চতুর্থ বর্ষ ।। দশম ওয়েব সংস্করণ ।। ১০ ভাদ্র ১৪৩০ ।। ২৮ আগষ্ট ২০২৩
বিতর্ক থাকবেই। আমাদের ভারতবর্ষে যেখানে এখনও সমস্ত মানুষের কর্মসংস্থান নেই। অন্নসংস্থান নেই। সেখানে চন্দ্রাভিযান মিশন নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। কিন্তু সেই বিতর্কের মাঝেও বিজ্ঞান গবেষণায় এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। তবেই ভারতবর্ষের পক্ষে জগৎ সভায় আবার শ্রেষ্ঠ আসন নেওয়া সম্ভব।
আমাদের চন্দ্র মিশনের যা খরচ তার থেকে বেশি খরচ করে একটা বলিউড মুভি তৈরি করা হয়। সেই মুভি আবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে টাকাও কামিয়ে নেয় চারগুণ। সেক্ষেত্রে কী মনে হয়, সেই মুভির লাভের অঙ্কটা কেবল আর কেবল বড়লোকেদের টেঁক থেকেই আসে? অথবা গরীব লোকেরা সেই মুভি দেখেই না?
যে সকল মানুষেরা সামান্য একটা আড্ডাতে বা নিজেদের ঠেকে এক বসাতে গরীব পরিবারের একমাসের সংসার খরচের সমতুল্য টাকা লালজল-পানে ফুরিয়ে দেয়, তাদের আবার চন্দ্র মিশনের বিরোধীতা মানায়? তাও আবার দেশে এখনও গরীব মানুষের অভাব নেই, না খেতে পাওয়া মানুষের অভাব নেই, এমন অছিলায়?
আমাদের দেশের চন্দ্রাভিযান করতে যেখানে ৬৫০ কোটি টাকা খরচ হয় সেখানে একজন চোরই তো ৯০০ কোটি টাকা চুরি করে বিদেশে পালিয়ে যায়। তাই, এই গরীব দেশে একদিকে যেমন গরীব মানুষের অভাব অনটন দূরীকরণের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে সরকারকে তেমনই বিজ্ঞান মিশন গুলোকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তবেই সামগ্ৰিকভাবে সাফল্য আসা সম্ভব।
এবার আসি অন্য কথায়। কেবলমাত্র মোদী বিরোধীতাকারীদের কথায়। তাদের কথায় নাকি চন্দ্র মিশনের সমস্ত সুনামটা মোদীই নিয়ে নিলেন। যদি মোদী না থেকে অন্য কেউ রাষ্ট্র প্রধান থাকতেন, তিনি কী এই সুনাম না নিয়ে থাকতেন? কিম্বা সেই সুনাম কী চন্দ্র মিশনের সমালোচনাকারীদের দেওয়া দরকার ছিল? অথবা বিজ্ঞানীরা যে কাজ করে দেখিয়েছেন সেই বিজ্ঞানীদের নামের জায়গায় কী মোদির নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকা সম্ভব? আমার মনে হয় মোদী অন্তত বর্তমান সময়ে একজন রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে আমাদের দেশকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করে চলেছেন সুচারুরূপে। নিয়ে চলেছেন বেশ কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। যা করার মতো ক্ষমতা সমসাময়িক কোনো বিরোধী দলনেতা, দলনেতৃর মধ্যে চোখে পড়ছে না। ভুল বা ঠিক সে প্রশ্নে না গিয়েও বলতে পারি দীর্ঘদিনের জং লাগা ভারতবর্ষকে নাড়িয়ে দিয়েছেন মোদী। সেক্ষেত্রে মোদীর কিছু দোষ থাকলে, এই দেশে দুধ কা দুলহা হে কোন্ ভাই? সবাই তো একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
প্রবীর ভট্টাচার্য / দেবাশিস সাহা / গৌতম দত্ত / তপন পাত্র / সুশান্ত সেন / সুজন পণ্ডা / ময়ূখ দত্ত
______________________________________________
প্রবীর ভট্টাচার্যের কবিতা
১.
অভিসার
আলো নেই
আঁধারহীন
ছায়া নেই
প্রচ্ছায়া কেন?
নিবিড় বনভূমি
বিপন্ন অভিসার!
২.
শান্ত তরবারি
এমন শান্ত সমিধ্ চাই
তোমার নির্জন,
নিশীথ হাওয়া কোথায়?
আগে তোমার রূপ
তারপর বহুরূপী
শেষে চাই
শান্ত তরবারি!
দুটি কবিতা
দেবাশিস সাহা
১.
রুপোর ঝিনুক
ডানায় ঝটপটিয়ে উঠলে অনির্বাণ কাক
শূন্য ও সুন্দরের মাঝখানে রাখা
রুপোর ঝিনুক, সাবধানে খুলি----
চিরতুষারাবৃত আঙুল ঘুরে দাঁড়ায় স্বরবর্ণ
সারারাত জলশব্দ শুনি : নদী এবং তোমার
কিছুটা অনৈতিহাসিক হয়তো-বা ----
বাল্মীকির উইঢিবি থেকে উড়ে-আসা বল্মীক
ডিঙিয়ে যায়
শূন্য ও সুন্দরের মাঝখানে রাখা
রুপোর ঝিনুক
২.
বেহিসেবী
যে - মানুষটা বৃষ্টির ফোঁটা দিয়ে
কবিতা লিখত
রামধনু পেড়ে এনে সাত রঙ লাগাত
চাদরে - বালিশে
পথ হারানোর পথে হারিয়ে ফেলত
বাজারের থলে
কোথায় কোন দিকে গড়ালো আলু-পটল-ঝিঙে ফিরেও তাকাত না
ছেঁড়া জামার বোতামগুলো উড়ত কঠিন হাওয়ায় লোকটা তবু নির্বিকার
কোথাও বেড়াতে গেলে দু'চার খণ্ড এলোমেলো
মেঘ,এক আধটা মজা নদী,পাখির কিচিরমিচির ভর্তি ছোটখাটো দু-একটা টিলা আর
গুচ্ছের লতা-গুল্ম
ব্যাগে পুরে সারা প্লাটফর্ম জুড়ে লাগিয়ে দিত
তুমুল হইচই
ফিরে, চওড়া হাসি হেসে
ঝোলা থেকে নামিয়ে রাখত বড় বড়
পাহাড়-নদী-ঝরনা
তারপর
বেহিসেবীর মতো খরচ করে ফেলতো
গোনা গুনতি রাত
চাঁদ - তারা দূরে থাক
সারা জীবনে যে-মানুষটা এক আঁটি খড়ও
কিনতে পারেনি
এত নক্ষত্রে তার দুচোখ ভরে উঠল কেমন করে ভাবি...
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু
গৌতম দত্ত
অবসন্নতা ঘিরে ধরে খুব
অবসন্নতা ঘিরে ধ'রলে
দীঘির ধারের সেই খেজুরগাছটার কথা ভাবি
জলের ওপর নুয়ে প'ড়ছে তবু মাটি তাকে কোলে ক'রে
ধ'রে রেখেছে মায়ের মতন
দেখি একটি শালের চারা
কেমন দু'চোখ মেলে হাসছে
ঝরাপাতার রাশের ভেতর
অবসন্নতা ঘিরে ধ'রলে
আমি শালবীজ হ'য়ে ঢুকে যাই
শিশুটির হাতের মুঠোয়
আকাশ না মেঘ
তপন পাত্র
১.
তোমার চোখের হাওয়া
আমাকে উপুড় করে ফেলছে মাটিতে।
তোমার কথার ঝড় খুলে ফেলতে চাইছে আমার অন্তর্বাস
আর
তুমি আরো ততো অহংকারী হয়ে উঠছো।
ভেঙ্গে যাচ্ছে,
ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে আমার বিশ্বাসের অহং।
শেষমেষ আমি যা বুঝলাম,
তোমার কাছে সম্পর্ক মানে একটা ডিসপোজেবল্ সিরিঞ্জ।
২.
আমি খড়কুটো দিয়ে শান্তি বানাতে চেয়েছিলাম।
তুমি দামি ফার্নিচারের ভিতর সাজিয়ে রাখতে চাইলে সুখ।
বাবুইয়ের মুখে ঝুলছে খেজুর পাতার সুতো।
তুমি সেটা মুখোশ ভাবছো,
আসলে ওটা বাসা।
সুখ ও শান্তির মধ্যে তেমন কোনো আত্মিক সম্পর্ক নেই,
জানো...
৩.
সবুজ ঘাসের দেশে বসে
যেদিকে নজর গেল
ওটা নীল আকাশ, আমি তো তাই জানতাম।
তুমি ডোবার পাশে বসে
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলে, অন্তত এই একটা জায়গায় বিশ্বাস ভাঙ্গা যায় না!
আমি যখন পেলব মায়ায়
সযত্নে তোমার বুকের রক্তক্ষরণ মুছে দিচ্ছি
তখন তুমি পিছন থেকে বসিয়ে দিচ্ছো ছুরি।
ভুল আমারই ...
যৌথ হৃদয়ের তানপুরা ভেবে আমি যেখানে হাত রেখেছিলাম,
সেটা আসলে বেশ্যার পাছা।
৪.
কংক্রিটের অহংগর্ভ থেকে জন্ম নিইনি আমি,
জন্ম আমার চাষার ঘরে
স্যাঁতসেতে মাটির উপর।
একমুঠো ভাতের জন্য গতর খাটাতে হয় আপ্রাকযৌবন।
ঈর্ষা জাগেনি কোন,
ঈর্ষার দাসত্ব করে না মানুষ।
কিন্তু মানুষ মানুষ না হলে সবুজ ঘাসের দেশে বসে যেদিকে নজর যায় ওটাতো আকাশ নয়,
মেঘ
ঈশানের পুঞ্জ মেঘ।
৫.
বয়ে নিয়ে যেতে কোন আপত্তি নেই,
কিন্তু আগ্রহও তো নেই।
যন্ত্রণাকে ভালোবাসা নিতান্ত কঠিন।
তবুও তো ভালোবাসে কেউ কেউ,
বাসতে হয়।
অতীতের অনেক কিছুই,
অভ্যাসের অনেক কিছুই মানুষকে দায়বদ্ধ করে।
স্বাতী নক্ষত্রের জল তখন ঝিনুকে পড়ে না,
কোনো কোনো দম্পতির হৃদিহীন আকস্মিক মিলনের মতো পাথরে বৃষ্টি পড়ে,
প্রতিটি ফোঁটার শব্দ পৃথক পৃথক...
সম্পর্ক
সুশান্ত সেন
কারও সাথে কারও সম্পর্ক না থাকলে কেমন হয় !
তাহলে আর সমাজ সমাজ খেলা টা থাকতো না।
গায়ে গায়ে লটকিয়ে লটকিয়ে এর ওর তার কাসুন্দি কাটা না থাকলে বেশ
মেঘ বৃষ্টি আকাশ দেখে সময় কাটিয়ে দেওয়া যেত,
অথবা পাহাড়ের কোলে কোন এক গুহায় বসে
বাইসন আঁকা যেতে পারতো অবিরাম।
ফিনিক ফোটা জোছনা
নিরাময়
সুজন পণ্ডা
বড় ঝিল দেখি। অনেক বড়। ওই পাশ কতো দূরে বোঝা যায় না।
রোজ?
না রোজ নয়। মাসে এক দিন দুদিন। বিশেষত পূর্ণিমায়।
আরো একটু খুলে বল
ওই দিনগুলিতে বিছানায় শুয়েছি কি শুইনি ঘুমে জড়িয়ে আসে চোখ। পাতা ভারী হয়ে নেমে আসে আর শুরু হয় সিনেমার মতো। একটা বিরাট ঝিল। বড় বড় অর্জুন গাছে ঘেরা। চাঁদ নেমে আসে বেশ নিচে, যেন হাতের নাগালে।
এরপর চুপ করে যুবকটি। চোখে অবিশ্বাস আর ভয় খেলে যায়। আবার শুরু করে
ওখানেই নামে ওরা... শাদা পরীর দল। ছয় জন নেমে আসে।
কি করে তারা?
গান করে, নাচ করে... খেলে বেড়ায়। ঝিলে নেমে স্নান করে সাঁতার কাটে।
তা এ তো ভালোই... এতে ভয়ের কি আছে?
আপনি জানেন না। পরী দেখা ভালো না। অমঙ্গল হয়।
বুঝলাম। কিন্তু আমি কি করতে পারি? আমি কিভাবে সাহায্য করব তোমাকে?
আপনি পারেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিন। আমাকে সুস্থ করে দিন.....
আসলে আমি পারিনা কিছুই.. তবুও লোকের বিশ্বাস আমি হাত বুলিয়ে সারিয়ে দিতে পারি অনেক কিছু।
যুবকের কপালে আঙুল রাখি, আস্তে আস্তে হারিয়ে যাওয়ার সুর গুনগুন করি।
মিনিট খানেক মাত্র। যুবক তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়।
আমি বলি - কই নিয়ে চলো আমায় সেই ঝিলের পাশে..
যুবকের চেতনার পথ বেয়ে আমরা উপস্থিত হই সেই বিরাট সীমাহীন জলদেশে।
ওই তো ওরা, শাদা জ্যোৎস্নার পোশাকে শরীর ঢেকে নেমে এসেছে ছয় তরুণী। ওরা এই পৃথিবীর এই জগতের কেউ নয় মনে হয়...
যুবকটি ছটফট করে ওঠে।
আমি আমার হাত রাখি ওর হাতে, যুবক আত্মসমর্পণ করে।
ইচ্ছে করছিল সারারাত দেখি সেই মহাজাগতিক উপস্থিতি। সেই সৌন্দর্য, পৃথিবীর সাধ্য নেই তাকে আটকে রাখার।
প্রকৃতির কাছে মনে মনে মুক্তি চাই আমার হাত ধরে থাকা যুবকটির।
আর তারপরই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায় স্বপ্নের সেই জগৎ, সেই রহস্য।
ছয় তরুণী ছড়িয়ে পড়ে জলার পাশের জমিতে।
অবশেষে যখন যুবকটি তন্দ্রা ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ায় তার পোশাকে তখন অজস্র শাদা কাশ ফুলের রেনু।
সেই ঝিলে তখন শরৎ নেমেছে।
জীবনের রং - ৩৬
অথ শাড়ি কাহিনী....
ময়ূখ দত্ত
বাঙালি বাড়িতে দুটো জিনিস কেনা নিয়ে প্রায়শই ঝামেলা বাঁধে - সোনার গয়না আর শাড়ি!! উইকিপিডিয়া বলে, শাড়ি নাকি খ্রীষ্টের জন্মের ২৮০০ বছর আগে থেকে অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই প্রচলিত ছিল। মহাভারতের সময়কাল আমরা যদি খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০০ বছর ধরি, তাহলে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ যে আসলে শাড়িহরণ ছিল সেটা মিলে যায়!! যে পোষাক (শাড়ি) মহাভারতের মত একটা মহাযুদ্ধের কারণ হতে পারে, সেটা নিয়ে চর্চা হবে, কাটাছেঁড়া হবে তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না...
স্কুলে পড়ার সময়ে দেখেছি মা-মাসি-পিসিরা সারাদিনই ঘরে বা বাইরে শাড়ি পরে থাকত, অন্য কোনো রকম পোষাক বলতে চোখে পড়ত স্কুলের মেয়েদের ফ্রক... আর সেই মেয়েরাই সরস্বতী পুজোর দিনে হলুদ শাড়িতে কেমন যেন অজানা, অচেনা হয়ে উঠত!! আজ আমরা সবাই যখন গ্লোবাল দুনিয়ার বাসিন্দা, মেয়েদের কাছে অপশনও অনেক... আজ কি কোনো স্কুলের মেয়েকে সরস্বতী পুজোতে শাড়ি পরতে দেখলে ছেলেরা অবাক হয়ে তাকায়? মনে হয় না... ধীরে ধীরে আমরা তো কোনো ব্যাপারে অবাক হতেই ভুলে যাচ্ছি, এই ব্যাপারটাও কি সেরকমই নাকি শাড়ি তার উপযোগিতা হারাচ্ছে?
যাই হোক, যেটা বলছিলাম - আজকাল মেয়েদের কাছে অনেক অপশন, পরিস্থিতি অনুযায়ী পোশাক...সালোয়ার কামিজ থেকে, ফ্রক, গাউন, কত কি... আগে জানতাম Dress এর বাংলা - পোশাক, কয়েকদিন আগে জানলাম যে "ড্রেস" নিজেই নাকি আলাদা একধরনের পোশাক!! তাই মেয়েরাও আজ খুব টেনশানে দিন কাটায়, কখন কি পরবে, কোনটা মানাবে!! শীতের, বসন্তের বা গরমের পোশাক আবার আলাদা.. দিনের পোশাক এক তো রাতের পোশাক আলাদা!! এত ডামাডোলের মাঝে শাড়ি কোথায়? সাধারণ দিনযাপন ছেড়ে শাড়ি কি আস্তে আস্তে অসাধারন দিনের পোশাকে পরিনত হচ্ছে বা হয়ে গেছে? পুজোর চার দিনে বা কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে বা যে কোনো গ্ল্যামারাস অনুষ্ঠানে শাড়ি এখন 'চলতি' হাওয়ার পন্থী!!.. কোনো এক ফ্যাশান গুরুমাকে একবার বলতে শুনেছিলাম যে "... when unsure, wear a saree.." । তর্ক হতে পারে, তবে এটা হয়ত খুব শক্তিশালী একটা কথা, ভারতীয়, বিশেষত বাঙালী মেয়েদের ক্ষেত্রে...
শাড়ি কেনা বা পছন্দ করা নিয়ে প্রচুর গল্প/কথা প্রচলিত আছে...আমার এক বন্ধু তার বন্ধুপত্নীদের "শাড়ি কিনিয়ে দিতে" খুব ভালবাসে...কোথায় কী শাড়ি ভাল এসেছে, কত দাম, কত ডিসকাউন্ট দিচ্ছে, কোনটা আজকাল 'চলছে' - ইত্যাদি তার এক্কেবারে নখদর্পনে, এই সব ইনফরমেশন দিয়ে বন্ধুপত্নীদের প্ররোচিত করা?... এই কিনিয়ে দেওয়ার শখটা সত্যিই তার হবি নাকি এটা তার বাকি পুরুষ বন্ধুদের প্রতি প্রতিহিংসামূলক একটা ব্যবহার, সেটা নিয়ে আমাদের বন্ধুমহলে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে!!
তবে শাড়ির দাম যে কত হতে পারে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে বিয়ের আগে বাঙালি ছেলেদের প্রায় কোনো ধারনাই থাকে না। আমাদের ছোটোবেলায় দেখেছি রেশন দোকানে "জনতা শাড়ি" পাওয়া যেত ২৬ টাকাতে। বিয়ের পরে প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে (৯৭ সালে) খুব শখ করে বৌকে বলেছিলাম ".. চল, শাড়ি কিনে দেব..."। বাউন্ডুলে স্বামীর পছন্দে বেশী ভরসা না রেখে তিনি ভরসা করলেন তেনার বাবার পছন্দের ওপরে... বড়বাজারে প্রিয়গোপাল বিষয়ীর দোতলার দোকানে যাওয়া হল... কাঞ্চীভরম শাড়ি পছন্দ করলেন বাবা-মেয়ে!! শ্বশুরের সামনে লজ্জার খাতিরে শাড়ির মূল্য কত না দেখেই আমি কাউন্টারে দাম দিতে গিয়ে ক্যাশমেমোটা দেখে দুবার চোখ মুছলাম - দামটা ঠিকঠাক দেখছি তো!! ডেসিমেলএর গন্ডগোল হচ্ছে না তো? ৩৩৫০/- টাকা শাড়ির দাম, সেইসময়ে ৬০০০/- টাকা মাসমাইনে পাওয়া আমি তো কল্পনাও করতে পারি না যে আমার মাইনের ৫৫% চলে যাবে একটা শাড়ি কিনতে!! পকেটে এত টাকাও নিয়ে আসিনি, ৬০০০ টাকা মাইনে পাওয়া লোকের মানিব্যাগে এত টাকা থাকা স্বাভাবিকও নয়!!... শেষে সেই শ্বশুরমশাই কি বুঝলেন কে জানে, বললেন ".. আচ্ছা, আমি দামটা দিয়ে দিচ্ছি, তুমি আমাকে পরে ফেরত দিয়ে দিও!!" দোকানীর কাছে কোনোক্রমে মান বাঁচিয়ে বাড়ি ফিরে এসে কাঁদব নাকি বৌ-এর মান ভাঙাব বুঝতে পারছিলাম না...থাকতে না পেরে বলেই বসলাম-
- একটা শাড়ির এত দাম হতে পারে? এত দামী শাড়ি কিনলে?
" শাড়ির তো এরকমই দাম হয়!! সংসারের তো কিছুই জানো না, কিছুই শেখোনি...তা, তুমি কত দাম হবে ভেবেছিলে?"
- আমি তো জানি "জনতা শাড়ি'-র দাম ২৬/৩৬ টাকা হয়...
" কি? শেষে আমি 'জনতা শাড়ি' পরব? বিবাহবার্ষিকীতে আমাকে তুমি 'জনতা শাড়ি' গিফট করবে?" এক বছরের পুরোনো বৌ-এর গলায় কান্নাভেজা বিস্ময়বোধক চিহ্ন!!
- (একটু লজ্জা পেয়ে) আরে না না, ম্যাগাজিনের পাতায় করিশ্মা কাপুরকে দেখি কোহিনুর শাড়ির বিজ্ঞাপন দিচ্ছে বা দীপ্তি ভাটনগর মীনু শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে... এসব শাড়ির দাম তো দেখি ১০০/১২৫ টাকা... সিনেমার নায়িকারা যদি এসব শাড়ি পরতে পারে, আমি তো জানি এগুলোই সবথেকে বেশী দামের শাড়ি!! দেখতেও তো বেশ!!
"(হতবাক হয়ে) ওগুলো তো ছাপা শাড়ি!! বিবাহবার্ষিকীতে ছাপা শাড়ি দেবে আমাকে? এই ঘরের ভেতরে যা বললে বললে, বাইরে যেন বলো না! বাবা-মা খুব কষ্ট পাবে..."
নতুন দুনিয়ার অবাক করা এই ইনফরমেশন কীভাবে আত্মস্থ করব বুঝতেই বছর কেটে গেল!! নিজের অজ্ঞানতার প্রতি ঘেন্নায় এত বছর এই গল্পটা নিজের কাছেই চেপে রেখেছিলাম, আজ বেরিয়ে এল!!
শাড়ি পছন্দ করার আবার প্রচুর গল্প আছে!! অনেক রঙ্গ-রসিকতা আমাদের অনেকেরই জানা... যেকোনো কথায় স্বামীর সাথে একমত হওয়া বৌ শাড়ি কেনার ব্যাপারে সবসময়ে সেলসম্যানের কথাতেই বেশি ভরসা করে থাকে সাধারনত!! "বৌদি, আপনার যা পাকা গম দানার মত গায়ের রং, তাতে এই শাড়িটাই ভাল মানাবে.." বলে শাড়ি গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা সেলসম্যান গুলো আমার দুচোখের বিষ!! তবে একবার চমকে গিয়েছিলাম আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ে এক স্মার্ট, তন্বী, মধ্যবয়সী মহিলার কথায়...
".. দিদি, এই শাড়িটাতে আপনার বয়স এক্কেবারে দশ বছর কমে যাচ্ছে!!"
- তাই? তাহলে অন্য শাড়ি দেখান!! যে শাড়ি খুলে ফেললে আমার বয়স দশ বছর বেড়ে যাবে, সে শাড়ি আমি কিনতে চাই না!!
দোকানদারের মুখটা আজও আমার চোখে ভাসে!!
সঞ্জীব চ্যাটুজ্জের এক লেখায় পড়েছিলাম, এক ভদ্রলোক কর্তব্যপরায়ন স্বামীর মত বৌকে নিয়ে শাড়ির দোকানে গেছেন... পেছনে একটা টুলে নির্লিপ্তভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকতে দেখে আর বৌদির পছন্দের ঠেলায় একের পর এক শাড়ি নামিয়ে দেখাতে দেখাতে বিরক্ত হয়ে দোকানদার বলে উঠল -".. দাদা, আপনি বৌদিকে একটু সাহায্য করুন, শাড়ি পছন্দ করে দিন... আপনার পছন্দ নিশ্চই বৌদির পছন্দ হবে..."। দাদা বিষম বিপদে পড়ে নিরুপায় হয়ে শাড়ি দেখতে বসল বৌ-এর সাথে। কিছুক্ষণ দেখার পরে দোকানদার আর থাকতে না পেরে বলেই উঠল ".. দাদা, আপনি তো সব শাড়ির শুধু আঁচলটাই দেখছেন, গায়ের ডিজাইনগুলো দেখুন, পাড়টা দেখুন, শুধু আঁচল দেখছেন কেন?"
- কি আর করব ভাই, বৌদির আঁচল ধরেই তো আমাকে চলতে হয়, তাই ওটাই দেখছি, কোন শাড়ির আঁচলটা ভাল!!
শাড়ি যখন দৈনন্দিন পোষাক থেকে অনুষ্ঠান পোষাকে পরিনত হচ্ছে আজকাল, একটা শাড়ি সারা জীবনে কতবার ব্যবহার হচ্ছে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন!! কিন্তু এই প্রশ্নটা বাড়িতে রাখাটা সবসময়েই বেশ ঝামেলার....আগে আগে বাড়িতে দেখেছি দশটা পুরোনো শাড়ি জামা বিক্রি করে একটা স্টিলের ডেকচি বা খুন্তি কেনা হত, তাও তো কিছু মূল্য ছিল সেসব শাড়ির... এখন তো সেসবও অতীত!! অনেকবছর আগে বরোদাতে থাকার সময় দেখেছিলাম নবরাত্রির সময়ে নয় রাত ধরে চলা উৎসবে মেয়েরা চাঁদা করে ঘাগরা-চোলি তৈরী করেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতিদিন পরে ডান্ডিয়া খেলতে যায়!! একই রকম ভাবে আমি এক পুজোর আড্ডায় মহিলা মহলে বলেছিলাম, "তোমাদের সবার আলমারীতে পড়ে থাকা দারুণ দারুণ শাড়ি গুলো নিয়ে আমি একটা শাড়ি ব্যাংক করব, একটা app তৈরি করে স্টার্ট আপ চালু করব, যাতে খুব কম ভাড়ায় তোমরা সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাল ভাল শাড়ি পরতে পারো, প্রতিদিন ফেসবুকে নতুন শাড়িতে ছবি পোস্ট দিতে পারো..."। ভেবেছিলাম আমার এই প্রস্তাবে সবাই খুব খুশী হবে, ও বাবা!! ব্যাপারটা যে কেউ খুব একটা ভাল ভাবে নেয়নি, সেটা বাড়ি ফিরে ওনার মুখ ঝামটায় বুঝেছিলাম!! আমার সাধের স্টার্ট আপের সেখানেই ইতি...
দেশের বাইরে বসবাস করার সময়ে আবার অন্য ঝামেলা... শাড়ির সাথে সবাই খোঁজে ব্লাউজ পিস আছে নাকি!! আর সেই ফ্রিতে পাওয়া ব্লাউজ পিস দেখলেই আমার টেনশান বেড়ে যায়!! সেই ব্লাউজ বানাতে দেশের বাইরে যা খরচ পড়ে, তাতে আরেকটা একই দামের শাড়ি হয়ে যায় প্রায়শই!! এদিকে ব্লাউজপিস ছাড়া শাড়ি মানে নাকি শাড়িটা ভাল নয়!! তাই কেনার সময়ে শাড়িতে ব্লাউজপিস আছে নাকি সেটা চেকলিস্টের একটা আবশ্যিক পয়েন্ট!! শাড়িতে ব্লাউজপিস না থাকলে নাকি শাড়ির কোয়ালিটি খারাপ- এই ধারনাটা কে যে চালু করেছিল, তাকে আমি আপ্রাণ খুঁজে যাচ্ছি বছরের পর বছর ধরে!!
আজকাল অধিকাংশ ছেলেরা জানে না ধুতি কীভাবে পরতে হয়, সেজন্য ইলাস্টিক দেওয়া ধুতি বাজারে এসে গেছে অনেক বছর আগে থেকেই!! মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অতটা না হলেও সেদিন শুনলাম ইলাস্টিক দেওয়া পাট পাট করে কুঁচি দেওয়া শাড়িও নাকি বাজারে বেরিয়ে গেছে...সুতরাং ইউটিউব দেখে দেখে কষ্ট করে শাড়ি পরার ঝামেলা নেই। তবে যে কোনো অনুষ্ঠানে ঠিকঠাক ভাবে পরিপাটি করে শাড়ি পারাটা যে বেশ ঝামেলার, সেটা বুঝেই হয়ত এক নতুন পেশার জন্ম হয়ে গেছে... শাড়ি পরিয়ে দেওয়া!! আগে বাড়িতে মা-মাসীরা শাড়ি পরিয়ে দিত, কেউ কেউ আবার পুরোনো স্টাইলে সামনে কুঁচি দিয়ে শাড়িও অনায়াসে পরিয়ে দিত!! এই শাড়ি পরিয়ে দেওয়াটাও যে একটা প্রফেশান হতে পারে, সেই শ্রমেরও যে একটা দাম থাকতে পারে, তার নান্দনিকতারও যে একটা দাম থাকতে পারে এই বাজার সভ্যতার যুগে, ওনারা হয়ত চিন্তাই করে উঠতে পারবে না...সেদিন কোথায় যেন পড়লাম ভারতে শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার এক বিখ্যাত পেশাদার আছেন, যিনি একটা শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার জন্য নাকি ৪৫ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা অবধি চার্জ করেন - কোন স্টাইলে পরানো হচ্ছে, কত সময় লাগছে তার ওপরে নির্ভর করে!! শাড়ি পরানোর চার্জই যদি এই হয় তাহলে সেই শাড়ির দাম যে কত হতে পারে আমি অনেক চিন্তা করেও কোনো অনুপাত বের করে উঠতে পারলাম না...
আমার এক বন্ধুপত্নী আবার শাড়ির ব্যাপারে প্রায় বিশেষজ্ঞ... কোন শাড়ি কোন গ্রামের, সেখানে কীভাবে সেই শাড়ি তৈরী হয়, তার ইতিহাস, সেই ডিজাইন কোথা থেকে এসেছে, রং কীভাবে লাগানো হচ্ছে, এসব ওর নখদর্পনে। প্রত্যন্ত প্রান্তরে গিয়ে গিয়ে শাড়ি খুঁজে আনে...শাড়ির ব্যাপারে ওর এই প্যাশনকে স্যালুট!!
আমি জানি না, দুনিয়ার আর কোনো পোশাক নিয়ে এত কিছু লেখা যায় নাকি বা এত কিছু ভাবা যায় নাকি। শাড়ি পরা নাকি ক্রমশ প্রাগৈতিহাসিক হয়ে যাচ্ছে, বাসে ট্রামে করে অফিস যাতায়াত করা অসুবিধার, অন্য অনেক পোশাকে বাড়ির কাজ করতে সুবিধে, এসব নিয়ে তর্ক আছে, হয়ত থাকবেও, তবে আমার দৃঢ় ধারণা, যতদিন আমাদের সিনেমায় শ্রীদেবী, জুহি, আলিয়ারা ফিনফিনে শিফন শাড়িতে বরফের পাহাড়ে কাঁপতে কাঁপতেও নেচে যাবে অবিচল মুখের অভিব্যাক্তিতে, আমাদের দেশে শাড়ি আছে, থাকবে... তার স্বকীয়তায়...
______________________________________________
আগের সংস্করণের পাঠ প্রতিক্রিয়া
______________________________________________
১/ ভাল লাগল 'মেস্তা বন্দর'... সায়ন্তন ধরের... আরও লেখা পড়তে চাই এঁর... ...
ভাল লাগল এই ভাস্করের অনেকগুলি কাজই... মনে থেকে যাবে তালা-হাঁস... তালা আর তালাও, দুটোতেই হাঁস চরে, দেখা যাচ্ছে!... কত বয়স হবে এঁর এখন?... ...
-------কবি অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র
২/ এ সংখ্যায় শুভাশিসের ছবি এবং সুজন পন্ডার লেখাটি চমৎকার।
অরন্ধন এগিয়ে চলুক নিয়মিত রন্ধনের দিকে।
--------কবি নির্মল হালদার
৩/ দুর্গা দা, সুজন বাবুর লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম।
সম্পাদকীয় সুন্দর।
শুভাশিসদা র আলোকচিত্রী প্রতিভা আগে জানা ছিল না। ভালো লাগলো।
তোমাকে ভালোবাসা জানাই।
মনসা পূজা ও পান্নার শুভেচ্ছা থাকলো।
---------কবি শ্যামাপদ মাহাত ( বাঁশি )
৪/ বাহ ভারী চমৎকার একটি সংখ্যা হয়েছে।
খুব সুন্দর ।
ছবি গুলি কথা বলে যেন।
-----------কবি সুজন পণ্ডা
৫/ অসাধারণ সম্পাদকীয়, সাম্প্রতিক প্রশ্নগুলো যেন আমারো। ভালো লাগলো খুব।
কি অপূর্ব কথাশিল্প--- প্রত্যেকটি কবিতা অসাধারণ। শ্রদ্ধেয় কবি নির্মল হালদার সবসময় ভাবতে শেখান, কি সাবলীল প্রকাশ! আর খুব ভালো লেগেছে সুজন পণ্ডার কথিকাটি।
------------কবি ডরোথী দাশ বিশ্বাস
৬/ সব ছবি অনবদ্য। ছবিগুলো কথা বলছে।
---------ভ্রমণ কাহিনীকার ভাস্কর বাগচী
৭/ খুব ভালো লাগছে দেখে, যত দেখি Shantiniketan কে ততই অবাক হয়ে যাই।
-------অজানা কেউ ব্লগে লিখেছেন
______________________________________________
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : হকুসাই-এর পেন্টিং, জাপান, আন্তর্জাল
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন