দ্বিতীয় বর্ষ ।। দশম ওয়েব সংস্করণ ।। ১৩ ভাদ্র ১৪২৮ ।। ৩০ আগষ্ট ২০২১








পুজো আসছে, গবেষকদের মতে আসছে মারাত্মক তৃতীয় ঘেউ। যাতে নাকি বড়োদের সাথে সাথে বাচ্চারাও দারুণভাবে আক্রান্ত হবে। এবং সেই আক্রমণের গতি হবে দ্বিতীয় ঢেউ-এর থেকে অনেক গুণ বেশি। মৃত্যুর হারও হবে দ্বিতীয় ঢেউ-এর তুলনায় অনেক গুণ। যার জন্য আগাম সতর্কতা অতি আবশ্যক। আবশ্যক সাধারণ মানুষ এবং সরকার একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে চলা। যাতে যতটা সম্ভব এড়ানো যায় এই মারাত্মক মহামারীর দাপটকে। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের সচেতন সরকার তা আটকানোর বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্ৰহণের সাথে সাথে একটা মারাত্মক ভুল করে বসলো। তা হলো এই সময় দুয়ারে সরকার ক্যাম্প করা। এই ক্যাম্পগুলো করোনার গতিকে যে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হয়ে উঠবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অর্থাৎ আমাদের আরও একবার মরণ ফাঁদে পড়ার জন্য এবং তৃতীয় ঢেউ চলে আসার পর অহেতুক পুলিশের লাঠি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
             গতবার অপরিকল্পিত নির্বাচনের কারণে, রাজনৈতিক দলগুলোর মিটিং মিছিল জমায়েতের কারণে দ্বিতীয় ঢেউ-এর গতি ত্বরান্বিত হয়েছিল। এবার সেই গতি বাড়ানোর কাজে নেমে পড়লো রাজ্য সরকার নিজেই। আর সাধারণ মানুষের কথা বলে কে? কোথাও কিছু পাওয়ার কথা এলেই হুমড়ি খেয়ে পড়া স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাতে জীবন যাচ্ছে যাক না, পাঁচ শত টাকা তো আসবে মাসে মাসে।



উত্তম মাহাত, সম্পাদক


_____________________________________________
এই সংস্করণে যাঁরা লিখছেন
_____________________________________________

মনোজ দে/ রুমি চৌধুরী/ গৌতম রায়/ দেবাশীষ সরখেল/ উমা মাহাতো/ সুজন পণ্ডা/ কুমারেশ তেওয়ারী/ উৎপল দাস/ মধুপর্ণা/ তপন পাত্র/ দীপংকর রায়/ কল্পোত্তম

_____________________________________________



ঋণ

মনোজ দে


শহরের মাঝে থেকে বোঝা যায় না মাটির ঋণ
কিছু দূরে সরে যেতে হয়, যতখানি দূরে গেলে
রোজ হয় না সম্ভব ফিরে আসা, এমনই বিকেলে
আমাদের তীব্র ঝগড়া, ভেঙে যায় জমানো আশ্বিন


অতঃপর ভবঘুরে বারংবার ফিরে আসতে চায়
সম্ভাবনা, সব দরজা, বন্ধ করে উঁকি দিই শুধু
পথে পথে কাশফুল, দুলে ওঠে বাতাসের ধূ ধূ
কতদূর হাঁটা যায় বলো, এই অনিশ্চয়তায়

রোজ মনে মনে ভাবি তুমি এসে ধরেছ আঙুল
মুহূর্তে যা কিছু দেনা মিটে যায় সিনেমার মতো
হাসি আসে কবেকার গাছে, স্নিগ্ধ সবুজ অক্ষত
একে অপরের বুকে ডুবে যায় ভীষণ নির্ভুল

এমনই বিবাহযোগ্য দিনে তুমি চেনাও শহর
খানিক শিয়রে বসো, কথা দাও শুরু হোক ঘর





রুমি চৌধুরীর কবিতা


১.
কভিড ও কদমের যুগল যাত্রা

                    
কভিড ও কদমের এই যুগল যাত্রায়
কার গল্পের ঝাঁপি আগে খুলি বল তো?
কদম যখন বর্ষার জলে নাদুসনুদুস হয়ে
মনোনিবেশ করছে সতেজ ডালপালা বিস্তারে 
কভিডও তখন বত্রিশটা হিংস্র দাঁত বসিয়ে
মানবজাতিকে সমূলে বিনাশে ব্যস্ত।

মন ও মননের ভৌতিক কর্ষণে আজ
সমকাল গিয়ে ঠেকেছে অচ্ছুৎ মহাকালে
তাবৎ পৃথিবীর অস্তিত্বের ক্রান্তিলগ্নে 
কভিডও যেন তাই নিয়ত কলঙ্কিত করে চলেছে
কদমের নরোম, নধর দেহখানি।



২.
চেতনার গোপন সমুদ্দুর
                

কী এক আশ্চর্য মোহ!
এক অদ্ভুত কূপমণ্ডূকতা!
মুখ ও মুখোশের আড়ালে জীবনের অচেনা অবয়ব
দৃষ্টির সীমানায় অন্ধত্বের অদৃশ্য ছায়া
যেন প্রতিনিয়ত মিথ্যে যোজনার কথা বলে!
যাপিত সময়ের দীর্ঘ সফরে
ক্ষয় হয়ে যায় অযুত মহাকাল
সভ্যতা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে স্মৃতির প্রতিবিম্বে।

অতঃপর একদিন...
মৃত্যু এসে দাঁড়ায় দুয়ারে
বাজায় কোমল সম্মোহনী সুর
যে সুরের তুমুল তরঙ্গে ভেসে যায়
চেতনার গোপন সমুদ্দুর। 



৩.
নির্বাণ প্রতীতি
            

একদিন, দুইদিন, এভাবে অনন্ত সময়
নিরন্তর ছুটে চলা সম্মুখের পানে
কখনো হোঁচট খেয়ে পড়ে নিকষ গহ্বরে
কখনোবা পা পিছলে যায় অপ্রত্যাশিত শ্যাওলায়
তবুও থেমে থাকে না চলা
থামে না স্রোতের গতিধারা।

সম্পর্কের জটিল রসায়নে মুখ থুবড়ে পড়ে
সরল জীবনের গতি
ধুলিধূসর এই বিশ্বআঙিনায় আলোর অভিপ্রায়ে
কালো পর্দা সরায় নির্বাণ প্রতীতি। 


    

গৌতম রায়ের কবিতা

১.
গাছ তো আলোয় থাকে


আগাছাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই
হলুদ পাতা পতনের হিউমাসে
তরতরিয়ে বেড়ে উঠবেই

তাদের সাদা সবুজের আড়ালে 
লুকিয়ে রাখে আমাদের অন্ধকারগুলি
সান বাঁধানো উঠোন থেকে
আমরা ছুঁড়ে ফেলি বদরক্তের মোড়ক
ভাবি কেউ দেখছে না

গাছ ডেকে এনে আলোকে দেখায়
আমাদের অন্ধকারগুলি,
গাছ তো আলোয় থাকে
অন্ধকারের তপস্যা করে না।



২.
গীতগোবিন্দ নবায়ন


ধীরে ধীরে ছাদ আমাকে নিয়ে য়ায় তার অবস্থানে
ভরিয়ে দেয় না-বেড়ার আলোকে
এই ছাদ আমার মন্দির
ধীরে ধীরে সিম হয়ে আসে আলো
অপেক্ষা নিয়ে যায় সন্ধিসময়ে

দশদিক থেকে শঙ্খধ্বনিতে ভরে ওঠে আকাশ
শঙ্খমালার সঙ্গে পাঞ্চজন‍্যের সেতুবন্ধে 
আমার যাকিছু একক সুরের নিশানা পায়,
এতো শঙ্খগন্ধ
এতো আলো
এতো স্থিরতা
এতো জু.ম
সব দরজা বন্ধ করলেও
পৃথিবী এতো আলোকিত কেন মনে হয় ?
কেন মনে হয় এপৃথিবীর গায়ে
এক খণ্ড কলঙ্কের আঁচড়ও
কেউ কী কোনো দিন কাটতে পারে ?
যা কিছু দাগ সেসব আমাদের
নিজস্বী নিদাঘ ।

ধীরে ধীরে কমলা রঙ সরে গেলে
উঠে আসে শুকতারা
আমি তপস্যারেখ যোগ করে
শুকতারা বিভার কাছে
নিজেকে নিয়ে যাই
 সেই জ‍্যোৎস্নায় লিখি
গীতগোবিন্দ নবায়ন।




দেবাশীষ সরখেলের কবিতা


১.
শ্রাবণশ্রমে পাথর ভূমে


পাথর ভূমের শ্রাবণশ্রমে  স্তব
হরিৎ রঙের টব
স্বপ্ন নাকি প্রকৃত বাস্তব ?
হরিৎ রঙের টব।

পাথর ভেঙ্গে ভেতরে জলতল
ভিতর চেং, মাগুর খল বল ।

পাথর কে যে ভাঙ্গে এবং ভাঙ্গায়
রঙছড়ালো  বিরহি  টাঁড়ের  ডাঙ্গায়
প্লাবন নামে প্লাবন থামে  স্থানু তিনি পাথর।
তিনিও তো এক পাথর ।
গানভুবনে ছড়িয়ে গেল আতর।
মনের পাথর সৃজন রসে  যখন দেখো গলে
ভাদুর টুসুর গান অফুরান  সুরসাগরের জলে।
সৃজন সুধায় গান ভেসে যায়
হৃদিপাথর হঠাৎ দেখি গলে
এক রঙিলা ভাষায় শিলা  পদ্ম দীঘির জলে।



২.
বালক জেনেছে


 অনলাইন ক্লাস
 রসুন সংস্কৃতির মত ভাবগতিক
 গুরুদেব বন্দনায় জুড়ে যান আরো দুই কবি ।

 এপারে শিক্ষাসেবী
 অন্যপারে অন্ধকারে রোগা পা দুটি
 প্যান্টের থেকে বড় হতে থাকে ।

 স্পন্দিত গোঁফের রেখা
 চঞ্চল চোখ 
 ভাঙা ভাঙা  স্বর
 অনলাইন ক্লাসে দ্বিপ্রহর  কাল ।

 একটি  এন্ড্রয়েড সেট 
 ওপাশে আচার্য কন্ঠ ।

 খেলা কখন লেখা হয়ে যায়
 কৈশোর মাধুর্য হারায় ।

 সেই অগ্নিময় পিতা
 ধরা পড়ে মাতাশ্রীর চোখ কাচুমাচু
 মাতা পিতা নয় যে বিধাতা ।

 বটের ডালে পিকধনী 
 দুইখানা পিক ।

 কোন গ্রন্থি খুলে গেলে গোনাডোট্রপিক
 বালক জেনেছে ।



৩.
ভাতভোগ


  ভাতের জন্য পরজীবী নও
  যারা উগাল মামাল করে

  যাবট দেয় 
  স্থিতপ্রজ্ঞ বটের ছায়ায়
  চুটি খায় ।

 চেন না তাদের
 ভাত ছড়িয়েছো  
 কাকেরা এসেছে রণ-ভূমে ।
 উদর পূরণের কথা লিখে  স্তূপীকৃত খোয়াব ।

 চেননি হৃদয়
 যারা ভাত ভিখারিনী
 তারাও জেনেছে হৃদয়ের আনন্দবাজার ।

  তুমি  অন্নভোগ শোক ছায়া
  ব্যবহৃত হতে হতে  মনহীন কায়া ।

 ভালবাসাহীন মানুষ  
 ভাগ্যবিড়ম্বিত  যুদ্ধ প্রণালী লিখে  একা কর্ণ ।

 কবচ কুণ্ডল ছিড়ে ছিড়ে  পিড়িত ।
 রচনা করে চলেছ  কাঞ্চন পাহাড়ের  চুড়া 
 ভাতভোগ ।



৪.
চারাগাছ


 কোন গাছের ছায়া ,কোন গাছে ফল
 বর্ষণ পেরিয়ে গেলেও  ঝরে পড়তো জল ।

 অশ্রুরাঙা বেদনা বাহিত গাছগুলি 
আগলে সামলে ভালোবেসে অভিমান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। 

গাছে গাছে প্রস্থানে প্রস্থানে  
উঠোন  শূন্য নয় কোনদিন ।

 আলোছায়া ফুল ফল  হয়ে গেলে গাছের প্রতিভূ ।

 ডালে ডালে জোসনা মাখানো
 জোনাকি মাখানো অন্ধকারময়  জেগে থাকা 
 বেঁচে থাকা ।
 রক্ষক বৃক্ষের মত জেগে আছো
 গাছের পর গাছ  ইতিকথা  
 জীবনবৃত্তে  কোন মুক্তকচ্ছ   ঝরনাদেশ নেই ।





স্মার্টফোন

উমা মাহাতো


তারপর যা চেয়েছি, পৃথিবী হাতের মুঠায় সকলের।

তবু নরম ঘাসের প্রথম পৃথিবী, জনমানবহীন উপকূল ঝর্ণার জলে পাহাড়ি ফুল শব্দহীন আর প্রজাপতি লিখবে মধু, এমন শুদ্ধ হাওয়া -- আঙুল স্পর্শ ভুলে গেছে তার বহুদিন।

তবু, মুঠোভর্তি মানুষের হৃদয় যেন কখনো ছিলই না, যেন কোনদিন নিকষকালো বনপথে গুহা ও শস্যের খোঁজে পাশাপাশি পথ হাঁটে নি কোনদিন, তাই প্রত্যেকে চেয়ে দেখি, কীভাবে শিশুর আশ্রয় আর মানবীর অহংকারকে, যুদ্ধ ও জিঘাংসায় কাছে-দূরে ধ্বংস কিংবা ধর্ষণ করে রোজ

একটি হাত অদৃশ্য মায়ার মতো শরীর ছাড়িয়ে গ্রাম, শহর, দেশ, ভিন্নদেশে উড়ে যায়।

মানুষের মস্তিষ্কে ঈশ্বর, ধুসর পদার্থ প্রকৃত অর্থে। কল্যানের মুক্ত আশীর্বাদ নেমে গিয়ে যাত্রাপালায় পৃথিবী আজ হাতের মুঠোয় অনস্তিত্বে, তারই বিবেকের...




ঘুমন্ত জ্যোৎস্না

সুজন পণ্ডা


রাতের ঠিক কোন গভীরতায়, 
চাঁদ ঘুমিয়ে পড়ে?
লক্ষ অযুত নক্ষত্রের বিছানায়।

বহুদূর বিস্তৃত সমুদ্র তটে
স্বচ্ছ বালু কণা
আয়নার মতো মনে হয়...
পান্না রঙের জলে ছায়া ফেলে
ঘুমন্ত জ্যোৎস্না
আর অতন্দ্রিলা লাইটহাউস।

রাত্রির সব মায়া জড়িয়ে
ঘুরে ফিরে যায় হাওয়া, 
কেবলই প্রশ্নের মত। 

চাঁদ ঘুমিয়ে যায়
রাত্রির সেই গভীর ক্ষনে
যেখানে বিমর্ষ মানুষ লেগে থাকে 
মৃত শৈবালের মত। 




কুমারেশ তেওয়ারীর কবিতা


১.
মালী ও ফুল বিষয়ক কবিতা


যে মালী পাহারা দেয় ফুলের বাগান
সে বড়োই স্বভাবে কোমল
ফুল নিয়ে যেতে আসে যারা
স্বরে মধু রেখে বলে, ফুলের ভেতরে 
বড়ো অনুরাগ থাকে, হাত ধুয়ে এসেছো তো বাবু?

তবু ফুল ছেঁড়া হয়, ফুলের দধিচী
মালীটি নির্বাক দেখে, ফুল তোলার সময় 
কীভাবে বদলে যায় মানুষের চোখ!
চোখের ভেতরে কত ভুল অন্ধকার। 
কারো কারো চোখে বর্ণচাপা সাপ 
কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে যেন ব্ল্যাকহোলে
মালিটি নির্বাক দেখে ফুলতত্ত্ব ছিঁড়ে দেয়
নির্বোধ আঙুল, অবলীলাক্রমে

বেণুকাকা ফুল নিতে এলে
মালী তার সাজি ভরে দেয় পরমার্থ ফুলে 
দেবতার পায়ে যাবে বলে
ফুলের ভেতরে কীট আনন্দ সাগরে দোলে




২.
দেখা


ধরো তুমি হেঁটে যাচ্ছো মাঠের উপর, সঙ্গে বন্ধু
তুমি দেখলে অয়ী লাবণ্যময়ী ফুল! 
বড়ো বড়ো পাপড়িতে নান্দনিক
বন্ধু দেখলো ফুল, ফুলের ভেতরে বজ্রকীট 
চেটে চেটে খেয়ে যাচ্ছে জমানো যেটুকু আলো 

বন্ধু দেখলো গাছ, অনন্তের ছায়া নিয়ে প্রসারিত বাহু
তুমি দেখলে গাছের ভেতরে নদী
নদীর জলে স্রোতের গুণ 
জ্যোৎস্না নামের মেয়ে নৌকা চালিয়ে চলে যাচ্ছে দূরে 

দুজনের চোখেই ক্যামেরা
একই ক্ষমতাসম্পন্ন লেন্স
তবু বন্ধু দেখলো মেঘে মেঘে ঘষা লেগে বিদ্যুৎ চমকালো
দিগন্ত দিলখুশ
তুমি দেখলে চকমকি পাথর ঠুকে আগুন ধরালো প্রমিথিউস




সোহাগ

উৎপল দাস


ভাদরের বেলা বঁধু ফুরাতে চায় না
এতো কাজ শরীরে না সহে
ধান গাছের গোড়ায় ঘাস
ফসলের ক্ষতি করে 

ধান নিকাবার লোক নাই 

এই গরমে সোহাগ করো
বঁধু তোমার লাজ নাই 

ক্ষেতের আলে কাশী ফুটেছে





ব্যক্তিগত পরিসরে লিঙ্গ রাজনীতি ও সূক্ষ্ম ক্ষমতার বিন্যাস।

মধুপর্ণা

ব্যক্তিগত পরিসরে লিঙ্গ রাজনীতি একটি সূক্ষ্ম অথচ প্রভাবশালী ক্ষমতার বিন্যাস রচনা করে। প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গ বৈষম্য জারিত হয়ে আছে আমাদের দৈনন্দিন কাজে কথায়, উচ্চারণে, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়। তার প্রতিনিয়ত চর্চা যে বাতাবরণ তৈরি করে তার মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্ক, উচ্চনীচের সমীকরণ রচিত হতে থাকে। তার ভিতরেই আমাদের যাবতীয় সম্পর্ক নির্মিত হয় বা বলা ভাল, সম্পর্ক এই ক্ষমতার সূক্ষ্ম রাজনীতির বুনোটের বাইরে কিছু নয়। যা কিছু আমাদের কাছে সাধারনভাবে অপাপবিদ্ধ, সরল, সহজ হিসাবে প্রতিভাত হয়, তার চলন এবং রেখা সমূহ বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে যে মানুষের ভিতরে পারস্পরিক এবং অন্তবর্তী রাজনীতি কতটা লিঙ্গ, উচ্চনীচের ক্ষমতা বিন্যাসের প্রতিফলন। পরিবারবদ্ধ, সমাজবদ্ধ, বিবাহে আবদ্ধ, সম্পর্কে আবদ্ধ মানুষ এই সমীকরণের মধ্যে রয়েছে এবং প্রতিনিয়ত চর্চা করে চলেছে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রতিটি সম্পর্ক, প্রতিটি সমীকরণ একটি নির্দিষ্ট কাঠামোজাত বৈষম্যকে নিজের মধ্যে বহন করে চলে। প্রতিটি ঘটনা, কাজ, কথা, টানাপোড়েন একটি বৈষম্যপূর্ণ নারী বিদ্বেষী সমাজের প্রতিবিম্ব হাজির করে প্রতিনিয়ত। এই যে আমরা কিছু কথা প্রায়শই শুনে থাকি, "ঘরের মধ্যে রাজনীতি আনবেন না", অথবা "সম্পর্কের মধ্যে রাজনীতি আনবেন না” এখন কথা হল আমরা রাজনীতি বলতে ঠিক কি বুঝি। আমাদের কথা প্রতিটি বাক্য, শব্দ, শব্দের ব্যবহার সব কিছুর মধ্যেই একটি তরল ক্ষমতার প্রবাহ চলমান থাকে। এর ভিতরে নারীকে হেনস্থা করার জন্য আয়োজন সর্বত্র বিছিয়ে রয়েছে। এই কাঠামোগত বিষক্রিয়া যা জারিত করে রেখেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের জীবন আর মানুষের সম্পর্কের বয়ান, দু কলম লিখে তা বদলানো যায় না। কি করে বদলানো যায় ? কোনো ভাবেই কি যায় ?

যে প্রোগ্রামিং বা পদ্ধতিক্রম জারি রয়েছে তা মানুষকে সেভাবেই তৈরি করবে। জন্মদাগের মত রয়ে যাবে কাঠামোর অসুখ মানুষের মনে, ইচ্ছায়, অভ্যাসে, চাহিদায়। এখন আনলার্ন বা অর্জিত জ্ঞান বাতিল করে নিজেকে মুক্ত চিন্তক হিসাবে গড়ে তুলতে এবং নতুন অভ্যাস ও ইচ্ছাপরম্পরায় নিজেকে অন্বিত করতে যে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তার আয়োজন আমাদের কাছে নেই এবং তার যে কোনো সম্ভবনা সমূলে বিনাশ করে আমাদেরই কাঠামো। এই আবর্তের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের ঝলকের মত কেউ কেউ চিৎকার করে। ঐ যেমন মেহের আলি চিৎকার করত “ তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়!" তেমনি এই ক্ষমতার প্রবাহ থেকে এই কাঠামো উপজাত জটিল বিন্যাস থেকে আমাদের আশু মুক্তি নেই।

নারীকে আরোপিত জীবনের পাঠ ভুলে নিজের জীবন বেছে নিতে হবে, নির্মাণ করতে হবে স্বতন্ত্র জীবনচর্যা। নারীবাদ মানে স্বতন্ত্র জীবনবোধ। আরোপিত অবদমনের চক্রান্ত চিহ্নিত করা এবং সেই আগ্রাসনের আয়োজন অস্বীকার করার স্পর্ধা। এত সূক্ষ্ম ভাবে এই বহুস্তরিক লিঙ্গবৈষম্যের জাল বিছিয়ে রাখা আছে যে তাকে বিশ্লেষণ করা ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। আমরা নিজেদের অভ্যাস বদলাতে পারি মাত্র কাঠামো বদলাতে পারি না। এই এত চারিদিকে কথাবার্তা, সভা সমিতি, সাম্য সাম্য খেলা। ব্যক্তিমানুষের অভ্যাস আর তজ্জনিত ইচ্ছার বদল না হলে কিছুই বদলায় না। ওয়ান ফাইন মর্নিং লিঙ্গসাম্য দরজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকবে না জেনেও বিশ্লেষণ করে যেতে হয়, তার কারণ একটা ঘন্টা শতাব্দীর পর শতাব্দী পরম্পরাক্রমে বাজিয়ে যেতেই হয় কেউ না কেউ তার শব্দ কান পেতে একান্তে কখনো শুনবে বলে। তারপর থেকে আরো একটা প্রতিধ্বনি শুরু হয়ে আরো কিছুদূর যাবে বলে। অভ্যাস আর ইচ্ছা বদল করে লিঙ্গসাম্যের চর্চা কখনো শুরু হবে বলে।





সীমান্ত বাংলার লোক প্রবাদে চাষবাস

                 
                           তপন পাত্র
_________________________________

            পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্ত বাংলার সাধারণ পরিচয় রুখা-শুখা , ডাঙা-ডহর , খরা- ধরা , ভখে-মরা পোড়া কপাল ভূমি । দারিদ্র তার দেহের ভূষণ । অনাহার তার তপস্যা , অপুষ্টি যেন অঙ্গসজ্জা । তাই এখানে রূপসী বাংলা গেরুয়া শাড়ি পরে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের সামনে এক কঠিন কঠোর তপস্যায় মগ্নপ্রাণ । তবুও এর অন্তরের সুড়ঙ্গ পথে বয়ে চলেছে এক সুস্থ-সংস্কৃতির অমলিন ঝর্ণাধারা । এই আলোকের ঝর্ণাধারার স্বচ্ছগতি , আবেগমথিত সুর সহজ সরল মাটির কাছাকাছি আটপৌরে খাটোয়া মানুষজনের প্রেরণার উৎসমূল।

এই এলাকায় আগত আর্যরা প্রথমে ছিলেন বনচারী । তারপর পল্লীবাসী হলেন । প্রথমে তাঁদের ধর্ম বলতে ছিল ধেনু আর জীবিকা মানে ছিল পশুচারণ । আর্যরা যখন পশুপালনজীবী তখন সীমান্ত বাংলা আদিম অধিবাসী অস্ট্রিক এবং দ্রাবিড় গোষ্ঠীর প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ । অস্ট্রিক ভাষাভাষী লোকজনের কাছ থেকেই আর্যরা কৃষিকাজ শিখেছিলেন ।

যেহেতু কৃষিকাজ এবং পশুপালনই এখানে বাঁচার মূলমন্ত্র , তাই স্বতোৎসারিত প্রাচীন পূজা-পার্বণগুলির বেশিরভাগেরই মূল কথা উৎপাদনের জন্য আরাধনা ; সন্তান-সন্ততিদের দুধে ভাতে রাখার মনোবাসনা ।

তাই ভাদু , টুসু , করম , জাওয়া , ইঁদ , ছাতা , ইতু , জিতা ---সকল পালা-পার্বণ বা ব্রত ইত্যাদির অন্তরালে রয়েছে উৎপাদন বাসনা ।

তেমনি এখানে এখনো যে লৌকিক প্রবাদ প্রবচন গুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে , ইতস্তত প্রক্ষিপ্ত শাল পলাশের মতো , সেগুলিরও বেশির ভাগই যেন কৃষিকথা । একসময় কৃষি পরিবেশ থেকেই সেগুলির জন্ম । আবার আজ মনে হয় , সেগুলি যেন পশুপালন ও কৃষি কৃষ্টির নির্দেশমালা । আসলে এতো প্রাণবন্ত , জীবন্ত সেই সকল প্রবাদ যে দ্বন্দ্বে পড়তে হয় তাই তো কৃষি অভিজ্ঞতা থেকে এগুলোর উৎপত্তি নাকি এগুলোই কৃষি উৎপাদন কর্মের নিয়মগাথা ।

            এই অঞলের এক বহুল প্রচলিত প্রবাদ "কার-ও পৌষ মাস , আর কার্-অ সব্বনাশ"।
সর্বনাশের উল্টোপিঠে সব পেয়েছির তাৎপর্যটি কৃষিনির্ভর সীমান্ত বাংলার আলো-হাওয়ায় সুপরিস্ফুট এবং অনুভবযোগ্য ।

           পৌষ মাস প্রান্তিক কৃষিজীবী মানুষের চোখে পূর্ণতার প্রতীক । আমরা শুনতে পাই পল্লীপ্রেমিক কবিগুরুর পরিচিত কণ্ঠস্বর : " ডালা যে তোর ভরেছে আজ পাকা ফসলে ..." । প্রাচুর্যের স্বর্ণময়ী পৌষ তো কৃষক , শ্রমিক , ক্ষেতমজুরের জীবনে সম্বৎসরে একবারই আসে । বাতাসে ভেসে আসে যেন মহালয়ার ভোরবেলার আবাহন সঙ্গীত : "আ'সচে মকর দু'দিন সবুর কর , তরা বাঁকা পিঠার জগাড় কর ..." ।

                সত্যিই মকর মানে সে কী লাবন্যে পূর্ণ দেহ , সে কী আনন্দধারায় বিগলিত প্রাণ ! এই মকরের প্রকৃত সূচনা অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে । কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে অঘ্রাণের গৌরব ও গুরুত্ব অপরিসীম । মাঠের ধান ঘরে আসে । কর্মহীন কাজ পায় । শূন্য গৃহ হয় পূর্ণ । তাইতো এমন প্রবাদ জমে ঝুলিতে -- "আঘন মাসে চু'টার্ অ সাতটা বহু " । এখানে হয়তো বড়লোকি ঠাট -এর প্রতি শ্লেষ আছে । কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা শ্রী ও সম্পদের সংশয়াতীত স্বীকৃতি রয়েছে। ভাদরে যখন রাজার ভাঁড়ারও খালি , তখন যে কৃষক এক দুখিনী গৃহিণীকে একমুঠো ভাত দিতে পারে না , পৌষে সে সাতটি বউকে ভাত দেবার ক্ষমতা ধরে । ভাদর তো সব অর্থেই "শূন্য মন্দির" । যে কৃষক ভাদরে সামান্য দু'মুঠো ভাতের জন্য কাঙ্গাল , অঘ্রাণ পৌষে সে সাজিয়ে তোলে রসনালোভন পিঠের থালা ।

              কিন্তু এ সবই নির্ভর করে আষাঢ়-শ্রাবণের ভালো বৃষ্টিপাতের ওপর । এখানে মৃত্তিকা অনুর্বর , কাঁকরযুক্ত , দ্রুত ধৌত ও মৃদু জলধারণ শক্তি সম্পন্ন । জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী কংসাবতী বা কাঁসাই , কুমারী , সুবর্ণরেখা , 
টটক কারও যৌবন তেমন উচ্ছল , উজ্জল গতি তরঙ্গময় নয় । আজও এখানে জলসেচের সুচারু বন্দোবস্ত নেই । আকাশের প্রসন্ন দাক্ষিণ্যের উপরই নির্ভর করেই চাষবাস সম্পাদিত হয় । তাই তো এমন রসঘন প্রবাদটি জন্ম নেয় -- "চাষ নাই বাস , টুরুই ব্যাঙের আশ "। অর্থাৎ চাষের কোন নিশ্চয়তা নেই , যদি প্রবল বৃষ্টিপাত হয় , তবেই উগাল , সামাল , জাবট , কাদা । আর চারাতলা রোপন ।

                 এখানকার চাষজমির জল ধারণের ক্ষমতা এবং বৃষ্টির জল বয়ে আসার সুবিধা অনুপাতে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত । বা'দ , কানালি ও বহাল । বা'দ জমিতে জলের আধার কম। কানালিতে মাঝামাঝি আর বহালে বেশ ভালো । তবে এখনকার অধিকাংশ জমিই বা'দ জমি । যে সকল জমির চাষ নির্ভর করে "টুরুই ব্যাঙ" ডাকার ওপর । "টুরুই ব্যাঙ" হলো এমন এক প্রজাতির ব্যাঙ , যারা টানা চার-পাঁচ দিন প্রবল বৃষ্টি না হলে ডাক ছাড়ে না । এই প্রবাদটির প্রায় সম মানের আর একটি প্রবাদ রয়েছে -- "জল পড়ে গা'দে , ধান লাগাব বা'দে "। একই উচ্চারণ , একই প্রত্যাশা -- প্রবল বর্ষণ ।


              আবার বহাল জমিতে চাষের ক্ষেত্রে এক বিপরীতধর্মী অনিশ্চয়তা । বহাল জমি সাধারণত নদী জলাধারের জলস্রোতের সঙ্গে সংযুক্ত ।
এখানকার মূল নদী বাঘমুন্ডি পাহাড় থেকে উৎপন্ন , দক্ষিণ-পূর্ব অভিমুখে প্রবাহিত । সৃষ্টি হয়েছে অনেকগুলি উপনদী ও শাখা নদী । আবার শাখা নদী ও উপনদী থেকে বেরিয়ে আসা ছোট ছোট জলাধার গুলি স্থানীয় ভাষায় জোড় নামে পরিচিত । বহাল জমি এগুলির সাথে কোন না কোন ভাবে সংযুক্ত । পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গের উচ্চভূমি বাঘমুন্ডি এলাকায় হঠাৎ বৃষ্টি হলে আচমকাই নদীতে বন্যা নামে । এর নাম "হড়পা বান" । হড়পা বান এলে নদীর নিম্নবর্তী এলাকার জমির ধান নষ্ট হয়ে যায় । পঁচে গলে যায় । সেই দুর্ভাবনা থেকে সঞ্জাত প্রবাদ "নদীধারের চাষ , আর মিছাই কর আশ "। স্থানভেদে "নদী নাময় চাষ , মিছাই কর আশ "।

              কৃষিকাজ যে এখানে আজও প্রকৃতির করুণার উপর নির্ভর এবং আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিতান্তই নগণ্য সে কথাও নানা প্রবাদ থেকে সকালের আলোর মতোই সুস্পষ্ট । একটি প্রবাদ "অবলার সঙ্গে চাষ, আর অদেখার সঙ্গে গৃহবাস" । অবলা মানে গরু , মোষ আর অদেখা মানে প্রকৃতি , মৌসুমী বায়ু , নিম্নচাপ । সমগোত্রীয় একটি প্রবাদ " রাজার হাতি ঘড়া , চাষার গরু কাড়া "।

                  ট্রাক্টর , রোপন ও নিড়ান যন্ত্র খুব একটা জায়গা করে নিতে পারে নি এখানকার এক ফসলি কৃষি ব্যবস্থায় । তাই "হাল বাহে ব্যাটার বাপ" প্রবাদটি এখনো এখানে মুখে মুখে ফেরে। যার হাল আছে অর্থাৎ লাঙ্গল ও বলদ বা কাড়া আছে , যে লাঙল বাইতে পারে , সে ব্যাটার বাপ । "বেটার বাপ" শব্দবন্ধটি এখানে সৌভাগ্যবান ও ক্ষমতাবান শব্দ দুটির একত্র পরিপূরক , পৌরুষের দ্যোতক ।

              পৌরুষত্ব বোঝাতে মরদ , মদ্দানি শব্দগুলির ব্যবহার আছে এতদঞ্চলে । যার কথার বা জবানের মূল্য নেই তাকে অলস প্রকৃতির বলদ এর সাথে উপমিত করা হয়েছে একটি প্রবাদে । প্রবাদটি হলো "কথা কাটা মরদ , আর পঁদ ঠেলা বলদ " । এই "পঁদ" শব্দটি ঘুরে ফিরে একাধিক প্রবাদে এসেছে । তথাকথিত ভদ্র সমাজে শব্দটি ইসদশ্লীল মনে হলেও , তা নয় । এর ব্যঞ্জনা টি অসাধারণ ; প্রয়োগ গুণে শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় নেপথ্য শক্তি , বল , কোমরের জোর । "পঁদ ঠেলা বলদ" কে লেজ মোচড়িয়ে , পাছায় লাঠি মেরে লাঙ্গল চালাতে হয় । অথবা এক হাল বলদ -এর মধ্যে তেজস্বী বলদ কে এক কাঁধে করে হাল চালাতে হয়। কৃষক সুকৌশলে জোঁয়ালে দড়িটি এমনভাবে বাঁধেন যে অলস গরুটির পরিশ্রম কম হয় । অন্য একটি প্রবাদ "পঁদের যু'ত নাই আঠর বিঘার আঁক চাষ" , বলতে চাওয়া হচ্ছে শক্তির বাইরে গিয়ে কাজ করার ব্যর্থ প্রয়াস ।

              তাহলে কৃষিকাজে যেমন বলবান কৃষিশ্রমিক দরকার তেমনি তেজস্বী কাড়া- বলদও প্রয়োজন । তার সমর্থনে শুনতে পাই "ছাগল দিয়ে চাষ হ'লে কেউ গরু পু'ষথ নাই" । আবার কম পয়সার বলদেও ভালো চাষ করা অসম্ভব । কারণ "কম পয়সার গরু ভিতা পায়না" । "ভিতা" হল চাষ জমির আলের অব্যবহিত পার্শ্ববর্তী অংশ । দুর্বল গরু দিয়ে লাঙ্গল বাইলে লাঙ্গলের ফলা সেখান পর্যন্ত যায় না ।

                  চাষ শারীরিক পরিশ্রমের ফসল । মাঠে চাষবাসের কাজ করলে দেহসৌন্দর্য লোপাট হয়ে যায়। লোকে বলে "চাষে রূপ নাশে"। শক্তি ক্ষয় হয় । তাই সাধারণ বাণী ঘুরে বেড়ায় --"কমরে যদি আছে বল , তবে মুঢ়া কদাল ধর " । চাষবাসে যত্ন-আত্তি , মেহনতের বিষয়টিও বেশ মূল্য পেয়েছে প্রবাদে । "অল্প চষি বিস্তর ঘাস"। তাহলে ভালো চাষের জন্য বারবার লাঙ্গল দেবার কথা বলা হচ্ছে । বলা হচ্ছে "চাষা চিন্ হায় আ'ড়ে আর তাঁতী চিন্ হায় পা'ড়ে"। যত্নবান কৃষকের ক্ষেতের আলটি গৃহীর সুন্দর করে গুছাটি দেওয়া উঠোন , দাওয়া , ধারীর মতো চকচক করে । এটি তাঁর আভিজাত্যের , যত্নশীলতা এবং রুচি ও নৈপুণ্যের পরিচায়ক । যেমন তাঁতীর পরিচয় তার তৈরি শাড়ির পা'ড়ে, আঁচলের কারুকাজে।


                    কিন্তু কৃষক যদি অনভিজ্ঞ হয় , বোকা হয় , তাহলে তার পদে পদে বিপদ । বোকা চাষার "কাটানো জল যায় , ভুলুকে তালি দেয়"। সে জানে না যে, " আগে রঁদ , পরে খঁদ"। ধান গম ছাড়াও অন্যান্য শাক-সবজি আনাজপাতি চাষের জন্য আগে বেড়া তৈরির ব্যবস্থা করে পরে চাষের কাজ শুরু করতে হয় । তা না হলে সেই"লাভের গুড় পিপঁড়ায় খায়"।

             কৃষিকাজে প্রচুর প্রতিকুলতা । বীজ বোনা থেকে ফসল খামারে এবং খামার থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত ঝঞ্ঝাট ঝামেলার শেষ নেই । তাই এখানকার লোকে বলে "চাষা ভাবছিস কী মনে মনে , চা'দ্দিকে তর ঘোঘ (জলস্রোত) ছুটচে , চাপ দিবি তুই কন খেনে "। কৃষিকাজ মানেই অনিশ্চয়তা । আজ যে রাজা , কাল সে ফকির। "চাষার দিন সাত তালে বয় , কখন যে কি হয় " । তবুও "আশায় মরে চাষা" যেমন
" ধ্যানে মরে যোগী"। সত্যিই তো "পুরুষের দশ দশা"।
তবে কৃষিকাজে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের অবদান অধিকতর । চালি ধানে থুপি দেওয়া , বীজ বোনা , চারা তোলা , চারা বসানো , আগাছা নিকানো , ধান কাটা , আঁটি বাঁধা , ধান ঝাড়া , ধান পরিষ্কার করা --- এক কথায় সূচনা থেকে উপসংহার পর্যন্ত তাদের অবদানই বেশি । তাই নারী হৃদয়ের অনুশোচনা জাত একটি জীবন্ত প্রবাদ "ভাত দেয় কি ভাতারে , ভাত দেয় গতরে"। "ভাতার" শব্দটির অর্থ --- "যে ভাত দেয়"। লোকসমাজ ভাতার অর্থে স্বামীকেই বোঝে। স্বামী স্ত্রীকে ভাত দেয় অর্থাৎ তার ভরণ পোষণ করে স্ত্রী গতর খাটায় বলে ; শারীরিক পরিশ্রম করে বলে। আঞ্চলিক পরিভাষায় "সুয়াং খাটায়" বলে ।

                কৃষকের কৃষিকাজ তো শুধু নিজের পরিশ্রমেই সম্ভব নয় , বেশির ভাগটাই সাধিত হয় কৃষি-শ্রমিক , দিনমজুরদের দ্বারা । শ্রমের দৈনিক মজুরি নিয়ে মনোমালিন্য হয় মনিবের সাথে শ্রমিকের। অসহায় শ্রমিক বিপদে পড়ে কম মজুরিতে কাজে যেতে বাধ্য হয় । কিন্তু তার মনের ভাবনাটি তখন এইরকম: "কী ক'রব্যাক বেতনে , মা'রে দিব খেটনে "! যেহেতু গলা বা 
মনিব নাহ্য বেতন দেবেনা , তাই সে কাজে ফাঁকি দেবে । বিড়ি, চুটি টেনে ; মন্থর গতিতে কাজ করে সময় পার করে দেবে । এমন পরিবেশে উত্থিত হয় জীবন্ত একটি প্রবাদ --- "গলা গেল ঘর, ন লাঙ্গল তুলে ধর"। হালের গরু চলছে তো মন্থর গতিতেই চলছে । দিনমজুর হালের বোঁটায় হালকা ভাবে হাত দিয়ে আছে , কোন শক্তি প্রয়োগ করছে না, ফলে আর লাঙ্গলের ফলা মাটির গভীর পর্যন্ত যাচ্ছে না ।

                   বাস্তব জীবন অভিজ্ঞতা থেকে কিছু সংস্কারেরও জন্ম হয়েছে । সেগুলো কুসংস্কার না কোথাও কোনো যুক্তি কেন্দ্রিক , তা বলা মুশকিল । যেমন "অমাবস্যা , পূর্ণিমায় ধরে হাল , তার দুঃখ চিরক্কাল" । প্রবাদটি একটু ভিন্ন রূপেও ঘুরে বেড়ায় "অম্বুবাচীতে ধরে হাল , তার দুঃখ চিরক্কাল"। আবার বলা হয় "আকালের মেঘ সকালে"। অর্থাৎ ভোরবেলা থেকে মেঘ ঘনিয়ে এসে সকালে বৃষ্টি হলে বুঝতে হবে এবার ভালো বর্ষা হবে না । আকাল বা খরা অবশ্যম্ভাবী । কেউ বলে , "শাবন পু'বা ধল্ল ভাই , বলদ বিকে কিন্অ গাই"। শ্রাবণ মাসের শুরু থেকেই যদি পূর্ব দিক থেকে বৃষ্টি নামে , তাহলে বুঝতে হবে অকালে বর্ষা-বিদায় নেবে ।অতএব "সাধু সাবধান" বলদ বিক্রি করো আর গাই কিনে ফেল ।

                  এসব প্রবাদকে বিজ্ঞানমনস্ক সুধীজন কুসংস্কার বলতেই পারেন , কিন্তু সীমান্ত বঙ্গে পদার্পণ করলে এখনো দেখা যাবে "মেঘ ধরেছে ঈশানে, তো কাঁধে কোদাল কিষানে"র । আজও মানুষের স্থির বিশ্বাস ঈশান কোণে মেঘ যখন ধরেছে , তখন বৃষ্টি নামবেই । সচেতন কৃষক আগেভাগেই কাঁধে কোদাল নিয়ে চাষ জমির দিকে এগিয়ে চলেছে , বৃষ্টি নামলো বলে , কোদাল দিয়ে তো আল বাঁধতে হবে ; তা না হলে জল পালিয়ে যাবে যে । কাল সকালে ধান রুইবে কেমন করে ? চাষার তো সেই আশা-ই বাঁচার সম্বল ।


_____________________________________________
আলো পৃথিবী প্রকাশন থেকে
প্রকাশিত হতে চলেছে 
কবি নির্মল হালদারের 
নতুন কবিতার বই 
"ধোবি ঘাট "
_____________________________________________

এই সংস্করণ থেকে শুরু হলো উপন্যাসীক দীপংকর রায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস-- 
"জলশ্যাওলার বিরহকথা"
_______________________________

জলশ্যাওলার বিরহকথা

দীপংকর রায়


তুমি কাকে দেখতে চাও, কাকে খুব কাছে পেলে তোমার এই উড়ু উড়ু ভাব এক নিমেষে থেমে যাবে?যাদের নিয়ে যে সঙ্গ- আকাঙ্ক্ষায় তোমার সকল সত্য গাছে চড়ে, বেশ খানিকটা উঁচুতে উঠে চিৎকার করে খালি খালি, আকাশ এবং বাতাসের মগ্নতায় , পাতায় পাতায় শিরশিরিয়ে বেড়ায়, তাদের এসব দিয়ে কী হবে----?
         যারা বোঝেই না---- সঙ্গ মানে শুধুই সঙ্গ নয়, সঙ্গ মানে স্পর্শ, ছোঁয়া; যদিও ছোঁয়া না হলেও তিনি উপনীত হতে পারতেন, কিন্তু এতেও তো তা হবার নয়, এ যে গোদা, নিরেট, সমস্ত ভেতর মহলের চৈতন্যে সে টানা ঘুম দেয়! তাহলে তুমি তাদের ছোঁবে কী করে? আর তাই কি তোমার এই ইঙ্গিত তাদের অন্য মানে দেয়? অন্যই বা কী, অন্য বলে কিছু আছে নাকি? অন্য মানে প্রতি শব্দে যে আলাদা আলাদা ভাব, কিন্তু তাও কি ঠিক? তাহলে এই যে এত একাকার হবার বাসনা, তার মধ্যেও কি এক গভীর ছলনা আছে----? নাকি একটি গভীর চালাকি! আরও পড়ুন





অন্তরালের শিল্প ও শিল্পীমহল

কল্পোত্তম


পুরুলিয়ার তথা পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ধারাকে বিশ্ব সংস্কৃতির অঙ্গনে তুলে নিয়ে আসার মূল যে নৃত্যকলা ছৌ-নাচ, সেই ছৌ-নৃত্যের আড়ালে আরও এক শিল্প এবং শিল্পীমহল অবস্থান করে আসছেন সমান্তরালভাবে । ছৌ-শিল্পের জন্মলগ্ন থেকে আমরা ছৌ-নৃত্যের ছন্দময় জাদুস্পর্শে মোহিত হলেও তার আড়ালে থাকা শিল্প এবং শিল্পীদের কথা, তাদের জীবনের হাসি-কান্না, দুঃখ-যন্ত্রণার ধারাবাহিকতাকে উপলব্ধি করার মতো উদারতা অর্জন করতে পারিনি। এক কথায় আমাদের মনের মধ্যে যতখানি জায়গা পাওয়ার কথা ছিল তাঁদের ঠিক ততখানি জায়গা আমরা কখনই তাঁদেরকে দিতে পারিনি। যার ফলে তাঁদের সেই হাসি-কান্না, দুঃখ-যন্ত্রণা চিরকালীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আমাদের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারও এঁদের বিষয়ে উদাসীন থেকেছে শুরু থেকেই। যার ফলে এঁদের শিল্পকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়নি এবং এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদেরও শিল্পীর মর্যাদা দেয়নি তারা।
           যে শিল্পের কথা এখানে বলতে চাইছি, তা হলো ছৌ-নাচের মুখোশ নির্মাণ শিল্প। এবং যে শিল্পীমহলের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি তা হলো ছৌ-নাচের মুখোশ নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীমহল। বলাই বাহুল্য এই শিল্পের বয়সকাল ছৌ-নৃত্য শিল্পের সমসাময়িক। কেন না পুরুলিয়ার ছৌ-নৃত্যের শুরু থেকেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে মুখোশের বিষয়টি।আরও পড়ুন






              আমাদের বই







সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
আলোকচিত্র : সন্দীপ কুমার
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com







মন্তব্যসমূহ

  1. কবিতা ছাড়াও..এবারের গদ্যের সম্ভার খুবই ভালো লাগলো..👌👌

    উত্তরমুছুন
  2. সবগুলোই খুব ভালো লাগলো। খুব পরিচ্ছন্ন এবং রুচিপূর্ণ।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪