পুস্তক আলোচনা
পাঠ অভিজ্ঞতা
দু ' এক কণা শৈশব / দেবাশিস সাহা
'চিন্তা' প্রকাশন প্রকাশিত " দু' এক কনা শৈশব"।
কবি দেবাশিস সাহার আত্মজীবনীমূলক শৈশব স্মৃতিচারণার ফসল এটি।
বইটির প্রচ্ছদ অসাধারণ। হলুদ নীল কালো লাল রঙের সমাবেশে- অঙ্কনে শৈশবের হাসিকান্নার রূপময়তাকে শৈল্পিক দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। অয়ন চৌধুরীর অসংখ্য প্রশংসা প্রাপ্য।
মুদ্রণ বিন্যাস বোর্ডবাঁধাই সবকিছুই দৃষ্টিনন্দন।
বইটি পড়তে পড়তে চোখের সামনে শৈশবের রামধনু জেগে ওঠে। স্মৃতির আলপথ ধরে পৌঁছে দেয় ফেলে আসা শৈশবের বুকে। এটি একান্ত ভাবে কবি দেবাশিস সাহার শৈশবের স্মৃতিমেদুর আলেখ্য হলেও--ছেলেবেলার জলতরঙ্গ সুরেলা হয়ে বেজে ওঠে বইটির নিবিষ্ট পাঠকের মনে।
ঘুড়ি ওড়ানো, জোনাকি দিয়ে টর্চ বানানোর চেষ্টা এমনি আরো অনেক কিছু হয়ে উঠেছে শৈশব স্বপ্নের চিরকালীন গাথা।
বস্তুত: এ বইটি লেখার তাগিদ ও আন্তর প্রেরণাটি ব্যক্ত হয়েছে অনুপম ভাষায়--
" প্রায় অর্ধশতাব্দী হতে চলল, এদের আমি ছেড়ে এসেছি। দু-একজন ছাড়া এদের কারো সঙ্গে কখনো আর দেখা হয়নি। তারা সকলেই রয়ে গেছে সীমান্তের কাঁটাতারের ওপারে। কিন্তু আমার শৈশব-স্মৃতির মধ্যে কোথাও তো নেই ভারত-বাংলাদেশের কাঁটাতার, নেই পাসপোর্ট দেখানোর ঝকমারি।সেখানে আমি স্বাধীন সম্রাটের মতো বিচরণ করি। আমার শৈশবের খেলার
সাথীদের সঙ্গে মাঠে মাঠে ঘুরি, পুকুরে ঝাঁপকাটি, জল-জঙ্গল তোলপাড় করি, গাছে গাছে গাব, কামরাঙা, নাটা ফল কুড়োই। গ্রীষ্ম-শীত ছিঁড়েখুঁড়ে
গোল্লা ছুট, হা-ডু-ডু, বাতাবি লেবুর ফুটবল খেলি। সেই খেলারই একটুখানি ধারাবিবরণ আমি রেখে যেতে চাই এই লেখায়, জীবনের এই পড়ন্তবেলায়। "
লেখকের পরিবারের সদস্যদের কথা বেশ উজ্জ্বল রঙে অল্প কথায় ফুটে উঠেছে। বাবা মা বড়দা বড়দি ছোড়দি মেজদা ছোড়দা ছোটবোন পারিবারিক বৃত্তের এঁরা সকলেই তাঁর শৈশবকে ঘিরে আছেন। যাঁদের বাদ দিলে শৈশবের পরিধি ও পরিসর কখনোই সম্পূর্ণ হতে পারে না।
কেবল বড়দির ক্ষেত্রেই নয়, আমার মনে হয় আদ্যন্ত বইটি লিখতে গিয়ে লেখক তাঁর কলমকে গঙ্গা জলে ধুয়ে নিয়েছেন। কোন মালিন্যতা আজ পর্যন্ত লেখককে স্পর্শ করতে পারেনি। সর্বোপরি তাঁর পিতার ব্যক্তিত্বের নিষ্কলুষ বিভাময় আলো অলক্ষ্যে তাঁর জীবনের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। তবে পরিবারের বাইরেও বহু বন্ধু বান্ধবের সাহচর্য ভালোবাসা সহযোগিতার কথাও সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। তাই 'ডুব দিই স্মৃতির গহীনে' পরিচ্ছেদ থেকে প্রাসঙ্গিক কিছুটা অংশ পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি --
"
.....................
.কত বন্ধুবান্ধব, কত স্বজনপরিজন এ জীবননাট্যের অংশীদার হল। তাদের মধ্যে কিছু নাম
অনিবার্যভাবে গেঁথে গেছে মনে, .............
সেই নামগুলি আজও মনের আকাশে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করে।
অসীম, কিশোর, প্রদীপ, পঙ্কজ,অশোক, ধ্রুব, অমর, লক্ষ্মী, জাহানারা, মিলু, আন্না, মলিনা, চায়না--এইসব
নামগুলি কী যে মমতা নিয়ে আমার আত্মার কাছাকাছি বাস করে, তা কী করে বোঝাই! আমার মৃত্যু না হলে মৃত্যু হবে না এদেরও। "
এই বইটি লেখকের শৈশব স্মৃতিচারণা হলেও এলোমেলো -বিক্ষিপ্ত শৈশব স্মৃতির ফুলঝুরি হয়ে ওঠেনি, এক একটি পরিচ্ছেদের নিটোল বৃত্তে ঘটনা- চরিত্রের রেখাঙ্কনে সুখপাঠ্য কাহিনীর রূপ পেয়েছে। উত্তাল সত্তর দশকের মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাত, দেশভাগে বিপর্যস্ত মানুষের মর্মদাহ বেহালার করুণ সুরের মতো বেজে বেজে উঠেছে।
ডুব দিই স্মৃতির গহীনে, পুকুরঘাটে নারকেলশ্রেণি, পাথুরেঘাটার বিল, হোগলাডাঙার হাট,বড়শি-চোর মাছ --এই পরিচ্ছেদগুলি যেমন আছে তেমনি আছে শিক্ষাপর্ব নিয়ে সুবিন্যস্ত চারটি পরিচ্ছেদ।
সুধীরদার মেধা,যে-খেলা খেলেছি শৈশব নিংড়ে, নৌকাবাইচ, অনির্বাণ জ্যোৎস্নারাত,ঘোড়াদৌড়,শৈশব ছুঁয়েছিল যে গান।এই নামগুলি থেকেই বিষয়বস্তুর খানিকটা আভাস পাওয়া যায়। এগুলিতে যে শৈশবের দুরন্তপনা উচ্ছলতা কান্না অবিমিশ্র মাখানো আছে তার বলার অপেক্ষা রাখে না।
আবার বিদায়বেলা, শৈশব স্মৃতিচিহ্ন: ইতিহাসের পাতায়, কাঁটা তারে বিদ্ধ শৈশব, সীমান্তের মেঘ পেরিয়ে, চাঁদপাড়া : রে রাতটি এখনো ভোর হয় নি, কলকাতায় প্রথম পা, প্রয়ানলিপি-তে আশৈশবের বিচরণ ভূমি ছেড়ে আসার বেদনা জড়িয়ে আছে।
তবে, পিতার মৃত্যুর ঘটনা দিয়েই " দু'এক কনা শৈশব" শেষ হয়নি।এর পরেও একটি পরিচ্ছেদ-
'বাবা ও বাল্যবন্ধু' লেখক লিখেছেন যা গ্রন্থটিকে অনন্য করে তুলেছে। বাল্যবন্ধু অসীম বন্ধুত্বের এক উজ্জ্বল নিশান-
"...............
কী অমোঘ টানে, অসুস্থ শরীরে অসীম ছুটে এসেছে, পঁয়তাল্লিশ বছর পর, বাল্যবন্ধুকে শুধু একবার চোখের দেখা দেখতে। আমার কাছ থেকে ওর কিছু পাওয়ার নেই।আমি একজন সামান্য প্রাইভেট টিউটর। অসীম কোটি কোটি টাকার মালিক।
শৈশবের বাল্যবন্ধুর ভালোবাসার পরিমাপ করার কোনো স্কেল আমার নেই। "
জন্মভূমি শৈশবের গ্রাম হোগলাডাঙা -কে ফিরে পাবার আকুতি বারংবার গানের মূর্ছনার ধুয়ার মতো তরঙ্গিত হয়, আমরাও এর অমোঘ টান অনুভব না করে পারি না--
" জন্ম-মৃত্যু, দুঃখ-শোক, রোগভোগ, জ্বালা-যন্ত্রণা এসবের ঊর্ধ্বে যেতে গেলে ক'টা মানবজন্ম পেরোতে হয় আমি জানি না। যে-কটাই হোক, জন্ম যদি নিতেই
হয়, হে ঈশ্বর, তুমি আমার কল্পনার ঐশ্বর্য, আমার শৈশবের স্বর্গ, আমার বাল্যের লীলাভূমি হোগলাডাঙা গ্রামখানা আমাকে বারবার ফিরিয়ে দিয়ো। "
দেশভাগ ,উদ্বাস্তু শরণার্থীর যন্ত্রনার কথাও লেখক লিপিবদ্ধ করেছেন। এপার বাংলা ওপার বাংলা মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া। আপন খুশির ভেলায় ভেসে বেড়ানো আত্মভোলা শৈশব কখনোই এই কাঁটাতার বুঝতে চায় না, মানতেও চায় না... মায়াবী রঙ- লাগা আট -ন বছরের শিশুর চোখে এক অখণ্ডতারবোধ জেগে উঠে। আমাদের সভ্যতার মানবতার শেষ ভরসা সেটুকুই।
পরিশেষে গ্রন্থটির বহুল পাঠক প্রিয়তা কামনা করি।
-----শ্রীদাম কুমার
আমার 'দু-এক কণা শৈশব' বইটির খুব সুন্দর আলোচনা করেছেন শ্রীদাম কুমার। সাহিত্যের জায়গাগুলি শ্রীদাম সঠিকভাবে উন্মোচিত করেছেন। ওঁর কলমের জয় হোক। অসীম শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। লেখাটি পত্রিকায় ঠাঁই দেওয়ার জন্য অরন্ধন সম্পাদককে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন