দুর্গা দত্তের কবিতা
আখেটিক পর্ব : সাত খণ্ড
আখেটিক : এক
১
শিকারপর্বের শেষ ।
স্বর্ণগোধিকার ছাল ছিলায় বেঁধেছি যত্ন করে ।
আমানির ঢোঁক নিয়ে এই আমার শিক্ষা দীক্ষা
মন্ত্রগুপ্তি ক্রিয়াকর্ম বৃত্ত উদ্ভাবন --
আমাদের জ্যা থেকে সুকৌশলে হাড় মাস নিয়ে গেছে
প্রচলিত যোগ্য কোনো জুতসই ধ্রুপদী শিকারী--
আমাদের হাড়ে দুব্বো গজিয়েছে বছর বছর
২
স্বর্ণগোধিকার কোনো জন্ম ইতিহাস
কোনো পরম্পরা আমরা জানি না
এই নে ফুল্লরা তোর হাড় জ্বালিয়ে কেউ তোকে
বিরক্ত করবে না এই দুপুর বেলায় --
আমানির গান তুই তুলে রাখ গর্তে গর্তে , শিকেয় সাজিয়ে।
এই নে রে ছাল তুই ইষ্ট গোধিকার, নে সোনালি চামড়ার --
যা ইচ্ছে তাই কর তুই,
প্রাণেতে যা চায় তোর, যেমনটি চায় --
সাধ মিটিয়ে দেখ সব ছিঁড়ে খুঁড়ে শৌখিন বাগান
৩
আমাদের গাথা কোনো মঙ্গল আখ্যানে লেখা নেই।
ফুল্লরা রে, আমানির চেনা স্বাদে জন্মান্তরে কাঁথা মুড়ি দে --
স্বর্ণগোধিকার ছাল ছিলায় ঝুলিয়ে নিয়ে
আমাকেও ফিরে আসতে হবে --
যদ্দিন না সেই গোধিকার অন্তঃসার , কানাকড়ি
তোর দাওয়া-তে নিয়ে আসতে পারি !
আখেটিক : দুই
এই নে ফুল্লরা তুই
ঘুমোনোর আগে আর ঘুমোনোর পরে তোর
স্বপ্নে পাওয়া শালবীজ, ধুনুচির ঘ্রাণ…
এই নে ফুল্লরা তোর ভোর রাতে স্বপ্নে দেখা
অলীক তৈজস …
এই নে ফুল্লরা তোর জলহীন সারাটা দুপুর…
মাংসপোড়ার গন্ধে বিকেলের আলো নিয়ে
লবণ সন্ধান আর উৎসব যাপন —
সন্ধ্যাক্ষরে ফুল্লরা রে
এই হলো আমাদের দিনাতিপাতের ইতিহাস ...
আখেটিক : তিন
শালগ্রাম শিলা নয়,
হলুদবাটার শিল হাট থেকে এনো মনে করে
কালো পাথরের বাটি, দই পাতবো,
মাঝেমধ্যে চিড়ে দই খাবে
পেট ঠাণ্ডা হবে দেখো, দমও থাকবে সারাদিন
মনে করে এনো জামবাটি ,
আমানি ও ফ্যান জল খাবে।
সাধ্যে কুলোলে কখনো বা দুধ রাখা যাবে।
তোমার যা ভুলো মন !
মনে করে নিয়ে এসো বাঁশের ফুকনল।
লাল জবাফুল চোখ । কাঁচাকাঠে , পাকানো ধোঁয়ায়
প্রতিদিন ফুঁ দিয়ে দিয়ে…
-
ছুঁচ সুতো নিয়ে এসো ,
ছেঁড়া কোঁচড়ের কথা মনে থাকে যেন ...
আর এনো রাঙাজবা আলতা , এনো শ্রীমতী সিঁদুর।
ডোকরা কামারের থেকে কুনকে নিয়ে এসো একখান ।
ধান রাখবো, কড়ি রাখবো,
আর রাখবো দুচারটে তামা পয়সা ,
তুলে রাখবো সবেধন নীলমণি সিঁদুরের দাগলাগা রুপোর টাকাটি --
গজপৃষ্ঠে ঝালরের নিচে লক্ষ্মী ঠাকরুণ নিয়ে এসো
ময়ূর গরুড় পেঁচা , দারুময় ভগবতী সহ --
আল্পনা এঁকে রাখবো দুয়ারে দুয়ারে ।
সকাল সকাল স্নান সেরে গাছকাপড়ে হলুদ শাড়িতে--
মনে করে এনো এই সব।
তোমার যা ভুলো মন , মনে করে এনো সবকিছু --
পাড়াপড়শিদের কাউকেও কিছুই বলিনি , শুধু
তোমাকে বলেছি
শেষরাতে স্বপ্ন দেখে বুকের ওপরে মাথা রেখে
চুপি চুপি তোমাকেই বলেছি এ কথা :--
পৌষের সকালে
নতুন ধানের চুপড়ি কুলুঙ্গিতে রেখে
লক্ষ্মীর আসন পাতবো আমাদের নতুন সংসারে
আর কাউকে নয় , শুধু তোমাকেই বলছি কালকেতু ...
আখেটিক : চার
এখন তো বন-ই নাই
তীর ধনু তুলে রেখেছি ঘরের মাচায়।
আমানির গর্ত নাই। দুটাকা কেজির ধরে চাল ।
ফ্যানভাতে দিন চলে যায় ।
একশো দিনের কাজে কুড়িয়ে বাড়িয়ে
একটু আধটু শখ আহ্লাদও মেটে।
সেই কবে ট্যানা ছেড়েছি, মনে নাই ...
এখন এই কস্তাপেড়ে হলুদ ডুরের এই ন'হাতি কাপড়।
সব ই তো জানো তুমি !
তবু ঘরে ফিরে এসো লক্ষ্মীসোনা বিকেল বিকেল।
কী জানি কী হয় চারদিকে!
দিন দুপুরে রাত নেমে আসে প্রতিদিন।
কী জানি কী হয় রোজ ! ভয় হয় তোমাকে নিয়েই।
কে কবে যে তোমাকেই ভেবে নেবে যোগ্য শিকার !
ভয় হয় প্রতিদিন সকালে দুপুরে ,
ভয় হয় প্রতি সন্ধেবেলা।
ঘরের টঙেতে ওড়ে প্রতিদিন রঙ বেরঙ কত শত শালু
সকালে বিকেলে ওড়ে ভিন্ন ভিন্ন এ ফুল ও ফুল …
এর ওর নির্দেশ মতো আজ্ঞাবহ উড়িয়েছে এর ওর টঙে
এর ওর মর্জির মতো পতপত নিজেদের কাপড়ের রঙ
তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এসো ।
কাজ নাই ভাতকাপড়ে কাঁসার থালায় --
কাজ নাই জামবাটি টিপে ও সিঁদুরে --
এটুকু তো বুঝে গেছো
তেলের কুপির চেয়ে ঢের বেশি অন্ধকার ইলেক্টিরি আলো ...
সন্ধে নামার আগে বাড়ি ফিরে এসো কালকেতু।
আমিও অপেক্ষা করি সারাদিন টানটান ছিলার স্বভাবে ---
আমানির গর্তে দেখো আবার আগের মতো
ছলছল করে উঠবে দ্বাদশীর চাঁদ ...
ঘরে ফিরে এসো কালকেতু
আর তোকে যেতেই দেবো না …
আখেটিক : পাঁচ
আমিও তোমার চোখে চোখ রেখে চিনে নিই
ঝরে পড়া শালপাতা, ধূলোওড়া বিকেলের পথ
জিরেনকাটের রসে ধোঁয়া ধোঁয়া শীতের সকাল,
বোঝাই ধানের গাড়ি, জোয়ালের কঠিন শাসন,
হট্টরোলে হাটবার, ফসলের হাসিমাখা পৌষ
তরতরিয়ে চলে যাওয়া পিঠেপুলি রোদের চাদর,
সদ্যোজাত বাছুরের ছোটাছুটি তিড়িং বিড়িং --
এ সবই তোমার চোখে চোখ রেখে চিনি প্রতিদিন
তোমার অজান্তে রোজ ধুলো মেখে মুখ মুছি তোমার আঁচলে --
তোমার আঁচলে খুঁটে এই দেখো বাঁধা আছে
সন্নিপাত নিবারণী কালোজিরে, নুনের পুঁটুলি —
লুকিয়ে লুকিয়ে ভিন জন্ম থেকে আনা বুনো শিকড়ের জড় …
আখেটিক : ছয়
তোমাকে দেবার মতো স্নেহময় বটতলা, ভিটেমাটি,
শাপলার তিরতিরে নীলাভ সকাল--
আজ আর কোনো কিছু নেই --
এই দেখো মৃত ডানা , ফড়িঙের শেষ শ্বাসবায়ু।
ভাসমান শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ঘুমিয়ে রয়েছে যেন
প্রতিদিনকার ম্লান অপরাহ্ন আলো--
তোমাকে দেবার মতো
নিঃশ্বাসের মতো সত্যি প্রতি মুহূর্তের সন্ধ্যাদীপ
মান্য আঁধারের শান্ত অনর্গল জোনাকি ভূমিকা
কোথায় যে গেল!
আমার শরীরে ভাঙা কুলুঙ্গিতে মন্ত্রগুপ্তি প্রত্ন আগুনের,
খাঁজে খাঁজে খড়ের সংসার
শেকড়ে বাকড়ে মজে পরিস্রুত বৃশ্চিকের অনাবিল ছাই।
তোমাকে দেবার মতো আজ আর কোনো কিছু নেই
তবু দেখো, কেবল তোমারই জন্যে
আজ এই পড়ন্ত বিকেলে
ধুলো কাদা পাথর মাড়িয়ে , খড় ঠেলে ঠেলে
কাঁটায় কাঁটায় ঢাকা পথ থেকে
সমুদ্র মন্থন করে নিয়ে এসেছি ডুবে-থাকা অনন্ত পালক ...
আখেটিক : সাত
ঘর থেকে বেরোনোর আগে মাথায় ঠেকানো হলো না
যাওয়া আসার লাছদুয়ারে পোঁটলাবাঁধা বিজয়ার ফুল
বলা হলো না দুগ্গা ! দুগ্গা ! শ্রীহরি ! শ্রীহরি !
বলা হলো না যে ভালো থেকো, সাবধানে থেকো।
গরু বাছুর দেখো । লালমণি পালমণি পাল থেকে ফিরে এলে
ঠিকমতো জাবনা ঘাঁটা দিয়ো ।
খড় বিচুলি কেটে দিয়ো, জল দেখিয়ো সকাল বিকেল।
পায়রার ডিম ফেটে এতদিনে নিশ্চয়ই জোড়া পারাবত !
খোপ থেকে পড়ে গেলে, ভালো করে হাত ধুয়ে মুছে,
শুকনো করে তাড়াতাড়ি তুলে দিয়ো খোপে।
মানুষের নোনা হাত, নোনতা আঙুল ;
কী জানি কী ক্ষতি হবে ছোঁয়া লাগলে না-ওঠা পালকে !
রোঁয়া ওঠা শিশু-গায়ে সাবধানে হাত রেখে
যথাস্থানে তুলে দিয়ো ছোট পারাবত।
বলা হলো না যে
কতদিন হয়ে গেল তোমার আটপৌরে কাপড়ও ছিঁড়ে গেছে।
জানি আমি। ভালোমতো জানি।
আনবো আনবো করে আর আনাই হলো না !
কবে যে ধান উঠবে ! কবে যে ...
কতো কী যে ভাবি প্রতিদিন !
বলা-ই হলো না যে
এবার আশ্বিন এলে সব কাঁথা, বালিশ দুখান
উঠোনে বিছিয়ে দিয়ে ঝনঝনে রোদ খাওয়াবে।
তোরঙ্গের তিনখানা 'তোলা শাড়ি'
রোদে দিতে ভুলো না বিমলা।
পুজো-পালা-পার্বণে এই শেষ সম্বল তোমার।
কস্তাপাড় তো কী হয়েছে ! আমি বলছি , তা- ই পরো।
তোমাকে মানায় ভালো । মনে হয় প্রতিমা প্রতিমা !
বলা-ই হলো না যে
লোক তো লোকেরই মতো , কতো কী যে বলে বাঁকা ঠোঁটে !
লোকধর্ম লোকের স্বভাবে চলে , লোক থেকে লোকে।
ও নিয়ে ভেবোনা কোনো কিছু।
তোমার আমার ধর্ম অন্যকিছু। অন্য পাত্রাধার ।
আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে তাপ নিতে নিতে একযোগে বেঁচেছি দুজনে।
বলাই হলো না যে
মোওয়া করবে মুড়ি ও খইয়ের । নবান্নতে পিঠেপুলি কোরো ।
পৌষ পরবে পুরপিঠে।
তর্পণে তিল দিয়েছো বলে তিলপুর বানাতে ভুলোনা।
তিলপিঠে কোরো। ছেলেপুলেরা রইলো সব ।
ওদের বুঝিয়ে বোলো কোথাও না কোথাও আমি আছি।
ঠি-ইক বুঝে যাবে।
বলা হলো না যে
তোমার কোলের ছেলে একটু খ্যাপাটে ।
জানোই তো সব ; আমার ন্যাওটা খুব,
তিলপিঠে খেতে ভালোবাসে।
এঁটোলির মতো গায়ে গায়ে লেগে থাকতো দিনরাত , সকাল বিকাল —
পথে ঘাটে ঠিকমতো হাঁটতেও পারে না ।
এখন কীভাবে আছে ? কী জানি !!
সামলে রেখো ওকে । বুঝিয়ে বোলো যে ওর
ভাঙাচোরা সেলেট পাথরে
কাঁচা হাতে লিখে রাখা ঠিক বেঠিক সমস্ত বানানে
আমি আছি। ও-ই আমার মুখ।
মুছলেও কিছুতে মুছবে না...
বলা হলো না যে
সন্ধে হলে প্রদীপ জ্বালিয়ো। তুলসীতলায়
শাঁখ বাজিয়ো রোজ , আগের মতোই ।
আমি নেই তো কী হয়েছে ! এই তো এখানে আছি !
জোনাকির ঝাঁকে ঝাঁকে ! সন্ধ্যার প্রদীপে !
মুখ তুলে তাকাও বিমলা।
কোথাও যাইনি আমি। এখানেই আছি দিনরাত ।
ঠি-ইক দেখতে পাবে দেখো
ঠি-ইক দেখতে পাবে রাত্রিজুড়ে ...
কবি দুর্গা দত্ত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন