তৃতীয় বর্ষ ।। চতুর্দশ ওয়েব সংস্করণ ।। ৬ কার্তিক ১৪২৯ ।। ২৪ অক্টোবর ২০২২


পরব তিহার বা সংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান কেবলমাত্র আমাদের জীবনকে আনন্দে মুখরিত করে তোলে তাই নয়, আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনকেও সুদৃঢ় করে তোলে। সেই মেলবন্ধনকে সুদৃঢ় করে তোলার লক্ষ্যেই হয়তো বারো মাসে তেরো পার্বণ। যে সকল পার্বণ নানা প্রয়োজনে নানা বাহানায় পরস্পরকে পরস্পরের কাছে নিয়ে আসে আমাদের। আর আমারা জড়িয়ে পড়ি নানা মায়ায়।
কালীপূজা এলো। হাঁস কার ঘরে আছে গো? আলোচাল নিয়ে এসো না, ও পাড়ার ঢাঙি দিদির কাছ থেকে। পাঠ কাঠি মনে হয় মাহাত পাড়ার বড় ভাঁশুরটার ঘরেই পাবে। ওরা গত বছর পাঠ পচিয়েছিল। সব কি জ্বালিয়ে শেষ করবে? নিশ্চয় রেখেছে। কালীপূজায় দরকার পড়ে। এমনই সব প্রয়োজন সম্পর্ককে দৃঢ় করে আমাদের। আর সেই পারস্পরিক প্রয়োজনগুলো অনেকাংশেই নিয়ে আসে এইসব পরব পার্বণগুলো। এগুলো না থাকলে হয়তো আমরা পরস্পরের এত কাছে থাকতে পারতাম না। তাই, কে কি বললো তাতে কান না দিয়ে আমাদের উচিত আমাদের সংস্কৃতি ও পরব তিহারকে ধরে রাখা। যাতে পরস্পর কাছে থাকতে পারি আমরা।


উত্তম মাহাত, সম্পাদক


______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
দুর্গা দত্ত / গীতশ্রী সিনহা / বিশ্বম্ভর নারায়ণ দেব / সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় / সুজন পণ্ডা / সপ্ না সাহা / সত্যম কুড়মি / তপন পাত্র
______________________________________________




______________________________________________

কালীপূজার শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই সকলকে।
______________________________________________




পুরনো লোক

দুর্গা দত্ত


বিশ্বাস করতো পিছু ডাকলে অকল্যাণ ।
ফিরে এসে চৌকাঠ ডিঙিয়ে 
মাথায় ঠাকুরের ফুল ছুঁইয়ে বলে উঠতো 
দুগ্গা দুগ্গা শ্রীহরি শ্রীহরি।
ঘর থেকে এক পা বেরোলেই বলতো 
ভালো থেকো, গরু বাছুর দেখো।
ছেলেমেয়েরা পুকুরে গেলে সঙ্গে যেয়ো।
সাঁতার জানে না ওরা।
ফিরতে কদিন দেরি হবে সন্ধ্যার মা। 
এদিকে ওদিকে যেতে হবে তো ! 
ঘরে বসে থাকলে কি চলবে ! 
দু পয়সা হাতে এলেই 
বিষ্ণুপুরের রথের মেলা থেকে 
তোমার জন্যে নিয়ে আসবো 
বেলুন চাকি, কড়ি গাঁথা লক্ষ্মীর চুপুড়ি,  আর একজোড়া শাঁখা। 
হাতটা বড়ো খালি খালি লাগে তোমার। 

অমূল্যকে ডেকে 
দু আঁটি বিচুলি এনে গুঁজে দিতে বোলো 
গোয়ালের চালে। 
বুধনি গাব্বিন গাই, 
জলে ভিজলে সন্নিপাত হবে।

এবার ছেলেমেয়েদের পাতে একটু ক্ষীর পড়বে। কদ্দিন যে বাটিভর্তি দুধ ওরা 
চোখেই দেখেনি!
আমার জন্যে ভেবো না শ্রীমতী। 
ঠিইক চালিয়ে নেবো।
ওদের একটু নজরে রেখো ।
বিল্ববরণের আগে 
আমি ঠিইক ফিরে আসবো ঘরে।


কতো কী যে আছে আজ!
কতো আলো , ঢাকবাদ্যি, কতো যে জৌলুস! 
পুরনো লোকেরা আজ 
কেন যে কেউ ঘরেই ফেরে না!








গীতশ্রী সিনহার কবিতা 

১.
লেভেল ক্রসিং

এলোমেলো অন্ধকার সরিয়ে ঘুম মাখা ঘরে শব্দের ছদ্মবেশে আর্বিভাব, 
ঘুমের ভিতর শব্দের তান্ডব... বেশ কিছু শব্দ বালিশে মুখ গুঁজে গোঙরাচ্ছে ...  
ঘুম ভেঙে যায়, কুঁকড়ে থাকা অগোছালো শব্দরা 
মধ্যরাতে লেপ্টে থাকা ঘুমে শিরশিরানি তোলে...  চোখের পাতা ভারি, পাশের ঘরে লাইব্রেরি থেকে বই এনে চটপট শব্দ গুঁজে রাখি বই এর পাতায় পাতায় ... তারপর, ঘুমন্ত শব্দরা জড়িয়ে ঘুমায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে আমার চোখে... 
সুখ শব্দ... আনন্দ শব্দ... 
ঘুমের ভাঁজে গল্প শোনায় তারা... 
শব্দের ইশারায় আঁচল ঢেকে গভীর ঘুমে তখন, 
এইভাবেই বুঝি ঘুমঘোরে গল্প সৃষ্টি হয় ! 
হ্যাঁ, স্বপ্নপূরণের গল্প ! ধূলিয়ানের পথে পথে লেভেল ক্রস করছি আমি ! আমার লেভেল ! 
আমার বালিশ চাপা মুখ থেকে ২৭০ কিলোমিটার দূরে...  পরিচালক আমি, ক্যামেরা অ‍্যাকশান রোল  বলার আগেই সিকুয়েন্স প্রস্তুত, শিল্পীদের পারফর্মেন্স দুর্দান্ত... আর আমি বিরক্তিকর ভাবে বলে চলেছি...  প্যান শট - টিল্ট শট - ডলি শট চাই...  কুইক !  কুইক ! ... ডলি জুম শট নেওয়ার সময়  কখনো ডলি ইন বা জুম আউট করার জন্য চিৎকার করে চলেছি ...  একটা ম্যাক্রো শট নেওয়ার জন্য লাফ দিয়ে উঠতেই গড়িয়ে পড়ি খাট থেকে ... 
লেভেল ক্রসিং টপকানো হলো না ! 
ভাঙাচোরা বাস্তবে গোঙরাচ্ছি তখন !



২.
তামাটে অস্ত্র

বধির- বিপন্ন কলমটা গঙ্গা জলে শুদ্ধ করে আনি 
লক্ষ্মীছাড়া অবাধ্য- বেচাল বশ মানে না আজকাল
আঁশ গন্ধমাখা পাঁচিল টপকে দুর্গন্ধ খুঁড়ে বেড়ায়
সেকি ! কলমের গায়ে লোম গজিয়েছে ! 
একদম ঠিক ধরেছো !  হুম হুম শুয়োরের মতো... 
না... না... ওকে বাচ্চা বলে ভুল করো না ! 
বোমা বাঁধার মতো শব্দদুষণ আগুনে ছুঁড়তে শিখেছে
দু'আঙুলের ডগায় নুন তোলার মতো এক চিমটি ছোবল-ই ওর যথেষ্ট ! 
তোমরা জিভের লাগাম দাও... দেখো,  খসে যেন না পড়ে! 
ভাঁজ করা মনের ব্যাধি ডি-ভি-সি'র বাঁধে সম্মিলিত গর্জন তোলে, 
পণ্য কলম আজ বিপন্ন সভ্যতায়... 
অভুক্ত পেটে এক মুঠো ভাতের ক্ষুধায়... 
ছেঁড়া রোদ উদ্বাস্তুর মতো অসহায় ন্যাকাবোকা চিরুনি তল্লাসি চালায়, শকুন আর শেয়ালের মুখে চিরকাল এঁটোই লেগে থাকে... 
এসব নিয়েই কলমে হাত পড়েছে... একটা জ্যান্ত কবিতা লেখার অপেক্ষায়। 
অনেক তো হলো !  পৌরাণিক পদ্য, মেদবতী নাভি ছুঁয়ে পঙ্গু মনের ভাবনার বিলাসিতা ...








অনুভূতিমালা 

বিশ্বম্ভর নারায়ণ দেব 


প্রাককথনে সবটা কি আর বেরিয়ে আসে 
আবেগ আমার তোমার মনের ভেলায় ভাসে 
আসুক অনুভুতিমালা আড়ে ও বহরে 
প্রকাশে উৎকর্ষ ঢালো অনন্ত অক্ষরে 
চাকার মতো যাক গড়িয়ে যাক‌। বাংলা কবিতার
বাঁকনির্ণয় বাতলে গেছেন বিনয় মজুমদার । 

ধান ভানতে কাজে লাগাও শিবের গীতও
বলে গেছেন ফল্গুদাদা; হায় পরিমিত ।
কান ফাটানো বাজির আওয়াজ শুনেছি উৎসবে
তাকে কি আর কবিতার খুবই ক্ষতি হবে ? 

সমাহিত কালীকৃষ্ণে গড় রেখেছি পা-য় 
বাক্য প্রতিবাক্য অক্ষয়বটের দিকে ধায় 
সাধুকবি অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্রের
কেন্দ্রে নয়, পরিধিতে রাখি তায়, সখ্যতা সূত্রের। 

ছাপার ভুলের আড়ষ্টতা সরিয়ে রেখে 
এখন সব কবিতাই ঝালিয়ে নিচ্ছি একে একে 
এক কবিতায় হৃদকাতুরে এক কবিতায় এলোকেশি
মনস্তত্ত্বে আমার চেয়েও দেখছি তোমার দখল বেশি ।





সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা 

১.
সত্তা

প্রহরের শেষে গোধূলির বেশে  
আবার চৈত্র মাস...  
তোমার চোখেই সত্যি দেখেছি  
আমার সর্বনাশ?

মোড়কে মলাটে চাপা পড়েনি কি  
কাহিনির হাঁসফাঁস?  
মাটি কর্ষণে অসত্য ছিল  
ফসলের উল্লাস?

দেহের দেউলে সত্য থাকে না,
মিথ্যার চাষবাস।
বুকের ভেতরে জ্বলছে নিদাঘ,
চিতায় সত্তা-লাশ।



২.
দাফন

বলার আছে অনেক কিছু 
মনের কথা মনে ; 
অলিন্দতে কথার আলাপ-  
চারি অনেক ক্ষণের....

হঠাৎ দেখি ঘরের মাঝে  
চোখের ঈশান কোণে....  
চারটি চেয়ার মুখোমুখি।  
বসবেন চারজনে?

চারজন শুধু বলতে ব্যাকুল,  
কে কার কথা শোনে।  
আসল কথার চারদিকে চার  
দেওয়াল চতুষ্কোণের

সবাই মিলে ব্যস্ত কথার  
মৃত্তিকা খননে  
সত্য এবার হবেই দাফন  
মিথ্যা সাতকাহনে।








পারস্পরিক

সুজন পণ্ডা

তুমি দেখছো পুরোটাই
অথচ, বুঝতে চাইছো না...
সর্বগ্রাসী পাকস্থলি ঘুন পোকার মত, 
ক্রমশ নিঃশেষ করছে
রোদ্দুর থেকে বিকেল, 
বিকেল থেকে শৈশব।

ওই সব কিছু এখন আসলে -
জাদুঘরের সংরক্ষিত নমুনা;
আসলে নষ্ট নির্জীব সাক্ষী।

অষ্ফুট আলোর এই কয়েকটি মুহুর্ত
রক্তহীন।
ফ্যাকাশে ।

তুমি দেখছো- অথচ
অনুভব করতে চাইছো না
এখনই বৃষ্টি দরকার
বজ্র বিদ্যুৎ সহ। 
প্রলয়ংকর কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
এক ঝড়ে লন্ডভন্ড দিনমান।

তুমি তো জানো
তাহলে একবার ঋজু কণ্ঠে বলো
এই পৃথিবীর একটা বিকেল চাই
স্মৃতিসৌধ নয়... সবুজে ঢাকা
একটা মাঠ,
ঘাস আর শিশির...।

একবার শুধু সবটুকু বিশ্বাসে
আদিম চাঁদের দিকে চেয়ে
বুকে হাত রাখো। 
নির্বাক দাঁড়াও।
তাতেই পৃথিবী তোমার, 
তাতেই তুমি পৃথিবীর।









ফিরে আসবে হয়তো 

সপ্ না সাহা

একটা ছোট্ট বেলার গল্প শেষ হতেই প্রেম হারিয়ে যায়---
কুঞ্চিত চামড়ার ফাঁকে লেখা থাকে সেসব কথা---

একটা আটপৌরে চেহারা হারিয়ে যায়
একটা অখন্ড বুকের মাঝে মাথা রাখে---

তারপর ফেনায় ফেনায় কান্না
ফিসফিস করা অভিমান ছাপিয়ে উঠে
দিগন্তের শাড়িতে শিউলি ফুল আঁকে
গন্ধবিদুর বুকে অপেক্ষা করে, সেই পুরনো সুগন্ধের---
হয়তো একদিন ফিরে আসবে প্রেম এই আশায়-









অভিমান

সত্যম কুড়মি 

জন্মকালে মধু দিতে পারোনি, 
শৈশবে খেলনা দিতে পারোনি, 
কৈশোরে খেলার সামগ্রী দিতে পারোনি, 
যৌবনে জীবনযুদ্ধে একা ছেড়ে দিয়েছো। 

শশ্মানেও একাই পুড়তে দিও। একাই পুড়বো।
আমি তল পাইনি
           বল পাইনি
                           জীবনের। 

এতটুকু উত্তাপ যদি লাগে তোমার ত্বকে
এতটুকু জল যদি ঝরে তোমার চোখে
এতটুকু অনুশোচনা হয় যদি তোমার বুকে! 

একা বাঘের মতো জীবন কাটাবো। 
হাত-পা-কাঁধ অবলম্বন কিছ্ছু আবদার নেই। 
একা বাঘ হয়ে দেখাবো। 
যদি গর্জনে দূর থেকে চিনতে পারো। 
পারলেও গহীনে হারিয়ে যাবো। গহীনে...








          রবীন্দ্রনাথের বেদনার গান 

                        তপন পাত্র

জীবনে চলার পথে যে সকল দেখোশোনা, চেনা-জানা, অভিজ্ঞতা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, হাসি-কান্না রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধকে সম্পূর্ণতা দান করেছিল, সেগুলির মধ্যে বেদনাকেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন সর্বাধিক। দুঃখ-বেদনা যে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ সাধনে, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় , অন্তরের জাগরণে বিশেষ সহযোগিতা করে ---এ কথা তিনি বারংবার স্বীকার করেছেন তাঁরা নানা রচনায়। ব্যথা-বেদনা মানুষের আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তোলে, "নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ" ঘটায়। কবি বেদনাকে জীবনে কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন, বেদনা তাঁর সৃষ্টিকলাকে কিরূপে প্রভাবিত করেছিল তার একটি অন্তর্মুখী ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে অসংখ্য গানের ভিতরে।
                         তাঁর সমস্ত সৃজনকর্মের মধ্যে গানগুলির প্রতি একটি ব্যতিক্রম ভালোবাসা ছিল। জীবনের যাবতীয় লেনাদেনা চুকিয়ে দিয়ে কবি যেদিন অমরলোকে পাড়ি দিলেন, তার তিন মাস আগে বলছেন ---
             "আমি এত কবিতা লিখলুম, গল্প লিখলুম, ছবিও কম আঁকলুম না। কিন্তু গান গেয়ে যে আনন্দ পেয়েছি সে আর কিছুতে পাইনি। গান সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। গানের সুরে যেন অসীমের সঙ্গে এক মুহূর্তে একটা যোগাযোগ ঘটে যায়। এমনটি আর কিছুতে হয় না।" --রানী চন্দ তাঁর "গুরুদেব" নামক গ্রন্থে একথা উল্লেখ করেছেন।
                 রবীন্দ্রনাথ বরাবরই সীমার মধ্যে অসীমকে, ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহৎকে, ব্যষ্টির মধ্যে সমষ্টিকে অন্বেষণ করেছেন। তিনি মনে করতেন যাবতীয় ব্যক্তিসীমা অতিক্রম করে অসীমের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই সকল শিল্প-সাহিত্য, কারুকলার শেষ কথা। নিজের জীবনের চারপাশের সমস্ত সংকীর্ণ বেড়াজাল ও সীমাবদ্ধ দায়িত্ববোধকে অস্বীকার করে কবিচেতনার নিবিড় গহনে প্রবেশ করার সর্বাধিক সুযোগ আছে গানে; তাই তিনি সকল সৃজন কর্মের চাইতে সংগীতকেই সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে বহুবার বলেছেন, যেকোনো সাহিত্য স্রষ্টার এবং শিল্পপিপাসু এমনকি সাধারন রাখাল বালকেরও অন্তরে গানেরই একাধিপত্য। গান যেন অভিমানিনী পাটরানী, খুব একনিষ্ঠভাবে মনোযোগ সহকারে তাঁকে না সাধলে তাঁর মন পাওয়া যায় না। গান নিয়ে খুবই অহংকারের সঙ্গে তাঁর ঘোষনা ছিল ---
         "লেখাটা যেন আমার বড়ো গিন্নি, আটপৌরে।সে সবসময় সকলের সামনেই বের হয়। কোনো দ্বিধা সংকোচ নেই । ছবি হলো আমার ছোট গিন্নি, তাকে একটু তোয়াজ করলেই সে ভোলে। কিন্তু আমার মেজো গিন্নি আমার গান। সে যখন আমার কাছে আসে, তখন কাউকেই সে সইতে পারে না, বড়ো অভিমানী কেউ এলো কি, অমনি সে যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল ---কত সাধ্যসাধনা করে তবে আবার ফিরিয়ে আনতে হয় তাকে।"
                  গান রচনার সময় এবং গানে সুর আরোপ করার সময় তাঁর ধারে কাছে কেউ চলে এলে অত্যন্ত কষ্ট হতো কবির। গানের কথাগুলি আর সেভাবে আসতো না পারে; সুর কেটে যেত, সেই সুর যেমনটি হতে পারতো, তা আর হতো না। কারণ প্রকৃত সুন্দর গান ও গানের সুর কোন ব্যক্তিক বিষয় নয়, নৈর্ব্যক্তিক মননের পবিত্র সৃজন। একজন স্রষ্টা ছবিতে, কবিতায়, গল্প-উপন্যাসে প্রয়োজন মতো বাস্তবতাকে হাতে নিয়ে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তাকে রূপায়িত করেন, কিন্তু গান দৈব বাণীর মতো পবিত্র, আমাদের গতানুগতিক পার্থিব অভিজ্ঞতার বেড়াজাল অতিক্রম করে অনুভব ও মননের অরূপলোকে সংগীতের অসীম অভিসার সংঘটিত হয়। বাঁধা পথের রাঙা ধুলার সীমা অতিক্রম করে বস্তুকেন্দ্রিক যুক্তিতর্কের কাঁটাতার অতিক্রম করে অলৌকিক অনুপম অরূপ অরণ্যে সংগীতের গতি। এই গতির বনিয়াদ বা নেপথ্য শক্তি গীতিকারের বেদন বা বেদনা। গানকে ঘিরে এমন কথা তো আমরা প্রত্যেকেই শুনেছি যে, "জগতের সমস্ত গানই বেদনার"। এক্ষেত্রে বেদনা শব্দটিকে আমি একটু বিস্তৃত অর্থে গ্রহণ করার পক্ষপাতী। "বেদনা" শব্দটির আদি অর্থ, মূল অর্থ বা বাচ্যার্থ হলো ---বোধ, অনুভূতি, আকুতি। আর প্রচলিত অর্থ ---ব্যথা, যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট, রিক্তের রোদন। উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি উভয় অর্থকেই ইঙ্গিত করে বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা", বেদনায় জীবন পেয়ালা কানায় কানায় পূর্ণ না হলে গানের রানী এসে পাশে বসেন না। যখন সমস্ত বাণী ফুরিয়ে যায়, তখন গানের রানীর নিঃশব্দ পদচারণা। কবি পি.বি. শেলীর অমর উচ্চারণ ---"our sweetest songs are those that tell of saddest thought."।
                         প্রকৃত গান যিনিই রচনা করুন, সেই কথার অন্তরালে বেদনা থাকবেই। অন্তর চোখের জলের সিক্ত না হলে গান রচিত হয় না। গান মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। প্রসঙ্গত লিওনার্দো দা ভিঞ্চির একটি কথা মনে পড়ে,"Tears come from the heart and not from the brain."গানও তাই। এই বেদনা, এই চোখের জলেই তো প্রকৃত সুখ, প্রকৃত শান্তি, এছাড়া তো সুখ শুষ্ক, সে সুখের কোন মূল্য নেই মানবজীবনে। "The word 'happy' would lose its meaning if it were not balanced by sadness."কার্ল জং-এর এই কথাটি মনে এলো এই প্রসঙ্গে।
                                                       (পরবর্তী অংশ পরের সংখ্যায়)



                                                                   আমাদের বই


সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের ছবি : গল্পকার স্বপন চক্রবর্তী
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪