চতুর্থ বর্ষ ।। ষোড়শ ওয়েব সংস্করণ ।। ৩ অগ্ৰহায়ণ ১৪৩০ ।। ২০ নভেম্বর ২০২৩
সরু একটা তারের মধ্যে কত যে সুর থাকে! সে কেবল সেই জানে, যে জানে তাকে কোথায় কীভাবে বেঁধে কীভাবে স্পর্শ করলে পাল্টে পাল্টে যায় সুর।
তার স্পর্শের যাদুময়তায় তারজন্ম হয়ে ওঠে সফল। তার স্পর্শের যাদুময়তায় তারেরও মাঝে আরোপিত হয় ছন্দ। তার তার সমস্ত বন্ধন খুলে মগ্ন হয়ে ওঠে ঋজুতা লাভে।
কারোর সঙ্গে কাউকে না কাউকে আবদ্ধ করে দিতেই জন্ম হয় তার। আবদ্ধ করে দেয় আষ্টেপৃষ্ঠেও। তারপরও কোনো কোনো বন্ধন থেকে তরঙ্গ ওঠে মুক্তির।
মানব দেহের এক অঙ্গের সঙ্গে বিশেষ আরেক অঙ্গের সুনিয়ন্ত্রিত বন্ধনে কি ওঠে না স্বর্গীয় ঝংকার? ওঠে না তরঙ্গ ভোরাই-এর?
তোমাকে জানতে হবে কেমন ভাবে স্পর্শ করতে হবে তার গায়ে। কেমন ভাবে ছড়াতে হবে ঢেউ এক জলাশয় থেকে আরেক জলাশয়ে।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
গৌতম দত্ত / সংঘমিত্রা চক্রবর্তী / দেবযানী ঘোষাল / পঙ্কজ মান্না / সুশান্ত সেন / পার্থসারথি মহাপাত্র / শ্যামাপদ মাহাত (বাঁশি) / ব্রততী পরামাণিক / সায়ন্তন ধর / তপন পাত্র / সুজন পণ্ডা / তৈমুর খান /
_____________________________________________
গৌতম দত্তের কবিতা
উৎসব
১.
ছাগল চরাচ্ছে যে মেয়েটি
ঠাকুরডুংরির টিলায়
তাকে একবার মা ব'লে ডাকো
আঁতুড়ঘর থেকে শ্মশানভূমি
মন্ত্র নয় মুদ্রা নয়
মা ডাকেই ঢেউ ওঠে জলে
গানে গানে নেচে ওঠে
সনাতন দাস বাউল
২.
শেষ রাতে মেলা থেকে ফেরার
যাদের উপায় থাকে না
তাদের অপেক্ষায়
পথের দিকে চেয়ে থাকে মা
গাছে গাছে জোনাকিরা জাগে
শেষ রাতে মেলায়
তখন মাদল বাজছে
জোয়ার জলে ফেনার রাশি
(উৎসর্গ : নির্মল হালদার)
একটা আকাশ
ভাগ বসাচ্ছে সবাই
যত ভাগ বসাচ্ছে
তত হেসে উঠছে
প্রসারিত হ'চ্ছে সে
এভাবেই একটা আকাশ থেকে
আর একটা আকাশ
একটা দিঙমন্ডল থেকে
আর একটা দিঙমন্ডল
শিশুর হাসির মতো
ছড়িয়ে প'ড়ছে অনবরত
অনাদি অনন্তে
সংঘমিত্রা চক্রবর্তীর কবিতা
১.
ম্যাজিসিয়ান
বসন্ত আসার আগেই ভাবছি ভ্রুটা শেভ করে নেবো ধনুকের মতো
বেশ গ্লো দেখে একটা ফেসিয়াল করালেই হয়ে যাবো তরতাজা
কানের দু' পাশে রুপোলি চুলের রেখা ঢেকে দেবো
নিপুণ ক্যারিশমায়
কেউ ধরতেই পারবে না ঝকঝকে এই ত্বকের রহস্য
আসলে স্পেশাল ক্রিম দিয়ে আঁকা !
স্বামীর পকেট মেরে হেব্বি গাঢ় একখানা
লিপস্টিক আনতে দিয়েছি
পাকা ডালিমের মতো লাল গাল দেখবে আমার
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে এবার নতুন কাজল
জল লাগলেও উঠবে না আইলাইনার !
চোখের পলক ফেলা মাত্র মুগ্ধ হয়ে যাবে সকলেই
বললাম তো অবাক করে দেবো সকলকে, একেবারে
মাতিয়ে তুলবো ভাল ভাল ছেলে দেখে আনমনা মন
মাথা ঘুরে যাবে খোঁপায় সাজানো আভিজাত্য দেখে
চিনতেই পারবে না সেই মধ্যবয়সের কাটাকুটি মুখ !
তখন চশমা খুলে অভিবাদন জানাবে তুমি
দেমাক দেখিয়ে আর থাকতেই পারবে না
এটা আমি জানি , বুকে হাত রেখে অনুভব করি
তুমি যতই কাজ পাগল হও না কেন
আমার হাসির প্রতি মুগ্ধতা তোমার চিরদিনের !
২.
আমন্ত্রণ
তুমি সিঙ্গেল আমি ফুরফুরে আস্কারা আছে পাশে
কাকে ভয় আর পরোয়া করি না
চলে এসো মধুমাসে ।
সুখ খুঁজে খুঁজে মরেছি কেবল ফ্যাকাশে ধূসর রাত
এত কাছে যদি তখন পেতাম দিনেরাতে যাতায়াত !
আমি বসাতাম খুশির রান্না স্বপ্নের সংসার
মনের মানুষ সঙ্গে থাকলে বার বার অভিসার
নতুনের মতো পুরনো শরীর ছাপিয়ে উঠত সুখে
বকম বকম জোড়া পায়রার মধু লেগে থাক বুকে ।
অনেকে হয়তো মুচকি হাসবে, বলবে ' মরণ ' নেই
ভালবাসা ঠিক বেহায়ার মতো ফিরে ফিরে আসবেই
প্রতিদিনকার ঝুট ঝামেলায় হৃদয়ের কাছে এসে
গোপন কষ্ট খুলে বল মন বারবার ভালোবেসে।
দেবযানী ঘোষালের কবিতা
১.
কুুয়াশা যখন
তোমার থেকে শিখেছি
মিথ্যে মুখোসের রূপ।
কুয়াশার আড়ালে আবছা থাকে
স্বচ্ছ্বতা।
শিখেছি একটু একটু করে।
বোবা হয়েছি আঘাতে আঘাতে।
মেনেছি দুর্বলতা।
অনভ্যাসি মন পারে না
ছিনিয়ে নিতে মন।
মেনেছি সবলের মন মানানো ব্যথা।
নরম মন কঠোর হতে পারেনি।
সুযোগ দিয়েছি ক্ষতকে ক্ষত হতে দিতে।
ফুরিয়ে যাবার আগে
ফুরানোর সুখে নিমজ্জিত হতে।
২.
কৃতজ্ঞতা
কৃতজ্ঞতার প্রত্যুত্তর বিনয় নয়।
আন্তরিকতা।
আন্তরিকতা যদি স্বার্থের তাগিদ হয়,
তবে দূরে সরে যাব।
মেঘলা হেমন্তে ছিটেফোটা বারিপাত ভেজায়
ম্যাজেন্টা রাঙা নয়নতারায়।
দুলে ওঠে উত্তরের শীতল হাওয়ায়।
এই নম্রতায় কোন কুয়াশা নেই।
স্বচ্ছতার সমারোহে শীত প্রারম্ভিক সকাল।
তোমরা তেমনটি হতে পারো না গো?
পঙ্কজ মান্নার কবিতা
১.
তবে তাই ...
যে সাঁকোতে দাঁড়িয়েছি তার কোনো পরিচয় নাই ,
যদি বলো ভালোবাসা এক আকাশ শুভম্ প্রার্থনা,
তবে তাই
শীতের বিকেল ,
কিছু রোদ লেগে আছে পাখির বাসায় ...
ওরা যেন জানে :
সম্পর্কের চারাগাছে দিতে হয় আবেগের সুরক্ষাবলয় ।
কুয়াশাপ্রবণ দিন ,
তোমারও জোড়ের নামতায় ঢুকে পড়ে হৃদয়-সংশয় ,
অবেলার রোদে ততখানি ওম কোথা পাবে !
সময় সহায় নয় ,
কাছে থাকো ;
যে স্মৃতিরেখা তমাল নদীর মতো গোত্রহীন
উৎস থেকে হেঁটে হেঁটে অসীমের চরণে মিশেছে
সেরকমই দূরপথে তুমি হও অক্ষয় সঞ্চয়
যে সাঁকোতে দাঁড়িয়েছি তার কোনো পরিচয় নাই ,
যদি বলো ঊষাকাল না-ফোট সকাল ,
তবে তাই
যদি বলো সহযাত্রী এক আকাশ শুভম্ প্রার্থনা ,
তবে তাই
২.
আমাদের কিছু নেই
আমাদের কিছু নেই,দেড় কাঠা প্রেম
বিষণ্ণ বিরহবেলা,তাহাই দিলেম
কেয়া পাতা দেখ নাই সুগন্ধি তেল !?
পাথর ছোঁয়ার স্বপ্নে ভক্ত উদ্বেল!
আমাদের কিছু নেই,দেড় কাঠা বুকে
সকল অসুখী মেঘে জলভার ঝুঁকে
ঈশ্বরী নিলামে ওঠে একান্ন পীঠে
গাঁজার তৃতীয় দমে অপমানও মিঠে
আমাদের কিছু নেই,দেড় কাঠা সুখে
জাতপাত ভেদাভেদ দেবো সবই রুখে
সুশান্ত সেনের কবিতা
১.
ক্রিকেট
বেশ করে জম্পেশ হয়ে বসে
চা এর কাপ হাতে
টিভি তে ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে
কারো মুন্ডুপাত কারো প্রশংসা
করতে গিয়ে দেখি সামনের মাঠে
কাঠবিড়ালি টা প্রাণের ভয়ে দৌড়ে
আমাদের পোষা কুকুর ভুলুর তাড়া খেয়ে
গাছে উঠে গেল।
ভয় কাঠবিড়ালি ক্রিকেট সব মিলে মিশে
মনে পড়লো কাল সকালে মার্কেটে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে,
এই মাসের টার্গেট এখনও অধরা।
মনটা ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতেও দেখছে না।
২.
শুকনো পাতা
শুকনো পাতা উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে,
সামনের গাছটাও ফেলে দিচ্ছে পাতা গুলো,
এখানে শীত এখন আমেরিকাতে।
কে জানে কোথা থেকে এক দঙ্গল পাখি
উড়ে উড়ে এসে বসে পড়লো সামনের বাগান জুড়ে
এপাশের ওপাশের।
খুঁটে খুঁটে কি যেন খেতে লাগলো।
মিনিট পাঁচেক।
উড়ে চলে গেলো সবাই একসঙ্গে তার পরেই।
আর তাদের দেখা গেল না।
এই রকম ই উড়ে যাচ্ছে জীবন।
এটাই কি কবিতা ?
৩.
কথায় কথায়
কথায় কথায় হাঁসের ডিম মাছি আর রসগোল্লা
নিয়ে খেলা করতে করতে
বেগম সাহেবা ক্লান্ত হলেন।
হেঁকে বললেন জুড়ি গাড়ি বের কর
ময়দানে হাওয়া খেতে যাব।
প্রাগৈতিহাসিক কথাবার্তা শুনে
সুইচ্ নিয়ে খেলতে বসা ছেলেটা
হে হে করে হেঁসে উঠলো।
সে তখন দুহাতে কন্ট্রোল চালাতে চালাতে
অন্য গ্রহ থেকে নেমে আসা সজারুর কাঁটা মত
মাথায় কিছু একটা পড়ে থাকা পোকেমন'টাকে প্রায় কাবু করে এনেছে ।
কথায় কথায় রাত হয়ে যায় ।
পরান্নজীবী
পার্থসারথি মহাপাত্র
উচ্চারণ মিইয়ে গেছে,
মুড়ির কৌটে জলের ছিটা
পরান্নে প্রতিপালিত জীব
ত্বকের ওপর কালশিটা।
জিহ্বার প্রতিবাদ ধ্বনি
বিবর্তনে লেলিহান স্তাবক
শিরদাঁড়ায় মাজরা পোকা
লেজ নাড়ে সারমেয় শাবক।
বিকছে ওরা ইচ্ছেগুলো
মনাক্ষরে লেখা পান্ডুলিপি
জীবন গড়ার সফেন স্বপ্ন
আজ বিষন্নতার ঢিপি।
বিন্যস্ত শিরায়
ধীররক্ত
লাল কণিকায় মরিচা
উচ্চস্বরে
বলতে মানা
স্বরযন্ত্রের চামড়া খিঁচা।
শ্যামাপদ মাহাত (বাঁশি)-র কবিতা
১.
চিটামাটি
খামারে মাটি লেপে মেজাপি মাহাতান।
আঁচলে টুপ করে পড়ে একটি আঁজির।
নুনুর বাপের আগে মুখ
দেবে কি করে?
শান্তিবালার চাইতে একটু বেশি দরদ দিয়েই
রাখতে হয় তরণীর মন।
সতীনের সঙ্গে ঘর করলে
চিড় ধরাধরি থাকবেই।
মনকেই করতে হয় চিটামাটি।
লেপা লেপি সাঁঝ সকাল ।
২.
মহড়া
হেমন্তের রাতে অবনীর চোখ জড়িয়ে আসছে
কংসাবতীর কোলে শুয়ে পড়েছে মুটরুডি।
রূপচাঁদ চর্মকারের চোখে ঘুম নেই
ঢোল ধামসা সারানোর কাজ রাতভর।
কার্তিক মাসে বাঁদনা পরব
তার আঘন মাস।
গাঁয়ে গাঁয়ে চলবে অহিরা গানের মহড়া
পুঞ্চা মানবাজার হয়ে বাগমুণ্ডি
হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে উঠবে
রূপচাঁদের সুর।
জীবনের মূল্য
ব্রততী পরামাণিক
জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিল জীবনের মূল্য
চলছে-চলবে দিন-রাত এভাবেই
মনের ভুল ভাঙে বিচ্ছেদের সুরে।
প্রিয়জনের জীবনদীপ নিভে
বেদনার চাদরে ঢাকে আনন্দের সীমারেখা।
নির্মম সত্যি মুছে দেয় জীবনের সব রং!
ফিরবে না সে আর অজানার দেশ থেকে-
সম্বিতেও মেনে নিতে চাই না পৃথিবীর চিরসত্যতা।
ধৌসি--- ডুয়ার্সের একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি
সায়ন্তন ধর
ভাইফোঁটার সময়ে ডুয়ার্সের চা বাগান সংলগ্ন এলাকায় যাওয়া মানেই নেপালিদের দুটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সাক্ষী থাকা। ডুয়ার্সের ছোট্ট একটি চা বাগান ইঙ্গো। একদম পাহাড়ের কোলে তার অবস্থান। জলপাইগুড়ি থেকে গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক পেরিয়ে চালসা ৪৮ কিলোমিটার পথ। অপরদিকে মালবাজার থেকে চালসা মাত্র ৭ কিলোমিটার। সেখান থেকে মেটেলি ৮ কিলোমিটার। তারপর আর ৮ কিলোমিটার গেলে জুরন্তী চা বাগান পেরিয়ে এই ছোট্ট ছবির মতো চা বাগানটিতে আমার ছোটবেলা থেকেই যাতায়াত। প্রতিবছর কালীপূজা-ভাইফোঁটার সময়ে যাওয়া তো হতোই, এছাড়াও গরমের ছুটিতেও ভরা বর্ষায় পাহাড়ের সবুজ দেখতে ছুটে যেতাম। বর্ষায় পাশ দিয়ে বয়ে চলা নেওড়া নদী বড় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতো। তার গর্জন শোনা যেত স্টাফ কোয়ার্টার্স থেকেই। আমার পিসো সেই বাগানের বড়বাবু ছিলেন, আর পাকদণ্ডী বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছিল পিসির এসএসকে স্কুল। ওখানে আদিবাসী (প্রধানতঃ সাঁওতাল, ওঁরাও, মদেশীয়), নেপালি ও বাঙালিদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান লক্ষ্য করার মতো। তবে এখন পিসিরা রয়েছেন চালসাতেই। চালসাও পাহাড়ের ঠিক পাদদেশে। এবারও ভাইফোঁটায় গিয়েছিলাম চালসা। ভাইফোঁটা সেরে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, বাবা, বড় কাকু ও কাকন ছিল সাথে। চালসার চৌপথি থেকে দক্ষিণের রাস্তাটি জলপাইগুড়ি, পশ্চিমের রাস্তাটি মালবাজার ও পূর্বের রাস্তাটি নাগরাকাটার দিকে গিয়েছে। তিনটি রাস্তাই সমতল। কিন্তু উত্তর পশ্চিম কোণের রাস্তাটি শুরু থেকেই উঁচু হতে হতে তিন চারটি লুপ শেষে বেশ উঁচুতে উঠে গেছে। চালসার রেলক্রসিং পেরিয়ে ভিউ পয়েন্টটি 'চালসা গোলাই' নামে খ্যাত। যদিও এবারে দেখলাম একটি সেগুন গাছের জন্য গরুমারা ফরেস্টের মাঝ বরাবর স্ট্রেটলাইন জাতীয়সড়কের অপূর্ব দৃশ্য ঢাকা পড়ে গেছে। গোলাই এর পর আর একটি লুপ ঘুরে সিনক্লেয়ার্স হোটেল। এর পরেই পাদ্রিকোঠি। এর আগে একবার পাদ্রিকোঠি গিয়েছিলাম। এবারে তার পাশ দিয়ে একটা কংক্রিটের রাস্তায় প্রবেশ করলাম। পুরো দু' কিলোমিটারের মতো হেঁটে যা বুঝলাম এটা অনায়াসে 'ভবিষ্যতের ঝাণ্ডি' হতেই পারে। ওপারে মূর্তি নদীর ভিউ রয়েছে তবে জায়গাটা সম্পূর্ণরূপে ভার্জিন রয়েছে এখনো। বন দোপাটি, সালভিনিয়া, হিপ্টিস(তোকমা), রাণী লজ্জাবতী, নানা রকম ফার্ণে সজ্জিত হয়ে রয়েছে প্রাকৃতিক ভাবেই। রয়েছে বিরল লাল বর্ণের অগ্নীশ্বর কলার গাছ। শেষপ্রান্তে চোখে পড়লো শিমূলকন্দের গাছের বাগান। যাকে ইংরেজিতে কাসাভা, ট্যাপিওকা নামে চেনে সবাই। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Manihot esculanta. শিমূলের সাথে পাতায় মিল ছাড়া আর কোনোই মিল নেই, এমনকি দু'জন এক পরিবারেরও নয়। পথে একটি বাচ্চা মেয়ে জিজ্ঞেস করলো ঘর থেকে উঁকি দিয়ে। কোথায় চলেছি আমরা? কি সুন্দর মিশুকে মেয়ে। ফেরার পথে ওদের তিন ভাইবোনের একটা ছবি তুললাম। একটা দেউসি দলের গান শুনলাম, বাচ্চা ছেলেটি কি সুন্দর গাইলো, কত লম্বা তার লিরিক্স, বাবা ওদের সাথে সাথে লাঠি মাটিতে ঠুকে দেউসি রে বলতে লাগলো, শেষে শ্যাল রুটি পেয়ে ওরা চলে গেলো। হ্যাঁ, যে কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম এবারে সেই প্রসঙ্গে আসি। আমাদের যেমন ভাইফোঁটা, তেমনি বিহারীদের ভাইদুজ ও নেপালিদের ভাইটিকা। সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সাক্ষী থেকেছি ভাইদুজের। ওরা জলের ধারে খোলা আকাশের নীচে সুন্দর গান গেয়ে পুরো অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে। তারপর অংশগ্রহণ করেছি ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানে, আর এখানে ঘুরতে এসে চোখ ভরে দেখছি নেপালিদের ভাইটিকার সাজ। গলায় গাঁদা ফুলের মালা, কানে গোঁজা গাঁদা বা শেফালী ফুল। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা, বেগুনী, গোলাপী রঙের চন্দনের ফোটায় চালের দানা দিয়ে কপাল চর্চিত। ক্ষুদে, মাঝবয়সী, বৃদ্ধ সকলের এক সাজ। তার সাথে সাথে এই সময় ধরে চলা দেউসি (ধোসী) গান। পথে দেখা হয়ে গেলো একটি আদিবাসী দল ও একটি নেপালি দলের সাথে। আসলে নেপালিদের থেকে আদিবাসীরা এই সংস্কৃতিটি গ্রহণ করেছে। তিহার উৎসবের সময় নেপালে এই দেউসি প্রচলিত আছে। সেটাই দার্জিলিং, কালিম্পং, ডুয়ার্সেও প্রচলিত। একজন পুরো গানের লাইন বলবে আর সাথে যারা রয়েছে তারা হাতে তালি দিয়ে বা হাতের লাঠি মাটিতে ঠুকে বলবে দেউসি রে। প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে তারা এটা করে আর বাড়ি থেকে তাদের মিষ্টি, শ্যালরুটি, চাল বা টাকা দেওয়া হয়। তারা খুশি মনে সেগুলো সংগ্রহ করে ও দাতার সমৃদ্ধি কামনা করে। ছেলেদের দল যে গানটি গায় তাকে দেউসি বলে আর মেয়েদের দল যে গানটি গায় তাকে ভাইলো বলে। যদিও স্থান ভেদে ব্যক্তিভেদে গানের কথা পরিবর্তিত হয়। পুরাণ মতে বালি ছিলেন পাতাললোকের সমৃদ্ধশালী রাজা। পাতাললোকের চেয়ে মর্ত্যলোক বেশি সমৃদ্ধশালী প্রমাণ করতে ভগবান বিষ্ণু রাজা বালিকে মর্ত্যলোকে পাঁচ দিনের জন্য পাঠিয়েছিলেন। এবং সেই সময়ে মর্ত্যলোককে আলোয় ভরিয়ে দিয়েছিলেন। এই পাঁচদিনকে যম পঞ্চক বলা হয় যা নেপালে তিহার নামে পরিচিত। অন্য একটি গল্পে পাওয়া যায়, একজন গর্ভবতী নারী একদা কাল্লাই নামক স্থানে পৌঁছেছিলেন যা বর্তমানে নেপালের জুমলা জেলায় অবস্থিত। নেপালি সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ জগমন গুরুং এর মতে, সেই নারীর সন্তান ছিলেন বালি। সেই সময়ে নেপালের খাসা সাম্রাজ্য ধ্বংসের মুখে। কোন শাসক ছিলেন না তখন। তখন বালি রাজা হলেন ও কল্লোল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করলেন। সেই সময়ে দেবদাস ও দেবদাসীর প্রচলন ছিল। বছরে একবার রাজা দেবদাস ও দেবদাসীদের গ্রাম পরিদর্শন করতে এবং ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করতে দিতেন। তাই দেবদাসীরা 'ভাইলো' (নেপালি শব্দ ভালো, যার অর্থ বাংলাতেও ভালো) গান গাইতো এবং দেবদাসরা গাইতো 'দেবদাস রে', যা পরে দেউসি রে হয়ে যায়। এরকম আরও বেশ কিছু গল্প রয়েছে। এই যে গান তা খালি গলায় নূন্যতম মিউজিক বা যন্ত্রসংগীত ব্যতিরেকেই গাওয়া হয়। দশ মিনিট থেকে আধাঘন্টা পর্যন্ত এই গান চলতে পারে। এই তিহারের তৃতীয় দিন লক্ষ্মীপূজার সাথে ভাইলো পরিবেশিত হয় ও চতুর্থ দিন গোবর্দ্ধনপূজার সাথে দেউসি পরিবেশিত হয়। তিহারের পঞ্চম দিনে অর্থাৎ যম দ্বিতীয়ায় ভাইটিকা অনুষ্ঠিত হয়। কাঠমান্ডু উপত্যকার নিউয়ার গোষ্ঠীর মানুষেরা এ সময়ে কাজী পূজা করে। এছাড়া বাকি সবকিছুই ভাইফোঁটার মতোই। যমরাজের বোন যমুনা যেমন যমরাজকে ফোঁটা দেয় তেমনি যমকে সন্তুষ্ট করে ভাইদের আয়ু বাড়াতে বোনেরা ভাইদের সাতটি রঙের সুরক্ষা টিকায় সাজিয়ে দেয়। একে সপ্তরঙ্গী টিকাও বলে। এর সাথে বোনেরা নিজ হাতে মখমলী ফুল অর্থাৎ গ্লোব অ্যামারান্থ (Gomphrena globosa) এর মালা গেঁথে পরিয়ে দেয় ভাইয়ের গলায়। ডুয়ার্সে অবশ্য মখমলী ফুলের তেমন দেখা মেলে না, তাই গাঁদা ফুল দিয়েই মালা গাঁথা হয়। এভাবেই প্রকৃতির সাথে সাথে আচার অনুষ্ঠানে ফারাক সৃষ্টি হয়। গড়ে ওঠে নতুন সংস্কৃতি। ওদের দেখাদেখি ভাইফোঁটাতেও শেফালি ফুলের মালা পরানো হয়, কানে গোঁজা হয় শেফালি ফুল, চোখে থাকে কাজলের টান। এভাবেই বিভিন্ন জাতির মানুষ মিলেমিশে নিজেদের সংস্কৃতি আদানপ্রদানে গড়ে ওঠে নতুন এক মিশ্র সংস্কৃতি। ওদের অনুষ্ঠানের এই যে রঙ তা এক অমোঘ আকর্ষণ। বাড়ির সামনে রাস্তায় ওদের দেখলেই মনে হচ্ছে ওদের ছবি তুলি। ওদের বেশ কয়েকটি দলকে একথা বলতেই ওরাও খুশি মনে পোজ দিলো। এমনিতেই পাহাড় রঙীন, রঙীনতর হয় রঙবেরঙের ফুলে, আর রঙীনতম হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক রঙে। ওদের থেকে রঙের ছোঁয়া লাগে বাঙালিদের মধ্যেও। তাই তো সাঁওতালি জিনি দিদির সাথে রিনি, রনি, সানি বেরিয়ে পড়ে দেউসি করার জন্য। জিনি দিদির হাতে থাকে একটা টুকরী, বাকিদের হাতে লাঠি। ইঙ্গো চা বাগানের পাহাড় লাইনে এসে দাঁড়ায় ওরা। প্রতিটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গান ধরে জিনি দিদি। রিনি, রনি, সানিরা কোরাসে বলে দেউসি রে...
"आहै ! भन मेरा भाइ हो - ध्यौसुरे /आहै ! राम्ररी भन - ध्यौसुरे/श्वोर मिलाईकन - ध्यौसुरे/भन न भन - ध्यौसुरे/हे ! राम्ररी भन - ध्यौसुरे/हे !मेरा भाइ हो - ध्यौसुरे/औसीको रातमा - ध्यौसुरे/४ भाइ साथमा - ध्यौसुरे/आकाशका तारा - ध्यौसुरे/झिलिमिली सारा - ध्यौसुरे/हे !रातो माटो - ध्यौसुरे /चिप्लो बाटो - ध्यौसुरे /लड्दै पड्दै - ध्यौसुरे/हे !आएका हामि - ध्यौसुरे/ए ! ध्यौसी खेल्न - ध्यौसुरे/ए !भन न भन - ध्यौसुरे/मेरा भाइ हो - ध्यौसुरे /राम्ररी भन - ध्यौसुरे/श्वोर मिलाईकन - ध्यौसुरे/यो घर कत्रो - ध्यौसुरे/सिंह दरबार जत्रो - ध्यौसुरे/दिन्छन दिन्छन - ध्यौसुरे/दिनै आँटे - ध्यौसुरे /गाऊ भाइ हो - ध्यौसुरे/मै मागी दिउला - ध्यौसुरे/आकाशका तारा - ध्यौसुरे /सेल खाने दारा - ध्यौसुरे /हे !आखाम बाखम - ध्यौसुरे /सेलापुरी चाखम - ध्यौसुरे /ए !भन न भन - ध्यौसुरे /ध्युसेरे भन - ध्यौसुरे"
খুব ইচ্ছে হলো এরই ছায়ায় নিজের ভাষায় ধৌসি গান লেখার-
আহা--- বলো, বলো ভাই--- ধ্যৌসুরে
ভালো ভালো বলে যাই--- ধ্যৌসুরে
সুর মিলিয়ে বলো--- ধ্যৌসুরে
সুরে সুর মিলো গেলো--- ধ্যৌসুরে
মোরা সব ভাই ভাই--- ধ্যৌসুরে
একসাথে এক ঠাঁই--- ধ্যৌসুরে
অমানিশা এই রাত--- ধ্যৌসুরে
চার ভাই এক সাথ--- ধ্যৌসুরে
আকাশেতে যত তারা--- ধ্যৌসুরে
ঝিলঝিল করে সারা--- ধ্যৌসুরে
আরে! লাল লাল কাদা--- ধ্যৌসুরে
পিচ্ছিল রাস্তা--- ধ্যৌসুরে
নিচে গড়ায় কে--- ধ্যৌসুরে
ধৌসি খেলে না যে--- ধ্যৌসুরে
খেলতে আইসেন--- ধ্যৌসুরে
স্বর মিলাইকান--- ধ্যৌসুরে
ইয়ো ঘর কাটরো--- ধ্যৌসুরে
সিংহ দরবার যাত্রা--- ধ্যৌসুরে
দিনহান দিহান--- ধ্যৌসুরে
দিনের আগে যান--- ধ্যৌসুরে
মা মাগি দিউলা--- ধ্যৌসুরে
ভুল পথে চলিলা--- ধ্যৌসুরে
আকাশের তারা--- ধ্যৌসুরে
সিল খান দারা--- ধ্যৌসুরে
আরে! আখম বখম--- ধ্যৌসুরে
সেলাপুরি চাখাম--- ধ্যৌসুরে
আসুন, আসুন--- ধ্যৌসুরে
গলা ছেড়ে বলুন--- ধ্যৌসুরে
সারাদিনে সংগ্রহ হয় অনেকটা চাল-ডাল-সব্জি, শ্যালরুটি, আর কিছু টাকা। তারপর রাত নামে পাহাড়ি চা বাগানে। আলোকমালায় সাজে ফ্যাক্টরি-স্টাফ কোয়ার্টার্স। পাহাড় লাইন থেকে ভেসে আসে মাদলের বোল। বাবুদের ছেলেরা ও শ্রমিকদের ছেলেরা একসাথে বাজি ফাটায়, হাউই রকেট ছাড়ে। ছোটরা বড়দের তদারকিতে ফুলঝুরি, রংমশাল, চরকি, তুবড়ির আলোয় মেতে ওঠে। নভেম্বর মাসে পাহাড়ে জম্পেশ শীত নামে। গরম জামা পরে সকলে। হঠাৎ কেউ একজন দেখা করে যায় বড়বাবুর সাথে। মুখে মুখোশ, যাত্রাপালা রয়েছে পাশের গ্রামে। ছোটরা ভয়ে অস্থির সে মুখোশ পরিহিত মুখ দেখে। তারপর রাত বাড়লে দেউসিতে সংগ্রহ করা আনাজপাতি দিয়ে হয় পিকনিক। চা বাগান সে রাত পুরোটা জেগেই কাটিয়ে দেয়। হ্যাঁ এমনটাই ছিল আমাদের ছোটবেলাটা। এখনও যে মোবাইলের রমরমার দিনে চালসায় গিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে দেউসি নিয়ে এতটা উন্মাদনা দেখবো ভাবতে পারিনি। যা ধারন করা হয় তাই তো ধর্ম। আমরা যদি আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে ধারন করে চলতে না পারি, তাহলে আমরা ব্যর্থ। যেমন দেউসি ও ভাইলো একই তিহার উৎসবের অংশ হলেও ডুয়ার্সে ভাইলো প্রায় শোনাই যায় না। তবে দেউসি এখনও বেশ জনপ্রিয়। যদিও এখন চা বাগানগুলোয় গেলে দেখা যায় বাবু ও শ্রমিক সকলেই তাঁদের সন্তানদের পড়ার জন্য বাইরে শহরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ছোট থেকেই তারা শহরের, তারা আর চা বাগানের নয়, তাদের ঘুমের জন্য আর ফ্যাক্টরির একটানা ঘরঘর আওয়াজের দরকার পড়ে না। ফ্যাক্টরির বড় বড় ফ্যানের হাওয়ায় তারা শুকিয়ে নেয় না তাদের ঘামে ভেজা পিঠ। বুক ভরে টেনে নেয় না চা পাতার আঘ্রাণ। চা পাতা বহনকারী যন্ত্রগুলোকে কেউ আর ডাকে না মনোরেল বলে। চা বাগান যে শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির স্তম্ভ, তাই নয়। চা বাগান হলো সংস্কৃতির একটি মিলন মেলা। বেঁচে থাকুক চা বাগান, বেঁচে থাকুক এ সংস্কৃতি, ভাইফোঁটা-ভাইটীকা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাক। শিশুরা ফিরে যাক চা বাগানের দেশে। ডুয়ার্সের রানীচেরা চা-বাগানে আমার দাদুভাই চাকুরী করতেন। আমার বাবা জ্যেঠামশাইদের জন্মভূমি। চা-বাগানের সকলের সাথেই জোরদার এক আত্মীয়তার বন্ধন। জীবনধারণ ও জীবিকার সন্ধানে সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে সবাই এই বাগান থেকে আজ বহুদূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে বছরে একবার পুণর্মিলন তথা পিকনিক উৎসবে এই বাগান সংলগ্ন চেল নদী উপত্যকায় মিলিত হয়েছিলাম। সেখানে কবিতা গান নাচ বক্তব্য স্মৃতিচারণের সাথে চা-বাগানের নিজস্ব সংস্কৃতি "ধ্যৌসি"- নাচ করেছিলেন মেয়েদের দল--- ননদ-বৌদির দল। সেখানে বড় পিতলের পরাতে প্রচুর টাকা উঠেছিলো যা প্রচণ্ড হাসি আনন্দের সাথে সাথে পিকনিকের ফাণ্ডের শর্ট মেক আপ দিয়েছিলো। শুধু তাই নয়--- নেপালি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কিভাবে সার্বজনীন হয়ে ওঠে এটা তারই প্রমাণ।
পাঁচপুতায় দশ ধেনু গাই
তপন পাত্র
মানভূমের মানভুঁইয়ে ঠিক কবে য গো-বন্দনা শুরু হয়েছিল, তা সঠিকভাবে বলা বড়ো মুশকিল , তবে একথা সত্য যে গরু পরম কল্যাণকারী বলেই মানুষ তাকে দেবতারূপে পূজা করতে শুরু করেছিল এবং আজও করছে । কৃষিজীবী সমাজের পক্ষে গো-জাতি বিশেষ উপযোগী বলেই তার ওপর দেবত্ব আরোপিত হয়েছে । পশ্চিম-সীমান্ত-বাংলায় কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথি গো-বন্দনার তিথি রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে । এই অমাবস্যার রাতে ধমসা-মাদল বাজিয়ে গান গেয়ে গোরুকে অভিনন্দন জানানো হয় । এই গানই "অহিরা গান" স্থানভেদে "আহিরা গান" আবার "বাঁধনা পরবের গান" নামেও পরিচিত । আর গো-বন্দনাকারীদের বলা হয় --"ধাঙ্য'ড়া" বা "ধাঙড়" দল অমাবস্যার রাতে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে গোয়াল এর কাছে গিয়ে তারা গান করে । এর জন্য পায় ---পয়সা , পিঠে , মুড়ি । এসকল নেহাতই প্রীতি-উপহার বা ভালোবাসার দান । মহুয়া মদের নেশায় হেলে দুলে সুর করে তারা সহজ সরল লৌকিক আটপৌরে ভাষায় মন মাতানো গান গেয়ে ওঠে প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিমায় । সে সমস্ত গানগুলির মধ্যে যে আর্থ-সামাজিক চিন্তাভাবনা , কৃষি ভাবনা এবং নিম্ন
-মধ্যবিত্ত,নিম্নবিত্ত , শ্রমজীবী মানব সমাজের পারিবারিক জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে , নর-নারীর পারস্পরিক সম্পর্কের কথা, হৃদয়ানুভূতির মধু নির্যাস চিত্রিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্যে তা বিরল বললেও অত্যুক্তি হবে না ।
যারা কার্তিকের অমাবস্যা রাতে গ্রামের কুলি কুলি ঘুরে ঘু্রে, ঘরে ঘরে প্রবেশ করে সকল পরিবারের গোয়ালের কাছে গিয়ে গরু জাগানোর গীত গায়, তাদের বলা হয় "ধাঙড়" । মানভূম এলাকায় ব্যক্তি-নামকে অল্পস্বল্প বিকৃত করে উচ্চারণের রেওয়াজ রয়েছে । তাই "মধু" হয়ে যায় "মধা" , "শিশির" হয়ে যায় "শিশ্ রা"। সেই সূত্রে "ধাঙড়" হয়ে গেছে "ধা'ঙড়া"। মূলত "ধাঙড়িয়া" শব্দটি থেকে "ধাঙড়" শব্দটি এসেছে । শব্দটি নানা অর্থে ব্যবহৃত হয় । "ধাঙড়" মানে "দলপ্রধান" বা "দলপতি" , "জমাদার" , "ঝাড়ুদার" , "অত্যন্ত আপনজন" আবার "যে 'রিঁঝে' অর্থাৎ "নিতান্ত সহজ পুলকে পুলকিত হয়ে নেচে-গেয়ে ওঠে" তাকে বোঝাতেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে । এক্ষেত্রে প্রত্যেকটি অর্থের তাৎপর্যই সম্পর্কিত ।
আর একটি শব্দ "বাঁধনা" । "বন্দনা" থেকে "বাঁদনা", তা থেকে ঝাড়খন্ডী ভাষাতত্ত্বের নিরিখে অল্পপ্রাণ ধ্বনির মহাপ্রাণ ধ্বনিতে উচ্চারণ প্রবণতা থেকে "দ" হয়ে গেছে "ধ"; সঙ্গত কারণে "বাঁদনা" হয়ে গেছে "বাঁধনা"। কেউ কেউ বলেন "বন্ধন" থেকে "বাঁধনা" এসেছে, সে ক্ষেত্রে যুক্তি দেখিয়েছেন, গরু-মহিষ কে বেঁধে খুঁটানো হয় বলে সেই বন্ধন বা বাঁধা থেকে বাঁধনা । এই বাখ্যা ততখানি যুক্তিগ্রাহ্য নয় । তবে গৃহপালিত প্রিয় জন্তুগুলির সঙ্গে মালিকের অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের সম্পর্ক থেকে বাঁধনা কথাটি আসতেই পারে ।
মানভূম- পুরুলিয়া-ঝাড়খণ্ডের লোকজীবনে মনসা পূজা, টুসু পরব আর কালীপূজা দেশের সর্বত্র প্রচলিত দুর্গাপূজাকে টেক্কা দেবার ক্ষমতা ধরে । আজ এই একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকেও পুরুলিয়ার নিতান্ত মফস্বল গৈ-গেরামে গেলে দুর্গাপূজার তেমন কোন উন্মাদনা নজরে আসে না । কিন্তু কালীপূজা পাড়ায় পাড়ায়, ঝোপেঝাড়ে বনে-বাদাড়ে , পাহাড় কোলে , টটক-কুমারী-কাঁসাই-সুবন্নখার তীরে তীরে অনুষ্ঠিত হয় । সকলে অনাবিল আনন্দধারায় অবগাহন করে, নানান রীতি-প্রথা পালন করে যে যার সাধ্যমতো । কালী পূজার দিনগুলি এতদঞ্চলে বাঁধনা পরব নামেই সমধিক প্রচলিত, যা প্রমাণ করে আধ্যাত্ম ভাবনার চেয়ে মানবপ্রেম ও সমাজ-লৌকিক বন্ধনের দিকটি-ই এখানে পাল্লাভারী । দেবতা এখানে মানুষ হয়ে পর্ণকুটিরে প্রবেশ করেছেন, আর আত্মীয়-স্বজন ,গরু-বাছুর হয়ে উঠেছে দেব দেবী, ভগবতী ।
বাঁধনা পরব সুবিস্তৃত ভূগোল সীমায় অনুষ্ঠিত হয় । বহু আদিবাসী , অনাদিবাসী , জাতি ও উপজাতির মানুষ এখানে বসবাস করেন । তাই অঞ্চল ভেদে এই উৎসব উদযাপনের ইতর বিশেষ লক্ষ্য করা যায় । তবে একথা সত্য যে বাঁধনা পরবের মূলগত ঐক্যটি নজরে আসে পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গের সমগ্র ভূগোল সীমায় ।
বাউরি, হাঁড়ি, ডোম মাহাত ,মুচি ,বাগাল, বাগদি, তেলি, তামলি, সূত্রধর থেকে শুরু করে পাত্র, মিত্র, ঘোষ,সেন, বৈদ্য, রজপুত, ব্রাহ্মণ ,ক্ষত্রিয় ইত্যাদি --- প্রায় সকল পরিবারেই বাঁধনা পরবের মূল ক্রিয়া-কর্মগুলি তিন দিন ধরে পালিত হয় । প্রথম দিন অর্থাৎ অমাবস্যায় কালী পূজার দিন কে বলে "জাগান" , পরেরদিন প্রতিপদের দিন "বাঁধনা" বা "চুমান" বা "গর'য়া" আর তৃতীয় দিন "খুঁটান" বা "বুঢ়ি বাঁধনা" ।
অশ্বিন সংক্রান্তির দিন অর্থাৎ জিহুড় দিনের পর পয়লা কার্তিক থেকেই হাতির পারা বাঁধনা পরবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় । বর্ষায় মাটির দেওয়াল যুক্ত খড়ের ঘর নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । সেই সমস্ত দেওয়াল ধারী, উঠোন গু'ছাটি মাটির প্রলেপ দিয়ে তার সৌন্দর্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলে । পুকুর থেকে অনুজ্জ্বল শুভ্র , ছাই রঙের পাঁক তুলে এনে দেওয়ালে লেপন করা হয় নিপুন হস্তে । নানারকম প্রাকৃতিক রং আর খড় পুড়িয়ে গোবরের সঙ্গে মিশিয়ে কালো রং তৈরি করে , খড়িমাটি, গিরিমাটি ,বিভিন্ন সবুজ পাতা, নীল বড়ি ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে সুচারু হস্তের নিপুন অঙ্গুলি রেখায় অঙ্কিত হয় দেওয়াল চিত্র । উৎসবের প্রথম দিন কালী পূজার রাতে মা লক্ষ্মীর আবাহন । লক্ষ্মীর আবাহনের ওপ্রান্তে রয়েছে অলক্ষ্মীকে বিতাড়ন । এই উপলক্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া-কলাপের প্রচলন রয়েছে । এদিন সন্ধ্যাকালে প্রায় সকল গ্রামেই ছেলেমেয়েরা "ইঁজো-পিঁজো" করে । কয়েকটি পাটকাঠি নিয়ে কাঠির মাথায় বিভিন্ন লতা-পাতা ও শন দিয়ে মোটা করে বাঁধা হয় । সন্ধ্যাবেলায় তাতে আগুন জ্বালিয়ে অথবা তার দিয়ে তৈরি একটি অগ্নিবলয় নির্মাণ করে আগুন নিয়ে সুদৃশ্য খেলা চলে । এই আগুন নিয়ে খেলার সময় ছেলেমেয়েরা ছড়া কাটে ----
(১) "ইঁজোরে পিঁজোরে ,
ধোরে মশারে ;
আমদের পাড়ার মশাগুলা'ন
উয়াদে পাড়াক যা রে ।"
(২) "ধা মশা ধা,
যথা খুশি যা ।
মশা গেল বনকে
লক্ষ্মী আ'ল ঘরকে ।"
(৩) " ধা মসা ধা ,
লক্ষ্মী আ'ল ঘরকে
হাভাত রে তুই যা ।"
ইঁজো-পিঁজোর ধা-মসা পর্ব শেষ হবার পর বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীরা গাঁয়ের বাইরে কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে পুরানো ভাঙা-চুরা কুলা-ডালা নিয়ে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় । সেই জ্বলন্ত আগুন তারা লাফ দিয়ে পার হয় আর ছড়া বলে --
"দাইদা বুড়ি দাদ লে
খইশা বুড়ি খোশ লে"
এই প্রথার মধ্য দিয়ে নানান চর্মরোগসহ অন্যান্য রোগ তাড়ানোর একটি সংস্কার পালিত হয় । এরপর তারা প্রথমে ফিরে আসে খামারে, তারপর গোবর কুড়ে এবং সবশেষে ঘরে । সর্বত্রই নিভে যাওয়া পাটকাঠিগুলির একটি করে নিয়ে মাটিতে , গোবরে প্রোথিত করে ।
একটু রাত গভীর হলেই গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে এসে ধাঙড়িয়ারা ভগবতী বন্দনা করে, গাই-গুরু জাগানিয়া গান ধরে, বেজে ওঠে ঢোল ,ধামসা, মাদল ,সানাই ।
এই দিন বাউরী সম্প্রদায়ের মানুষের একটি পবিত্র মধুর অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়, যার নাম "হাঁড়িকাড়া" । কী হয় এই হাঁড়ি কাড়ায় তা সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে কোন এক মানভূমবাসীর লেখা একটি কবিতায় । এখানে সম্পূর্ণ কবিতাটি তুলে ধরছি ---
" আ'জ বাউরীর হাঁড়িকাড়া কাল বাউরীর বাঁধনা...
বাঁধের সাদা পাঁক তুলে এনে ঘরের দেওয়াল ;
দোআঁশ মাটি, গোবর দিয়ে মাটির উঠোন তকতকে করেছে ।
আতপ চালের গুঁড়িতে পা'নালতার রস মিশিয়ে উঠোন ভর্তি আলপনা ,
মা লক্ষ্মীর পদচিহ্ন ।
আজ হাঁড়িকাড়া
পুরানো যতো মাটির হাঁড়ি-কুঁড়ি-খলা ফেলে দেওয়া ।
নদী, জোড় , কিংবা পুকুর থেকে
মাথায় ক'রে নতুন হাঁড়িতে জল আসে ।
গোবর দেওয়া মাটির উনুনে ভাত রান্না হয় ,ডাল ও বেসাতি ।
সাত পুরুষের উদ্দেশে ষোল পাতায় চাল সিজা ।
ডাল ,তরকারি ,পান, খৈনি, বিড়ি, মাংস, মদ
সাজিয়ে দিয়ে আগুড় ঠেসিয়ে দেয় আশা ।
বাইরে দাঁড়িয়ে সব চুপচাপ ।
ভিতরে পিদিম জ্বলে, ষোড়শ নৈবেদ্য
খেয়ে যায় সাত পুরুষের প্রেত।
তারপর আত্মীয় বান্ধব সহ চেটেপুটে প্রসাদ খেয়ে হাঁড়ি কাড়া সাঙ্গ হয় ।
সারাবছর ওই হাঁড়িতেই ভাত ,
ওই খলাতেই সজনে শাগ সিঝা।
রাত পোহালেই বাঁধনা পরব ।
গাই-গরুর বিয়া আর জামাই উত্থানো ।
আশা বউ ।
মানে আশালতা বাউরী
সন্ধ্যাবেলা দাঁড়িয়ে থাকবে
ভালোবাসার সাজিয়ে নিয়ে উত্থন থালায় ,
ঘরের খুঁটায় বেঁধে দেবে ধানের মুকুট ,
শোভা পাবে সর্ষে তেলের প্রদীপ দূর্বাঘাস আর এক মুষ্টি আলো ধান ।
আজ বাউরির হাঁড়িকাড়া , কা'লকে গরুর বিয়া।"
পরবের দ্বিতীয় দিন "বাঁধনা" বা "চুমান" বা "গর'য়া" । সকাল থেকে প্রতিটি পরিবারে সাজো সাজো রব । কুলি বা পথ থেকে আঙিনা দিয়ে গোয়াল পর্যন্ত আতপ চালের গুঁড়ির সঙ্গে পা'নালতার রস মিশিয়ে বিচিত্র আলপনা অংকনের পালা । গোধূলি বেলায় সেই আলপনার উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হবে লকলকে সবুজ ঘাস । সকাল থেকেই তো গাই গরু বাছুর কে যত্ন করে সাবান মাখিয়ে স্নান করানো হয়েছে । সিঙে ঘষে ঘষে মালিশ করা হয়েছে সরষের তেল । ধলা-শ্যামলা বর্ণের গাই-গরুর সারা গায়ে লাল, নীল আর কালো রঙের হ'লে তাদের গায়ে সাদা রংয়ের বিচিত্র অঙ্কন , গোল গোল ছাপ-ছোপ । বিকেলের আগে মাঠে গিয়ে গাই-গরুদের চরিয়ে নিয়ে আসে রাখাল বালক অথবা বাড়ির মালিক স্বয়ং , যখন গোধূলি বেলায় সেই আলপনার উপর দিয়ে সবুজ ঘাস চিবোতে চিবোতে তারা গোয়ালে প্রবেশ করবে তখন ঘরের মহিলারা কাঁসার থালায় হলুদজল, ধান,দূর্বা নিয়ে তাদের পায়ে ছিটিয়ে দেবে । তার আনন্দের সঙ্গে ধীরে ধীরে গিয়ে গোয়ালে পৌঁছাবে । রাত্রিবেলায় গৃহবধূরা নানান পূজার সামগ্রী আর প্রদীপ সহ ভালোবাসা সাজিয়ে নিয়ে উত্থন থালায় তাদের সম্মান জানাবে । গাই-গরুর বিয়ে দেবে । উলু ধ্বনি ও শঙ্খধ্বনিতে সারা ঘর-বাখুল আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠবে ।
হঠাৎ করে কার্তিকের অমাবস্যা রাতে গরুদেব প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান জানানোর কেন এই ঘটা ? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে অবতারণা করতে হয় প্রাসঙ্গিক একটি লোকগল্পের ।
" সে অনেক প্রাচীনকালের কথা , সেকালের একটি গাছপাথরেরও অস্তিত্ব নেই এখন । গরু-মোষ ইত্যাদি গৃহপালিত জন্তু একদিন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিল । মানুষের বড়ো অত্যাচার, শোষণ,পীড়ন , নির্যাতন ! তাই আমরা আর মানুষের উপকার করবো না । বিষয়টি তো অত্যন্ত কঠিন । এরা যদি মানুষের ঘরে পরিশ্রম না করে, তাহলে তো সৃষ্টি রসাতলে চলে যাবে !
রসাতলের যাক আর জাহান্নামেই যাক, তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল আর মানুষের ঘরে খাটবে না । দিনরাত রোদে পুড়ে, জলে ভিজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটু ভালো খাবার দাবার পর্যন্ত পায় না । উপরন্তু ক্লান্ত , অবসন্ন, কঙ্কালসার দেহ নিয়ে লাঙ্গল , গাড়ি টানতে না পারলে উপর্যপুরি চাবুক মারে নিষ্ঠুর মানুষ । আর তাদের গৃহবধূদের কথা তো বলারই নয় । তাদের দুরবস্থার , মাতৃ হৃদয়ের যন্ত্রণার অন্ত নেই । বেঁধেছেঁদে সবটুকু দুধ দুয়ে নিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে । আর তাদের ছেলেমেয়েরা শুকিয়ে প্যাকাটি কাঠির মতো নীরস, ঠুনকো হয়ে যায় । তাই তারা এবার সকল কাজ ও সেবা বন্ধ করে সর্বাত্মক ধর্মঘটে সামিল ।
খবরটা নারদের মধ্যস্থতায় দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে গিয়ে পৌঁছালো । একে একে সকল গরুবাছুর মহাদেবের দরবারে গিয়ে একই নালিশ জানালো । দেবাদিদেব মাথা ঠাণ্ডা রেখে তাদের বোঝালেন , এতো অল্পে অস্থির হলে তো চলবে না বাবা , তোমরা শান্ত হয়ে আপাতত কাজে যোগ দাও । আমি সরজমিনে তদন্ত করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবো । আগে নিজের চোখে না দেখলে শুধুমাত্র তোমাদের কথা শুনেই মানুষকে অপরাধী বলে শাস্তি প্রদান করা তো আমার ঠিক হবে না । এ তো কখনো দেবতার কাজ নয় ।
কথাটির যুক্তি আছে বুঝে তারা পুনরায় কাজে যোগদান করে । দিন যায়--- রাত যায় --- অবশেষে একদিন এগিয়ে এলো কার্তিক মাসের ঘোর অন্ধকার অমাবস্যার রাত্রি ।
গভীর রাতের অন্ধকারে বৃষবাহন পশুপতি তাঁর ষাঁড়ে চেপে মর্ত্যে অবতীর্ণ হলেন । এসে যা দেখলেন তাতে তো তিনি গরু-মোষের প্রতি বিব্রত হলেন, বি
বেজায় ক্রুদ্ধ হলেন । কারণ কারো না কারো মাধ্যমে মানুষ খবর পেয়ে গেছে যে, এই দিন রাত্রিবেলা মহাদেব আসবেন গরু বাছুরদের অবস্থা পর্যবেক্ষণে । আর মানুষ তো বড় ধুরন্ধর প্রাণী । দুষ্টু বুদ্ধিতে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের কেউ-ই তার সমতুল্য নয় । তাই তারা আগের থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দেয় । ঝকঝকে উঠান, তকতকে গোয়াল , চকচকে তাদের শরীরে নানা বর্ণের সুদৃশ্য অলংকরণ, সিং দু'টি সরষে তেলের ঘর্ষণে ঘৃৎ প্রদীপের আলোর ছটায় জ্বলজ্বল করছে । কপালে সুশোভিত ধানের মুকুট, সিঁদুরছর বিন্দু । তাদের উদরপূর্তির জন্য ছানি, খোল, ঘাসের ছড়াছড়ি , দনে সুমিষ্ট চুবি ।
মহাদেব এসে যা দেখলেন , তাতে তিনি অকৃতজ্ঞ প্রাণীগুলির উপর বেজায় চটে গেলেন । তাঁর মাথার সর্প পর্যন্ত পশুপতির ক্রোধের কারণে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো । মাথার জটা খাড়া হয়ে গেল । তিনি ওই পশুদের অভিশাপ দিলেন, "যা বাছা ,তোরা চিরকাল পরের ঘরেই খেটে মরবি" আর মানুষকে আশীর্বাদ জানালেন , "তোমাদের লক্ষ্মী লাভ হোক । তোমরা পাঁচপুতা দশ ধেনু গাই নিয়ে সুখে ঘরকন্না করো ।"
সেই সে কাল থেকেই গো বন্দনা চলে আসছে কার্তিক অমানিশার অন্ধকারে । এদিক থেকে এক বিচারে এই উৎসব মানুষের কূটনীতির বিজয় স্মৃতি । তবে ধীরে ধীরে মানুষের এই কূটনীতির বিজয় পর্ব প্রাণীকুলের প্রতি কৃতজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে । শুধু গরু-মোষ নয় , মানভূমের মানুষ সকল কৃষি যন্ত্রপাতি যথা ---লাঙ্গল, মই, জোঁয়াল, গাঁইতি, কোদাল, শাবল, এছাড়া ঘরের খুঁটি, দরজা-জানালা গো-গাড়ি সমস্ত কিছুর প্রতিই কৃতজ্ঞতা জানায়, বন্দনা করে, পূজা করে ধানের মোড় পরিয়ে ।
পরবের তৃতীয় দিন -- খুঁটানো । মানে গরু খুঁটা , কাড়া খুঁটা । সে এক অদ্ভুত উন্মাদনা । নিজের চোখে না দেখলে কিছুতেই বোঝা যায় না পশু ও মানুষের আনন্দ মিলন মেলায় কোন্ উদার অভ্যুদয় ঘটতে পারে । এই দিনই আবার ভাইফোঁটা । ভাইকে ফোঁটা দিয়ে ফোটার সময় বোনেদের হৃদয় নিঙড়ানো উচ্চারণ ---
"ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা ।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা ।"
অঞ্চল ভেদে, স্থান ভেদে পাঁচ দিন ধরে উৎসব চলে এবং সমগ্র মানভূমের নানা প্রান্তে বিভিন্ন দিনে নানারকম টুকরো টুকরো সংস্কার, রীতি -প্রথার প্রচলন রয়েছে ; যেগুলির এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের কোন মিল নেই । সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই তিথিতে উৎসবের আনন্দঘন উদ্বেলতা পরিলক্ষিত হয় । তাদের উৎসব "সহরায়" বা "সঁহরই" বা "সহরাই" নামে পরিচিত । তাঁদের তো বারো মাসে তেরো আনন্দ-বিনোদন লেগেই আছে । তবুও তাঁরা নিজেরাই স্বীকার করেন এই সহরায় তাঁদের "হাতির লেকিন পরব" অর্থাৎ সবচেয়ে বড়ো পরব । সহরায় শব্দটির অর্থ প্রশংসা বা প্রশস্তি । এখানে ভগবতীর প্রশংসা । দৈনন্দিন জীবনে গাই গরুর অতুলনীয়, অনুপম অবদান । সেই কারণে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উৎসব । পাঁচদিন ব্যাপী চলে এই আনন্দধারা । পাঁচ দিনের জন্য কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীরা খুঁজে পায় বাধা বন্ধনহীন মুক্ত প্রাণের উল্লাস ।
প্রথম দিন "উম" । এটি ঘরদোর উঠান প্রাচীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সংস্কার করার দিন । দ্বিতীয় দিন-"বঙা বুরু" বা "বঙা-মাহা"। এদিন মূলত পূজা-অর্চনা । তবে কম-ঝম নাচ-গানও হয় । সারারাত চলে ভগবতীর বন্দনার গান । তৃতীয় দিন "খুন্টাও মাহা"। এ দিন খুঁটিতে বেঁধে গরু কাড়া খুটানো হয় । চতুর্থ দিন "জালে মাহা"। দিনটিকে "খুন্টি তোৎ"ও বলা হয় । আগের দিন যে খুঁটিতে বেঁধে বলদ মোষকে খুঁটানো হয়েছে , সেই খুঁটি উৎপাটনের দিন এটি । পঞ্চম দিন অর্থাৎ উৎসবের অন্তিম দিনটির নাম "গাদয় মাহা"। এটি সর্বত্র উদযাপিত হয় না । কোন কোন এলাকায় পালিত হয় । এদিন শুধু যুবক-যুবতীরাই নয় , বুড়ো-বুড়িরাও একত্রে বাড়িতে বাড়িতে হাস্যকৌতুকে মেতে ওঠেন।
উৎসব ফুরিয়ে গেলেও মানভূমের আকাশে বাতাসে তখনও আনন্দের রেশ , কান পাতলে তখনও শোনা যায় পৃথিবীর এক ব্যতিক্রম কাব্য সুষমামণ্ডিত সরস সংগীতের অনুরণন ----
" জাগো মা লক্ষ্মীনি, জাগো মা ভগবতী
আজি ত আমাবস্যার রাতিরে
(আর )জাগেকা প্রতিফল দিবে গো মহাদেবে
পাঁচপুতায় দশ ধেনু গাই রে---"
সমস্ত পরিবারের পিতা-মাতার অন্তরে অন্তরে ধ্বনিত হয় ঈশ্বরী পাটনীর শাশ্বত প্রার্থনা ---"আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে"।
ফিনিক ফোটা জোছনা
রোমন্থন
সুজন পণ্ডা
এ আমার রোজকার হেঁটে যাওয়া। এই নীপবিথী, আঙুলে জড়িয়ে যাওয়া অপরাজিতা, ধুলোর ঘূর্নী সব আজন্মের আত্মীয়।
কোথায় কেউ একতারা বাজিয়ে শরীরে ধারণ করছে মহাকাশ। ওই শোনো...
আমার হাত ধরো।
তাকে বসে থাকতে দেখলাম নদীর ঘাটে। শেষতম সিঁড়িতে। হয়তো জলে পা ডুবিয়ে স্রোত ভাঙছে... হয়তো এমনিই ভাসিয়ে দিচ্ছে দিনের ক্লান্তিগুলি সব।
হাওয়া নেই এখন। আমি একটু অপেক্ষা করতে পারি। হাওয়া বইলে ওর চুল উড়বে। চুলের গন্ধ মিশে যাবে কদম ফুলের ঘ্রাণে।
রাত্রির এই মুহূর্তগুলি এত নির্জন হয় কেন? সমগ্র বিশ্বে কি কেবল আমরা দুটি প্রাণী মাত্র আছি? এত নির্বাক নিশ্চুপ কুয়াশা... মাথা ঝিম ঝিম করে। আমার চিরকালের এই পথ, এই হেঁটে যাওয়া হঠাত দু দন্ডে এরকম এলোমেলো লাগে কেন?
শরীর জড়িয়ে মহাবিশ্বের বেড়ে ওঠার কল্পনা আমার বহুদিনের। মাঝে মাঝে জোছনার এই রাত্রি গুলিতে নিজেকে পৃথিবীর চেয়ে কতো বড় লাগে, হাতের মুঠো চাঁদে ভর্তি, জ্যোৎস্নায় ভিজে যায়... আমার দেহ থেকে শুরু হয় মহাকাশ... আমার দেহেই কোথাও শেষ হয়... ওই তার একতারা বাজে। ওই নারী যদি সেই সুর শোনে কখনো? যদি উঠে আসে নদী ঘাট ছেড়ে... আমার রাত্রি ছলাৎছল.... ।
কল্পনায় আমি শূন্যচারী। আমার মহাকাশ জুড়ে জল, জ্যোৎস্নার মতো। আমি সাঁতার দিয়ে উঠবো কোনো কদম ফুলের ঘাটে, কোনো উপগ্রহে।
সে কবেকার কথা, এক রাত্রে আমি হেঁটে অথবা ছুটে পার হচ্ছিলাম নগর, রাজপথ.... কেউ ডেকেছিল বিষাদে। একতারায়। সেই কী প্রথম রাত, প্রথম চাঁদ? হয়তো। ভয়। ফাঁকা রাত্রি।
এভাবে এখানে তখনও নিশ্চুপ কুয়াশা, নদীর ঢেউ ভাঙচুরের মধ্যে কোথাও হাওয়া ছিল না। শুধু কদম ফুলের ঘ্রাণ। গলিত জ্যোৎস্নায় দূরত্বের হিসেব করতে পারা যায় না, হাত দশেক হতে পারে কিম্বা আলোকবর্ষ। সেই মেয়েটি, যার চুলের গন্ধ সেদিনও আসেনি, আজও পাইনি ঢেউ মাখতে মাখতে মিশে গেছিলো নদীতে, জ্যোৎস্নায়, মহাবিশ্বে। ছুঁতে পারিনি, আটকাতে পারিনি।
কোন এক শক্তি পায়ে জড়িয়ে গিয়েছিল। নীল অপরাজিতার লতা হতে পারে, এখন মনে করতে পারি না আর।
আজও সেই নারী সেখানেই, সেই ঘাটে আমারই অপেক্ষায় কি? নাকি অপেক্ষা সেই জোছনা লগ্নের। রোজকার মতো। সেই নারী বসে থাকে তারপর ধীরে ধীরে নেমে যায় নদীতে। প্রথমে আকণ্ঠ তারপর আরো গভীর জোছনায়। প্রতিদিন। সেই দিন থেকে প্রতিদিন। আমার নীপবিথী, অপরাজিতা লতার রাস্তা একই থাকে, সেই হাওয়া বাতাস হীন মুহূর্ত... সব এক। একেকটি, প্রত্যেকটি ব্রহ্মাণ্ডে আমি ঘুরেছি। কিচ্ছু বদলায় না।
সেই সন্ধ্যায় তখনও চাঁদ নেই আকাশে, শুধু দুয়েকটা তারাফুল জোনাকি পোকার মতো ইতস্তত পুব আকাশ জুড়ে। একটি নারী ও একটি পুরুষ... কি কারণ, কতোটা প্রয়োজন কে কার তোয়াক্কা করে... হিংসা মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। সভ্যতার মুখোশ ভেঙে তুমুল ঝগড়া...।
কি হতে কি হলো... কার্য কারণ খোঁজেনি দুজনের কেউই। যতোটা না হলেও চলতো ততোখানি ঝগড়া... তার ঢের বেশি অভিমান।
নারী বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে, পুরুষের মুখে শ্রাবণ মেঘ।
বহুক্ষন পরে হুঁশ ফিরলে আমি রাস্তায় বের হয়ে আসি... কোথায়... আর কতদূর?
ততক্ষণে চাঁদ, জ্যোৎস্না... রাজপথ জুড়ে আলো... একলা শহর খুঁজছি তন্নতন্ন করে। একটি নারীকে। তার চুলের গন্ধ আমার খুব চেনা।তার হাসি, হাত... কপালের ঘাম। কোথায়? সারা শহরে এত্ত মানুষ, সে কই? রাত বাড়তে বাড়তে নিস্তব্ধ অলিগলি।
তার অনেক পরে এই নীপবিথী।অপরাজিতার লতা। এই নদীঘাট।
আমার চোখের সামনে আমি সমগ্র বিশ্বকে দেখেছি অভিমানে ডুবে যেতে। আমার ভারী পা। আমার অসহায় আত্মসমর্পণ।
এই রাস্তা আমার আজন্ম আত্মীয়। আমার চিরকালের একতারা। এই জ্যোৎস্না আমার চিরকালের পানীয়। অপরাজিতার পাতায় পা পড়েছে আমার মুক্তি নেই।
অন্ধকারের উপকথা থেকে ভদ্রাসন : আদিচেতনার প্রবাহ চারণা
তৈমুর খান
'অণুগল্প' ছোট করে লেখা গল্পের রূপ নয়। অণুগল্প স্বতন্ত্র একটি সাহিত্য ধারা—যার আদি-মধ্য-অন্ত থাকা, কিংবা 'শেষ হয়ে হইল না শেষ' পরিণতিতে পৌঁছানোর বিষয়টিও ততটা জরুরি নয়। এর ঝটতি উত্থান এবং ঝটতি পতন, কতগুলি রেখাঙ্কিত শব্দচিত্র, যার মধ্যে জীবনদর্শন, অস্পষ্টতা বা রহস্যময়তা বা অধরা ও না-বলা বিরাজ করে। এরকমই দুটি বই নিয়ে এই লেখার আয়োজন।
মানুষের সাইকোলজি বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ান মনস্তত্ত্ববিদ সিগমণ্ড ফ্রয়েড মানবজীবন সম্পর্কে বলেছেন:
“We are what we are because we have been what we have been, and what is needed for solving the problems of human life and motives is not moral estimates but more knowledge.”
অর্থাৎ আমরা যা রয়েছি কারণ আমরা যা ছিলাম তাই আমরা ছিলাম, এবং মানুষের জীবন এবং উদ্দেশ্যগুলির সমস্যা সমাধানের জন্য যা প্রয়োজন তা নৈতিক অনুমান নয় বরং আরও জ্ঞান। অর্থাৎ মানুষ যে আদিমতা নিয়ে তার প্রবৃত্তিযাপনের অভিমুখ উন্মোচিত করে তার পরিবর্তন করা যায় না। জীবন জীবনের দাবি নিয়েই চলতে বাধ্য। কথাগুলি মনে পড়ল ব্রতী মুখোপাধ্যায়ের অণুগল্পের বই 'অন্ধকারের উপকথা' (২০১৭) পাঠ করতে গিয়ে। মানবজীবনের এই অন্ধকার যা যৌনতা, সহিংসতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, হিংস্রতা, কঠোরতা এবং অসহিষ্ণুতা ও অসামাজিকতার মধ্যে কেন্দ্রীভূত। মোট ৬৪টি অণুগল্পের ভেতর দিয়ে লেখক জীবনের পাঠ দিতে চেয়েছেন। যে পাঠের মধ্যে আছে রহস্য, অর্ধস্ফুটতা, ছায়াছন্নতা, না-কথা ও শূন্যতা। তবে পারিপার্শ্বিক মানবজীবনের নানা অন্তরায় কিভাবে ঘনীভূত হয়েছে, জীবনের ছেঁড়াখোঁড়া মালিন্য, হতাশা, বিপন্নতা, মনুষ্যেতর জীবন, রাজনৈতিক চক্রান্ত খুনজখমের ইঙ্গিতময় কাহিনিও তিনি সংকেতবদ্ধ করেছেন।
গ্রন্থের দুটি অংশ—'বেহুলামঙ্গল' এবং 'মহাকাহিনিপাঠ'। দুটি অংশ জুড়েই আছে অন্ধকারযাপনের জীবন অন্বেষণ। নেশাখোর পুরুষের সাপিনী রূপ নারীর যৌনছোবলের বিষ নামানোর কাহিনি থেকে নারীর প্রেমিকা রূপ এবং স্ত্রী-রূপের আসক্তির পরিচয়। স্বামী ও প্রেমিক দুয়েরই অভাবে তার বিরহ চেতনা। শরীর বিক্রি করে জীবনধারণের পরিচয়। তেমনি শরীরও ভিক্ষার ঝুলি। অল্প টাকাতেই তা ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। মনস্তাত্ত্বিকভাবেই তার সন্তানের মধ্যেও চারিত হয় এই আচরণ। বোষ্টুমির ভালবাসার আসক্তি কখনো কান্নার রূপ পায়। প্রেমিকের চোখে সেখানে শরীরী রূপটিই প্রকট হয়ে ওঠে। রাজাবাদশার মতো রূপকথার গল্পেও পুত্রসন্তান জন্ম দিতে অক্ষম রানি রাজার অনুমতিতেই পুত্রসন্তান লাভের আশায় সন্ন্যাসীর আশ্রমে কামক্রীড়ার সুখ পায়। তখন রাজঐশ্বর্যও তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। তেমনি কাজের মেয়ের মধ্যেও এই যৌনতার আবির্ভাব ঘটে। অসম ব্যাপার হলেও তা স্বাভাবিক। কখনো গুরুজি ছাত্রীর মায়ের শরীরও ভোগ করে।বাড়িতে ছাত্রীকে পড়াতে আসা টিউটরও ভোগ করে। টিউটর গুরুজির মতলব জানতে পেরে বলে "তন্দ্রার পিরিয়ড হয়েছে। চান্স নেই এবার।"
অধ্যাপিকা হলেও অনেক পুরুষ সঙ্গী দরকার হয় বাণীদির। বৃষ্টির দিনে কেউ না থাকলে হাবুকেই জড়িয়ে ধরে। সঙ্গমের অনুভূতি পাপ মনে হলেও আবার তা কেটে যায়। পুরনো প্রেম নতুন করে জেগে ওঠে। মননশীল যৌনতার মোচড় যা তির্যক গতিময় অন্ধকারের সংলাপ। পরকীয়ায় সিক্ত, দাম্পত্যে বিচ্ছেদ, ব্যবহারে বৈপরীত্যের প্রকাশ, সেখানে কান্নার মধ্যেও যৌনতার উদ্ভব ঘটে। আত্মচেতনার মধ্যেও যৌনতার কাল্পিক দেহ নির্মাণ চলতে থাকে। রেন্ডি নারীর বহু পুরুষের সংস্পর্শ, প্রেমকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য সমলিঙ্গ হওয়া এবং প্রকৃতির মধ্যেও জৈবনিক সংলাপ গল্পগুলিকে তীব্র ও তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। কবিতার শরীরে লেপ্টে গেছে মায়াময় জীবনচক্রের আধার।
'মহাকাহিনিপাঠ' অংশেও সময়ের গতিনির্ধারক নদীপ্রবাহে ভেসে উঠেছে অজস্র ঘটনার ঘনঘটা। মহাভারতের মহারণকে উল্লেখ করেই এই গল্পচক্রের প্রজ্ঞাবিন্যাস। এখানে সব গল্পই 'দুঃখে সেলাই করা'। বস্তিবাসী, প্ল্যাটফর্মবাসী, উদ্বাস্তু মানুষের জীবনচক্রের বেশি প্রতিফলন ঘটেছে। শ্রমিকের মৃত্যু, রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যু, জয় শ্রীরাম ধ্বনি,মবলিঞ্চিং, গৃহযুদ্ধ, মাওবাদী কিষানজির কথা, অসহায় জীবনের কথা সবই উঠে এসেছে। আর এসব নিয়েই অন্ধকারের রূপকথা। একটি সংলাপ উল্লেখ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে:
"—ওই যে কে একজন না খেয়ে মরে গেল…
—বাচ্চা মেয়ের হাতের আঙুল পুলিশ এসে কেটে ফেলল…
—একটা মেয়ে স্কুল থেকে ফিরছে, তাকে পাঁচ-সাত জন মিলে…
—তারপর ওই চাপাতি, পেট্রোলবোমায় জ্বলছে যাওয়া মুখ, বাপের সামনে খুন হয়ে গেল ছেলে…."
এইসব সময়ের অবক্ষয়, মূল্যবোধহীন চিত্রগুলি গল্পের বিষয়। লেখক এখানেই জীবনকে খুঁজেছেন। কিন্তু জীবন সেই আদিম অভ্যাসেই ক্রিয়াময় বন্যসভ্যতা নিয়ে বিরাজ করছে।
দুই.
মানুষের অবচেতন মনের ক্রিয়া সম্পর্কে সিগমুন্ড ফ্রয়েড আরও বলেছেন:
“There is a powerful force within us, an unilluminated part of the mind— separate from the conscious mind that is constantly at work molding our thought, feelings, and actions.”
অর্থাৎ আমাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী শক্তি আছে, মনের একটি অপ্রকাশিত অংশ—সচেতন মন থেকে আলাদা যা আমাদের চিন্তা, অনুভূতি এবং ক্রিয়াকে ঢালাই করে নিরন্তর কাজ করে।ব্রতী মুখোপাধ্যায় তাঁর আরেকটি অণুগল্পের বই 'ভদ্রাসন'(২০১৭)-এও মানবমনের গহনগভীর অবচেতনের ক্রিয়াগুলিকে তুলে এনেছেন, যা চিরন্তন জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আত্মপ্রকাশ করে। তাই গল্পগুলিতে বাল্য-কৈশোর-বয়ঃসন্ধি-যৌবন এবং বিগত যৌবন ও বার্ধক্যের নানা ক্রিয়া, উপলব্ধি ও ভাবনার প্রকাশ আছে। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনের অন্তরালে মানুষ কিভাবে আদিম প্রবাহে অবগাহন করে চলেছে তা অকপটভাবে দেখিয়েছেন। 'ভদ্রাসনে' মোট ৫৩ টি গল্প আছে।গল্পগুলিকে তিনটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে: 'স্নাতক', 'রূপকথার দেশে' ও 'যুদ্ধ'। গুরু-শিষ্যের অস্ত্রবিদ্যা-পরীক্ষার সংলাপের ভূমিকা দিয়ে গল্পের প্রথম পর্ব শুরু হয়েছে। পক্ষীর চক্ষুতে তিরবিদ্ধ করতে গিয়ে শিষ্য অস্ত্র ত্যাগ করতে চেয়েছে। স্নাতক হতে পারেনি। গল্পের রহস্যের মধ্যে লেখক পাঠককে ছেড়ে দিয়েছেন। কেন, কিভাবে, কোথায়, কে বা কারা তার কোনো স্পষ্ট সদুত্তর বা কারণ পাওয়া যাবে না। বাড়ির ঝির বুকে হাত, চুমু খাওয়া; কুকুর পাহারা দিলেও বোবা মেয়ের পেটে বাচ্চা আসে; রিক্সাওয়ালা মার্ডারার তা স্বীকার করে; কাশি, কোমরের হাড় ভাঙা, জ্বর, পালানো মেয়েকে ফিরিয়ে আনা, বউকে বশে রাখা, চাকরিপ্রাপ্তি প্রভৃতির জন্য মন্দিরে পূজা দান; সবজি বাগানে ফুল নেই কিন্তু নবম শ্রেণির মেয়েই ফুল প্রভৃতি বিষয়গুলি গল্প হয়ে ওঠে। যৌবনের পড়াশুনা, বই সংগ্রহ,কত-কী জানার আগ্রহ কিন্তু জীবন সায়াহ্নে উদাসী মন সেসবে আর কৌতূহল নেই। শিশুমনস্তত্ত্বের প্রভাবে মান-অভিমান, বৃদ্ধ বয়সের নিঃসঙ্গতা বারবার ফিরে এসেছে।
গল্পের দ্বিতীয় পর্বে পুরাণপ্রসঙ্গেই রোমান্টিক আবহ; সেখানে প্রিয়ংবদার নিতম্বের মায়াদোলন এবং ভ্রূ-যুগলে রহস্যসাপ আদিমচেতনার প্রজ্ঞাকেই ইঙ্গিত করেছে। এই পর্ব শুরু হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর সংলাপে রাতে বিছানায় ঘাম ঝরানোর কামক্রীড়ায়। তারপর এক কবির সঙ্গে অন্যের বউ পালানোর প্রসঙ্গ। সুন্দর মার্জিত শিক্ষিত পুরুষের প্রেমে পড়ে দেখা গেছে সেও সমকামী। আবার সদ্য বিবাহিত পুরুষেরও অত্যাধিক কামুক পরিচয়। শিশু বয়সে ফুলের সৌন্দর্য মায়ের কাছে বর্ণনা করলেও যৌবনে মেয়েদের বুকে ফুটে ওঠা স্থলপদ্মের বর্ণনা করতে পারে না। শ্বশুর-বৌমার দৈহিক সম্পর্ক এবং মায়ের স্বর্ণালংকার হারানো প্রসঙ্গও খুব মনস্তাত্ত্বিক। অধ্যাপকের পরকীয়ায় পাপ-পুণ্যের ধারণারও নস্যাৎ হওয়া সবই আদিম চেতনার প্রবাহের শামিল।
তৃতীয় পর্বে আছে যুদ্ধপ্রসঙ্গ। এই যুদ্ধ একদিকে ইতিহাসখ্যাত বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ আতঙ্কের স্মৃতি, অন্যদিকে জীবনযুদ্ধ, বেঁচে থাকার আয়োজন। কিন্তু লেখক সুকৌশলে মনস্তত্ত্ব প্রয়োগ করেছেন, যার ফলে যুদ্ধ ব্যক্তিজীবন এবং সমাজজীবনেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই পর্বের ভূমিকায় স্ত্রী সঙ্গমে অকৃতকার্য স্বামীর হতাশা ফুটে উঠেছে । অর্থাৎ যৌনযুদ্ধে সে পরাজিত। গল্পগুলিতে ফিরে এসেছে ধর্ষণ, পুড়িয়ে মারা, প্রতিবাদী মিছিল, যুবকদের হাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করা ইত্যাদি নানা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। প্রেমিকার বিয়ে ঠিক হলেও, প্রেমিক বামপন্থী রাজনীতিতে দেওয়াল লিখনে ব্যস্ত।বিপ্লবস্পন্দিত পৃথিবী আনবে সে। রাজনৈতিক পোস্টার দেওয়ালে সাঁটার জন্য ঘুঁটেগুলো ফেলে দেয়। বোমা বাঁধতে গিয়ে হাত উড়ে যায়।'ছাই ছাই গন্ধ রাত্রির বাতাসে'। ব্যর্থ কবিও পত্রিকার সম্পাদক হয়ে বসে।নারী কবির প্রতি তার দুর্বলতাও প্রকাশিত হয়।এভাবেই 'ভদ্রাসন' রচিত হয়।
দুটি গল্পগ্রন্থেই বাস্তবতার নিরিখে লেখক অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করেছেন। বিশেষ করে প্রচলিত সংলাপ, জীবনের দ্বান্দ্বিক পর্যবেক্ষণ, হতাশা-ক্লান্তি, যৌনতা, পাশবিকতা এবং আদিমতাকে লিখতে গিয়ে কোথাও কার্পণ্য করেননি। ক্ষুদ্রপরিসরে মানবতরঙ্গের অতিসূক্ষ্ম এবং অনপনেয় ভাবকে সংকেতবদ্ধ করেছেন। রূপকাশ্রয়ে মূল বিষয়টির প্রতিই পাঠকের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছেন।কোথাও সমাধানে যেতে চাননি। সুতরাং গল্পগুলিত লেখকের নিজস্বতা ক্ষুন্ন হয়নি।
১) অন্ধকারের উপকথা: ব্রতী মুখোপাধ্যায়, ২৪ বাই ৭ পাবলিশিং কম, ১৩ নিউ রোড, কলকাতা ৭০০০৫১, প্রচ্ছদ:অঙ্কন মাইতি, মূল্য ১৭৫ টাকা।
২) ভদ্রাসন: ব্রতী মুখোপাধ্যায়,কথা ও কাহিনি প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩, প্রচ্ছদ: অঙ্কন মাইতি, মূল্য ১০০ টাকা।
______________________________________________
আগের সংস্করণের পাঠ প্রতিক্রিয়া
______________________________________________
১/ প্রিয় উত্তম,
তোমার সম্পাদকীয় মাঝে মাঝে একটি অন্য ঘরানার স্বাদ দেয়।
কবিতা অংশে অনেকগুলি নতুন নামের লেখকের সঙ্গে পরিচিত হলাম।
মুশকিলটা বরাবরের অভিজ্ঞতার সামনেই নিয়ে ফেলে। তবে ভাবনার কত নতুন প্রয়াশ! দুঃখের বিষয় স্বরের এবং চালের নতুনত্ব যেটা ঝুঁকির ---- অর্থাৎ যা নতুন সুরে পড়িয়ে নেয় লেখাকে। তার নিজস্ব ভাষায় অভ্যস্ত করে তার দেখা পেতে অনেক দিন ধরে চেয়ে আছি ---- কিন্তু সেই চেয়ে থাকা চেয়ে থাকাই ---- ।
তবে এখানে এবারে বেশ কিছু ভালো কবিতা পড়লাম। তাঁরা যথেষ্ট দক্ষতায় নুতুন নতুন ছবি তুলে এনেছেন কবিতায়।
এটি তো কম প্রাপ্তি নয়!
ছবি প্রদর্শন-শালা বিভাগের ছবিগুলি যথেষ্ট বর্ণময়। যন্ত্রের দক্ষতা মানুষের হাতে, মানুষের চোখে, মানুষের মনের হাত ঘুরে সৃষ্টিকে কত অন্য মাত্রা এনে দিতে পারে, সেটাই আমরা দেখি চোখ মেলে চেয়ে। এটা কি কম বড়?!
----------সাহিত্যিক দীপংকর রায়
২/ সম্পাদকীয় কলম টা অসাধারণ 😊
কে রাখে কার জিডিপি'র খোঁজ।
ওরা ওদেরটাই দেখে আমরা তো শিকড়কে আকড়ে পড়ে আছি। ওদের শিকড় দেখার সময় কোথায়।
-----------কবি ভাগ্য
৩/ কবিতা গুলো পড়ে ভালো লাগলো।
----------কবি পার্বতী রায়
৪/ ছবিগুলো প্রাকৃতিক, সুন্দর।
লেখাগুলো পড়ে ভালো লাগলো।
---------কবি শ্যামাপদ মাহাত (বাঁশি)
৫/ খুব ভালো লাগলো জয়দেব চক্রবর্তী-র তোলা বেশিরভাগ ফটো।কয়েকটি ফটো বিমূর্ত চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত।
------------সাহিত্যিক স্বপন চক্রবর্ত্তী
৬/ 'অরন্ধন'-৬ নভেম্বর'২০২৩ সংখ্যায় চোখ বুলোলাম। 'অরন্ধন'-এর সম্পাদকীয় পড়ি। এই সংখ্যার সম্পাদকীয়তে সম্পাদক তাঁর নিজস্ব ভূমিতে দাঁড়িয়ে আবেগতাড়িত। কিন্তু, পুরুলিয়ার কৃষি-অর্থনীতি যে আজ কতটা বিপন্ন, এ বিষয়টা ভুক্তভোগী, বিশেষভাবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা ভালোভাবে বুঝবেন। মানবাজার-১ ব্লক এলাকায় সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় প্রায় নব্বই শতাংশ জমিতে এবারে ধানের আবাদ হয়নি । আবার আশ্বিন মাসের বৃষ্টিতে সব্জী চাষেও ব্যাপক ক্ষতি হ'য়েছে। আর এই এলাকায় কাজ না থাকায় গ্রামের বহু মানুষ রোজগারের জন্য বাইরে চ'লে যেতেও বাধ্য হ'চ্ছে। এরকম অবস্হায়, খাদ্য-সুরক্ষা প্রকল্পে পাওয়া রেশনের চাল-গম ও মিড-ডে মিল প্রকল্পের খাবারের ওপর আমাদের এলাকার বহু বহু পরিবার সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। তাছাড়া আমাদের মানবাজার এলাকাতে সরকারি স্বাস্হ্য পরিষেবা প্রায় অচল হ'য়ে পড়ায় দুঃস্হ ও নিম্ননিত্ত মানুষজন যে কি অসহায় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তা নিজে যেমন উপলব্ধি করছি, রাস্তায় বেরিয়ে চোখ মেলে তাকালে টেরও পাচ্ছি। নিষাদের মনও তো আর মায়ামৃগে ম'জে নেই। ফলে যা হবার তাই হ'চ্ছে। পুরুলিয়ার মতো কৃষিনির্ভর এলাকায় অর্থব্যবস্হার এই ভয়ংকর রূপটিকে অস্বীকার ক'রে তাই সম্পাদকের সাথে গলা মেলাতে পারলাম না। আমি আশা ক'রবো, 'অরন্ধন'-পুরুলিয়ার এই অনোলোকিত দিকটিতে তার দৃষ্টি ফেরাবে। এর বেশি কিছু নয়।
------------কবি ও গল্পকার গৌতম দত্ত
৭/ ভীষণ ভালো লাগলো এবারের অরন্ধন। সম্পাদকীয় নিবন্ধে মাটির টান অনুভব করলাম। দেশের বিপদ সঙ্কেত কে বা খেয়াল করে!
চমৎকার সব কবিতা এবং শেষে আরব দেশের পুজো নিয়ে নিবন্ধটি আরব দেশের মাটিতে বসে ভীষণ ভালো লেগেছে। এই সব ধর্ম সংক্রান্ত প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদেরকেও হতে হয়। মানব ধর্মের কথা এই সব প্রশ্ন কর্তারা জানেন না। এই প্রবন্ধে তার সদুত্তর আছে।
ছবি প্রদর্শনশালায় জয়দেব চক্রবর্তীর অসামান্য কিছু ছবি আবার দেখার সুযোগ পেয়ে আবার ভালো লাগলো।
-------------কবি সুনৃতা রায়চৌধুরী
৮/ অরন্ধন ওয়েব ম্যাগাজিনে পড়লাম কবি গাফফার আনসারির কবিতা । বিষয়বস্তু যখন নগ্নতা তখন নিজের নগ্নতা দিয়েই শুরু করছি । তাঁর ফেসবুক লেখা ছাড়া অন্য কোন লেখা পড়িনি , পরিচয়ের সূত্রপাতও ফেসবুক । সেই সামান্য পরিচয়ের কৌতূহলেই তাঁর লেখার প্রতি মনোযোগ । প্রথম পাঠে প্রথম কয়েকটি লাইন পড়ে মনে হয়েছিল আর পাঁচজন দার্শনিক কবি যেমন কয়েকটি তত্ত্ব দর্শন উগলে দেয় কবিতায় তেমনি হয়তো । প্রথম পাঠে টনক নড়লো শেষ লাইনে " - নগ্ন হওয়ার জন্য সত্যি কত কম জায়গা " পাঠকের হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এর আগের লাইনটির উল্লেখ প্রয়োজন - " বিশাল এই পৃথিবীতে বেডরুম আর বাথরুম ছাড়া " এ লাইনের উল্লেখ মুখরোচক যৌনতার উল্লেখে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নয় , জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে আয়নায় দেখার জন্য এই দু' টি লাইন কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ । কবি কবিতার নাম ' নগ্নতা' কেন রাখলেন এখনও বুঝে উঠতে পারছি না । এ তো সত্য । আমরা প্রতি মূহুর্তে সত্যকে আড়াল করে চলেছি একমাত্র 'বেডরুম ' আর ' বাথরুম ' ছাড়া । সে যাই হোক যে প্রসঙ্গ আলোচনা করছিলাম - আমরা তো আর উলঙ্গরাজার সেই শিশুটি নয় , কিংবা রবীন্দ্রনাথের " বিচ্ছিন্নদ্বীপ" - র অনুভবও নেই । তাই হয়তো কবির অনুভূতিকে অনুভব করার জন্য ' বেডরুম ' আর 'বাথরুম ' উপযুক্ত অনুষঙ্গ । এই দু'টি লাইন পড়ার পর আমরা বুঝতে পারব পূর্ববর্তী লাইনগুলোর মর্মার্ম । কবি বলেছেন - " সারাটা জীবন কেবল অন্ধকার ঘেঁটেযাওয়া " অন্ধকার ঘাঁটা নয়তো কী ? যেখানে প্রতি মূহুর্তে মানুষ নিজেকে আড়াল করে চলেছে সেখানে কেউ যদি তার প্রাপ্তির আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেন তাহলে -
" নিজের উপর অহংবশে ভাবছেন
হাতের মুঠোয় পৃথিবী ঘোরাচ্ছি
আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত
আপনার দেওয়ালে পিঠ "
-------------কল্যাণ মাহাত
৯/ এত চমৎকার কাজ নিয়মিত করে যাচ্ছ।
সত্যি বলছি, বেশ নিষ্ঠাবান তুমি।
-------------কবি পঙ্কজ মান্না
______________________________________________
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের ছবি : তপন পাত্র ও কল্পোত্তম
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন