দ্বিতীয় বর্ষ ।। নবম ওয়েব সংস্করণ ।। ৩০ শ্রাবণ ১৪২৮ ।। ১৬ আগষ্ট ২০২১
আমাদের জীবন যাপনের সমীকরণ আমূল বদলে যাওয়ার প্রবণতা দ্রুততর হয়ে উঠেছে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে। শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, সংস্কৃতি সমস্ত ক্ষেত্রেই একটা অপরিকল্পিত পরিকল্পনা যোগ হয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে হনহনিয়ে। আর মানুষ সেটাকে মেনেও নিয়েছে মাথা পেতে। এ জন্যই হয়তো মানুষকে অর্থাৎ আমাদেরকে "পরিস্থিতির দাস" বলে।
১০০ টাকার সরষের তেল ২০০ টাকা। ৬৫ টাকার ডিজেল ১০০ টাকা। তেমনই বাকি খাদ্যদ্রব্য, প্রসাধনী দ্রব্য, পরিধেয় দ্রব্য সহ অন্যান্য সকল জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়েছে। চিকিৎসা খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি আদেশ উপেক্ষা করেই বৃদ্ধি পেয়েছে যাতায়াতের ভাড়া রাতারাতি। বৃদ্ধি পেয়েছে জ্বালানি গ্যাসের দাম। কেবল বৃদ্ধি পায়নি মজুরদের মজুরি। ব্যাটারি ফুরিয়ে আসা ঘড়ির কাঁটার মতো আটকে রয়েছে এক জায়গায়। আমরা তবু মেনে নিয়েছি। নির্দিধায় মেনে নিয়েছি। কারণ মেনে নেওয়াই আমাদের কাজ। আমাদের নিয়তি। মেনে নিতে না পারলে মানুষ হওয়া যায় না।
সেই ছোটোবেলা থেকে জেনে এসেছি, "যে সহে সেই মহাশয়।" আমরা সেই মহাশয় হওয়ার জন্যই হয়তো নীরবে মেনে নিয়েছি সবকিছু। আর আমাদের হাতে গড়া, আমাদের ভোটে গড়া, আমাদের ভালো করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সরকার এক শ্রেণীর দলদাস হয়ে আমাদেরকেও দলদাস বানানোর প্রয়াসে সব সময় সচেষ্ট। তাই দিনের পর দিন ধনী দরিদ্রের অবস্থানটা সুমেরু এবং কুমেরুর দিকে ছুটে চলেছে একটা নির্দিষ্ট গতি নিয়ে।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ এই সংস্করণ
_______________________________________________
দুর্গা দত্ত/ গৌতম সেন/ দীপংকর রায়/ পর্ণা দাশগুপ্ত মিত্র/ মুজিবর আনসারী/ উৎপল চট্টোপাধ্যায়/ দীপ্তিশিখা দাস/ সায়ন্তন ধর/ সৌরভ লায়েক/ সুজন পণ্ডা/ সন্দীপ মুখোপাধ্যায়/ পল্লব গোস্বামী/ ব্রততী পরামাণিক/ সৌরভ লায়েক/ পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়/ মধুপর্ণা/ তপন পাত্র
_______________________________________________
খঞ্জনি : তিরিশ
দুর্গা দত্ত
সব অঙ্ক উল্টে দিয়ে কোনো কিছু না ভেবেই
জংলীপথে হনহন হেঁটে যেতে যেতে
অকপটে বলেছিল ,শ্যামল-সুঠাম যুবা
কুল্যে তৃতীয় শ্রেণি ,ইস্কুলপালানো ,
মহিষবাগাল বন্ধু , মুর্মু সুচাঁদ :--
একসঙ্গে থাকা কাকে বলে, তুমি জানো ?
একযোগে থাকা কাকে বলে ?
গায়ে গায়ে লেগে থাকা নয়,
এক সুরে বেঁধে বেঁধে থাকা ? জানো ?
কাকে বলে যৌথজীবন ?
কাকে বলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকা ?
দূরে দূরে বহুদূরে থাকলেও
গানের সুরের মতো গুনগুন ছুঁয়ে ছুঁয়ে
গান হয়ে বেঁচে থাকা যায় , -- তুমি জানো ?
যেরকম প্রতিদিন
চাঁদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় আকাশপ্রদীপ,
বৈষ্ণবীর চোখের পাতায়
যেরকম কীর্তনের সুর ছুঁয়ে থাকে ঢুলুঢুলু ,
যেরকম জাহেরের থানে
শালফুল রেণু দিয়ে ঘিরে রাখে মারাংবুরুকে,
ভোরের হাওয়ায়
যেরকম দুলে ওঠে শাপলা-শরীর--
তাকে বলে একযোগে থাকা। জানো কি এসব ?
শরীরে শরীরে নয় ,
মনে মনে জুড়ে জুড়ে থাকা।
সুরে সুরে বেঁধে রাখা গোটা একটা জীবনপ্রণালী ...
তুমি বোঝো ?
সুচাঁদের ভাষা আমি কিছুই বুঝিনি।
সব অঙ্ক উল্টে দিয়ে
বহুদিন চলে গেছে মহিষবাগাল বন্ধু
মুর্মু সুঁচাদ।
বলেছিল বটে বন্ধু মুর্মু সুঁচাদ :-
যেমন ঘূর্ণির মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে ওঠে
শুকনো পাতারা
কোথায় কীভাবে যায় কোথায় হারায়
কেউ তার কিছুই জানেনা ;
জেনে রাখো, তাকে বলে সহবাস ;
তাকে বলে একযোগে থাকা ;
তাকে বলে রাতের সেরেঞ্ ...
সব অঙ্ক উল্টে দিয়ে, আজও দেখি
সুচাঁদের বনপথে অবিরাম ঘূর্ণি ওঠে ।
পাক খায় শুকনো পাতারা ...
গৌতম সেনের কবিতা
পাথর ডোবা গ্রাম
পাথর ডোবা গ্রাম পেরিয়ে চলে যাচ্ছি। দু'পাশে শীর্ণ পেশী পাহাড়। সিমলাপাল থেকে কিছুটা দূরেই তার শিখরগুলো ডেকে ওঠে। যেন মাথা তুলে স্থির জ্ঞানীভ্রমে স্তব্ধতায় ডুবে আছে। তুলোর আঁসের মতো তুষার উড়ছে বাতাসে। ধ্বসে পড়ছে পাহাড়ের ছোট ছোট চাঙ্গড় আর সমাগতদের জাগাতে নেমে এলো গেরিলা বৃষ্টি।
ফেরার কথা ছিল না, আনন্দ , আমি কি তাহলে ঘুমবো?
গ্ৰামদেশ
অবশেষে; সে মনস্থির করলো আসন্ন সন্ধ্যায় গ্রামে
ধীরে ধীরে ফিরে যাবে। দুঃখের কান্তারবন পার হয়ে,
রাত্রিজলের হাওয়া গায়ে মেখে দাঁড়াবে তার
ভিটেমাটিতে। এইখানে জগৎ কুয়াশায় মিশে আছে
তার শীতহিম মাটির শরীর। গতরাত্র স্বপ্নে দেখেছে সে,
গম্ভীর, ভাঙা কুয়োর চাতালে অনন্তনাগের মতো
বেয়ে চলেছে পুঁইয়ের সারি। হেলেঞ্চা বনের লতানো
শব্দ আর ঝরে পড়া পাতাদের বোবাগান...
নগরের কোলাহল ক্রমে ম্লান হয়ে আসে। দুর্বোধ্য
হাওয়া তলপেটে ঘাইমেরে ফিরে যায় গ্ৰামদেশে...
দীপংকর রায়ের এক গুচ্ছ কবিতা
১.
চুন খসা দেওয়ালে কেউ আঁকতে চাইছে একটি মুখ ;
মেঘেরা পারদ ছুঁড়ছে--
মাঠে ভেঙেচুরে পড়ে আছে ছায়া-শরীরের রং।
কেউ আহুতি আঁকার পরিকল্পনায় ধাক্কা দিচ্ছে--
ধ্যানমগ্ন যেখানে এক গভীর সত্য ;
সে যখন দাঁড়ায় দেয়ালে
দেয়ালও কথা বলে ওঠে জীর্ণতা ধুয়ে,
ধ্যান ভেঙ্গে ছুটিয়ে দেবার হৃদয় কি অল্প কিছুতে থামতে চায়?
একটি একটি করে গাছ-পাতারা ঢেউ ভেঙে ছুটে আসছে প্রকাশিত হবার তাড়নায় ;
আড়াল ঠেলছে যতই, ততই
বর্নময় হচ্ছে জঙ্গল ঘেঁষা নদীর উপরে মাঘীপূর্ণমার চাঁদ---
ছুটে যাবার চেষ্টায় বারবার সেই আলোকে কোষ কেড়ে ধরতে চাইছে বিনম্র আহ্লাদ-
বর্নময় হয়ে উঠছে সমস্ত আঙুলে, শুভেচ্ছা-প্রাপ্ত আলো-অন্ধকারের চিত্রপট
চুন খসা দেওয়াল কাঁদছে তবুও।
কেন যে নিজেকে প্রসারিত করে একাত্ম হতে চাইছে জীবন
যেন আর কোনো বিভাজন নেই
দেওয়াল সচিত্র প্রকাশে বিস্তীর্ণ পূর্ণিমা
তবু এই রূপ কি আলাদা হয়?
সমস্ত দেওয়াল জুড়ে আজ তুমি ক্যানভাসে কত রং লাগিয়ে দিলে ---- !
বিম্ব
পর্ণা দাশগুপ্ত মিত্র
একলা মেয়ে জীবনের খোঁজে
তৃষ্ণা থেকে শান্তির খোঁজে।
হাহাকার আকাশে বাতাসে
জল দাও একটু জল------
মাটি কোপানোর জেদ
খুঁড়তে থাকে সময়কাল।
অবশেষে ...
পাতালফুঁড়ে
ছলকে ওঠে জলস্রোত।
হাতের তালুতে চাঁদ নেমে এলো
তরল আনন্দ বিম্ব ...
মুজিবর আনসারীর এক গুচ্ছ কবিতা
----------------------------------------------------------------------------
১.
রাজা
---------
অদ্ভুত আলোর সংসার একটা দেখেছি
দেখেছি নিমতলে মাথায় ফেট্টিবাঁধা যুবকের কাম
দৈনতাকে ঘর থেকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার
হিম্মত ছিল তার ৷ দেখেছি, দৈবরথ উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার স্বপ্নগুলো কোনও এক অলৌকিক
আদি শহরের দিকে, প্রাচীন রাজবাড়ির দিকে
মায়াতীর্থে এসে সবাই যখন থেমে যায় সবাই যখন
দণ্ডবত হয় সে তখনও স্থির অবিচল দাঁড়িয়ে থাকে
যতক্ষণ না রাজাধিরাজ বের হন, অভিবাদন জানান
তাকে
উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
১.
তেঁতুল
******
সূর্য থেকে চুরি করা বয়স এসে থামে নদীর কাছে
জলের অতলে মিশে যায় শব্দশ্বাস
নিরুত্তর বালির উপর এঁটো তেঁতুল বিচি
অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে আরো একটি সৌর বিলাসে
দ্বিপত্র সবুজ স্বপ্নের মতো আগুন
ছুঁয়ে যায় মেঘকনা, আলো আর উনমনা ছাই
স্মৃতির রুমালে আকন্ঠ নৈশব্দ
ঝুলে থাকে জিভের জল হয়ে
বড় কঠিন ঝরে পড়া হাওয়ায় মিশে যাওয়া বাষ্পেরা
কড়া রোদের আঁচে মুখ পোড়ে
সারা দুপুর জীবন্ত শৈশব
ঘোলা জলের অম্ল স্বাদে বিভোর যাই
ভুলে থাকা দিনলিপি যেন মিশে আছে
তেঁতুলের সমান্তরাল পাতার ছায়ায়
২.
ইলিশ
******
গভীর কাছে থাকার এমন দৃশ্যে তুমি মাছ
হাত পা বিহীন পাখনায় তোমার
মায়াবী সেই ময়ূরকণ্ঠী রঙ
লাল মুখ বাদামী চোখ
নৌকার মতো সুডৌল শরীরে
লাবণ্য আভা ....... হীরক দ্যুতি
জলজ রানী তুমি
এমন অহংকারের অতল ছুঁয়ে জলের বাঁক
নীল নদী আবর্তে বিহ্বল
জীবনের নেশায় কি সেই চঞ্চল অঙ্গীকার!
আমি দেখি , রূপালী আঁশে তোমার সোনালী সতেজ দীনন্তের যত সূর্যাস্ত প্রতিশ্রুতি
আমি দেখি , দূর বর্ষার আহ্বানে মেঘ
তোমার উনমন ডানার ছায়া কেটে
দিগন্তে লুকায় যত পহাড়ী প্রজাপতি
তবুও মানুষ
নৃশংস মানবিকতা
তোমার সুন্দরতা বর্ণনা হয় রান্নার ঘ্রাণে
অথবা মাংসে, স্বাদে
৩.
একটি বৃষ্টির কবিতা
********************
খাতা নিয়ে বসেছি বৃষ্টির মুখোমুখি
ফোঁটা ফোঁটা জলকণার হিসেব
ঠোঁটে লাগছে ভিজে হাওয়া, চা কাপ
আর কুমারী উষ্ণতার সুর
এই তো যথেষ্ট
আমার সমস্ত মুখে আসন পেতেছে জল
মেঘ উড়ে রোদ্দুর মুছছে আকাশ
পুকুর ভরছে, ঘাট ভরছে ,
কানায় কানায় জল ঠেলে ঠেলে
রাস্তা ভাগ করছে রিক্সাঅলা
বাকী সবটুকু পথ
এক লাইনে কবিতার মতো
ছিপছিপে শব্দের সমাহার
আমি বসে আছি ,
এমন পা ডোবা জলে কখন
তোমার কাঁখের কলস ভিজিয়ে দেবে
আমার সাদা কবিতার খাতা
দহনের পথে......
দীপ্তিশিখা দাস
শরীর থেকে কোথাও যেন ছিঁড়ে পড়েছে অস্তমিত সূর্যের কালো মেঘ।
নীরবতা কেঁদে ওঠে মাঝরাতে বালিশের পাশে ; ঘন আঁধারে পুড়ে যায় আরো রাত।
বারবার জ্বলে ওঠে পোড়া রাতের অবশেষ ----
সেকি আমাকে আমার ভেতর জড়িয়ে?
কে আছে, যার কোলে শুয়ে ঘুমপাড়ানি গান শুনবে এই দাবানল----
একটু শান্ত হবে বলে?
কেই বা দেবে পোড়া মাটির ভূঁই , যার ভেতর জেগে উঠবে আকাশের সব নক্ষত্ররা ?
জোনাকিরা ভিড় করে নদীর রুখু স্রোতে ;
বালুচরে ফাঁসে রোদ
আমি তো জোয়ারের টান খুঁজি বালির তলায়।
জ্বলে-পুড়ে ছারখার
পৃথিবীর সব ছাদ!
ছাদের উপর চাদঁ নেই আজ, একাকী হেঁটে যাওয়া নিরুদ্দেশ কক্ষপথে কেই বা কার সঙ্গী, কেই বা অংশীদার --
যার বুকে ভর দিয়ে
মৃতের স্তুপ ঘুমিয়ে থাকে, তারই বা জোর কোথায় পথের উপর....?
যুগ যুগ ধরে শ্মশানের ছাইয়ে ভেসে যায় সব অস্তিত্বের আকাশ ...;
থাকবে কি কারও স্বাধীনতা !?
না কি সেও কারো ইচ্ছার উপর নির্ভর করেই মৃত্যুকে আপন ভেবে জ্বলে ওঠে সেই চিতায়?
ঘাড়ে গামছা বেঁধে দলে দলে লোক চলেছে দহনের পতাকা হাতে।
আমিও আছি?
এই দহনে মেঘ-রোদ-চাঁদ কে যে কাকে চায়, কি জানি!
----- ফেকাসে পাহাড় জুড়ে খাঁ খাঁ করে ওঠে হারিয়ে যাওয়া বহু কিশোর- কিশোরীর প্রেম---।
জ্বলছে দোয়েলের ঘর।
পোড়া খাঁচা পড়ে আছে।
শির শির করে যে ঝাউবন, বুকের ভেতর নড়ে ওঠে, তাকেও গলা টিপে ধরে সেই ঈশান কোনের গুমোট অন্ধকার!
কল্পনা ছাড়া আর তো কিছু নেই! সব বাস্তবতা তো ছিন্ন করেছে আমায়
অগোছালো চোখ উদাসীন পড়ে আছে ধানের শীষে !
ছেঁড়া হৃদয় বৃষ্টির গন্ধে রক্তের উপর বাড়িয়ে দেয় আরো লবনতা, কতো ঢেউ ভেঙে যায় যে চারদিকে ---
পায়ে পায়ে জড়িয়ে বনলতা আটকে রেখেছে বলেই এখনো ভিজে যাইনি সব কোনা।
বুলন্দ দরজার ভেতরে হাওয়াদের নাচগান আজ বন্ধ , তবু কে যে ডাকে রোজ দুপুরের ঘরে, সে কি মৃত্যু ?
মৃত্যু , সব সময়ের জমানো ভয়ঙ্কর শক্ত কুৎসিত কিছু ব্যর্থ রক্তকনার কথা?
কারো কাছে পাবো বলে তো দিই না সকালের আধঘুমে কোয়েলের
মিষ্টি সুর.....!
যা ছিল দেওয়ার, সেই নিতে পারে যে শিশিরে কচি ফুলের স্পর্শকে ছুঁতে পেরেছে , যে মরুভূমির স্তব্ধতাকে চুঁইয়ে খেয়েছে গাঢ় তৃষ্ণায় ;
কে পারে এভাবে বিলিয়ে দিতে, ধুলিকণায়, বনের ছায়ায় !
মানুষের ভেতরে হাজার মানুষের বাস যেখানে, সামান্য দেওয়া-নেওয়ায়
কতটুকু সন্তুষ্ট কে?
প্রতিদিন কিছু কীটপতঙ্গের মধ্যে আসে যায় সময়, নোংরা হয়
মেঝে.....
তবু তার মধ্যে যদি একটি প্রজাপতি এসে চুপটি করে
রং ঢেলে যেত ...
নিজের মনে নিজেই হেসে বলতাম, এই তো, কত কি দেখে ফিরে এলে
নদীর গতিমুখ ঘুরিয়ে ;
শরীর জড়িয়ে তখন বানভাসি আলতা পায়ের চিহ্ন......
কতজন এল আর গেল!!
শিশুর খেলনাও ভেঙে পড়ে রইল মেঝের উপর ;
কত না ভেঙেছে এমন ....... ।।
একেবারে চুরমার ভস্মীভূত হতে কে দেখেছে তাকে?
কেই বা দেখেছে চাতকের চুপচাপ চলে যাওয়া কোন দূর গভীর অরণ্যে...
সায়ন্তন ধরের তিনটি সনেট
১.
স্বর্নালী তন্তু
পথ চলতে হঠাৎ দেখলাম তাকে-
কাজলা দিঘীতে নেমে ঢেউ তোলে জলে,
দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম কোন এক বাঁকে-
শান্ত সুনিবিড় গ্রামে, বনছায়া তলে।
জানতে চাই যে আমি, "কি করো গো তুমি?"
উত্তরে সে হাসে, বলে, "দেখো ভালো করে,
এ হল সোনালি তন্তু, ধুয়ে নিই আমি।"
আবারো তরঙ্গ ওঠে, জলকণা ঝরে।
সবুজ চারারা বাড়ে, হয় বড় গাছ-
কাটা গাছ পচে জলে, পাটকাঠি জমে,
একগোছা পাট নিয়ে জলে ধোয়া কাজ
উন্মুক্ত পিঠ তখন ভিজে যায় ঘামে।
নয়ানজুলির জলে জলকেলি শেষ,
মেহনতী আভিজাত্যে আনন্দের রেশ।
২.
মায়া রাত
দিন ফুরোলে চাঁদের উঁকি ঐ আকাশে
মেঘের ভেলায় মন ভেসে যায় দূরে
চাঁদের আলোয় ম্লান তারাদের পাশে
গাইছে কে যেন মন হারানোর সুরে।
ঝোপঝাড় থেকে ডাকে একটানা ঝিঁঝিঁ
ধান ক্ষেতে থেকে থেকে শেয়ালের ডাক
রাগ ইমনের সুরে দাঁড় টানে মাঝি
কোন এক বাড়ি থেকে বাজে সাঁঝ শাঁখ।
হুইসল্ দেয় ট্রেন ছাড়ে নলহাটি
শেষ ট্রেনে ঘরে ফেরা হল না তো আর
মেঘ ঢাকে চাঁদটাকে কালো রাঙামাটি
তুলনা নেইতো কোন এ রাত শোভার।
শহরে শিশুরা সব শোয় ফুটপাথে
কত কি যে ঘটে যায় এ আঁধার রাতে।
৩.
প্রতিচ্ছবি
বিকেল তখন সবে, শুরু হলো যাত্রা-
জলশহর ছাড়িয়ে- পাঙ্গা প্লেন ঘাঁটি।
তুলবো এমন ছবি, পাবে অন্য মাত্রা,
সূর্য্য ঢলেছে পশ্চিমে, রাঙা আভা সৃষ্টি।
পথের ধারের তৃণ, অনাদরে পড়ে,
দুটি পাতায় জীবন, সূর্যালোক চায়।
শেষ ফোটন কণায়, খাদ্য তৈরী করে,
আগামী দেখবে বলে, আনন্দিত হয়।
নজরে আসে এমন, অপূর্ব সে দৃশ্য-
ক্যামেরাতে হয় বন্দী, পারফেক্ট ক্লিক।
বারবার ঘুরি ফিরি, এ আমার বিশ্ব,
সাদাকালো অতীতের, রঙীন ঝিলিক।
দুটি পাতা এক কাণ্ড, নেই ভেদাভেদ,
মানুষে মানুষে আজ, কেন এত ভেদ?
পাখি
সৌরভ লায়েক
ওরা সব উড়েছিল অন্যের আকাশে
পায়নি আশ্রয়
আমি বলি - " আয়
আমার আকাশ অযুত বৎসর একলাই পড়ে আছে"
ওরা আসে , ওরা ভাসে
এরপর একদিন উড়ে চলে যায়
সুজন পণ্ডার কবিতা
১.
রাত কত
রাত কত?
নিরলস চেষ্টার পরে
সারাটা আকাশ পেরিয়ে এসেছে
তারা দুটি...
মিটিমিটি আলোয়
ক্লান্তির ছাপ...
রাত কত?
ট্যাক্সির হলুদ গুলে
স্ট্রিট লাইট আরো ভারী,
রাত শুধু আলোর হিসেব জানে।
বাকল বিহীন কিছু গাছ
আঁধারে বাড়ছে,
ফুল এসেছে শেষ সন্ধেয়।
তারা আর বাতি থেকে দূরে
মায়ের কোল জিজ্ঞেস করে
রাত কত?
২.
অতিথি
শব্দেরা আসে... দল বেঁধে
কারো মাথা নিচু
কারোর নখে রক্তের নোনা
ইচ্ছেমত কাটায় কিছুক্ষণ...
তারপর ইতস্তত
বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন...
শব্দেরা আসে...
বাতাসে কখনো বারুদের ঘ্রাণ
কখনো নবজাতকের সুবাস
শহুরে শব্দেরা
আকাশের খোঁজ করে,
মফস্বলের দাবি রাজপথ
শব্দেরা আসে
কখনো কখনো
সুযোগ পেলে আসন সাজাই
দু এক দানা কবিতার জন্ম হয়।
সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের এক গুচ্ছ কবিতা
১.
ঢেউ
ঢেউ আসে , ঢেউ যায়
বিন্দু বিন্দু জলরাশি
সাগরে মিলায় !
ঢেউ আসে , ঢেউ যায়
আমি কি মিশেছি তাতে
আমি কি ভেসেছি তাতে
মাঝদরিয়ায়!
গভীর ..... গভীর.....
গভীর কালো জল
এসো ! এসো হে
অনাদিনাথ !
অতল ! অতল !
আরও কবিতা পড়ুন
পল্লব গোস্বামীর কবিতা
১.
শিকার
======
কারা যেন পাড়ার ছেলেগুলিকে ডেকে নিয়ে গেছে আজ ,এই অবেলায় | গভীর রাতে ঠিক যেন নিশির ডাক |গুলতি - বাঁটুল হাতে তারা পেরিয়ে গিয়েছে,
জলকাদা মাঠ, জলারণ্য ...
বিলের ধারে গজিয়ে উঠেছে
বিচিত্র সব
পাখি ধরার ফাঁদ |প্রাকৃতিক হুইসেল |
পোষা পাখি দিয়ে বুনো পাখি ধরে
কারা যেন একটি পাখিখামার বানিয়েছে | ডাকাতিয়া ছায়ার ভেতর সেজে উঠেছে খেজুর পাতার খাঁচামহল | খাঁচার ছায়া পড়ছে শিশুদের গালে | প্রতিটি শিশুর মুখে প্রাচীন মিশরের মতো অন্ধকার যেমন |
এ কোন পিরামিড দেখি,পাশের গাঁয়ে ?
ঝিলের গায়ে , ছোটো ছোটো দ্বীপে
এ কোন খাদ্যজাল ?
ধীরে ধীরে সরাল,সারস শামুকখোল পাখিরা নেমে আসে | আকাশে জ্বলে ওঠে হলুদ হ্যাচারির আলো | সারা জঙ্গল জেগে ,পাখিরা শিশু পাহারা দেয় |
প্রত্যেকটি পাখির ঠোঁটে
আমি ঠিক শুনতে পাই
এক একটি
শিকারি মানুষের হাসি ...
==============
২.
নেফারতিতি
==========
যে কবিতা ছোঁয়া হয়না কোনোদিন
সেইসব কবিতার ভেতর,
স্বপ্নের সুতিকাগৃহে
শবাসনে আমি শুয়ে পড়ি ....
ধ্যানের এক একটি স্তরে
এক একটি
মহাসন পাতা
পটভূমিতে রাখা:
একটি তিব্বতি গানের বাটি
বাটি হাতে এক শবর বালিকা
লাল পিঁপড়ের ডিম ধুতে আসে ...
তার হাতের গন্ধে লেগে থাকে
রামায়ণের
এঁটো কুলের ঘ্রাণ
বাঁশি ছেড়ে
এক নেটিভ আমেরিকান
মদনভেরি বাজান
তাঁর আঁতছেঁড়া সুরে
খুলে যায় অন্তিম দুয়ার
সেখানে আহত বাঘের মতো একা
এক শঙ্খচূড় সাপ
তিনি আমাকে ছোবল মারতে উদ্ধত
আমারও বেরিয়ে পড়ে দাঁত-নখ
আমাদের হৃদয়ে নীরবে সূর্যোদয়
নাভিপদ্মে মেশে,
নিযুত নেফারতিতি !
=====================
ব্রততী পরামাণিকের কবিতা
১.
পৃথিবীর খেয়াল
উত্তাল সময় এখন শান্ত
নিস্তেজ, ক্ষমতার আপন অধ্যায়
ঢেউ এসে এলোমেলো সব-
যারা গেল, তারা গেল
পড়ে রইলো ক্ষুধার্ত পেট
নি:সহায়ের আকুতি ভরা ক্রন্দন
সাধারণের নেই কোনো মান
আপন খেয়ালেই পৃথিবী চলে
আপনি মেতে উল্লাসে।
২.
ছন্দহীন
অবহেলায়,অনাদরে,পরিচর্চার অভাবে
নষ্ট হয় বহু জীবন...
কে কার খোঁজ রাখে-
থাক পড়ে, যে থাকে
চলমান পৃথিবী যে ঘুরছে
মানুষও তার তাল রাখে,
যে, না পারে মেলাতে
ছন্দহীন পড়ে যায় অকুলে।
৩.
বাঁধনছাড়া বাঁধন
বাঁধনছাড়া বাঁধন জটিল গেরো
খোলার বৃথা চেষ্টায় অন্তিমক্ষণ
দিনে-দিনে পাঁকই বাড়ে
উপায়হীন, তবু রাস্তা চলা
দুর্গম গিরি পারাপার দুস্তর
পিঠেতে বোঝা, শিরদাঁড়া নুয়ে;
সুদীর্ঘ পথের যাত্রা ধিকিধিকি,
অপূর্ণতার কলস বাজে ঠংঠং।
৪.
সুদিনের অপেক্ষা
সুদিনের অপেক্ষায় বেঁচে থাকা
বাসস্থান থেকে সরে রাস্তায়
রাস্তা থেকে বন-জঙ্গলে
বিস্তীর্ন পথ হেঁটে সুদূরে
তারপর নদী, সাগরের বালুতট
দ্বিধা-দ্বন্দ্বই সীমানা ঘেরা
জীবনে শুধু বিভীষিকার অভিজ্ঞতা
বেঁচে থাকায় দুঃসহ যন্ত্রণাময়।
মনস্কাম
সৌরভ লায়েক
ভেঙেছিস ?
বেশ ।
আরো ভেঙে ভেঙে গুড়ো হয়ে যা
যেদিন তুই ধুলো হয়ে যাবি
সেইদিন -
সেইদিন তোকে কুড়িয়ে নেব একটু একটু করে
তারপর কপালে আঁকবো বিভূতি
সাধন - অঘোরে
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনটি কবিতা
১.
উদ্বোধন
শুধু পা ঠেকালে অসম্মান, বরং সিঁড়ি বেয়ে সরাসরি
উঠে এলে কয়েক ধাপ, নর্মসখার মতো আশ্রয়ই এসে
ধরে নিরঙ্কুশ হাত; তাতে ক্ষতি কী বা! এক বালতি দুধে
কয়েকটি পলাশের ফুল ঝরে পড়লেও তখন কি শুধু
দুধে-আলতার কথাই ভাববো? চাইবো, সমস্ত স্তন্যপানের
দৃশ্য থেকেই এক-এক করে শোষণের ছবি মুছে যাক
চাইতে চাইতেই কত যে জটিলতা
বুকের অম্লশূলের জায়গাটা কম্পাস দিয়ে নির্ণয়
করে যদি কোনোদিন জানা যায়
ওখানেই বিদ্ধ থাকে ত্রিশূল, অসুরের বুকে
আমরা শুরু করবো হৃদয় খোঁড়াখুড়ি
হৃদয় ও অস্ত্রাগারের দূরত্বে যেখানে অতি প্রাচীনকালে
ঘটেছিল এক ব্রহ্মদৈত্যের শিলান্যাস...
২.
মাছ
জলে থাকে মাছ – এই কথাটি সহজ ও জটিল
মাছ থাকে শব্দহীন স্নানে; যেটুকু উন্মাদনা সে
সে পান করে সমুদ্রের – বোধি-শ্যাওলার কাছে
তার জন্য প্রার্থনা করে নৈঃশব্দের বিবমিষা
মাছ বুঝি জানে মেছোবাজার নামে অন্য অন্য অহরহ সাগরসঙ্গমে
মৃত্যুর অপ্রতিরোধ্য ওপারে আছে প্রভূত কোলাহলে ঝনঝন করা
মেছুনির প্রাদুর্ভাব; তাদেরও মন, চিন্তার অসাড়তা – অ্যানাস্থেসিয়া
মাঝে মাঝে জানতে পায় – নীরব শ্যামল নদীর বুকে বসে আছে
অকথ্য পিরিত – মৃতকল্প মাছ ডাঙায় তোলার উদযাপনে নয়
জ্যান্ত মাছের পালিয়ে যাওয়ার দিকে চেয়ে...
৩.
নৃসিংহের নিচে
সূচের ছিদ্রে এখন সুতো ঢোকে না
সূচের পিছনে একটা চোখ থাকলেও
সামনে সে কেঁচোর চেয়ে বেশি অন্ধ
কেঁচোর কথা বললেই আসবে না বৃষ্টি ওপর-ছাদে,
তবু কেন আমি ভাবি, রোদের পলায়ন পিঠে নিয়ে
উড়ে গেল, বাহারি চুড়োয় যে-পাখি শিল্পসম্মতভাবে
ছিল বসে অফুরন্ত শীর্ষস্থান রেখে পা-য়; কেন ভাবি,
আউল-বাউল চারটে বোতাম যখন খুশি উড়ে গেলেই
আমাকেই পেতে দিতে হবে বুক, অতিশয় নৃসিংহের নিচে!
যে সেলাই-কল রাজবেশ বিদীর্ণ করে পেয়ে থাকে
কলিজার আঁকিবুকি সে বুঝি জানে না – হৃদির দ্রুতির
পাপোষ হয়েও আজও বেঁচে কিছু কিছু জেব্রা-ক্রসিং –
নরম রোদে নরদেহ বিছিয়ে...
'না'। পূর্ণচ্ছেদ।
মধুপর্ণা
মেয়েটি বলল –'না'। এই 'না' পুরুষতন্ত্রের কাছে থ্রেট, মেয়েদের 'না' মেনে নিতে শুধু অসুবিধা হয় না তাদের, আতঙ্ক তৈরি করে। সেই আতঙ্ক প্রকাশ পায় আগ্রাসনের আকারে। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে মেয়েদের 'না' কিভাবে পুরুষতন্ত্র মেনে নিতে পারে না। এই 'না' এর সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য সমাজ বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। প্রথমত তাচ্ছিল্য করে উপেক্ষা করে, তারপরও আয়ত্ত্বে না এলে অবদমন করে, নিষ্পেষণ করে। পুরুষতান্ত্রিক একাধিপত্যের আকাঙ্খায় “না” এই ছোট শব্দটি ফাটল ধরায়। পুং অহং এর ফাঁপিয়ে তোলা ফানুসের কাছে এই 'না' হয়ে ওঠে সংকট। সামাজিক কাঠামো যখন নারীকে 'অপর', 'দ্বিতীয় লিঙ্গ’, ‘আংশিক মানুষ' হিসাবে দেখতে চায়, নারীকে গড়ে তুলতে চায় পুরুষের স্বেচ্ছ্বাচারের একচ্ছত্র ক্ষেত্র হিসাবে তখন নারীর মুখ নিঃসৃত একটি শব্দ 'না' পিতৃতান্ত্রিক মানসকাঠামোর জন্য হয়ে ওঠে ঝুঁকিপূর্ণ। তাই দ্বিমত হবার, অস্বীকার করার অধিকার নারীকে দিতে নারাজ সমাজ। নির্দেশিত নিয়মপালন করে যাওয়া এবং প্রশ্ন না করা তাদের কাছে প্রত্যাশিত। সেখানে যখন প্রতিস্পর্ধী 'না' উচ্চারিত হয়, তার প্রতিধ্বনি ঘুরপাক খেতে থাকে পুং অহং এর ক্ষমতাদর্পী অলিন্দে। এই না এর সম্মুখীণ হলে পুরুষতন্ত্রের দাঁত-নখ ক্রমে নগ্ন হয়ে পড়ে। নারীর 'না' কে তারা পাল্টা অস্বীকার করে এবং কৌশলে হোক বা ত্রাস সৃষ্টি করে হোক তারা 'না' কে 'হ্যাঁ' বা সম্মতিতে রূপান্তরিত করতে চায়।
নারীর মধ্যস্থ প্রতিরোধ স্পৃহাকে কোনো ক্রমে বিদ্ধস্থ করতে পারলে পুং অহং স্বস্তি এবং নিরাপদ বোধ করে। শুধুই প্রতিরোধ নয়, নারীর ইচ্ছা, পছন্দ, নিজস্ব পরিসরের বেড়া, নিজের সীমানা নিশ্চিত করার জন্য ‘না’ ভীষণ জরুরি। এখানেই পুরুষতন্ত্রের সমস্যা শুরু হয়। এই সবগুলির বেড়া বিনষ্ট করে দিতে পারলে নারীকে গ্রাস করতে সুবিধা হবে বলে সে ধারণা করে। বাহ্যিকভাবে অবদমনের মধ্যে রেখেও সে স্বস্তি বোধ করে না। তার মন, মনন, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে তাকে উপনিবেশ বানিয়ে নিজের আয়ত্ত্বে রাখতে চায়। সেই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে, একাধিপত্যের আয়োজন নস্যাৎ করার ক্ষেত্রে নারীর 'না' মূর্তমান হুমকি। পিতৃতন্ত্রের অসুস্থ মানস প্রবণতাকে মুহুর্তে তছনছ করার ক্ষমতা রয়েছে এই নেতিবাচক শব্দটির। একই সঙ্গে তা ডেকে আনে হিংসা, আক্রমণ। পুরুষতন্ত্র এই নারীকে শায়েস্তা করে নিজের অহং তৃপ্ত করতে চায়, নিজের হীনমণ্যতা যার প্রতিফলন হয় উচ্চশ্মণ্যতায় তাতেও কবোষ্ণ তা দিয়ে লিঙ্গ বৈষম্যপূর্ণ সমাজে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতার ধার ঝালিয়ে নিতে চায়।
দৈনন্দিন ইচ্ছা, পছন্দ থেকে শুরু করে সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা, যৌণতা, সিদ্ধান্তগ্রহণ, পারিবারিক অর্থনীতি, সম্পত্তি বাটোয়ারা সর্বত্র নারীর মতামত অবহেলিত হয়। আরোপিত মত মেনে না নিলেই বাঁধে দ্বন্দ্ব। এই মেনে না নেওয়ার মধ্যে একটি অসীম শক্তির সম্ভবনা রয়েছে। 'না' এর মধ্যে রয়েছে লিঙ্গ বৈষম্যপূর্ণ সমাজে নারী পুরুষের পারস্পরিক সমীকরণের খোলনলচে বদলে দেবার ক্ষমতা এর মধ্যেই নিহিত আছে সমাজ রূপান্তরের বীজ। লিঙ্গ সাম্যের জন্য কনসেন্ট বা সম্মতির পাঠ নেওয়া জরুরি। নারীর 'না' কে, অসম্মতিকে মর্যাদা করতে শেখা জরুরি। ব্যক্তিগত পরিসরে তার অসম্মতি মানে অনুরোধ বা আদেশের পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা সম্মতিতে পরিণত হবে এই বিষাক্ত সংস্কৃতিকে সর্বাগ্রে বর্জন করা দরকার। সামাজিক চাপ তৈরি করে, ভয় দেখিয়ে, মানসিকভাবে হেনস্থা করে, নারীর অসম্মতিকে অগ্রাহ্য করে পুরুষতন্ত্র তার ক্ষমতা প্রদর্শন করে থাকে। নারীর 'না' বলাকে তৎক্ষনাৎ স্বীকার করা এবং অসম্মতি-সম্মতির স্বচ্ছ সিমানা নির্ধারণ করা জরুরি। ব্যক্তিগত পরিসরে নারীর 'না' মানে অসম্মতি। তার ভিন্ন কোনো কাব্যিক বা অতিরঞ্জিত অর্থ খোঁজার প্রয়োজন নেই। তাই মেয়েটি যখন বলল 'না'। তখন তার একমাত্র এবং কেবলমাত্র অর্থ হল-না। পূর্ণচ্ছেদ।
ইঁদ পরব
তপন পাত্র
________________________________
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্ত বাংলার একটি প্রায় সর্বজনজ্ঞেয় লোকপ্রবাদ "ভাদর মাসে রাজার ভাণ্ডারও খালি"। রাজার ভাণ্ডার খালি হলেও সীমান্ত বাংলায় তথা মানভূমে ভাদর মাসে গাদর পরব । করম , জাওয়া , বিঁধা , জিতা , ভাদু , ছাতা আবার ইঁদ । একগুচ্ছ পা'ল-পার্বণে ভাদর ভরা নদীর মতো উচ্ছল-চঞ্চল-গতি-তরঙ্গময় । কাশ ফুলে ফুলে দোলে ভাদরের নীলাকাশে পেঁজা তুলার মতো পুঞ্জীভূত শুভ্রবর্ণা মেঘরাশি । মানভূমের গগনে-পবনে , বনে-বাদাড়ে , ডুংরি-টিলায় উৎসবের অনাবিল বাঁশি । সেই বাঁশির সুরে মাতোয়ারা হয় যেমন নানান জনজাতির উঠান , তেমনি আবার রাজপরিবার নামে পরিচিত অভিজাত , অনভিজাতদের অঙ্গন ।
করম উদযাপিত হয় ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে । ভূমিজ-মাহাত-ভুঁইয়া-বাগাল সহ বিভিন্ন জাতির মানুষ করম উৎসবে অংশ নেন । আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যেও পাঁচ রকম করমের প্রচলন রয়েছে । তাঁদের যে পাঁচ প্রকার করমের পরিচয় পাওয়া যায় , সেগুলি হল --মাঝি করম , ডাঙ্গুয়া করম , গুরু করম , চেলা করম , মাঃ মড়ে করম ।
জাওয়া গান বা জাওয়া নাচের গান করম পূজারই একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । জাওয়া উৎসবের আনুষ্ঠানিক বিষয়গুলি কুমারী মেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । তবে নৃত্যানুষ্ঠানে এয়োতিরাও অংশগ্রহণ করেন । জাওয়া উদযাপিত হয় করম তিথিতেই ।
ইঁদ পরবের ১২ দিন পর জিতা । জিতাষ্টমী । উৎসবটি স্থান ভেদে "জিতুয়া" নামেও পরিচিত । জিতায় জীমূতবাহনের পূজা হয় । মূল উদ্দেশ্য উৎপাদনশীলতার বন্দনা । ধলভূম গড় রাজপরিবারের বিঁধা পরবের সূচনা হয় এই জিতাষ্টমীর দিনটিতেই । ঘাটশিলায় রঙ্কিনী দেবীর মন্দিরে দু' সপ্তাহ ব্যাপী বিঁধা উপলক্ষ্যে মেলা চলতে থাকে। একথা আজ স্বীকার করতেই হয় যে, জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির পাশাপাশি এই উৎসবও দিনে দিনে বিলুপ্তির পথে পা বাড়িয়েছে ।
ভাদু পূজার আবাহন ভাদ্রমাসের সূচনা দিবসে । সারা মাস জুড়ে প্রতি সন্ধ্যায় আটপৌরে নৈবেদ্য সাজিয়ে পূজা আর গান । সংক্রান্তির দিন জাগরণ । পয়লা আশ্বিন নিরঞ্জন । ভাদরের সংক্রান্তির দিন আরেক বড় পরব ছাতা পরব । পুরুলিয়া পঞ্চকোট রাজ পরিবারের ও চাকলতোড়ের ছাতা পরবের গরিমা সর্বজনবিদিত । একটি নির্দিষ্ট মাঠে এক বিশাল শুভ্র বর্ণের ছত্র খোলার মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা । তারপর নাচ-গান হৈ-হুল্লোড় । ইতিহাসের পথ ধরে যতই দিন গড়িয়ে গেছে বাংলা , বিহার ঝাড়খন্ড , উড়িষ্যার আদিবাসী সাঁওতাল সমাজের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে এই মেলায় । তাঁরা এক বিশাল শাল খুঁটির ডগায় বিরাট এক ছাতার নিচে সকলে সমবেত হন । মেলাটি ক্রমে সাঁওতাল সমাজের স্বয়ম্বর সভায় পরিণত হয়েছে ।
ভাদরের এই অসংখ্য উৎসবের মাঝে ইঁদ পরবের গুরুত্ব , তাৎপর্য ও জনপ্রিয়তা আজও সর্বাধিক । এটি কোন কোন অঞ্চলে "সনপেটা" বা "সুনিয়া" নামেও পরিচিত । ইঁদ ইন্দ্রধ্বজ পূজা বলেই বিবেচিত । বিশুদ্ধ পঞ্জিকা অনুসারে এর নাম "শক্রোত্থান" । কালের ধারাবাহিকতায় ইন্দ্রদেব পরিণত হয়েছেন ইঁদ-এ । নাকি ইঁদ থেকেই ইন্দ্রদেব চলে এসেছেন , তা যুক্তি সহকারে বিচার বিশ্লেষণ করা প্রায় অসম্ভব । তবে পুরুলিয়া তথা মানভূম-ঝাড়খণ্ডের এই প্রাচীন লোকোৎসবের মধ্য দিয়ে একদিন স্থানীয় রাজার আধিপত্য এবং প্রভুত্ব ঘোষিত হতো রাজকীয় মর্যাদায় । ইঁদ পূজার উত্থানের সম্ভাব্য কারণ
-- কোন এক বছর নাকি ভাদ্র মাসের শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে সূর্যের দক্ষিণায়ন হয়েছিল , সেই কারণে ইন্দ্রধ্বজ পূজার সূচনা । আবার পুরাণকাহিনী বলছে, চেদিপতি উপরিচর বসু দেবাধিপতি ইন্দ্রদেবের কাছে ইন্দ্রধ্বজ লাভ করে তাঁর পূজার্চণার সূত্রপাত করেন । এর ফলে তিনি পুত্র এবং প্রচুর ধন-সম্পদ লাভ করেন । সেই কারণে প্রজাদের মধ্যেও ইন্দ্রধ্বজ পূজার প্রচলন ঘটে যায় । কারণ যুগে যুগে উচ্চ-মধ্য-নিম্ন নির্বিশেষে সকল বিত্তের সকল মা বাবারই চিরন্তন প্রার্থনা সন্তান এবং সম্পদ । "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে"।
আজও কোথাও কোথাও ইঁদ ভাদ্রমাসের শ্রামণা নক্ষত্র যুক্ত শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে উদযাপিত হয় মহাসমারোহে , কোথাও দায়সারাভাবে । এই বর্ষা-শরৎ কালীন বিভিন্ন লোক উৎসবের পৃষ্ঠপোষক সাধারণ মানুষ , কৃষক , কৃষি শ্রমিক । আর ইঁদ পরবের পৃষ্ঠপোষক দেশের রাজা । অন্যান্য উৎসবগুলির মধ্যেও জাঁকজমক আছে ঠিক কথা , কিন্তু তার চেহারায় একটা দারিদ্র্যের ছবি লক্ষণীয় । রাজার পরব ইঁদ ; স্বাভাবিকভাবেই তা ছিল আড়ম্বরপূর্ণ , বিলাসবহুল ।
করমে করম কথা চলতে থাকে , জাওয়ার নাচে গানে মধু মুখরিত হয়ে ওঠে মানভূমের ঝোপ-ঝাড় , বন-জঙ্গল , খাল-বিল , নদী-নালা । তার রেশ কাটতে না কাটতেই বেজে ওঠে ইঁদ পরবের বাজনা । তাই জাওয়া নৃত্যানুষ্ঠানের অন্তিম পর্যায়ের গানে ইন্দ্রপূজার আভাস -ইঙ্গিতটি সুস্পষ্ট ---
"রাজার বিটির ইঁদ আর হামদের জাওয়া গো ,
ডেগে ডেগে পঞ্চ ডেগে উঠে রাজার ইঁদ গো।
কে কে যাবে ইঁদ দেখতে হামরা দিব কড়ি গো
ডেগে ডেগে পঞ্চ ডেগে উঠে রাজার ইঁদ গো।"
জাওয়ার নৃত্যগীতানুষ্ঠানের আসর থেকেই পল্লী বাংলার মানুষজন ইঁদমেলা দেখার জন্য ইঁদকুড়ির ময়দানের দিকে রওনা হয় । মানভূমের যেখানেই রাজা বা জমিদার সেখানেই ইঁদ পরব । পরব স্থান এলাকাটির নাম ইঁদকুড়ি । ইঁদ পরবের ময়দান কোথাও কোথাও ইঁদটাঁ'ড় নামেও পরিচিত । পুরুলিয়ার মানবাজারের গড় পাথরমহড়া রাজবাড়ি , বরাবাজার রাজবাড়ি , বাঁকুড়ার বন বিষ্ণুপুর রাজবাড়ি, খাতড়ার কাছে অম্বিকানগর রাজবাড়ি, মেদিনীপুরের ধারেন্দা ও ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি সহ সমস্ত রাজপরিবারেরই একটি স্থান বিশাল জাঁকজমকপূর্ণভাবে , মহাসমারোহে ইঁদ পরব উদযাপনের জন্য বরাদ্দ ছিল । এই নির্দিষ্ট সীমানাটি ইঁদকুড়ি নামেই পরিচিত । এখন আর কোন রাজপরিবারেরই এই প্রসারিত ইঁদটাঁ'ড় নেই । মূলত পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট পরিচালিত সরকারের জমানায় এই স্থানগুলিতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় পরবের মাটি একেবারে সংকীর্ণ হয়ে উঠেছে । ফলে কোথাও কোথাও আর মেলার আয়োজন করা যায় না । নমো নমো করে কোন প্রকারে প্রাথমিক কিছু প্রথা-রীতি-সংস্কৃতি প্রতিপালনের মধ্য দিয়েই উৎসব সাঙ্গ করতে হয় । এ নিয়ে এলাকাবাসীর মনে ক্ষোভ ও মনস্তাপ যথেষ্ট । কিছুদিন আগেও ইঁদকে ঘিরে যে জাঁকজমক , আবেগ-উচ্ছ্বাস ছিল এবং রাজবাড়ির উদ্যোগে নির্দিষ্ট রাজ এলাকার প্রজাদের মধ্যে ভুরিভোজের আয়োজন হতো , এখন সে সমস্ত কিছুই বিলুপ্তির দিকে । সেটাই স্বাভাবিক । কারণ আঞ্চলিক জমিদার , ভূস্বামীদের সেই রমরমা দিন আজ আর নেই । জমিদারিরাজ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত বা রূপান্তরিত হয়েছে পঞ্চায়েতীরাজে । কিন্তু কোনো পঞ্চায়েতেরই ঐতিহ্যমন্ডিত ইঁদ-ছাতার মতো প্রাচীন সংস্কৃতি রক্ষার প্রতি তেমন কোন আন্তরিক সাংস্কৃতিক দুর্বলতা নেই , দায়িত্বও নেই। সঙ্গত কারণেই এখনো কোথাও কোথাও টিমটিম করে এইসব উৎসবের যে আলো জ্বলছে, আগামী এক দেড় দশকের মধ্যেই তা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবে । মানভূম হারাবে তার এক মান-মর্যাদার প্রতীক , সুস্থ সুন্দর সাংস্কৃতিক বিনোদনের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ।
অথচ এক সময় এই মেলায় এমনই জনসমাগম ঘটতো যে বিস্তৃত ভূগোল সীমার জনগণের যাতায়াতে গ্রামের বাঁশঝাড় , তালগাছে ভরা ঝোপ-জঙ্গলয়য় মাঠে নতুন রাস্তা তৈরি হয়ে যেত ----
"তালতলে বাঁশতলে কে করিল পথ গো ,
ঠিকেই ইগলা ইঁদ দেখা লক ।
ইঁদ দে'খতে গেলি তরা ইঁদের কত জাঁক গো,
ডেগে ডেগে পঞ্চডেগে উঠে রাজার ইঁদ গো।"
উৎসবের কয়েকদিন আগে সাধারণত ভাদ্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে অথবা অন্য কোনো শুভ দিন , শুভ ক্ষণ নির্বাচন করে রাজা সপারিষদ ঘোড়ায় চড়ে , শোভাযাত্রা করে এলাকার কোন গভীর অরণ্যে প্রবেশ করেন । তারপর ইন্দ্রধ্বজ পূজা বা ইঁদ পূজার প্রয়োজনে একটি বা দু'টি উপযুক্ত শালবৃক্ষ নির্বাচন করেন , ইন্দ্রদণ্ড বা "ইঁদ ডাং" হিসাবে ব্যবহারের জন্য । যে বৃক্ষটি নির্বাচন করা হয় , লক্ষ্য রাখা হয় সেই বৃক্ষে যেন কোন পাখির বাসা অথবা কোটর না থাকে । তাছাড়া বৃক্ষটিকে হতে হয় ঋজু দীর্ঘ এবং সুলক্ষণযুক্ত । বৃক্ষটি যেন অগ্নিদগ্ধ বা বজ্রাহত অথবা কীটদষ্ট ও শ্মশানস্থলের না হয় , সেদিকেও সযত্ন দৃষ্টি দেওয়া হয় । বৃক্ষ নির্বাচিত হলে প্রথমে রাজা এবং তারপর রাজপুরোহিত উত্তর মুখে অথবা পূর্ব মুখে বসে বৃক্ষ দেবতা তথা বনদেবতার পূজা করেন । প্রথাবদ্ধ আচার-অনুষ্ঠানের পর বৃক্ষ দেবতার উদ্দেশ্যে করজোড়ে প্রার্থনা করেন ---"হে বৃক্ষদেবতা, তুমি আমার ভক্তিপূর্ণ পূজা গ্রহণ করো । ইন্দ্রের ধ্বজা প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচিত ক্ষেত্রে আমরা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি । তুমি প্রসন্ন চিত্তে ওই ধ্বজার্চণার ক্ষেত্রে উপনীত হও । আমাদের অপরাধ নিও না । ক্রোধ করো না । আমরা কৃষিজীবী মানুষ । কৃষিই আমাদের জীবনধারণের মূলাধার । সেই কৃষি দেবরাজ ইন্দ্রের প্রসন্ন দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল । ইন্দ্র কে তুষ্ট করার জন্য আমাদের ইন্দ্রধ্বজা উত্তোলন করতে হবে । এর জন্য যেমন বৃক্ষচ্ছেদন করতে হচ্ছে , তেমনি তার পরিবর্তে আমরা এই অরণ্যে পাঁচটি বৃক্ষ রোপন করবো।"
পূর্বে এই দণ্ডটি আনার সময় দিগ্বিদিক প্রকম্পিত হত নানান বাদ্যযন্ত্রের নিনাদে । ব্রাহ্মণেরা করতেন বেদধ্বনি । পথের ধারে দাঁড়িয়ে বারবিলাসিনীরা শঙ্খ ধ্বনি ও উলুধ্বনি করতেন । তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হত নানারকম সংগীত । ইঁদকুড়িতে ইঁদটাঁ'ড়ে পৌঁছে নির্দিষ্ট স্থানে সেই শাল দণ্ড প্রোথিত করে তার উপরে বাঁশের ছাতাকে নতুন বস্ত্র খন্ড দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয় । ছত্রটিকে খই দই ইত্যাদি দিয়ে পূজা করা হয় । সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে ঢাক ঢোল । ইন্দ্র দন্ডটিকে কেন্দ্র করে ঘিরে-ঘিরে শুরু হয় নৃত্য । কোথাও কোথাও একটি দণ্ডের পরিবর্তে দু'টি দণ্ড ব্যবহৃত হয় । পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গের মতো বিহারের দ্বারভাঙ্গাতে এবং উড়িষ্যার গড়জাত মহলেও ইঁদ উদযাপিত হয় ।
"যখন উঠে ইঁদটি ,
তখন ভাঙ্গে নিঁদটি ,
ঝাড়গাঁর গড়ে ।
ঠমকি ঠমকি হাতি চলে ,
ঝাড়গাঁর গড়ে। "
এই ইঁদ ওঠার সময় যদি কিছু ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে তাহলে তা অমঙ্গলসূচক বলে বিবেচিত হয় । যেমন ধ্বজদন্ড উত্তোলনের সময় মাটিতে পড়ে গেলে রাজ্যনাশ হয় । দণ্ডটি ভেঙ্গে পড়লে রাজার মৃত্যু ঘটে। আবার ছত্রটি ভেঙ্গে পড়লে রাণীর মৃত্যু হয় । এসব কথার উল্লেখ আছে দেবীপুরানে । বাস্তবে এগুলি কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয় ।
ইন্দ্রধ্বজা উত্থানের আট দিন পর তা নামানো হয় । দিনটি ইন্দ্রদণ্ড সহ ধ্বজা বিসর্জনের দিন । কোন কোন রাজপরিবারে ইন্দ্রের বিসর্জন হয় সংগোপনে। তাঁদের সংস্কার আছে, বিসর্জন দেখলে নাকি এক বছরের মধ্যে রাজার মৃত্যু অনিবার্য । তবে সর্বত্রই সেদিন রাজা সমস্ত আভিজাত্য বিসর্জন দিয়ে প্রজাদের সঙ্গে আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠেন । হাতির পিঠে চড়ে রাজা সারা ইঁদকুড়ি পরিভ্রমণ করেন এবং প্রজাদের ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা করেন , খোঁজ খবর নেন । প্রজাদের সঙ্গে আলোচনা করে সেই বছরের কৃষি উৎপাদনের সম্ভাবনার বিষয়টি জেনে রাজস্ব নির্ধারণ করেন । রাজার রাজ এলাকার মধ্যে যে গ্রাম বা মৌজার কৃষি উৎপাদনের সম্ভাবনা সবচেয়ে কম , সেই মৌজার উৎপাদনের কথা বিবেচনা করেই সাধারণত খাজনা নির্ধারিত হত । এতে প্রজাদেরই লাভ । তবে সেই রাজত্ব আজ আর নেই । রাজ ব্যবস্থাও নেই খাজনা নির্ধারণও নেই । আদায়ের প্রশ্নও ওঠে না । পূর্বেই উল্লেখ করেছি ইঁদকুড়ির ইঁদটাঁ'ড়ও সংকীর্ণ হয়ে এসেছে । মানুষের দাঁড়াবার গাছতল নেই । চুড়ি-মালা-ফুল-ফিতা, ফিরফিরি-ফ্যাটফেটি, হাতে বেলা গোলাকৃতির ছোট ছোট নানা রঙের পাপড় ভাজা, জিলিপি , মনোহরা বিক্রির দোকান বসার জায়গা নেই । বারোভাজা বিক্রির খোপ ওয়ালা চৌকি , কাঠপুতুল বিক্রির মানুষ আজ আর দেখা যায় না । সর্বোপরি ইন্দ্রের ধ্বজার প্রতি মানুষের আজ আর আস্থা নেই , মানুষের হাতে আজ নিত্যনৈমিত্তিক অন্য অন্য ধ্বজা । মানুষের হাতের তালুতে আজ ভিন্নতর সংস্কৃতি ।
__________
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : দেবাশিষ সাহা
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন