয়েমস (গদ্যকবিতা)। সেইসব লেখায় তীব্র রসিকতার মােড়কে রয়েছে সময়কে দেখে নেওয়ার এক গম্ভীর চোখ। কবি বিচার্ড গার্সিয়ার তেমনই কয়েকটা গদ্যকবিতা রইল বাংলা তর্জমায়।


মই
---------
প্রথমে মানুষকে মই আবিষ্কার করতে হল। কেউ তার আগে মইফই দুচক্ষে দেখেনি। তাে মই যেই হল, ওমনি তরতর করে দেওয়াল বেয়ে ওঠাটাও আবিষ্কার হয়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই ওরা বুঝে গেল, একটা পাঁচিল টপকাতে দুটো মই লাগে। একটা দিয়ে পাঁচিলে উঠতে হয়, আরেকটা উল্টোদিকে নামার জন্য। মানুষজন এভাবেই একটা মই দিয়ে ওপরে ওঠে, আর একটা দিয়ে নিচের দিকে নামে, তারপর চলে যায়, মই গুলাে যেমনকার তেমনি পেছনে পড়ে থাকে। ঠিক এই
কারণেই পৃথিবীতে অসংখ্য মই এমনিই পড়ে থাকে। সেইসব মইগুলাে জোগাড়যন্তর করে রাখা থাকে একটা প্রকাগু গুদামে। বৈজ্ঞানিকেরা বুদ্ধি দিয়েছেন, মই গুলােকে একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে জুড়ে বরং মহাকাশে যাওয়ার একটা সিঁড়ি বানানাে হােক। কেউ কেউ আবার সব মই গুলাে গুঁড়িয়ে তছনছ করে ফেলতে চায়। কেউ কেউ আবার বলে পাঁচিলগুলােই না হয় ভেঙে ফেলা হােক। কেউ কেউ আবার মাঝখান থেকে বলে ওঠে একদিন ওপরের দিকে তাকাবার সময়ে পৃথিবীর এই সমস্ত মইগুলােরই দরকার হয়ে পড়বে...



সোনালিচুল মেয়েদের বেপাত্তা হওয়ার রহস্য
--------------------------------------------------------------------

পৃথিবী থেকে আচমকা সােনালিচুল মেয়েরা বেপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। এই তাে গতকালই, একজন আমার টেবিলের সামনে পা তুলে বসেছিল, যেমন সােনালি তেমনই ভয়ংকর। তার নখগুলাে গাঢ় নীল রঙ, সে নিজের নখের দিকে তাকিয়েছিল। সবে মনে হল দুটো কথাবার্তা বলবে, ওমনি হুশ। পুরাে হাওয়া। পিছনে পড়ে রইল তার শেয়ালের লােমওয়ালা চাদর। তার কুতকুতে দুটো কাচ চোখ ঠায় তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

আমার লাল-চুল বউ স্বীকার করেছে, আসলে তার চুলও সােনালি। আর তার নাম আসলে ঠিক ক্যাথেরিন নয়। সে লিণ্ডা। তা বেশ। আমি তাে আমার প্রথম পক্ষের আসল নামটি জানতুমই না, যদি না কাঁধে গলফের সরঞ্জাম ঝুলিয়ে আমি সদর দরজা দিয়ে বেরােতুম আর বাইরে ট্যাক্সি ড্রাইভার ক্ষতিপূরণ চেয়ে সােজা এসে সামনের উঠোন থেকে আমার টাইখানা খপাৎ করে বাগিয়ে নিতো।

কোনাে দেশে, যেখানে কোনাে সােনালিচুল মেয়ে নেই, সেখানে এইসব নকলি সােনালিরাও বহুত ঝামেলা করে দিতে পারে। এই যখন আমি এসব লিখছি, আমার বউ পেছন থেকে আমার কাঁধের ওপর দিয়ে সব দেখেশুনে বলছে, তােমার তাে বাপু উঠোনফুঠোন কোনােদিনই ছিল না, তুমি তাে কই গলফের গ-ও জানাে বলে জানি না, আর তাছাড়া তুমি আবার টাই পরতে শিখলে কবে? যাও যাও, নিজের গােড়ায় রঙ করাে গে, আমি বলি, ফাঁক দিয়ে সােনালি দেখা যাচ্ছে।

সুইডেনের সরকার জরুরি ভিত্তিতে অধিবেশন ডেকেছেন। আইসল্যাণ্ডের পুলিশবাহিনি সমস্ত সােনালিচুল মেয়েদের ধরে ধরে নিয়ে চলে যায় গােপন আস্তানায়। এদিকে আমার অফিসে আমি চেয়ারে এলিয়ে পড়ি। ভাবি... আচ্ছা, খালি খালি সােনালিচুল মেয়েরাই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে কেন? আমি খবরের কাগজ খুলে পড়ি ---- মিনেসােটায় আর একজনও সােনালিচুল মেয়ে নেই।  

আমি কম্পিউটারে সেভ করা ফাইলগুলােয় চোখ বােলাতে থাকি। টের পাই, আমার কবিতা থেকেও সেনালিচুল মেয়েরা দূরে সরে যাচ্ছে - সেই যে, সেই মেয়েটা যে আমায় ফটো ডেভেলপ করার তরলের বিষ খাওয়াতে চেয়েছিল; সেই মেয়েটা যাকে আমি মােটরবাইকে চাপা দিয়েছিলুম; সেই মেয়েটা যাকে শেষবার অ্যামাজনের জঙ্গলে দেখা গিয়েছিল, সারা গায়ে সােনার ছিটে লাগা কাদা মাখছে; সেই মেয়েটা যে আমায় বাইরে বৃষ্টি ভিজতে ডেকেছিল যখন আমি কিনা জ্বর বাধিয়ে বিছানায়...

আর ঠিক তখনই, আমার বউ, চুলের গােড়ায় সদ্য লালচে তামা রঙ লাগিয়ে, গটগট করে আমার
অফিসে ঢােকে। এমন করে এসে আমার টেবিল চেয়ারে বসে, যেন সেই মালকিন... তারপর দেখতে থাকে তার ঘন নীল রঙ লাগানাে নখ...


ছাতার ইতিহাস
------------------------

লেত্তি আর গুলতির মতন প্রথম ছাতাটি বানানই হয়েছিল অস্ত্র হিসেবে। উদোম যােদ্ধারা সব, সারা
গায়ে রক্তের নকশা আঁকা, ভয়ংকর সব ভঙ্গিমায় নিজেদের ছাতাগুলাে ধরে, নাচত। ওরা ছাতাগুলাে তুলে ধরত আকাশে, ঝটপট করে খুলে দিত তারপর আবার বন্ধও করত, হাওয়ার পেট ফুঁড়ে দিত ছাতায়; যদিও কিছুদিন পরেই ওরা বুঝতে পারল, যুদ্ধের ডামাড়লে ছাতায় হোঁচট খাওয়ার প্রভুত সম্ভাবনা আছে। অথবা, যখন শত্রুপক্ষের দিকে রে রে কৱে তেড়ে যাওয়ার সময়, তখন ছাতাফাতা খােলাটা একটা বিচ্ছিরি রকমের সময় নষ্ট। আরও বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার হল, যখন শক্রশিবিরের দিকে ওরা ছােট ছােট ছাতা হাতে করে এগােতাে, তখন অপরপক্ষ ওদের সার্কাসখেলুড়ে অথবা ব্যালেরিনা মনে করে হ্যা হ্যা করে হাসতে শুরু করে দিত। এমনি করে বছরের পর বছর, তারপর একদিন কারাের একজনের মাথায় এল যে ছাতা দিয়ে বৃষ্টিও আটকানাে যায়। আর ঠিক সেই কারণেই, আজও সেই পরিত্যক্ত ছাতাগুলাে পড়ে থাকে বিমানবন্দরে, রেল স্টেশনে, বিশ্রামকক্ষে, গাড়িবারান্দায়, রাস্তায়.....



রাতকাবার
----------------

বালিশ হিসেবে পাথরের চাইতে একটা বই ঢের বেশি ভালাে। জলে-ডোবা বই উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। বালিঝড়ের মধ্যে পড়া বই প্রতিমুহূর্তে তার সিদ্ধান্ত পাল্টায়। সেই যে বুকের ওপরে ধরে রাখা সেই বই, যে কি না বুলেট শুষে নিয়েছিল, তার সম্পর্কে কে না জানে?  

একবার একটা ঘড়ি একজন চোরের প্রেমে পড়ে। কিন্তু চোরটার কাছে ছিল অনেকগুলাে ঘড়ি। সে দুহাতেই অনেকগুলাে করে ঘড়ি পরে থাকতাে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেমন হয়, এই ঘড়িটাও স্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কেউ আর খবরই রাখে না যে এই বইটা এত কম খাচ্ছে আজকাল, যে বেঁচে থাকাই দায়। ব্যাণ্ডেজের বইটার আর কেউ খোঁজখবর করে না। ওই যে দিগন্তরেখায় জেগে আছে একটা বই। ওই যে বইটা আকাশের দিকে মেলে দিল, তার নাম দিগন্ত...

জলের বােতলের ব্যাপারে কী আর বলবাে? তার তাে প্রায় কোনাে অস্তিত্বই নেই... অন্তত নদী হিসেবে ব্যর্থতার পর, আর শুই যে বৃষ্টি... তুড়ি মারছে, ধৈর্য বলে কিছু নেই, সেও কি মেঘ হিসেবে ব্যর্থ হয়নি?


আমার কুয়াশা
-----------------------

আমার কুয়াশা এক কোণে মুখ নিচু করে বসে।দু-একবার কথা বলেছিল। একবার বলেছিল, প্লিজ। তারপর আবার বলল, থ্যাংক ইউ। ঠিক জানি না, কেন বা কীসের জন্য... আমি জানি, সব কুয়াশারাই ঠিক এতটাও ভদ্র নম্র হয় না। এই যে যেসব কুয়াশা পাহাড়ের গায়ে জন্মায়, তারপর গুঁড়ি মেরে নামে, শত্রু সেনার অঞ্চলে, তারা ? তাদের হাতে কোনাে বন্দুক নেই, গ্রেনেড নেই কোনাে, কেবল ছুরি আর তরবারি। লন্ডনের আততায়ী কুয়াশাকে কী বলবেন? বা হ্রদের নিচে শুয়ে থাকা ওই বিষাক্ত কুয়াশা? যার হাত ধরে ঘুমের ভেতর হ্রদটাই উল্টে গেল পুরাে। ওই যে কোণটায় আমার কুয়াশা বসে, সেদিকে যদি তাকাই, যথারীতি দেখব, সে আর নেই। আবার যেই মুখ ফেরাবাে, ওমনি সে তার গােয়েন্দাগিরি শুরু করে দেবে। আমি শুনতে পাই দূরে কুয়াশার বাঁশি বাজছে। মনে হয় যেন বলছে, তােমার কুয়াশা, আরেকটা বাঁশি উত্তর দেয়। আমার কুয়াশা। তােমার কুয়াশা। আমার কুয়াশা। আমি উঠে পড়ে জানলা দিয়ে বাইরে দেখি। রাস্তার ওপারে একটা বাড়ি চোখে পড়ে, কই এতদিন তাে দেখিনি। হয়ত ওই বাড়িটা আসলে কুয়াশা পেরিয়ে শীতের ঘনয় উড়ে আসা কোনাে পরিযায়ী বাড়িদলের অংশ। হ্যাঁ, অমনটা হতেই পারে। সবটাই তাে এক অর্থে চলমান। যেমন লস অ্যাঞ্জেলেস। চোখ মেলে হয়ত একদিন আচমকা দেখতে পেলাম ওই দূরে জেগে উঠছে একটা পাহাড়। পরের দিনই সে আর নেই



দেশলাই খাতা
---------------------

আমার পায়ে জোরে জোরে শব্দ হয়, যেন বা কোনাে বিশাল হলঘরে রয়েছি। আমি পকেটে এক খাতা দেশলাই খুঁজে পাই, একখানা জ্বালিয়েও ফেলি।নিজের হাতখানা প্রায় পুড়িয়েই ফেলেছিলাম, আর ঠিক তখনই আলাে গেল নিবে, বাতাসে পড়ে রইল সামান্য গন্ধকের ছোঁয়াচ। আমি আরেকখানা জ্বালাই, কিছুটা উঁচু করেই ধরে রাখি। দড়ি। পর্দা। নিচু করতে হয়। আমি হাঁটু গেড়ে বসি। কাঠের মেঝে। আমি আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকি, পা ঘষে ঘষে, যেন বা হাওয়া ভেসে চলি। হাঁফ নেওয়ার শব্দ পাই। কেউ একজন খিকখিক করে হাসে। মানে, আমায় কেউ লক্ষ্য করে
চলেছে। আমি দেশলাই গুনি। আমি একটাও নষ্ট কতে চাই না। কে জানে, হয়ত একটা মােমবাতি খুঁজে পাব ঠিক। একটা টর্চ লাইটের সুইচ। আমি দমবন্ধ করে পরের দেশলাইটা জ্বালাবার জন্য তৈরি হই। টের পাই, একটু একটু করে আমি পারদর্শী হয়ে উঠছি...


          চিত্রশিল্পী : কল্পোত্তম


গড়িয়ে যাওয়া জীবন

কল্পোত্তম



বেশ কয়েকদিন হলো মাথাটা চুলকোচ্ছে। মনে হয় উকুন হয়েছে। কাজের চাপে ফুরসৎ না মেলায় ঠিকভাবে শুকোনো হয়নি চুলগুলো। কোনোমতে স্নান সেরে এসে ভাত খাওয়া। খেয়েই বেরিয়ে যাওয়া ইট ভাটার কাজে। আজ বুধবার, হপ্তার দিন বলে একটু সময় হয়। মাথায় মাটি ঘষে চুল শুকোয় সস্তা পিসি। নারকেল তেলের কৌটাটা রোদে দিয়ে বলে, ভুচকি, ভুচকি-ই-ই। ভুচকি দৌড়ে আসে। কি-ই-ই? মাথাটা দেখ না, উকুন হয়েছে নাকি। ক'দিন ধরে খুব চুলকোচ্ছে। 
            ভুচকি বসে পড়ে। সস্তা পিসির পিছন দিকে বসে মাথার চুলগুলো এদিক ওদিক চিরে চিরে উকুন খোঁজে। কই উকুন ? ডিম আছে কানের পাশ দিকে, পিছন দিকটায়। একদম সরু সরু।
            কিছুক্ষণ খুঁজতে খুঁজতে সস্তা পিসি নড়ে বসে। দাঁড়া দাঁড়া, নড়িস না, একটা পেয়েছি। বলেই বাঁ হাতের দুটো আঙ্গুল একেবারে গভীরে নিয়ে যায়। চিমটি দিয়ে ধরে টেনে আনে উপরে। আঃ! লাগছে লাগছে। চুলটাকে টানলে হবে? উকুনটাকে ধরতে হবে না।
            ভুচকি বিরক্ত হয়ে বলে, ই বাবা, এমন একটু একটু লাগবেই। আমি কি ইচ্ছা করে লাগাচ্ছি।
            ঠিক আছে ঠিক আছে, বাছ।
            ভুচকি উকুন বাছতে বাছতে অনেকক্ষণ হয়ে যায়। রোদে দেওয়া নারকেল তেলটা গলে জলজলে হয়ে আসে। বেলাটাও গড়িয়ে পড়ে খানিকটা। ফুল গাছের ছায়াগুলো অনেকটা এগিয়ে যায় পূর্ব দিকে। কয়েক জন সাঁওতাল মহিলা মাথায় ব্যাগ নিয়ে চলে যায় পাঞ্জনবেড়ার দিকে। সঙ্গে কয়েকটা ছেলে মেয়ে। তারাও হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। কখনো কখনো পিছিয়ে গেলে দৌড়চ্ছে। তাদের হাতে খাবারের পেকেট। খেয়ে খেয়েই যাচ্ছে। চিৎকার করে করে কথাও বলছে তারা। কি সব বলছে, বোঝা যাচ্ছে না। সাঁওতালি ভাষা সস্তা পিসির জানা নেই। ভুচকিও জানে না।
            যেদিন ইট ভাটা যায় না, সময় থাকে বসার, টগর গাছের তলায় গিয়ে বসে। উঠোনের টগর গাছের ছায়াটা ঘন হওয়ায় আরামদায়ক। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে। বিশেষ করে গ্ৰীষ্মের দিনে, টগর গাছের ছায়ায় বসলে মনটা ঠান্ডা হয়ে যায়। সস্তা পিসি ছোটো একটা খাট বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। ছোটো ছোটো কালো, বাদামী, ধূসর, সবুজ রঙের পাখিগুলো টিঁয়ক টিঁয়ক, চিঁয়িক চিঁয়িক, টিক টড়ক টিক টড়ক, আরও কত রকমভাবে ডাকতে ডাকতে ডালে এসে বসে। এ ডাল সে ডাল লাফায়। তারপর উড়ে যায়। সস্তা পিসি শুয়ে শুয়ে এইসব পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে কি সব ভাবে। তারপর ছেলে-মেয়ের দল এসে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে সেও চিৎকার করে, এই চল্, দূরের দিকে খেলবি যা। তেঁতুল তলের দিকে যা। কান গোড়াটায় এসে চেঁচাচ্ছে। শান্তিতে একটু শুতেও দিবি না লোককে?
               ছেলেরা পালিয়ে যায়। সস্তা পিসি চুপচাপ দেখতে থাকে পাখিদের আসা যাওয়া।
               টগর গাছের কাছে আরও কয়েকটা গাছ, ঝোপঝাড় রয়েছে। তিন চার রকমের জবা, জুঁই, হাড়জোড়া, সজনে, ইছুর, পুটুস, পেঁপে এবং একটু দূরে দু'তিনটে খেজুর। তার একটাতে ফল ধরে দু'টাতে ধরে না। 
               খেজুর পাকার সময় সস্তা পিসিকে আরও বেশি জ্বালাতন করে এ পাড়ার ও পাড়ার বিচ্ছু ছেলেরা। লুকিয়ে লুকিয়ে এসে দুম করে ইট পাথর ছুড়ে খেজুর গাছে। কোনো কোনোটা সোজা গিয়ে পড়ে সস্তা পিসির চালের উপর। চিৎকার করে ওঠে সস্তা পিসি। কে রে, কে? কানটা ধরে সোজা তোদের বাপের কাছে নিয়ে যাব। শুনে দৌড়ে পালিয়ে যায় ছেলেরা।
              খেজুর গাছের কাছে একটা ইলেকট্রিক খুঁটি। তাতে ঘন সবুজ গুলঞ্চ লতা। ওপরে ওঠার চেষ্টায় বার বার ঝুলে পড়া তার। পাশেই একটা শিম লতা। গাছের মতো করে গেড়ে দেওয়া শুকনো ডালের মাথায় রাজ্য বিস্তার করতে করতে এগিয়ে যায় বাইরে। তাতে কিছু কচি কচি শিম। থোকা থোকা হয়ে ঝুলে আছে নিচের দিকে।
               একটা ছাগল আসে।শিম লতার দিকে লাফাতে গেলে চেঁচিয়ে ওঠে সস্তা পিসি। ধাট ধাট, এই ভুচকি তাড়া তাড়া। কে যে ছাড়ে, রোজ আসে ছাগলটা, এদের জন্যে দু'টা লতা পাতাও হবে না। চরানোর লোক নেই তো রাখে কেন ছাগল! কয়েকটা পাথর কুড়িয়ে দৌড়ে যায় ভুচকি। ছাগল লক্ষ্য করে দুম দুম ছোঁড়ে। পাথরের চোটে ম্যা ম্যা করতে করতে পালিয়ে যায় ছাগল।
               তেলটা গলেছে, ছাগল তাড়িয়ে এসে কৌটোটা নাড়িয়ে দেখে সস্তা পিসিকে জানায় ভুচকি।
সস্তা পিসি বলে, নিয়ে আয়, লাগিয়ে দে মাথাটাতে। তোরটাতেও লাগা। তুইও তো মাথা ঘষেছিস। ভুচকি অনেকক্ষণ ধরে চুলগুলো এদিক ওদিক উল্টে পাল্টে তেল লাগিয়ে দেয় সস্তা পিসির মাথায়। তারপর বেণী বেঁধে দেয়। বেণী শক্ত রাখার জন্য লাগিয়ে দেয় কয়েকটা চুলচিপা। পরে নিজের মাথায় তেল লাগাতে লাগাতে জানতে চায় ভুচকি, চুলচিপাগুলো কার কাছে নিয়েছো পিসি? কেন বিদ্যার শ্বশুরের কাছে। ক' দিন আগেই তো এসেছিল। ওর কাছেই ভালো। বেশি বাড়িয়ে বলে না। পাতুয়াড়ার ফেরিওয়ালাটা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে। পাঁচ টাকার জিনিসে দশ টাকা নেয়। ভালো লাগে না ওকে। তার থেকে বিদ্যার শ্বশুর অনেক ভালো। 
             ভুচকির মাথায় তেল লাগানো হয়ে গেলে সস্তা পিসি ঝুটি বেঁধে দেয়। সূর্যটা লাল হয়ে ঝুঁকে পড়ে পাহাড়ের দিকে। ইলেকট্রনিক খুঁটির ছায়াটা ছাড়িয়ে যায় পাঁচ ছ'টা ঘর। সস্তা পিসি আর ভুচকি আয়না, চিরুনি ও নারকেল তেলের কৌটোটা নিয়ে ঢুকে যায় গলির মুখে।

____________________________




_____________________________


আমাদের বই







সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
নাচনি নাচের ছবি : সন্দীপ কুমার
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

  1. নাচনি অর্থাৎ লাচনি তে এক অসাধারন শিক্ষার কথা বর্নিত হয়েছে।এছাড়াও প্রতিটি লেখাই খুব সুন্দর হয়েছে।

    "শিক্ষার আলো চারিদিকে,
    তবুও অন্ধকার এই সমাজ।
    শোনার চেষ্টাই না করলে কি আর,
    শুনতে পাবে সেই আওয়াজ।।
    শিক্ষিত সব মূর্খের দল,
    প্রকৃত শিক্ষাই আজ ডুবে।
    লাভ নেই বেশ তাও দেখা যাক,
    একদিন না একদিন হবে।।"

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪