'না'। পূর্ণচ্ছেদ। / মধুপর্ণা


'না'। পূর্ণচ্ছেদ।

মধুপর্ণা


মেয়েটি বলল –'না'। এই 'না' পুরুষতন্ত্রের কাছে থ্রেট, মেয়েদের 'না' মেনে নিতে শুধু অসুবিধা হয় না তাদের, আতঙ্ক তৈরি করে। সেই আতঙ্ক প্রকাশ পায় আগ্রাসনের আকারে। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে মেয়েদের 'না' কিভাবে পুরুষতন্ত্র মেনে নিতে পারে না। এই 'না' এর সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য সমাজ বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। প্রথমত তাচ্ছিল্য করে উপেক্ষা করে, তারপরও আয়ত্ত্বে না এলে অবদমন করে, নিষ্পেষণ করে। পুরুষতান্ত্রিক একাধিপত্যের আকাঙ্খায় “না” এই ছোট শব্দটি ফাটল ধরায়। পুং অহং এর ফাঁপিয়ে তোলা ফানুসের কাছে এই 'না' হয়ে ওঠে সংকট। সামাজিক কাঠামো যখন নারীকে 'অপর', 'দ্বিতীয় লিঙ্গ’, ‘আংশিক মানুষ' হিসাবে দেখতে চায়, নারীকে গড়ে তুলতে চায় পুরুষের স্বেচ্ছ্বাচারের একচ্ছত্র ক্ষেত্র হিসাবে তখন নারীর মুখ নিঃসৃত একটি শব্দ 'না' পিতৃতান্ত্রিক মানসকাঠামোর জন্য হয়ে ওঠে ঝুঁকিপূর্ণ। তাই দ্বিমত হবার, অস্বীকার করার অধিকার নারীকে দিতে নারাজ সমাজ। নির্দেশিত নিয়মপালন করে যাওয়া এবং প্রশ্ন না করা তাদের কাছে প্রত্যাশিত। সেখানে যখন প্রতিস্পর্ধী 'না' উচ্চারিত হয়, তার প্রতিধ্বনি ঘুরপাক খেতে থাকে পুং অহং এর ক্ষমতাদর্পী অলিন্দে। এই না এর সম্মুখীণ হলে পুরুষতন্ত্রের দাঁত-নখ ক্রমে নগ্ন হয়ে পড়ে। নারীর 'না' কে তারা পাল্টা অস্বীকার করে এবং কৌশলে হোক বা ত্রাস সৃষ্টি করে হোক তারা 'না' কে 'হ্যাঁ' বা সম্মতিতে রূপান্তরিত করতে চায়।

নারীর মধ্যস্থ প্রতিরোধ স্পৃহাকে কোনো ক্রমে বিদ্ধস্থ করতে পারলে পুং অহং স্বস্তি এবং নিরাপদ বোধ করে। শুধুই প্রতিরোধ নয়, নারীর ইচ্ছা, পছন্দ, নিজস্ব পরিসরের বেড়া, নিজের সীমানা নিশ্চিত করার জন্য ‘না’ ভীষণ জরুরি। এখানেই পুরুষতন্ত্রের সমস্যা শুরু হয়। এই সবগুলির বেড়া বিনষ্ট করে দিতে পারলে নারীকে গ্রাস করতে সুবিধা হবে বলে সে ধারণা করে। বাহ্যিকভাবে অবদমনের মধ্যে রেখেও সে স্বস্তি বোধ করে না। তার মন, মনন, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে তাকে উপনিবেশ বানিয়ে নিজের আয়ত্ত্বে রাখতে চায়। সেই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে, একাধিপত্যের আয়োজন নস্যাৎ করার ক্ষেত্রে নারীর 'না' মূর্তমান হুমকি। পিতৃতন্ত্রের অসুস্থ মানস প্রবণতাকে মুহুর্তে তছনছ করার ক্ষমতা রয়েছে এই নেতিবাচক শব্দটির। একই সঙ্গে তা ডেকে আনে হিংসা, আক্রমণ। পুরুষতন্ত্র এই নারীকে শায়েস্তা করে নিজের অহং তৃপ্ত করতে চায়, নিজের হীনমণ্যতা যার প্রতিফলন হয় উচ্চশ্মণ্যতায় তাতেও কবোষ্ণ তা দিয়ে লিঙ্গ বৈষম্যপূর্ণ সমাজে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতার ধার ঝালিয়ে নিতে চায়।

দৈনন্দিন ইচ্ছা, পছন্দ থেকে শুরু করে সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা, যৌণতা, সিদ্ধান্তগ্রহণ, পারিবারিক অর্থনীতি, সম্পত্তি বাটোয়ারা সর্বত্র নারীর মতামত অবহেলিত হয়। আরোপিত মত মেনে না নিলেই বাঁধে দ্বন্দ্ব। এই মেনে না নেওয়ার মধ্যে একটি অসীম শক্তির সম্ভবনা রয়েছে। 'না' এর মধ্যে রয়েছে লিঙ্গ বৈষম্যপূর্ণ সমাজে নারী পুরুষের পারস্পরিক সমীকরণের খোলনলচে বদলে দেবার ক্ষমতা এর মধ্যেই নিহিত আছে সমাজ রূপান্তরের বীজ। লিঙ্গ সাম্যের জন্য কনসেন্ট বা সম্মতির পাঠ নেওয়া জরুরি। নারীর 'না' কে, অসম্মতিকে মর্যাদা করতে শেখা জরুরি। ব্যক্তিগত পরিসরে তার অসম্মতি মানে অনুরোধ বা আদেশের পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা সম্মতিতে পরিণত হবে এই বিষাক্ত সংস্কৃতিকে সর্বাগ্রে বর্জন করা দরকার। সামাজিক চাপ তৈরি করে, ভয় দেখিয়ে, মানসিকভাবে হেনস্থা করে, নারীর অসম্মতিকে অগ্রাহ্য করে পুরুষতন্ত্র তার ক্ষমতা প্রদর্শন করে থাকে। নারীর 'না' বলাকে তৎক্ষনাৎ স্বীকার করা এবং অসম্মতি-সম্মতির স্বচ্ছ সিমানা নির্ধারণ করা জরুরি। ব্যক্তিগত পরিসরে নারীর 'না' মানে অসম্মতি। তার ভিন্ন কোনো কাব্যিক বা অতিরঞ্জিত অর্থ খোঁজার প্রয়োজন নেই। তাই মেয়েটি যখন বলল 'না'। তখন তার একমাত্র এবং কেবলমাত্র অর্থ হল-না। পূর্ণচ্ছেদ।









মধুপর্ণা কর্মকার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যা চর্চাকেন্দ্রে গবেষণা করেন। লিখেছেন - ' গার্লস হস্টেল ; আবাসিক নারীর মানসভূমি।'(২০১৮)


তাঁর ব্লগ লিঙ্কে প্রবেশ করুন

তাঁর লিঙ্কট্রি লিঙ্কে প্রবেশ করুন

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪