মেয়েদের হস্টেল আর হস্টেলের মেয়েরা / মধুপর্ণা কর্মকার

মেয়েদের হস্টেল আর হস্টেলের মেয়েরা

মধুপর্ণা কর্মকার

নারী শিক্ষা সূত্রপাতের বন্ধুর পথ পেরিয়ে যখন মেয়েরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে শুরু করল এমনকি বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় অন্য জেলায় অন্য রাজ্যে গেল পড়াশুনার জন্য, সেইখানে থাকতে শুরু করল বছরের পর বছর, ক্রমে মেয়েদের হস্টেল হয়ে উঠল তাদের জীবনে তথা সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সেখানে শুধু তারা পরিবার ছেড়েই থাকছে না, নতুন জায়গা- নতুন শহর দেখছে, বিভিন্ন মানুষজনের সংগে মিশছে, পরিবারের কয়েকটি ভুমিকার বাইরে গিয়ে পড়াশুনার মধ্যে দিয়ে নিজেদের চিনছে। এই সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে যেমন বদলে যাচ্ছে, তেমনি ধীরে ধীরে ঘটছে একটি সামাজিক রূপান্তর। এদেশে মেয়েদের আবাসজীবন খুব বেশিদিনের পুরোনো নয়, নারী শিক্ষার সমান্তরালে প্রায় দেড়’ শ বছরের কি তারও কম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেই প্রথম যুগে যে কয়েকটি মেয়েদের হস্টেল তৈরী হয়েছিল বিশ্বভারতীর ‘শ্রীসদন’ (১৯০৯ সাল) তাদের মধ্যে একটি। নানা প্রতিবন্ধকতার পাহাড় পেরিয়ে যাঁরা শিক্ষালাভের জন্য পরিবারের নিগড় কেটে বাইরে আসতে পেরেছিলেন সেই নারীরাই সমাজকে এগিয়ে দিয়েছিলেন কয়েক ধাপ। আবদ্ধ গার্হস্থজীবন থেকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে নারীর পরিচিতির ইতিহাস বেশ প্রতিকুলতার।  পরিবারের বাইরে  ভিন্ন একটি সামাজিক পরিসরে নারীর বসবাস-  এই বিষয়টা মেনে নিতে এবং অভ্যস্ত হতে অনেক সময় লেগেছিল পুরুষশাসিত সমাজের। নির্ধারিত কিছু পারিবারিক ভূমিকার বাইরে হস্টেলে এসে তারা নিজেদের দেখল নতুন ভূমিকায়। নিজেদের দেখল, অন্যদের দেখল, পরস্পরকে দেখল। একদিকে পড়াশুনা করার নতুন অভিজ্ঞতা অন্যদিকে পরিবারের বাইরে সমবয়সীদের সাথে থাকার অভিজ্ঞতা। এর ভিতরেই  নতুন সাপেক্ষতায় ঘটল নারীর আত্মআবিষ্কার। নারীর সামাজিক ভূমিকায় এল বদল, শুধুমাত্র গার্হস্থ্য জীবনে কন্যা, স্ত্রী, মাতা এই ভুমিকার জায়গায় দেখা দিল নতুন  পরিচয়, তারা ছাত্রী, তারা আবাসিক। সাংসারিক কাজকর্ম ছাড়াও তাদের এখন নতুন কাজ পড়াশুনা, যে মগজে কেবলই গৃহকর্ম আর পরিবারের সদস্যদের পরিষেবা দেবার চিন্তা পাক খেত সেখানে ঘটল তুমুল পরিবর্তন, বাইরের পৃথিবী, অনেক মানুষের সঙ্গে, আলাপ তাদের সাহচর্য জন্ম দিল নতুন মননশীলতার, চর্চিত হতে থাকল নতুন জগত, আর সম্ভবনাময় ভবিষ্যতের কথা। পারিবারিক কয়েকটি সম্বন্ধ ছাড়াও মেয়েরা পরিচিত হল আরো নানা মাত্রার সম্পর্কের সঙ্গে।  বদলের এই সন্ধিক্ষণ খুব সাবলীল ভাবে আসে নি।
                পরিবার ও হস্টেল একই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর অন্তর্গত দুটি প্রতিষ্ঠান। তারপরও দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। হস্টেলে সমবয়সী বা প্রায় সমবয়সীদের সঙ্গে বেড়ে ওঠে ছেলেমেয়েরা। পরিবারের প্রত্যক্ষ নজরদারীর বাইরে তাদের নিজস্ব জীবনবোধ তৈরি হয়।  ধীরে ধীরে নিছক পড়াশুনা করার জায়গার থেকেও হস্টেল আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। যা ছাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গি  মানসভূমি নির্মাণে বিশেষ ভুমিকা নেয়। হস্টেল জীবনের প্রভাব থেকে যায় সারাজীবন। পরিবারের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার বিকল্প হিসাবে দেখা দেয় হস্টেলজীবন। মেয়েদের হস্টেলে  থাকা ও পড়াশুনা করার মধ্যে একটি বিশেষ মাত্রা আছে যা তার অস্তিত্ববোধের সঙ্গে, চেতনার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এত বিশাল এক একটা বাড়ি, তার মধ্যে শত শত মেয়েরা একসাথে থাকে, সামাজিক অবস্থান ভেদে প্রত্যেকের রুচি আলাদা, বোধ আলাদা, উদ্দেশ্য আলাদা, সমস্যা আলাদা, প্রতিকুলতা আলাদা, তা থেকে রেহাই পাবার সংগ্রাম আলাদা। গ্রাম থেকে মফস্বল থেকে মেয়েরা শহরে আসছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। তাদের শ্রেনী, ধর্ম, জাতি, বর্ণ সবই আলাদা। কিন্তু তারা হস্টেলে নিচ্ছে একত্রবাসের পাঠ। এই একত্রবাসে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে, সমঝোতা করতে শিখছে, পাচ্ছে স্বাধীনতার স্বাদ। শুধু তাই নয় প্রচন্ড রক্ষনশীল পরিবারের মুসলিম পরিবারের মেয়েটি এখানে এসে পাচ্ছে ধর্মীয় জীবন যাপন না করার অবকাশ। নিজের পছন্দের পোশাক পরার অবকাশ। অত্যন্ত অস্বচ্ছ্বল পরিবারের মেয়েটি এখানে পাচ্ছে একটা পড়ার জায়গা, পড়ার টেবিল, নিজের জন্য  সময়। এমনকি অনেকে হস্টেলে এসে প্রথম ব্যবহার করছে শৌচাগার, আলো, পাখা। পরিবারের কাজে ,পরিবারের জমিতে চাষের কাজে সময় দিতে গিয়ে যার সময় থাকত না পড়াশুনা করার সেই  মেয়ে হস্টেলে এসে পাচ্ছে পড়ার অবসর। বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় তারা সমৃদ্ধ হচ্ছে, নিজেদের ইচ্ছা অনুভূতির প্রকাশে ধীরে ধীরে অকপট হয়ে উঠছে। সামাজিক গোঁড়ামি, কুসংস্কার ইত্যাদি থেকে নিজেদেরকে বের করে নিয়ে তারা নিজেদের জীবন নির্মাণ করে তুলছে। ছেলেদের হস্টেলের তুলনায় তাদের হস্টেলে কেন ভিন্ন নিয়ম চর্চা হবে, নিয়মে কেন বৈষম্য থাকবে  - আরো অনেক দাবী নিয়ে ভারতের নানা প্রান্তের হস্টেলের মেয়েরা আন্দোলনে সামিল হচ্ছে। সার্বিকভাবে আবাসিক মেয়েদের  জীবনের উদযাপনে হস্টেল আগেও যেমন ভূমিকা নিয়েছে, অনেকখানি এখনও নিয়ে চলেছে।




 ছবি - বিশ্বভারতীর প্রথম মেয়েদের হস্টেল ‘শ্রীসদন’( প্রতিষ্ঠা -১৯০৯ সাল)। প্রসঙ্গত বলি এই হস্টেলে আমার প্রথম আবাসজীবনের সূচনা আর কেটেছে বেশকিছু বছর। 








মধুপর্ণা কর্মকার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যা চর্চাকেন্দ্রে গবেষণা করেন। লিখেছেন - ' গার্লস হস্টেল ; আবাসিক নারীর মানসভূমি।'(২০১৮)


তাঁর ব্লগ লিঙ্কে প্রবেশ করুন

তাঁর লিঙ্কট্রি লিঙ্কে প্রবেশ করুন





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪