কথাবার্তা ৩ / মধুপর্ণা
কথাবার্তা ৩
মধুপর্ণা
পিতৃতন্ত্র সফল এবং খুশি নারী অপছন্দ করে। তার কাছে খুব পছন্দের হয়ে ওঠে “ সাত চড়ে রা না কাড়া" নারী। কারণ সেখানে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীণ হবার সম্ভবনা নেই। ভঙ্গুর পুং অহং প্রশ্ন পছন্দ করে না। কারণ প্রশ্ন তার হীনমণ্যতাকে বিদ্ধ করে। বিকৃত পুং অহংয়ের যেহেতু কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই, পুরোটাই বস্তুত দাঁড়িয়ে আছে একটি ক্ষমতালিপ্সা এবং বাড়তি সুবিধাভোগের আকাঙ্ক্ষার উপর সেকারণে তার অন্তবর্তী শূন্যতা ঢাকার জন্য নির্মাণ করতে হয় উচ্চস্মৈণ্যতার বর্ম। যা আসলে তীব্র একটি হীনমন্যতার অনিবার্য বহিঃপ্রকাশ। এই ছদ্ম উচ্চস্মৈন্যতার পক্ষে প্রশ্ন সহ্য করতে পারা কঠিন। কারণ তা অন্তস্থ হীনমণ্যতাকে কান ধরে টেনে বের করে নিয়ে আসে। তখন পুং অহং আহত জন্তুর মত উচ্চস্মৈন্যতার আড়ালে নিজেকে ঢেকে আত্মরক্ষা করতে চায় এবং হয়ে ওঠে হিংস্র। তার কাছে আর কোনো উপায় কার্যত খোলা থাকে না। তাই সে নিজের চারদিকে অনুগত নারীর উপস্থিতি পছন্দ করে এবং তাতে নিরাপদ বোধ করে। পুং অহংয়ের এই করুণ পরিস্থতির জন্য তাকে নির্মাণ করতে হয় একটি স্বাচ্ছন্দ্যের পরম্পরা যাতে তার কোনোভাবেই বিদ্ধ হবার সম্ভবনা তৈরি না হয়। যে নারী ক্ষমতার দর্পের সঙ্গে সমঝোতার পাঠ গ্রহণ করে নি বা সুযোগ পায় নি এবং বিচিত্র ধরণের অসহায়তা, সমস্যায় জর্জরিত, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষের কাছে আবেদনময়ী হয়ে ওঠে। কারণ মানসচক্ষে পুরুষতন্ত্র তাদের অন্তর্বাহির স্ক্যান করে এই আশ্বাস পায় যে তার হীনমণ্যতার এখানে ঘা খাবার সম্ভবনা নেই বা তুলনামূলক কম। বরং নারীটিকে ক্রীড়নক হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। সেখানে পুরুষতন্ত্রে জারিত পুং আত্মার অনুরাগ আছড়ে পড়ে।
খুশি নারী এবং আত্মনিমগ্ন নারী আরোই অপছন্দের পুরুষতন্ত্রের কাছে। অপছন্দ শুধু নয়, এক্ষেত্রে তারা বস্তুত বোধ করে আতঙ্ক। এখানে তার ফাঁপিয়ে তোলা, পুরুষতান্ত্রিক ভণিতা ঘোর বিপদের সম্মুখীণ হয়। নারীটির খুশি তাকে নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করতে বাধা দেয়, বা ছদ্ম আত্মবিশ্বাসের বুদবুদের কাছাকাছি একটি ফুৎকারের উপস্থিতি সে টের পায়। যা তার অস্তিত্ত্ববোধকে করে তোলে সংকটের মুখোমুখি। তাই খুশি নারীটি তার কাছে থ্রেট। তার খুশি সে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় নিজের কাছে যতটুকু সহনযোগ্য এবং যতটুকু তাকে বিদ্ধ করার আয়োজন করবে না। যে নারী নিজের কাজে বিভোর থাকে এবং মূলত মানসিক ভাবে স্বনির্ভর, পুরুষের সাপেক্ষতায় নিজেকে প্রতিফলিত দেখার থেকে নিজের কাজের মধ্যে নিয়োজিত থাকে সেখানে পুরুষতান্ত্রিক মানসকাঠামো সব থেকে বড় ধাক্কাটা খায়। সেখানে তার সর্পিল গতিতে ক্ষমতা বিস্তারের সম্ভাবনা কম। তাই সেখানে সে নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। শিলা রোবথাম লিখেছিলেন নারী হল সর্বশেষ উপনিবেশ। যার ওপরে ক্ষমতা কায়েম করতে চায় পুরুষতন্ত্র। বিভিন্ন সমাজ বদল, বিপ্লবে বিশ্বাসী ইত্যাদি স্বঘোষিত সংস্কারকগণ এ বিষয়ে নিরাপদ নীরবতা বজায় রাখেন অথবা এক ধরনের “ধরি মাছ না ছুঁই পানি" পন্থা অবলম্বন করেন।
পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো মূলত মর্ষকামী। নারীর খুশি, আনন্দ তার কাছে পছন্দসই না। পুরুষটির খুশিতে মেয়েটি খুশি হবে, পুরুষের আনন্দে মেয়েটি হবে আনন্দিত। এই হচ্ছে প্রচলিত ছক। তার নিজের আনন্দ, খুশি থাকতে পারে এইটা খুবই অসহনীয় মনে হয়। মেয়েটির মধ্যে রয়েছে এমন একটি অঞ্চল যেখানে সে কোনো ভাবেই সম্পর্কিত নয়, তার কোনো প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ সেখানে খাটে না। বস্তুত সেখানে সে কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক নয় এই পরিস্থিতি পুং অহংকে করে তোলে বিদ্ধ। স্বনির্ভর এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ নারী যেখানে পুরুষের পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। সে কারণে সেই নারীরাই হয়ে ওঠে পিতৃতন্ত্রের আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু। অনধিকৃত অঞ্চল গুলিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার মরিয়া চেষ্টা করতে থাকে।
সাপেক্ষতা একটি মাইক্রো পলিটিক্স তৈরি করে। সফল, স্বয়ংসম্পূর্ণ নারীটি নিজের জীবন রচনা করে নিজে। নিজের ইচ্ছা, অনুভূতি, জীবনপ্রবাহ তথা রিসোর্স সবকিছুর ওপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকে। কোন দিক থেকে সে নির্ভরতা বা অবলম্বন হিসাবে পুরুষকে চায় না। পিতৃতন্ত্র মূলত সাপেক্ষতা তৈরি করতে চায় তার কারণ সাপেক্ষতা অপব্যবহার, শোষণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। নিদেনপক্ষে একটি পাওয়ার প্লে চালিয়ে যেতে পারলে বিভিন্ন ভাবে স্বনির্ভর নারীটিকে উত্যক্ত করা যায়, ক্ষতি করা যায়। এই আবর্ত গুলো চিনতে হবে নারীদের। হীণমণ্য ক্ষমতালিপ্স পুরুষদের ঈর্ষা যা মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে উৎপন্ন তার আঁচ থেকে বাঁচার জন্য নারীদের তৈরি করতে হবে নিরাপত্তা বলয়। এবং এই পিতৃতান্ত্রিক স্পর্ধাকে ধুলিস্যাৎ করার দৃঢ় মনোভঙ্গি নির্মাণ করতে হবে। শোষণ এবং অপব্যবহারের রকমফের গুলো স্পষ্ট ভাবে চিনতে হবে যাতে যে কোনো ধরনের অপব্যবহার এবং অনুপযুক্ত আচরণ মোহহীন ভাবে বরদাস্ত না করার ক্ষমতা তৈরি হয়। বিশেষত যে সমাজ গুলি অশিক্ষা আর ধর্মীয় গোঁড়ামির কালো গর্তে আকণ্ঠ ডুবে আছে,সেখানে পিতৃতান্ত্রিক কদর্য অনুশীলন এখনও নগ্ন ভাবে বিদ্যমান। পিতৃতান্ত্রিক অপব্যবহার আর শোষণের সূক্ষ্ম আয়োজন এবং তার দৈনন্দিন প্রতিফলনকে চিনে তার উপযুক্ত জবাব দেওয়া রপ্ত করতে পারলে নারীরা অনেকাংশে মানসিক মুক্তি লাভ করবে।
মধুপর্ণা কর্মকার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যা চর্চাকেন্দ্রে গবেষণা করেন। লিখেছেন - ' গার্লস হস্টেল ; আবাসিক নারীর মানসভূমি।'(২০১৮)
তাঁর ব্লগ লিঙ্কে প্রবেশ করুন
তাঁর লিঙ্কট্রি লিঙ্কে প্রবেশ করুন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন