তৃতীয় বর্ষ ।। নবম ওয়েব সংস্করণ ।। ২৯ শ্রাবন ১৪২৯ ।। ১৫ আগষ্ট ২০২২
স্বাধীনতার ৭৫ বছর হয়ে গেল। প্রকৃত স্বাধীনতা কি পেলাম? পেরেছি স্বাধীনভাবে পথ চলতে? এখনও ভয়ে ভয়ে পথ চলা আমাদের। প্রতিটা মুহূর্তে ভাবতে থাকা কোথায় অনৈতিকভাবে কে কি দাবি করে বসবে। বেসরকারি তো দূরের কথা, কোনো সরকারি অফিসে স্বাধীনভাবে কোনো কাজ করিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখি না আমরা। জমিদার প্রথার বিলোপ ঘটলেও মন্ত্রী থেকে আমলা, সরকারি অফিসের ডি গ্ৰুপ থেকে সি গ্ৰুপ সকলেই সাধারণ মানুষের উপর জমিদারি চালিয়ে যাচ্ছে। কলুর বলদ হয়ে এখনও ঘুরে চলেছি আমরা। এখনও বাইক নিয়ে রাস্তায় বেরোলে ভাবি, সব কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও চা নাস্তার টাকা দিতে হবে না তো কাউকে?
সরকারি পদগুলো অনৈতিক টাকা এবং দাবি আদায়ের ছাড়পত্র হয়ে উঠেছে। হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের বাস্তব দাবি এবং পাওনাকে অস্বীকার করার সুরক্ষা বলয়। যে বলয়ে থাকলে সাধারণ মানুষের উপর কোনো না কোনোভাবে জ্বালাতন করা যায়। কাজে ফাঁকি মেরেও পাই টু পাই বেতন পাওয়া যায় মাসের শেষে। আর বাড়তি রোজগারের কথা বলে কে ?
এই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম আমরা? একেই কি স্বাধীনতা বলে? দালালি করা বুড়ো ভামের ঘরে ট্রাক ট্রাক টাকা আর সারাদিন শ্রম দেওয়া মাটির মানুষ বলরাম সিং, মাহাত বা সহিসের ঘরে অসুস্থ শিশু সন্তানকে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বাসে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য সামান্য ভাড়া দেওয়ার টাকা নেই?
আমরা ৭৫ এ এসেছি কিন্তু পার হতে পারিনি ৫ কে। আমরা এখনও পঞ্চবানে জর্জরিত।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
নির্মল হালদার / দুর্গা দত্ত / সত্যম কুড়মি / অয়ন জোয়ারদার / সুজন পণ্ডা / স্রোতস্বিনী চট্টোপাধ্যায় / কল্পোত্তম / তপন পাত্র / উমা বন্দ্যোপাধ্যায়
______________________________________________
হরিতকী গর্ভের আলোয়
নির্মল হালদার
দোকানি
১:
কে যে দোকানি কে যে দোকানি নয়
সময় নেই আর চেনাচিনির
ধার বা নগদে নয়, দরদারও করবো না
কাছে দাঁড়াবো
যদি প্রশ্ন করে, কী চাও হে?
গামছা পাতবো
চাল না দিলেও যদি একবিন্দু নুন পাই
বেলা তো হলো, নুন চেটে চেটে খাবো।
২:
কই হে দোকানি কেমন আছো?
বাজারের হালচাল যেমনই হোক
তুমিতো কৃপা দৃষ্টি দেবে?
দোকানদারও কখনো কখনো কৃপানাথ
দু দানা মুসুরি ওজনে বেশি দিয়েও
কথা বলে না।
এই যে না--কথার রূপ ভালবাসতে ইচ্ছে করে।
ভয়ও করে।
শ্বাস
দুর্গা দত্ত
বৃক্ষের দেবতা তুমি শোনো
পথের দেবতা তুমি শোনো
শস্যের দেবতা তুমি শোনো
নদীনালা খালবিল ডাঙা ডহর টাঁড় বাইদ
ঝোপঝাড় লতাগুল্ম ধুলোবালি গোষ্পদের পোকামাকড়ের সব দেবতারা
তোমরা সব শোনো :--
কাকে বলে বেঁচে থাকা তার থেকে
এতটা যোজন দূরে
কেন পাড় ভাঙে মৌন তট ?
রাতের সমস্ত মূঢ় শব্দের ছায়ারা
বেঁচে থাকা কাকে বলে কিছুই কি জানে ?
হরিণের ছায়া দেখে দিনরাত বাঁচে কেন
জানে শীর্ণ নীল স্বচ্ছতোয়া ?
কাকে বলে বেঁচে থাকা
জানে প্রত্ন বালি আর জল ?
কে কী বোঝে ,ভাবে ,জানে ,
গুনগুনিয়ে সুর তোলে সাবলীল,
হাওয়ায় ঘুমোয় ভোররাতে
ঠিকমতো কেউই জানেনা, শুধু
সমুদ্র দেবতা তুমি
প্রতিটি বিন্দুতে তুমি মনে প্রাণে
ঠিক ঠিক জানো
কোথায় কীভাবে কারা বাঁচে
প্রতিটি বুদবুদে কেন অস্থায়ী জন্মের মুখরেখা
সঞ্চারীর উপক্রমণিকা --
কাকে বলে বেঁচে থাকা
তোমার ওই ধর্ম অনুসারে
একমাত্র জানে সেই ফেনার নূপুর ...
মোহনা
সত্যম কুড়মি
অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই
অক্সাইড... ভূতে চক্রে ভগবান।
তারপর জল প্রোটোপ্লাজম দুই
মিলে জীবন।
আমার হাতে কোনোটাই নেই।
আমি পরিব্রাজক।
তারাখসার মতো শালুক।
হাঁটছি।
মাধুকরি সংগোপনে জড়ো করছি।
পাথার ঢেউ,
মিছে হইচই।
রাস্তা না পেলে
বহতা অনুকূলে
মোহনায় মেশার নেশায়, আশায়
ক্রমশ মহুলের মতো ঋতুযাপন।
চলন গমন রেচন জনন।
হায়! এ জীবন ধায়।
এপিটাফ - ৩
অয়ন জোয়ারদার
আমার পারলৌকিক ক্রিয়াদি হচ্ছে?
সেকি! এসব তো মানত না কেউ!
বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায়? সাধনাচিত ধামে যাত্রার জন্য?
কি আশ্চর্য! আত্মা এত সহজে জড়িয়ে থাকা এ আবর্তন ছেড়ে চলে যাবে।
যতদিন মনে থাকে ততদিন তাড়িয়ে দিও না।
প্রতি শ্রাদ্ধে কেউ কাঁদে না। তাও একটা বছর যেতে দাও!
স্মরণ সভা টভা ক'র না, ওতে সবাই খুব মিথ্যে বলে।
আমার বাল্যকাল, কৈশোর কাল, যুবক বৃত্ত মনে করে, যদি কিছু যন্ত্রণা দিতে পারো নিজেকে,
তবে এ আত্মা শান্তি পায়।
অতৃপ্তি তো একটা ছিল না!
নির্মল এক আলো
সুজন পণ্ডা
শেষ রাতে, সব ভিড় সরে যায়।
নির্মল আলো শুধু...
হাতের তালুর মত জমি,
অজস্র বলি রেখা,
অজস্র অস্ফুট শ্বাস।
যে পথে হেঁটে গেছো
ছাড়া আছে পায়ের ছাপ আর
ধুলোয় মোড়া আশীর্বাদ।
জমিতে ছড়ানো দেহের বীজ।
একটি একটি কবিতা
একটি একটি অঙ্কুর।
আমি দেখি অফুরন সম্ভাবনা
শিশুর হাসির মতো
ছায়ার মতো লেগে আছে।
বয়স শুধু বিভ্রম।
আমি দেখি এক ধ্রুব তারা,
হাত ধরে অক্ষর চেনা,
এই সময় আরো জড়িয়ে থাকার
উষ্ণতা ভাগ করে নেওয়ার।
আমি দেখি চাঁদের হলুদ
ধানের খেতে.... শস্য দুধের স্বাদ।
স্রোতস্বিনী চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
১.
প্রপঞ্চময়
সে সুর যেন দিনের শেষে
আলতো শোনা যায় ,
গড়িয়ে নামে চাঁদের ছায়া
নীলাভ সন্ধ্যায়
উছলে ওঠে জ্যোৎস্না ভেজা
অপার্থিব জল ,
জলের কালো চাদর মোড়া
সিক্ত চলাচল ,
তবুও চোরা হাওয়ার টানে
অলীক খেয়াপথ ,
তন্দ্রামাখা রাতের শেষে
কোমল দ্বৈরথ
ভাসিয়ে নেয় পলকা ছবি ,
সকল ভেসে যায়...
তারার আলো আবছায়ায়
মেঘের গায় গায়
২.
স্থানু
অদ্ভুত অসাড় জেগে আছি ,
চোখ বন্ধ হয়ে আসে প্রায়,
দূর থেকে ভেসে আসা ধূসর প্রলাপ
ধোঁয়ার মতোন ভেসে যায়
আচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যে ভাবি,
ছুটি পেলে আমিও কি যেতে পারি
পুরুলিয়া অথবা বরাক!
আষাঢ়ের সন্ধেবেলা , স্টেশন চত্তরে
বিদেশি অতিথি দেখে
ভীতু স্বরে ডেকে ওঠে কাক...
আলংকারিক - ২
কল্পোত্তম
স্বর্ণরেখা নদী জানে কোথায় সোনার খনি, কোথায় সোনার রেণু মিশে যায় প্রবাহে প্রবাহে। সমুদ্র স্রোত জানে কোথায় লুকোনো আছে রত্নরাশি পললের নিচে।
তোমাকে জানতে হবে তাদের কৌশল, তাদের নীরব সেই ভাষা সোনা আর রত্ন সন্ধানে। হাঁটতে হবে প্রবাহে প্রবাহে প্রতিদিন, সরীসৃপ হেঁটে যায় বুক রেখে মাটির উপর যেভাবে নীরবে।
বিগলিত হয় মাটি, স্বর্ণ-তাল, রত্ন জমে বুকের উত্তাপে, কেলাস আকারে। মেঘখন্ড হতে, যেভাবে বৃষ্টি জমে ভিজে যায় চাতকের ঠোঁট, সেভাবেই ঠোঁট ভেজে আমাদের, গলে পড়া শ্বেত রক্তে ভিজে ওঠে গোপন আস্তানা চাঁদের আলোয় আলাপে আলাপে। স্বর্ণরেখা নদী জানে কোথায় সোনার সাথে মানুষের গোপন বন্ধন।
শ্রাবণে রেঁধে ভাদরে খাওয়া
তপন পাত্র
"পূজা" মানে "আরাধনা", "অর্চনা", " উপাসনা", "শ্রদ্ধা জ্ঞাপন"। পূজা আসে "শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভক্তি" থেকে । তবে ভয় থেকেও যে ভক্তি আসে এবং সেভাবেও পূজার প্রচলন হয় সে কথা সম্পূর্ণ খাটে মনসা পূজার ক্ষেত্রে । "রূপে ভক্তি , গুণে শক্তি" --এ কথা সত্য হলেও "ভয়ে ভক্তি" --এই মূল্যায়ন মনসা পূজা বা সর্প পূজার ক্ষেত্রে সবিশেষ প্রযোজ্য । গ্রামেগঞ্জে লোকসমাজে মাঝেমাঝেই একটি কথা শোনা যায় কলিযুগের "জীয়ন্ত দেওতা" (জীবন্ত দেবতা) মা মনসা । কথাটি মনে হয় মনসা দেবীর বাহন সর্পের ভয়ংকারিতার কারণেই এসে গেছে । প্রকৃতির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানো ছোট্ট শ্রীমন্ডিত এই জীবটি ভারতবর্ষের প্রায় সকল প্রদেশের মানুষকে ভয় দেখিয়ে , আতঙ্কে রেখে , শোকাচ্ছন্ন করে তার দেবীর এবং নিজের পূজা আদায় করে নিয়েছে , নিচ্ছে । মনসা পূজা এবং পূজা উপলক্ষে বলিদান থেকে একটা বিশেষ শিক্ষা পাওয়া যায় বলেই আমার মনে হয় । এখান থেকে আমাদের অগণতান্ত্রিক এবং অসম রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার একটা ইঙ্গিতও মেলে । বাগদেবী সরস্বতীর বাহন হংস একটি নিরীহ , শান্ত-সৌম্য , অহিংস পক্ষীবিশেষ । মনসা পূজায় দিকে দিকে লক্ষ লক্ষ সেই নিরীহ প্রকৃতির অসহায় প্রাণীটিকে বলিদান দেওয়া হয় । এর মধ্য দিয়ে দুর্বলের প্রতি সবলের পরাক্রমের একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় । কারণ মনসা পূজায় হংস বলি হলেও কই সরস্বতী পূজায় তো মা মনসার বাহন সর্পকে বলি দেওয়া হয় না ! বিষয়টি উত্থাপনের কারণ কোন প্রাণী বলির পক্ষেই সওয়াল করা নয় ; শক্তিমান ভয়ংকরের প্রতি না , দুর্বলের প্রতি আক্রমণই আমাদের সমাজে প্রচলিত , ঘটনাটি সেই বিষয়টিকেই ইঙ্গিত করে, এ কথা তুলে ধরা ।
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চল ঝোপ-ঝাড়, বন-ডুংরী-পাথর আবৃত অঞ্চল । সাপের প্রকোপ এখানে কম নয় । বিশেষ করে বর্ষাকালের দিকে প্রায় প্রতিদিনই নানা প্রজাতির সাপ ঘরের পাঁচিলে, উঠোনে, সবজি বাড়িতে, ক্ষেতে-খামারে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় । অনবধানতাবশত তার শরীরে কোন প্রকার আঘাত লাগলেই ছোবল মারে । প্রতিবছর বহু মানুষ প্রাণ হারায় এই কাল সাপের আকস্মিক এক-একটি দংশনে । সরাসরি লড়াইয়ের কোন প্রশ্ন নেই , আচম্বিতে বজ্রপাতের মতো এক ফোঁটা বিষ মানুষের শরীরে ঢেলে দিলেই সারা শরীর নীল হয়ে যায়। প্রাণ চলে যায় অদৃশ্যলোকে আর সর্পটিরও অন্তর্ধান ঘটে দৃষ্টির অগোচরে । এহেন উপায়হীন করুণ মুহূর্তে সর্পসম্রাজ্ঞী মনসাকে স্মরণ করা ছাড়া মানুষের গত্যন্তর থাকে না ।
যতদূর জানা যায় ভারতবর্ষের অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদিম মানুষ প্রথম সর্প পূজার প্রচলন করেন । দেশের সকল প্রদেশে তা আজও চলে আসছে । অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীরা সর্প পূজা করেন নি কিন্তু "সর্পটোটেম"-এর অস্তিত্ব সেখানেও বিদ্যমান । "টোটেম" একটি ইংরেজী শব্দ , যার অর্থ হলো বা যে শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় --" স্বাভাবিক স্বভাবে উৎপন্ন কোন বস্তু বা পশু যার মধ্যে আধ্যাত্মিক অর্থ আছে মনে করে তাকে প্রতীক বলে ধরে নেওয়া হয় , "কুলপ্রতীক" রূপে কল্পনা করা হয়" । এই কল্পনার অস্তিত্ব সেখানে আছে । আফ্রিকার সর্বত্রই সর্পদেবতার কথা আছে ।
মানভূম-পুরুলিয়ার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ১৩ই জ্যৈষ্ঠ রোহিনীর দিন থেকে শুরু করে আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি তথা জিহুড় দিন পর্যন্ত বিভিন্ন তিথিতে মা মনসার পূজা হয়। তার মধ্যে শ্রাবণ সংক্রান্তির পূজা সর্বাধিক জাঁকজমক পূর্ণ। সংক্রান্তির আগের সপ্তাহেও মা মনসার পূজা হয়। এটি যদিও নিতান্তই অনাড়ম্বরভাবে কৃষক পরিবারগুলিতে উদযাপিত হয়। আষাঢ় শ্রাবণে ভালো বৃষ্টি হলে শ্রাবণ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সাধারণত ধান লাগানোর কাজ শেষ হয়ে যায়। মাসের শেষ সপ্তাহ অর্থাৎ চতুর্থ সপ্তাহে মানভূম পুরুলিয়া কৃষক পরিবারে "খইঢেরা" নামে একটি পারিবারিক উৎসব উদযাপিত হয়। সাধারণত শনি ও মঙ্গলবার এর মধ্যে কোন একটি দিন নির্বাচন করে নেয় পরিবারগুলি। চাষের কাজ শেষ হয়েছে সেই আনন্দে একটা দিন দিনের বেলা ভাত তরি তরকারি না খেয়ে দই চিঁড়ে গুড় খই মুড়ি ঘুগনির উৎসব। পরিবারের সদস্যরা নিজেরা যেমন আয়েশ করে সেদিন সারাদিন এইসব খাদ্য গ্রহণ করেন, তেমনি আত্মীয়-স্বজন কুটুম্ব বন্ধুবান্ধবদের নিমন্ত্রণ করে এসব দিয়েই ভুরিভোজের ব্যবস্থা করেন। অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে একটি ভোজ কর্মের ব্যবস্থা করতে গেলে তা যতোখানি ব্যয়বহুল এই উৎসব ততখানি ব্যয়বহুল নয়, কিন্তু এতে কোন আন্তরিকতার ঘাটতি থাকে না তাই এই উৎসব হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত, জীবন্ত ও আনন্দঘন। সারাদিন চিঁড়ে মুড়ি খই দই খাবার পর রাত্রিবেলা পান্তা ভাতের আয়োজন।
শনি কিংবা মঙ্গলবার যেদিন এই খইঢেরা উৎসব উদযাপিত হয় তার আগের দিন সন্ধ্যেবেলা বাড়ির মহিলারা স্নান করে শুদ্ধবস্ত্র পরিধান করে ভাত ও বিভিন্ন ধরনের সবজি রান্না করেন। তারপর ভাত ঠান্ডা হলে তাতে জল মিশিয়ে ভাতের হাড়ি ও তরকারি পত্রের পাত্র শুদ্ধাচারে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হয়। খইঢেরার দিন রাত্রিবেলা গৃহের কর্তা বাদ দিয়ে প্রত্যেকেই সেই বাঁসি ভাত ও সবজি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। যে পরিবারের গৃহকর্তা বাঁসি ভাত খেতে চান, সেই পরিবারের অন্য একজনকে রাত্রিবেলা অন্ন সেবা থেকে বিরত থাকতে হয়। কোন কোন পরিবারের এই বাসি ভাত বা পান্তাভাত এর সাথে বাঁসি তরকারি ছাড়াও টাটকা ছাতু অথবা মাছ রান্না করে খাবার রীতি আছে। সারাদিন খই মুড়ি চিঁড়ে খাবার পর রাত্রিবেলা গরম গরম ছাতুর ও মাছের তরকারি দিয়ে পান্তা ভাত খুবই উপদেয় বলে শোনা যায়।
এছাড়া মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমী তিথিতে রাঁধা বাড়া ও ষষ্ঠীর দিন পান্তা ভাতের যেমন রেওয়াজ আছে মানভূম এলাকায়, তেমনি অনেক পরিবার এই শ্রাবণ সংক্রান্তির দিন রাঁধা-বাড়া এবং ভাদ্র মাসের প্রথম দিন পান্তা ভাত খাওয়ার ও খাওয়ানোর রীতি রয়েছে। এটিও একটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক অনুষ্ঠান। ছোটবেলায় যখন শুনতাম শ্রাবণে রেঁধে ভাদরে খাওয়া, তখন মনে মনে একটু আশ্চর্যানিত হতাম, যে একমাস আগের ভাত একমাস পর কীভাবে খাওয়া সম্ভব ? একটু বড় হয়ে বুঝেছি আসলে সংক্রান্তির দিন রান্না করে পরের মাসের পয়লা দিন বাঁসি ভাত রূপে সেগুলি আরাম করে খাওয়ার রীতি হল এক মাসে রেঁধে পরের মাসে খাওয়া দাওয়া। এই পান্তা ভাত উৎসবের দিনেও পান্তার সাথে যেমন বাসি তরকারি খাওয়ার রেওয়াজ আছে, তেমনি আবার গরম গরম মাছ মাংসের ঝোল রান্না করে বাঁসি ভাতের সাথে খাওয়ারও প্রচলন রয়েছে। সাধারণত সংক্রান্তির দিন যে মনসা দেবীর পূজা হয় সেদিন ভোরের দিকে হাঁস ও ছাগ বলি হয়। সেই বলি প্রদত্ত ছাগ ও হাঁসের মাংস রান্না করে প্রসাদ হিসেবে বিভিন্ন পরিবারের সদস্যরা গ্রহণ করেন এবং আত্মীয় কুটুম্বদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান। এই অরন্ধনের দিনও মানভূম পুরুলিয়ায় অলিখিত বনধ্। টুসু উৎসব যেমন মানভূমের জাতীয় উৎসব, কালী পূজার জাঁকজমকও যেমন কম নয়, তেমনি পয়লা ভাদ্রের এই উৎসব মানভূমবাসীর কাছে প্রাণের উৎসব এবং মানর উৎসব।
বর্ষাকালের ধান লাগানোর কাজ শেষ হয়ে যাবার পর শ্রাবণ মাসের শেষ সপ্তাহেই পরপর এই যে দু'টি পান্তা ভাতের উৎসব শুধুমাত্র সামাজিক রীতিই নয়, সংস্কারই নয়, এর পিছনে যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত কারণ রয়েছে। দীর্ঘদিন চাষবাসের কাজে কৃষক শ্রমিক নারী পুরুষ ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে যান । তারপর চাষবাসের কাজ শেষ হলে মনের আহ্লাদে তাঁরা শ্রাবণ মাসের শেষ সপ্তাহটি আনন্দ যাপন করেন। বাঁসি ভাতের আগের দিনগুলিতে অর্থাৎ রাধা বাড়ার দিন ভাত রান্না করে ভাত ঠান্ডা করে নিয়ে সেগুলি একটি পাত্রে ঠান্ডা জলের সঙ্গে মিশিয়ে রাখা হয়। জল ও ভাতের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। ভাত আর তখন সরাসরি অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসতে পারে না। গাঁজন প্রক্রিয়া, ত্বরান্বিত হয়ে যায়। ভাতের পাত্রের ভিতরে এনারোবিক ফার্মেন্টেশন ঘটে। কার্বোহাইড্রেট ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় । ফাইটেটের মতো যে সকল এনটিনিউট্রিশনাল ফ্যাক্টর থাকে, সেগুলিও ক্ষয়ে যায়। এবং ভাত হাইড্রেট হয়ে থাকে। এই জাতীয় ভাত অর্থাৎ পান্তা ভাত খেলে কাজে বেশি উদ্যম পাওয়া যায়, ক্লান্তি দূর হয়। মানবদেহের জন্য উপকারী বহু ব্যাকটেরিয়া পান্তা ভাতের মধ্যে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় ।পান্তা ভাত খেলে পেট ব্যথা, কোষ্ঠবদ্ধতা দূরীভূত হয় ।শরীরে তাপের ভারসাম্য বজায় থাকে, ক্লান্ত মনে আসে সজীবতা। আবার অনিদ্রা থেকে মুক্তির পথও খুঁজে পাওয়া যায়।
আবার চিঁড়ে,গুড়,দই আনুষ্ঠানিকভাবে এগুলি সেবনের ও যথেষ্ট তাৎপর্য আছে। চাষবাসের কাজে অত্যন্ত পরিশ্রমের পর এইসব খাবার নিতান্তই উপকারী। দইয়ে ক্যালসিয়াম, নানান ভিটামিন,ম্যাগনেসিয়াম,, পটাশিয়াম আছে যথেষ্ট। শরীরও ঠান্ডা থাকে, খাবার হজম ও হয় বেশ। গুড় খেলেও শরীর সুস্থ থাকে।রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখে।শক্তি যোগায়। বর্ষার শেষে যে কফ,গলাব্যথা, গলা খুসখুস দেখা দেয় তা রোধ করে। রক্তের হিমোগ্লোবিন বাড়াতেও সাহায্য করে । পাকস্থলী, অন্ত্র, ফুসফুস এবং খাদ্যনালী সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করে। আর চিড়ায় আঁশের পরিমাণ কম থাকে বলে তা ডায়রিয়া , নানান ক্রণিক ডিজিজ, আলসারেটিভ কোলাইটিস, অন্ত্রের প্রদাহ এবং ডাইভার্টিকুলাইসিস রোগ প্রতিরোধ করে। চিড়ায় পটাশিয়াম এবং সোডিয়াম কম থাকে। এটি কিডনি রোগীদের পক্ষেও কল্যাণকর। একথা এখানে উল্লেখ করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে, বর্ষাকালে কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে এই সমস্ত খাবারগুলি আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রহণ করার যে রেওয়াজ সুপ্রাচীন, তা কেন (?)একদিন সূচনা হয়েছিল --তার তাৎপর্য উদ্ভাবন নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা চলছে।
কবি পঙ্কজ মান্না-র কাব্যগ্রন্থ :
' প্রাক্তন ফাল্গুন জানে ' ----
পাঠ প্রতিক্রিয়া ....
কবি উমা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রাক্তন ফাল্গুন জানে আর জানে পোড়া চিতাকাঠ~ পথ হাঁটে জীবনের কারবারী~ জানে না জীবনের অন্তরে জীবন । জেনে যায় তাই কবির মানস-আলো মাখামাখি গভীর জীবনবোধ~ যাপনের সব আবিলতা, মিথ্যে মোহ-আবরণ, মুখ ও মুখোশের ঐকান্তিক বেদনা ।
' প্রাক্তন ফাল্গুন জানে' কাব্যগ্রন্থের শুরুতেই তাই কবির প্রার্থনা এক অন্তহীন ঘুমের। পূর্ণিমায় পুৃড়ে যায় সম্পর্কের সাঁকো~ কথাকলি নাচের ছলনায় প্রেম ~ জ্বরতপ্ত যাপনের অসুখ~ ক্ষয়ে যাওয়া অবসাদগ্রস্ততায় কবি যেন চান সেই ধ্যানস্থ পাহাড় থেকে নেমে আসা ঘুম~ ঘুম ধ্যানস্থ শ্মশান থেকে ।
মাটির জীবনে বসবাসকে আঁকড়ে বাঁচা, তবু কিছুই থাকে না শেষমেষ। যা কিছু ধরা হাতের মুঠোয় , এ পৃথিবীর যা, তা প্রকৃত শূন্যতা ~ একথা জানে কররেখাগুলি আর কবির অনন্ত জীবনবোধ ।জীবন থাকে জীবনের গভীরে অনন্য অনুভবে ।মনে হয় আছে সবই জীবনের দাগ হয়ে~ আসলে থাকে না কিছুই । কবি পঙ্কজ মান্নার এই গহন সংবেদী উচ্চারণ তাঁর কাব্যলোককে চেনায় । তাঁর হাত পাতা কোনও অলৌকিক ভোরের কাছে~ঘোলাটে বস্তু জীবন পেরিয়ে~ যে জীবনে শুধু আত্মমগ্ন মানুষ~ ডুবন্ত মানবতার জাহাজের শেষ যাত্রী এই কবিসত্তা~হৃদয় উষ্ণতাকামী~ নিজের মুখোমুখি হতে চান উত্তরণের আলো ।
জীবন ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে সামাজিক হতে গিয়ে গোলকধাঁধার পিছুটান বার বার , অপচয় হয়ে যায় জীবনের কড়ি, তবু কবি জীবন চেনেন ।
" তবুও জীবন বড় মোহময় জয়ে বিপর্যয়ে,
মৃত্যু তো অনন্ত প্রবাস, ক'জন ফিরেছে!?"
কত ডাক আসে, যায়~ কখনো সানাই বন্ধনের~ "কখনো বা ডাক দেয় অন্ধ কানাই /অনুরাগে ভিখিরি সাজালে ভুবনডাঙায় / পাশুপত অস্ত্র ডাকে, কখনো গান্ডীব, / দশপ্রহরণ ডাকে-- কানে ঢালে গভীর মন্ত্রণা" ~
এসবের পিছে আসে যদি সেই ডাক~
"ডাকো যদি , যেতে পারি , ত্যাগের গৈরিকে নৈঃশব্দ্য শকটে " ~ এমন কাব্য আমাদের ভাসিয়ে দেয়, তীর্ণ করে এক আলোময় বোধের আঙিনায় ।
কবির চেতনাবলয়ে শুধু নিজের জন্য নয়, আবিশ্ব মানুষের যুগযন্ত্রণার ক্ষত নিরাময়ের এক আশ্চর্য উপশম লেখা তাঁর কবিতার অক্ষরমালায় । সুস্থির মনে এক নিভৃত সাধনকোণে এ যেন কবির শুভময় প্রার্থনা । খুব সংহত বোধের মন্ত্র তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে ।" বেলাশেষে মেলে না হিসেব, উপহাস করে অমোঘ শূন্যতা "~ তবু তাঁর কবিতাভুবনে ভাসে এক মানবিক সচ্ছলতা ।
কবি তাঁর অন্তর্লোকে যে ভাব লালন করেন , তা-ই আসে তাঁর কবিতায় অপরূপ চিত্রময় শব্দছবির বাঙ্ময়তায় ।
" তবুও তো আগুন পোহাই জীবন ঘিরে শীত সকালে
অগ্নিবাণে হৃদয় তাপাই জীবনপোড়া মৃদু আঁচে"
জীবনের অর্বাচীন ভুলের পরেও এক জাগরণের মন্ত্র লেখা কবি পঙ্কজ মান্নার কবিতায় ।
"প্রিয় ভুল, ফুল হয়ে ফোটো, হৃদয় সাজাই--
কেউ কি জানে কত মনস্তাপে বিরহ- বকুল!"
এক গভীর মানবিক চেতনা, সহজ থেকে সহজতর যাপন প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী কবি~ উষ্ণতা হৃদয়ের , উষ্ণতা সাহচর্যের, প্রেমের , সখ্যতার।~
"পারিজাতের সুবাস ভরে ঘর
দুখ -সাধনায় প্রণয় প্রদীপ জ্বালো"
এমনই বার্তা পায় পাঠক। এত অসুখ পৃথিবীর , তবু মন মরেনা ।তবু এতসব ' প্রচল বচন 'মিথ্যে করে তিনি জাগিয়ে রাখতে জানেন জীবনের আশ্বাস ।
এ গ্রন্থের শেষে এক অসামান্য কবিতা পাই , যা কবি লেখেন তাঁর গল্পকার বন্ধুর জন্য ।
" একলা মানুষ অসীম গভীর, ছোঁয় না তাকে ভুবনজোড়া মন্দ বাতাস / তুমি বুঝি জীবন-সাধক, শুদ্ধতম উচ্চারণে গল্পাতীত গল্প বলো।"
সকলের কথাই যেন কবির কথা এমনটাই মনে হয় এ কাব্যগ্রন্থ পড়ার কালে । এক অপার শান্তি, স্থিতি, স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহিত সঙ্গীতময়তা, অসামান্য চিত্রকল্পের প্রয়োগ, সবটাই যেন হৃদয় উৎসারিত ~ এক নিভৃত সাধনরত কবিমানসের প্রতিফলন । এক দুর্লভ কাব্যিক সততার স্পর্শে মুগ্ধ হয় পাঠকচিত্ত ।
মুগ্ধ হয়েছি এ কাব্যগ্রন্থের আস্বাদে । কবিকে গভীর শ্রদ্ধা । আরও অনেক অনেক লিখুন কবি । আমরা সাগ্রহ প্রতীক্ষায় রইলাম ।
বইটি কবিপত্র থেকে প্রকাশিত।
প্রচ্ছদ : উত্তম মাহাত ।
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : সমীর আইচ
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
দুর্গা স্যারের কবিতা প্রতিবারের মতোই ছুঁয়ে যাওয়া, অয়ন জোয়ারদার এর কবিতার কথা আলাদা করে বলতেই হয়। তপন বাবুর লেখা শুধু একটি লেখা নয়, লোকায়ত জীবনের পদধ্বনি।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ ভালোলাগা
উত্তরমুছুন