ঝুমুর জগতের বিস্মৃত জগৎ
ঝুমুর জগতের বিস্মৃত জগৎ
সৌরভ লায়েক
" হারমোনিয়ামের যেমন গত্ তেমনি কবি জগৎ " । অথচ পুরুলিয়ার ঝুমুর সাহিত্যে ভবপিতানন্দ ওঝা , পীতাম্বর দাস , রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলী , গঙ্গাধর ঘোষ , ঢিমা ঠাকুর প্রভৃতি এর নাম যেভাবে আলোচিত হয় সেভাবে কবিরাজ জগৎ চন্দ্র সেনগুপ্ত কে দেখতে পাই না। তাই ঝুমুর জগতে ' বিস্মৃত জগৎ ' বলতে দ্বিধা নেই । মানভূম মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ তপন কুমার পাত্র সংকলিত মানবাজারের কবি ও কবিতা সংকলন "কুটুস" এ লিখেছেন - জগত কবিরাজের বাড়ি রামনগর বারমেশ্যা অঞ্চলের ' পলমা ' গ্রামে । কিন্তু এই অঞ্চলে ' পলমা ' নামে কোনো গ্রামের অস্তিত্ব নেই । আবার খাতড়ার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জগৎকবিরাজের গ্রামের উল্লেখ পোলমী বললেও থানা বলেছেন মানবাজার । যদিও তা নয় । কবিরাজ জগৎচন্দ্র সেনগুপ্ত বা জগৎকবিরাজ - এর নিবাস ছিল অধুনা পুরুলিয়া জেলার পুঞ্চা থানার অন্তর্গত চাঁদড়া পায়রাচালী অঞ্চলের পোলমী গ্রামের হরিমন্দিরের একেবারে উত্তর দিকে ।
জগৎ কবিরাজের ঝুমুর প্রধানত দরবারি ঝুমুর । উচ্চরুচিসম্পন্ন পুরুলিয়া রাজ পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় যে ঝুমুরের বৃক্ষ প্রোথিত হয়েছিল ' ভাদরিয়া ' , ' দাঁড়শাইলা ' ঝুমুরের পাশে । জগৎ কবিরাজের ঝুমুর গুলির উপজীব্য বিষয় রাধাকৃষ্ণ ও নদীয়ার চাঁদ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু । তিনি যে দরবারি ঝুমুর ছাড়াও অন্য আঙ্গিকের ঝুমুর লিখেছেন এর প্রামাণ্য কোনো দলিল নেই । তাই ছড়িয়ে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ঝুমুরের পর্যালোচনায় দেখা যায় যে দরবারি ছাঁদে রাধা কৃষ্ণের বিষয়ইটি বারে বারে উঠে এসেছে তার ঝুমুরে । কখনো তিনি রাধাভাবে ভাবিত হয়ে বলছেন -
" বলগো নাম ফিরে ফিরে বল
হৃদয় মাঝে প্রবেশিয়ে আমার প্রাণ করিল শীতল "
এ তো সেই পদাবলীর পূর্বরাগের পদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় -
" সই কে বা শুনাইল শ্যাম নাম
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ "
পদাবলীর যেমন ' গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ ' ঠিক তেমনি গৌরাঙ্গ বিষয়ক ঝুমুর গানের দেখা পাই জগৎএর ঝুমুরে -
" গোরা রূপের কী মাধুরী কী পুরুষ কিবা নারী
এ জগতে কে না হয় দাস । "
গানটির ভণিতা চরণটিতে সুন্দর ভাবে নিজের নামটির ব্যবহার করেছেন । কখনো আবার শ্রী গৌরের চাঁদ রূপ দেখে ডুবিয়ে ফেলেছেন কর্মযোগ , জ্ঞান সমস্ত মায়াবিদ্যা , যার তুলনা করেছেন 'ডাঙা' অর্থাৎ উঁচু জমির সঙ্গে -
" হেরি গদাধর শ্রীমুখইন্দু , উজলিল ব্রজভাবের সিন্ধু
কর্ম্মযোগ - জ্ঞান ডাঙা ডুবি গেল পাতালে ।। "
জগৎচন্দ্র সেনগুপ্তের পিতা হৃদয়চন্দ্র সেনগুপ্তের পৈতৃক নিবাস ছত্রিণা নামে একদা পরিচিত বর্তমান বাঁকুড়া জেলার ছাতনা গ্রামে । ১২৬৪ মতান্তরে ১২৬৬ বঙ্গাব্দে জগৎ কবিরাজের জন্ম পোলমী গ্রামে হলেও কৈশোর বয়স থেকে পৌষ মাসে তিনি ভাগচাষির কাছে পৈতৃক জমির ধানের ভাগ নিতে ছাতনায় যেতেন এবং নিজ অংশের ধান নিয়ে আবার পোলমী গ্রামে ফিরে আসতেন । তাঁর জন্ম থেকে জীবনাবসান সমস্তই পোলমী গ্রামে , কর্মজীবন বাগমুন্ডি ও তামাড় রাজার রাজবৈদ্য ও সভাকবি রূপে । তাই ' লোকশ্রুতি ' গ্রন্থে উল্লেখিত বাঁকুড়া জেলার তিনজন ঝুমুর কবির একজন জগৎচন্দ্র সেনগুপ্ত মতটি গ্রাহ্যনীয় নয় । যদি হয় তাহলে আধুনিক বাংলার কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও বাংলাদেশের কবি বলতে হয় । কবিরাজ জগৎচন্দ্র সেনগুপ্তকে পুরুলিয়ার একজন বিস্মৃত ঝুমুর কবি বললে অত্যুক্তি হয়না ।
ছাতনা যাওয়া আসার সুবাদে বড়ু চন্ডিদাস ও ' শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ' কাব্যের সম্পর্কে যে তার মতো ব্যক্তি ওয়াকিবহাল থাকবেন একথা আন্দাজ করা যেতেই পারে । বিশেষত তাঁর কৃষ্ণের উক্তি , রাধার উক্তি দেওয়া গান গুলি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও চন্ডিদাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । যখন তাঁর ঝুমুর গানের রাধা সখি ললিতাকে বলে -
" নাবিকে না-বিকে কি দিব দাম বল বল বল ললিতে । "
- তখন যেন নৌকাখন্ডের শ্রীরাধিকাই হয়ে ওঠে প্রতীয়মান ।
ভালোবাসার মহিমা কীর্তনেও জগতের ঝুমুর অতুলনীয় , উঠে এসেছে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমের লাগি রাধিকার পায়ে ধরার প্রসঙ্গ । তিনি কৃষ্ণের প্রেমের মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন -
" বলে দিব বৃন্দাবনে
পুরুষ হয়ে নারীর পায়ে ধরিলে কেমনে ( রঙ )
...
জগৎ বলে ভালোবাসা জানা গেল এতদিনে । "
পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি তাঁর ঝুমুরে উঠে এসেছে আত্মনিবেদনের সুর । পদাবলীর নিবেদন পর্যায়ের পদ গুলির মতো তিনিও ঝুমুর গানে ঈশ্বরের কাছে সেই রূপ নিবেদিত । তাই তিনি হরিকে শিখিয়ে দাও বলে বলেছেন -
" ডাকার মতো ডাক শিখিয়ে দাও গোউর হরি
নামাভাসে উঠে যেন গোউর আমার অঙ্গ শিহরি ।।
যেমন নয়নেতে গলে ধারা , কন্ঠে গদাগদগিরা ,
হৃদয় হয় সাগরের পারা উঠে মহা ভাবের লহরী ।। "
কখনো রাধাভাবে ভাবিত , কখনো কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা , কখনো সখা সুলভ মার্জিত আনন্দ , কখনো বা একনিষ্ঠ ভক্ত কবিরাজের ঝুমুর গানে অলংকার প্রয়োগ রোমাঞ্চিত করে তোলে । যেমন -
" কত ছাঁদে কাঁদে সখি গোকুল গো - কুল "
এই চরণটিতে ছেকানুপ্রাস , অন্ত্যযমক অলংকারের সুচারু ব্যবহার যেমন দেখি অন্যদিকে জগৎ কবিরাজ বৃত্ত্যনুপ্রাস অলংকারে কৃষ্ণের যে বর্ণনা করেছেন তা ঝুমুর জগতে বিরল -
" বাঁকা লম্পট শঠ কপট কুটিল কঠোর কালিয়া হে । "
পূর্বে উল্লেখিত " নাবিকে না-বিকে কি দিব দান..." চরণটিতেও আদ্য যমক অলংকারের প্রয়োগ ও ভাব গভীরতা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । এরকম প্রচুর অলংকার সমৃদ্ধ চরণ জগৎ কবিরাজের ঝুমুরে দীপ্তমান ।
পেশায় কবিরাজ হলেও জগৎ নেশাতেও রাজ কবি কবিরাজ , অন্তত তার ঝুমুর গুলি তারই প্রমাণ । বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগ হলেও প্রত্যন্ত দক্ষিণ পশ্চিম রাঢ় বাংলায় মধ্যযুগীয় ভক্তিরসের প্লাবন তখনও চলছিল তার নিদর্শন কবিরাজের দরবারি ঝুমুর গুলি । অথচ জগৎ কবিরাজকে পুরুলিয়ার ঝুমুর সাহিত্য একেবারে অনাঘ্রাতা ফুলের মতো করে রাখলো , তার কারণ হয়তো প্রচার বিমূখতা , গানের পান্ডুলিপির হারিয়ে যাওয়া , সেই সঙ্গে গ্রামীণ উদাসীনতা । গ্রামের কিছু কিছু বাড়িতে তাঁর গানের খাতা আছে তার আভাস পাওয়া যায়, তবে নাগাল পাওয়া যায় না । জন্মগ্রাম পোলমী থেকে সত্তর থেকে দেড়শো কিমি দূরে যেখানের রাজাদের তিনি সভাকবি ছিলেন সেই বাগমুন্ডি কিংবা ঝাড়খন্ডের তামাড় অঞ্চলের কোনো গ্রামে হয়তো এখনো কোনো বৃদ্ধ আপন মনে গেয়ে ওঠেন জগৎ-এর গান আপন খেয়ালে । কিন্তু আধুনিক জগতের ছেলে মেয়েরা , সমাজ হয়তো অচিরেই ভুলে যাবে দরবারি ঝুমুর জগতের বিস্মৃত বিস্ময় কবিরাজ জগৎচন্দ্র সেনগুপ্তকে । তবুও ঠিকই কোনো না কোনো মননশীল হৃদয় আধুনিক আলোর মাঝে ঠিক খুঁজে নেবেন পোলমী গ্রামের তুলসী তলায় জাজ্বল্যমান হৃদয়চন্দ্রের পুত্র জগৎ নামক মাটির প্রদীপটিকে ।
(পৌলমী গ্ৰামে জগৎ কবিরাজের বাড়ির বর্তমান অবস্থা।)
লেখক পরিচিতি
সৌরভ লায়েক
সাধারণ নিম্নবিত্ত এক চাষি পরিবারের ছেলে । রামানন্দ সেন্টিনারি কলেজ লৌলাড়া থেকে বাংলা সাম্মানিক বিভাগে স্নাতক , তারপর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্ৰি লাভ । বর্তমানে স্বরাজনগর টিচার্স' ট্রেনিং কলেজ থেকে শিক্ষক শিক্ষণ ট্রেনিং নিচ্ছেন তিনি ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন