চতুর্থ বর্ষ ।। সপ্তম ওয়েব সংস্করণ ।। ৩১ আষাঢ় ১৪৩০ ।। ১৭ জুলাই ২০২৩



নির্বাচনকে এতখানি প্রহসনে পরিণত করা যায়, সম্ভবত এর আগে দেখেনি ভারতবর্ষের মানুষ। দেখেনি এতটা হিংসাত্মক নির্বাচনও। তাই বাংলার মুখকে এই নির্বাচন যে উজ্জ্বল করেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই!
          নতুন নির্বাচন কমিশনার রূপে নিযুক্ত হওয়ার পরক্ষণেই মহোদয়ের নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা, সেও আবার এক মাসের মধ্যেই, একটা সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করেছিল প্রথমেই। দিন যত গড়িয়েছে সেই সন্দেহ গভীর থেকে গভীরতর হতে হতে নির্বাচনের দিন এবং সেই নির্বাচনের ফল ঘোষণার দিন গিয়ে ঠেকেছে একেবারে অসীমে। যেখান থেকে আর নিঃসন্দেহ হওয়া সম্ভব নয়।
           তাহলে কি বাংলার রাজনীতিই দেশের সবথেকে কলঙ্কময় রাজনীতি? বাঙালিই সবথেকে জঘন্য রাজনীতির স্রষ্টা?
           একটা কথা অবশ্য প্রচলিত আছে, বাংলা আজ যা ভাবে, দেশ তা ভাবে কাল। হয়তো হতেও পারে, বাংলা থেকেই এই রাজনীতির সূত্রপাত। এবং ধীরে ধীরে তা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়বে। জয় হবে বাঙালির। বাঙালিই যে বুদ্ধিমান!


উত্তম মাহাত, সম্পাদক 



______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
প্রতুল মুখোপাধ্যায় / সমীর দে রায় / দুর্গা দত্ত / রূপক চট্টোপাধ্যায় / সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় / অঙ্কন রায় / নির্মল হালদার / ময়ূখ দত্ত 
______________________________________________


শুভ নববর্ষা

প্রতুল মুখোপাধ্যায়


আষাঢ় এবার দিল ফাঁকি। 
এ-কে বৃষ্টি বলে নাকি? 
মাসটা তো শেষ, কোথায় বৃষ্টি?
শ্রাবণে তাই পড়ুক দৃষ্টি। 
আয়রে শ্রাবণ ধারা নামুক।
গ্রীষ্মবাবুর খরা থামুক।
গরম এবার বড্ড বেশি। 
সবার ঘরে নেই তো এ সি।
রবি ঠাকুরের এতো গান- 
হচ্ছে তাদের অভিমান। 
মেঘলা আকাশ,সবুজ ঘাস।
অন্ন আনুক চাষির চাষ। 








সমীর দে রায়ের তিনটি কবিতা 


১.
রাত-শুক্তো


মাঝরাতে ঘুমে কাল শুক্তো উঠে এলো

পাটক্ষেতে টগবগ করে ফুটছে কাঁচকলা, মুলো, 
ভাঙা-চাঁদ, করলা বেগুন, ঝোড়ো হাওয়া  
জানলার ফাঁক দিয়ে মিঠে বাতাসের সাথে ঘাই মারছে 
রাঁধুনি-ফোড়ন গন্ধ, ঘিয়ে-ভাজা বড়ি, দুধে-বাটা মগজের ঘ্রাণ।    

সুদূর নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আজ 
স্নেহস্নিগ্ধ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার মা  
অদৃশ্য হাতায় উজাড় করে ঢালছেন সবুজের সমারোহ  
জ্যোৎস্নার থইথই দুধসাদা বাঁশকাঠি ভাতের ওপর।  

বাকি বন্ধ জানলাগুলো আজ আমি খুলে দিলুম—
এসো হে নিঝুম রাত, নিশাচরী প্যাঁচা, ঝিঁঝিঁ ও জোনাকি এসো 
হাওয়ার নিমঘ্রাণ সারা গায়ে মেখে— 
প্রান্তরের জ্যোস্নাময় অন্ন ও ব্যঞ্জন চলো চেটেপুটে খাই।  

তারপর শেষরাতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে একসাথে ভাতঘুমে যাবো। 




২.
বৃক্ষ স্বপ্নময়


পাতা জড়ো করে আনছে মেয়ে
তুষের আগুনে জ্বলছে ভুসোকালি মাখা ধানসেদ্ধ হাঁড়ি
দু-একটা শুকনো ডাল, কঞ্চি-টুকরো দুমুখো উনুনে পুড়ে খাক
মা শুধু দূরের জঙ্গলে চেয়ে বৃক্ষ দেখছে, স্বপ্নময়

কপালে ঘামের ফোঁটা গর্জন-তেলের মতো,
আগুনের আঁচে সে আজ ঈশ্বরী
বৃক্ষ হতে হবে তাকে—ডালপালা মেলে মহীরুহ

সে আজ স্থবির এই মধ্যাহ্ন-দুপুরে
পোড়া উনুনের তাপ, মাটি গেড়ে বুঝি পাশে বিঁধেছে শিকড়
বৃষ্টি এলে অঙ্কুরোদ্গম—
পদতল থেকে ঊরু নাভিদেশ বক্ষ কপোল জুড়ে 
একরাশ কিশলয় সবুজ পাতায়
বৃক্ষ হতে হবে তাকে—স্বপ্নময়

ওদিকে বিষুবরেখা, সূর্যতেজ—
ধান-শুকনোর চ্যাটা পেতে
কন্যে তার বসে আছে রোদে



৩.
দানাদার


অখণ্ড মণ্ডলাকার বলতে আমি সামনের টেবিলে প্লেটে রাখা দানাদারটাকেই বুঝছি। বেশ রসালো, কচকচে চিনির দানাগুলো পাহাড় পর্বত মালভূমি বা সমতলের মিনিয়েচার। গা দিয়ে টসছে রস সমুদ্রময়—মায়াবী আলোয় চকচক করে উঠছে। 

অন্তরীক্ষ থেকে পৃথিবী এমনটি মনে হলে তবে আমি ড্রোন হয়ে মহাকাশে ধ্বংসকর্তা হবো। কক্ষচ্যুত হোক আজ এই চরাচর—দু-দাঁতের ফাঁকে পিষে টুকরো টুকরো হয়ে যাক, লাভাস্রোতে ভেসে যাক বর্ণহীন রক্তধারা, অরণ্য-প্রান্তর। সূর্য শুষে নিক সপ্তসাগর মেরুদেশ।

তারপর মহাকাশে দুলতে থাকুক একরাশ খণ্ডখণ্ড পৃথিবী।

চেয়ারে ভক্ষক আর টেবিলে দানাদার—এখনও অখণ্ড, মুখোমুখি আমরা দুজন সন্ধের নীল আলোয় দাবা খেলছি।








দুর্গা দত্তের কবিতা 

শ্রাবণগাথা 
   
১.
কে কাকে যে ভালোবাসে কতোখানি বাসে 
কে যে কতোদূর কতোখানি জলস্রোতে 
নিজেরই অজান্তে প্রতিদিন 
ভাসায় মাতাল নৌকো , পাতার পোশাক ,
ঝরে যাওয়া পদ্মের শরীর কিম্বা 
লাল ঘুনসির পিছুটান -
 
কেউই না 
এমনকি 
সে-ও জানে না।


২. 
বৃষ্টি এলে তোমাকে খুঁজে পাই
আলোকলতা মুখ বাড়িয়ে থাকে
পায়ের পাতায় জলঝর্ণার ধ্বনি
বৃষ্টি এলে তোমাকে কাছে পাই

বৃষ্টি এলে তোমার সুরে স্রোত
ঘুমের ভেতর প্লাবন নিয়ে আসে
জন্ম জীবন ভাসিয়ে নিয়ে যায় 
দিকচক্রে অনন্ত গান ভাসে

বৃষ্টি এলে তোমাকে ছুঁয়ে থাকি 
বৃষ্টি এলে আকাশও ভিজে যায়
বৃষ্টি এলে শুকনো ঘরে একা
হাতের মুঠোয় বৃষ্টি নিভে যায় 

তোমার জন্যে বৃষ্টি সারারাত
তোমার জন্যে হাতের মুঠো খোলা
তুমিই জানো বৃষ্টি কাকে বলে
তুমিই জানো কোথায় অঝোর স্নান ...



৩. 
দূরে সরে যাচ্ছে সব ছাপ
তোমার পায়ের...

শিরায় শিরায় তীব্র শুনতে পাই আলো ফোটবার শব্দ
পাখিদের ওড়াউড়ি
অরণ্যের সোঁদা গন্ধ 
সরষে ক্ষেতের মধু 
অকালবৃষ্টির মৃদু ছাট --

কিছুই আর বাদ থাকে না।

গির্জার ঘণ্টার ধ্বনি 
হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকে বালির পাহাড়ে ।
অদীক্ষিত ফকিরের ঝুলি থেকে উড়ে যায সুশান্ত কবচ 
উড়ে যায় ফজরের অকূল নামাজ...

এসব কিছুর মধ্যে হয়তোবা 
কোনো কিছু কোথাও থাকে না --

একটাই ঘটনা। শুধু একটাই ঘটনা।

দূরে সরে যাও তুমি। কেবলই দূরের রেখা… 

পথে পথে পড়ে থাকে সব ছাপ তোমার পায়ের।

বৃষ্টির ফোঁটা কিম্বা বকুলের ফুল 
যে যাই বলুক একে 
শেষ অবধি পড়ে থাকো কেবল তুমি-ই--

আমার প্রতিটি শ্বাসে, প্রতি শ্লোকে
কেবলই তোমার ধ্বনি 
প্রতি জন্মে, প্রতিটি মৃত্যুতে...



৪. 
পথঘাট থেকে
নিজের স্বভাব দোষে কোনো কিছু না ভেবেই
কুড়িয়ে এনেছে কতো শুকনো পাতা
ঘাসবীজ,ভাঙাচোরা পাথুরে ময়ূর আর 
আকন্দের মূল...

কুড়োতে কুড়োতে
ডানাভর্তি শিশিরের ফোঁটা...

আলো ফোটবার আগে
শিশিরের গন্ধটুকু তোমার দুয়ারে রেখে 
সন্তর্পণে চলে গেছে নীলকণ্ঠ পাখি 

আবডালে ঘুমে থাকা অলিখিত কবিতার মতো -

যা তোমার কবিও জানেনা



৫.
নিহত সর্ষের ক্ষেত, 
দূরে মাঠে একা একা পড়ে থাকে 
হলুদের শব --

আকাশ জুড়েই চড়া রোদ

অলীক বসন্ত দিন স্বপ্ন দেখে ঃ - 

চোখে মুখে গান উড়ছে রঙ বেরঙের...








রূপক চট্টোপাধ্যায়ের একগুচ্ছ কবিতা 


১. 
ঝড়

 
এলোমেলো প্রবাহের অতলেও একটা,
 স্থিতধী জলচৌকি থাকে
 ধ্বংসের শেষ এসে বসার আর জলের ঘটি
 বাড়িয়ে দিয়ে হাতপাখা করার মানবীকে
 সব কথা বলে, বুকের পাথর কেটে কেটে
 নদীস্রোতের শব্দ শোনার! অথবা
খোলা জানালায় অবিন্যস্ত সবুজ সম্ভার দেখে
প্রেমিকের মতো
নতজানু হয়ে মেনে নেওয়ার বজ্র সমাধান, 
সব মেঘেদের কাছে!




২.
মেঘ


বিমূর্ত প্রেমিকার মতো এসেছো জানালায়।
কৃষ্ণবর্ণ রূপ খুলে দেখি বৃষ্টি সিক্ত অন্তরটুকু 
থৈ থৈ ঝর্ণা বহুল! কি যে মোহাবিষ্ট হয়ে
ভেসে যায় শ্রাবণ প্রান্তর। ভাঙা রেডিওতে 
বাদল সংবাদ বয়ে আনে আর
পিছু পিছু রবীন্দ্র যাপনের অমলিন সুর!
কানা লন্ঠন জ্বলে। বুড়ো গন্ধরাজ ফোটে।
আমি দেখি ধানের চারার নিচে জলের সঞ্চয়, 
আর মনে মনে ভাত গন্ধে তুমি যেনো
 এক মাথা চুলে ভেজা অপূর্ণ ইচ্ছেরা!




৩.
বজ্র 


অগ্নীভ লেখনী তুমি। কে জানে 
মেঘলা কগজে লিখো কার নামান্তর! 
ছায়াময় পাখির শরীর থেকে
ছিঁড়ে রাখো আগুন পালক। বহুকালের
জন্মান্তর থেকে ফেরা কোন চেনা মুখ
থমথমে কলতলায় তখনো
জলভরে একলাটি, নয়নে ব্যস্ত অভিসার! 




৪.
বৃষ্টি 


তোমাকে নিয়ে লিখতে পারি না বলেই
আমি শ্রাবণী সখ্যতায় রাত জাগি!
আজন্ম সহারা শরীরে 
ঢলঢলে মেঘ পরে
মনেহয় হেঁটে যাই তোমার বাড়ি!
তুমি স্মিত হেসে বাড়িয়ে দিও লাল চা
আর একপশলা গল্পের ভেতর না বলা 
বর্ণমালা রাস্তা পেরিয়ে শালবনে
তখন অঝোরে নামবে মেঘমল্লার! 






তোর

সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় 


কফি কাপ বেয়ে হবো ধোঁয়ার সকাল। 
ভুরুভাঁজ ধরে হবো ফাল-কাটা আল। 
আল জিভ হবো তোর গানের গলায়। 
গোপন জমানো কথা বুকের তলায়। 
গোপনাঙ্গে তিল হবো… খুললে বরাত। 
থালার কিনারে লাগা ঝুরোঝুরো ভাত। 
ঝিলিক ঝিলিক হবো চোখের আড়ে। 
হবো তোর ঠোঁটছাপ গ্লাসের পাড়ে। 
নেমে আসা চুড়ি হবো কব্জি বেয়ে। 
অথবা পরেরবার জন্মাবো মেয়ে —
স্নানঘরে মানা নেই, দরোজা খুলে
চলে যাবো যেন কোন মনের ভুলে। 
গ্রীবার পুলকে হবো কাঁটা শিরশির। 
শিরদাঁড়া সরণিতে আমি-দের ভিড়। 
থমকে যাওয়া শ্বাস তোর কথার মাঝে। 
এক ফোঁটা ঘাম হবো বুকের খাঁজে।  
হবো তোর গাল বেয়ে প্রথম অশ্রুজল। 
পায়ের আঙুল-চাপা লজ্জা অনুপল। 
আর কিছু হই না-হই তোর হবো, ‘তোর’।
প্রতি অঙ্গ লাগি তোর প্রতি অঙ্গ মোর।








আমার ঢালা গানের ধারা

অ ঙ্ক ন  রা য়


আষাঢ় দিল      মেঘের ছবি      আকাশ জুড়ে
মেঘ দিয়েছে     বাদলধারা        রবির পুরে।
তুই দিয়েছিস    আমার নামে    একটা খাতা
সেই খাতাটায়   জলপদ্যর         নানান পাতা।

বৃষ্টি দিল            মুক্তোফোঁটা     তোর দু'চোখে
চোখ দিয়েছে     আমার চেনা    মেঘকে ব'কে!
তুই দিয়েছিস     আমার হিয়ায়  তোর ও হিয়া
ঠিক যেখানে     সাঁঝের ঘরে      জ্বলছে দিয়া।

বাগান দিল        রংবেরংয়ের    ফুল সাজিয়ে
ফুলের দেওয়া    জলতরঙ্গে      সুর বাজিয়ে
তুই গেয়েছিস    সেই সুরে গান  হৃদয়কাড়া
মিশলো তাতে    'আমার ঢালা   গানের ধারা'।।









ঘর গেরস্থের শিল্প

নির্মল হালদার


বঁটি


বঁটিতে দু চারবার আঙুল কেটেছে মা মাসিদের, দিদি বৌদির এই তো স্বাভাবিক। রক্তের দেখা না পেলে সম্পর্ক যে পোক্ত হয় না। বঁটির সঙ্গে সহজ হতে হলে এক আধবার রক্ত দিতেই হবে। বঁটিও থাকবে ঘরে।

এক রকম নয়, তিন তিন রকমের বঁটি।আঁশ বঁটি। নিরামিষ বঁটি। ফল কাটার বঁটি। তিন রকম বঁটি নিয়ে সংসার চলে।

আঁশ বঁটিতে মাছ মাংস কাটা হবে। শাকসবজিও কাটাকুটি করে। একেবারে নিরামিষাসীদের জন্য নিরামিষ বঁটি। অনেক পরিবারেই অনেকে আছেন যারা পেঁয়াজ - রসুন  ছোঁয়া স্পর্শ করেন না। নিরামিষ বঁটিও তাই আঁশের ধারে--কাছে আসবে না একেবারেই।

ঠাকুর ঘরের বঁটি ঠাকুর ঘরেই থাকে। ফলমূল কাটে। শুদ্ধ শান্ত হয়ে থাকে চুপচাপ।

এ সমস্ত বঁটি কামার ঘরের বঁটি।

কামার শালে হাতা খুন্তি কড়াই তৈরির পাশাপাশি বঁটিও তৈরি হয়। আজও। আজও ধুকধুপ করে চললেও কামারশাল গ্রাম বাংলায় চলে। কোথাও কোথাও।

মাছের বাজারে যে সমস্ত বড় বড় বঁটি দেখা যায় তা আসে হুগলির কামারকুন্ড থেকে। পুরুলিয়ার ঝালদাতেও লোহার সামগ্রী তৈরি হয়ে থাকে। পুরুলিয়ার বাজারে দেখাও যায়।

পুরুলিয়ার ছোটখাটো মেলা বড় মেলাতে লোহার হাতা খুন্তি কড়াই বঁটি ও ছুরির দোকান বসে।

বিহার ও ঝাড়খন্ড থেকেও লৌহজাত সামগ্রী মেলাতে মেলাতে আসে বিক্রির জন্য। মহিলাদের কাছে চাহিদাও খুব।

নারকেল কোরার জন্য আরেক রকম বঁটি আছে, যার মাথা মোরগের ঝুঁটির মতো। যার সাহায্যে নারকেল কোরানো হয়। সেই বঁটিতে ফল কাটাও হয়ে থাকে। বঁটির নাম মাহাত্ম্য মহিলাদের কাছে থাকলেও আমার কাছে কামার বা কর্মকারদের বিশেষ একটি বিষয়, পুরুলিয়া জেলায় অনেক কর্মকার আছেন, যারা একসময় লিখে গেছেন ঝুমুরের পদ। তার মধ্যে চামু কর্মকার।অখু কর্মকার। উদয় কর্মকার। পরেশ কর্মকার।  কৃত্তিবাস কর্মকার এছাড়াও আরো অনেকে আছেন। কামারদের সম্পর্কে একটি প্রবাদ শোনা যায় : 
                       ঢোলে গামহার
                       ঝুমুরে কামার।

কামার বা কর্মকাররা লোহার কাজে যুক্ত থেকেও রসিক হয়ে আছে পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতিতে।




২.
কুলো


বাঁশের তৈরি একটি কুলো।

কালিন্দী বা ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ ঝুড়ি ঝ্যাঁটার সঙ্গে তৈরি করে কুলো। কুলোর সমস্ত বাঁধন বাঁশের বাঁধন।

কঠিন বাঁধন।

কুলোর তিনটে বেড় দেখলেই মালুম হয়, কুলো-কারিগর, কারিগর নয়, শিল্পী। কুলো থেকে সহজেই পড়ে যাবে না ধান গম চাল।কুলোর পিছন দিকটি নিচু যেমন, উপরের দিক উঁচু।

পাছড়াতে পাছড়াতে চাল থেকে উড়ে যায় আবর্জনা। চাল বা গম থেকে আলাদা হয়ে যায় বালি ও কাঁকর।

ঘর গেরস্থে কুলো অপরিহার্য।

কুলো নিয়েই পূজার্চনা হয়ে থাকে।

কুলোর বাতাস দিয়ে তাড়ানো হয়ে থাকে ঘরের অলক্ষীকে।

কুলো আমাদেরই।

সেই কুলো শিল্পীরা এই বাংলার গ্রামে গ্রামে। তাদের খোঁজ ক'জনই বা রাখি! ক'জন  জানি, তাদের ভাঙাচোরা জীবনের ছন্দে ছন্দ মেলানোর আর কেউ নেই।

ক'জন জানি, চড়াই-উৎরাই।

কুলোতেই তো  ফুল ফল রেখে ঘরে অভ্যর্থনা করি নতুন মানুষ।

নতুন আলো।

সূর্যোদয়।





 
ডাইরীর ছেঁড়া পাতা --- থাইল্যান্ডের ক্যারাওকে...

ময়ূখ দত্ত


এই দেশটাতে ক্যারাওকে গানের খুব চল আছে (ব্যাকগ্রাউন্ডের রেকর্ডেড ইন্সট্রুমেন্ট ট্র‍্যাক বাজিয়ে নিজের গলায় গান গাওয়া)। জাপানে তৈরী হওয়া এই বিনোদনের বয়স খুব বেশী বছরের হয়তো নয় (সাতের দশকে), কিন্তু শুধু এই দেশটাতে নয়, আশেপাশের সবকটা দেশেই, (মানে জাপান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া..)এই ক্যারাওকে সংস্কৃতিটা সমাজের সর্বস্তরেই আছে। খুব জনপ্রিয় বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। তবে এই বিনোদনের মধ্যেও আবার রকমফের আছে!! পয়সাওয়ালা মানুষদের জন্য বা ট্যুরিস্টদের জন্য অনেক "ক্যারাওকে বার" আছে, যেখানে অন্য যে কোনো আধুনিক শহরের মতো গান-বাজনা ছাড়াও পানীয় ইত্যাদির ঢালাও ব্যাবস্থা থাকে। সুন্দরী, স্বল্পবসনা 'ওয়েট্রেস'-রা আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে...এটা নতুন কিছু নয়!! যেটা থাইল্যান্ডে আমাকে একটু অবাক করল সেটা হল থাইল্যান্ডে সাধারণ সরকারী আউটডোর পার্কেও প্রতি সন্ধ্যেবেলা একদল মানুষ স্পীকার, মাইক্রোফোন ইত্যাদি নিয়ে এসে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে নিজেরাই ক্যারাওকে ট্রাক বাজিয়ে গানবাজনা করছে.... অধিকাংশই অত্যন্ত বেসুরো, তালের কোনো হয়তো ঠিক নেই, ক্যারোওকের বাজনা যদি কাশ্মীরের দিকে তো গায়কের গান হয়তো কন্যাকুমারীর দিকে চলছে, কিন্তু তাতে কারুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই!! বেশীরভাগই বয়স্ক/ মধ্যবয়সী মানুষ!! কেউ কেউ আবার হাতে লাঠি ধরে হাঁটাহাঁটি করছেন...কিছু কিছু মানুষ আবার নিজেরাই জুটি বেঁধে বেসুরো গানে নিজেরাই ছন্দ খুঁজে নিয়ে নাচছেন বা বলা ভাল, হাত-পা নাড়ানোর চেষ্টা করছেন!! অনেকে তো বাড়ি থেকে টিফিনবক্স ভরে খাবার নিয়ে এসে সেই বেসুরো গান শুনতে শুনতে পার্কের বেঞ্চে বসে নিজের মনে তাল ঠুকতে ঠুকতে সঙ্গীর সাথে ডিনার করছে। ওদের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় সময়েই ওই বেসুরো, অসহ্য গানের গুঁতোর থেকে এড়াতে আমি কানে গুঁজে দিই আমার ইয়ারবাড!! এভাবেই চলছিল, একদিন হঠাৎ শুনতে পেলাম এক সুরেলা গলা, কি মনে হতে আমিও সেদিন বসে পড়লাম পার্কের একটা বেঞ্চে.... সাধারণত এখানকার স্থানীয় মানুষ ছাড়া কেউ এই পার্ক ক্যারাওকে গান মন দিয়ে শোনে না, তাই হয়তো আমাকে বেঞ্চে বসে গান শুনতে দেখে পাশে এক মধ্যবয়সী থাই ভদ্রলোক একটু যেচেই আলাপ করতে এলেন...তারপরে আমার থাই ভাষাতে কথাবার্তা চালানোর অক্ষমতা আর ওনার ইংরেজির সীমাবদ্ধতাতে অনেককিছু বোঝা বা জানার ইচ্ছে থাকলেও বেশীক্ষণ কথাবার্তা চালানো গেল না... আধা ইংরেজী, আধা আভাসে ইংগিতে এটুকুই শুধু বুঝলাম - জীবনের হাজার প্রতিবন্ধকতার মাঝে এই মানুষগুলো অনেক দূর দূর থেকে বিকেলবেলা এই পার্কে ছুটে আসে আরো কিছু সমমনস্ক মানুষের সাথে নিজেদের সুখ-দুঃখের কিছু কথা শেয়ার করার জন্য, কিছু সহমর্মিতার জন্য!! কিছুটা সময় অন্যভাবে কাটানোর জন্য... ক্যারাওকে গান তো একটা বাহানা মাত্র!! এই যে দু-তিন ঘন্টার বেসুরো গান, অক্ষম, বেতালা নাচ - এসবই ওদের এই শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও হয়তো জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে... চরৈবেতি... আরও একটা কথা মনে এল-   জীবনের সুর, তাল মেলানোর জন্য বাইরের দুনিয়া কি সুরে গাইছে, গানের স্কেল কি, কার কি যায় আসে? সেটা কি খুব দরকারী? অতি সাধারণ ছন্দের দলবদ্ধ সাঁওতালি নাচকে কি কোনদিন আমরা ব্যালে, জ্যাজ বা আমাদের নিজেদের কত্থক, ভারতনাট্যমের সাথে তুলনা করতে পেরেছি? অতি সাধারণ কথায়, খুব বেশী হলে হয়তো "আদিবাসী নৃত্য" ক্যাটাগরিতে ফেলে রেখেছি!!  কিন্তু, সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরে মহূয়ায় মাতোয়ারা ধামসার ড্রিম ডিমাডিম গম্ভীর আওয়াজের সাথে সেই নাচ দেখতে দেখতে আমার মত অনেক বেতালা, বেসুরো মানুষজনও প্রতিসময়েই হয়তো পা নাচাতে আরম্ভ করি, নিজের অজান্তেই জীবন উদযাপন করি, উদযাপন করি প্রতিটি শ্বাস নেওয়ার সবথেকে দামী মুহূর্তটা, সেই সাফল্যটা...!! শিল্প, সাহিত্য, গান-বাজনার মূল উদ্দেশ্য যদি মানুষের মনকে ছুঁতে চাওয়া হয়, যদি দৈনন্দিন জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে ভুলে কিছুটা সময় আনন্দ করে কাটানো হয়, সমাজের ভ্যালু সিস্টেমকে জানা-বোঝা-জানানো হয়, নিজেকে সেই সমাজে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তবে থাইল্যান্ড পার্কের এই বেসুরো, বেতালা গানও হয়তো উদ্দেশ্য সাধন করে চলেছে প্রতিদিন... 

ক্যারাওকের বেসুরো গান শুনতে শুনতে আমার কাছে কোথাও যেন ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি, মুরগুমা,  থাইল্যান্ড মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়!!





______________________________________________
আগের সংস্করণের পাঠ প্রতিক্রিয়া 
______________________________________________
১/ চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর উজ্জ্বল মাহাত-র সৃষ্টিগুলি দেখলাম। 
চমৎকার। 
বিশেষত ভাস্কর্যগুলোর বেশ কয়েকটি গভীর  ব্যঞ্জনাময়! 
একটি মই বেয়ে উঠতে থাকা নবীন তরুলতার প্রতিটি ধাপে রয়েছে ধারালো ছুরি-- প্রতি মুহূর্তে এই সংহারের আশঙ্কা, পাশাপাশি নবীন প্রাণের অপরাজয়-- বিপরীতধর্মী এই দুই বার্তার তরঙ্গ দর্শককে সম্মোহিত করে। 
এই ভাস্কর্যটির প্রায় পরিপূরক আরও দু-একটি কাজ অবশ্য অতিরিক্ত মনে হলো। 
"উড়ান", মাকড়শার জাল দিয়ে তৈরি খাঁচায় বন্দী কুটুম কাটামের মতো দুটি পাখি, তালা দিয়ে তৈরি হাঁসের ঝাঁক ইত্যাদি অনবদ্য।
                            -----------গল্পকার স্বপন চক্রবর্তী

২/ আজ চুপ থাকব সারাদিন।

*তোমার সম্পাদকীয় পড়েই এই সচেতন সিদ্ধান্ত, কেননা এই চরম উলঙ্গ সত্যের সামনে নিজের প্রতি ঘেন্নায় আর নিদারুণ লজ্জায় নতমস্তকে নীরব থাকাই শ্রেয়।

*রাস্তার মোড়ে মোড়ে এই কথাগুলো মানুষের অবগতির জন্য ও জনসচেতনার বিকাশের জন্য ফ্লেক্সে হোর্ডিয়ে টাঙ্গিয়ে রাখা প্রয়োজন।

*আমার অশেষ প্রীতি জানাই।

তুমি হীরের টুকরো ছেলে। 

ভালো থেকো সকলে।

*কবিতা পরে পড়বো।
শরীর ভালো নেই, ভাই।
গত পয়লা জুন সকালে বাজারে ফেন্ট হয়ে একাকার কান্ড হয়েছিল।
এখন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হচ্ছে।
                                      ------------কবি পঙ্কজ মান্না 

৩/ অনবদ্য উজ্জ্বল মাহাত!  ওর একক প্রদর্শনী হলে খুব ভালো হত।
                             -----------কবি সোমেন মুখোপাধ্যায় 

৪/ চমৎকার হচ্ছে প্রতিটি সংখ্যাই। এই সংখ্যার সম্পাদকীয় মনে থাকবে। বেশ।
                                            ------------কবি তপন রায় 

৫/ খুব জ্যামিতি আছে এবারের তোমার প্রদর্শনশালায়। ভালো লাগলো কাজগুলো। কেমন জ্যামিতি, অ্যাবস্ট্রাক্ট, রেখা এবং রিয়েলিস্টিক মিশিয়ে করেছে কাজগুলো।
                     -----------কবি মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

৬/ সম্পাদকীয় খুব ভালো লাগলো। বাস্তবতায় মোড়া। সকলের কবিতাই মন ভরিয়ে দেয়।
                                          -----------কবি অমিত মণ্ডল 

৭/ উজ্জ্বলের কাজ সম্পর্কে আমরা অনিকেতের বন্ধুরা কমবেশি সকলেই পরিচিত। অরন্ধনের এই পেজে ওর কাজের উজ্জ্বল উপস্থিতি ভালো লাগলো।
                                             ---------দেবমাল্য মাহাত

৮/ খুব ভালো কাজ। একটা একক প্রদর্শনীর দাবি রাখছি। শিল্পীকে অভিবাদন।
                            ----------কবি দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

৯/ চমৎকার কাজ। স্নেহাশীর্বাদ থাকলো। উজ্জ্বল থেকো।
                                          -----------নামহীন কেউ 

১০/ অত্যন্ত আনন্দিত এবং নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে- বাড়ীর পাশের উজ্জ্বলের শিল্পকর্ম দেখে - উজ্জ্বলের পাশের গ্রামেই থাকি অথচ তার এত গুনের বিষয় অজানা ছিল ৷ অনেক শুভেচ্ছা জানাই শিল্পীকে❤️
                                           -----------নামহীন কেউ

১১/ অনেক ভালো কাজ একসঙ্গে দেখার আনন্দ অপরিসীম।
                                             -----------সমীরণ ঘোষ

______________________________________________



                                 আমাদের বই









সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ :  প্রকাশ কর্মকারের পেন্টিং, আন্তর্জাল
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪