জলশ্যাওলার বিরহকথা
জলশ্যাওলার বিরহকথা
দীপংকর রায়
১০ম পর্ব
অঘ্রাণ, বাইশে নভেম্বর
আজ বুঝি তাঁর কৃপা পেলাম ! একেবারে সকালে উঠেই একটি গল্প------ লেখা হয়ে গেলে পড়ে শোনাবার ইচ্ছে জাগে মনে মনে। কাকে শোনাবো ? কে শোনে এইসব কলাকৌশল ? সত্যিই কি বোঝাতে পারবো ? সবটা বোঝানোরই বা কী আছে ? যদিও মনে হলো, সে কিছুটা বুঝতে চায় হয়তো। কিন্তু আজ কি সময় আছে তার ? আজ যে শ্যালিকার বাড়ির ভাড়াটে ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেটি এসে উপস্থিত হয়েছে। সে রাতে কার্তায়নী মণ্ডবে যার গলা জড়িয়ে তাক করেছিল বেলুন ফুটো করতে বন্দুকের নল। সে যে এখন তাকে নিয়েই আটখানা হচ্ছে আহ্লাদে উচ্ছাসে । এখন কি আর এই ধেড়েকেষ্টর কী আবেগ ঘন হলো, সেদিকে নজর আছে তার ? সে যে একেবারে মামি মামি করে আহ্লাদে গড়িয়ে পড়ছে দু'হাত ধরে !
যদিও তার এই আগমন হেতু টিপ্পনী কেটে জানিয়েও গেছে, বলেছে চোখ টিপে, দেখেছেন তো, দেখেছেন তো, ভাগ্নে কেমন ভাবরসে ডুবে ছুটে এসেছে চল্লিশ কিলো ঠেঙ্গিয়ে ----?
ভেতরে ভেতরে মেয়েদের এই বৈচিত্রের স্বাদ নেওয়া নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ নিজেকেও জড়িয়ে উদাস হয়ে পড়ে রইলাম জানলার পাল্লাটি খুলে বাইরের দিকে চেয়ে।
মনে মনে বললাম, তুমিও একই বেলাল্লাপনায় দুষ্ট নও কি ? ------ তা না হলে এই ঈর্ষা জাগছে কেন ভেতরে ? হতেও তো পারে সহজ মেলামেশা। কেন তাহলে অমন মুখ ঘুরিয়ে চলে এলে ?
একটি মন যেন অভিমানে রাগে আটখানা হয়ে বলছে, আর নয়, আর নয়, অপাত্রে অনেক দান করেছ। আবার এও বলছে, সত্যিই কি করেছ কিছু দান ? কই, কিছুই তো ছাড়নি একচুলও------ তাহলে এসব ভাবনা মাথায় আসছেই বা কেন ?
এবার ভেতর থেকে কেউ যেন সত্যি সত্যি বিদ্রোহ করে উঠতে চাইছে। তাহলে আবার পরমুহূর্তেই মেনিমুখো ধেড়েকেষ্ট হয়ে গড়িয়ে পড়তে চাইল কেন আবেগে --- ?
রবীন্দ্রনাথের সাহাজাহান পড়ে চিৎকার করে শোনাতে চাইলাম এদের সবাইকে ! মনের এইসব উল্টাপাল্টা আবেগের হদিশ কীভাবে যে পাই ?
ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় গৌররের সঙ্গে ঢাকায় যাওয়ায় সম্মত হলাম ফোনে।
তার মানে আমাকে আবার ফিরতে হবে মাগুরায় ,তারপর তার সঙ্গে ঢাকায়।
পুরো দুপুরবেলাটা কাটলো সেই একই রকমের ন্যাকামির সঙ্গে হাতের উপরে হাত রাখতে দিতে, গালের উপরে গাল, পারলে পাওডার ডলে দেয় বুকে, পারলে মুখে আরো খানিকটা।
আমিও কি সত্যি সত্যিই পাগলের পাল্লায় পড়ে পাগল হলাম ? এতটা সহনশীলতা আয়ত্ত করলাম কখন, কীভাবে ?
এত কিছু দেখে দেখে নিরেট গাধার মতো পড়ে আছি কেন ? আমি কি ধাড়ি বেড়ালের মতো, নাকি বুড়ো ষাঁড়------ যেভাবে ঘাড় গুঁজে, মটকে ,লেটকে পড়ে আছি ! আর তাই কি, গুঁতিয়ে, খামচে, চিমটে যতবার চেষ্টা করলো জাগাতে, তারপরও জাগলাম না যেন, ঘাড় ভেঙ্গে পড়ে রইলাম তারই মুঠোর ভেতর !
২৩ নভেম্বর, অঘ্রাণ
গতকাল রাতে দোতলায় গৌতমের পাশের ঘরে থাকতে হলো। এই ঘরে দু’হাজার এক এ অনেকটা সময় কেটেছিল। সেও আর এক অনুভব। যাকগে, যে পেছনে সরে গেছে তাকে সামনে এনে আর দাঁড় করাতে ইচ্ছে করে না। শুধু এইটুকু যেন মনে না করলে অনেক ঋণ স্বীকার করা হলো না বলে মনে হয়। জীবনের কাছে পথ যে কত ঋণের বোঝা চাপায় খালিখালি, অযাচিতভাবে তার সব হিসাব কি রাখা যায়, না রাখতে পারি ?
সেদিনের পরের রাতও উপরে থাকবো কি না সে প্রশ্নেরও উত্তর চাইলো এক ফাঁকে।
রাত-ভোর কেন যে একটা ছটফটানি ছিল, কীসের যে তা, সে যেন নিজেই বুঝতে পারছি না। মনে মনে বলছি যেন, আমি কি উন্মাদ, শুধু শুধু কেন যে এত কষ্ট পাই, তা বুঝি না।
চরিত্র কাকে বলে ? একটুখানি বাইরে বেরিয়ে সকালবেলাটা যে উপলব্ধি করব তারও উপায় নেই। রোদেরা যেন আমাকে অনুসরণ করে আগুপিছু করছে ! অঘ্রাণের সকালের রোদেদের কী যে রূপ, তার আলোছায়ায় একটু যে ইচ্ছে মতো এদিক ওদিক যাবো তারও যো নেই। মনে হলেই যাকে খুশি হাত ধরে টেনে নিয়ে অতি সরল ভাবে বলবো, চল, পথে পথে একটু রোদ মেখে ঘুরে আসি।
এসবে সন্মতি বা সমর্থন কার কাছেই বা নগদ বেচাকেনায় পাওয়া যাবে এখানে। সবই তো অদ্ভুত এক লেনদেনে ডুবিয়ে আছড়িয়ে মারছে । কে যে কোথায় চোখ টেপাটিপি করছে ! ভয়ও তো আছে, এত ভয় থাকলে কি পৃথিবীর সব রূপ -রস-গন্ধ পাওয়া যায় ?
এ যেন ধেড়েকেষ্টর মদনগোপাল হবার শখ?
আগামীকাল----- এই দিনের স্মৃতি আজন্মকাল বইতে হবে যে তা জানি। কিন্তু সেই ভোরেরবেলার অর্ঘ উল্টো দিকে কি কোনো শিউলির ঘ্রাণ বয়ে আনে আজও --- জানি না তো সেসব কি কোথাও এক আঁজলা শিউলি বা একটি দুটি স্থলপদ্ম হয়ে অঝোরে চোখের জল ফেলে একটি মুহূর্তের জন্যও অন্তত ?
ভাবতে চায় মন।
আচ্ছা, সেই জন্যেই কি ঢাকায় যাবো বলে বললো, ' ভেবে পাচ্ছি না, মেলাতে পারছি না, সত্যিই আপনি আসছেন কিনা ! '
কিন্তু কই , আর তো যোগাযোগ করলো না ! করলে না হয় বোঝা যেত টান। যদিও জানি না এখন করছে কি না। গৌর-এর মোবাইল নম্বর দিয়েছিলাম, জানিনে হয়তো বা সেখানেও করতে পারে !
টাকা ফুরিয়ে আসছে। ধার আর করবো না ভেবেছি। বেশি টাকা তো আনা যায় না। তাছাড়া পাবোই বা কোনখানে ? ধারের জ্বালা ভীষণ। আজ মাগুরায় চলে যাব ভেবেছি। আগামীকাল ঢাকায়। এরকমই কথা হয়েছিল গৌর-এর সঙ্গে। পারবো কিনা বুঝতে পারছি না। শরীরের যা হাল, প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে ইঞ্জিন ফেল করবে বুঝি। তবু ঢাকায় না গিয়ে চলে যাব, তা কি করে হয় ! তাই প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হলাম। হাজার কষ্ট হলেও যেতে আমাকে হবেই।
খুব তাড়াতাড়িই চা এলো সকালের। কারণটা বুঝেছি। বড় শালা বউকে যতটা সোজা সরল মনে হয়েছিল, তা তো না ! এসব ক্ষেত্রে এরা সরল হতে পারে না যেন। তবে আমার আর সহজ কঠিন দিয়ে কী হবে। রাতে পাশে সেই ছেলেটিকে নিয়েই শুতে হয়েছিল। এমনিতে প্রাণচ্ছল। হ্যাঁ, ভালোই তো! গান গায় হেড়েগলায়। রবীন্দ্রসংগীত গায় তাও উল্টোপাল্টা সুরে। অন্যান্য যা গাইল সেসব সব এখনকার বাজনা-সর্বস্ব গান। তা শুধু হারমনিয়ামে আর কতটা ঝঙ্কার তুলতে পারে।
মামির সঙ্গে ভাগ্নের ভাবরসের আদানপ্রদান নিয়ে খুব একটা গিঁট খুলে মেলে ধরতে চাইছে না। কাঁচা মামি । ভাগ্নেও কাঁচা । এই রসায়ন আমার আর বোঝার কি আছে !
গতকাল রাতে শোবার আগে গানের আসর বসেছিল যে উপরে গৌতমের ঘরে খাটের উপর, সেই বিষয়টাতে মামির যে খুব একটা ভাগ্নের গানে টান ছিল তা তো না । সোনার ভাগ্নের গান শেষ হলে সে বললো, জামাইবাবু আমি আপনার কোলে একটু মাথাটা রেখে শুই ? আমার মাথাটা না ভীষণ ধরেছে, আপনি একটু হাত বুলিয়ে দেন না।
শ্যালকের নতুন বউ ------ আমি কি তার আব্দার ফেলতে পারি ? এর আগেও যেমন দিয়েছি আজও তো তেমনই তার ভালোবাসার আব্দার রাখলাম। এতে আর সঙ্কোচের কিই বা আছে এত ?
টি.ভি-তে রাতের নাটক হচ্ছে। গান। এখানকার গান তো একটুখানি শুরু হয়েই থেমে গেছিল ----- এর সঙ্গে সঙ্গেই একরকম টি. ভি-র অনুষ্ঠান শেষ হলেই খাওয়া-দাওয়া ঘুম।
চা এল। নিচের ঘরে নামলাম। দেখতে দেখতে বেলাও হলো। কিন্তু একটা গন্ডগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। যা প্রায় সকলেরই নজরে পড়া শুরু ও করে দিয়েছে। ভাবছিলাম কিছু একটা চেয়ারে বসে বসে। স্নান-টেনান সেরে এসে এমনি এমনিই একাকী একটুখানি নিভৃতি উপভোগ করছিলাম। একেবারে সেজেগুজে ঘরের ভেতরে ঢুকেই সটান কোলের উপরে চেপে বসে পড়ল । গালের উপরে গাল রাখলো। বার কয়েক সমস্ত শরীরের ভরও ছেড়ে দিল যেন আল্হাদের ছলে। কিছু বলা এবং কওয়ার আগে কেন যে বেশ খানিকটা নির্লিপ্তি আমাকে সেই সময় সঙ্গ দিল আড়াল থেকে একেবারে-------কোনো সাড়া দিইনি কোনো সম্পর্কে। কী করে যে এতটা আয়ত্ত করলাম ----- তা নিজেই জানি না । বললাম, হয়েছে, বাচ্চা মেয়ের কোলে চড়া ? চল্
দেখি বস তোর জায়গায়, কোথায় ছিলি?
সে কিছু না বলে খানিকটা ভাবলেশ হীন হয়ে নেমে যেয়ে পাশের বিছানায় বসে থাকলো ঘাড় ঝুঁকিয়ে ।
এর আগে দক্ষিণের বাগানের দিকে যে বাথরুমে স্নান করতে যাই, সেখানেও গিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করেছিল, তাকে রেখে আমি কী করে থাকবো। ঢাকা থেকে আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসি যেন। আমাদের বিবাহের সময়কার গল্প শুনতে চাইল। কীভাবে আমার এখানের সঙ্গে পরিচয় হলো। শেষে আবারও বললো, আপনি চলে গেলে আমার ভীষণ কষ্ট হবে। কী করবো তখন ? আপনার প্রেমে পড়বো ?
সকালে বাজারের থেকে মোবাইল ফোন হায়ার করে নিয়ে এসে সাথীর সাথে তার মায়ের কথা বলিয়ে দিলাম। সে নিজেও এগিয়ে এসে এক ফাঁকে কথা বললো। সাথী নাকি ওকে বলেছে, শোন, তোর ওই বাস্তব-জ্ঞানহীন জামাইবাবুটার দিকে তুই একটু খেয়াল রাখিস। ও কিন্তু ওখানে ভীষণ একা একা অনুভব করে। তুই ওর খেয়াল রাখিস কিন্তু।
সাথী যদি সত্যি সত্যি একথা বলে থাকে তাহলে আমি আর একবারও তার কাছে নিজের মাথাটা নামিয়ে ধরলাম। মাঝে মাঝেই দেখেছি ওর চিন্তা ভাবনা অদ্ভুত অদ্ভুত রকমের কাকতালীয় সংযোগ অনুভব করে ফেলে। তখন সত্যি ওর কাছে আমি যেন অনেক ছোটো হয়ে যাই।
তারও পরের গল্প আর বেশিক্ষণ নিল না। খাবার ডাক এল। খাওয়ার সময়ও কাছ-ছাড়া হয়নি। পারলে খাইয়েও দিতে চায়। তরকারি মেখে,পর পর অন্যান্য পদও ভেঙ্গে , বেগুনভাজার চোকলা সরিয়ে মাছও বাছতে লাগলো। এইবার একটু রাগই করলাম। বললাম, তুই কি আমাকে ছোট্ট শিশুটি পেলি নাকি ?
উত্তরে বললো, হ্যা…. দিদি বলেছে তো আপনাকে দেখাশোনা করতে, আপনি নাকি মাঝে মাঝে বাস্তব জ্ঞান-শূন্য হয়ে যান, তাই যা করবো একদম কথা বলবেন না।
সমস্ত ধরণের সঙ্কোচ বোধ এবার আমাকে ঘিরে ধরল যেন, অথচ সে কিন্তু কোনো কিছুই খেয়াল করছে না। শাশুড়িরা হাসাহাসি করছে। সকলেই কিছু একটা আশঙ্কা করছে যেন, কী হয় কী হয় ভেবে। এই না আমি রেগে ফায়ার হই, এই আশঙ্কা তাদের। কারণ, গত এতগুলো বছর তারা যেভাবে দেখেছে তার জন্যেই হয়তো। কেন না এর আগে তো কেউ এভাবে পারেনি !
ভাবছি এত ভালোবাসা আমি রাখবো কোথায় ? সেকি এই ফুটো কপালে সহ্য হবে ! আমার মা যা পারেনি কোনোদিন, সাথীও না , সেটা এই একরত্তি মেয়েটি পারলো কী করে ? এত সাহস ও কোথায় পেল ? কাউকে পরোয়া না করে , কারোর দিকে না তাকিয়ে, আগে পিছনে কিছুই না ভেবে এতটা সাহস ও পেল কোথায় ? আমিই বা ঘাড় গুঁজে খাচ্ছি বা কেন ? একসময় কেন জানি না চোখের কোনে যে জল এসে গেছে তাও টের পেলাম। মনে মনে বললামও যেন ' তুই আমার কে হস রে ……. ' ?
মাগুরায় এলাম। আসার সময়ে দরজা পর্যন্ত এলো। হয়তো চেয়ে ছিল। কিন্তু আমিই তাকাতে পারলাম না।
এবার আর এক বন্দী জীবন শুরু হলো। না থেকেও উপায় নেই। আবার থাকলেও জ্বালা। কেষ্ট দাদুর আমার সাথে কথা বলতে বলতে চোখ বুঁজে আসার নাটক। দিদিমার চোখ পিট পিট। বউদের এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি। কী করবো ? পালিয়ে যাবো ? সমস্ত রাত ছটফট করলাম নানা গ্লানিতে। জানতে পেলাম সকালেও ঢাকায় যাওয়া হবে না। বৃহস্পতিবারেও না। হলোও সেটাই। লিখলাম, আজ চব্বিশে নভেম্বর, অঘ্রাণ ---- বুধবার, অনেক কষ্টে রাত পোহালো । বাজারে গেলাম গৌর-এর সঙ্গে। কই মাছ এলো, পাবদা এলো । মনে মনে বললাম, এ যেন পাঁঠাটাকে বলির আগে ভালো মন্দ গেলানো। একসময়, রেগে বিড়বিড় করতে করতে বললাম, এইসব শালারা এবার আমার পেছনে গুঁজে দেবে ? ঢেমনামি করছে আসল কাজে ? কথা দিয়ে ডেকে এনে নছল্লা হচ্ছে বাপ ছেলে মিলে ?
কুচকিকণ্ঠা ভরে দুপুরে খেয়ে চিত হয়ে পড়ে রইলাম দোকানঘরের পেছনের খাটে। এরপরের খেলাটা শুরু হলো সন্ধে লাগলে। বাপ-মা-বউ সকলের পরামর্শে একেবারেই বাতিল হয়ে গেল গৌর-এর ঢাকায় আমার সঙ্গে যাওয়াটা।
পরদিন আবার শ্যালিকার আশ্রয়ে লোটাকম্বল নিয়ে থুয়ে পৌঁছনো। ওদের একবারও মনে হলো না, এই মানুষটাকে নানা গল্প বলে, ফোন করে করে ডেকে এনে, এখন বলছে কিনা, নানা সমস্যা। যাওয়া হচ্ছে না মামা।
মনে মনে ভাবতে থাকলাম, কলকাতায় গেলে তো তোদের পুরুষাঙ্গটাও পারলে আমাকে ধরে পেচ্ছাপ করিয়ে দিতে হয় তোদেরকে …… !
কোনো কথাই মনে থাকে না বিষয়ী মানুষদের । বার-কয় কেউ যেন ছোটবেলার চুঙ্গো বন্দুকে ঠেসে দিল কায়োজাঙ্গালের ফল একটার পরে একটা। তারপরে জোরে ঠাসা দিলে পটাস করে খানিকটা ধোঁয়া বেরিয়ে গিয়ে বলটা গিয়ে যেভাবে গুলির মতো ছুটে গিয়ে পড়তো, এখানেও তেমনি একটা ক্রোধে কেবলই যেন বারুদ ঠাসতে লাগলাম আমিও অদৃশ্য সেইসব খেলনা বন্দুকে ।
আমি কি অপ্রকিতস্থ হয়ে গেলাম কিছুটা ? এরপরে আর কি এদের এই ঠাট্টা উপহাসের পাত্র হবো আর কোনোদিন জীবনে কখনো ?
এই মজা কে না নিয়েছে ? গৌরদের এই মানুষিক অবস্থার পেছনেও তো অনেক কারণ আছে ! সে কথা না বললেও এই ছকবাজির আগা মাথা বোঝা যাবে না।
নব্বই শুরু, ভাগ হয়ে গেল চণ্ডী ঘোষ রোডের বাড়ি। বাড়ি মানে বাড়ি না। সবগুলোই দোকান। কথাটা ঠিক দোকান বাড়িও বলা যায় না। পর পর সবই দোকান ঘর।
বড় বোন তার অংশ ভাগ করে আমায় একখানি খালি দোকান অতি কষ্টে ছেড়ে দিল। বাকি আমার অংশের যেগুলি, সেগুলি তো ঠাকুমা ঠাকুরদাদাই ভাড়াটে বসিয়ে রেখেছিল। সেগুলিকে উচ্ছেদ করে নতুন ভাড়া পাওয়া এবং নিজস্ব স্বত্ব সর্ব-অর্থে কায়েম করা সে কাজ যে কতটা দুরূহ তা টের পেয়েছি কয়েকবছর কোর্ট মামলা এইসব করে। শেষে একদিন মনে হলো এই ছদ্মবেশী চেঙ্গিস খাঁ-দের হাতের ভেতর থেকে যত তাড়াতাড়ি পালাতে পারবো ততই মঙ্গল।
যা হোক, ভাই বোনের ইজমালী সম্পত্তি ভাগ হয়ে গেলে, ওই যে বললাম, অতি কষ্টে একখানি খালি দোকান ঘর পাওয়া গেল, যদিও সেই প্রাপ্তির বাকি নাটকের কথা নাই বা বললাম !
এবার প্রাপ্ত দোকান নিয়ে কী করবো , এই ভাবতে ভাবতেই সাথীর কাকা এসে এখানে উঠল। সে এদেশেই থাকবে এরকম একটা পরিকল্পনা। প্রাইভেট টিউশনি করে কতটা আর ভবিষ্যত! তাই প্রসঙ্গ নিয়ে জল্পনা -কল্পনা শুরু হলো। শ্বশুরমশাইরাও চায় সে একটা কিছু পাকাপাকি ভাবে করুক। আর আমাকেও সে কথাই ভাবা ছাড়া অন্য আর কিছু তো ভাবা সম্ভব না।
চুরানব্বই-এর সেই উদ্দাম দিনগুলির মধ্যে বারবার অভিমানের প্রসঙ্গয় উঠে এসেছে সেই কথাগুলি থেকে।
অসুস্থতা সুস্থতায় সাহারা বলতে যাকে ভাবতে পেরেছিলাম একদিন, তারই অনুরোধে অনেকদিন পরে আবার এই শ্বশুর বাড়িতে আসতে বাধ্য হই । এবং কাকাবাবু ও খালি দোকান ঘর এমনি এমনি ফাঁকা ফেলে রাখা, এইসব প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ- আলোচনার মাঝে আটকে যাই তাকে নিয়ে যৌথ কর্মকাণ্ডে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শে তাদের সঙ্গে। এবং তাদের সাহসে উদ্দীপনায় কিছুটা আর্থিক সহায়তার আশ্বাসবাণী পেয়ে কলকাতায় ফিরে তার সঙ্গেও আলোচনা খোলামেলা ভাবে সেরে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি একটি প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করাতে । শুরু হয় আমার দোকানদারির জীবন।
দায়িত্বজ্ঞানহীন কাকাবাবু শেষ যেদিন দোকান উদ্বোধন হচ্ছে সেদিন তিনি জানালেন, 'ব্যবসা আপনার, আপনি আপনার জিনিস একা একা বুঝে নেবেন না তো কে বুঝে নেবে ! '
নির্ভরশীলতার মাটি সরে গেল। শ্বশুরালয় থেকে টাকার জোগান বন্ধ হয়ে গেল। মহাজনেরাও সাপ্লাই বন্ধ করলো। পুঁজির জোর কম বলে নতুন দোকান যদি না চলে, তাহলে তাদের টাকা মার খাবে ! সেই চিন্তায় তারাও মুখঘুরিয়ে চুপ করে থাকলো। শুরু হলো নতুন যুদ্ধ। শুরু হলো দেহ-মনেরও ভাঙ্গন ।
সেই গঙ্গাপুরীর বাড়ি থেকেই এই গৌর-এর বাবার আমাদের ঠাকুমা ঠাকুরদার বাড়িতেই তার নিয়মিত আসা যাওয়া ওদেশ থেকে।
দেশ ভাগ হওয়াতে সংখ্যালঘুরা যে অনিশ্চয়তার শিকার হলো। তার থেকেই একটু সচেতন হিসেবী মানুষজনেরা তাদের অস্তিত্ব যেনতেন প্রকারে টিকিয়ে রাখার জন্য ভেতরে ভেতরে দুই দেশেই তাদের একটা নিশ্চয়তা খুঁজে বেড়াতে লাগলো। আর তেমন সুযোগসন্ধানী একজন বিচক্ষণ মানুষ এই গৌর ঠাকুরদাসের বাবাও । তিনি এই কাজে একটু অধিকই সচেতন হয়ে, অনেকটা দূরের সম্পর্ককে তিলতিল করে অনেকটা কাছের করে নিলেন। তাই এখানের ব্যাঙ্কে, পোষ্টাফিসে তার অনেক দিন থেকেই আনাগোনা। এবং কাজে কাজেই কাজের প্রয়োজনে অনেকটা দূর ও কাছের হয় যে কারণে সেই কারণেই আত্মীয়তা গভীর হতে লাগলো দিন দিন। এবং তার সমস্ত হিসাব-কেতাব আমাদের হেপাজতেই। তথাপি তাকে আমরাও নিজের দাদুর আসনেই বসালাম। আর তার হাত ধরেই ব্যবসার জীবনের হাতেখড়ি আমার। সে সেই শান্তিপুর ফুলিয়া থেকে বড়বাজার, ঢাকা-বাংলাদেশ সবই তার হাত ধরেই। অন্নসংস্থানের এই লড়াইএ দাদুই হলো আমার পথপ্রদর্শক।
চলবে…….
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন