আমার বিবাহিতা বান্ধবীরা
আমার বিবাহিতা বান্ধবীরা
মধুপর্ণা
একটা শব্দ হঠাতই খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে মেয়েদের জীবনে। "বিয়ের বয়স”। এই বয়স সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী বদলায়। এই 'বয়স' এসে পড়লে সব কাজ ফেলে দিয়ে মেয়েদের বিয়ে করে নিতে হয়। এই 'বয়সের' সঙ্গে সমাজ আপোষ করতে দেয় না। এ এক অনিবার্য নিয়তির মত, অকস্মাত বজ্রাঘাতের মত এসে পড়ে। তার হয়তো পড়াশুনা শেষ হয় নি, হতে পারে তার সংসারজীবনের ইচ্ছা তৈরি হয় নি, হতে পারে 'বিবাহ' প্রতিষ্ঠানটিকে সে পছন্দ করছে না। হতে পারে চারপাশের অভিজ্ঞতা দেখে শুনে তার 'বিবাহিত' পরিচয়ে পরিচিত হতে অ্যাবসার্ড, হাস্যকর মনে হয়। অনেকিছুই হতে পারে। হতে পারে কারণ না জেনেই একটি আবর্তে পড়ে যাবার আশংকা তৈরি হয়েছে। অথবা সে এতদিনে পড়ে ফেলছে বেশ কিছু বিপজ্জনক বই। অথবা জেনে ফেলেছে বিবাহের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। অথবা জেনে ফেলেছে 'ওম্যান আর দ্য লাস্ট কলোনি'(শিলা রোবথাম) অনেক কিছুই হতে পারে।
'বিয়ের বয়স হয়ে যাওয়া অবিবাহিতা মেয়েটি কি প্রচন্ড অস্বস্তিকর সমাজের কাছে, পরিবারের কাছে, এমনকি নিজের কাছেও? সেই 'অরক্ষণীয়া'কে নিয়ে এখন কি করবে সমাজ খুঁজে পায় না। তার যৌণাঙ্গে এখনও বিশেষ একজন প্রভুর দখল কায়েম হয় নি। এর থেকে সাংঘাতিক কথা আর কি হতে পারে ?
বিয়ে প্রতিষ্ঠানটি মেয়েদের সম্ভবনাকে বিনষ্ট করে দেবার জন্য যথেষ্ট। ব্যতিক্রমের উল্লেখ করে পরিস্থিতি লঘু করার চেষ্টা করে বস্তুত কোনো লাভ হয় না। অজস্র সম্ভবনাময় মেয়ে নিছক বিয়ে করে আর কোনো দিকেই নিজেকে নিয়ে যেতে পারে না। কারণ বিয়ের ভিতরে “নিজে" বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। ব্যক্তিমানুষ নিজেকে অন্যের সাপেক্ষতায় দেখতে অভ্যস্ত হয়। অন্যের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে নিজের সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত তৈরি করে। এবং তার ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করে। আমার এক বান্ধবীকে যদি উদ্ধৃত করি “দ্যাখ, আমি আর নিজেকে তেমন ফিল করতে পারি না। এখন রোল প্লে করি। কে কিসে খুশি হবে, কোন কোন পরিষেবা পেলে বাকিরা ঠিক থাকবে এটাই আমার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে” আরেক জনের কথা যদি বলি, "কি ছিলাম আর এখন কি হয়েছি, এমনিতে খারাপ লাগে না, একেক সময় খুবই অস্থির হয়ে পড়ি" অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্রী বিয়ে করে কিছুদিন পরে জানাল, "একটা অদ্ভুত ব্যাপার জানিস! অন্যের ইচ্ছেতে চলাটা তাকে সম্মান জানানো বলে এরা মনে করে। মানে আমাকে যা বলা হচ্ছে আমি তাই করছি এটা আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ইত্যাদির বহিঃপ্রকাশ। এইটা বুঝতে আমার বেশ কিছু সময় লেগেছিল।” বলে বসি, তোমার তো গবেষণা করার কথা ছিল, দুম করে এই সব উল্টোপাল্টা করতে গেলে কেন ?
বাবা মারা যাবার পর মা চিন্তায় পড়ে গেছিল, সবদিক কেমন ঘেঁটে গেছিল। ভাবলাম বিয়ে করে নিলে সব ঠিক করে নিতে পারব। কিন্তু আরো যে গন্ডগোল হয়ে যাবে কে জানত?
তুমি জানতে না? এটা আমাকে মেনে নিতে হবে? তুমি জানতে না গন্ডগোল হয়ে যাবে?
হ্যাঁ জানতাম। কিন্তু মানতাম না। এখন এইসব বলে নিজেকে বোঝাই। বিরক্ত লাগে।
একজনের শ্বশুরবাড়িতে গান গাওয়া বারণ। যে মেয়েটি নিজের ইচ্ছেয় গান গাইত, তার তানপুরা হারমোনিয়াম সব, মিউজিয়ামের মত রাখা থাকে। না সে গান গেয়ে বিশাল কিছু করে ফেলতে পারবে না। গায়িকা হয়ে যাওয়া বা গান বেচে পয়সাও সে করতে পারবে না। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় সে গান গাইবে, একটা জানালা, যেখান দিয়ে কিছু দমবন্ধ করা বাতাস বেরিয়ে যাবে। “ ওরা পছন্দ করে না। বাড়ির বৌ আবার গান গাইবে কি? অথচ বিয়ের আগে, বাপরে বাপ! আমার সমাদর ছিল আলাদাই রকমের"। বিয়ে করে আনা বৌ নিজের মত কিছু করে খুশি থাকছে, আনন্দে থাকছে এইটা তো হতে দেওয়া যাবে না। হতে দিলে পিতৃতন্ত্রের পলেস্তারা খসে পড়বে। মেয়েদের যে কোনো রকমের নিজস্বতা ক্ষতিকর এই পরিকাঠামোর জন্য। আজ্ঞাবহ দাস হয়ে থাকলে তবেই সবদিক বজায় থাকে। যারা চাকুরিজীবি তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে কিন্তু ঘরে বাইরে সামলাতে সামলাতে তারা ক্লান্ত। সংসার - সন্তান - চাকরি সবই তাদের নাকি "একা হাতে" সামলাতে হয়।
আমার বিবাহিতা বান্ধবীরা কেমন ব্যক্তি থেকে ধীরে ধীরে পরিবারভুক্ত 'যে কেউ' হয়ে গেল। তাদের বুদ্ধিদীপ্ত মুখে এসে পড়ল অদ্ভুত ম্লান হাসি। তারা নিজেদের সম্ভবনার কথা প্রায় বিস্তৃত। অথবা মনে করলে কষ্ট হয় তাই ভুলে যাওয়া ভাল। তাদের ক্ষিপ্র গতি কেমন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করল। প্রতিটা ফোন কল শুরু হয় “ঐ আছি একরকম শেষ হয় আর কি বলব, ভাল লাগে না।" এই দিয়ে।
মধুপর্ণা কর্মকার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যা চর্চাকেন্দ্রে গবেষণা করেন। লিখেছেন - ' গার্লস হস্টেল ; আবাসিক নারীর মানসভূমি।'(২০১৮)
তাঁর ব্লগ লিঙ্কে প্রবেশ করুন
তাঁর লিঙ্কট্রি লিঙ্কে প্রবেশ করুন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন