চতুর্থ বর্ষ ।। অষ্টাদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ১ পৌষ ১৪৩০ ।। ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩



আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার সম্পর্কে প্রথমেই নিষেধ করেছিলেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। তিনি এই টেকনোলজি নিয়ে না এগোনোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই নিষেধাজ্ঞা মানা হয়নি। দৈনন্দিন জীবনের নানা ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার শুরু করা হয়। বর্তমান প্রজন্ম এই টেকনোলজির উপর এতটাই নির্ভরশীল যে, হাজার হাজার মানুষের কর্ম খেয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। এবং দিনের পর দিন এই প্রবণতা বেড়েই চলেছে। 
          বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার আমাদের জীবনকে আরো সহজ সরল করে তোলার জন্য ব্যবহার করা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর অপব্যবহার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই এই টেকনোলজি মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে সমর্থ হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষকে একেবারে সর্বস্বান্ত করে তুলতেও সক্ষম হয়েছে। এই টেকনোলজি এতটা সুনিপুণ ভাবে সব কাজ করে ফেলছে যে, মানুষের সমস্ত চালাকিকে পরাস্ত করে তাকে ধোঁকা দিতে পারছে সহজেই। ফলে হাজার হাজার মানুষ আজ এই টেকনোলজির অপব্যবহারের শিকার। এর ভয়ঙ্কর দিকটা এত বেশি ক্ষতিকর যা ভাবলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।
             হুবহু আপনার ভয়েস টোন কপি করে আপনি বিপদে পড়েছেন এমন খবর জানিয়ে ফোনের মাধ্যমে পরিবারের লোকজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা, মেয়ে বা মহিলাদের ছবি থেকে পোশাক তুলে দিয়ে সেই নগ্নছবি বিভিন্ন পর্ণ সাইটে ব্যবহার করা বা সেই ছবি দিয়ে উক্ত মেয়ে বা মহিলাকে বা তাদের পরিবারের লোকজনদের ব্ল্যাকমেল করার মতো ঘটনা আকছার ঘটছে। ঘটছে অপমানিত হয়ে সুইসাইড করে নেওয়ার মতো ঘটনাও। এ রকম কত কাণ্ড।
              তবে এইসব ঘটনার জন্য কেবলমাত্র যে প্রতারকরা দায়ী তা কিন্তু নয়। আমরাও কোথাও না কোথাও কোন না কোন ভাবে এইসব ঘটনাকে ঘটতে সাহায্য করে থাকি। গোচরে অগোচরে আমরা বিভিন্ন এপ্লিকেশন ব্যবহার করতে গিয়ে হুটহাট নিজের বহুকিছু তথ্য ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে থাকি তাদের, যা তারা স্টোর করে রেখে আমাদের ফাঁদ তৈরি করে এবং পরবর্তীতে নাস্তানাবুদ হই আমরা। অতএব আরও বেশি সচেতন হতে হবে আমাদের। এইসব এপ্লিকেশন ডাউনলোড বা ব্যবহার করার আগে বিচার বিবেচনা করে দেখতে হবে। প্রয়োজনে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে এইসব বিষয়গুলো থেকে। নচেৎ মুখিয়ে থাকা সর্বনাশকে ঠেকানো সম্ভব নয়।


উত্তম মাহাত, সম্পাদক 




______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
শুভাশীষ ভাদুড়ী / গৌতম দত্ত / তন্ময় সরকার / পার্বতী রায় / সুজন পণ্ডা / শান্তনু পাত্র / সুদীপ্ত চক্রবর্তী / জয়দীপ রাউত / রূপক চট্টোপাধ্যায় / রাজীব লোচন মাহাত / অঙ্কন রায় / ইন্দ্রনীল মজুমদার
_____________________________________________



নিধিরাম

শুভাশীষ ভাদুড়ী


কোনও এক নষ্ট বাগানের
আমি এক বোকাসোকা মালি,
রোদ-জ্বলা, আগাছা পীড়িত
মাটিতে সেবার জল ঢালি,
সার দিই,খুরপিও চালাই...

আকাশে গম্ভীর মেঘ এলে
মনে মনে হিসেব ঝালাই,
যদি বৃষ্টি হয় ভরা মাস
মাটি তার জ্ঞান ফিরে পাবে!
হয়তো বা চলাচল পথে
বেজে উঠবে পাতার নূপুর!
দু পায়ের তলায় আবার
ভেসে যাবে সবুজ আকাশ!

কিন্তু মেঘ রূঢ় ও গম্ভীর ।
খুরপির হালৎ মরচে ধরা ।
পড়শি চোখের কূট খরা
দলবদ্ধ নজর শানায়,
বারংবার মেঘ মরে যায়---

আমি সেই নষ্ট বাগানের
অপগণ্ড, নিধিরাম মালি;
কদাচিৎ ফুলের আশায়,
কদাচিৎ পাখ-পাখালির
কম্পন শুনব বলে ঠায়
করে চলি কাজ আর কাজ,

বসে থাকি জেগে রাতভর,
যদি বেড়া টপকে আসে,
হানা দেয় ছিঁচকে ফুল চোর ।।









পুতুল নাচ

গৌতম দত্ত


কেউ ভাবছে কাছে পিঠে
কেউ বা একটু দূরে
পুতুল নাচের খেলা এখন
চ'লছে মধুপুরে

চাঁদ ওঠানো ফুল ফোটানো
একটু হাতের ছোঁয়া
শালের বনে খ‌্যাপা হাওয়া
সাগরকূলে ধোঁয়া

যেমন খুশি সাজে সবাই
সাজায় নিজের ঘুঁটি
সবই এখন বাঁ হাতের কাজ
ডান হাত কাটায় ছুটি

মুঠোর ভেতর আমলকি
ঝুলিয়ে কাছায় বিশ্ব
কিছু মানুষ রাজা উজির
বাকি সবাই নিঃস্ব
               







সব নষ্ট করে দেবো

তন্ময় সরকার


সব নষ্ট করে দেবো।
সব্বাইকে নষ্ট করে দেবো ।

আধপোড়া সিগারেটকে বলবো - ফিল্টার অবধি পোড় ।
লঘুপদে হেঁটে যাওয়া কিশোরীকে শিখিয়ে দেবো ছন্দ ।
লাজুক কলাপাতাকে দেখিয়ে দেবো কিভাবে মেলে ধরতে হয় নিজেকে ।
নিরন্তর ডেকে যাওয়া কোকিলের কানে কানে বলব, সংবরণ ।
আজ বিকেলে উদ্ভট সাজে হাটের মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে শিশু
তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলবো, শাবাস ।

কেউ কেন বন্দী থাকবে ?
সব শিকল ছিঁড়ে দেবো ।

সব পিপীলিকার পিঠে ডানা জুড়ে দেবো
যাতে তাদের আর আগুনের ভয় না থাকে ।

সব লন্ডভন্ড করে দেবো ।
শুধু ভালোবাসা দিয়ে সব নষ্ট করে দেবো ।









পার্বতী রায়ের কবিতা 

১.
দূরত্ব 


 যা দেখি , যা যা দেখি সব কি সত্যি !
কোন কোনও দিন দূরত্ব বাড়িয়ে দিই 

তোমার আমার মাঝে 
এখন একটা খোলা মাঠ
 একটা মুক্ত আকাশ
 আর কিছু পাখি উড়ছে 



২.
বিষাদ 


এই সব বিষাদের কোনও নাম রাখিনি 
আজীবন ভাসছে মেঘ 
শত সহস্র সম্ভাব্য বৃষ্টিদিন ...

শুধু দিনের আলোয় থোকা থোকা ফুল ফুটতে দেখি 

ফুল আমার আলো 



৩.
নষ্ট 


নষ্ট হয়ে আসছে আঙুল 
প্রেমের মুদ্রা থেকে সরে যাচ্ছে শরীরের পাতাবাহার 

আর কি ভেসে থাকা সম্ভব !
রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে আসছে 
ফ্যাকাসে হয়ে আসছে টার্গেটগুলো 

এখন কি নেমে আসা দরকার শীত !








চোখ খুললেও রোদ খোলে না

সুজন পণ্ডা


শিশিরে ভিজে যায় গোটা গ্রাম
গলিত বরফের মতো জ্যোৎস্না
তারা দের মৃতদেহ।
শীত এসে হাত রাখে বস্তিতে
উলঙ্গ শিশুর গায়ে নখ
খড়ি ওড়ে
হঠাত চোখ খুললেও রোদ খোলে না।

দুরের আলো তাপ আনে না একটুও, 
শহরের এক প্রান্তে দেদার উষ্ণতা
তবুও অন্য দিকের রাত্রি গুলি দীর্ঘতর।
এখানে হঠাত চোখ খুললেও রোদ খোলে না।
নাগরিক শীত মানুষ খোঁজে
তাপ উত্তাপ আলিঙ্গন... 
এখানে হঠাত চোখ খুললেও রোদ খোলে না
শেষ রাত্রে
দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে ভেজা রাজপথে
রোদ ওঠে না।


 







সমাস

শান্তনু পাত্র

১. 
তৎপুরুষ


যেখানে শুধুই লোপ, বিয়োজন
অলংকার খুলে ফেলে তার পুরুষ

বন্টনে বন্টনে শরীর হাল্কা হয়




২. 
কর্মধারয়


'কর্মা চাষৌ ধারয়শ্চ'

যে করে, সেই তো ধরে
এ তো শুধু নাম নাম খেলা

যতবার তুমি কানামাছি খেলেছ,
ততবার আমি রূপক সেজেছি!




৩. 
বহুব্রীহি


রহস্যময় সেই প্রতিমূর্তি

নয় পূর্ব, নয় পশ্চিম
নয় আদি, নয় অন্ত

শুধু পুরুষের তৃতীয় চোখেই দেখা যায়...




৪. 
দ্বিগু


এখানে একক কোনো মানুষ নেই,
শুধুই যৌথ খামার

এখানে জটিল কোনো অঙ্ক নেই,
কেবল সরল সমাধান।




৫. 
দ্বন্দ্ব


'মিলন হবে কত দিনে?'
সংঘাত, তুমি দূর হটো।

তুলোর কাঁটা বলছে,
আমরা সমান সমান।

এসো, সমানাধিকারে বাঁচি
ইভ ও আদমের মতো

সাম্যবাদের ইস্তেহার লিখি পাতায় পাতায়...









সরাইখানা  

সুদীপ্ত চক্রবর্তী


বেড়াতে যাওয়ার আগের রাত সুন্দর ও ব্যস্ত

সাবান, পেস্ট, হালকা গামছা, রঙীন স্কার্ফ  
বাড়িটা কিছুদিন বন্ধ হয়ে পড়ে থাকবে দরজা-জানলা  
ভোর হলে বাস ছেড়ে যাবে

কোথায় যাবে সে  
কাকে নিয়ে যাবে, এসব চিন্তা  
ভাসে শেষরাতে

পাহাড় এগিয়ে আসে ক্রমে  
অদূরে অমাবস্যা জেনে  
সাগর আসে দোরগোড়ায়

জলে গোড়ালি ভিজিয়ে বসে থাকি  
সকাল সকাল বাস।  
ব্যাগের একটা চেন ছেঁড়া, সেখানে ভরে চলেছি পুরোনো পাথর ও হালকা ঝিনুক

ড্রাইভারকে বলেছি, খিদে না পেলে  
থেমো না কোথাও








অশেষ

জয়দীপ রাউত


শুধু তোমারই পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে  
দু'দণ্ড বসব বলে আমি এখানে এসেছিলাম।  
দিন যায় কোন প্রার্থনায়, তুমি জানো।  
তুমি জানো কত রাত্রি ভোর হল চাঁদ আর চাহিদায়।

জীবন ফুরিয়ে এল  
জীবন ফুরিয়ে আসে, হায়












রূপক চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা 

অগ্নি তত্ত্ব 

১.
আগুনের নক্সাকাটা চিতার ওপর একটি 
জীবনের ধূসর খাতা পুড়ে যায় মাত্র। 
যার পাতায় পাতায় কাটাকুটি খেলা,
মনোরম নির্জনে ফেলে রাখা মন খারাপ, 
অথবা লাভ ক্ষতির নৌকায় বসে থাকা
গহন শাওন সাঁঝের জলবায়ু! 
একটু মাঝের পাতায় দেখা যায় 
একলাটি দশমিক জানালা বসে বসে
বর্গমূলের দিগুণ চাহিদায়
বিক্রি করেছে পারিজাত রঙের বেহালা।
তারপর শেষ পাতায় ধোঁয়াটে স্টেশন, রেলপথ, 
কখন শেষ ট্রেন চলে যায় জোৎস্না ছিটিয়ে।
নিভু নিভু তারাজ্বলা রাতের পথিক,
একলাটি পথ মোচড় নিচ্ছে
 দূরত্ব ইকুয়েল টু ইনফিনিটির দিকে!




২.
আগুন নম্র হয়ে এলে সমবয়সী পাখিদের কথা 
খুব মনে পড়ে। সময়ের পালকে চঞ্চু ডুবিয়ে
নিঝুম হয়ে যায় ঘড়ির দোলন কাল,
দেওয়াল টিকটিকি ডাকে।

মাটির ভাঁড়ে চায়ের আপেক্ষিক চুমুক
থমকে যায় বাঁকুড়া - বর্ধমান হাইওয়ের ওপর।
একটা স্কুল বাস ত্রিশটা বসন্ত ধরে রঙ খুইয়ে খুইয়ে ছুটে যায় রোজ ওই পথে।

সময়ের পাঠশালায় কোন ঘন্টাধ্বনি নেই। 




৩.
আগুন লাগিয়ে দেওয়া বাজার থেকে
মধ্যবিত্ত শরীর বার করে আনতে আনতে 
 দহন হীন হয়েও, পোড়া গন্ধ উঠে যায়!
 গলা অবধি সুখ এসে
 আর চিবুক ছুঁতে পারেনা মাসের শেষ দিকে!
 তবুও জানালার রডে চিবুক রেখে
 আকাশের দিকে তাকালেই 
 সহজ অবন্তীকা হয়ে আসে আটপৌরে দিন!









অসময়

রাজীব লোচন মাহাত 


পাকা ধানে ভাতের গন্ধ আসে।

অকাল বর্ষনে আকাল দেখা দেবে?

যে মা অর্ধেক কাজ করে
সন্তানকে দুধ পান করায়...

সুসময়ে দুঃসময় আসায়
মেঘের জলে চোখের জল
মিশে যায় তার।









আজ বৃষ্টির জন্য

অঙ্কন রায় 


বৃষ্টি আসে গাছগাছালির পাতায়
বৃষ্টি আসে ফুলের গায়ে
বৃষ্টি আসে মাঝির না'য়ে
বৃষ্টি এসে মনকে আমার মাতায়।

বৃষ্টি নাচে উঠোন জলে ভিজে
বৃষ্টি নাচে ছন্দে সুরে
বৃষ্টি নাচে হৃদয়পুরে
বৃষ্টি নেচে উন্মনা হয় নিজে।

বৃষ্টি লেখে জলপদ্যর ছড়া।
বৃষ্টি লেখে মনদোতারায়
বৃষ্টি লেখে মেঘের পাড়ায়
বৃষ্টি লিখে ভরায় প্রেমের ঘড়া।

বৃষ্টি, সে তো এলিয়ে দিয়ে কেশ
বৃষ্টি, সে তো কান্না ধোয়া
বৃষ্টি, সে তো হৃদয় ছোঁয়া
বৃষ্টি ধরে বাদল বাউল বেশ।

বৃষ্টি আমার মনদরিয়ার পানি।
বৃষ্টি আমায় দিনের শেষে
বৃষ্টি আমায় মেঘের দেশে
বৃষ্টি আমায় পৌঁছে দেবে জানি।।








ছিন্ন পাতার তরণী : প্রদীপ রায়গুপ্ত         
(প্রকাশক : ঋতাক্ষর )

সাতটি দশক পেড়িয়ে এসে কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার প্রদীপ রায়গুপ্ত ফিরে দেখেছেন পেরিয়ে আসা দিন।সেই ফিরে দেখা একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। খুব কাছের মানুষ ফিরে আসছেন ঘুরে ঘুরে দেখা (in the round) ভাস্কর্যের মতো। এক নির্মোহ দুরত্ব থেকে ভালবাসার অন্য মানে তৈরি হতে চায়। আবার দূরের মানুষ এমন কাছে চলে আসেন যে মনে হয় বলি, একটু থাকো। সব মিলিয়ে প্রাপ্তির ঝুলিই ভারি। প্রসন্নতা, জীবনের প্রসন্নতা। সেখানে আলোড়নের চেয়ে শিকড় গভীর। এত বড় সময় ধরতে গেলে সমস্যা হয়। কী রাখব, কী রাখব না ? যারা ঢুকে পড়তে চাইছে তাদের কি সরিয়ে দেব আঙুল নাড়িয়ে ? কালানুক্রমিক ঘটনার বিবরণ নাকি আলোয় ভেসে থাকবে কিছু, আর কিছু ঠেলে দেব মহাকালের গর্ভে ? পরিপ্রেক্ষিত পাল্টায়, পাল্টায় মানুষও। যা ঘটনা তাই কী শেষ সত্য? সমস্যা সামাজিকতারও? পাছে লোকে কিছু বলে। পরিবার, ভাই, বন্ধু। আমাদের সমাজে তো রুশোর কনফেশানস বা জাঁ জেনের থিফস জার্ণালের মতো আত্মকথন সম্ভব নয়। সম্ভব নয় নিদেনপক্ষে হেনরি মিলার বা কাম্যু। তাহলে ? প্রদীপ তাই কালানুক্রমিক বহির্জীবন কথাকেই তুলে দিয়েছেন। তাঁর সহজাত বিশ্লেষনমুখীনতায় প্রদীপ খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন , “স্মৃতিকথার ঝোঁকটা যেন বহির্জীবনের দিকেই বেশি, প্রসার বেশি হলেও সেখানে খানিকটা আত্মবলেপ হয়ত সম্ভব। অন্যদিকে আত্মকথার মূল উপজীব্য অন্তর্জীবন, যা আত্মকে ঘিরে আবর্তিত আর বহির্জীবন তার আধার। আত্মকথা লেখা বেশি কঠিন, কারণ কতটুকু লেখা উচিৎ আর কতটুকু নয় সেই বিবেচনা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়”। কপটতাই , “বাহিরপানে চোখ মেলেছি , আমি ভিতরপানে চাইনি” । বাইরে এলেই তা দলিল হয়ে দাঁড়ায়। বহির্জীবনকে এগিয়ে দিলে একটা আবরণায়ন হয়তো সম্ভব। তাছাড়া নিজেকে কতটুকু রাখব সেটাও আর এক সমস্যা। সব ভেবেই প্রদীপ এই লেখাকে স্মৃতিকথনই ভেবেছেন। সেখানে আমিই কথক, আমিই সূত্রধর। সেখানে বিস্তার বেশি, মানুষও বেশি আর আছে পরিব্যাপ্ত স্থানান্তর। সেই জায়গাগুলো বিশেষভাবে আলাদা হয়ে ওঠেনি। স্মৃতি এসেছে কলানুক্রমিকতায়–বাবা মা জেঠু দাদা বৌদি স্কুলকলেজ পত্রিকা চাকরী জীবন সাহিত্যসাধনা। প্রদীপের পঠনপাঠন, মনন ও  অভিজ্ঞতার সংশ্লেষ সেগুলিকেই উত্তীর্ণ করেছে এক হার্দ্য বহুমাত্রিকতায়। প্রশান্তি ও ঋজুতাই তাঁর চলন, চমক নয়।

ছোটবেলা, স্কুল কলেজ, অশোকনগর পর্ব (প্রায় ৭০ পাতা ) মনে থাকে, হয়ত বন্ধুহিসাবে সেগুলো আবার ফিরে এলো বলে। আমরা তো কেউই অমৃতের পুত্রকন্যা ছিলাম না। আমাদের চাওয়া পাওয়া ছিল ছোট ছোট। সেই ছোটকেই প্রদীপ ধরে রেখেছে।
 
উচ্চপদে দীর্ঘদিন দেশজুড়ে কাজের সুবাদে এসেছেন অনেক সহকর্মী,  অনেক সিচুয়েশান। সেই প্রায় একশো পাতা মনে হয় প্রদীপের কর্মজীবনকে চিনিয়ে দেবে আর স্মৃতিভারে আকুল করবে  প্রদীপের উল্লিখিত  প্রাক্তন সহকর্মী, অনুজ ও অগ্রজদের। দশম পর্যায়ের দশ/বারো পাতায় খুব কাছে এসে গেলেন কেউ কেউ–ডেভিডদা,  মৈনানের সরোজবাবু যেমন। পিতার প্রতিমা দিয়ে শুরুটাই স্নিগ্ধ করে। সত্যিই তো বাবাকে নিয়ে আমরা তো প্রতিমাই বানাই–আশ্বাস, নির্ভরতা, বিশ্বাস। মা তো মাঘের শীতের কাঁথা আর তার বুকজোড়া নকশা – সেখানে পাখি ওড়ে, সূর্য ওঠে। জ্যোৎস্নার মতোই মা আসেন সমাপ্তির ‘জ্যোৎস্নার আলোছায়া’ অংশটিতে। মায়ের এলজাইমার্সগ্রস্ত শেষ জীবনের বেদনার দিনলিপি প্রদীপ আমাদের আগেও দিয়েছেন। এই নিয়েই  ছিল ‘আকাশলীনা’ গল্প সংকলনের ‘জ্যোৎস্নাপথের আলোছায়া’ গল্পটি। সেই অংশটুকু নিয়ে আমার ভাললাগা জানিয়েছিলাম প্রদীপকে। এই স্মৃতিকথনের পর্যায়ে মায়ের সঙ্গে বাবাও আছেন। বিস্মরণের মধ্যেই বাবা রাতে দরজা বন্ধ করতে না দিয়ে অস্পষ্টভাবে বলছেন , “একজন এখনও আসেনি”। ফকনার লিখেছিলেন Memory lives in flesh.
জলার্ক পত্রিকা প্রসঙ্গ, বইমেলার আদিপর্ব নিয়ে কি আরেকটু বিস্তৃত লেখা যেত ? পরের দিকে অবশ্য  প্রদীপ বেশ কয়েক বছর চাকরিসূ্ত্রে কলকাতার বাইরে ছিল। দিদির জন্যে কলঘরে দাঁড়িয়ে থাকার কথা পড়ে নিজেরই কথা মনে পড়ে গেল। মেজদি কলঘরে গেলে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম কেন ? ভেতরে ভেতরে কত কিছু যে মিলে যায়।
পঠনপাঠন ও চিন্তার ভার এই বয়সে লেখায় ছাপ ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। স্মৃতিকথা সেখানে সন্দর্ভ হয়ে উঠতে চায়। পাঠও তো স্মৃতিতেই থাকে, বিশেষত প্রদীপের মতো ক্ষুরধার স্মৃতিতে। ষষ্ঠী পুজো, রাসমেলা, চোদ্দ শাক, শ্বেতসিংহ, ধুঁদুল অথবা লুফা এই প্রসঙ্গে মনে আসছে। ভাষা ও শব্দের নিবিড় বন্ধন মন টানে যখন এই শিরোনামগুলি আসে–পিতার প্রতিমা, আস্য, অপূপস্মৃতি।
স্মৃতিভ্রষ্টা মা মৃত স্বামীর (প্রদীপের বাবা ) ছবি দেখিয়ে বলছেন , ‘একে আমি চিনি’। তখনই লেখা হতে থাকে, ‘দিক ভোলাবার পাগল আমার হাসে অন্ধকারে’। শেষকথা তো এই। আমাদের, মানুষেরও। 

                                  ---ইন্দ্রনীল মজুমদার       




______________________________________________
আগের সংস্করণের পাঠ প্রতিক্রিয়া 
______________________________________________

১/ উত্তমদা, খুব সুন্দর পত্রিকা ও ছবি।
                                               ---------সুকুমার কৈবর্ত 

২/ রূপক চট্টোপাধ্যায় এর কবিতাগুলা বেশ লাগল৷
উনার কি কোন প্রকাশিত বই আছে?
যে দুজনের কথা বলা হয়েছে, তার একজন আমি।
4 নং কবিতাটা♥️
উনাকে বলবেন যেন চাঁদ ওঠার আশ্বাস দেন৷
চাতালে এখনো সমানভাবে অপেক্ষাই আছি।
শ্রদ্ধা জানাবেন উনাকে।
                           -----------কবি সুপ্রিয় পাণ্ডে

৩/ আশীষ নন্দীর বেশ কয়েকটি নিসর্গচিত্র খুব ভালো লাগলো।
                  -----------গল্পকার স্বপন চক্রবর্তী

৪/ অসাধারণ সম্পাদকীয়। ভারি সুন্দর কবিতার ডালি নিয়ে হাজির প্রিয় পত্রিকা অরন্ধন। কবি পঙ্কজ মান্না কবি সুজন পণ্ডার কবিতা পড়লাম। পরে অন্যান্য কবিতাগুলো পড়বো।
                            -----------কবি ডরোথী দাশ বিশ্বাস 

৫/ প্রদর্শনী বেশ ভালো হয়েছে।
একটু অন্যরকম।
             ------------আলোকচিত্রী শুভাশিস গুহ নিয়োগী

৬/ দুঃখিত দাদা, পড়ে উঠতে কয়েক দিন দেরি হল।ষোড়শ সপ্তদশ দুই সংখ্যায় পড়লাম। কবিতা ভালো লেগেছে, গদ্য সুন্দর। 
এবারের সম্পাদকীয় হাল্কার মধ্যে ভারী।
ভালোবাসা নিও।
                    ------------কবি শ্যামাপদ মাহাত বাঁশি 


______________________________________________

                                     আমাদের বই















সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : সায়েদ হাইদার রজার পেন্টিং, আন্তর্জাল
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com





 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪