জলশ্যাওলার বিরহকথা
জলশ্যাওলার বিরহকথা
দীপংকর রায়
তুমি কাকে দেখতে চাও, কাকে খুব কাছে পেলে তোমার এই উড়ু উড়ু ভাব এক নিমেষে থেমে যাবে?যাদের নিয়ে যে সঙ্গ- আকাঙ্ক্ষায় তোমার সকল সত্য গাছে চড়ে, বেশ খানিকটা উঁচুতে উঠে চিৎকার করে খালি খালি, আকাশ এবং বাতাসের মগ্নতায় , পাতায় পাতায় শিরশিরিয়ে বেড়ায়, তাদের এসব দিয়ে কী হবে----?
যারা বোঝেই না---- সঙ্গ মানে শুধুই সঙ্গ নয়, সঙ্গ মানে স্পর্শ, ছোঁয়া; যদিও ছোঁয়া না হলেও তিনি উপনীত হতে পারতেন, কিন্তু এতেও তো তা হবার নয়, এ যে গোদা, নিরেট, সমস্ত ভেতর মহলের চৈতন্যে সে টানা ঘুম দেয়! তাহলে তুমি তাদের ছোঁবে কী করে? আর তাই কি তোমার এই ইঙ্গিত তাদের অন্য মানে দেয়? অন্যই বা কী, অন্য বলে কিছু আছে নাকি? অন্য মানে প্রতি শব্দে যে আলাদা আলাদা ভাব, কিন্তু তাও কি ঠিক? তাহলে এই যে এত একাকার হবার বাসনা, তার মধ্যেও কি এক গভীর ছলনা আছে----? নাকি একটি গভীর চালাকি! স্বপ্ন দেখ কেন, কেন এত দুই পা শুয়ে শুয়ে ডোলে বেড়াও? সব বুড়ো আঙুলে লুকোনো থাকে নাকি সেই স্পর্শ? সব বুড়ো আঙুল, বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে রাতের বেলায় পুরুষেরা মেয়েমানুষ হয়, না মেয়েমানুষেরা পুরুষমানুষ হয়? কোনটা হলে তোমরা খুশি?
জানি, সেসব বলবে না। নিতান্ত গোপনে রেখেই এইভাবে দুষিয়ে বেড়াবে সারা জীবন। যে সব প্রণালীর মধ্যে এমন সব সম্পর্কের ওঠা নামা, এমন সব সম্পর্কের চি কিত্ কিত্,ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা; তাহলে বলতে হবে, যা কিছুর আড়ালে সেই মহান সম্পর্কের, স্পর্শের জন্যে তোমরা এলোমেলো হও, তা কেউ তার মতো করে পায় না!
নাকি পাওয়া-টাওয়া ভেক, যা আসে সেটাই অধিকারের, যা যায় সেটাই অনধিকারের?
তবু তো মিলিয়ে দেবার একটা ব্যপার থাকে, না, তাও ঠিক না? বলবে যার যার মত মেলে, যে যার মত মেলায়, এইটাই নিয়ম, এই-ই অভ্যাস, একেই বলে নিরন্তর, যার মধ্যে দিয়ে ধুলো ওড়ে, পথ বড় হয়, বাঁ পাশে ডান পাশে আঁজি টেনে নেমে যায় সেই গৃহের পথটি!
কখনো তোমার মনে হতেই পারে সবটাই ওই বড় রাস্তার শাখা, সবটাই নানান স্পর্শের ভেতর টানা আছে! যেমন তার মন আজ বড় প্রশ্নমুখিন, যেমন তার মন আজ গভীর বিচ্ছিন্নতায় আমড়ে আছে। দেখে তোমার মনে হতেই পারে, গাছটার সব পাতা কুঁকড়ে গেছে নতুবা গাছটি শেকড়শূন্য বসানো আছে-মাত্র অন্য উপমায় ।
অন্য বিশ্লেষণে যদি সে গাছ না হয়ে পাথর হতো, তাহলে এই শূন্যতার কোনো মানে থাকতো না বলো?কিন্তু কেউ যদি সেখানে একটি নারায়ণ শীলা ভরে দেয় গভীর নিষ্ঠায় , তাহলে বোধহয় ভগবান কথা বলে উঠতে পারেন, ভগবান আশীষ জানাতে পারেন জনতার উদ্দেশে? জনতা করজোড়ে থমথমে মুখ নিয়ে একবার শূন্যে , একবার পাথরে ! ফলাফল কী হত তাহলে? ফলাফল তাই হত, যেখান থেকে এলেবেলে হয় তারা। যেখান থেকে তুমি এই স্পর্শকে পাপ আখ্যা দিয়েছো অন্যএক ধেড়েমিতে পড়ে। তোমাদের নিষ্ঠায় সম্পূর্ণ কোঁত না দিলে যেমন মলত্যাগ হয় না, ঠিক তেমন, সে কথাও সে কথা হয় না, যার পর তিনি এসে তার হাত দিয়ে করজোড়ে ফেলে দেন সেই পুষ্প, যে ফুলের জন্যই তুমি তাকে দেখতে পাও।
আমরা সকলেই আমাদের মত করে, আপনি যাকে আমাদের মত বলছেন, তাকে দেখতে চাই ----কথা ঠিকঠাক হল না। কথা ঘুরিয়ে আমি যেমন তোমাদের জালে ফেলছি, তোমরাও জাল দীর্ঘ হোক এই ছলনায় তাকে দীর্ঘায়িত করছ এই ভেবে, দেখ না, নছল্লাটা কতটা দূরে গিয়ে শেষ হাতটি রাখতে পারে মূল জায়গায়!
--- তার মানে, আপনি কি বলতে চাইছেন, আমরা হাত রাখবার জন্য ব্যাকুল?
---না, তা ঠিক না, তবে এও বলছি হাতটি হাতের মত হওয়া চাই ---- মানে, যাতে তোমাদের স্বপ্নগুলো ঠিক ঠিক মত থাকে। অর্থাৎ, উত্তেজনার শিশমহল ছোঁয়া ।
----- আপনি ভীষণ অশ্লীল।
----শ্লীল অশ্লীল বলে কিছু নেই ---যেমন নেই ল্যাংটো ঢাকা বলে কিছু। সবটাই আমাদের শিক্ষা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত, আমাদের ধ্যান দিয়ে ----আমাদের আকাঙ্ক্ষা তাকে পান্না হীরে চুনি এইসব বানায়, আমাদের আকাঙ্ক্ষাই তাকে গগনচুম্বী করে। তা না হলে গাছে গাছে এত বিভিন্ন ধরণের বর্ণে ঘুরে বেড়াতে পারত না সে। অর্থাৎ সকলেই তো ফুল, আবার ফুল হলেই তো হল না, ফুলেরও তো জাত আছে, নানা জাতের সব ;
------ আপনার এত কথার সব অর্থ বোধগম্য হবে, এমন তো কথা নেই, শুধু এই কথাটাই আমাদের কাছে সত্য , আপনারা কাহিনীকারেরা, শিল্পীরা, বড্ড সমকামী ।
-----হ্যাঁ হ্যাঁ ... ঠিক আছে, এই কথার পর আমার একটা প্রশ্ন জাগে, সমকামী মানে কী? কাম মানে কি তাই, যা শুধু কর্মে বাঁধা? আর তাই যদি, তাহলে শ্লীল অশ্লীলতার প্রশ্ন কী ওইভাবে আসে? আমারাই বা ল্যাংটো হলাম কখন? তোমরাই বা অবগুণ্ঠনে অবগুণ্ঠনে হয়ে উঠলে সেই মানুষ? বোঝাতে পারবে না, একটুও বোঝাতে পারবে না।
-----না না বোঝাতে চাইছিও না। শুধু এইটুকুই বলতে চাইছি, আপনার এই সব কথার মধ্যে যে মানে আছে, তার জন্যে আমাদের কোনো কিছু নতুন করে জানার প্রয়োজন নেই। আমরা একটা নিয়মে বেড়ে উঠেছি, এই একটা নিয়মেই মরে যাবো। খামাখা আপনি আমাদের মধ্যে এমন কিছু রং দেবেন না, যা নিয়ে আমরা দিশেহারা হয়ে যাই।
ঘটনা তাহলে কোণ দিকে যাচ্ছে? কথা তাহলে এখানেই থেমে গেল নাকি? কুকুরটির সঙ্গম ইচ্ছা ছিল না বলেই, দু'দিকে দু'জনের এই ছুটে যাওয়া?
এই যেমন এই মুহূর্তে শুনলাম, এ বাড়িতে গোরুর সন্তান ধারণের সময় হলে, পালের ষাঁড় দিয়েই তার সে মুহূর্ত পূরণ করা হয়। এখানে গাইগোরুটির ইচ্ছাটাই প্রধান না গরুটা সন্তান প্রসব করলেই দুধ দেবে, এটাই বড়? কোনটা?
মানুষের যেমন কনে দেখা সময় লাগে, কে কোন গোত্র, গোরুর কেন সেই সমাজ নেই?
এসব প্রশ্নের ভেতর তোমরা ঢুকতে চাইবে না। তোমাদের কাছে গোরুর জন্যে দুধের বিষয়টি যেমনই হোক, মানুষের জন্যেও তেমন কনে দেখা বেলা এবং জাত টাত এসব একটা ব্যাপার, তারপর বেঁচে থাকা, সমাজ টমাজ এবং শেষে সেই শেষ কথাটি, একটি উচ্চ পরিচয়, যা গোরুর জন্যে দুধের জন্যেই সীমাবদ্ধ শুধু, যা মানুষের জন্য অন্য ছদ্মবেশে, গোরুরই মতো !
আর এসবের মধ্যেই কি বুড়ো আঙুল এবং পায়ের দ্বিজাতিতত্ব লুকিয়ে?
তাহলে যে, এই যেমন সেদিন, তোমাকে দেখলাম মগ্ন একটি মুহূর্তে চোখে জল ভরে নিয়ে, গায়ে ঘাম শুখিয়ে টেবিলের উপর, চেয়ারের উপর, বিছানার উপর চনচনে টনটনে মুখটি লাল করেই টুপ করে পানকৌড়ির মতন জলে ডুবে যেতে দু'চারবার; এরপরে খানিকটা কলের জল মুখে ছিটিয়ে নিয়েই, আবার এসে শান্ত চুপচাপটি হয়ে যেতে কী স্বাভাবিক ভাবে! মনে করেছ কি, এ আমার চোখের আড়ালে ঘটে গেল, এ আমি বুঝেও কেমন নাদান গোবেচারাটি হয়ে গেলাম?
না, তা তোমাদের ওই কনে দেখা আলোর সংস্কার ----- তা তোমাদের ওই জাত-ধর্ম নির্বিশেষে লুকোনো উচ্চ আকাঙ্ক্ষার ফলাফল ----- আমি আর কিছুতেই গোয়ালে বাঁধা ওই ষাঁড়টির মত দড়ি ছিঁড়তে পারলাম না। আর তাই তোমরা মজা পেলে! আর আমি শেষপর্যন্ত যেন জাবর কাটতে কাটতে, কান নাড়তে নাড়তে, গলা চুলকোতে চুলকোতে, ঠ্যাং ভেঙে মাটিতে বসে পড়লাম! অর্থাৎ গৃহকর্তার মর্জি হলেই আমার গলার বাঁধা দড়িটা খুলে দেওয়া হত , আমিও টেবিলের কোণায় ,চেয়ারের উপর, বিছানার উপর চড়ে এমনই একটি কাজ করে ফেলতাম, যখন তোমাদের আর বুড়ো আঙুলের সুড়সুড়ির প্রয়োজন হত না এই ভেবে, কখন সেই কনে দেখা আলো, থুড়ি, বেলা ----মানে সময় আসবে, আর তোমরা একে একে এমনই এক পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে যাবে, যেখানে গোমাতা আর গোমাতা থাকবে না, তিনি তখন কুয়াশাচ্ছন্ন একটি ভোর প্রকাশিত করছেন। আর আমরা আমি থেকে ছোট্ট একটি ছায়ায় বেরিয়ে আসছি দিগন্তপ্রসারী ওই ফসলের মাঠের ভেতর থেকে এমনই একটি ছায়া হয়ে, যাকে দেখে তুমি কেঁপে উঠবে, তুমি উড়ে উঠবে পুনরায়, যে সকল আকাঙ্ক্ষায় তোমার মনের সকল সত্য গাছে চড়ে ফের নেচে উঠবে ---- ?
দশই নভেম্বর ইমিগ্রেশনের সিল পড়লো। পড়লো দু'পাশেই । এর আগে কতবার পড়েছে, গোনা নেই।
প্রথম যেবার এই দেশে এসেছিলাম, সেটা ছিল গ্রীষ্মকাল, আম পেকে উঠেছে, ঝড়ের পূর্বাভাস ----- হাওয়া, আমরা একটি পাড়ার মধ্যে দিয়ে দৌড়চ্ছি ----পাড়াটার রাস্তার ধারে সিমেন্টের ফলকে কিছু লেখা ছিল কিনা তা মনে নেই । তবে পাড়াটার বসতবাড়ির মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গা ছিল। আম কুড়োচ্ছিল দু'পাশেই পাড়ার বউ-ঝি-রা, বাচ্চারা, আমিও কুড়িয়েছিলাম পায়ের কাছে পড়া আধো হলদে একটি আম। এরপর একটি বাড়িতে রাত্রিবাস। ভোর ভোর গরুর গাড়ি চেপে মাঠের পাশ দিয়ে গাড়োয়ান ডাস মাছি তাড়াতে তাড়াতে আমাদের তিনজনকে নিয়ে একটি ফাঁকা পথের মাঝে, 'পুলিশ... পুলিশ....' বলে ভয় দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। বলেছিল, 'এখানেই নেমে যাও। '
এরপর অনেকটা রাস্তা। বাগান জঙ্গল অনেকটা পেরিয়ে তবে পিচ রাস্তা। বাসের আওয়াজ। শহরে যাবার পথ।
সেসব কতকাল আগের কথা! এখনো মনে পড়লে আঁতকে উঠি।
আজ যখন এই পথ পেরোচ্ছিলাম, তখনও মনে পড়ছিল আরো এক সময়ের কথা, একাত্তর, মাঝের এই তেত্রিশ বছর, তার মধ্যে ভাগ করে কত বছর কলকাতায়, কত বছর এদেশে, তা পাসপোর্টের আগের বইগুলি ঘাঁটলে মনে পড়বে। কিন্তু তাইলে কি সব স্মৃতি পাসপোর্টের পাতা উল্টোলেই মনে পড়বে? মনে পড়বে কি ছেলেবেলার সব অনুসঙ্গ ?
হয়তো একটু একটু করে পড়বে। তাই বলে কি সেই জাবর কেটে এখনো কোনো লাভ আছে?
তা যেমন নেই, তেমনই এও ভেবে লাভ নেই, কেন এই টানাপোড়েন?
হয়তো কোথাও কিছু রয়ে গেছে বলে আজও এই বছর অন্তর একটি অনুষ্ঠানকে মনে রেখে দিন গোনা! কিন্তু সব কিছু কি ঠেলে ফেলে দেওয়া যায়, না ফেললেই ফেলতে পারি? অনেক কিছুই তো যেতে চায় না। এই যেমন, প্রত্যেকের এত অনুরোধেও আজও পারলাম না এই পুজোটাকে ওদেশে নিয়ে যেতে। সকলেই তো বলে, 'মুসলমানের দেশ, আর কি লাভ , এই পুজো ওদেশে রেখে? খরচা তো আছে একটা, সেও তো কম না!'
খরচা। সময়। টানাপড়েন। লুকিয়ে-চুরিয়ে জামাকাপড়, ফলমূল, রং-তুলি, ডাকের সাজ, এই সব, এই সব করেও তো সেই দিদিমা একেবারে আসার পরেও, টেনে হিঁচড়ে বছরগুলো কাটিয়ে এইভাবে ; এখন এসব সব গা সওয়া হয়ে গ্যাছে। টাকা দেওয়া। ভয় ভয়। লুকোনো-চুরনো। জড়তা। ডলার। টাকা বিনিময় । এসব সবই গায়ে সয়ে গেছে। কিন্তু এসবের পেছনে কোনো অনুপ্রেরণা কাজ করে কি? না তা খুব পরিষ্কার করে বলতে পারবো?
আসা এবং যাওয়া। এ যেন ক্রমাগত একটি বিধান। দুর্গা পুজো হয়ে যাওয়ার পর পরই একটি টান ----- এ যেন অমোঘ! কার যেন ডাকের ইশারা ------ তল্পিতল্পা বেঁধে অমনি ছুটে চলা।
এই তো, বর্ডারের নিয়মকানুন পর্ব শেষ করে একটি রিক্সার জন্য দাম দস্তুর ঠিক করবার সময় একজন বি. ডি. আর-কে দেখলাম মোটরসাইকেলে আমার চারপাশে ঘুরপাক খেতে। মনে মনে বেশ উতকণ্ঠাই জাগছিল, ভাবছিলাম কী চায় রে বাবা-- এ ? ওমা, এ দেখি এগিয়ে এসে আমাকেই জিজ্ঞাসা করছে আরো,' ভালো আছেন দাদা? '
আমি বললাম, 'কে ভাই, আমি তো ঠিক চিনতে পারলাম না! '
------ ভালো করে দেখুন তো, চিনতে পারছেন কি না?
------ না, ঠিক করতে পারছি না তো, আচ্ছা, আচ্ছা দাঁড়াও দেখি, উঁ....
------কষ্ট করতে হবে না বেশি, আমি বলে দিচ্ছি, নীলুকে চেনেন তো, আপনার মামাবাড়ির পাড়ার শেষের বাড়ি ----যোগিন পরামানিকের ছেলে নীলু, আমি তার ছোটো ছেলে বলাই ---
------ও নীলু মামার ছেলে তুমি --- হ্যাঁ হ্যাঁ , এবার চিনতে পেরেছি। বাবা! তুমি একেবারে আঁতকে দিয়েছিলে তো প্রথমটায় , ভাবলাম, কী রে বাবা, এ এমন চারপাশে পাক খাচ্ছে কেন, কী অপরাধ করেছি রে বাবা! তা, বলো, তুমি এখানে কতদিন?
------ তা হলো তো, বেশ কিছুদিন তো হলো, তা, আপনার রিক্সা নিয়ে কি একটা হচ্ছিল যেন? অ্যাই ---এদিকে এসো দেখি, এনাকে তোলো তো দেখি, উঠুন দাদা, চলুন, আমিও আছি সঙ্গে সঙ্গে আপনার , চলুন বাসে তুলে দিয়ে আসি.....
এতক্ষণ যারা রিক্সা নিয়ে দামদস্তুর করছিল তারা বেশ সহজেই একে অন্যকে বললো, ' তুই নিয়ে যা, যা দেখি, স্যারের লোক..... '
------ এনারাও কি আপনার সঙ্গে?
------- হ্যাঁ হ্যাঁ --- দু'খানা লাগবে ----
------- এই, দুটো...
দুটি রিক্সাই আমাদের তুললো। আর কোনো দাম-দরের ব্যাপার নেই। এতক্ষন সিরিয়াল, সিরিয়াল এত সব, সব থেমে গ্যালো। -----' তাহলে ওঠেন দাদা, নাকি, আপনি আমার বাইকে উঠবেন? তাহলে ওঠেন না, ওনারা উঠুক রিক্সায় না হলে, ওখানে যেতে যেতে কথা বলি না হয়.... '
বলাই-এর বাইকে না উঠে আমিও রিক্সাতেই উঠলাম। আমার সঙ্গে যারা ছিল তারা আর একটিতে। তবে বলাই-এর হম্বিতম্বিতে সবকিছু বেশ সহজ হলো। রিক্সা চলতে লাগলো বেনাপোল বাসস্ট্যান্ডর দিকে। আমার মনে পড়ছিল, বলাই-এর দাদুর কথা। সাতষট্টির সেই তিনজনের চুরি করে বর্ডার পেরোনোর মধ্যে একজন তো এই বলাই-এর দাদু ! আর আমার দিদিমার হাত ধরে আমি। আজ তেত্রিশ বছর কি, তার বেশি-ই হবে, আজ তারই নাতি, সে কিনা আজকের সীমান্ত-প্রহরী !
ভাবনার ভেতরে যেটুকু আবেগ এই মুহূর্তের ঘটনার সঙ্গে প্রবেশ করতে চাইছিল, তারমধ্যে বড় বেশি করে মনে পড়ছিল তাদের বাড়ির মিষ্টি তেঁতুল গাছটির কথা। মিষ্টি তেঁতুল আর আমার ছেলেবেলার সঙ্গী তার পিসির কথা। আমার প্রথম একটু বড় হবার দিনগুলির টুকরো টুকরো কথা। কত ছবি যে সে সব, কাঁচাগোল্লা খেতে যাওয়া তাদের বাড়ির সকলবেলাগুলোর কথা। তাদের মিষ্টির ব্যাবসা ছিল। যতদূর জানি এখনো আছে সে ব্যাবসা। মনে পড়ছিল ওর ঠাকুমার কথা। দাদুর মৃত্যু সংবাদ শোনার কথা। সব এক টানে একসঙ্গে কেউ যেন বলাই-এর মুখের ছায়া ভেঙ্গে, কেউ যেন ঝপাঝপ অতি পুরোনো কতকালের স্লাইডগুলি একবার চোখের সামনে ধরেই সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে......!
বেশ কিছুক্ষণ রিক্সায় চলতে চলতে আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। বলাই আমাকে একেবারে বাসে তুলে দিয়ে, তারপরে তার পদমর্যাদার কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে গেল, ' সামনে যদি বি. ডি. আর কোনো মালামাল নিয়ে অহেতুক ঝামেলা করে, তাহলে আমার নামটা বলবেন, আমার ব্যাচ নম্বরটা লিখে রাখুন, বলবেন, সে আমার ভাই হয় --- ।'
আরও বলে গেল, বাড়ি পৌঁছে আমি যেন তার বাড়িতে তার এই বর্তমান অবস্থানের কথাটা বলি ওর বাবা-মাকে।
বাস ছাড়লো। বাসের শেষ গন্তব্য বরিশাল। বরিশাল নামটার সঙ্গে অন্য গল্প জুড়ে আছে। সেসব স্মৃতি না হয় থাক।
একটি একটি করে চেনা, অতিপরিচিত কত সুবাস সমেত ছোটো ছোটো মফস্বল শহর, বাজার, আর ফাঁকা মাঠের ফসল শূন্য ক্ষেত, অল্প অল্প ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস, এই হেমন্ত ঋতুর আবহ, এই সব নিয়ে দুটি ঘন্টা কাটানো এই বাস যাত্রা, যা প্রতিবারের, প্রতিটি কার্তিক অঘ্রাণ জুড়ে, যে স্মৃতিমাধুর্য, তা কি কোনোভাবেই ভোলার? এরপরেও আর এক পর্ব ছোটো বাস যাত্রার পথ থাকে। তারপর গাঁয়ের পথ, ভ্যান রিক্সা, নদীর পাড়, নবগঙ্গা, খেয়া নৌকো, সব কিছুই তো কত কথাই না মনে করায়!
দিনলিপির পাতা থেকে:
---- সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কুয়াশা ছড়িয়ে পড়েছে নদীর উপরে। খেয়া ঘাটে আমি একা। কোথাও কোন মানুষজন নেই। ওপারে সবে যেয়ে খেয়া লেগেছে ঘাটে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ঝাপসা। জলের দু'চার হাত উপরে কুয়াশারা ভেসে বেড়াচ্ছে। ওপারে, ঘাটের উপরে যা দু'একটি দোকান-ঘর আছে, তাতে আলো জ্বলে উঠেছে। কারণ আজ গড়হাট। হ্যাঁ হ্যাঁ তাই তো মনে হয় ! এর আগে, অর্থাৎ বছর কয়েক আগেও তো এইসব দিনকাল, ঋতুকাল, সময়, সব জল-ভাত ছিল। কিন্তু এখন? এখন কেন এই একাকিত্বে গা ছম ছম করছে? অথচ কতো একাকী মুহুর্ত এই তো বছর দশ আগেও গায়ে লাগত না! ঐ তো ওখানে দাহ করা হয়েছিল হাজরা বৈরাগীকে! তার একটু ওপাশে উত্তম গলায় দড়ি দিল! এপার ওপার মিলে কতজন তো চলে গ্যালো! যাক সেসব, এখন এই নিলক্ষ্মীর চরে বসে ওসব আর ভেবে কী করবো? মনে মনে ভাবতে থাকলাম খেয়া কখন আসে।
এইসব পর্ব। এমন সব পর্ব পর্বান্তর পেরিয়ে বছর ঘুরিয়ে এখন একবার করে আসা। আর সেও কি এমনি এমনি? এতদিনের পুজো, কালীপুজো, দিদিমার পালন করা অনুষ্ঠান। শুধু কি অনুষ্ঠান? আর কিছু না? ওরে চতুর মন, তুমি কি কিছুতেই স্বীকার করতে চাও না বাকি কথা? গোপন করতে চাও! গোপন করে করে সবই তো এলোমেলো হয়ে গ্যালো! পারলে কি রাখতে? এই যে এত করে গোপন জালে আটকে কানকোবাজি খেলছ, তা কি অজানা কারোর? কিন্তু একবারও ভেবে দেখলে না, বেলা যে যায়, অনেক বেলা হল তো, এখনও একই রকম রয়ে গেলে! পাল্টাও না এবার একটু...
কী করে পল্টাই বলো, যা স্বভাব তা তো একইরকম থাকে । সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে না হয় কম আবেগী করে নেওয়া যায় একটু, তার বেশি তো আর কিছু করা যায় না! তাছাড়া যে মানুষ সবটাই পাল্টাতে চায়, বা পারে, তাকে কি তোমরা ঠিক মানুষ ভাবতে পারো?
না, পারি না। তা আপনি জানেন বলেই এতটা জোর দিচ্ছেন, আপনার ওই বিশ্বাস, এই একগুয়েমি, এসব নিয়ে কী পেলেন ,তা কি একবার ভেবে দেখেছেন?
পাওয়া না পাওয়ার সঙ্গে তো আমি চলিনি !সকল মানুষ কি পাওনাই চায় শুধু?
কোন্ দুনিয়ায় আছেন আপনি? এখন কথা বলতে ইচ্ছা হলেই যে কোনো জায়গায় কথা বলতে পারেন, ঠিক সেইভাবে ভাবলেই আপনার এই ভুল সুখানুভূতি ফুরিয়ে যাবে।
নদীতে হাওয়া দিচ্ছিল। বুকের ভেতর দশ বছরের আগুন সেই বাতাসে গা ভেজাতে চাইছিল। কিন্তু তা কি হয় ,তা তো হয় না! তা হয় না বলেই সে নদী --- এই হাওয়া ---- এই নিষ্ঠুর নির্মম ভাগ্যফল যেন আমাকে উচ্ছন্নে পাঠিয়ে দিতে চায় ---- অথচ তাও তো পারে না! আমি দেখে ফেলি তার চিত্তচাঞ্চল্য, চঞ্চলতার সুবাস, ওই চেরা কাঠের হলুদ হয়ে যাওয়া বুকের উপরের এই রোদ-ছাওয়া শীতের গন্ধ ; না না তাও যে সবটুকু না, এ এক মরা আলোর জ্বলে বেড়ানো নিঝুমতা যেন, ওই চেরা কাঠের এই রোদছাওয়া উদাসীনতার এই তেপান্তরী ভাব বিনিময়ে সব কিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে যেন!
পুজোপাঠ শেষ করে দশবছরের স্মৃতি- বিস্মৃতি উলটে পালটে এক এক পিঠ ভালো করে দেখার পর রওনা হওয়া গেছিল। কিন্তু কি অমোঘ নিষ্ঠুরতা, আবার এক তোড়ে নৌকার মুখ ঘুরে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার মতো এসে পড়ল যেন আর এক ঘাটে!
গল্প আরম্ভ ?
কিন্তু সে সব ছেঁদ কথা কি এই কাহিনীর গলা টিপে, মেরে, আবার আর একটির উদাসীনতার হাওয়া-বাতাস নিয়ে খেলছে, এ সব কি একেবারে খাপছাড়া নয়? না না প্লট চাইছি না আমরা, প্লট চাইছি না। সে সব ঢ্যামনামি ঢের হয়েছে , এ প্লটে অন্য একটু গল্পের সূত্র যদি না দাও তাহলে এত নিছক ভ্রমণবৃত্তান্ত, না হয় আত্মজীবনী মূলক কিছু! কিন্তু তা তো ধরতে পারছি না! আচ্ছা আচ্ছা বেশ বুঝলাম গল্পের প্রধান চরিত্র তার স্মৃতিপথে হাঁটছে । আমরা সে পর্যন্ত চুপ করেই থাকলাম। কিন্তু তা এত সংক্ষিপ্ত, তাও আবার দিনলিপির পাতায়! এ যে একেবারে দরখাস্ত লেখার মত, এ যে একেবারে চিঠি ---- চিঠি? না, তাও ঠিক না। প্রলাপ বলবো একে। না না তাও ঠিক হয়নি। তার চেয়ে বাপু চুপ করে থাকো, আমরা শুনবো না। তুমিও বলবে না।
রেগে যাও কেন? তোমার এই রাগ মানায় না। তোমার এই রাগ মানায় না । তুমি তো ইতরের থেকেও অধম। গণ্ডেপিণ্ডে শুধু মানুষের দুর্বলতা নিয়ে খাওয়া দাওয়া সারতে চাও। কিন্তু একবারও কি ভেবেছ সে সব কেলেঙ্কারিতে কত ঝাউপাতা হাওয়া বাতাসে ঝরে পড়ে এই বালির ভেতর!
ও সব ভাবি বলেই তো নিজের আপন সত্তাও রেহাই দেয় না আমায়। না না আমি নিজেই দিই না তাকে রেহাই। দিলে আর যাই হোক এসব নিয়ে এমন খামখেয়ালী করতে পারতাম না। তোমরা ভাবো লেখক মনগড়া কাহিনী বানিয়ে বেশ ফুরফুরে হাওয়ায় দোল খায় ! তবে শোনো, সে লেখক না। সে লেখার দোকানদার। পশরা সাজিয়ে বসে। তার সাথে রাস্তার ল্যাংড়া ভিখিরির, কানা ভিখিরির কোনো তফাৎ করা যাবে না। আমি তেমন লেখক হতে চাইনি জনৈক পাঠক, আমি সেরকম হতে চাইনি ------ আর যার জন্যেই সমস্যাটা আরো ঘোঁট পাকিয়েছে । এই যেমন, আজ বিশে নভেম্বর, মোটামুটি একটি বিদায় পর্ব সেরে, আমার প্রধান চরিত্র, ধরো যার নাম রাখা হল পথিক, ধরে নাও সে এবার শহরের পথ ধরল গ্রাম ছেড়ে । অর্থাৎ একটি স্মৃতির পথ ছাড়িয়ে আর একটির দুয়োরে প্রবেশ করছে এমনই সময় ----- 'আরে আরে কে এসেছে দ্যাখো দ্যাখো ---
---- ওমা.... জামাইবাবু যে.....!
(চলবে...)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন