সায়ন্তন ধরের রহস্য গল্প
ব্লু রকেট রহস্য
ক্যালেন্ডারের শীতকাল হলেও সূর্যের তেজ এত প্রখর যে মাঝে মাঝে মনে হয় বসন্তকে অতিক্রম করে গ্রীষ্ম এসে গিয়েছে। পৌষ-মাঘ শীতকাল, আর মাঘের শীতে বাঘ পালায় শুনেছি, সেই মাঘ মাসের ২৫ তারিখ আজ অথচ দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর আশেপাশে। প্রীতমের অবশ্য তাতে লাভ হয়েছে। রাজধানী থেকে প্রচুর পর্যটকের সমাগম হচ্ছে। স্থানীয় মানুষেরাও একটু ঠান্ডার আশায় ডুয়ার্স-তরাই ঘুরছে। তাই তার উপার্জন টাও ভাল হচ্ছে। ওয়েল মেনটেনেন্স, ভালো ব্যবহার, দক্ষ ও সেফ ড্রাইভিং ও সঙ্গে গাইডের কাজ হয়ে যাওয়ায় প্রীতম ও নীল সুইফ্ট এর চাহিদা বেশি। তাই নির্ধারিত সময়ের কিছু আগেই কার লোন শোধ হয়ে গেছে। প্রীতমের মনটা বেশ ফুরফুরে তাই। আজ শনিবার দেব কুটীরে গেলে নীলাদ্রিদের সঙ্গে দেখা হবে এই আশা নিয়ে দেব কুটীরে এল সে। দেব কুটীরের বারান্দায় বসে ছিল নীলাদ্রি, সুজন, ত্রিহানা। নীল সুইফ্ট এর আওয়াজ শুনেই তাকাল গেটের দিকে। ত্রিহানা বলল, "ওই তো প্রীতম দা এসেছে, আমি আর এক কাপ চা করে আনি।"নীলাদ্রিদের পুরনো কোলবলের উনুনটাকে টুকটাক মেরামত করে ওরা এখানে চায়ের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। প্রীতম এসেই তার কার লোন পরিশোধ এর খবর দিল। সুজন বলে উঠলো, "তাহলে এই খুশিতে খাওয়া তো প্রাপ্য আমাদের, কি খাওয়াচ্ছ প্রীতম দা? আর কবে খাওয়াচ্ছ? আজকালের মধ্যেই খাওয়াও, নীলাদ্রি আবার পরশু চলে যাবে।" ত্রিহানা চা নিয়ে আসলো। প্রীতম চায়ে চুমুক দিয়ে বলল মুখ ফুটে খেতে চাইলি যখন তখন এগুলো নে। এই বলে তিনটা ডেয়ারি মিল্ক চকোলেট পকেট থেকে বের করে এগিয়ে দিল ওদের দিকে। কপট রাগ দেখিয়ে ওরা বলে উঠলো, "এটা কি হলো?" প্রীতম উত্তরে বলল, "আচ্ছা আমি কি বাড়ি বানিয়েছি নাকি হোটেল খুলেছি? আমি তো গাড়ি কিনেছি, তাই এর মধ্যে খাওয়া আসছে কোথা থেকে! তার চেয়ে এই গাড়ি নিয়ে চল কোথাও ঘুরে আসি।" ঘোরার কথায় সবাই ভীষণ খুশি। সবাই প্রীতম কেই ভার দিল জায়গা ঠিক করার। প্রীতম ইতিমধ্যে সারা ডুয়ার্স, দার্জিলিং, কালিম্পং এমনকি সিকিম ও চষে ফেলেছে। প্রীতম বলল, "জায়গা তো অনেক রয়েছে, তবে আমার দুটো পছন্দের জায়গা হল- গোরখে ও টুমলিং। দুটোই দার্জিলিং জেলার সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানে অবস্থিত। তবে দুটো দুই প্রান্তে, টুমলিং হলো…" মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নীলাদ্রি বলে উঠলো, "সান্দাকফু যাওয়ার পথে নেপাল সীমান্তের ছোট্ট গ্রাম। গোরখে না হয় পরে কোন বার যাব, এবার টুমলিং। আসলে গত শরৎকালের ইউনিভার্সিটি থেকে সান্দাকফু নিয়ে গিয়েছিল শিক্ষামূলক ভ্রমণে। তখন রডোডেনড্রন ও ম্যাগনোলিয়া দেখতে পাইনি।এবার বসন্তকাল, চাঁপা গুরাসের সাদা-গোলাপী-লাল রঙে উপত্যাকা সেজে উঠবে। সে দৃশ্য শুনেছি দেখার মত।" এবার সুজন, ত্রিহানাও বলে উঠলো, "তাহলে টুমলিং এই যাওয়া যাক।" কিন্তু যাব বললেই যাওয়া হয়না। সবার কলেজ ইউনিভার্সিটি খোলা। ওরা ঠিক করল দোলের ছুটিতে টুমলিং যাবে। এবার দোল সোমবার পড়েছে যার অর্থ হলো শনি-রবি মিলিয়ে টানা চার দিন ছুটি। এর মধ্যে একদিন ত্রিহানার কাছে তার কলেজের বন্ধু রাজন্যা শুনলো টুমলিং এ ঘুরতে যাওয়ার কথা। রাজন্যা ত্রিহানার মতই কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট হলে কি হবে মেশিনের থেকেও তার প্রকৃতির প্রতি আগ্রহ বেশি। ফড়িং প্রজাপতি সহ অনেক রকম পতঙ্গ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। ফটোগ্রাফি টাও খুব সুন্দর করে। রাজন্যা আবদার করল সেও যাবে।সবাই যখন এ কথা জানলো সানন্দে এই আবদার মেনে নিল।কারণ জাতীয় উদ্যানে ঘোরা মানে শুধু চতুষ্পদ প্রাণী দেখাই নয় সেই অঞ্চলের পতঙ্গদের মধ্যেও রয়েছে অনেক আকর্ষণ। তাছাড়া পাঁচজনের মধ্যে দু'জন মেয়ে থাকলে লজে রুমের ব্যাবস্থা করা সুবিধাজনক হবে। ধীরে ধীরে দিন এগিয়ে আসতে লাগলো। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হয়ে গেছে। ওখানে এখনো বেশ ঠান্ডা। রাতে যে শিশির পড়ে তা ভোরবেলায় জমে গিয়ে বরফ হয়ে যায়। ০ থেকে ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা বিরাজ করে। তাই ভারী গরম পোশাক আবশ্যক। প্রীতম টুমলিং-এর প্রিমুলা লজ বুক করেছে। নীলাদ্রি রাও ইউনিভার্সিটি থেকে প্রিমুলা লজেই উঠেছিল। প্রিমুলা লজের ডরমিটরি তে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। যাবার দিন ওরা সবাই দেব কুটীরে জড়ো হয়েছিল। প্রীতম গাড়ি নিয়ে এলে রওনা দিয়ে দিল। রাজন্যাকে ওর বাড়ির সামনে থেকে তুলে স্টেট হাইওয়ে ধরল ওরা। ঠিক এক ঘন্টায় বড় শহরে পৌঁছে মানেভঞ্জন এর উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলল। মাঝে দু'বার গাড়ি থামাতে হল রাজন্যার জন্য। সে দুটি প্রজাপতি দেখে তাদের ক্যামেরা বন্দী করল। ত্রিহানা হাত জোড় করে বলল, "হে ভগবান আজকের মত প্রজাপতিদের বিশ্রাম নিতে বলো, না হলে যে এই পথ শেষই হবে না।" প্রীতম গান চালাল "এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো?" এভাবে চেন সিস্টেমে গান চলতে লাগলো। সকাল ৬ টায় রওনা দিয়ে বেলা ১১ টায় মানেভঞ্জন পৌঁছলো গাড়ি। মানেভঞ্জন কে সান্দাকফুর বেসক্যাম্প বলা যেতে পারে। এ পথের শেষ শহর মানেভঞ্জন। এখান থেকে নেপাল সীমান্ত দিয়ে যেতে হবে- চিত্রে, লামাধুরা, মেঘমা, টংলু র পর আসবে টুমলিং। সবকটি ছোট ছোট গ্রাম যেগুলি কোনোটা ভারতে আবার কোনোটা নেপালে। মানেভঞ্জন এ ফরেস্ট চেকপোস্ট রয়েছে, ৫ জনের জনপ্রতি ১০০ টাকা ও গাড়ির জন্য ১০০ টাকা দিয়ে ওরা ভিতরে যাওয়ার পারমিট করালো। এখান থেকে সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান শুরু হলো। ছবির মত রাস্তা দ্বিপ্রাহরিক ঝকঝকে রোদে গাঢ় নীল আকাশে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা ডানদিকে। সাদা সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গেছে। বাঁকগুলো খুব তীক্ষ্ণ। দক্ষ ড্রাইভার ছাড়া এই রাস্তায় আসা উচিত নয়। প্রীতম অবশ্য ভীষণই দক্ষ নিজেও আগে এসেছে এই পথে। ক্রিপ্টোমেরিয়ার অরণ্য শেষ হতেই দেখা মিলল সাদা চাঁপা, হিমচাঁপার। ওক গাছের ফল পড়ে রয়েছে রাস্তা জুড়ে।রাস্তার দু'পাশটা ঘনসবুজ হলেও কাছের শৃঙ্গ গুলি কেমন যেন ন্যাড়া। নীলাদ্রি বলল, "এখানে বৃষ্টিপাত তুলনামূলক কম উচ্চতা বেশি। শীতকালে তুষারপাত হওয়ায় তুষারাবৃত থাকে শৃঙ্গগুলি। তাই বড় গাছ বেশি জন্মাতে পারে না। ইতস্তত কিছু এরিকেসী, রোজেসী, পলিগোনেসীর ঝোপ আর ঘাস ও মসের সহাবস্থান। ওই যে পাহাড়গুলো একটু হলদেটে সবুজ দেখাচ্ছে তার কারণ হলো মসের উপস্থিতি। লামাধুরায় গাড়ি থামিয়ে একটু চা খেয়ে নেওয়া, তিব্বতি কায়দার চা হাতে নিয়ে রাস্তার পাশের গার্ডওয়াল এ বসে খাদের দিকে তাকিয়ে থাকার যেন অন্যরকম আনন্দ। রাজন্যার মুড অফ দেখে প্রীতম তার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে জানায় যে হয়তো ভগবান ত্রিহানার প্রার্থনা শুনেছে, একটাও প্রজাপতি নেই। আসলে এত ঠান্ডায় প্রজাপতিরা ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। রাজন্যার গোমরা মুখে বিজ্ঞের মত কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। রাজন্যা ও যোগ দিলো সেই হাসিতে। অবশেষে গাড়িতে ওঠার আগে ওরা কাঞ্চনজঙ্ঘা কে সাক্ষী রেখে একটা ফটোর আবদার জানালো রাজন্যার কাছে। রাজন্যা এমন ভাব করল যেন ওর ক্যামেরা শুধু প্রজাপতি তুলতে পারে। ত্রিহানা ছাড়বার পাত্রী নয় সে রাজন্যার ব্যাগ থেকে নিজেই ট্রাইপড বের করে আনল। অগত্যা ফটো উঠলো। ওরাও উঠে এলো গাড়িতে। প্রীতম গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে এগোতে যাবে, দুটি ভুটিয়া কুকুর গাড়ির সামনে এসে কুঁইকুঁই করতে লাগলো। সুজন একটা গোটা বিস্কুটের প্যাকেট খুলে খাওয়াতে লাগল ওদের। দুজনেই খুশিতে সে কি লেজ নাড়া। বেলা ১টার দিকে ওরা পৌঁছে গেল টুমলিং। প্রিমুলা লজ রাস্তার ধারেই। লজের মালিক বিনোদ প্রধান ওদের দেখেই করজোড়ে বেরিয়ে এলেন। ভীষণ অমায়িক মানুষ। এর আগেও নীলাদ্রিরা যখন এসেছিল ওদের যত্নআত্তির ত্রুটি রাখেননি। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারেন। পর্যটকেরা বেশিরভাগই বাঙালি বলে তাদের মুখ থেকে শুনে শুনেই শিখে নিয়েছেন। ওরা লজে চেক ইন করে ডরমিটরি তে এলো। মূল লজটা দুই ভাগে বিভক্ত, একটি অংশে কিছু রুমের সাথে ডাইনিং স্পেস ও রান্নাঘর। ওখানেই পরিবার নিয়ে থাকেন বিনোদ বাবু। আর অপর অংশে বেশ কয়েকটি ডরমিটরি। সিজন টাইম হলেও বেশ ফাঁকা প্রিমুলা লজ, ওরা ছাড়া আর মাত্র একটি পরিবার উঠেছে। অথচ পার্শ্ববর্তী লজ গুলোতে বেশ ভীড় চোখে পড়ল। এর কারন জিজ্ঞেস করলে কিছুটা যেন এড়িয়ে গেলেন বিনোদ বাবু। পরিবর্তে বললেন, "লাঞ্চে কি খাবেন?" ওরা সবাই 'থুকপা' খাবে বললে উনি নিজ হাতে 'থুকপা' বানাতে প্রবৃত্ত হলেন। নীলাদ্রিরা সবাই ডরমিটরি তে এসে দেখল সেটি আট বিছানার ডরমেটরি। পাঁচটি খাট লম্বালম্বি ও তিনটি খাট আড়াআড়ি করে পাতা। প্রীতম একদম কোণার লম্বালম্বি খাটটি দখল করে সবাইকে পছন্দমত খাট বেছে নিতে বলে নীচে চলে গেল গাড়িটিকে সুরক্ষিত করতে। রাজন্যা ও ত্রিহানা দুটি আড়াআড়ি খাট দখল করে তৃতীয় খাটটিকে লাগেজ রাখার জায়গা বানিয়ে ফেলল। প্রীতম এর পরের দুটি খাটে নীলাদ্রি ও সুজন। সুজনের পাশের খাটে ছেলেদের লাগেজ ও তার পরের খাটটি একদম খালি। এই খাটটা একদম জানালার সামনে তাই ঠান্ডাটা একটু বেশি এখানে। স্বচ্ছ কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যায় সিমেন্টের রাস্তা চীনের প্রাচীরের মতো উঁচু হয়ে যেন আকাশ ছুঁয়েছে। ওটা টংলু শৃঙ্গ। টংলু পশ্চিমবঙ্গের চতুর্থ উচ্চতম শৃঙ্গ। রাস্তার পাশে একটা লালিগুরাস ফুলে ফুলে লাল হয়ে রয়েছে। ভীষণ সুন্দর দৃশ্য। সবাই ফ্রেশ হলে পরে প্রীতম ফ্রেশ হয়ে নিল। তখনই বিনোদ বাবু ডাকলেন লাঞ্চের জন্য। ডরমিটরিটা দোতলায়। আরো চারটি ডরমিটরি রয়েছে এখানে তবে সবই খালি। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে ওরা দেখল প্রীতম দা গাড়িটিকে লনে এনে রেখেছে আর একটা কালো ত্রিপল দিয়ে সুন্দর করে ঢেকে দিয়েছে। লজের এই অংশে কেউ নেই বলে ওরা সদর দরজায় তালা দিয়ে ডাইনিং স্পেসে এলো। পাঁচটি সুদৃশ্য লালরঙা কাচের বাটি থেকে ধোঁয়া উঠছে। বিনোদ বাবু নিজে হাতেই সার্ভ করলেন সবকিছু। হাসিমুখে ওদের বসতে বললেও বিষণ্নতাটা আড়াল করতে পারলেন না। যাইহোক গরম গরম 'থুকপা' খেয়ে ওরা বাইরে এল। সকলেই ছুটে গেল রডোডেনড্রন গাছটির দিকে। ফটো তুলতে ব্যস্ত হলো সবাই। রাজন্যার প্রজাপতি না পাওয়ার দুঃখ ভুলিয়ে দিল লালিগুরাস। ওহো ভালো কথা নেপালি ভাষায় লালি মানে লাল আর গুরাস হল রডোডেনড্রন। প্রীতম সকলকে বলল, "একটা গাছকে পাঁচজনে ভাগ করে কাজ কি? লজের পিছন দিকে আয় সকলের ভাগ্যে চার-পাঁচটা করে রডোডেনড্রন পড়বে। তারপর যত পারিস ফটো তুলবি।" সত্যিই তাই লজের পিছনে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গাটা এই লজেরই। লাইন করে কুড়ি পঁচিশটা বিভিন্ন রঙের রডোডেনড্রন সেখানে। লাল-গোলাপি-সাদা রং এ ভরে আছে জায়গাটা। এত ঠান্ডাতেও মনে করিয়ে দিচ্ছে তারা, "বসন্ত এসে গেছে।" রডোডেনড্রন খুব একটা লম্বা গাছ নয়, তার মধ্যে এগুলি কম বয়সী গাছ, তাই ফুলগুলো সব হাতের নাগালে। কিন্তু ওরা কেউই ফুল ছেঁড়া পছন্দ করেনা। নিচে প্রচুর বাসি ফুল পড়ে রয়েছে ওগুলোই কুড়োতে লাগলো। রাজন্যা, ত্রিহানা পরস্পরের চুলে লাগিয়ে দিল ফুল। খুব সুন্দর লাগছে ওদের। সময় যে কোথা দিয়ে গড়িয়ে গেল। ক্যামেরার চার্জ শেষ হতেই হুশ ফিরল রাজন্যার। ঘড়িতে তখন চারটে বাজে। পাহাড়ি অঞ্চলে দিন ফুরিয়ে আসে তাড়াতাড়ি। ওরা সকলে ফিরে এলো লজে। বাড়িতেও ফোন করা হয়নি কারোর।সকলে বাড়িতে ফোন করে নিয়ে আবিষ্কার করল যে চার্জিং পয়েন্ট মোটে একটি আর সেখানে চার্জ হচ্ছে রাজন্যার ক্যামেরা। এদিকে সকলেরই মোবাইলে চার্জ দরকার। তখনই ত্রিহানার নজরে পড়ল একটা কাঁচের দরজার দিকে। দরজাটি এপ্রান্ত থেকে আটকানো। ছিটকানি খুলতেই খুলে গেল দরজা ওদিকে আরো একটি ডরমিটরি। সেখানেও একটি চার্জিং পয়েন্ট আছে।ওই ডরমিটরির অন্য দেওয়ালে আরো একটি দরজা একইভাবে আরো একটি ডরমিটরি পাওয়া গেল। নিচের তলাতেও দুটি ডরমেটরির দরজা খোলা পাওয়া গেল। অতএব পাঁচজন ৫ ঘরে মোবাইল চার্জে বসিয়ে এলো নিজেদের ঘরে। রাত আটটায় ডিনার হবে তাই তার আগের সময়টা গল্প করেই কাটাতে হবে সবাইকে। এবার নীলাদ্রি বলল, "আচ্ছা সিজন টাইমে এরকম ফাঁকা কেন লজটা? গতবার যখন এসেছিলাম এরকম তো দেখিনি।" প্রীতম বললো সেও এর আগে এসে বেশ রমরমা দেখেছে। কাজের লোকেরও তো অভাব ছিলনা। রাজন্যা ত্রিহানার কাছে ওদের চারজনের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনেছে। সে বলে উঠলো, "তোমরা কি কোন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছো নাকি?" নীলাদ্রি বলল, "তা তো একটু মনে হচ্ছেই তবে আমরা ঘুরতে এসেছি বেশি ভেবে লাভ নেই।" সুজন বলল, "তারচেয়ে বরং অন্য গল্প হোক। রাজন্যাকে শুধু বুনু চেনে, তা বুনু তুই একটু পরিচয় করিয়ে দে রাজন্যার কীর্তিকলাপের সঙ্গে।" ত্রিহানা যা বললো তার সারমর্ম এই- রাজন্যা কথা বলে কম, আর কোন কথা বললে ভেবেচিন্তে টেনে টেনে কথা বলে। রাজন্যার বাড়ি শহরে নয়, মাসির বাড়িতে থেকে পড়ে। ত্রিহানাদের অনেকবার নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছেন ওর মাসি। রাজন্যার প্রজাপতি, ফড়িং ব্যতীত বিড়াল খুব প্রিয়, ওদের একটি মা বিড়াল ও খানপাঁচেক বিড়ালছানা আছে। ওদের ছাদ বাগানে বিনস গাছ আছে তাতে অনেক বিনস ধরে। এছাড়াও টবে অনেক ফুল গাছ আছে। নিজে হাতে ওগুলির যত্ন নেয় সে। এত কথার পর রাজন্যা টেনে টেনে বলল "তোমাদের সম্পর্কে আমি অবশ্য অনেক কিছুই জানি। তোমাদের স্কুল বাসের রহস্য সমাধান এর গল্পও শুনেছি ত্রিহানার কাছে। এখান থেকে ফিরে কিন্তু তোমরা সবাই একদিন এসো আমার মাসির বাড়িতে।" প্রীতম বলল, "অবশ্যই যাব, তবে যা বুঝলাম সুজন, ত্রিহানা হলো আমাদের ঠাকুমা, ঝুলি থেকে গল্প বের করে শোনানোটাই ওর কাজ।" সবাই হেসে উঠল সমস্বরে। এভাবেই গল্প গুজব করতে করতে আটটা বাজল। ওরা চলে এল ডাইনিং স্পেসে। বিনোদ বাবু বললেন, "একটু বসো তোমরা, রান্না প্রায় হয়ে গেছে।" দশ মিনিটের মধ্যে ধূমায়িত ভাত ও দেশি মুরগির মাংস চলে এল টেবিলে। খেতে খেতে পরিচয় হলো অন্য পরিবারটির সঙ্গে। ওঁরা দুই ভাই বাংলাদেশের নাগরিক। প্রতিবছরই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। ব্যাংকে চাকরি করেন, বাড়ি ঢাকায়। গতবছর ভুটানে গেছিলেন। এবার এসেছেন এখানে। কাল সকালে সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন তারপর সবরগ্রাম ও ফালুট। এরপর গোরখে হয়ে ঘুম ও দার্জিলিং। এভাবে দিন সাতেকের ভ্রমণ শেষে ফিরে যাবেন কলকাতা। সেখান থেকে বিমানে ঢাকা। পরস্পরের সাথে পরিচিত হয়ে দু'পক্ষেরই বেশ ভালো লেগেছে। ডিনার শেষে সবাই ফিরে এলো ডরমিটরির পথে। আজ দোল পূর্ণিমা রাতের কালচে নীল আকাশে জ্বলজ্বল করছে চাঁদ। চাঁদকে মাঝে মাঝে ঢেকে দিচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ। ত্রিহানা, রাজন্যা ও প্রীতম উপরে ডরমিটরি তে উঠে গেলে সুজন ও নীলাদ্রি উপভোগ করতে লাগল চন্দ্রালোকিত নিশীথ শোভা। ঠান্ডা গায়ে না লাগলেও মুখমন্ডলে সুচ ফোটাচ্ছে যেন। ডরমিটরি থেকে ফ্লুওরোসেন্ট আলো কাচের জানালা চুইয়ে মাটিতে পড়েছে। সামনের পাহাড় গুলো সেভাবে দৃশ্যমান না হলেও চাঁদের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। বাকিদের ডাকলো সুজন। সবাই উপভোগ করতে লাগল এই দৃশ্য। তারপর সদর দরজায় তালা দিয়ে নিজেদের ঘরে চলে এলো সকলে। সব দরজা জানালা ভালো করে আটকে দিল ওরা। এখানে ঠান্ডায় মশার উৎপাত নেই তাই মশারির বালাই নেই। সকলে শুয়ে পড়ল লাইট নিভিয়ে। চাঁদের আলো নাইট-ল্যাম্পের মতো জ্বলবে সারারাত। ভোর চারটে তে ঘুম ভাঙলো সুজনের। সকলকে সে ডেকে দিল। রাজন্যা তার গো প্রো ক্যামেরাটি জানালায় সেট করে দিল টাইমল্যাপস তোলার জন্য। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে একটি উজ্জ্বল আলো পাহাড়ের উপরে সাদা টিপ এর মত ধীরে ধীরে দিগন্তে নামছে। সূর্যকে নিমন্ত্রণ পত্র দিতে শুকতারাকে এখনই দিগন্তের ওপারে যেতে হবে যে। ক্রমশ শুকতারা অস্ত গেল। লাল হয়ে উঠল পূর্বদিক। ওরা সকলে প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়ল। ভোরে ঠান্ডা টা যেন রাতের চেয়েও বেশি। পাহাড়ি কিছু ক্রিসেনথিমাম এর প্রজাতির পাতার কিনারা গুলো বরফে পরিণত হয়েছে। নীলাদ্রি বলল, "পাতা যেমন বাষ্পমোচন করে তেমনি কিছু প্রজাতি জল মোচনও করে হাইডাথোড বা জলরন্ধ্রের সাহায্যে। এখানে সেই জলই ঠান্ডায় বরফে পরিণত হয়েছে।" প্রিমুলা লজের নাম সার্থক, অসংখ্য প্রিমুলা ফুলের গাছ রয়েছে সেখানে। তবে প্রিমুলা বর্ষার জল না পেলে ফোটে না। ওরা এগিয়ে চলল চীনের প্রাচীর সম রাস্তা দিয়ে টংলু পাহাড়ের দিকে। ক্ষণে ক্ষণে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারদিক। মেঘ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মুখমন্ডল। সবাই এগিয়ে গেলেও পিছিয়ে পড়েছে নীলাদ্রি, তার চোখ নাম-না-জানা অচেনা তৃণের দিকে। কুয়াশায় বাকি চারজন কে দেখা যাচ্ছে না তবে ত্রিহানার গলা শোনা যাচ্ছে। সুরেলা কন্ঠে সে আবৃত্তি করছে কবির কুয়াশা কাব্যটি -
"কুয়াশা থেকে এসে কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া/ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশায় পথ চলা/এভাবেই ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়া/এভাবেই চলে যেতে হয় বুঝি!/কোথা থেকে শুরু এই পথ/আরো কত দূর যেতে হবে/এ রহস্য আজও অজানা/জীবনের কিছু খেলা ক্ষণিকের/সে আনন্দ পলকে মিলায়/পলকে পৃথিবী যেন স্থবির হয়ে যায়/জানিনা এ গল্প কোন মোড় নেবে/প্রতিটা বাঁক কি এভাবেই মিলায়/ঘন কুয়াশায়…"
সত্যিই ঘন কুয়াশায় কত যে রহস্য আছে, পাহাড়ের কোন বাঁক কি মেলে ধরে তা বোঝা মুশকিল। নীলাদ্রি অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে থাকে। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা রং পাল্টাচ্ছে। এখান থেকে সান্দাকফু ও দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। টংলু পাহাড়ের চূড়ায় কে যেন একটা সোনার ফুটবল রেখে দিয়েছে। পাহাড়ের ঢাল এখানে মৃদু, ঢাল বেয়ে অনেকটা নামা যায়। সূর্যের আলো খাদে পড়তেই একদিকে ঝলমলিয়ে উঠল সাদা ম্যাগনোলিয়া। অপরদিকের ঢালে মেটে সিঁদুর রঙে সুসজ্জিত রডোডেনড্রন এর দল। দুই দল প্রস্তুত সোনালী ফুটবল নিয়ে খেলার জন্য। এমন সময় একদল পর্যটক এর সাথে দেখা হল নীলাদ্রির। তারা জিজ্ঞেস করলো, "কোথা থেকে আসছেন? কোথায় উঠেছেন? আমরা রাজধানী থেকে আসছি, উঠেছি মাউন্টেন ভিউ লজে। নীলাদ্রি বলল, "আমরা এসেছি তিস্তাপারের জলশহর থেকে, প্রিমুলা লজে উঠেছি।" এই শুনে উনারা নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। আর বলল যে পারলে যেন ওরা অন্য লজে শিফট করে। নীলাদ্রি বলল, "কেন এমন বলছেন?" উনারা বললেন, "এই লজের খাওয়ায় গন্ডগোল আছে, সবাই তাই বলে, এর বেশি কিছু জানিনা।" তারপর আসছি বলেই চলে গেলেন। নীলাদ্রির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। কিন্তু এখনি কাউকে কিছু বলল না। অন্যদের আনন্দের মুহূর্ত টা নষ্ট করতে চায় না সে। সবাই ফিরে এলো লজে প্রাতরাশ এর জন্য। ডিম টোস্ট ও চা সহযোগে প্রাতরাশ শেষে বাংলাদেশের পর্যটক দুজন সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। লজে এখন শুধু ওরা রইল। আজ ওরা যাবে টংলু পাহাড়ে, ওখানে একটি ভেষজ উদ্যান আছে, প্রাকৃতিক এই ভেষজ উদ্যান সমতলের ভেষজ উদ্যানের মত নয়। কোনো কৃত্রিমতা নেই এখানে, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ তাদের ইচ্ছেমতো জন্মেছে এখানে। তাদের মাঝ বরাবর ফুট তিনেক চওড়া বোল্ডার এর রাস্তা সর্পিল ভাবে রয়েছে। সকলেই বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। নীলাদ্রি অপরিচিত গাছ হারবেরিয়াম করার জন্য প্রেষণ যন্ত্রটা লজে ফেলে এসেছে তাই সকলকে এগোতে বলে ফিরে এলো লজে। লজের সামনেটা শুনশান কিন্তু পিছনে যেখানে রডোডেনড্রন এর বাগানটা রয়েছে সেখান থেকে চাপা উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনলো সে। খুব সাবধানে পিছনে গিয়ে নিজেকে আড়ালে রেখে দেখতে পেল একটি কমবয়সী ছেলেকে বিনোদ বাবু নেপালি ভাষায় ধমকাচ্ছেন। সম্ভবত ছেলেটি কিছু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ছেলেটি কাঁচুমাচু মুখে চলে যেতেই ফিরে আসলেন আর নীলাদ্রি পড়ে গেল তাঁর সামনে। তিনি নিজেই বললেন, "আর বোলো না ভাই কুমতলবে রান্নাঘরে ঢুকেছিল, ধরে ফেলেছি তবে কিছু পায়নি বোধহয়, রান্না তো কিছু হয়নি এখনো। যাক সে কথা তোমার বন্ধুরা তো সবাই বেরোলো দেখলাম তুমি যাওনি? নীলাদ্রি একটু বুদ্ধি করে বলল, "শরীরটা একটু খারাপ লাগছিলো তাই ফিরে এলাম।" বিনোদ বাবু চমকে উঠে বললেন, "পেট খারাপ হয়নি তো?" নীলাদ্রি বলল, "না না এমনি একটু ঠান্ডা লেগেছে। কিন্তু আপনি চমকে উঠে হঠাৎ পেট খারাপের কথা বললেন কেন?" বিনোদ বাবু আমতা আমতা করতে লাগলেন। নীলাদ্রি তাকে আশ্বস্ত করে বলল, " বিনোদ বাবু আপনি শান্ত হোন, চলুন কিছু কথা আছে আপনার সাথে। লজে নয় অন্য কোথাও বসি।" বিনোদ বাবু নিমরাজি হয়ে বললেন, "চলো তাহলে ওই ফাঁকা চত্বরটায় বসি।" দুজনে সেখানে এলে নীলাদ্রি বলল, "দেখুন আমি আপনার লজে আগেও থেকেছি তখন এর রমরমা দেখেছি।রান্না থেকে শুরু করে খাওয়া সার্ভ করার আলাদা লোক ছিল আপনার। অথচ এখন সিজন টাইমেও আপনি ছাড়া আর কোন কর্মচারী নেই, আমরা ছাড়া কোন অতিথি নেই।" আজ সকালের সেই পর্যটকদের থেকে শোনা কথাগুলি ও বলল নীলাদ্রি। "আর এখন আমার শরীর খারাপ শুনে আপনার চমকে ওঠা, সব মিলিয়ে আমি একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। দেখুন আমি আপনাকে যতদূর বুঝতে পারছি আপনি বেশ বিপদে আছেন কারণ আপনি নিশ্চয়ই নিজে আপনার লজের দুর্নাম চাইবেন না। আপনি আমাকে ভরসা করে বলতে পারেন কি হয়েছে।" বিনোদ বাবু কিছু আশ্বস্ত হয়ে বললেন, "ঠিক আছে আমি যতটুকু জানি বলছি, তবে ব্যাপারটা আমারও পুরোপুরি বোধগম্য হচ্ছে না। বেশ রমরমিয়ে চলছিল আমার লজ। মাস চারেক আগে অফ সিজন তখন। তাও কিছু উৎসাহী পর্যটক আসে বরফের সৌন্দর্যের টানে। আমার লজ মোটামুটি হাউসফুল। একজন অস্ট্রিয়ান পর্যটক ছিল সেবার, নাম তার জোনাথান ফিন। একদিন ডিনারের পর আমার সাথে কথা বলতে এলেন তিনি। বললেন যে তোমরা এখন যে ডরমিটরি তে আছো লজের সেই অংশটা পিছনের বাগান সমেত তিনি কিনতে চান। সত্যি কথা বলতে কি টুমলিং এ যতগুলি লজ আছে ওই লোকেশনটা সবচেয়ে সুন্দর। ওটা আমি পরে কিনেছি। ওটা কেনার সময় বিভিন্ন লজের সাথে কঠিন প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে আমাকে। এর আগেও অনেক পর্যটকও ওটা কিনতে চেয়েছে। কিন্তু আমি রাজি হইনি। আমি ভেবেছিলাম এই সাহেবও সেরকমই কেউ। আমি সরাসরি বলে দিই বিক্রি করব না। সাহেব আমাকে টাকার লোভ দেখান। টাকার অংক বাড়িয়ে আমার কেনা দামের দশ গুণ পর্যন্ত বলেন। তাও আমি রাজি হইনি। সাহেবের মুখটা রাগে বীভৎস হয়ে যায় আর শীতল কন্ঠে আমাকে শাসিয়ে বলেন এর ফল খারাপ হবে। আমার ন্যায্য টাকায় কেনা জমিতে ন্যায্য ভাবে তৈরি লজ। সমস্ত টাকা-পয়সার হিসাব আমার ঠিকঠাক। কে ক্ষতি করবে আমার? তাই আমি পাত্তা দিলাম না সাহেবের হুমকি কে। সাহেব চলে গেলেন নিজের ঘরে। ঘটনাচক্রে আমি যে ঘরে পরিবার নিয়ে থাকি তার পাশের রুমে ছিলেন সাহেব। আমি সমস্ত কাজ শেষে ঘরে গিয়ে সবে শুয়েছি এমন সময় শুনতে পেলাম চাপা গলায় সাহেব ফোনে কথা বলছেন, "Ningma, I want some blue rocket, bye." এই বলেই সব চুপচাপ। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে সাহেব চেক আউট করে বেরিয়ে গেলেন। দুদিন পর তখন আমার লজে প্রায় ৩৬ জন পর্যটক ছিলেন। রাতের ডিনার এর পরে হঠাৎই সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রত্যেকেরই পেটে ভীষণ ব্যথা, ডায়রিয়ার মত অবস্থা। রাতে চিকিৎসক পাওয়াও সম্ভব নয়। অন্য লজে একজন ডাক্তার বাবু পর্যটক ছিলেন। তিনি সকলের প্রাথমিক চিকিৎসা করেন। পরদিন সকলকে মেডিকেল কলেজে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিই। সবাই সন্দেহ করছে যে ফুড পয়জনিং হবে। অথচ এর আগে কখনোই এরকম হয়নি। সে যাত্রায় কারোর কিছু ক্ষতি হয়নি। কিন্তু দুদিন পর নতুন পর্যটক আসতেই আবার ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এবারও সকলের ওই একই উপসর্গ। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো যে আমার লজের খাদ্যের গুণগত মান খারাপ। পর্যটক আসা কমতে লাগলো। আমি প্রমাদ গুনলাম কর্মীসংখ্যা কমিয়ে দিলাম। আমার কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত আমার ভাইয়ের ছেলে নরবু কে রান্নার দায়িত্ব দিলাম আর বাকিটা আমি সামলে নিচ্ছিলাম। এখন নরবু অসুস্থ বলে বাড়ি গেছে তাই আমি একাই সামলাচ্ছি সব।" এমন সময় একটি গাড়ি এসে থামল প্রিমুলা লজের সামনে। একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক নামলেন। বিনোদ বাবু এগিয়ে গেলেন। কথাবার্তায় বোঝা গেল উনি আজকে থাকবেন। বিনোদ বাবু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নীলাদ্রি প্রেষণ যন্ত্রটা নিয়ে হাঁটতে লাগলো টংলুর দিকে। একটা পিকআপভ্যান পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, হাত দেখাতেই দাঁড়িয়ে পড়ল। নীলাদ্রি লিফট চাইলে ওরা লিফট দিতে রাজি হল। গাড়ি গুলি পানীয় জল বহন করে লজ গুলিতে পৌঁছে দেয়। খুব তাড়াতাড়ি টংলু পৌঁছে গেল সে। ভেষজ উদ্যানের গেটের কাছে নীলাদ্রিকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল গাড়িটি। নীলাদ্রি দেখলো রাস্তার দুই ধারে বচ গাছ। নীলরঙা ফুল ফুটে রয়েছে তাতে। মাঝে মাঝে সাপের ন্যায় ফণা তুলেছে এরিসিমা গাছের ফুলগুলি। পাকদন্ডী বেয়ে নিচের দিকে নামতে লাগল সে। গতবার এদিকটায় আসা হয়নি। এবার দেখল রোজেসী ফ্যামিলির গাছে পরিপূর্ণ জায়গাটি। বেশিরভাগই রুবাস এর প্রজাতি। তবে একটি গাছেও এখন ফুল নেই। রুবাসের ফুল বর্ষাকালে হয়। আসলে এই বনভূমি সারা বছরই নতুন নতুন সাজে সজ্জিত হয়। আর একটু এগোতেই দেখতে পেল নাম-না-জানা অর্কিড। হারবেরিয়াম এর জন্য স্পেসিমেন কালেক্ট করে নিল সে। এই অরণ্যে গাছ কালেকশন অন্যায় কিন্তু নীলাদ্রি উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার সুবাদে পারমিশন নিয়ে নিয়েছিল আসার সময়। আরও কিছুটা এগিয়ে শুরু হলো রডোডেনড্রন। সার সার লাল ফুলে ভ'রে রয়েছে জায়গাটা। যেদিকে দুচোখ যায় শুধুই লাল। এখানেই নীলাদ্রি বাকিদের পেয়ে গেল। ওরা সবাই রাজন্যার ক্যামেরার সদব্যবহারে ব্যস্ত। নীলাদ্রিকে আসতে দেখে প্রীতম বলল, "কিরে তোর এত সময় লাগলো, আমরা তো চিন্তা করছিলাম।" নীলাদ্রি বাকিদের কিছুক্ষণ আগের কথাটা বলল। তারপর আবার সবাই মিলে নামতে লাগল পাকদন্ডী বেয়ে। খাদের দিক থেকে ভেসে আসছে রেড পান্ডার ডাক। এটি খুব লাজুক ও বিপন্ন প্রাণী। রাস্তার দুধারে এখন এক বিশেষ ধরনের সরু ও কম উচ্চতাসম্পন্ন বাঁশগাছ। এটি পাণ্ডাদের খুব প্রিয় খাদ্য। প্রতিটি বাঁশের অগ্রভাগ কচি বলে পান্ডাদের পেটে গেছে সেগুলি। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেছিল ত্রিহানা। সে আবিষ্কার করল একটি পাহাড়ি ছাগলের শিং, হাড়, ক্ষুর ও লোম। অর্থাৎ মাংসাশী জন্তুর আক্রমণ হয়েছিল। এই জঙ্গলে ভালুক রয়েছে যা খুবই ভয়ানক। ভালুকগুলি শীতে হাইবারনেশন এ যায়, আর বসন্তে জেগে যাওয়ার পর ভীষণ ক্ষুধার্ত থাকে। তাই সকলে আর না এগিয়ে ফেরার পথ ধরল। নামতে যতটা ভালো লেগেছিল, ওঠাটা অতটা সহজ হলো না। লজে পৌঁছতে পৌঁছতে তিনটা বেজে গেল। ওদের আসতে দেখে বিনোদ বাবু ওদের পছন্দমত 'থুকপা' তৈরি করতে লাগলেন। ওরা ফ্রেশ হয়ে এলে গরম গরম সার্ভ করলেন। খাবার পর সবাই ডরমিটরি তে এসে বসলো।নীলাদ্রি ওর সংগৃহীত উদ্ভিদের স্পেসিমেন গুলো দেখালো সবাইকে। এরপর রাজন্যা তার তোলা ফটোগুলি দেখাতে লাগলো। নীলাদ্রির দেখা ফুলগুলির অসাধারণ সব ফটো তুলেছে রাজন্যা। এছাড়াও ওর পতঙ্গদের ফটো। একে একে নাম বলে চলেছে রাজন্যা। এনগ্রাইল্ড, ইয়েলো টেইল, পিস ব্লজম, গোল্ডেন প্লাসিয়া -এগুলি সবই বিভিন্ন প্রজাতির মথ। লং টাং বাম্বেলবী মৌমাছি, হিমালায়ান কমন পিকক, দার্জিলিং ব্লু টিট প্রজাপতি এরকম আরো অনেক কিছু। সর্বোপরি আসে ত্রিহানা, সুজন, প্রীতমের গুরাসের দৃশ্যপটে বিভিন্ন পোজে ছবি। নীলাদ্রিরও একটা ছবি আছে। কিন্তু রাজন্যার কোনো ছবি নেই। কারণ জিজ্ঞেস করায় রাজন্যা দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল, "ফটোগ্রাফারের এই এক দুঃখ তার কেউ ফটো তুলে দেয় না।" নীলাদ্রি বলল, "ভারি অন্যায় হয়েছে আমাদের, কাল তোমারও ফটো তুলে দেব।" এরপর ক্যামেরা মোবাইল চার্জে বসিয়ে সবাই একটু ঘুমিয়ে নিল। ঘুম ভাঙলো বিনোদ বাবুর ডাকে। ডিনারের জন্য ডাকতে এসেছেন উনি। নীলাদ্রি দরজাটা খুলতেই তার চোখ পড়ল রান্নাঘরের দিকটায়। একটা ছায়ামূর্তি ছিটকে সরে গেল যেন।নীলাদ্রি তাড়াতাড়ি বিনোদ বাবুকে বলল সেখানে যেতে। তারপর সবাই বেরিয়ে চলে এল ডাইনিং স্পেসে। আজকে আসা নতুন ভদ্রলোকও আসলেন। রান্নাঘরে কাউকে পাওয়া গেল না। নতুন ভদ্রলোকের নাম রজত ব্যানার্জি। ব্যাংকে চাকরি করতেন এখন রিটায়ার্ড। শখ পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো। বিপত্নীক মানুষ, ছেলে আমেরিকায় থাকে, উনার তাই কোনো পিছুটান নেই। সকলের সাথে পরিচিত হলেন রজত বাবু। এই সময় বিনোদ বাবু খাবার সার্ভ করলেন। কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে যাওয়ায় রজত বাবু ডালে চুমুক দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা ঘটে গেল ওনার মধ্যে। এই শীতের রাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হল। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হল। ছটফট করতে লাগলেন। পেটে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে বললেন। তাঁর চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। কি বলছেন আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সুজন নিজের জলের বোতল থেকে জল খাওয়ানোর বৃথা চেষ্টা করলো। একটুও জল খেতে পারলেন না। ধীরে ধীরে নাড়ির গতি অসম্ভব ক্ষীন হয়ে গেল। ডাইনিং স্পেসের একটা বেঞ্চে শুইয়ে দেওয়া হলো তাঁকে। কিন্তু ধরে রাখা যাচ্ছে না ওনাকে শোওয়া অবস্থায় থেকেও এলিয়ে পড়ছেন যেন। শ্বাস-প্রশ্বাস ধীর হয়ে পড়লে হঠাৎ একদম নিস্তেজ হয়ে পড়লেন উনি। নীলাদ্রি সকলকে কোন খাওয়া খেতে নিষেধ করে দিল। জলের বোতলের জল ফেলে দিয়ে রজতবাবুর ডালের বাটি থেকে ডাল ঢেলে নিল বোতলে সুজন। ত্রিহানা ও রাজন্যা হাত পা ঘষে ও হাওয়া করে রজত বাবুর সেবা করতে লাগলো। সুজন বিনোদ বাবু কে সঙ্গী করে বাকি লজ গুলিতে কোন ডাক্তার আছেন কিনা তা দেখতে ছুটল। প্রীতম ওর গাড়িটাকে বের করে আনল কারণ কোন ডাক্তার পাওয়া না গেলে কাছেপিঠের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এখানে সবচেয়ে কাছের হাসপাতালও কুড়ি কিলোমিটার পাহাড়ি পথ। সুখিয়াপোখরি ব্লক হাসপাতাল। রাস্তাও খুব একটা ভালো নয়। সময় অনেকটা লেগে যাবে। সুজন ও বিনোদ বাবু ফিরে এলেন। কোন ডাক্তার নেই আজ টুমলিং এ। নীলাদ্রি বলল নাড়ির গতি ভীষণ ক্ষীন আর দেরি করা যাবে না। প্রীতম গাড়িতে স্টার্ট দিল। বিনোদ বাবু সামনের সিটে বসলেন। পিছনে সুজনের কোলে রজত বাবুর মাথা। বিনোদ বাবু মানেভাঞ্জন পুলিশ ফাঁড়িতে ফোন করে জানালেন খবরটা। ত্রিহানা, রাজন্যা ও নীলাদ্রি ডাইনিং স্পেসেই অপেক্ষা করতে লাগল। এভাবে একটা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিলে ওরা সবাই। লজে আর কোনো ঘটনা ঘটেনি। ধীরে ধীরে নিয়ম মেনে ভোর হলো, সূর্য উঠলো, উপত্যাকা সেজে উঠল লাল ও সাদা রঙে। এমন সময় নীলাদ্রির ফোনটা বেজে উঠলো। সুজনের ফোন। সুজন বলল, "আপাতত সব ঠিক আছে, ডাক্তার বললেন যে আরেকটু দেরী হলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারত। বিষক্রিয়া হয়েছিল বোঝা যাচ্ছে। পাম্প করে যদিও বিষ বের করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবুও হৃদপেশীর ক্ষতি হয়েছে। মায়োকার্ডিয়াম পেশীতে সোডিয়াম চ্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ক্ষুদ্রান্ত্রের একটা অংশের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে, এছাড়া স্মায়বিক দৌর্বল্য দেখা দিচ্ছে। হাসপাতালের পথে গাড়িতেই উনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন, এখনও জ্ঞান ফেরেনি, ৭২ ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা যাচ্ছে না বা কোথাও স্থানান্তরিতও করা যাবে না। তবে আজ সকালের মধ্যে মেডিকেল কলেজ থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এসে যাবেন। আর মানেভাঞ্জন এর পুলিশ বিনোদ বাবুকে সাময়িক অ্যারেস্ট করেছে। কিছুতেই আমাদের কথা শুনল না। তবে আমাদের ও জেরা করেছে এবং আজ সকালের মধ্যে টুমলিং যাবে জেরার জন্য।" নীলাদ্রি সব শুনে বলল, "সেটাই স্বাভাবিক, উনাদের ওঁদের কাজ করতে দিতেই হবে। আর তোরা ওঁদের জানিয়ে এখানে চলে আয় ওখানে তো আর কোন কাজ নেই তোদের।" আচ্ছা বলে ফোন রাখলো সুজন। নীলাদ্রি দেখল সেই আগের দিনের পর্যটক এর দলটি যারা নীলাদ্রিকে বলেছিল হোটেল পরিবর্তন করতে, তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন গেটের সামনে। শুকনো হেসে নীলাদ্রিকে বললেন, "এইজন্যই বলেছিলাম আপনাদের, শুনলেন না, এখন কেমন ফেঁসে গেলেন দেখুন তো।" নীলাদ্রিও হাসি বিনিময় করে একটু উদাস হয়ে এগিয়ে গেল অন্যদিকে। মানুষ শুধু বিপদ দেখে সরে পড়তে জানে। প্রতিকারের কথা ভেবে দেখেনা। কাল দুপুরের পর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। রান্নার জিনিসগুলোকে ভরসা করা যাচ্ছে না। যদিও সম্ভবত শুধুমাত্র ডালেই বিষ মেশানো হয়েছে। কারণ ওটিই একমাত্র কমন পদ। রজত বাবু ডাল, রুটি ও মাংস অর্ডার করেছিলেন। আর নিলাদ্রীরা ডাল, পনিরের তরকারি ও ভাত। তাই খুব তাড়াতাড়ি বিষ মেশাতে হলে ডালে মেশানোই উচিৎ। নীলাদ্রির মন বলছে বিনোদ বাবু কোনমতেই এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নন। উনি যখন নীলাদ্রিদের ডাকতে এসেছিলেন সেই সুযোগেই ছায়ামূর্তি এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। ওদের সঙ্গে কিছু ড্রাই ফুড ছিল। সুজন ও প্রীতম এর জন্য রেখে ওরা খেয়ে নিল কিছুটা। তারপর কাল রাতে ছায়ামূর্তিকে যেদিকে যেতে দেখেছিল সে দিকে এগোলো নীলাদ্রি। শক্ত মাটিতে কোন পায়ের ছাপ পাওয়া না গেলেও একটা পায়েহাঁটা দুর্গম পথ চোখে পড়ল। সেটি চলে গিয়েছে গ্রামের দিকে। ছোট্ট গ্রাম তবে সাজানো। তার মানে যে এসেছিল সে স্থানীয়। এমন সময় দুটি গাড়ি এসে থামল লজের সামনে। একটা পুলিশের জিপ আর তার পেছনে প্রীতমের গাড়ি। দুজন পুলিশ এগিয়ে গেলেন ত্রিহানা রাজন্যার দিকে। নীলাদ্রি ও সেখানে গেল। পুলিশের জেরা শেষ হলে নীলাদ্রি ডালের স্যাম্পলটা পুলিশের হাতে তুলে দিল। আর নিজে যতটা শুনেছিল বিনোদ বাবুর থেকে সেটা ও নিজের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানালো। পুলিশ ইন্সপেক্টর খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন নীলাদ্রির পর্যবেক্ষণ। নীলাদ্রি জানালো যে সে ওই অস্ট্রিয়ান সাহেব জোনাথন ফিনকে সন্দেহ করে। তাঁর ব্যাপারে একটু খোঁজখবর নিলে ভালো হয়। ইন্সপেক্টর আশ্বাস দিলেন ও ওদের সাবধানে থাকতে বলে চলে গেলেন। ওরা ঠিক করল খাওয়াটা অন্য লজে খেয়ে নেবে কিন্তু এই লজেই থাকবে। পুলিশ তাতে সম্মতি দিয়েছে, তবে রান্না ঘরের সমস্ত নমুনা নিয়ে ফরেনসিক ল্যাব এ পাঠানোর পর রান্নাঘরটি সিল করে দিয়েছে। নীলাদ্রি সকলকে বলল একটু ঘুমিয়ে নিতে। সকলের ঘুম হলে ওও ঘুমিয়ে নিল। আজকে সারাটা দিন ডরমিটরিতে কাটিয়ে লাঞ্চের জন্য গেল পাশের লজে। লাঞ্চ সেরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো একটা বুদ্ধিস্ট মনাস্ট্রীর কাছে। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মনাস্ট্রীর স্বর্ণালী চূড়াটি চকচক করছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, সাথে তুলোর মতো মেঘ যাতায়াত করছে। কাল রাত থেকে ধকল গেলো অনেক। ত্রিহানার মনে চাপ পড়লে গুনগুন করে গান গায় ও। এখনো রবীন্দ্রসঙ্গীতের কলি গুনগুন করছে-
"এই মৌমাছিদের ঘরছাড়া কে করেছে রে/তোরা আমায় বলে দে ভাই বলে দে রে/ফুলের গোপন পরান মাঝে/নীরব সুরে বাঁশি বাজে/ওদের সেই সুরেতে কেমনে মন হেরেছে রে/যে মধুটি লুকিয়ে আছে/দেয় না ধরা কারো কাছে/সেই মধুতে কেমনে মন ভরেছে রে…"
নীলাদ্রি প্রথমটা খেয়াল করেনি ত্রিহানার গানের কলি গুলো, সুরে হারিয়ে যাচ্ছিলো সে। সংবিৎ ফিরতেই ওকে আবারও গাইতে বলল। মৌমাছি ও মধু শব্দ দুটিতে খটকা লাগল তার। রাজন্যা কাছেই ছিল দৌড়ে ওর কাছে গিয়ে আগের ফটোগুলো দেখাতে বলল নীলাদ্রি। রাজন্যা বাম্বেলবীর ফটোটা দেখাতেই নীলাদ্রি বলে উঠলো, "সাবাস, ত্রিহানার গান ও রাজন্যার ফটোগ্রাফি আমাকে রহস্যের জট খুলতে সাহায্য করল।" সবাই যখন ওর দিকে হা করে তাকিয়ে তখনই পুলিশ অফিসারের ফোন এল নীলাদ্রির কাছে। জানা গেল যে ফরেনসিক রিপোর্ট অনুসারে ডালের মধ্যে যে বিষ পাওয়া গেছে তাই রজত বাবুর পেটেও পাওয়া গেছিল। তবে ডাল ব্যতীত অন্য কোন খাদ্যদ্রব্যে বিষ পাওয়া যায়নি। এই বিষ অ্যালকালয়েড প্রকৃতির। নীলাদ্রি ও এমনটাই আশঙ্কা করেছিল। নীলাদ্রি জিজ্ঞেস করল জোনাথন ফিনের ব্যাপারে। অফিসার তার উত্তরে জানাল যে মাস চারেক আগে ওই নামে একজন এসেছিলেন ইন্ডিয়ায় কিন্তু দিন তিনেক থেকে উনি নেপালে ফিরে যান। নীলাদ্রি বলল, "কিন্তু ওই ভদ্রলোকের খোঁজ আমাদের পেতেই হবে। নেপাল পুলিশের সাথে কথা বলা যায়না?" অফিসার বললেন যে সেটা একটু কঠিন তবে টুমলিং যেহেতু নেপালে পড়ে তাই উনি একটা চেষ্টা করে দেখবেন। ফোন রেখে নীলাদ্রি ইন্টারনেটে অ্যাকোনিটাম লিখে সার্চ করল। অ্যাকোনিটাম একটি ভীষণ সুন্দর ফুল যা এই অঞ্চলে পাওয়া যায়। গাঢ় বেগুনি বা উজ্জ্বল নীল রঙের পাপড়িযুক্ত ফুল। একসাথে অনেকগুলো ফুল একটি মঞ্জরিতে হয়। ব়্যানানকুলেসী পরিবারের এই গাছটির দুটি সদস্য অ্যাকোনিটাম নেপালাস ও অ্যাকোনিটাম ফেরক্স এর জন্মভূমি সিঙ্গালিলা। প্রীতম জিজ্ঞেস করল, "কিন্তু এর সাথে এই কেসের কি সম্পর্ক?" "ধৈর্য্য ধরো দাদা অনেক সম্পর্ক আছে" এই বলে রাজন্যার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল নীলাদ্রি। রাজন্যা ক্যামেরায় তোলা তার প্রতিটি মথের ছবি দেখিয়ে বললো যে প্রতিটি মথেরই শুককীট দশা (শুঁয়োপোকা) অ্যাকোনিটামের পাতা খেয়ে বড় হয়ে ওঠে। এবার নীলাদ্রি বলল, "হ্যাঁ, এটা আমি জানতাম না তবে যেটা জানতাম সেটা হল বাম্বেলবী এই ফুলের পরাগমিলনে সহযোগিতা করে।" ত্রিহানা বলল, "তাহলে এই গাছ আমরা দেখলাম না কেন?" সুজন ফুট কাটলো, "তুই আবার গাছ চিনিস নাকি?" ত্রিহানা বলল, "দেখ দাদা নীলাদ্রিদা তো বর্ণনা করলই গাছটার, নীলাদ্রিদার বর্ণনা শুনেই তো চিনে যাওয়া উচিত, কিন্তু সত্যিই আমার চোখে পড়েনি।" এবার নীলাদ্রি বলল, "হুমম, কারনটা হল ওই গাছের ফুল ফোটার সময় এটা নয়। শরৎকালে ফুল ফোটে ওর। কিন্তু গাছটা তো থাকে সারা বছর। আর বাম্বেলবী বা ঐ মথগুলোর উপস্থিতিতে বোঝা যাচ্ছে এই গাছ এখানে রয়েছে। এবার এখানে দেখো সবাই অ্যাকোনিটাম গাছের মূল থেকে অ্যাকোনিটিন উপক্ষার পাওয়া যায় যা অত্যন্ত বিষাক্ত। এর বিষক্রিয়ার ফলে যা যা উপসর্গ দেখতে পাওয়ার কথা রজত বাবুর ক্ষেত্রে প্রত্যেকটিই হয়েছে। আমার ধারণা এর আগের পর্যটকদের একসাথে পেট খারাপের ঘটনাটাও এই বিষের অল্প মাত্রায় প্রয়োগের ফল। আর সবচেয়ে বড় কথা হল অ্যাকোনিটামের অনেকগুলি কমন ইংরেজি নামের একটি হল 'ব্লু রকেট'। মনে আছে কারোর এই শব্দটা?" ত্রিহানা বলল, "হ্যাঁ, এটাতো জোনাথন সাহেব ফোনে কারো কাছে যেন চেয়েছিলেন। তাহলে কি…?" নীলাদ্রি বলল, "হ্যাঁ ঠিকই ধরেছিস। এজন্যই পুলিশকে আমি জোনাথন সাহেবের কথা বলেছি। উনার মোটিভ টা খুবই পরিষ্কার। দুর্নাম করো এই লজের তাহলে পর্যটক এর সংখ্যা কমবে। আর ব্যবসায় মন্দা হলে বিনোদ বাবু লজটা বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। কিন্তু এবারের ডোজটা বেশি হয়ে যাওয়ায় রজত বাবুর ব্যাপারটা পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়ে যাওয়ায় সব গন্ডগোল হয়ে গেল ওদের।" এই বলে নীলাদ্রি ফোন করল পুলিশ অফিসারকে। নীলাদ্রি বিনোদ বাবুকে নিয়ে লজে আসতে বলল পুলিশ অফিসারকে। পুলিশ অফিসার কনভিন্স হয়ে ওদেরকে বিশ্বাস করে রাজি হলেন এ কাজে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অফিসার বিনোদ বাবুকে নিয়ে চলে এলেন। টংলু শৃঙ্গকে রাঙিয়ে সূর্য তখন অস্তাচলে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। নীলাদ্রি অফিসার কে বলল, "বিনোদ বাবু নির্দোষ উনাকে ছেড়ে দিলে ভালো হয়। অপরাধী চিহ্নিত হয়ে গেছে। জোনাথন সাহেবের খবর কি অফিসার?" অফিসার বললেন, "নেপাল পুলিশ সহযোগিতা করেছে। পশুপতি নগরের একটি লজে আছেন উনি, সঙ্গে একজন নেপালি ছোকরা রয়েছে। আমাদের তরফ থেকে নির্দেশ পেলে তবেই উনাকে আটক করা হবে।" নীলাদ্রি বলল, "আপনাকে ফোন করার পর আমরা গ্রামে গিয়েছিলাম বিনোদ বাবুর ভাইপো নরবুর সাথে দেখা করতে। কিন্তু অবাক কান্ড বিনোদ বাবু, আপনার অসুস্থ ভাইপো সপ্তাহ খানেক হলো নিরুদ্দেশ। আপনি হয়তো জানতেন না তাই না?" বিনোদ বাবু অবাক হয়ে বললেন, "সেকি? আমি জানতাম না। আসলে আমি লজেই থাকি গ্রামে যাওয়া হয় না। কেমন আছে জানার জন্য ফোন করলেও ফোন আউট অব রিচ বলছিল। ভেবেছিলাম নেটওয়ার্কের সমস্যা।" নীলাদ্রি বলল, "ওদিকে আপনার ভাই জানেন যে নরবু আপনার এখানেই আছে, তখনই সন্দেহ হল আমার। একটু আগে অফিসার বললেন যে একটি নেপালি ছেলে রয়েছে জোনাথন সাহেবের সাথে। অফিসার, আপনি কি আমার কৌতূহল নিরসন করবেন?" অফিসার বললেন, "বল কি করতে হবে?" নীলাদ্রি বলল, "আপনি পশুপতি নগরের ওই লজের রেজিস্টারের একটা ফটো পাঠাতে বলুন। আর বিনোদ বাবু আপনি মাফ করবেন আমায়, আপনার অবর্তমানে আপনার কর্মচারীদের মাইনের খাতাটি আমি একটু ঘাটাঘাটি করেছিলাম।" একটা নোটিফিকেশন এল অফিসারের মোবাইলে। ফটোটি খুলে নীলাদ্রির দিকে এগোতেই নীলাদ্রি বলল, "নেপালি ছেলেটির নাম নিংমা, তাই তো?" সবাইকে অবাক করে দিয়ে হ্যাঁ বললেন অফিসার। নিংমা তার নাম ও অন্যান্য তথ্যাদি যেখানে লিখেছে তার সাথে নরবুর মাইনের খাতায় লেখার হুবহু মিল রয়েছে। অফিসার বললেন, "দুজনের লেখা দেখে মনে হচ্ছে, দুজনেই বামহাতি।" বিনোদ বাবুও সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন। সুজন নীলাদ্রি কে জিজ্ঞেস করল, "কি করে বুঝলি নরবুই নিংমা ?" নীলাদ্রি বলল, "তোরা খেয়াল করেছিস কিনা জানিনা, যেদিন রজত বাবুর সাথে ওরকম টা হল সেদিন সব সময় বিনোদ বাবু রান্না ঘরেই ছিলেন। শুধু এক মিনিটের জন্য আমাদের ডাকতে এসেছিলেন আর সে সময়ে আমি একটা ছায়ামূর্তি দেখি। তারপরেই ওই ঘটনা। অর্থাৎ এত অল্প সময়ে সেই একাজ করতে পারে যে এই রান্নাঘরটাকে সবচেয়ে ভালোভাবে চেনে।" এই বলে নীলাদ্রি বলল, "বিনোদ বাবু একটু জল খাওয়াবেন?" বিনোদ বাবু রান্নাঘরে গেলে নীলাদ্রি সবাইকে বলল, "লক্ষ্য করে দেখুন উনার হাতের ব্যবহারটা। উনি ডানহাতি তাই জলভরার সময় বাম হাত দিয়ে পাত্রের মুখটা খুলে ডান হাতে গ্লাসে জল ভরলেন। আর বাম হাত দিয়ে পাত্রের মুখটা যখন ধরলেন তখন উপরের দিকে শুধু বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ থাকে। বাকি আঙ্গুলগুলো নিচের দিকে।" বিনোদ বাবু সকলকে জল দিলেন। জল খেয়ে নীলাদ্রি আবার বলল, "রজত বাবুকে নিয়ে তোরা হাসপাতালে গেলে আমি ডালের পাত্রটা লক্ষ্য করছিলাম ভালো করে। পিছনের গ্রাম থেকে লজে আসার শর্টকাট রাস্তাটি এক জায়গায় বেশ দুর্গম। দক্ষ ও অভ্যস্ত পাহাড়ি মানুষেরও হাতের সাহায্য নিতে হবে ওই জায়গাটা পেরোতে। সেই মাটি আমি দেখলাম ডালের পাত্রের ঢাকনায় লেগে রয়েছে এবং সেটা ডান হাতের ছাপ।" এই বলে সে দেখালো সবাইকে। এবার অফিসারকে বলল নীলাদ্রি, "আপনাকে সমস্ত তথ্য প্রমাণ দিলাম এবারে জোনাথন আর নিংমা কে অ্যারেস্ট করুন। অফিসার বললেন, "বাহ অসাধারণ পর্যবেক্ষণ তোমাদের, আমি মুগ্ধ। আমি চাই শেষ অধ্যায়েরও তোমরা সাক্ষী থাকো। আমি আমার ফোর্সকে বলে দিচ্ছি মানেভঞ্জন থেকে ওরা পশুপতিনগর পৌঁছাবে। আমরা এদিক থেকে রওনা দিচ্ছি সবাই। বিনোদ বাবু আপনি রেস্ট নিন। কাল সকালে পশুপতিনগর ঘুরিয়ে আপনার গেস্টদের আমি নিজে পৌছে দেবো এখানে।" এই বলে অফিসার জিপে স্টার্ট দিলেন। প্রীতমও গাড়িতে স্টার্ট দিল। সন্ধ্যার অন্ধকার চিড়ে দুই জোড়া হেডলাইট পশুপতিনগরের দিকে এগিয়ে চলল। জোনাথন যে লজে ছিল তার নাম পশুপতি লজ। ওরা পৌঁছাবার আগেই মানেভঞ্জন এর ফোর্স ও নেপাল পুলিশের সহযোগিতায় জোনাথন ও নিংমা ওরফে নরবুকে অ্যারেস্ট করে। হোটেলের ঘর তল্লাশি করে আড়াইশো গ্রাম এর মত অ্যাকোনিটিন পাওয়া গেছে। নরবু 'ব্লু রকেট' কোড ব্যবহার করে অ্যাকোনিটিনের চোরাকারবার করত। ওর জবানবন্দিতে ওর আরো তিন শাগরেদ কেও ধরা হলো। এর পরপরই আরো একটি সুখবর পাওয়া গেল যে রজত বাবুর জ্ঞান ফিরে এসেছে। উনি এখন সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত তবে হার্টের অনেক ক্ষতি হওয়ায় পাহাড়ে ভ্রমণ সম্পূর্ণ নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। মনটা ভাল হয়ে গেল ওদের সকলের। অফিসার ওদের পশুপতি মন্দির ঘুরিয়ে নিয়ে এলো পশুপতি মার্কেট এ। কি নেই সেখানে, বাচ্চাদের খেলনা থেকে শুরু করে, মেয়েদের গয়না, জামা কাপড়, রান্নাঘরের তৈজসপত্রাদি, ঘর সাজানোর জিনিস, ইলেকট্রনিক্সের সম্ভার। কুটির শিল্পে প্রস্তুত অনেক রকম মেমেন্টো। অফিসার সবাইকে একটি করে পশুপতি শিবের মূর্তি গিফট করলেন। প্রতিটি মূর্তি একে অপরের চেয়ে কারুকার্যে আলাদা। ধুপিকাঠ খোদাই করে স্থানীয় শিল্পীরা তাতে নিজেদের শিল্প কীর্তির ছাপ রেখেছে। চমরিগাই এর দুধ দিয়ে তৈরি সুরপি কিনল প্রীতম। এখানকার পশমের শীতবস্ত্র বেশ বিখ্যাত ত্রিহানা ও রাজন্যা দুটি পশমের জ্যাকেট কিনলো। রাতে ওরা পশুপতি লজেই রইল। ভোর হতেই অফিসার ওদের নিয়ে এলেন সুন্দরপানি ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে দৃশ্যমান হলো গোর্খা চা বাগান যেটি নেপালের সর্বোচ্চ চা রপ্তানিকারক চা বাগান। তেমনি সুন্দর এই চা বাগানটি। শেডট্রির ছায়ার দৈর্ঘ্য একটু কমতে ওরা রওনা হল টুমলিং এর উদ্দেশ্যে। মানেভঞ্জন থেকে অফিসার ওদের বিদায় জানালেন। ওরা পাঁচজন সুখিয়াপোখরি তে গেল রজত বাবুর সাথে দেখা করতে। রজত বাবু এখন অনেকটাই ভালো। চোখ খুলে বললেন, "তোমরা ছিলে বলে এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। ডাক্তার বললেন পাহাড় আর নয়। অনেক তো হলো এবার নাহয় সমুদ্র দেখব, কি বলো?" যোগাযোগ রাখবে এই আশ্বাস দিলেন রজত বাবু। ওরা সবাই বিদায় নিল রজত বাবুর থেকে। এরপর ওরা ফিরে এলো টুমলিং। বিনোদ বাবু ওদের আসতে দেখে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে লাগলেন আর বললেন, "দেখতো তোমরা ঘুরতে এলে, আর কি বিপদে ফেললাম আমি, ঠিকমতো ঘোরাই তো হল না। আজ মেঘমা থেকে ঘুরে এসো। খুব সুন্দর জায়গা, একটা মনাস্ট্রীও আছে। আর আজকে তোমরা আমার অতিথি এটা মাথায় রেখো।" ওরা সেদিন মেঘমাতে খুব আনন্দ করলো। পরদিন সকালে বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি হয়ে বিনোদ বাবুকে বলল সকলে যে ওরা সবাই কে প্রিমুলা লজের কথাই বলবে টুমলিং এ থাকার জন্য। বিনোদ বাবু ঝাপসা চোখে বিদায় দিলেন ওদের। মেঘের রাজ্য থেকে ওরা ফিরে এলো তিস্তাপারের জলশহরে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন