প্রথম বর্ষ ।। ষষ্ঠ ওয়েব সংস্করণ ।। ৯ কার্তিক ১৪২৭
উৎসব আসে উৎসব চলে যায়। এক একটা উৎসবের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায় আমাদের ব্যস্ততম জীবনের এক একটা সুচারু মুহূর্ত। কিন্তু এ বছর সেই উল্লাসে খানিকটা ভাটা পড়ে গেল। শঙ্কামুক্ত হয়ে বেরোতে পারলো না মানুষ। বেরোতে পারলো না রুদ্ধশ্বাস কিছু মুহূর্তের খোঁজে। যে মুহূর্তগুলোর সন্ধানে অপেক্ষা করে থাকে এক বছর।
আজ বিজয়া দশমী। বড়দের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেওয়ার দিন। কিন্তু, সত্যিই কি ছুঁতে পারবো পা? নাকি পা ছোঁয়ার আগে ভেসে উঠবে মারণ ভাইরাসের ছবি? শিউরে উঠবে প্রতিটি লোমকূপ!
বহমান সাম্পানের মতো বয়ে যাবে একদিন।সমস্ত ভাইরাস বয়ে যাবে সময়ের স্রোতে। থেকে যাবে ঘটে যাওয়া ঘটনার ঘনঘটা। আর তখনও গুঞ্জরিত হতে থাকবে জীবনের জয়গান।
অরন্ধন ওয়েবের সকল বন্ধুদের বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা জানিয়ে---
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
কাঠিনাচ
দুর্গা দত্ত
আজ আমাদের গাঁয়ে( বিবড়দাতে ) এসেছিল নাচকাঠি / লাচকাঠি / কাঠিনাচের --দল। কিছুটা দূরের অন্য এক গাঁ থেকে। আগামী কাল, পরশু, অষ্টমী আর নবমী-তেও আসবে অন্য অন্য গাঁ থেকে। দেখিয়ে যাবে নাচ।
আগে আমাদের গাঁয়েও ছিল নাচকাঠির দল । ছিল বালকসঙ্গীত / বালিকাসঙ্গীতের দল ; ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে ছিল মনসাযাত্রা । কতো যে দেখেছি অল্পবয়সে ! সেসব কবেই শেষ হয়ে গেছে আমাদের গাঁ থেকে। দূরের অন্য অন্য কয়েকটি গাঁ থেকে এখনো পুজোর এই কদিনে অবিশ্যি দু-একটি দল আসে। এ গাঁয়ে ও গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে পথে পথে গেরস্থবাড়ির সামনে, পূজামণ্ডপে নেচে গেয়ে সন্ধের পরে নিজেদের গাঁয়ে ফিরে যায়। এই নাচকাঠি বা কাঠিনাচ দক্ষিণ পশ্চিম রাঢ়ে টিমটিম করছে কয়েকটি গাঁয়ে। প্রায় নিভে আসবার মুখে।
নবমীর দিনে গাঁয়ে আসে সাঁওতালদের দাঁসাঞ - নাচের দল। স্থানীয়ভাবে বুয়াঙ্ / ভুয়াঙ্ নাচও বলে একে। দাঁসাঞ সাঁওতালদের আদিনায়কের অসঙ্গত মৃত্যুর শোক পালনের নবম দিবস। দাঁসাঞ-এর গান আসলে শোকগাথা। মহিষাসুর-হত্যার জন্যে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর এ এক অন্তর্গত অশ্রুপাতের কাহিনি। আদিম জনজাতির জীবন ও সংস্কৃতির মধ্যে মহিষাসুর বা 'হুদুড় দুর্গা '-র মীথ রে কতো গভীরভাবে সজীব, -- দাঁসাঞ তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
যৌথতা ভেঙে যায় (তৃতীয় কিস্তি)
অভির সঙ্গে রাধানাথ এসেছিল। সরল গ্রামীণ মুখ।অবিন্যস্ত চুল ও জামা-কাপড়। এবং মুখ চোরা। অভিও যে খুব কথা বলত এমনটা নয়, তবে আমি এত বেশি কথা বলি সব সময়, এত বেশি প্রশ্ন করি, তাদের কথা বলতেই হয়।
অভি ও রাধানাথের সঙ্গে তাদের বন্ধু পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার ডেরায় পৌঁছে গেছিল একদিন।এসেছিল অনেকেই। আশা করি সবাই ভালো আছে। তাদের ভাল থাকার দিকে চেয়ে চেয়ে আমার দিন যায়। আমার শুভবোধের প্রতি মুহূর্ত মানুষকে পেতে চায় । কেননা, মানুষ ছিল মানুষ আছে মানুষ থাকবে।
মানুষকে ধ্বংস করা যাবে না কোনো ভাবেই।
আমি অভিকে ঘিরেও স্বপ্ন দেখেছিলাম। যে স্বপ্নে এক মাহাত যুবক এগিয়ে যাচ্ছে, নিজের শিকড়ের কথা বলতে বলতে। তার চারপাশের যে দারিদ্র ও অসহায়তা তার কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে।
সবাইকে কবিতা লিখতেই হবে, সবাইকে পেতে হবে প্রচারের আলো, এই জায়গা থেকে দূরে দাঁড়িয়ে নিজের গ্রামের কথা বলুক। নিপীড়ণের কথা বলুক। ভালোবাসার কথা বলুক। এই ছিল চাওয়া।
আমি যা চাই সব কি আর হতে পারে? আমি যা পেতে চাই, সমস্ত কি আর পাবো? তবুও অভিকে ঘিরে আমার স্বপ্ন ছিল।
আমার স্বপ্নের দিকে অভি হেঁটে যায়নি। সে তার নিজের পথ নিজের মতো করে বেছে নিয়েছে।
আমারও কোনো বিরোধিতা নেই। সে ভালো থাকুক, এই আমার কামনা।
চেয়েছিলাম, ৭০ দশকের পরেও নতুন করে শুরু করবো। নতুন ছেলেদের নিয়ে শুরু করবো শহর ঘেরাও। যে তরুণরা নতুন চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে নতুন চেহারা দেবে। আমাদের চারপাশের।
আমার স্বপ্ন আমার ভাবনা আঘাত খেয়েছে নিত্যনতুন ভাঙ্গা গড়ার মধ্যে। কিছুই কী গড়তে পেরেছি? কেউ কারোর খোঁজ-খবর করিনা। কে কত মলিন হয়েছি, কে কতটুকু উজ্জ্বল হয়েছি, কেউ জানি না। মুজিবরের ছেলে কত বড় হল কোন্ ক্লাসে পড়ে, আমি জানি না। সোমেন অতনু সজল কেমন আছে?আমার কী বয়স হয়েছে?
আমি তো আজও ছুটে বেড়াই। কোনোদিন পুটিয়ারি । কোনোদিন রঞ্জনডি। ছুটে বেড়াতে বেড়াতে কী পাই, কী পেতে চাই? তারুণ্যের আলো আমার বুক জুড়ে আমাকে করবে অনুপ্রাণিত। আমাকে করবে দীপ্ত। আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে আরো অনেকটা পথ। যেখানে পৌঁছে দেখতে পাবো, কোনো অভাব নেই কোথাও। শুধু আলো আর আলো আলো আর আলো।
আলোর বদলে যদি দাঁড়িয়ে থাকে অপমান? যদি দাঁড়িয়ে থাকে আঘাতের পর আঘাত, আমি কী স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাবো? মেরেছো কলসির কানা, তা বলে কী প্রেম দেব না?
প্রেম তো দিতেই হবে, তার আগে শোনাতে হবে কৃষ্ণ নাম। যদি তুমি আমাকে কৃষ্ণ নাম শোনাও আমি আছি, তোমার পাশেই আছি।
আমন এলো। তরুণ এলো। বিশু এলো। বিল্টু এলো। ইত্যাদিরা এলো। এই এদের নিয়েও পাল্টে দিতে কি পারলাম আমার চারপাশ? গ্রামজীবনের আলো বাতাস নিয়ে যারা আমার কাছে পৌঁছে ছিল একদিন, তাদের মুখের দিকে চেয়ে আমিও তো
বাঁচতে চেয়েছি।
কতটুকু বাঁচতে পারছি আজ? খুব বিধ্বস্ত লাগছে, খুব খুব। কেবলই মনে হচ্ছে আমার চারপাশের শিরদাঁড়া শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কোনো হাওয়া নেই । সুমন বন্দ্যোপাধ্যায় সুপ্রিয় দেওঘরিয়া সঞ্জীব বাউরী দেবজ্যোতি রায় সন্দীপ মুখোপাধ্যায় বাপি কর্মকার আমাকে দেখাবে দিশা? অবনী মাহাত সাড়া কী দেয়? কাছে এবং দূরে যা কাদা
পিছলে পড়তে হচ্ছে বারবার। বাইরের চাহিদার দিকে, ইশারার দিকে, অজয় ও দীপাংশুরা যদি চলে যায়,
ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো ক্ষয় ক্ষতি নেই, ক্ষতি যে ওদের কে বলবে? আমি আমার টি-শার্টে স্লোগান লাগিয়ে দিয়েছি, কন্ঠ ছাড়ো জোরে------কিন্তু বাস্তবে কন্ঠ তো নেই। রাস্তায় একজন পথচারী আমজনতার কাছে মার খাচ্ছে । সঠিক কারণ জেনে, আমি কি আমার কন্ঠ ছেড়ে প্রতিবাদ করতে পেরেছি? বুকে থাকবে লেখা গিটার। অথচ একতারার একটি তার চিনি না। ভড়ং নয়। ভয় নয়। ভালোবাসার দিকে এগিয়ে চলো, যদি যৎসামান্য রাস্তা তৈরি করতে পারো।
সাধন মাহাতর কাছেও তো অনেক আশা করেছিলাম। সেও চলে গেল রাজনীতির দিকে। এখন বলতে পারি যদি তার রাজনীতি তাকে এবং তার পুরুলিয়াকে নতুন করে বাঁচতে সাহায্য করে আমি নিশ্চয়ই তাকে সমর্থন জানাবো। অপেক্ষায় আছি।আপাতত এই।
শুভাশীষ ভাদুড়ীর কবিতা
মকর সংক্রান্তি ১৪২৬
পর্দা আমি টাঙাই
কারণ, ওইটুকুই আছে,
আড়াল রাখি ক্ষতির সম্ভার
কাঙালপনা ভিতরে
বারফট্টাই সব তুলো
ফুৎকারে হয় এস্পার ওস্পার
বালির মতো জীবন,
তাকে আঁজলা মেপে ধরি
বালির গায়ে নোনা জলের ছাপ
ভয় লেগেছে ঢেউয়ে,
আমার আর্ততার স্বরে
হাওয়ায় ওড়ে
পূণ্যদিনের পাপ
প্রলাপ
১.
রোদ পড়ে গাছে
রোদে পোড়া গাছ
সংসার আসলে এক, নড়ে ওঠা প্রতিবিম্ব
পাগলের হাতে ধরা ভাঙা আয়নায়---
যার দেহে পারা লেগে আছে
পাগল নিজের মতো
খেলা করে, ভাবে
সংসারও, নিজের মতো
খেলে, আর বাঁচে
২.
যে জল নদীতে থাকে, তার
ভয় হয়, বঁড়শির ভয়
আরও আছে---পাথরে ধাক্কার
যতবার ঘাটকাজে গেছি
আমি, জল ডুবতে দেখেছি
রুমঝুম নূপুরের ধ্বনি তোলে কোন্ তরঙ্গিণী...
সায়ন্তন ধর
সময়টা গ্রীষ্মকাল , তবে স্থানটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে ( প্রায় সাত হাজার মিটার ) হওয়ায় শীত সারাবছরই সেখানে রাজত্ব করে । এই স্থানে একসময় একটি শিশুকন্যার জন্ম হয় । প্রতি গ্রীষ্মে বাড়তে থাকে তার বয়স । সেই মেয়ে ভীষণ চঞ্চলা । কিছুতেই একখানে সে থাকতে চায় না । একসময় সে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কিছুটা নীচে নেমে আসে । একটি হ্রদ তার চোখে পড়ে । সেই হ্রদের গাঢ় নীল টলটলে জলের ওপর ভেসে থাকে বরফখন্ড । সেই মেয়েটির বড়ো ভালো লেগে যায় এই পরিবেশ । এই হ্রদে হেসে খেলে সে কাটিয়ে দেয় অনেকটা সময় । একসময় শীতকাল এলে হ্রদের গাঢ় নীল জল শ্বেতশুভ্র বরফে রূপান্তরিত হলো । শীতরূপী সেই দৈত্যের নিকট ছোট্ট সে মেয়ে হলো বন্দী । তার চোখের জল নিমেষে বরফ হয়ে যায় । কান্নাও সেখানে তখন নিষিদ্ধ । এভাবে বন্দিনী সেই কন্যা তার চঞ্চলা স্বভাবকে হারিয়ে চুপ করে বসে শুধু ভাবে কবে সে মুক্তি পাবে । এমন সময় দীর্ঘ যুদ্ধে সূর্যের তেজের কাছে পরাস্ত হয়ে শীত দৈত্য বিদায় নিলে এতোদিনের ক্রন্দনোৎসারিত জলে তার চোখের দু'কূল ছাপিয়ে গেলো । হ্রদ তাকে বললো, " কন্যা, তুমি স্বভাবচঞ্চলা, কোন একস্থানে থেকো না কখনো ।" সেই কথা শুনে সেই মেয়ে বিদায় জানালো হ্রদকে । আর মনে মনে ঠিক করলো , আর কখনো সে ফিরবে না হেথায় । চোখের দু'ফোঁটা জল হ্রদের কাছে দিয়ে সে নেমে এলো আরও খানিকটা । আরও কিছু ছোট বড়ো হ্রদ সে দেখলো, থামলো তারপর শুধু ছুঁয়ে গেলো তাদের । এরপর শুধুই তার ছুটে চলা অব্যাহত রইলো । একসময় শীত দৈত্যের রাজ্য পেরিয়ে এলো সে । চঞ্চলিনী এবারে প্রবেশ করলো পাথরের রাজ্যে । বেশ আনন্দ হলো তার । সারাদিন সে ছুটোছুটি করে বেড়ায় এখানে । এ পাথর থেকে সে পাথর , পাথরের গায়ে গায়ে চলকে ওঠে তার হাসি । সূর্য হতে পায় সে প্রাণস্পন্দন । সবুজ অরণ্যানী দেয় তাকে শীতল ছায়া আর স্নিগ্ধ বাতাস বাড়িয়ে তোলে তার প্রাণশক্তি । বনের পশু-পাখীরা তার বন্ধু । পাখীরা শোনায় গান । প্রজাপতি শেখায় রঙে রঙে রাঙিয়ে রঙীন করে দিতে । বন্যেরা তার সাহচর্যে হয় মুগ্ধ । সে যে তাদের জীবনস্বরূপা । এতো আদর , এতো যত্ন তবুও স্বভাবচঞ্চলা সেই মেয়ে নিজেকে আটকে রাখেনি এখানে । হয়তো এখানে তার চঞ্চলতাকে ত্যাগ করলে সে সুখী হতো , কিন্তু হ্রদের সেই উপদেশকে মনে রেখে সে এই স্থানকেও বিদায় জানালো । এগিয়ে চললো অজানাকে জানতে , অচেনাকে চিনতে । বেশ কিছুকাল অতিবাহিত হলো , পথে কোথাও বন্ধুর সাথে হাত মেলালো , কোথাও সহজেই শত্রুকে করলো পরাস্ত । এভাবে সেই সেদিনের শিশুকন্যা ক্রমে লাবণ্যময়ী কিশোরী হয়ে উঠলো । এমনই একদিন সেই কিশোরী দেখতে পেলো এক সুদর্শণ তরুণ এগিয়ে আসছে তারই দিকে । চলার পথে সঙ্গী পেয়ে দু'জনেই গিরিশ্রেনীর অতন্দ্র প্রহরাকে উপেক্ষা করে বন্ধুত্ব করলো । হাতে হাত রেখে এগিয়ে চললো আরো অনেকটা পথ । যদিও শান্ত সে তরুণের উপস্থিতি সহজেই কিশোরীর চঞ্চলতায় ঢাকা পড়ে যায় । কিশোরীর আব্দারমতো তার পথেই অগ্রসর হয় তরুণ । এভাবে দু'জনে মিলে পাহাড়ি পথের প্রায় সবটাই পেরিয়ে এলো । সময় পেরিয়েছে , কিশোরী এখন পূর্ণ যুবতী ।তবুও সে তন্বী, তার রূপে সকলেই মুগ্ধ । তন্বী হবে নাই বা কেন ? এতোদিনের দুরন্তপণায় সে ক্লান্ত । সে উপলব্ধি করলো যে এবার তাকে শান্ত হতে হবে । সে শান্ত হলো , স্নিগ্ধতা বাড়তে লাগলো । ধীরে ধীরে সে পাহাড়ের পাদদেশ পেরিয়ে সমভূমিতে শান্ত পদবিক্ষেপে চলতে লাগলো । আশেপাশে দীনদরিদ্রের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো । অন্যায় দেখলে সে হয়ে উঠতো প্রতিবাদী , ভালোবাসা পেলে সে প্রতিদানে দিতো ভালোবাসা । কোথায় হারিয়ে গেলো সে চঞ্চলা । সে এখন ধীর স্থির নারী । রূপলাবণ্য ও গাম্ভীর্যের সহাবস্থান তাকে করেছে মহীয়সী । এইসময়ে অনেক সখী পরিবৃতা হলো সে । তাদের মধ্যে কেউ তারই মতো ধীর স্থির , কেউ চপলমতি , কেই শান্ত ভদ্র , কেউ বা অতি দুষ্টু । সকলকে সাথী করে সে পার্থিব মঙ্গলকার্যে ব্রতী হলো । কোথায় চলেছে সে ? তার চলার শেষ কোথায় তা সে জানে না । কিন্তু মনে সাধ বৃহৎ কোন হৃদয়ে সে আত্মসমর্পন করে । কিন্তু হায় , এ সময়ে তার চালিকাশক্তি রুদ্ধ হয় । এবার কোন দৈত্য দানো নয় । যাদের সে এতোদিন অকাতরে বিলিয়েছে তার বৈভব সেই মানুষই এখন তার সবচেয়ে বড়ো শত্রু । মানুষ আরো লাভবান হতে চেয়ে লোলুপদৃষ্টি নিবদ্ধ করলো তার উপর । সহসা বন্দিনী হলো সে । এ বন্ধন মুক্ত করে কি তার সাধ্য ! চোখের জল বাধা মানে না । দু'কূল ছাপিয়ে যায় তাতে । তবু মুক্তি মেলে না । অত্যাচারের বহর বাড়তেই থাকে । কে বলবে সে পূর্ণযৌবনা ? নিপীড়নের ফলে সে বুড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত । চলচ্ছক্তিরহিত হয়ে পড়ছে সে ক্রমে । অবশেষে কোনরকমে আশ্রয় নিলো সে বড়োই আপনার জন যমুনার কাছে । মানুষ জানে না , প্রকৃতির এই কন্যা হার না মানা , জেদী , এগিয়ে চলার মন্ত্রে দীক্ষিতা । মানুষ ভাবছে পদানত করেছে সে এই নারীকে । কিন্তু সে ভুল । এই নারী ধ্যানমগ্না হয়ে শক্তি সঞ্চয় করে নিজের চঞ্চলতাকে ফিরে পেতে চাইছে । একদিন সে তা অর্জন করবেই আর সেদিন সব বন্ধন ছিন্ন করে মুক্তি পাবে সে আর সকলের কাছে নবরূপা অচেনা এক নারী হিসেবে প্রতীয়মান হবে । সে সেই চঞ্চলা বালিকা বা ধীর স্থির নারী নয় , সে হবে চঞ্চলিনী পাগলিনী নারী, এতোদিন ধরে যা কিছু বিলিয়ে ছিলো অকাতরে সে সবই ফিরিয়ে নিয়ে এক লহমায় নিজেকে সঁপে দেবে সাগরের বুকে। আর বলবে , "চেয়েছিলাম কিছুদিন খেলবো এই পৃথিবীতে , কিছুদিন সেবা করবো আর্তের, আর একদিন ঠিক মিশে যাবো সাগরে। সবই হলো, উপরি হিসাবে যা সৃষ্টি হয়েছিলো এতোদিন সে সকলই ধ্বংস করতে হলো নিজ হস্তে।"
(উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী তিস্তাকে মনে রেখে ...)
বিশ্বম্ভর নারায়ণ দেবের কবিতা
১.
দ্বি-প্রহার
থাকতে তো চাই একটা নিয়েই
অকস্মাৎ ঢুকে পড়ে দুই
কথাটা যতই বলি ইনিয়ে বিনিয়ে
ভাইটি আমার রাগ করিসনি তুই।
একটি আমার হলুদ মাখানো হাত
আরেকটি দুর ছাই
পান থেকে চুন খসলে বাজিমাত
ভাত নয় রোজ চিতাভস্ম খাই।
একটি আমার তাওয়াই ঘোরানো রুটি
জলে ময়দায় তালেগোলে মাখামাখি
বিরহের প্রান্ত ছুঁয়ে গগন পথ অন্যটি
ছন্দ ভেজা হাঁটছে শরীর, ইচ্ছাময়ী নাকি?
এই তো সবে হয়েছে সন্ধ্যে
বাকি আরও কত যে সন্ত্রাস
কবিকে বলি, কবিতায় মন দে
তারপর যতো দ্বি-প্রহার হোক, খাস!
২.
শ্রী নির্মল হালদার
আপনাকে কাছে পাওয়া মানে
দারিদ্রসীমা পার হ'য়ে
এক অসীম সম্পদের কবিতাকে পাওয়া।
তাই এত কথা অনাদর নিয়ে
ক্ষুধা নিয়ে একাকীত্ব নিয়ে
উদ্দেশ্যহীনতা নিয়েও কথা।
এই বিহ্বলতা অনেকের বোঝার নয়
কেননা, তার উৎসে এক অতলান্ত চেতনা।
মনে পড়ে গতবার শারদ নবমীর দিন
কবিতার আলোয় ঠিক যেন
দুয়ার ভেঙে আসা জ্যোতির্ময়
শূন্যতার মুকুট- শোভিত
এ কোন রাজা
এ কেমন রাজৈশ্চর্য
অভিঘাতে বুক-ভেতর হুহু করে ওঠে!
বউকে দেওয়া উপহারের
কথা মনে পড়তেই
রাজা হয়ে আসে আলতা সিঁদুরের পৃথিবী!
চেনা পৃথিবীর বাইরে
অরণি বসু
চেনা পৃথিবীর বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি একা।
সন্ধে পেরিয়েছে সবে, রাত্রি এখনও ঝাঁপিয়ে পড়েনি
শুনশান চতুর্দিক, চক্কর কাটছে পথ-কুকুর,
হাওয়ায় উড়ছে পরিত্যক্ত পলিথিন প্যাকেট।
চোখের সামনে, প্রায় চোখের নিমেষে
সব কিছু অচেনা হয়ে গেল হু হু করে।
মানুষের হাসি আনন্দ বিশ্বাস খসে পড়তে পড়তে
সীমান্ত পেরিয়ে চলে যাচ্ছে মাথা নীচু করে ।
চেনা পৃথিবীর বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি যার জন্যে
সে পাশ দিয়ে কখন যে চলে গেল টের পাইনি
অর্ধেক মুখ ঢাকা ছিল তার, আমারও।
রামকুমার আচার্যের কবিতা
১.
ভ্রম
মাঝে-মাঝে মনে হয় শেষ হয়ে যাচ্ছি
পিঁপড়ের লাইন দেখে ভুল ভাঙে
মালগাড়ি দেখে বিশ্বাস হয়
গন্তব্য বলে কিছু নেই।
আমি খোয়াইয়ের পথ চিনি না
শুধু জানি ক্ষয় হতে। মেঘের মতো।
ধূলোর সঙ্গে ধূলো মিশিয়ে
তুমি কি গড়বে পাথর!
পাহাড় বাঁচে আঘাতে, বৃষ্টির ফোঁটায়
২.
ফেরা
ভাবছি ফিরে যাব
আরও ক'দিন কাটিয়ে ফিরব
পাখিদের মতো যদি ফিরতে পারতাম!
তোমার অহংকার আমাকে পুড়িয়ে দেয়
অফিসের ঘাম করে ক্লান্ত, ব্যাথিত
তোমার পথ বাতি ধাঁধা, কৃত্রিম
প্রত্যেকটি ইটে তুমি গেঁথেছো নুন
ভাত কি দিয়েছো!
তাই ফিরে যাব আলপথ ধরে
এখানে চাঁদ জ্বলে পাখিরা ফিরলে
ফাঁকা মাঠকে বলব চিৎকার করতে
বিপুল চক্রবর্তীর কবিতা
১.
দু'য়ে
জানালে সহাসে, উত্তরে থাক তুমি
মজা ক'রে বলি, আমি থাকি প্রশ্নে
সেইদিন থেকে দু'-জনের দুই ভূমি
গড়ায় জীবন, ঝগড়ায় দোষ নেই
জানতে চেয়েছ পরিচয় বারেবার ---
ঘরদোরে শুধু চাও পরিচয় পেতে?
পথচলা তুমি জানবে না? আরে বাঃ
দিগন্ত ছুঁয়ে দাঁড়াই যে ধান-ক্ষেতে
তুমি কি ভ্রমণে কাটাওনি দূরে রাত্রি
অন্তত, ধরো, কাছের দার্জিলিঙে
সেখানে নিজেকে ভেবেছ কি শরণার্থী
বাগবাজারের গঙ্গা-পাড়ের ফিঙে!
বহুদিন পরে, এসপ্ল্যানেডের ফুটে
দেখি বোঝাচ্ছ লোকজনে, রক্ষে নেই
জল-জঙ্গল-জমি সব নেবে লুটে ---
পুব --- পশ্চিম --- উত্তর --- দক্ষিণের...
সভা শেষে জোট বাঁধবার গান গাই
বুকের ভিতর ব্যথারা দেয় যে উঁকি
বুড়িগঙ্গার ছেলে আমি --- গঙ্গায়
তুমিও আজকে হ'লে উদ্বাস্তু কি!
মিছিল চলেছে, চলেছি দু'জন আমরা
ভিন্ন, তবুও, একে অপরকে ছুঁয়ে
অপমানিতের রৌদ্রে সেঁকেছি চামড়া ---
লক্ষ প্রাণের মিছিলে ভেসেছি দু'য়ে
২.
আমার উৎসব নেই
সব কান্না কাব্য না নিশ্চয়
তথাপি যে মেয়েটি নীরবে
পুড়ে গেছে, এঁকেছে সময়
তার ছবি তোমার উৎসবে
আজকাল কখনও কখনও
আগুনকে অযথা মনে হয়
আমার উৎসব নেই কোনও
পুড়ে যাচ্ছে আমার সময়
(উত্তর প্রদেশের হাতরাসে নির্যাতিতা কিশোরী মনীষা বাল্মিকীকে মনে রেখে)
আমাদের ছোট নদী
তন্ময় সরকার
আমাদের বাড়ির পূর্বদিকে বেশ একটা বড় নালা ছিল। শুনেছিলাম সেটা নাকি আসলে কোনও একটা হারিয়ে যাওয়া খালের অংশ । যদিও এই তত্ত্ব আমি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করতাম না । কারণ, আমার কাছে সেই ভাঙা খাল, যা কিনা আসলে একটা নালার থেকে বড় নয়, ছিল আমাদের সেই ছোট নদী যা বর্ষাকাল বাদে অন্য কোনও সময় ‘গোড়ালিজল’ না থাকলেও, আঁক এবং বাঁকের কল্পনায় শিশুমন ভিজিয়ে তোলার ক্ষমতা রাখত । বলা বাহুল্য, তা ছাড়া সেই ‘ছোট নদী’ কিংবা ‘বড় নালা’, আর প্রায় কোনও কাজেই আসত না । তার এই নিয়মিত অকর্মণ্যতার পালা অবসানে একটি পেয়ারা ডালের খুঁটি হাতে একটি শিশুর ভূমিকা বোধহয় একরকম কালের অনিবার্যতা ছিল ।
তখনও পর্যন্ত শহরতলীরা শহর হয়ে ওঠার চেষ্টায় এত মত্ত হয়ে ওঠেনি । রেলমাতৃক সভ্যতার নিয়ম মেনে, এলাকার একমাত্র বাজার, একজোড়া ক্লাব, গুটিকয়েক দোকান, পাশ করা হোমিওপ্যাথি এবং না করা এ্যালোপাথি ডাক্তারদের ডিসপেন্সরি – সবই তখন রেল স্টেশনের পাশেই থাকত । কেবল দুটি সর্ব্বজনীন এবং একটিমাত্র বাড়ির দুর্গাপুজো ছিল সবার সম্বল । তাতে যে আনন্দে ঘাটতি পড়ছে, তা বোঝার মতো বয়স তখন আমাদের মতো ছোটদের হয়নি তো বটেই, এমনকি বড়দেরও হয়েছিল বলে মনে হয়নি । পাড়ার একমাত্র টিভিওয়ালা বাড়িতে সপ্তাহান্তে একটা করে বাংলা ও হিন্দি সিনেমা পাড়া ঝেঁটিয়ে দেখা অথবা চাঁদনি রাতে লোডশেডিং-এর দৌলতে হঠাৎ পাওয়া নৈশ আড্ডা একই রকম মনোহর ছিল । কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত-এর মত আগ্রাসী ক্রিকেটারের আগ্রাসনও কেবল ব্যাটেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং বাধ্য হয়ে মাঠের মধ্যে ঘামে ভেজা টি-শার্ট বদলের সময় দর্শক উল্লসিত হয়ে উঠলেও তাঁকে যথেষ্টই কুন্ঠিত দেখাত । তখন রাতের বেলা ঘরের মধ্যে খবরের কাগজ জ্বেলে বাচ্চার দুধ গরম করা হত এবং আমাদের শাসনের দায় দায়িত্ব পালনে পাড়ার কাকু থেকে পথচলতি রিকশাওয়ালা- সকলেই সমান সাবলীলতায় কান টেনে ধরতেন । তাঁদের মধ্যে যাঁরা একটু বেশি শিশুদরদি ছিলেন, তাঁরা এক কান বেশি লাল হয়ে উঠলে অন্য কানের সাহায্যে রঙ মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন ।
শৈশবের সেই প্রবল কনফিউশনের দিনে আমরা দিব্যি বেড়ে উঠছিলাম । সাড়ে তিন পা দৌড়ানোর যায়গা পেলেই তা আমাদের খেলার মাঠ হয়ে উঠত । বারংবার কোমর থেকে পড়ে যেতে চাওয়া হাফপ্যান্ট টেনে তুলতে দেখে কোনও স্নেহময়ী একটুকরো ছেঁড়া শাড়ির পাড় দিয়ে তা বেঁধে দিলেই আমরা ডবল খুশিয়াল হয়ে আরো একবার চোর খাটতে রাজি হয়ে যেতাম । কিছুদিন পরপরই একটা করে ধাপ আসত আর আমরা বুঝতে পারতাম যে আরও একধাপ বড় হলাম । রংবাহারি প্লাস্টিকের পটি তখনও বাজারে আসেনি বা আসলেও অন্তত আমাদের চোখে পড়েনি । শুয়ে শুয়ে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে সব কিছু করার দিন মনে নেই, তবে যা মনে আছে তা হল কোনও গুরুজনের সামনে ছড়ানো দুই পায়ের নিচে পাতা পুরোনো খবরের কাগজ আর উপরে আমাদের পা ছড়িয়ে বসার ভারচুয়াল কমোড ব্যবস্থা। হঠাৎ একদিন শুনলাম যে আমার ক্রমবর্দ্ধমান ওজনের ফলে বড়দের পা ব্যাথা করছে । অতএব শুরু হল আমার আউটডোর ট্রেনিং ।
বাড়ির থেকে দূরে, ওই নালার পাশেই তৈরী হল আমার পার্সোনাল ওপেন এয়ার ল্যাট্রিন । সমান্তরাল ভাবে পাতা দুটি গোটা ইঁটের ওপর উবু হয়ে বসে প্রথমে দুটি ইঁটের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব নিরূপণ এবং তারপর যাতে ডিগবাজি (অবশ্যই ব্যাকরোল) খেয়ে নালায় গড়িয়ে না যাই, তা নিশ্চিত করতে সামনে উপযুক্ত দূরত্বে সজোরে ধরার উপযোগী একটা পেয়ারা গাছের ডাল মাটিতে শক্ত করে পুঁতে দিয়ে সমগ্র ব্যবস্থাকে সুস্থিত করে তোলা হল । দুই ইঁটের মাঝখান থেকে কোদাল দিয়ে একটা নালা কেটে দেওয়া হল যার অপর প্রান্ত গিয়ে পড়ল বড় নালায় । নতুন ব্যবস্থায় ধাতস্থ না হওয়া পর্যন্ত সাধারনত আমার বাবা অথবা বাড়ির বড়রা কেউ সামনে থাকতেন এবং কাজশেষে আর যা যা করণীয় ছিল তার দায়িত্বও তিনিই নিতেন । জলের ধারায় কর্মফলের যাত্রাপথ পর্যবেক্ষন অচিরেই আমার গুটিকতক দৈনন্দিন কাজের মধ্যে সসম্মানে যায়গা করে নিলো । কিছুদিনের মধ্যেই আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল এবং আমি সগর্বে জাহির করা শুরু করলাম যে আমি একাই পারব । বিপদ বাধল প্রথম দিনেই ।
কথা ছিল যে হয়ে গেলে বড়দের ডাকতে হবে। সেই মতো মা, বাবা, ছোটপিসি, কাকু, বড়দা, ঠাকুমা, কাজের মেয়ে নুরবানুদি সকলকেই ডেকে চললাম, কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে কারোর দেখা পাওয়া গেল না। যত সময় যেতে থাকলো ততই ভয়ে গলার জোর কমতে থাকলো । সাহস করে উঠতেও পারছি না । অগত্যা ভ্যাঁ । সেদিন উদ্ধার পাওয়ার পর মনে হল একটা ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ডাকলে সবাই শুনতে পায় । সারাদিন ধরে ভেবে একটা যুৎসই কথা এবং লাগসই সুর ঠিক করলাম । পরের দিন, যথাসময়ে গোটা পাড়ার কানে এক শিশুকণ্ঠের চিৎকার ভেসে এলো - “হয়ে গেছে পাই খানা” । সুরের বিন্যাস খুবই সহজ । ‘হয়ে’ এবং ‘পাই’ চড়ায়, ‘গেছে’ এবং ‘খানা’ আর সবকিছুর সাথে খাদে । ম্যাজিকের মতো কাজ হলো । পাড়ার সকল কোলাহল, পথচলতি মাছওয়ালার চিৎকার এমনকি গাছের কাক-শালিক-চড়াইও এই বিজাতীয় চিৎকারে চুপ মেরে গেল । আমার কর্মকাণ্ডের আর কোনও প্রচার প্রয়োজন ছিল না । জিজ্ঞাসামাত্র প্রবল উৎসাহে এই নতুন ব্যবস্থা সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাতে লাগলাম এবং ফলস্বরূপ ছিঁচকাঁদুনে শিশুকুলের চাপে এর অনুকরণে বাড়ি বাড়ি অনুরূপ ব্যবস্থা গড়ে উঠল । সেই ছিল আমার বাঁধা প্রথম গান । তবে এরপর আমার সেই ‘ছোটো নদী’-তে বৈশাখ ও অন্যান্য মাসে হাঁটু অবধি কী থাকে, তা আর কহতব্য রইল না ।
উমা মাহাতোর কবিতা
অসুখদিনের গল্পকথা...
১।
ভাঙা চৌকাঠে পাহারাদার মৃত্যু রেখে,
ফসলের খোঁজে যেতে হয়।
ধীরে ধীরে বন্ধ হবার উপক্রম হলে প্রশ্বাসের দম,কাস্তের রূপকথা নিয়ে জেগে ওঠে ধানের নাড়া।
ভাগের শস্য নিয়ে ফিরে গেছে সন্তান, অনাহারঘরে।পিতা তার আপনদেশে!
নদীকূলে ধোঁয়া ওঠে হেমন্তের ।শোক ও সান্ত্বনা, নবান্নের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে।
২।
দূরত্ব বেড়েছিল বহু আগেই
ভিতরে ভিতরে ডাল-পাতা ছড়াচ্ছিল আরোই
নইলে এত সহজে সংক্রমণের কথা বিশ্বাস করলাম কী করে!
পরস্পরের অসুখ নিয়ে মরার রূপকথাগুলোই আজ অতিমানবিক।
গ্ৰামের গড়াইত্ বলরাম
কল্পোত্তম
আকাশ পরিষ্কার। চারপাশে তারাদের ছড়াছড়ি। মাঝে মাঝে বিদুৎতের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে পশ্চিমে। এতটুকু আওয়াজ নেই। অনেক দূরে কোথাও চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। হয়তো বৃষ্টি পড়ছে। ভ্যাপসা গরমে একটু ঠান্ডা বাতাসের অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘরে গেল বলরাম। আর আসবে না। আজকের মতো বৃষ্টির আশা সাঙ্গ হল বুঝি।
রাস্তাটা চওড়া হচ্ছে। দুটো গাড়ি চলাচলের উপযোগী রাস্তাকে ভেঙে তার উপর কাঁকর দিয়ে রোলিং করছে। তারপর পাথর বসিয়ে রোলিং করে ছ ইঞ্চির ঢালাই। তার উপর দেওয়া হবে পিচ। একসঙ্গে চারটি গাড়ি চলাচলের উপযোগী করা হবে রাস্তাকে।
নির্মাণের কাজ হলেও এই পথেই গাড়ি চলছে। শয়ে শয়ে গাড়ি কতরকম মাল নিয়ে ছুটে যাচ্ছে প্রতিদিন। ওড়িশ্যা আন্ধ্রা তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব হরিয়ানা ঝাড়খন্ড, যত রাজ্যের গাড়ির যাতায়াতের মূল রাস্তা হওয়ার কারণে ছুটি নেই গাড়ির। রাতদিন অঁ আঁ, ঝং ঝড়লং, পুঁ পাঁ, চেঁ রট্ রট্, কত রকম আওয়াজ।ঝালাফালা হয়ে যায় কান। রাস্তার পাশে মোবাইলে শোনা যায় না কথা। তার উপর ধুলো। রোলিং করা শুকনো মাটির উপর ছুটে চলা এক একটা গাড়ি দেখে মনে হয় এক একটা ঘুর্ণিঝড়। সাময়িক দেখা যায় না রাস্তা। বাইক, সাইকেল, হেঁটে চলা মানুষ দাঁড়িয়ে যায় খানিকক্ষণ। খানিক হালকা হলে শুরু হয় হাঁটা।
গ্ৰীষ্মের শুরু থেকে শরতের শুরু অব্দি ভালো ছিল। বেশিরভাগ সময় জুড়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বইছিল হাওয়া। বলরামের ঘর থেকে পশ্চিমে অবস্থিত রাস্তাটার ধুলো উড়ছিল পশ্চিমেই। প্রাণভরে শ্বাস নিচ্ছিলো সে। শরতের পক্ষকালের মধ্যেই পালা বদল হাওয়ার। পশ্চিম থেকে ধেয়ে আসছে পূর্বে। রাস্তার ধুলার আস্তরণে ভরে উঠছে ঘরবাড়ি। তার জামা কাপড়, আসবাবপত্র, খাবার দাবার হয়ে উঠছে ধূসর। নাতিনাতনীদের শরীরও ধূসর হয়ে উঠছে প্রতিদিন। শ্বাস নেওয়া মুশকিল হয়ে উঠছে বলরামের।
রাস্তাটা যখন বিশ ফুট চওড়া ছিল, রাস্তা থেকে দশ ফুট দূরে বাড়ি ছিল বলরামের। মাটির পাঁচিল দেওয়া খড়ের বাড়িতে নির্ঝঞ্ঝাট বসবাস করতো অনেকগুলো ছেলে মেয়ে আর স্বামী-স্ত্রী দু'জন। দেওয়াল ঘেঁষে থাকা ছোটো ছোটো গোলাকার পাতাযুক্ত শিশুগাছটা গাড়ি ঘোড়া থেকে সুরক্ষা দিতো তাদের। এখন সেই খড়ের বাড়ি নেই। শিশুগাছ নেই। পুরোটাই কাঁকর বিছানো ধূসর পথ। রাস্তা চওড়া করার জন্য জমি বাড়ি অধিগ্রহণ করে ভেঙ্গে দিয়েছে সব। গোল পাতাযুক্ত শিশুগাছটার সাথে সাথে উপড়ে দিয়েছে বলরামের পুরনো ভিটের শিকড়।
কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়েছে সরকার। খানিকটা সরে গিয়ে পাকা দেওয়াল যুক্ত এডবেস্টারের বাড়ি বানিয়েছে বলরাম। তিন ছেলের জন্য তিনটা রুম আর নিজের জন্য একটা। গাঁয়ের লোক হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। কিন্তু সেই কাজ করার জন্য তার পিতা সুচাঁদের লাগানো আম, তেঁতুল, ডুমুর সহ বেশ কয়েকটা গাছ কাটতে হয়েছে তাকে। নিশ্চিহ্ন করতে হয়েছে পিতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিগুলো। সে সবের দাম কি দিতে পারবে সরকার ?
সম্পদ, বিষয় আশয়, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির তিনগুণ চারগুণ দাম দিতে পারে সরকার। দাবি করলে দিতে পারে অধিগ্ৰহণের কাজে ভূমিহীন হয়ে যাওয়া ব্যাক্তিকে কোথাও না কোথাও বসবাসের জমি। কিন্তু মানুষের স্মৃতি, তার আবেগের দাম কোনো কালেই দিতে পারেনি সরকার। দিতেও পারবে না কোনোদিন। বলরামের পিতা সুচাঁদের লাগানো গাছের দাম দিলেও তাদের সুশীতল ছায়ার দাম হিসেবের বাইরেই থেকে যাবে সরকারের।
বিদ্যুতের চমকানিটা অনেকটাই কাছে এলো। সামান্য হলেও শোনা যাচ্ছে মেঘের গর্জন। দিগন্তের কাছে থাকা তারাগুলো ডুবে যাচ্ছে একে একে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা মেঘের ঘনঘটা গিলে ফেলছে তাদের। বলরামের অস্বস্তির থেকে স্বস্তি-ভাবটাই চোখে পড়ছে বেশি করে। অস্বস্তির কারণ ভাঙ্গাচোরা খড়ের চাল নেই আর। একটু বৃষ্টি হলে ধুলোটা কমবে এই আশাতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে সে। বৃষ্টির জলে রাস্তাটা ভিজে এলে ধুলো উড়বে না। শিব মন্দির সংলগ্ন রাস্তার পাশেও দাঁড়াতে পারবে কিছুক্ষণ।
এই মন্দিরের সঙ্গে বলরামের সম্পর্ক ওতপ্রোত। গ্ৰামের গড়াইত্ বলরামকেই সমস্ত মিটিং বা লোক জড়ো হওয়ার ডাক দিতে হয় সারাগ্ৰামে। গ্ৰামের মোড়ল তথা মন্দিরের বংশ পরম্পরায় স্বঘোষিত মালিক তাকে নির্দেশ দিলে সারা গ্রামের লোককে ডেকে দেয় সে। তারপর লোক জড়ো হয়। আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করা হয় উদ্ভূত পরিস্থিতির। করা হয় সমাধান।
গ্ৰাম কমিটিকে বলা হয় ষোলো আনা। এ এক ব্যঞ্জনাপূর্ণ নাম। ষোলো আনা শুধুমাত্র গোটা এক টাকার মুদ্রা নয়। সেখানে এক আনা দু' আনা তিন আনা চার আনা আট আনারও অবদান থাকে। সবাইকে নিয়েই হয়ে থাকে ষোলো আনা। তেমনই গ্ৰামের ধনী গরীব উঁচু নিচু জাত বেজাত সকলকে নিয়েই ষোলো আনা। গ্ৰামে কোনো পরব পার্বণ হলে যার যেমন অবস্থা তার কাছে তেমন পরিমাণ নেওয়া হয় চাঁদা। কেউ কোনো অন্যায় বা দোষ করে থাকলেও অবস্থা দেখে নেওয়া হয় জরিমানা।
বেড়াদা গ্ৰামের মাঝখানে মন্দির। মন্দিরকে কেন্দ্র করে এক একটা পাড়া। সেই সব এক এক পাড়ায় এক এক জাতির বাস। কোথাও মাঝি, কোথাও সহিস, কোথাও মাহাত, কোথাও ভূমিজ। কোথাও কোথাও আবার একাধিক জাতির পাশাপাশি বসবাস। এই সহাবস্থানই জন্ম দিয়েছে একের প্রতি অন্যের টান, একের প্রতি অন্যের দায়িত্বশীলতা। তাই কাছের কেউ অসুবিধায় পড়লে আনচান করে ওঠে তাদের মন।
গ্ৰামে অনেক সহিস রয়েছে। কিন্তু গড়াইত্- এর দায়িত্ব যে সুচাঁদই পেয়েছে এটা তার সৌভাগ্য। ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় মানুষের সেবা করার সুযোগ পায় মানুষ, বার বার এই ভাবনা মনে আসে বলরামের। সে তার পিতা সুচাঁদের কাছ থেকে বংশপরম্পরায় পেয়েছে এই কাজ। চার ভাইয়ের মধ্যে সেই বড়। তাই, বড় ছেলের অধিকার হিসেবে তাকেই দিয়েছে দায়িত্ব। সেই দায়িত্বে এখনও সমানভাবে দায়িত্বশীল সে। কখন কি দায়িত্ব পড়ে এই আশায় বেশির ভাগ সময় মন্দির সংলগ্ন এলাকাতেই পাওয়া যায় তাকে।
এখন ধুলোর ভয়ে সেদিকে এগোতে চায় না পা। নিজের অতীত আঙিনায় দাঁড়িয়ে মন্দিরের চূড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে বলরাম।
আজ সেদিকেই বিদ্যুৎ-এর ঝলকানি দেখে আশা জেগেছে মনে। বৃষ্টি পড়বে, বন্ধ হবে ধুলো ওড়া। হয়তো মন্দিরের দিকে যেতে পারবে সে।
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
আয়োজক : অনিকেতের বন্ধুরা
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার-৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল-uttamklp@gmail.com
অসাধারণ সংখ্যা, আফশোস , যদি কালি কাগজে ছাপা অবস্থায় সংগ্রহে রাখা যেত📖📖
উত্তরমুছুনজেনে ভালো লাগলো। ভালো থাকুন।
মুছুনতন্ময় সরকারের লেখা "আমাদের ছোট নদী" পড়ে আমাদের ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল। এবং কল্পোত্তম-এর লেখা "গ্ৰামের গড়াইত্ বলরাম" পড়ে ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনআপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। ভালো থাকুন।
মুছুনদুর্গাবাবুর লেখাটি অনবদ্য। উত্তমদা তোমার লেখাটিও খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনবিপুল বাবুর 'আমার উৎসব নেই' ছুঁয়ে গেল।
সবমিলিয়ে খুব ভালো হচ্ছে।
ভালোবাসা জানাই। ভালো থেকো।
মুছুনদারুন সংখ্যা।। ভালো লাগছে খুবই লেখাগুলো পড়ে।। তন্ময়দার লেখা "আমাদের ছোটো নদী" অসাধারণ।।
উত্তরমুছুনখুব ভালো সংকলন হয়েছে উত্তমদা।
উত্তরমুছুনভালো উদ্যোগ।