প্রথম বর্ষ ।। চতুর্থ ওয়েব সংস্করণ ।। ২৫ আশ্বিন ১৪২৭
স্কুলে পড়তে গিয়ে শিক্ষা পেয়েছিলাম। যেমন হোক, যতটুকু হোক শিক্ষা দিয়েছিলেন আমার শিক্ষক শিক্ষিকারা। সেই শিক্ষাদানের কাজে সহায়ক হয়েছিল তখনকার সরকারি শিক্ষানীতি। আর এখনকার ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়তে গিয়ে চাল পাচ্ছে, ডাল পাচ্ছে, এক কথায় পেট ভরে খেতে পাচ্ছে। পাচ্ছে স্যানিটাইজার, মাক্স, হাত ধোয়ার সাবান। কিন্তু মূল বিষয় শিক্ষাটাই পাচ্ছে না। এও এক রাজনীতি। সবাই সমান শিক্ষা পেলে মজুর তৈরি হবে কিভাবে?
এই সামান্য নীতিটুকু বুঝে ওঠার ক্ষমতা নেই অনেকের। তাই, ঘুঁটে পোড়ে আর গোবর হাসে, বিষয়টা চলে আসছে ধারাবাহিকভাবে। আমরা বলতে পারছি না----দয়ার দানসামগ্রী নয়, আমাদের ন্যায্য পাওনা শিক্ষাই দরকার। যা দিয়ে অনেক অনেক চাল, ডাল এবং মাক্স কিনে নিতে পারবো।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
Artist : Sunil Bambal, Chikhli, Maharashtra
যৌথতা ভেঙ্গে যায় (দ্বিতীয় কিস্তি)
নির্মল হালদার
মনে আছে উত্তম মাহাত আমার ডেরাতে প্রথম দিন এসেই, দেয়ালে টাঙানো প্রকাশ কর্মকারের নারীমূর্তি দেখেই জানতে চেয়েছিল ছবিটি কার ?
সে সারল্যের সঙ্গে বলেছিল, এমন ছবি সে হামেশাই আঁকতে পারে-------
আমি বলেছিলাম মৃদু হেসে, হ্যাঁ আঁকবি।
পরবর্তীকালে পুরোপুরি কবিতা ও ছবির সঙ্গে জড়িয়ে তার মনোভাব তার বোধবুদ্ধি পাল্টায়। সে পরিণত হয়।
প্রথম থেকেই উত্তমের জেদ ছিল, শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে মড়িয়ে থাকবে। আজও শিল্প বিষয়ে সে প্রবল উৎসাহি।
হায়ার সেকেন্ডারি করার পর সে ভর্তি হল আই টি আই এ-----রঘুনাথপুরে। শনিবার সন্ধেবেলা আমার কাছে চলে আসতো। একা একা। শুধু কবিতার জন্য। তখনো দলবদ্ধভাবে কিছু করার পরিকল্পনা আমার ছিল না। তখনো সবাই জড়ো হয়নি এক জায়গায়। আমার ডেরা তৈরির আগে আমাদের আড্ডা ছিল রাস্তার ধারে। নর্দমার উপরে একফালি বারান্দায়। স্বপন চক্রবর্ত্তী তখন পুরুলিয়াতে কর্মরত। তিনি মাঝেমধ্যে আসতেন আমাদের আড্ডায়।
প্রসাদ দাশগুপ্ত ছিলেন। তিনিও বাইরের মানুষ, চাকরি সূত্রে পুরুলিয়াতে এসে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ। আসতেন হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়। মুকুল চট্টোপাধ্যায়। তখনকার তরুণদের মধ্যে সুব্রত মুখোপাধ্যায় মদন ব্যানার্জি। এই দুজনের মধ্যে সুব্রতর সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ। সেই সময় ছিল সে কলেজি ছোকরা। আজ দুই সন্তানের পিতা। কিন্তু আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি কোথাও।
যৌথতায় বাঁচবো। চলবো একসাথে। কি কঠিন কি জটিল, প্রতিপদে হোঁচটের ভয়। অপমানের ভয়। আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেক-----
দু চারজন অভিভাবক আমার দাদাদের কাছে অভিযোগ করতে এসেছেন, আমি অনেক ছেলেকে নষ্ট করছি ।
নষ্ট করেছি ভালবাসার পাঠ দিয়ে। শিল্প-সংস্কৃতির পাঠ দিয়ে। এবং নিজেও তারুণ্যের উজ্জীবনে উজ্জীবিত হয়েছি। কবিযশো প্রার্থীদের পাশাপাশি প্রায় দিন সন্ধেবেলা মদের আসর বসেছে। কোনোদিন তর্ক বিতর্ক বাক বিতণ্ডা। গ্লাস ভাঙ্গা ভাঙ্গি।
শেষে দেখা গেল রক্তাক্ত হয়েছি আমি একা।
হিসেব করে চলি নি কখনো। গা বাঁচানো সংস্কৃতি আমার চরিত্রে নেই। সাপের মুখে চুমু ব্যাঙের মুখে চুমু চরিত্রের সংখ্যাই বেশি। এরা নিজের বৃত্তে যেমন সাবধানী, তেমন সমাজের ক্ষেত্রেও। তার ফল তো দেখছি আমরা, চারদিকেই স্থবিরতা স্থবিরতা স্থবিরতা।
ছাতিমতলাও আমার পরিকল্পনায় গড়ে উঠেছিল। মূল সহযাত্রী ছিল উজ্জ্বল রায় ময়ূখ দত্ত রামাশিস অধিকারী। সেও তো ঈর্ষা আর হানাহানিতে তিন চার বছরের বেশি টিকলো না।
ছাতিমতলাও ছিল প্রকৃত অর্থেই গাছতলার আড্ডা। সেখান থেকেই ছাতিমতলা নামে পত্রিকা। বিজ্ঞান বিষয়ে পথসভা। বস্তিতে বস্তিতে বিজ্ঞান বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গেছি। ছাতিমতলা নিয়ে বিপুল---অনুশ্রীর গান।
আমার সব সময় একটা চেষ্টা থাকে, শিল্পের সমস্ত শাখাতে সকলেই যাতায়াত করুক। বিনিময় হোক কবিতার সঙ্গে ছবি। গানের সঙ্গে কবিতা। ফিলমের সঙ্গে নাটকের। এই আগ্রহ থেকে আমন্ত্রণ করেছি প্রকাশ কর্মকার, সমীর আইচ, চন্দ্র ভট্টাচার্য, শুভাপ্রসন্ন। চিত্রকলা সমালোচক সন্দীপ সরকারও এসেছেন। এসেছেন দেবাশিস চন্দ। বিপুল অনুশ্রী বাদেও প্রতুল মুখোপাধ্যায় পল্লব কীর্তনীয়া এসেছেন। এসেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী বাবলি সাহা। শিল্পী এনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়। যার বাড়িতে একবার কালীদার সঙ্গে গিয়ে বলেছিলাম, আপনার বাড়িতে থাকবো। তিনি চমকে উঠে বলেছিলেন, থাকবে মানে ?
হ্যাঁ থাকবো। আপনার বাজারহাট করে দেবো। ফাইফরমাশ খাটবো এই আর কি। কিন্তু কোথাও তো থাকলাম না। নিজের কাছে কি থাকতে পারি? থাকতে পারছি থিতু হয়ে? যখনই কিছু না কিছু আঁকড়ে
বাঁচতে গেছি, তখনই পরমুহূর্তেই ভুল মনে হয়েছে। আমার জীবন অভিজ্ঞতা তাই বলে।
অনিকেত এই শব্দটি পছন্দ করেছিলাম একটাই কারণে, যার কোনো ঘর নেই সেই অনিকেত।
কিন্তু ঘর সবার আছে কেবল আমার নেই। কি করে সবাইকে নিয়ে গড়ে তুলবো স্বপ্নের খামার? সবাই কেনই বা আসবে নিজের ঘর ছেড়ে যৌথ-খামারে?আজ যদি কাউকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, তোমাকে এক বস্তা চাল দিচ্ছি, তুমি কুড়ি জনকে বিলি করে দাও। আমার কাজ আছে বলে সে দায় এড়িয়ে চলে যাবে।
একটা সময় আমার ডেরা থেকেই সপ্তাহে একদিন শনিবার চাল বিলি করা হতো। সেই চাল পেয়েছি আমার বন্ধুর কাছ থেকে। আমার নিজের ক্ষমতা নেই। তার কাছ থেকে নিয়ে, তারো তারো কাছ থেকে নিয়ে, কিছু মুখের কাছে আলো দিতে পারি তো? আগ্রহ নেই, এপাশে নেই, ওপাশে নেই। শুধু আগ্রহ কত তাড়াতাড়ি নিজের আখের গোছানো যায়।
কাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখবো, কারা স্বপ্ন দেখাবে?
তরুণরাই তো এগিয়ে নিয়ে যায়। তরুণরাই তো অভাব-অনটন প্রতিরোধ করে।
প্রতিরোধ কী দেখতে পাচ্ছি?
অভিমুন্য মাহাত কলেজে ঢুকেই আমার ডেরায়। পরের দিকে তার চাকরির জন্য আমি নিজে লোকজন ধরেছি। এখন যোগাযোগহীন আমার সঙ্গে।
আমার প্রথম থেকেই ভাবনা ছিল পুরুলিয়ার পিছিয়ে পড়া জনজাতির ছেলেপুলেদের লালন করতে হবে, সেই ভাবনা থেকেই বিশ্বনাথ বাউরীকে ধরে রেখেছি এতদিন। জানি না, আর ধরে রাখতে পারব কিনা।
হীনমন্যতাকে ছাড়তে হবে। উচ্চমন্যতাকেও ধরে রাখা চলবে না। খোলামেলা হতে হবে। নমনীয় হতে হবে। চোখ কান খোলা রেখে, মন খোলা রেখে দেখে যাওয়া দেখে যাওয়া দেখে যাওয়া। জীবনকে দেখতে দেখতে পড়তে পড়তে এগিয়ে যাওয়া।আমলকি না পাই, আমড়া পাবো।
অনেক সময় আমাদের অন্তরে অনেক কিছুই থাকে না, বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হয়। চর্চা করতে হয়। অর্জন করতে হয়। সবাই তো জন্ম থেকেই কিছু পায় না, জন্মের পরে পরে গ্রহণ করতে হয় যা কিছু সুন্দর। আমি মন্দ বলে আমার ভালোবাসাটা মন্দ হয়ে যায়নি, একথা কাকে বলবো ? অপমানের অনেক রঙ। কেউ কেউ আমাকে আর্থিক সাহায্য করার পর অধিকার ফলাতে চায়। আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এবং টাকা দিয়েছে বলে জ্ঞান দিতেও চায়।
আমার ডেরাই ছিল আমার স্বপ্নের কেন্দ্র। যা আমারই দোষে হয়ে গেল বিনোদন পার্ক। এখানে সবাই মিলিত হয়। এখানে ফুর্তি হয়। এবং এখান থেকে বেরিয়ে ভুলে যেতে হয়, নির্মল হালদারকে।
কেউ কোনোদিন খোঁজ করে না আমার কিভাবে চলছে। আমি কোত্থেকে কত টাকা পাই, খোঁজ করে না কেউ। যারা চাকরি করে ক্ষমতা আছে তারাই যখন দেয় না, তখন বেকাররা কিভাবে দেবে কিভাবে সাহায্য করবে?
এখানে একটা কথা, কেউ বলতেই পারেন , আমাকে কেন সাহায্য করবেন ? সত্যি সত্যি কেন করবেন, আমার প্রতি কারোর কোন দায় নেই।প্রয়োজনে আমাকে ব্যবহার করবে তার পরেই ভুলে যাবে আমাকে। এই আমার নিয়তি।
বিশ্বজিৎ লায়েকের কবিতা
জীবন এক কাঙালের মতো বাড়িয়েছিল হাত
১।
কোনো দুঃখই আজ তক লিখে যেতে পারলাম না
তাই নিজিকে লিখে লিখে বেসামাল পুড়িয়ে দিলাম আয়ু
আর গাজনের গান
আর কী নেবে স্বপ্নের মতো কুড়িয়া পাওয়া আদিম জীবনের কালযাপন
শান্তি ছিল না বলেই আমার গোলাপি শহরের দিকে যাওয়া হল না।
যাওয়া হল না কোনো নীরব লিরিকের দিকে
শুধু উড়িয়ে দেওয়া হল ঠোঁটে লেগে থাকা লিপস্টিক
২।
এই দেখো বৃষ্টি নামল বলে সব প্রেম গেল গাঙুড়ের জলে ভেসে
কেঁপে উঠল ইনবক্সের ছবি
অন্ধ তারা তুমি আর স্ফুরণে যেয়ো না ঘুমিয়ে থাকো কাঙালের মতো
আমি হাসিটুকু নিয়ে ফিরে যাব মা, বউ আর ছেলেদের কাছে
কোনো রহস্যই মুগ্ধ করো না আর দম নিতে ক্লান্ত করে
না আর নয় এবার বিস্মিত হও পুড়ে পুড়ে যাও
যেখানে যাওয়ার ছিল না সেই কারুকাজে যাও অথবা ছাতিমের বনে
পরাগ মুছে মুছে আমার আর অবশেষ নেই
কোনো শোক নেই
বিভ্রম নেই কাঁটাতার নেই ক্ষুধা নেই তৃষ্ণা নেই
নেই যুধিষ্টির
আমি এক বিপন্ন বক
আর কার কাছে জানতে চাইব বল
মৃত্যু সুখ দুঃখ বিশ্বাস ভয় জয় পরমার্থ কী কেন কোথায়
৩।
তোমাদের ভোঁতা লাগামের ফলা না দিতে পারে চাষ না দিতে পারে ফসল
জীবন এক কাঙালের মতো বাড়িয়েছিল হাত
কামিনী নয় কাঞ্চন নয় মুগ্ধতায় কেবল বিশ্বাস রাখতে শেখো
কারা বলেছিল এত কথা কেউ শোনেনি অথচ
না শুনেই হাততালি দিয়েছিল জলে জলে মেঘে মেঘে
যারা ঘুরছিল চিরকাল
উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
১.
অপ্রাসঙ্গিক
খুব সহজেই রোদ কুড়াই
অপ্রাসঙ্গিক বৃষ্টি
খুব সহজেই মরা মানুষের হাড় দিয়ে
যাদুককের সুচতুর দৃষ্টিভ্রম
চোখ ঠেলে ক্লান্তির শ্বাস মেশানো আগুনে
কঙ্কাল কঙ্কাল খেলা
অরন্ধন রান্নাঘরে সীমাহীন নিস্তব্ধতায়
শীতল উনুন.........কলঙ্কের কালি
এবার চোর সেজেছেন রাজা
এবার ভগবানের ভূত নিয়ে হবে মাদারীর খেল
আন্দোলনের মাথায় লাথি
সমস্ত চেনা দৃষ্টি.......সমস্তই চেনা চোখ
শুধু দৃশ্যের অন্তরালে পশুবলি
শকুণির পাশায়.........বাজি মানুষ
এ যে সে মানুষ নয়
পেটে গামছা বেঁধে আলু পুড়িয়ে
খাচ্ছে শতাব্দীর পহেলা পোয়াতি .....
২.
কবিকে দুঃখ দিলে
কবিকে দুঃখ দিলে.........আমি জানি,
নষ্ট হয়ে যাবে অন্ধকার
কবিকে দুঃখ দিলে
তোমার হাতে উঠে আসবে শ্মশানের কালি
কে জানে ? এমন নীল আর কজন দেখে ?
কে চেনে ? সাগরের বুকে এমন সফেন ঢেও
কবিকে দুঃখ দিলে
তোমার স্বপ্নের মাটিতে ফুল ফোটে
নিরিবিলি কথা বলে অন্ধকার মানুষ
এবার সীমান্তে আলো.......রোদরঙ
বসন্ত ছায়ার কোলে ঘুমন্ত পথিক
এভাবেই আবার জীবন
এভাবেই আবার বাঁচা
কবিকে দুঃখ দিলে
কবিতায় ঝরে পড়ে জীবনের কথকতা
রুমি চৌধুরীর কবিতা
১.
হলুদ স্মৃতির সুতো
খরচের খাতায় নাম লিখিয়ে
একটু একটু খরচ করে জীবন
একদিন প্রাচীন হয়ে ঝরে যাবো
প্রাচীনতর এই পৃথিবীর বুক থেকে।
চুঁইয়ে পড়া সময়ের হিসেবের কাছে
কিছুটা প্রণয় ধার করে নিয়ে
রেখে যাবো হলুদ স্মৃতির সুতো
প্রিয় কিছু মানুষের নকশীর পাড়ে।
তারপর...
কোনও এক ধূসর বিকেলে
ধুলোর পাহাড়ে চাপা পড়ে যাবে
বাধানো ফ্রেমের সেই প্রাচীন ছবিটাও
ঘুণপোকা খেয়ে যাবে ছবির কাঠামো
কাটবে স্মৃতির সেই হলুদ সুতোটাও।
২.
মুগ্ধ আগামী
একদিন সব ঝড় থামবে জানি
সব পাখি ফিরবে আপন নীড়ে
সব নদী পেয়ে যাবে মোহনার সুখ
মিশে যাবে সাগর গভীরে।
থামবে যেখানে যত শোণিতের ক্ষোভ
দুঃখের তিমির হবে সোনালিমা ভোর
গ্লানির পাহাড় ফুঁড়ে ফুটবে শেফালি
শস্যের সম্ভারে বসুধা বিভোর।
একদিন সব ভুল শুধরে আবার
একতার গানে হবে মুখর যামী
মিটে যাবে হেমলক, বারুদ পিপাসা
করতলে তুলে নেবে মুগ্ধ আগামী।
বেদনার সব শোক ভুলবে শিশির
ঘুচবে দুঃখের স্রোত, নগ্ন প্রেষণা
প্রত্যাশা জুড়ে থাক আকাঙ্ক্ষা ভীড়
অনুভবে পুষে রাখি অশেষ বাসনা।
উৎপল দাসের কবিতা
প্রতিশ্রুতি উড়ছে
১.
যদি মন চায়,
মেঘের ভিতর সাঁতার কাটতে
অযোধ্যা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়াব
আমাদের রুখামাটি আলোকিত করে
বিস্তর এই সবুজ...
যদি মন চায়,
এখানেই এসে দাঁড়াব
আজকের এই বিষণ্ণ সময়ে ।
২.
তখন ভোরের তারা ডাকতো আমাদের
তখন কয়েকজন বন্ধু মিলে দৌড়োতে যাই মাঠে
শেষ হলে আকাশের তলায় বসে পড়েছি
আজ সেই বন্ধুরা কোথায়?
এখনও ভোরের তারা ডাকে আমাকে
যখন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে যাই
৩.
সভা সমাবেশ থেকে
ঝাঁকে ঝাঁকে প্রতিশ্রুতি উড়ছে বাতাসে
লাল থেকে হলুদ, হলুদ থেকে সবুজ
সবুজ থেকে গেরুয়া
তারা রং বদলায়
হা করে গিলে নেয় দিন আনা-- দিন খাওয়ার দল।
মহিউদ্দিন স্যইফ-এর কবিতা
১.
বনভৈরব
কাদাতৃপ্ত পায়ে সোমরা বাউরীর ছেলে আসে ।
শরীরে তার শালুকফুলের ঘ্রাণ ।
বেঘাটে নেমে জাহেলিয়াত-জল সরিয়ে কিজানি কী দেখে !
হয়তো, নিজেরই বনভৈরবের মতো অন্তহীন রূপ ।
বিকেলবেলা ভৈরবথান থেকে আগুন লাগার শব্দ আসে ।
সারা গ্রামে সুবাস মেতে বেড়ায় ।
মেঘগুলো সব ধূপ হয়ে আজ জ্বলে ।
ভোরবেলা দেখি শ্যাওলা-চাথালজুড়ে
কমণ্ডলু, বাঘচামড়া আঁকা ।
মধ্যিখানের বনভৈরব ভস্ম একেবারে ।
সিঁড়ির মুখে কাদাপায়ের ছাপে আকনফুলের ঘ্রাণ ।
এদের মর্ম বুঝতে পারি
তেমন সহজ হয়েছি আর কই ?
২.
রাঢ়কন্যা
ভোরবেলা অমন করে ঘুম ভাঙালো কারা ?
কোন্ রহস্যলোক থেকে ডাক দিয়ে শিহরিত করে রবাব-বীণার সহোদরারা !
যেন অতীত থেকে ভেসে আসে প্রপিতামহীর সুমধুর কোরানপাঠ ।
দেখি, মা-ও উঠে পড়েছে ।
সেই গালিবানা সুর তাকেও করে দিয়েছে উজাগর ।
মা কি তবে রাঢ়কন্যা ছিল এর আগেও ?
'আমার টুসু খায় না কিছু, শুখাঁই গ্যেছে চাঁদবদন ।'
মা অধীর হয়ে কুলুঙ্গীর দিকে তাকায়।
শূন্য কুলুঙ্গী দেখে ঝাপসা হয়ে আসে চোখ ।
সহসা পাগলিনী উঠোনের দিকে এগিয়ে যায় মূষিকপ্রগল্ভতায় ।
কোথায় পিঁড়ি, আমন ধান !
চাঁউড়ির গোবরস্নিগ্ধ মাড়ুলিই বা কই !
মুয়াজ্জিন আজান হাঁকে ।
মা কেমন গুটিয়ে গেল,
বাধ্য মেয়ের মতো চুপিচুপি অযুর বদনা তুলে নিল হাতে ।
৩.
সমাধি
আজকাল মনও যেন হতে চায় মাটির সহোদর ।
গৌড়ের জনস্থলীতে এসে কইন্যা মহুয়ার খবর পুছে বেদেদের দোরে ।
নিরঞ্জন সন্ধ্যেজুড়ে বসে থাকে কাফেনচোরা পালার অপেক্ষায় ।
আত্মলীন ধ্যানমুগ্ধ নটরাজ নৈঋতে এমন কৃতজ্ঞ হয়ে কার কথা ভাবে ?
এমন উদ্বেল কে করে তাকে ?
কে বা চায় খড়্গবিষাণ নাম দিতে ?
বৃক্ষলতার দিকে চেয়ে সমাধি আসে তাঁর ।
কখনো বলে, "চুপ্ চুপ্, আমি ধরব ফড়িং ।"
কখনো বলে, "অরণ্য ! একা তোমার ভয় করে না বুঝি !"
উজ্জ্বল রায়ের কবিতা
১.
কবি
কল্প যুগের পরিধির গায়ে লিখেছ সপ্তপর্ণী গান,
পরিজন, প্রতিবেশীর যে সন্তান
তােমার লালন বৈরাগীর ছবি আঁকবে বলে
সাধন লিপ্ত,
তার হাতে বটফল তুলে দিয়ে কি ছিল
তােমার প্রতিশ্রুতি, কবি?
যে কংসাবতীর শুষ্ক বালিতে মুখ ডুবিয়ে
তুমি তাকেই দিয়েছ অশ্রুভার, সে কী তােমার
মায়ামুক্তির ব্যর্থ অভিপ্রায়!
গৃহস্থের প্রদীপ শিখার মতাে
তিরতির করে কম্পমান তুলিন স্টেশন থেকে
হুইসেল বাজিয়ে যে মেলগাড়ি
পূর্বাচলের দিকে চলে গেল,
তার চাকায় চাকায় পিষ্ট খােলামকুচির শরীরে
তােমার যে রক্তরাগ অভিমান,
তা আজও মিশছে সােনারেখা নদীর জলে।
আর তার পাশেই ওই তাে নামাে পাড়া,
বড্ড ভাতের গন্ধ ভেসে আসছে, আজ,
কতদিন পরে, গরম ভাত।
পাত পেড়ে দিদির অপেক্ষা যদি
সুবর্ণরেখার সমান্তরাল হয়, কোন প্রান্তে
তুমি দাঁড়াবে কবি আবার প্রশ্নহীন!
২.
নিরুত্তর
ধুলােটুকু বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে
গুহা থেকে রাজপথ----এতাে যে পায়ের ছাপ,
কোথায় লুকালে তুমি, মাটির পৃথিবী!
কোথায় লুকালে তুমি আবহমানের
পদপিষ্ট ঘাসফুল, অভুক্ত দেহের ছাই!
প্রত্যেক পদচিহ্ন ঘিরে যে যুদ্ধ কাহিনী কথা,
যে পােড়া গন্ধ, মানবের-শ্বাপদের, তাকে
ছুঁয়েই কি আবার, আবার বইছে
এই জন্ম-নদীর স্রোত?
বলাে তুমি, আজ বলাে তবে,
হে নিরুত্তর মাতৃ-পৃথিবী
যে আদিম অগ্নি-ভারে তুমি অন্তঃসত্ত্বা,
অন্তহীন শস্য প্রসবের যে যন্ত্রণা
বহন করছাে তুমি আজো,
সেই যন্ত্রণাই কি আমাদের নিত্য সূর্য সম্ভব?
চাঁদু
পলাশ মাহাত
চাঁদুকে প্রায়ই দেখি ক্লাব ঘরের মাঠে । একা একা খেলা করছে । বগলে দাবা একটা লাল মোরগ । রোজ সকালে সে মোরগটাকে দু’ফড় রসুন খাওয়ায় । কে তাকে বলেছে , রসুন খাওয়ালে নাকি মোরগের জেদ বাড়ে । সেই থেকে রোজ খাওয়ায় । তাছাড়া পোকা-মাকড়, ব্যাঙ, ফড়িং তো আছেই । এক কথায় সে মোরগের বড় রসিক ।
তা সে যাই হোক , আমি যখন স্নান করতে যাই তখন ক্লাব ঘরের মাঠে ঘোরাঘুরি করে সে । তার হাতে থাকে ছোট একটা পলিথিনের ক্যারিব্যাগ । তাতে তেলের শিশি আর মাখা সাবান । আসলে সে আমার অপেক্ষা করে । আমি স্নান করতে গেলেই আমার সংগে যাবে । যাওয়া চাই-ই চাই । আমার আর তার কম্পিটিশন হয় ডুব দেওয়ার ।
চাঁদুর বয়স নয় বছর । এর মধ্যে বেশ সাতারু হয়ে উঠেছে চাঁদু । পান ডুবকির মত ডুব দেয় টুকটুক ।
সেই সময় শীতকাল । কনকনে ঠান্ডা পুকুরের জল । ছুঁতে ইচ্ছে করে না । ডুব দিয়ে স্নান করা মানে যুদ্ধে জয়লাভ করার সামিল । আমি আর চাঁদু তবু প্রতিদিন ডুব দিয়ে স্নান করি । আমি এক ডুব দিলে সে দেয় দু'ডুব । আমি দুই দিলে সে দেয় তিন । মোট কথা আমার থেকে এক ডুব বেশি দিয়ে আমাকে হারায় । হারতে চাই না কিছুতেই । হারলে যেন বিরাট বদনাম তার । আর এই জন্য কোনদিন ডুব দেয় না আমার আগে । সবসময় তার ভয় , পাছে তাকে হারিয়ে দিই ।
আমার আর চাঁদুর এই স্নান করা দেখে চাঁদুকে গাল দেয় তার বাড়ির লোক । মা বাবা আর বিশেষ করে তার দিদা। দিদারই বেশি স্নেহধন্য সে । দিদার কাছেই বেশি লাই পায় । কিন্তু কারও কথা শোনে না চাঁদু । রোজ রোজ আমার সংগে স্নান করার জন্য আমার অপেক্ষা ক্লাব ঘরের মাঠে, দাঁড়িয়ে থাকে মিনিটের পর মিনিট । আমাকে দেখতে পেলে ভীষণ খুশি । আমার পিছু পিছু যায় । আর প্রতিদিন তাকে জিততে দিতে হয় তার আনন্দঘন মুহূর্তভরা মুখ দেখার জন্য । দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই ।
কখনও কখনও তার দিদা মৃদু ভর্ৎসনা করে আমাকে বলে, কেন হুচকাও চাঁদুকে ? জ্বর সর্দি কিছু হয়ে যাবে ।
আমি চাঁদুকে শাসন করতে গিয়েও পারি না শুধু তার আনন্দঘন মুখের দিকে চেয়ে ।
একদিন আমি স্নান করতে যাচ্ছি । ক্লাব ঘরের কাছে আমার সংগী হয় সে । আর আমি তাকে বলি, তুই একডুবের বেশি দিলে তোকে খুব মারবে তোর দিদা ।
চাঁদু হাসে সামনের দুটো ইঁদুর দাঁত দেখিয়ে। হাসিটি বড় পবিত্র তার । বড় অমলিন । হেসে হেসে চাঁদু বলে, আমাকে কোন দিন মারতে পারবে না ।
---- কেন ? কেন রে তোকে মারতে পারবে না ?
সে আবার হাসে । এই বারের হাসি একটু অন্য রকম । মজা পেলে যেমন হাসি হয় ঠিক সেই রকম ।
আমি তো তার হাসি দেখে মুগ্ধ । তার মজা পাওয়া হাসির রহস্য বোঝার জন্য তাকে বলি , কেন মারতে পারবে না বল ? তখন চাঁদু বলে বেশ খুশি খুশি মুখে, আমাকে মারলে দিদা নিজেই কাঁদবে ।
----- কেন কাঁদবে ? তুই তো আচ্ছা বোঝাচ্ছি আমাকে । তুই মার খাবি আর দিদা কাঁদবে , এটা কখনও হয় না কি ?
সে আমাকে তার কথা বিশ্বাস করানোর জন্য গলায় অধিকতর জোর দিয়ে বলে , হু । আমাকে একবার মেরেছিল তখন আমি খুব কেঁদে ছিলাম । আর দিদাও খুব কাঁদছিল তখন । কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, আর কোনদিন তোকে মারব না ।
হাসি পাই চাঁদুর কথায় । মৃদু হেসে বলি, দিদাকে ভালয় পটিয়েছিস ?
সে এইবার কথা না বলে গর্বিত ভাবে হাসে, আর হাসতে হাসতে একদিকে মাথা নাড়ে ।
দিন তিন পর একদিন হঠাৎ খেয়াল করি চাঁদুকে তো ক'দিন ধরে দেখতে পাইনি । গেল কোথায় ? নিশ্চয় মামাবাড়ি গেছে । তাছাড়া কোথায় বা যাবে । এইসব ভেবে আমি চাঁদুর কথা তেমন ভাবি নাই । তারপর একদিন হঠাৎ সকাল বেলা চাঁদুর কন্ঠস্বরে আমার ঘুম ভেঙে যায় । আমাদের আঙিনায় সে কার সংগে গল্প করছে । আমি তাড়াতাড়ি উঠে তার কাছে যাই । গিয়ে বলি , কি রে পার্টি , তোকে যে আর দেখতে পাই না। কোথায় গেছিলি বল তো ?
সে তার ছোট ঠোঁটে স্বভাবসসিদ্ধ হাসিটি জাহির করে বলে , কোথাও না ।
------ ঢপ মারছিস ?
------ না , সত্যি বলছি কোথাও যায়নি ।
------ তা হলে তোকে দেখতে পাইনি কেন বল ?
চাঁদু বলে , আমার কানে ব্যথা হয়েছে । ডাক্তার ওষধ দিয়েছে খাওয়ার আর লাগাবার । আর বলেছে , আমার বাঁধে স্নান করা বারন ।
------ এখনো ভাল হয়নি ?
------ না ।
------ তবে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন ?
------ তোর সংগে দেখা করতে এসেছি ।
আমার মুখের কথা হারিয়ে যায় চাঁদুর কথা শুনে । তার অসুখ , আর সেই এসেছে আমার সংগে দেখা করতে ? আজব ছেলে । বলি , কেন রে ? কি দরকার ?
তখন মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলে , দিদা আমাকে রোজ বলে , কই রে চাঁদু , তোর পার্টি তোকে কই দেখতে আসে । খুব তো পার্টি পার্টি করিস । একদিনও তোর খবর নিয়েছে তোর পার্টি ?
বলেই চাঁদু একটা মোটা শ্বাস ফেলে । তারপর আবার বলে , আমার শুনতে খুব খারাপ লাগে । কষ্টও পাই ।
চাঁদু চুপ করে কিছুক্ষণের জন্য । তারপর আমার মুখের দিকে কাতর চোখে চেয়ে বলে , যাবি তো আমাকে দেখতে ?
আমি তাকে কাছে টেনে নিই । তার মাথায় স্নেহের হাত বোলাতে বোলাতে বলি , যাব ।
সে আর দাঁড়ায়নি । কথা আদায় করে সোজা বাড়ি চলে যায় ।
সেইদিন আমি স্নান করতে যাওয়ার সময় তাদের বাড়ি ঢুকি । তার দিদা আমাকে দেখে তো মহাখুশি, তার থেকেও বেশি অবাকও হয়ে যায় । সে আমাকে দেখেও বিশ্বাস করতে পারে না আমি চাঁদুকে দেখতে তাদের ঘরে এসেছি । আনন্দ ধরে রাখতে না পেরে সে চিৎকার জুড়ে দেয় , চাঁদু রে , এই চাঁদু , দেখ কে এসেছে ?
একটা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে চাঁদু । আমার কাছে দাঁড়ায় আমার মুখের দিকে চেয়ে । ঠোঁটের কোনে একটু চালাকি মেশানো হাসি ।
আমি বলি , কি রে পার্টি স্নান করতে যাবি নাই ?
চাঁদু না সূচক মাথা নাড়ে । কিন্তু উৎসুক চোখে চেয়ে থাকে দিদার দিকে । দিদা বললেই সে যেন এখনই আমার সঙ্গে যাবে ।
তার দিদা তার অসুখের বৃত্তান্ত আমাকে শোনায় । তারপর বলে , খাটে শুয়ে শুয়ে কত যে তোমার খবর নেয় , কতবার যে তোমার নাম করে তার কোন ইয়ত্তা নেই । কি দিয়ে এই বাঁদরটাকে তুমি বশ করেছ ?
প্রত্ত্যুত্তরে আমি চাঁদুর আদরযোগ্য ছোট মুখের দিকে চেয়ে থাকি । তারপর টেনে নিই নিজের কাছে । নিজের কোমরের সঙ্গে জড়িয়ে ধরি । হাত বোলায় তার মাথায় । বলি , আজ তোকে ডুব দিয়ে হারাব ।
চাঁদুর মুখের অভিব্যাক্তিগুলো ক্রমশই নিষ্প্রভ হয়ে আসে । আর যাই হোক সে হারতে চায় না । বিশেষ করে আমার কাছে । আমার মুখের দিকে চেয়ে বলে , আজ ক’ডুব দিবি তুই ?
------ দুই ।
বলে তাকে দুটো আঙুল দেখায় । সে হাসে । অসহায়ের হাসি । আমি তার মাথায় হাত বোলাতে থাকি বন্ধু সুলভ আচরণে । তার দিদা একবার আমাকে আর একবার চাঁদুকে দেখতে থাকে পালাক্রমে ।
গন্ধের রূপ
কল্পোত্তম
কোনো কোনো গাছ কোনো কোনো ফুলের মতো কোনো কোনো নারীরও শরীরে সুমিষ্ট গন্ধ থাকে। কাছে বসলে বা দাঁড়ালে ভেসে আসে নাকে। মুগ্ধ হয় মন।
অনেকদিন আগে হেমলতার শরীর থেকে সেরকমই গন্ধ ভেসে এসেছিল হাওয়ায়। তারপর কতবার পেয়েছি, কতবার পাওয়ার জন্য কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। হেমলতা বুঝতে পারেনি।
তার শরীরের গন্ধে কে বিভোর হলো, কে কাছে এসে দাঁড়ালো, কি এসে যায় তার? সে তো ফুল, গন্ধ ছড়াতেই মগ্ন।
কুমারীর তীর বরাবর যে ঘাস জমি, হেমলতার আঁচলের মতো বিস্তৃত, কতবার বসেছি। কতবার শুয়ে শুয়ে দেখেছি ক্যানভাসের মতো আকাশকে। সেখানেও কি গন্ধ ছড়ায় হেমলতা?
কয়েক বছর আগে পলাশের ঘর লিপানিয়া গিয়েছিলাম। আসার সময় লিপানিয়া মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় নাকে এলো সেই গন্ধ। চারদিকে ঘুরিয়ে দেখলাম দৃষ্টি, কই হেমলতা তো নেই। তবে কি অন্য কারোর গন্ধও হেমলতার মতো? মনটা ভারি হয়ে এলো। নুয়ে পড়লো নিম পাতার মতো।
নিম পাতার সঙ্গে অনেকেরই ভালোবাসা, গভীর ভালোবাসা। নিম পাতা কি তাদের জন্যই নুয়ে পড়ে? পড়তেও পারে হয়তো। তবে, আমি খুব বেশি নুয়ে পড়তে পারলাম না, হেমলতা ছিল না বলে সেখানে।
ফুল আর গাছের গন্ধের মতোই হেমলতার গন্ধও হারিয়ে যায় বাতাসে। পড়ে থাকে কেবল আঁচলের মতো বিস্তৃত নদীচর। একেবারে সবুজ। যে সবুজ দাগ লাগায় না পাঁজরে। বরং মনকে টানতে টানতে বাড়িয়ে দেয় আকাশের দিকে আকাশমনি গাছের মতোই।
আমার শৈশবের কোনো এক বিকেলে প্রথম মুগ্ধ হয়ে উঠেছিলাম হেমলতার সুগন্ধে। সে তখন বিয়ে করে প্রথম এক গ্ৰাম থেকে আরেক গ্ৰামে এসে পৌঁছেছে। তার জীবনের সাথে শৈশব থেকে যুক্ত থাকা ঠিকানা পরিবর্তিত হয়ে যুক্ত হয়েছে নতুন একটা ঠিকানা। তার লাজুক লাজুক দৃষ্টি চিনে নিচ্ছে নতুন ঠিকানার একেকজন মানুষকে। আমিও সেই অপরিচিতের সদস্য হয়েই প্রথম কাছে গিয়ে বসেছিলাম তার। তখনই অনুভব করেছিলাম হেমলতা অনেক অনেক নারীর থেকে অনেকটাই আলাদা। সে শুধু রূপে নয়, গন্ধেও আলাদা, মনেও আলাদা, আচরণেও আলাদা।
লিপানিয়ার মোড়ে সেই গন্ধটা অহেতুক ছিল না। সেখানেও চা দোকানের চেয়ারে বসে ছিল এক মেয়ে। তখনই অনুভব করি আমি, এই গন্ধ কেবলমাত্র হেমলতার গন্ধ নয়। পৃথিবীর আরো অনেক অনেক নারীর শরীর থেকে এই গন্ধ অনায়াস মিশে যায় পর্ণমোচীর হাওয়ায়।
হেমলতা জানে, তার প্রতি আমার আকর্ষণ আসলে তার শরীরের জন্য নয়। তার শরীরের প্রতিটা রোমকূপ থেকে ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়া সুগন্ধের জন্য। যে গন্ধের মায়া মুগ্ধতায় পাশে পাশে ঘোরাঘুরি করে বাতাস।
দীর্ঘ বারো বছর পেরিয়ে গেল। হেমলতার সঙ্গে সেভাবে কোনো সম্পর্ক ছিল না আমার। ছিল না কোনো ভাবেই সাক্ষাৎ করার সুযোগ। সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে অনেক গুলো বছর অনেকটা দূরে থেকে মনে হয়েছে এও এক ভ্রান্তি বিলাস। না ঘটায় উচিত ছিল জীবনে।
পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে গেল হেমলতা। আমিও পা দিলাম তেচল্লিশে। ঘটনার ঘনঘটায় কাছে এলাম। একেবারেই কাছে এলাম আবার। এখন আর গন্ধ নেই। পৃথুলা শরীর, স্ফুর্তিও দেখা যায় না সেরকম। তবুও গন্ধ খুঁজি। চেনা সেই গন্ধ খুঁজি কাছে এলেই। সেটাই তো চিরচেনা আমার। যে শুধু অনুভবে আসে, তারপর হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় মেঠোপথ, ধানখেত, ঝরে পড়া পাতাদের শিরায় শিরায়।
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
আয়োজক : অনিকেতের বন্ধুরা
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
খুব ভালো।
উত্তরমুছুনভাল লাগল!! এগিয়ে চলুক সব চিন্তাধারা...
উত্তরমুছুন