তৃতীয় বর্ষ ।। চতুর্থ ওয়েব সংস্করণ ।। ২২ জৈষ্ঠ্য ১৪২৯ ।। ৬ জুন ২০২২





"লিংক" শব্দটা সাধারণ মানুষের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে। কখন কার দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন বিষয় থেকে "লিংক" সরে যাবে সেই আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ।
            ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়ে দেখা গেল "লিংক" নেই। বিপদে পড়ে টাকা তুলতে গিয়ে পাওয়া গেল না টাকা। কার কাছে হাত পাতবেন তাহলে? যার কাছে গচ্ছিত রাখা হয়েছে বিপদে-আপদে কাজে লাগবে বলে, সেই তো দিল না। অন্য কেউ কি দেবেন? যার দায় রয়েছে দেওয়ার, সে, "পরে আসবেন" বলে দিলেই খালাস। আর কোনো দায় নেই তার!
             রেশন দোকানে মাল তুলতে গিয়ে দেখা গেল পরিবারের এক বা একাধিক ব্যক্তির আধার লিংক সরে গিয়েছে। লিংক না করানো পর্যন্ত মাল পাবেন না তাঁরা। এও এক বিপদ! সারা মাসের মাল তুলতে না পারলে রেশনের চাল-ডালের উপর নির্ভর করে বাঁচা গরিব মানুষের বাঁচার উপায় থাকে না।
             ছাত্র-ছাত্রীরা বা চাকরি প্রার্থীরা কোনো সময় ফর্ম ফিলাপ করতে গিয়ে দেখা গেল, অর্ধেক ফিলাপ করতে না করতেই লিংক সরে গেল। অপরিপূর্ণ থেকে গেল ফর্ম ফিলাপ। আর কিছু করার থাকল না সেদিন। বাধ্য হয়েই শহর থেকে ফিরতে হলো বাড়ি। আবার নতুন করে বাড়ির কাজ ছেড়ে ফর্ম ফিলাপ করার জন্য শহরে ছুটতে হবে একদিন। 
             এইসব সমস্যাগুলো প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনভাবে আমাদের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অথচ সেই পরিষেবা নিখুঁতভাবে দেওয়ার জন্য সরকার বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আমাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে সুচতুরভাবে। ডিজিটাল পরিষেবার পরিণতি যদি এই দাঁড়ায়, কোনো না কোনভাবে মানুষকে হেনস্থা করা, তবে উচ্চমাত্রায় পরিষেবা কর দিয়ে কিসের ডিজিটালাইজেশন?



উত্তম মাহাত, সম্পাদক 


______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
বিশ্বম্ভর নারায়ণ দেব / মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া / সত্যম কুড়মি / জওয়াহের হোসেন / উৎপল চট্টোপাধ্যায় / মহিউদ্দিন সাইফ / শ্রীদাম কুমার / মতিয়ার রহমান / ব্রততী পরামাণিক / তপন পাত্র
______________________________________________



অক্ষয় তৃতীয়া

বিশ্বম্ভর নারায়ণ দেব


যতবার তালি দিয়ে ওড়াই
জুড়ে এসে বসে ফের
এ-গলি ও-গলি শরীরের।

খাদ্যে অখাদ্যে
ভনভনে মাছিটির মতো 
অন্তর্গত অন্ড থেকে ব্রহ্মাণ্ড চেটে খায়
মহাকালিক মুদ্রায়।

অতঃপর দেখি
এ দেহ তো কাব্যদেহই
ভাষার আধার
শরীরস্নেহে ধারণ করেছে
আমারই গ্ৰহণযোগ্য পদ্যসম্ভার।





মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়ার কবিতা

১.
কুয়ো

 
জংলি লতায় ছাওয়া খাঁ খাঁ করা বাড়ি
আলোর আড়াআড়ি
চমকে উঠে জীয়ন্ত তক্ষকের ডাকে
খোলসের অবসাদে ডুব দিলো ফের
বিড়ে পাকিয়ে নিলো শীত বিকেলের
দুধিয়া ফুলের ঝোপে জোড়া বাস্তুসাপ
ঘুরতে এসে শুকনো আর ফাঁপা লাগে গা-হাত
ওষুধে ওষুধে এত শাদা হয়ে থাকে রাত
ঘিলুর ভেতর শুনি চাপা গুঞ্জন
জংলাগা অসাড় মন
ডালপাতা চাপা দিয়ে রাখি  
পোড়ো ভিটের পেছনে ভাঙা কপিকলসমেত
শুকনো কুয়োর এই মাথা নিয়ে নেমে যাই
বিপজ্জনকভাবে
যেন হাওয়ার গিঁট বেঁধে প্রতিধ্বনি উঠে যাবে
মোমবাতি নেভার গন্ধ যেভাবে ঘোরে
দড়িবালতি নিয়ে মরা কুয়ো থেকে উঠে
ধাক্কা খাবে মাথার দেওয়ালে খুব জোরে
চমকে ওঠো তুমি এতো বেশি নীল
মনের অসুখের মতো গভীর আর ফাঁকা
এই অতর্কিতে পড়ে যেতে পারো ভেবে ভয় পাও
আমাকে জঙ্গলে রেখে ফিরে যাও একা…!

        

২.
হারমোনিয়াম


স্পর্শ স্বরের মতো ভাঙা ভাঙা আলোয়
আমাকে বাজায় রোগা গান মাস্টার
সবাই জানে ছন্দা ম্যাডামের বিয়ের দিন থেকে
গাইতে পারে না লোকটা
গলা দিয়ে ছাই আর রক্ত পড়ে
শুধু ঠোঁট নাড়ে স্বভাবদোষে
অভ্যেসে ভোর ভোর ঘুম ভেঙে বসে 
পিঁপড়েরা পছন্দ করে না অপচয়
চিনির দানার সাথে  মুখে করে তাই
বয়ে নেয় ভুলে ভরা সময়
পান খাওয়া লালের ভাঙা মেহফিল!
ম্যাডামের লিপস্টিকের মতো ছটফট করে বন্দিশ
কাহিনির সবটুকু বিষ
শুষে নিই শাদা কালো রিডে আর
আগুন ফলের মতো ফেটে যাই যেদিন
মেহগনিকাঠের বুকে হলকা দ্যাখে হস্টেলের মেয়েরা
ঝোলানো রশ্মির সাঁকো ধরে যেতে যেতে বলে 
লোকটা পারেও বাবা ফোয়ারার ধারে কাত হয়ে
এত তরঙ্গ চাঁদের নীলচে মোম মরা মৌমাছি
ফের ধুঁয়ো ওড়ে কোত্থেকে বলো?
গাইতে না পেরে খালি খালি মুখ নিচু করে থাকে 
ছাইয়ের স্তুপ হয়ে বসে থাকে ঠায়
ভাঙা পরী ফুঁপিয়ে ওঠে 
পাথরের জল ঢালে ঝলসানো গানের দুপায়..

                 





সময়ের জলছবি

সত্যম কুড়মি


মটরের ফুলের মতো বেগুনি চোখে
ভিজে যায়, সঁপে থাকে
ডাহুকের বাসার ভেতর পৌষের আলো
খড়ের জলের আভা, সবকিছু গন্ধে ছিলো 
 
পেঁপে ফুলের  সবুজে, রোদের ঠোঁট
আমি ভেবেছি ঘোলাটে পুকুরে
সব মিছে, সব ধোঁয়া পলাশের কাঠ
মহুলের বনে, ঘ্রাণে ঘুরেছি বেঘোরে

সময়ের আষাঢ়ে শ্রম ছিলো বলদের মতন
নবান্নের সাদা পায়ে শিমূলে আলতা
গহীনে পুটুস, পুরনো কলাইয়ের যতন
এক পায়ে জানালা আছে আমার বিষন্নতা

ভিনসারে অভিসার ছিলো টোপরের ছবি
রটনার মতোই স্বর্ণলতা, সব তোর্ ঈ
শ্যাওলার কিনারে নিরাপদী বোষ্টমী
চল, একলা সহজ প্রোটোপ্লাজম শ্রী 




জওয়াহের হোসেনের একগুচ্ছ কবিতা 


১.
আড়ষ্টতা
  

বন্ধ্যা-বৃষ্টিতে সেঁকে নিই সুরার আগুন

কতটা সিঁদুর-রাঙানো মুগ্ধতায় আক্রান্ত রাত্রিবাসে
কতটা বিষের দামে অঝোর জলে তোমার অভিসার

কতবার মনে রেখে ভাবি দ্বন্দ্ব ও ভয়!

কামনার আয়ুতে ঝুলে থাকে ত্রস্ত শয্যা

আরশে ঋণী হয়ে যায় প্রাপ্তির ফসিল




২.
কুয়াশাবিদ্যুৎ


কুয়াশায় যে-ঘোর জমে আছে দূর পথের আদলে
তা দিয়ে রচি ধাঁধার জগৎ
গন্তব্যে রাত্রিজাগা গুটিপোকাদের নির্জন খেলা
পুরো গ্রাম লুটিয়ে পড়েছে

বিদগ্ধ বিহারে—
জমি খুঁড়ে খুঁড়ে এঁকে নিচ্ছি অবসর

অনুভূতিহীন ভস্ম দিনকূলে

                                    আরও কবিতা পড়ুন







উৎপল চট্টোপাধ্যায়

১.
অপেক্ষা


অন্ধকার ভেঙে মেটে রোদ্দুর 
কিছু একটা জ্বলছে 
ধারে কাছে কেউ নেই 
ভর গরমে শুধু দুজন 
রেনকোটের ভেতর তাদের 
ক্লান্ত জবজবে শরীর 
কিছু একটা পুড়ছে 
চামড়া পোড়া গন্ধে বিভোর বাতাস 
আমি একটু এগোতেই 
দুটি চোখের ইশারা আমাকে ক্ষান্ত করল 
একজনের স্পষ্ট উচ্চারন......দূ.....রে 
পরিচয়হীন অস্পৃশ্য লাশের 
মাথা ভাঙছে 
শরীর চুঁইয়ে জল 
বিষন্ন বিভ্রমে ক্লান্তির ছোপ দাগ 
মিলিয়ে যাচ্ছে শিরা ধমনী আর বলিরেখা 
এভাবে শান্ত আগুন, গণ আহুতি 
বিকেলের ছাই ঢেলে নিঃস্ব বাতাসের শব্দে 
আবার সেই চেনা ছন্দ.....কলতান 
আরও আসছে..........আরও আসবে 
এখন অপেক্ষা শুধু তোমার আমার ....


২.
বিষ


অন্ধকার বুকে জেগে উঠলো 
আরও একটি অন্ধকার । 
বাসস্টপে উসখুস ছায়ায় ভেতর 
চোখের আলো আর পুরাতন গন্ধ । 
হাজার মৃতের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বয়স । 
রৌদ্রের চিৎকারে রূপ থেকে রূপান্তর , 
ভাঙা রিক্সার পাটাতন পেরিয়ে এবার 
একাদশী মাঠ । 
প্রাচীন মাটির বুকে চোখ পড়লে 
জন্মান্ধ-এর খাবারে আমি 
     বিষ মিশিয়েছি এখন ।।।।।






মহিউদ্দিন সাইফের কবিতা  

১.
বৃষ্টি হল


আজ বৃষ্টি হল, অনেক দিন পর। বৃষ্টি হলেই আনন্দ। জীবনের রস দিয়ে যায়। বিবিধ রঙ ফুটে ওঠে গভীর একাগ্রতায়। এই সন্ধ্যেবেলা পাখিরা ঘরে এল। আমার জানালার কাছে চার-পাঁচঘর ছাতারে থাকে। আর থাকে বুলবুলি, টুনটুনি, শ্যামা, ফিঙে। পাগল কোকিলার দিন কাটে ডেকেডেকে। তার ডাক শুনতে শুনতে আমিও সমর্পিত হয়ে যাই।
এখন আর কেউ ডাকেনি। মেঘ অনেক দূরে। এই অরব সংহতির কাছে বসে আছি অনাশ্রয়ী। ভালবাসার কথা ভাবছি। ভাবছি অস্পষ্ট মুখের রেখা। সবুজ পাতার চিকনে কত যে মিনতি। আমার অন্তর করুণ হয়ে উঠছে। বিনত মনে একটি শিশুর কল্পনা আসে। তার সুরভিত মুখগন্ধে কতদিন যে পাগল ছিলাম। আজ এমন সম্ভাবনাময় নিরালায় প্রসন্ন রাত্রিকে আবাহন করব ভাবছি। ওই গাছ স্বাগতা হবে, আমার রক্তিম মর্মের গোলাপে সঞ্চারিত আলো। ওই গাছ বিভাবরী।



২.
গুডু কোড়ার পুত্রবধূ


ঘাসের আড়াল সরে। যেন অরচনার বিস্মিত প্রান্তর। গুডু কোড়ার গলাফোলা বউ ভাদরের দুফরে নিড়েন দিচ্ছে আজিজুলের ক্ষেতে। সঙ্গে পুত্রবধূটি, উন্মন ধ্বনির প্রতিমা। কুহুকুহু গায়ের নীলিমা, উত্তাল, আত্মময় ও নিশ্চিত। হঠাৎ খুলে গিয়ে নিল বিশাল সারসের রূপ। নির্মোহ অন্তহীন দুই ডানা, চঞ্চু ঋজু নিশীথিনী। উড়ে-উড়ে-উড়ে গেল সাদা আকাশের কাছে। সাদা সূর্যকে খুবলে খেল, আকন্দের মতো ঝাঁকঝাঁক তারা। সেসব খেয়ে অনিবার্য দুটি চোখ চেয়ে আছে আরও কোথাও। উপরে না নীচে! বোঝা ঠিক গেল না এখনো।







ছিপ ফেলেছ

শ্রীদাম কুমার


ছিপ ফেলেছো 
নামামৃত লোভে.....

ফাতনা ডোবে ওঠে  
রকমারি গন্ধবিধুর মীনেরা আসে  
ঘোরাফেরা করে
পুচ্ছ নাচিয়ে কেতন ওড়ায়।

সাধ্য কি, যায় অন্য কোথাও..

টানছো কী অদৃশ্য সুতোয়?

বাঁকানো কাঁটায় রক্তঝরা মুখ,
গোলকধাঁধায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
খাবি খাওয়াও আবর্তে তোমার 
 
তোমার দর্পিত সুখ 
ফেলে দেয় আমাদের
                         খাদের কিনারে।






মতিয়ার রহমানের কবিতা

১.
সাহস


স্বপ্ন দেখতে কি সাহস লাগে
তবু সর্বদা ভয় আমার
রাত বাড়লে এসে দাঁড়াও
চৌকাঠের ওপার।

ভোর পর্যন্ত সাথে থাকো
মুখোমুখি পাশাপাশি
বলতে তবু পারলাম কই
তোমায় আমি ভালোবাসি।



২.
কষ্ট


গভীর রাতে
মায়ের কাছে
আঁচল পেতে শোওয়া।

বৃদ্ধাশ্রমের চিতায় তুলে
সন্তান সেও হস্টেলে
সার হয়েছে বউয়ের বকুনি খাওয়া।

                                     আরও কবিতা পড়ুন









নির্ঘুম রাত্রি

ব্রততী পরামাণিক



রাত্রে ঘুম আসে না- 
শৈশব থেকে বর্তমানের ধারাস্রোত
বয়ে যায় মস্তিস্কের রন্ধ্রে, 
হৃদয়ের সঞ্চিত খাতা খুলে 
শুধু ভুলের হিসাব-নিকাশ 
মাসুলের পাল্লা এত ভারি 
বইতে গিয়ে ক্ষত ঘা-
নির্ঘুমে ব্যর্থতার কড়ি গোনা।






রহস্যময় ধাঁদা


                   তপন পাত্র

           " তোমার সাথে কোনদিন কোন অন্ধকারে আমার দেখা হল না বলে মুখ ফুটে তোমাকে বলতে পারলাম না আমার অন্তরের কথা । ফলে এ জীবনে প্রেমের দোলনায় দোলা হলো না আমাদের। " চোখ ঝলসে যাওয়া সুস্পষ্ট দিবালোকে সব সময় সব কথা বলা যায় না । যেমন কথা, তা বলার তেমন পরিবেশ চাই তো ‌। তাই  ঝরো ঝরো মুখর বাদল  যেদিন আঁধার হয়ে গেছে চারিধার সেদিন কবি বললেন,  "এমন দিনে তারে বলা যায় , এমন ঘনঘোর বরিষায় ,এমন  দিনে মন খোলা যায়... তপনহীন ঘন তমসায়..." কাকে, কী বলা যায়-- তা তো আমরা সকলেই বুঝতে পারছি । এ তো  মানব মানবীর যুগ-যুগান্তরের চিরন্তন লীলার শাশ্বত রহস্য ।


                       রহস্য সৃষ্টির জন্য একটু আঁধার, একটু অস্পষ্টতা, বলা ভালো একটু আঁধার ও একটু আলো; এক কথায় একটা আলো-আঁধারি পরিবেশ বড়ো প্রয়োজন, তাই তো বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মাবলম্বী চর্যাপদের সাধক কবিরা গুহ‍্য সাধনতত্ত্বের কথা বলার জন্য বেছে নিয়েছিলেন "আলো-আঁধারি", "সান্ধ্য ভাষা" । একটা তাৎক্ষণিক রহস্য সৃষ্টি করা, সকলকে খুব সহজেই বুঝতে না দেওয়াই তার উদ্দেশ্য । এই তাৎক্ষণিক রহস্য  শুধু চোখ নয় , আমাদের মনকে আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে ধাঁধিয়ে দেয় । আলোর অধিক উজ্জ্বলতা ধাঁদিয়ে দেয় চোখকে আর শব্দ বা বাক্যের অস্পষ্ট অন্ধকার ধাঁধিয়ে দেয় মনকে । এই তাৎক্ষণিক রহস্য থেকেই জন্ম ধাঁধার । মানভূমবাসী "ধাঁধা"কে বলেন "ধাঁদা" । কারণ এখানে শব্দ উচ্চারণের খুবই সাধারণ একটা প্রবণতা অল্পপ্রাণকে মহাপ্রাণ এবং মহাপ্রাণকে অল্পপ্রাণে উচ্চারণ । 
                       তবে এখানে "ধাঁধা" "ধাঁদা" বলে যতো না পরিচিত, তার চেয়ে অধিক পরিচিত "রা'ত ক'হ্ নি" বলে । এর রহস্যটা এটাই, ওই যে বললাম রহস্য সৃজনের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ কিঞ্চিৎ অস্পষ্টতা । আমরা তো দেখেছি, যাদুকরেরা বেশ কিছু না কিছু একটা ঘনঘটা তৈরি করে রহস্য জমিয়ে তোলার পরিবেশ রচনা করেন । তেমনি ধাঁধা সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ গ্রামীণ, পল্লী প্রকৃতিতে অন্ধকার রাত্রির বাতাবরণ । রাত্রে ধাঁধা যেমন জমে ওঠে দিনের স্পষ্ট আলোতে ততোটা আনন্দ মুখর হয়ে ওঠে না । তাই রা'তের কহ্ নি "রা'তকহ্ নি"।
                 একটি শ্যামাসঙ্গীতের চরণ " শত নামে কত জনে ডাকে যে তোমায় দাও মা সাড়া..." এই ধাঁধার ক্ষেত্রেও যেন কথাটি সত্য ।  কত নামেই যে ধাঁধাকে নামাঙ্কিত করা হয় তার ইয়ত্তা নেই , কিন্তু বোঝায় সেই একটি বিশেষ বিষয়কেই ।
                 "ধাঁধা" বললে অনেকেরই "ধাঁদা" লেগে যায়, কারণ তারা জানেন না "হেঁয়ালি"-ই ধাঁধা । আবার কেউ বলেন "ভাঙ্গানি", কেউ বলেন "কহ্ নি" কেউবা বলেন "শ্লোক" বা "শোলোক"। শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই ধাঁধার প্রচলন ছিল এবং আজও রয়ে গেছে । ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে এর বিভিন্ন নাম । যেমন - চিলতা  ঢক, ঢপ, কিচ্ছা, জান কহনী ইত্যাদি । গ্রীক ভাষায় Anieo , ইংরেজিতে Riddle বা Puzzle , ফরাসীতে Enigma -- এরকম নানা দেশে নানা নামে ধাঁধার প্রচলন রয়েছে । জগৎ জুড়ে ধাঁধার অষ্টোত্তর শতনাম । তবে কোন্ দেশে, কোন্ যুগে যে প্রথম ধাঁধার সৃষ্টি, সে কথা কিছুতেই বলা সম্ভবপর নয়। ধাঁধার নানান দিক বিশ্লেষণ করে একথা আন্দাজ করা যায় যে এটি মনে হয় প্রাচীনতম সাহিত্যিক সৃষ্টি অথবা ছড়ার সমসাময়িক সৃষ্টি ।


                        বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও যেমন ধাঁধার প্রচলন রয়েছে তেমনি মানভূম-পুরুলিয়ার কথ্য শব্দ প্রয়োগের মধ্য দিয়েও যুগ-যুগান্তর কাল ধরে বিভিন্ন ধরনের ধাঁধা চলে আসছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ধাঁধা লোকশিক্ষার অন্যতম বিশিষ্ট বাহন । ধাঁধার মধ্যে যে বক্রোক্তি ও রূপক অলংকার সৃষ্টির পরিকল্পনা তা লোক সমাজের কবি প্রতিভার দিকটিকে চিহ্নিত করে, আমরা বিস্মিত হই । ধাঁদা র ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তা ও মননশীলতা লক্ষণীয়, এতে লোকগান, লোকসাহিত‍্যের মতো আবেগানুভূতির প্রকাশ নেই । শব্দ প্রয়োগে কোনরকম বাহুল্য নেই ।   সমাজ-সংসারের যাঁরা "পাকা মাথা" বলে বিবেচিত অর্থাৎ যাঁরা জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যৌবন ও প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে বার্ধক্যে গিয়ে পৌঁছেছেন, হয়তো একদিন তাঁরাই জীবনের নানান অভিজ্ঞতাকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে চারিয়ে দেওয়ার জন্য ইতিহাসের ধারায় এগুলির সৃষ্টি করেছিলেন । তারপর সেগুলি শতাব্দীর পর শতাব্দী সমভাবে প্রবহমান । কিন্তু বর্তমান কাল যেহেতু লোক শিক্ষার কাল নয়, তাই লোকশিক্ষার অন্যান্য উপাদানের মতো ধাঁধাও আমাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে । হারিয়ে যাবে ।


                      মানভূম-পুরুলিয়ায় প্রচলিত ধাঁধাগুলিকে ব্যাকরণসম্মতভাবে "লোকধাঁদা" বলা যাবে কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন চিহ্ন হাজির হতেই পারে । কারণ কোন এলাকার কোন ধাঁধাই সমষ্টির সৃজন নয় । এটি ব‍্যষ্টিসৃষ্ট । কিন্তু কার সৃষ্ট সে তো আর কোথাও লেখা নেই । মানুষের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে কিছু কিছু শব্দ হয়তো বদলে গেছে, সে দিক থেকে এই সকল ধাঁধার পূর্বে "লোক" বিশেষণটি যুক্ত করা যেতেই পারে । সে ব‍্যষ্টির হোক, আর সমষ্টির হোক , সেই সুদূর প্রাচীনকালে  স্রষ্টাদের মধ্যে আলংকারিক বাক্য গঠনের প্রবণতা আমাদের বিস্মিত করে। রূপকের অন্তরালে যে অলংকার বিজড়িত বাক্য বা দু'চার চরণের ছোট ছোট ছড়াগুলি সৃষ্টি হয়েছিল ,সেই পথ ধরেই হয়তো একদিন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে জন্ম নিয়েছিল চর্যাপদ, বাউল তত্ত্ব, বাউল গান। চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের লিখিত প্রাচীনতম নিদর্শন হলেও ধাঁধাকে আমার তার চাইতেও প্রাচীন অলিখিত সাহিত্যিক সম্পদ বলে মনে হয় । মানুষের মুখে যেদিন ভাষা গজিয়েছে   , মানুষ সংঘবদ্ধভাবে বা দলগতভাবে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়েছে তখন থেকেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশে একের পর এক জন্ম নিয়েছে নানান ধরনের ধাঁধা । তাই ধাঁধার বিষয় হয়ে উঠেছে বৃক্ষ, ফল, ফুল, নদী-নালা, গার্হস্থ্য জীবন, গণিত, তত্ত্ব , প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য, বিভিন্ন ধরনের মানুষের আচার-আচরণ, হাস্যকৌতুক আনন্দ-বিনোদন, কাহিনী ও চিত্রকল্প । একে একে এই সমস্ত শ্রেণীর ধাঁধা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনাই বর্তমান প্রবন্ধের  উদ্দেশ্য ।

                      ( পরবর্তী অংশ পরের সংখ‍্যায় )


                    আমাদের বই












সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
অলঙ্করণের চিত্রশিল্প - সমীর আইচ  
প্রবন্ধের ছবি - তপন পাত্র
ইমেইল - uttamklp@gmail.com



মন্তব্যসমূহ

  1. সত্যম কুড়মির কবিতা নতুন পাওয়া আমাদের কাছে।
    তপনবাবুর নিত্যনতুন বিষয় নিয়ে দারুণ সব লেখা..দারুণ পাওনা।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪