প্রথম বর্ষ ।। পঞ্চম ওয়েব সংস্করণ ।। পুজো সংখ্যা ।। ২৭ আশ্বিন ১৪২৭
পূজা বা উৎসব মানেই শুধু হৈ-হুল্লোড় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের অনেক দুঃখ দুর্দশা এবং তাদের বহুকালের ইতিহাস। তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। পূজার মাধ্যমেও অনেক মানুষ তার ইতিহাস তৈরি করতে চায়। অনেকেই চায় এসবের মধ্যেই খুঁজে নিতে বংশপরম্পরায় ফেলে আসা ইতিহাস। আর কেউ কেউ এই পূজা-পার্বণের মধ্যেই খুঁজে নিতে চায় দু'মুঠো অন্নের সংস্থান।
কেউ টাকা উড়িয়ে দেয়, কেউ টাকা কুড়িয়ে নেয়। কেউ টাকার বদলে নেয় খেলনা, কেউ খেলনার বদলে টাকা। দেবও জানে না কার কি দরকার পৃথিবীতে।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
নতুন বাসা
তন্ময় সরকার
একটা বাড়িকে বসবাসযোগ্য করে তোলার মধ্যে একটা নিবিড় আনন্দ আছে । যখনই বাসা পরিবর্তন করে নতুন কোথাও যাই, নতুন ঘরের দেওয়ালে মেঝেতে ছাদে তাকাই । বুঝে নিতে চেষ্টা করি কার কতটা আদর প্রয়োজন । জানালার পর্দা, মেঝের পাপোশ, বালতি মগ, শীল-নোড়া - সবাই প্যাকিং বাক্স বা বস্তা থেকে বেরোনোর জন্য হাঁকুপাঁকু শুরু করে । কে কত দ্রুত তার জায়গায় গিয়ে বসবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় । নতুন বাসা সেসব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে । খাট কোথায় পাতা হবে আর আলমারী কোথায় ঢুকবে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণের মাঝে হাতে চলে আসে চায়ের কাপ । হেঁশেল চালু করে দিতে পারলে বাকি সব গোছগাছের কাজে জোর চলে আসে । একসাথে চলে ফ্যান লাগানো, পাইপ সারানো আর নতুন কাজের মাসীর খোঁজ । ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি - পুরোনো বাসার জিনিসপত্রের নতুন বিন্যাস । দরজা-জানালার পর্দার হিসেব বড় গোলমেলে । কখনও সংখ্যায় কম হয় তো কখনও বেশী । বেশীতে অসুবিধে নেই, অতিরিক্তরা বক্স খাটের পেটের ভিতর বসে পরের বাসার জন্য দিন গোনে নিশ্চুপে । কম হলেই বিপদ - নতুন কিনে আনলেও, পুরোনোদের সাথে তাদের রং মেলেনা কিছুতেই । তবে তাদের সহাবস্থান কখনও কখনও সুখেরও হয় - সে খুবই কম ।
হেঁশেল চললে কাজে তেজ আসে । রান্নাঘরে চুল্লী জ্বললেই গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলে সব । নতুন বাসা আনমনে সেসব দেখে আর ভাবে ক'দিন আগের কথা । এইখানেই ছিলো অন্য মানুষজন । তারা কথা বলতো অন্য ভাষায়, খাদ্যাভ্যাসও ছিলো আলাদা । অথবা তারও আগে যারা ছিলো - সবারই রকমসকম আলাদা । সবাই নিজের মতন করেই গুছিয়ে নেয় । দেওয়ালের রং পাল্টায় । জানালায় বসে মশা আটকানোর জাল । জালের বাইরে আটকে পড়ে মশা, আর ভিতরে আটকে পড়ে একটা সাত বছরের মেয়ে । চিৎকার করে সে বাইরে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া ফেরিওয়ালাদের ডাকে । জালে নাক ঠেকিয়ে ফুলের গন্ধ খোঁজে বাতাসে । নতুন বাসা চুপচাপ দেখে । কাঠের জাফরী দেওয়া পার্টিশান কদিন আগেই ম্যাটাডোরে চেপে চলে গেছে পশ্চিমে । আজ সকালে তার জায়গা নিয়েছে বাহারী কার্পেট । তারই উপর, ঘরের এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে ছেঁড়া প্যাকিং বাক্সের টুকরো, পুরোনো খবরের কাগজের একরাশ পাকানো দলা, বাবলপেপারের ফালি । এসব আর কাজে লাগবে না কোনো । নতুন কাজের মাসী ঝাঁটা খুঁজে পেয়ে গেছেন । প্রথমদিন কাজের উৎসাহ তাঁর অন্যরকম । ধীরে ধীরে তা কমে আসবে - নতুন বাসা তা জানে ; অনেক দেখেছে এসব । রান্নাঘরে প্রেশার কুকারের সিটি পড়ে ট্রেনের হুইসেলের মতন । জানান দিতে চায় যে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় শেষ । লোকজন ওঠা নামা অনেক হোলো । আবার ছুটতে হবে - তৈরী হও । রান্নাঘরের মেঝেতে সদ্য খোলা বাসনের বস্তা থেকে বাকি বাসন উৎসুক মুখে দেওয়ালে স্টিলের র্যাক লাগানো দেখে । গ্যাসের ওভেনে বসানো কড়াইতে গরম তেলে শুকনো লঙ্কা আর পাঁচফোড়নের মধ্যে চিরগন্ডগোল এখানেও শুরু হয়ে গেছে । সিদ্ধ করা মুসুর ডাল এসে ওদের ঝামেলা থামাবে । সম্বাতের গন্ধ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পরের পর ঘর পেরোতে থাকে । কাজে গতি আসে আরো । আলমারী আর এবেলায় গোছানো হবে না । দুপুরে খেয়েদেয়ে একটু গড়িয়ে নিতেই হবে । সন্ধ্যেবেলার জন্য আলমারীর পায়ের কাছে পড়ে থাকে কাপড়ের ব্যাগ ।
আমিও এসব দেখতে দেখতে সিগারেট ফুঁকি, এর ওর প্রশ্নের জবাব দিই, একাজে ওকাজে হাত লাগাই । আসলে কিছুই করি না তেমন । কাজ করার ভান করি, কাজ করি না । নতুন বাসার সাথে সন্ধি-প্রস্তাবটা কী দিয়ে শুরু করলে ঠিক লাগসই হবে সেটাই ভাবি । আর মনে মনে ঠিক করার চেষ্টা করি কাঁদতে ইচ্ছে হলে কোথায় গিয়ে লুকাবো, নাচতে ইচ্ছে হলে কোথায় সেটা করলে গুঁতোগাতা খাওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে কম, বসে আড্ডা মারার জন্য কোন জায়গাটা সঠিক - এইসব । কাজ শেষ করে একে একে সবাই চলে যায় । সবার প্রাপ্য মিটিয়ে দিতে দিতেই রান্নাঘর থেকে আদা-রসুন-জিরেবাটা কষানোর মসৃন গন্ধ এসে নাকে ঢোকে । ছাদের দিকে তাকাই । দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি । দ্বিতীয় কড়াইটাও বেরিয়ে পড়েছে ও জানে ? এখনই সেটায় গরম তেলে ছাড়া হবে ডিমসিদ্ধ - জানে ও ? আমি বহুকাল হোলো এসব বুঝি । নতুন বাসায় হেঁসেল চালু করে দেওয়াটাই প্রথম কাজ । ওটা হলেই বাকি সব কাজ গড়গড়িয়ে হবে । খুঁজে পেতে গামছা নিয়ে স্নানে ঢুকি । সাবান-শ্যাম্পুর প্যাকেটটা যে কোথায় গেলো !
মাথায় জল পড়তেই একটা কথা মাথায় এলো । দেশও বোধহয় এখন নতুন বাসার মতন । নতুন করে সব করতে হবে । মানে, পুরোনো জিনিসই নতুন করে সব লাগাতে হবে - এটাই বলতে চাইছি । কেবল একটাই কথা - হেঁশেল চালু রাখতে হবে । সবার ঘরে উনুন যেন জ্বলে । তাহলেই কাজে তেজ আসবে । সব কিছু ঠিক গড়গড়িয়ে চলতে শুরু করবে । ল্যাজের আগুন সোনার লঙ্কা ছারখার করে আর কী কী পোড়াবে তা আমি জানি না । প্রমিথিউস-এর চুরি করা আগুনের মর্মও আমি বুঝি না । আমি শুধু জানি, সবার হেঁশেলে আগুন জ্বললে কাজে তেজ আসে । উনুনের আগুনের থেকে পুণ্যতর আর কিছু নেই ।
উপহার নয় শুভেচ্ছা বলো
নির্মল হালদার
আমাকে কি দেবে?
----কিছুই না
---বাহ বাহ------
----আমাকে কি দেবে?
----কিচ্ছু না
-----চমৎকার চমৎকার
----আমাকে কী দিতে চাও?
----কোনো কিছুই না
---আহা
----আমাকে কী দিতে চাও?
----না কিছু না
---দারুন দারুন
এই যে তোমাদের "না" কি অসম্ভব সুন্দর, আমি দেখতে চাইছিলাম। না দেখলে,"না" য়ের মর্ম কি করে বুঝবো। এই কারণেই, না --কে চাই মাঝে মধ্যে। কেন না ,"না" হলো সেই শব্দ যার ভিতর হ্যাঁ আছে।
না করেছে বলেই হ্যাঁ করবে একদিন। হ্যাঁ করবেই। আজ হাতের চুড়ি বেজে উঠলো না। কাল বাজবেই। যেমন আজ মেঘ ডাকলো না একবারও। অথচ বৃষ্টি হলো ঝমঝমিয়ে।
আমি একবার একটা বড় পাথরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ শুনি সে বলছে, কী চাইছো তুমি কি? আমি খুব অবাক হয়ে আরেকবার জানতে চাই, কী বলছো তুমি আরেকবার বলো?
পাথর বললো, আমার ভিতর অনেক অনেক কিছু আছে, দেখতে পাবে না কোনোদিন। সারা জীবন ধরে এত এত কিছু পেয়েছি বলেই, আমি আজ পাথর।
ভাই, পাথর হতে যেও না। যা পাবে যা নিতে পারবে দিয়েও দেবে দু হাতে।
আমি কী পাই? কিছু কী পাই কারোর কাছে?
নদীর সঙ্গে দেখা। আমি হাত পাততেই আমাকে বলে, দেবো সব দেবো। আমার মত বইতে হবে। এক দন্ড থামলে চলবে না। আমি যেমন পাই তেমনি দু'পারে দিতে দিতে যাই। মনে রেখো, এক দন্ড থামলে চলবে না।
আমি নেমে গেলাম নদীতে। আমি নিজেকে বিলিয়ে দিলাম জলে। নদীর পাথরে ধাক্কা খেয়ে আমার কপাল গেল ফেটে। আমি নদীর চরে উঠে দাঁড়ালাম।
দু'পারে অসংখ্য মানুষ ফসলের জমিতে দাঁড়িয়ে আমাকে বলছে, উঠে এসো। তুমি এইবার ফসল ফলাবে।
তোমাকেও দিতে হবে। ধান যব গম ডাল ভুট্টা তোমাকেও দিতে হবে। আমরা জানি, তোমার ভেতরে সমস্ত "হ্যাঁ" জড়ো হয়ে আছে। তুমি সবাইকে "হ্যাঁ" দেখালেই আর কোনো কষ্ট নেই কোথাও।
চিত্রশিল্পী : দেবাশিস সাহা
ঐ তো যোগেশ্বরের বউ চাল ধুচ্ছে। ঐ তো জ্বলছে উনুন। ভাতের হাঁড়িতে লাগছে কালি।
হাঁড়ির কালি মাটির কাজল।
জলছবি
তনুশ্রী চন্দ্র
স্বপ্নটা যেন চেপে বসছে ত্রয়ীর মনে। হঠাৎ কেন এমন স্বপ্ন দেখলো সে? কত দিনের বিচ্ছেদে ভুলেই গেছিল যে নামটা, যে মুখটা শান্ত সমুদ্রের মতো তাকে হাতছানি দিয়েছে বারবার, যে মুখটাকে ভালো না বেসে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। সে মুখটা স্বপ্নের আবছা আলোয় ভাল করে না দেখা গেলেও ত্রয়ীর অন্তরের চিনচিনে ব্যাথা বলে দেয় ওটা প্রত্যয়ের মুখ। প্রত্যয়ের প্রতিটি অঙ্গ ভঙ্গিমা দিনের আলোর মতো তার কাছে স্বচ্ছ, যা কেবল ত্রয়ীর ভলোবাসার মাপকাঠিতেই মাপা যায়। ওর গলার স্বর, পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার মাদকতা ওকে বারবার টেনেছে। প্রত্যয়, নামের মধ্যেই কোথায় যেন আকর্ষণ খুঁজে পেয়েছে ত্রয়ী। যাকে কোনোদিন কাছে না পেয়েও শুধু দূরত্বের গভীরে ভালোবেসেছে সে।
মনে হয় এই তো সেদিন কলেজের ফেস্ট-এ এক বছরের সিনিয়র প্রত্যয় নিজের আঙুল কেটে তার কপালে তিলক এঁকে দিয়ে নবীন সহপাঠিনীকে বরণ করে নিয়েছিল এক মায়াবী দৃষ্টি মেশানো জাদু দিয়ে । ঘোর অনিচ্ছা স্বত্বেও বন্ধু তানির পীড়াপীড়িতে তিনদিনের জ্বর মাথায় করে ক্লাসরুমের তিন নম্বর বেঞ্চে বসে সাদামাটা প্রত্যয়কে আপাদমস্তক অনুধাবন করছিল ত্রয়ী । সেদিন প্রত্যয়ের শীতল আঙুলের স্পর্শে কেঁপে উঠেছিল তার ঠোঁট। ত্রয়ী সেদিনই বুঝেছিল এতোদিন যার স্পর্শ অনুভবে তাকে ছুঁয়েছে , কথা বলেছে ঘণ্টার পর ঘন্টা, এ স্পর্শ তারই। যেন যুগ যুগ ধরে স্থির শান্ত নদীর মতো বয়ে চলেছে কোনো এক অজানা চরে গিয়ে মিশবে বলে । ত্রয়ীর মনে বারবার প্রশ্ন জেগেছে , প্রত্যয়ও কি তাকে নিয়ে একই অনুভব করে ? পরবর্তী দু'বছরে বহুবার কলেজে তারা মুখোমুখি হয়েছে , প্রত্যয় সাদামাটা দু' চার কথা ছাড়া কোনো ভালবাসার সংকেত তাকে দেয়নি । অদ্ভুত জেদি ত্রয়ী , অহল্যর মতো স্থির থেকে শুধু অপেক্ষা করে গেছে তার রামচন্দ্রের ঘুম ভাঙার আকাঙ্ক্ষায় । না ! অহল্যার আশায় জল ঢেলে দিয়ে ঘুম ভাঙেনি রামচন্দ্রের । ত্রয়ীর তপস্যা বিফল করে প্রত্যয় তার সাধাসিধের আবরণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
যেদিন প্রত্যয়ের ফেয়ার-অয়েল দেওয়া হল ত্রয়ী সেকেন্ড ইয়ার । ঠিক তার আগের দিন রাত্রে কাঁপুনি দিয়ে ত্রয়ীর জ্বর এলো । সিনিয়র দাদা দিদিদের ফেয়ার-অয়েলের দায়িত্ব এবার তাদের কাঁধে । ফুলের তোড়া চন্দনের ফোঁটা , করমর্দনে শেষ বিদায় । জ্বরের চোটে ভালো করে দাঁড়াতে পারছে না ত্রয়ী , তবু প্রত্যয়কে শেষ বিদায় জানাতে তাকে যে থাকতেই হবে । বিশাল পাহাড়ের মতো তখনও ত্রয়ী অচঞ্চল, স্থির, শেষ পর্দার অপেক্ষায় । তখনও বুকে ক্ষীণ আশা , অন্ধকার মুছে দিয়ে হয়তো খুশির ঝলকানিতে ভরে যাবে তার জীবন । হয়তো শেষ বিদায়ের সাথে ত্রয়ীর জীবনে নেমে আসবে হঠাৎ খুশির বাঁধ । হয়তো এতোদিন যে আগ্নেয়গিরি চাপা ছিল গভীর পাথরে তা তুমুল অগ্নূতপাত ঘটিয়ে বলে উঠবে -এই তো আছি ।
কাঁপা হাতে প্রত্যয়কে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দেয় ত্রয়ী , করমর্দনের জন্যে হাত বাড়ায় । প্রত্যয় হাসি মুখে দু'হাত দিয়ে তার হাতটা চেপে ধরে । ত্রয়ী দেখে আজও প্রত্যয়ের হাত সেদিনের মতোই হিমশীতল । ত্রয়ীর শরীরে এতদিনের জমানো ক্ষোভ বাষ্পীভূত হয়ে বেরিয়ে আসতে চায় । তারপর কিচ্ছু মনে নেই ত্রয়ীর । দু'দিন তার জ্ঞান ফেরেনি ।
তার শরীরের উত্তাপ , তিন বছরের তিলে তিলে দগ্ধ হৃদয়ের অনুভূতি কি প্রত্যয়ের হৃদয়ে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি ? নাকি লাজুক চেহারার খোলোশ ছেড়ে সে বেরিয়ে আসতে পারেনি? ত্রয়ী জানে না । নিজেকে সস্তার মেকি ভালবাসার বাজারে বেচতে পারেনি কোনোদিন , তাই হয়তো ফলাও করে প্রত্যয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের সামগ্রী হওয়া থেকে দূরে থেকে নীরবে ভালবেসে গেছে । শুধু ছলছল চোখে সেদিন দেখেছিল প্রত্যয়কে আসতে আসতে বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যেতে । প্রত্যয় তার জীবনে শুধু একটা নাম , একটা স্মৃতির মোড়কে ভরা সময় হয়েই থেকে গেছে ।
বিস্মৃতির অতল গভীরে যে নাম দাবিয়ে রেখেছিল দশ বছর তা হঠাৎ ভোরের স্বপ্নের আবরণে তাকে আবার নাড়া দিয়ে বলে গেল -ভুলতে চায়লেই সবকিছু ভোলা যায় না । সেই মুখ নতুন করে তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে । তার একাকীত্ব জীবনে সে আজ রাতের অপেক্ষায় , সে চায় দিন সমাপন হোক রাতের তারারা সাক্ষী থাকুক তার হৃদয় কোণের ছোট্ট দরজায় একটাই নাম - প্রত্যয় । তাকে নিয়ে সেই স্বপ্ন বারবার ফিরে আসুক তার জীবনে , যা তার গোপন কুঠুরিতে এতোদিন বন্দি ছিল , আজ তা খোলা আকাশে নতুন করে শ্বাস নিক । সেখানে সে নির্দিধায় অবগাহন করতে পারে । চিৎকার করে বলতে পারে - যেখানেই থেকো ভালো থেকো ।
ছোটো উরমার পরব
কল্পোত্তম
ছোটবেলায় দুর্গাপূজা বলতে একটাই পূজার কথা মনে পড়ে, ছোটো উরমার দুর্গাপূজা। সেই পূজার জন্য বছরভর অপেক্ষায় থাকতাম আমরা। শুধু আমরা না, ছোটো উরমাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত গ্রামগুলি রয়েছে সেই সমস্ত গ্রামের মানুষজন অপেক্ষা করে থাকতেন এই পূজার।
ছোটো উরমার দুর্গাপূজা একটা আলাদা মাত্রা যোগ করে স্থানীয় মানুষদের জীবনে।
এখান থেকে অযোধ্যা পাহাড় খুব একটা দূরে নয়। মেলা প্রাঙ্গণ থেকে পাঁচ ছ কিমি দূরেই পাহাড়ের শুরু। খানিকটা ওঠার পর উশুল ডুংরির সান রাইজ পয়েন্ট। সূর্যোদয় দেখার জন্য টাওয়ারও রয়েছে সেখানে। মনোরম সূর্যোদয়ের পর পাকা রাস্তা দিয়ে অনায়াসে চলে যাওয়া যায় অযোধ্যা হিলটপ।
টাটা ধানবাদ যোগাযোগকারী বত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথ এই মেলার গুরুত্ব বাড়িয়েছে অনেক। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলেও এলাকার সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নত হয়নি খুব একটা। এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা রয়ে গেছে যে তিমিরের সেই তিমিরেই। তাই স্থানীয় বহু মানুষের কাছে এই মেলা এনে দেয় বেশ কিছু চকচকে গোল চাকতি, কয়েকদিনের পেটের মাড়।
অষ্টমীর দিন মহাপূজা। সেদিন ভিড় খুব একটা হয় না। উপোসিরা এসে ধূপ দীপ জ্বেলে প্রসাদ চড়িয়ে চলে যান। পরের দিন নবমী, সেদিন কাড়াকাটা, অর্থাৎ মহিষ বলি দেওয়ার দিন। দুপুর থেকে কাড়াকাটা দেখার জন্য জড়ো হতে থাকেন মানুষজন।মানতকারীরাও নিজেদের কাড়া নিয়ে উপস্থিত হতে থাকেন সেখানে। বেলা যখন ফুরিয়ে আসার অপেক্ষা,পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্তে অযোধ্যা পাহাড়ের গায়ে ঢলে পড়তে যাচ্ছে সূর্য। সারা আকাশ লাল হয়ে উঠছে, তখন শুরু হয় কাড়াকাটা। ঢাকের তালে তালে খড়্গ হাতে এগিয়ে আসেন পূজারী। গিজগিজ করা ভিড়ের মাঝে বলি হয় এক একটা প্রাণ। তারপর উপস্থিত সকলেই রক্তের তিলক নিয়ে প্রণাম করেন দুর্গাকে। বাচ্চারা কেউ বেলুন কেউ ঝিনঝিনি কেউ ঘোরাফুল নিয়ে ঘরে ফেরে।
পরের দিন বিজয়া দশমী। মূর্তি বিসর্জনের দিন। অর্থাৎ দুর্গাকে বিদায় জানানোর দিন। সেদিন সকাল থেকে আশপাশের দোকানদরা কেউ সাইকেলে কেউ গরুর গাড়িতে করে নিজেদের জিনিস পত্র নিয়ে এসে পশরা সাজিয়ে বসেন। ছোটো উরমা রেল ষ্টেশনের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে সুবিস্তৃত মাঠজুড়ে ধান ক্ষেতের ধারে ধারে বসে পড়েন তাঁরা। অপেক্ষায় থাকেন ক্রেতাদের।
দূরে অযোধ্যা পাহাড়ের অসংখ্য নীলচে চূড়ারা উঁকি মারে দিগন্ত থেকে। কাছে সবুজ ধান ক্ষেতের আলে আলে সফেদ কাশফুলের দোলন। আর চারপাশের বাইদ বহালের মাঝ দিয়ে সরু সরু আলের উপর দিয়ে হাঁটা পথ। পথে পথে রঙিন পোশাকে আবালবৃদ্ধবনিতার ছুটে আসার ছবি। এই মিলন মেলায় কয়েকটা গ্ৰাম নয়, কয়েকটা অঞ্চলের মানুষ মিলেমিশে এক হয়ে যান।
কত মানুষ কত মন কত মনের মিলন। কত অপরিপূর্ণ প্রেমের পরিপূর্ণতা লাভ। স্মৃতির গভীরে হারিয়ে যাওয়া কত পুরাতন মনের পুনর্নবীকরণ। চোখাচোখি হয়েই কাঁটা দিয়ে ওঠা সমস্ত শরীরের।
যে রেল ফটক দিয়ে গাড়ি ঘোড়া পার হয় সেই রেল ফটক অনেকটা দূরে। সেখান দিয়ে প্রতিমা পার করতে গেলে ব্যাঘাত ঘটে মেলার। তাই রেল লাইনের উপর দিয়েই পার করা হয় দুর্গা প্রতিমা। দুর্ঘটনা এড়াতে ষ্টেশন মাষ্টার কাঁটাডি আর বরাভূম ষ্টেশনে ফোন করে সাময়িক বন্ধ করে দেন রেলগাড়ির আসা-যাওয়া।
মেলা প্রাঙ্গণ জনারণ্য হয়ে উঠলে শেষ বিকেলে প্রতিমা বার করা হয় মন্দির থেকে। গরুর গাড়িতে চড়িয়ে মানুষে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় মেলার দিকে। দর্শনার্থীদের দূর্বার্পণ চলতে থাকে প্রতিমা লক্ষ্য করে। চলতে থাকে দুর্গা প্রতিমার চরণে সিঁদুর অর্পণ, ভক্তিভরে প্রণাম।
চারপাশে দোকান, মানুষের ভিড়, ঝিনঝিনি ওয়ালা বাঁশি ওয়ালা হাওয়াই লাড্ডু ওয়ালা বেলুন ওয়ালার ভিড়। মাঝ দিয়ে গরুর গাড়ি চেপে প্রতিমার এগিয়ে যাওয়া। মেলা প্রাঙ্গণ থেকে মানুষের চিৎকার হারিয়ে যায় ধানখেতে।
একটু এগিয়ে গেলে শোনা যায় খালি গলায় ঝুমুরের সুর, টুসু গানের সুর। হাতে এক গোছা নতুন প্রকাশিত স্বরচিত বই নিয়ে ধানখেতের আলে দাঁড়িয়ে বিক্রি করছেন গীতিকার।
এঁরা শুধু গীতিকার নয় সুরকারও। নিজের লেখা গানে নিজেই সুর বসান, নিজেই গেয়ে শুনিয়ে বিক্রি করেন মেলায় মেলায়। এই মেলায় হল তাঁদের বই প্রকাশের জায়গা। সারা বছর ধরে গান লেখার পর বই ছাপিয়ে প্রকাশের জন্য অপেক্ষায় থাকেন এই মেলার। মেলায় আসা মানুষজনও জানেন কোন্ খেতের আলে পাওয়া যায় নতুন প্রকাশিত টুসু-ঝুমুরের বই।
আরও খানিকটা এগিয়ে জুয়া খেলার আড্ডা, নাচনি নাচ তারপর শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া মেলার। সেখান থেকে আবার ফিরে আসা ষ্টেশনের দিকে।দেখে দেখে আসা গত বছর কুমারী দেখে আসা কত মেয়ের রূপের মূর্ছনা খুলে গেছে সিঁদুরের ছোঁয়ায়। কত মেয়ের কোলে উঠে এসেছে দুধের পোকা শিশু।
সূর্য ডোবে, ঘরে ফেরে মানুষ। সাঁওতাল মুন্ডাদের মেলায় আসা শুরু হয় সেই সময়। তাদের অলচিকি ভাষায় রাতভর ডার্মা চলে। চলে দেশী মদ, হাঁড়িয়া। চলে জিল ভাজা। চলে প্রেম নিবেদন। তখন অন্য সাধারণ মানুষরা পাত্তা পান না। তবে হুবহু তাঁদের ভাষা তাঁদের মতো করে বলতে পারলে আলাদা কথা।
তাঁদের এই মেলা পরের দিন বিকেল পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। দেশী মদ, হাঁড়িয়ার নেশা কাটলে টলতে টলতে ঘরে ফেরেন তাঁরা। শুরু হয় আরও এক বছরের অপেক্ষা।
হৈমন্তিক
স্বপন চক্রবর্ত্তী
বাতাসে টান লেগেছে।
হ্যাঁ, হৈমন্তিক আভাস।
যা জীবনকে পূর্বস্মৃতির দিকে নিয়ে যায়।
যা কিছু ফেলে এসেছি-- তাদের দিকে ফিরে দ্যাখা।
আমি কাঁদছি, কাঁদছে সে-ও।
দুই-এর আকুতিতে এই পূর্ণতা।
বিরহের।
ফিরে পাবার আকাঙ্ক্ষা।
অথচ ধরা যায় না। ছায়া-ছায়া। ওই হিম-হিম হৈমন্তিক স্পর্শেরই মতো।
অথবা ওই যে আকাশে অনেক ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে স্তূপ মেঘের ইশারা।
তারাও জানাচ্ছে একই বার্তা।
মেঘদূতের ঋতুতে যক্ষ মেঘকে বার্তাবাহক করে পাঠিয়েছিল প্রেমিকার দিকে।
আজ উল্টোরথ।
ওই দিক থেকে মেঘ আজ বার্তা নিয়ে এসেছে বিরহীর কাছে।
ভাবতে ভালো লাগছে।
"ভালো লাগছে" মানে "দুঃখ"।
"ভালো লাগছে " মানে "মনখারাপ"।
" ভালো লাগছে" মানে ওই যে হাহাকার জাগছে অন্তরে-- সেটা। সেই দুঃখ আস্বাদন।
নতুন পর্বে নতুন ভাবে জীবনকে দ্যাখা, চেনা।
তাই না?
আমি পথে বেরিয়ে পড়েছি। মনে মনে।
মনে মনে অন্বেষণ।
বাহিরের আলো-আকাশে, সোনালি রোদ্দুরে...
ঝোপের অন্তরালে পাখির ডাক।
পতঙ্গের ওড়াওড়ি।
আর, চারপাশ ঘিরে যে ছমছমে মন্থর স্তব্ধতা-- সে তো আছেই ! তার অন্তরে কি কম ঐশ্বর্য !
গার্গী মুখার্জির কবিতা
১.
শারদীয়া
পূজা এলে বড় ভয় করে আমার..
জানি ভার মুক্ত হবে আকাশ
কিন্তু মেঘ ভিড় করে আসবে আমার
মনের আকাশে
খোকনের মাকে হয়তো তার পছন্দের শাড়িটি দিতে পারবনা..অভিমান করে থাকবে..
কাজ থেকে ফিরে প্রিয় হাসিমুখ টি আর দেখতে পাবোনা..
ইচ্ছে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো শাড়িটি তাকে উপহার দিই..
সাধ্য নেই সাধ আছে..একথা অভিমানিনী কে বোঝানো যাবে না..
খোকনের হয়ত জামা হবে..জুতো হবে না
প্রতিদিন এক বার আমার খালি হাতের দিকে তাকিয়ে ছল ছল চোখ ফিরিয়ে নেবে..
মা আসছেন আনন্দময়ী হয়ে..
আমার মায়ের একটা ছোট্ট ইচ্ছের কথা শুনেছিলাম..
পাবো কি আমার ঘরের জীবন্ত প্রতিমার মুখে সেই ইচ্ছা পূরনের হাসি টুকু দেখতে!
ঋণী আমি যাদের কাছে..তাদের বলতাম পুজো এলে শোধ করব..
পুজা এসে গেল তাই একথা আর বলা যাবেনা..
তাই পুজা এলেই বড়ো ভয় হয় আমার.
নীল আকাশ যখন ভার মুক্ত হয়ে হাসবে..
তখন আমার প্রিয় মুখ গুলির বিষাদের ছায়া আমাকে নিরানন্দ করে তুলবে।
২.
কন্যা দিবসে
কন্যাগুলি ভাল থাক
ভাল থাক জন্মের আগে বা জন্মের পরে।
ভাল থাকুক রাতের রাজপথে বা অন্ধকার ঘরেও।
কন্যা বলেই নারী শরীর আছে তাই বিক্রি হয়ে না যেন হারায় অতল অন্ধকার এক লোভের গহ্বরে। কন্যাগুলি ভাল থাকুক রাত থেকে ভোর।
হাতে যেন বই থাকে খাদ্য থাকে, না থাকে জীবন বয়ে নিয়ে যাওয়ার ভার।
ভাল থাকুক কন্যাগুলি আমার।
আমার দুর্গাপূজো
সন্দীপ মুখোপাধ্যায়
১.
সেই শৈশব থেকে কত স্মৃতি যে মনের মধ্যে জমে আছে যা ভাবলে আজও ভীষণ আনন্দ হয় । ছোট্টবেলার আমাদের গ্রামের পারিবারিক
দুর্গাপূজো - রঘুনাথপুর থানার বিলতোড়া গ্রাম । মতিরামপুকুরের ধার বেয়ে গ্রামের রাস্তা বেয়ে সেই মেঠো গন্ধ আজও অম্লান ।
প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো আমাদের মুখোপাধ্যায় পরিবারের এই সাবেকি পারিবারিক দুর্গাপূজো। বহু যুগ আগে ভক্ত -সাধক ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় হুগলি জেলার বঁইচি থেকে কোন সূত্রে মানভূমের বিলতোড়াতে এসেছিলেন ।বঁইচিতে পারিবারিক পূজোর সূত্র ধরে বিলতোড়াতেও এই দুর্গাপূজো প্রতিষ্ঠিত হয়।বাড়ির লোকজনই পুরোহিত পূজারী। প্রথমে মাটির মন্দির ছিল শুনেছি, পরে উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মন্দিরকে পাকা করে দেন । তালপাতায় লেখা পুঁথি ছিল আগে, পরে অমূল্যরতন মুখোপাধ্যায় সে সব পুঁথি নতুন করে লিখে সযত্নে রাখেন, যা আজও সংরক্ষিত।ঐ পুঁথি মেনেই সাবেকি রীতিতে পূজো হয়ে থাকে ।
সেই ছেলেবেলার দিনগুলি কোথায় যেন হারিয়ে গেলো! সময়ের স্রোতে আমিও এখন রঘুনাথপুর শহরের বাসিন্দা । জয়চন্ডী পাহাড়ের কোলে ছোট্ট শহর রঘুনাথপুর । বাড়ির ছাদে উঠে সেই চেনা পরিচিত পাহাড়টিকে আমি প্রতিদিন একবার দেখি, আর ভাবি অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে যেন আমায় হাতছানি দিচ্ছে ! পূজোর গন্ধে এই চেনা শহরটিও আমার কাছে অচেনা হয়ে ওঠে । নতুন সাজে সেজে গরবিনী আমায় চিনেও চেনে না ।
২.
রঘুনাথপুর বাজার পূজোর গন্ধে যখন ম-ম করে তখন আমাদের মনেও চলে সেই আনন্দের রেশ । এবার কি সেই আনন্দ পাবো আমরা! পুরোনো বাজারের সেই সাবেকি দুর্গাপূজোর আনন্দ আজও মনে পড়ে ।পুরাতন বাজার সর্বজনীন রঘুনাথপুর ষোলআনা দুর্গাপূজা । আদি প্রতিষ্ঠাতা কাশীপুর মহারাজার ভাটরা । মন্দির নির্মাণ করেন এখানকার গন্ধবণিক সম্প্রদায় । মহানন্দ মুদি মূল উদ্যোক্তা । বর্তমানে তাঁর ছেলে নাতি এঁরাই রক্ষণাবেক্ষণ করেন । আনন্দের খবর -এই মন্দিরে ছাগবলি উঠে গেছে ।
রঘুনাথপুর শহর হলেও আমার কাছে মনে হয় একটি বড় গ্রাম । গ্রামীণ পরিবেশ আমায় টানে ।আমি তো গ্রামেরই ছেলে ।পূজো এলেই মনে পড়ে যায় গ্রামের অনাদি দাদুর তৈরি গুড়ের নাড়ু । সেই নাড়ুর গন্ধে মন যখন ম-ম করে ওঠে, তখন রঘুনাথপুর তাঁতিপাড়ার মিষ্টির দোকানে বসে গুড়ের নাড়ু খেয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়। রঘুনাথপুর তাঁতিপাড়ার ষোলআনা দুর্গাপূজা, ধোবাপাড়া-সরকারপাড়ার দুর্গাপূজো আজও মনে দাগ কাটে । এছাড়া মিউনিসিপ্যালিটির দুর্গাপূজো, ব্লকের দুর্গাপূজো খুব জাঁকজমকভাবে হয়ে থাকে । আলোর রোশনাই -এ ভাসতে থাকে রঘুনাথপুর শহর ।
রঘুনাথপুর শহরের লাগোয়া ছোট্ট রেল-শহর আদ্রা । মায়াবী এই শহরটি দেখে মনে হয় যেন কতকালের চেনা! ঝিকঝিক রেলগাড়ির শব্দে সম্মোহিত হয়ে কবে যে শহরটির প্রেমে পড়ে গেছি কে জানে!
৩.
দুর্গাপূজোর মনমাতানো আনন্দে পূজো পরিক্রমা শেষে আদ্রার ঠাকুর দেখা । উত্তর আদ্রার নিগমানন্দ সেবাশ্রম দুর্গাপূজো, বাঙালী সমিতি দুর্গাপূজো, রামমন্দির সর্বজনীন দুর্গাপূজো, সেবানগর সর্বজনীন দুর্গাপূজোর কথা ভাবলে আজও নস্টালজিক হয়ে
পড়ি । পুরোনো স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে মন যে কখন কোথায় চলে যায় তা নিজেও টের পাই না ।
সাবেকিয়ানা দক্ষিণ আদ্রার পূজোর অন্যতম ঐতিহ্য । দক্ষিণ আদ্রা পূজো পরিক্রমা করতে গিয়ে মন ছুঁয়ে যায় -সুভাষনগর দুর্গাপূজো, বি.ডি হস্টেল দুর্গাপূজো, ডি.এস কলোনি দুর্গাপূজো, চিলড্রেনপার্ক দুর্গাপূজো, আনন্দনগর দুর্গাপূজো ইত্যাদি।
পূজো আসে পূজো যায় কিন্তু মনের এককোণে কখন যে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি নিজেও বুঝতে পারিনা! পূজো মানেই আনন্দ. . . আনন্দ. . . আনন্দ. . . ! সেই আনন্দ ২০২০-তে কোথায়! নিয়ম মেনে পূজো আসছে কিন্তু সেই পূজো পূজো গন্ধ কই? চারদিকে মারণ ভাইরাসের থাবা । মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ এক বড়ো সংকট।কবে যে এর থেকে মুক্তি পাবো জানি না । মানুষ ভীষণ অসহায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কথায় বলতে হয়- "মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও "
৪.
দুর্গাপূজো মানে আনন্দ ...
বিষাদ . . .
এখন আনন্দের আবহও নেই। আছে শুধু একরাশ যন্ত্রণা!
প্রকৃতি যে কত শক্তিশালী তা আমরা দেখলাম । তবু আমরা প্রকৃতির উপর কত অত্যাচারই না করি । প্রকৃতিই তো মা . . . ঈশ্বর । আমরা তার
সন্তান । সন্তান খারাপ হলেও মা কখনো খারাপ হতে পারে না । সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের কথায় -
"কুপুত্র হয় অনেক গো মা, কুমাতা নয় কখনো তো ।"
Photo by : Alpi Biswas
(তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করেছেন- আমার পিতা শিক্ষক আদিত্য প্রসাদ মুখোপাধ্যায় , অগ্রজ কবি দুর্গাদাস পাল, আমার ছাত্র প্রকাশ মুখোপাধ্যায়)
ডুয়ার্সের দুর্গোৎসব-সেকাল একাল...
ডরোথী দাশ বিশ্বাস
বৈশাখের দ্বিতীয় দিন থেকে সেই যে বর্ষণ শুরু হয়েছে,স্লেট রঙের আকাশটা আজ আশ্বিনেও রঙ বদলালো না। পৃথিবীটা সত্যিই যেন বদলে গেছে। মহামারী মৃত্যু বিষাদ ভুলে শিউলি ফুটছে তারার ফুল হয়ে, নদীর চরে কাশ ফুটি ফুটি করে ফুটেই গেলো অবশেষে। মহালয়া ভোরে কচি দূর্বায় শিশিরের নাকছাবি দেখা গেল। ঊষার শীতল বাতাসে দুললো কাশের চামর। কুয়াশার চাদর জড়ানো মনখারাপির সকাল এলেও দিকবধূরা অবশেষে আকাশে নীল চাঁদোয়া টাঙিয়ে দিলো। হ্যাঁ, আমি ডুয়ার্সের কথাই বলছি। ডুয়ার্স ছাড়া এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর কোথায় আছে, কোথায় আছে এমন মাটির সরসতা ? দেরীতে হলেও শরত এসেছে তার আপন বৈশিষ্ট্যের ডালি নিয়ে। ডুয়ার্সের দুর্গাপুজোর সেকাল ও একাল জানবার আগে একটু জেনে নিই ডুয়ার্স বলতে ঠিক কোন ভূখন্ডকে বোঝায়। সেই সঙ্গে জেনে নেবো এই আশ্চর্য ভূখন্ডের জনজাতির দুর্গোৎসবে সব কষ্ট ভুলে আনন্দে মেতে ওঠার গল্প।
মানুষের জীবনে যেমন উত্থান পতন আছে, উত্থান পতনের মাধ্যমে যেমন গতি সংস্কৃতি বজায় থাকে, প্রকৃতিরও একটা উত্থান পতনের ব্যাপার আছে, যার মাধ্যমে ভূমিরূপ, আবহাওয়া বিশেষভাবে পরিবর্তিত হয়ে নুতন বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভূখন্ড সৃষ্টি হয়। ভূগোলের ভাষায় ব্যাপারটা একটু বুঝে নেওয়া যাক।
নদীগুলো পাহাড় কেটে প্রচুর পরিমাণে নুড়ি পাথর বালি অর্থাৎ উপলখন্ড ও শিলাচূর্ণ সমভূমি অঞ্চলের দিকে নিয়ে আসে, যেখান থেকে শিলাচূর্ণ অপসারিত হলো সেখানে ঘটল অবরোহণ, যেখানে শিলাচূর্ণ সঞ্চিত হলো সেই স্থানটি ভূমি থেকে কিছুটা উঠে এলো, অর্থাৎ আরোহণ বা উত্থান ঘটলো। এইরূপ আরোহণের ফলে হিমালয় পাদদেশে প্রায় ২৮ মাইল দক্ষিণে যে বিস্তীর্ণ ঢালযুক্ত শিলাময় ভূমির সৃষ্টি হয়েছে সেই অঞ্চলে প্রচুর ছোট বড় নদী প্রবাহিত। তিস্তার মত নদী, যার সৃষ্টি হিমবাহ থেকে, সেই নদীতে সারা বছর জল থাকে। তবে ছোট ছোট নদীগুলি শুষ্ক ঋতুতে অন্তঃসলিলা হলেও বর্ষায় বিস্তৃত উপলখন্ডের ফাঁকফোঁকর দিয়ে এগুলি জলাভূমির রূপ ধারণ করে। আর নদীবিধৌত স্থান বলে আবহাওয়াও স্যাঁতসেতে। ঝোপঝাড় জন্মে প্রচুর পরিমাণে। মানুষের বসতি বেড়ে যাওয়ায় নদীগুলির গতি রুদ্ধ হয়েছে, নদীগুলিকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেতু দ্বারা। সড়কপথ রেলপথ নির্মিত হওয়ায় জলাভূমিগুলি অনেকটাই বুজে গেছে। তাও যে অংশে নদীগুলি আত্মপ্রকাশ করে আছে তার চারপাশে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বনভূমির সৃষ্টি হয়েছে। বনভূমির পাতা পড়ে হিউমাসযুক্ত মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে। এটাই হল তরাই অঞ্চল। কিন্তু এই তরাই অঞ্চলের আর একটি বৈশিষ্ট্যজনিত কারণে তিস্তা নদীর পূর্ব পাড়ের হিমালয়ের পাদদেশীয় অঞ্চলটিকে বলা হয় ডুয়ার্স। বাংলা, ভোজপুরী, মৈথেলী, মাগধী ও অহম ভাষায় ডুয়ার্স শব্দের অর্থ দ্বার বা দুয়ার। নদী উপত্যকার এইরকম ১৮ টি দুয়ার দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভূটানে প্রবেশ করা যায়।পশ্চিমবঙ্গে এইরকম দুয়ারের সংখ্যা ১০, অসমে ৭, অসম ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় স্থানে বিস্তৃত দুয়ার ১ টি।
এইরকম কয়েকটি দুয়ারের নাম হলো : লক্ষ্মীদুয়ার, জিতি, চামুর্চি, টোটোপাড়া, জয়গাঁ, বক্সাদুয়ার, আলিপুরদুয়ার, ক্রান্তিদুয়ার,ভল্গাদুয়ার (পশ্চিমবঙ্গ), যমদুয়ার,গেলেফু, মাথানগুঁড়ি, চাপনা, দারাঙ্গামেলা (কোকরাঝাড় -অসম)। অর্থাৎ সংক্ষেপে বলা যায় পশ্চিমে তিস্তার পূর্ব তীর থেকে পূর্বে ধানসিঁড়ির পশ্চিম তীর পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ ও অসম রাজ্যে ডুয়ার্স অঞ্চল বিস্তৃত। সঙ্কোশ নদী দ্বারা পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের ডুয়ার্স অঞ্চলের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে।
ডুয়ার্সের জলবায়ু, আবহাওয়া,মৃত্তিকা যে চা চাষের অনুকূল সেটা বুঝেছিলেন ইংরেজরা। তাই ডুয়ার্সের ঘন অরণ্য কেটে চা-বাগান তৈরী করেছিলেন তারা। উত্তরবঙ্গে দার্জিলিং-এ ১৮৪১ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম চা বীজ পুঁতেছিলেন ডঃ ক্যাম্বেল। লেবঙের কাছে ধোতরে হলো উত্তরবঙ্গের প্রথম চা-বাগান (১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দ) ডুয়ার্সে প্রথম চা-বাগানের পত্তন হয় ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে। রাঁচি, সিংভূম হাজারিবাগ - এইসব অঞ্চল থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের, নেপালের তেমাল, ওয়াফল, মাওয়ার, থংয়াল,ইয়োলমো - এইসব জায়গা থেকে নেপালী সম্প্রদায়ের শ্রমিক আনা হয়েছিলো। দেশ বিভাগের পর প্রচুর বাঙালী ডুয়ার্সের চা-বাগানে আসেন জীবিকার সন্ধানে। ইংরেজদের হাত ধরে সৃষ্ট চা-বাগানের প্রশাসনিক কাজে গোরা সাহেবরা থাকলেও অন্যান্য অফিসিয়াল কাজে নিযুক্ত ছিলেন এই বাঙালীবাবুরা। বাঙালীবাবুরাই মালিক ও শ্রমিকের মাঝে সংযোগরক্ষা করতেন। ডুয়ার্সের জনজীবনে নানা জাতির সমন্বয় দৃষ্ট হলেও ডুয়ার্সের চা-বাগানের প্রধান উৎসব হিসেবে বাঙালীর দুর্গোৎসব একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল।
স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিটি চা-বাগানে যেমন খেলার মাঠ, প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কোম্পানীর নিজস্ব গাড়ি ছিলো, তেমনই ছিলো স্থায়ী পুজোমন্ডপও।যেগুলির ভেতরে ছিলো প্রতিমা রাখা, ফলমূল রাখা ও ভোগ রান্না করার আলাদা আলাদা কক্ষ। ছিলো বেলতলা,মন্ডপের ভেতর সমবেত ভাবে পুজো উপভোগ করার জন্য আচ্ছাদনযুক্ত চারদিক উন্মুক্ত মঞ্চ, নাটমন্দির, চারদিকে বিভিন্ন ফুলগাছ,ফলের গাছ,পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা, ট্যাপকল - সব। প্রায় শতাব্দী প্রাচীন বাগানের পুজোয় বাগান সংলগ্ন কোন শহরের ব্রাক্ষ্মণ পরিবার থেকে পুরোহিত থাকতো বাঁধা। ঢাকি আসত ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, ফালাকাটা থেকে। পুজো শুরু হবার একমাস আগে থেকেই প্রতিমা গড়ার মাটি,খড়, পাট, পাটের দড়ি, কাঠ, বাঁশ, পেরেক - সব চলে আসত। জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি থেকে আসত প্রতিমার কারিগর। খড়ের কাঠামোয় মাটি দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রতিমা। প্রতিমার অবয়ব তৈরীর কাজ দেখতে জমে যেত ছোটদের ভিড়। বাতাসে পুজোর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে প্রতিটি "গুদরী"-র দিন অর্থাৎ যেদিন যেদিন কোম্পানী শ্রমিকদের সাপ্তাহিক বেতন প্রদান করত সেইদিন বাগানের হাটখোলা রঙীন হয়ে উঠত ক্ষুদ্র বস্ত্র ব্যবসায়ীদের অস্থায়ী দোকানে টাঙানো বিচিত্রবর্ণের পোশাক পরিচ্ছদে। গাদা বন্দুক, বিভিন্ন ধরনের রঙীন মিষ্টি নিয়ে উপস্থিত থাকত দোকানীরা। হাটখোলাগুলি ভিড়ে ঠাসা হয়ে যেত চা-শ্রমিকদের বোনাস পাবার পর। চা-শ্রমিকেরা সাপ্তাহিক যে বেতন পেত সেটা প্রায় শেষ হয়ে যেত কাবুলিওয়ালার ঋণের টাকা, মাদ্রাজীর সুদের টাকা ও মুদীখানার বাকি মেটাতে। অনেক শ্রমিক মনের সুখে আকন্ঠ হাঁড়িয়া খেয়ে উদাস চোখে টলতে টলতে বাড়ি ফিরত, কেউ কেউ আবার মত্ত অবস্থায় অবচেতন মনের ইচ্ছেগুলো গালিগালাজের মাধ্যমে প্রকাশ করত। হাঁড়িয়ার নেশায় কোন কোন শ্রমিক সারারাত বাইরে পড়ে থাকার পর সকালবেলা হুঁশ ফিরে পেয়ে বাড়ি ফিরত। তাই বাগানে পুজো মানেই সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকা কবে বোনাস প্রদানের দিন ঘোষণা করা হবে। বোনাস প্রদান নিয়ে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের মধ্যে অনেক টানাপোড়েন চলতো, আন্দোলন হতো, বাইরে থেকে শ্রমিক নেতারা এসে অংশগ্রহন করতো, কিছুটা উত্তেজনারও সৃষ্টি হতো। কখনো ৮.৩৩%, কখনো ১০%, কখনো ২০% বোনাস কর্তৃপক্ষ দিতে বাধ্য হতো। এই বোনাস শ্রমিকদের হাতে আসার পর পার্শ্ববর্তী ছোট ছোট শহরগুলির ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফুটে উঠতো। কারণ এই বোনাসের সিংহভাগ অর্থই চা-শ্রমিকেরা গৃহসজ্জা, জুতো, পোশাক, প্রসাধনীসামগ্রী ইত্যাদি বিভিন্ন দ্রব্য ক্রয়ে খরচ করতো। সাধারণতঃ বোনাসের পর থেকে চা-বাগিচা সংলগ্ন ছোট ছোট শহরগুলিতে কেনাকাটার ধুম পড়ে যেতো। এই সময়ে কোম্পানীগুলি বাবুদের সপ্তাহে একবার পুজোর বাজার করার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করে দিতো। অফিস ছুটি হয়ে যাওয়ার পর পরিবার সহ বাবুরা পার্শ্ববর্তী শহর মালবাজার বা জলপাইগুড়িতে গিয়ে দোকানগুলিতে ভিড় জমাতো এবং প্রতিবারই রাত ন'টা থেকে দশটার মধ্যে বাগানের গাড়িতে করেই ফিরে আসতো। বাগানের গাড়িতে একসাথে এতোগুলি পরিবারের লোকজন হৈ হৈ করতে করতে এভাবে পুজোর কেনাকাটা করা - এ এক অনন্য অনুভূতি। যাঁরা সন্তানের পড়াশুনোর জন্য তাঁদের পরিবারকে শহরে বাসা ভাড়া করে রেখেছিলো তাঁরা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছিলো। পুজোর বোনাস দিয়ে অনেকে সাইকেল কিনতো, কেউ বা স্বল্প মূল্যে দু-তিন কাঠা জমি কিনে রাখতো,কেউ বা মেয়ের বিয়ের জন্য এক পদ গহনা গড়িয়ে রাখতো। এই বোনাস সকলের কাছেই ছিলো এক বিরাট প্রত্যাশা। মুশকিলাসানও বটে।
এরপর ডুয়ার্সের চা-বাগানগুলি সেজে উঠতো পুজোর সাজে। এই সময়ের মধ্যেই মন্ডপের চারপাশে যত বড়ো গাছ থাকতো, সেগুলির গোড়া থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত চুনের প্রলেপ দেওয়া হতো। মন্ডপের চারধারে লোহার জালের পিলারগুলিকেও রঙ করা হতো।রাস্তাঘাট নতুন করে মেরামত করা হতো। চারদিকের জঞ্জাল কেটে পরিষ্কার ঝকঝকে করে তোলা হতো। তখনো টুনি বাল্বের আবির্ভাব ঘটেনি। ছোট ছোট ১৫ ওয়াটের বাল্বের গায়ে রঙীন সেলোফেন পেপার মুড়িয়ে মন্ডপের চারধারে মালার মতো ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। এই ছিলো আলোকসজ্জা। টিউবলাইট মহার্ঘ ছিলো। বড়ো বড়ো ৫০০ বা ১০০০ ওয়াটের বাল্বগুলো মন্ডপের চারদিক আলোকিত করে রাখতো। তখন পেশাদার ডেকোরেটার্সদের ব্যাপার ছিলো না। কোম্পানীর সহযোগিতায় রঙীন কাগজ, প্লাইউড এবং বিভিন্ন ধরনের রঙ দিয়েই মন্ডপের আভ্যন্তরীন সজ্জাকে আকর্ষণীয় করে তোলা হতো। এই কাজটি করতো সেই শ্রমিকেরা যারা কোম্পানীর কাঠের ওয়ার্কশপে কাজ করতো ও চায়ের বাক্স তৈরী করতো।মন্ডপ ঘিরে কলাগাছের গায়ে রঙীন কাগজ জড়িয়ে একাধিক তোরণ তৈরী হতো।
মন্ডপে প্রতিমার গায়ে রঙ লাগতো, বস্ত্র ও সলমা-জরি চুমকির অলঙ্কারে ভূষিতা হতেন দেবী। মহালয়ার ভোরে বাড়িতে বাড়িতে ট্রানজিস্টার রেডিওতে শুরু হতো মহিষাসুরমর্দিনীর বন্দনা। যাদের রেডিও ছিলো না তারা চলে যেত অন্য বাড়িতে। ডুয়ার্সের শারদ ভোর মানেই বাতাসে হিমের ছোঁওয়া। গরম চাদর গায়ে জড়িয়ে মহালয়া শোনার সেই আনন্দ তুলনাহীন। চতুর্থীর দিন শহর থেকে ঢাকী ও কাঁসরবাদক এসে পৌঁছাতো। পুজোর সাতদিন আগে থেকেই সন্ধ্যাবেলা মন্ডপে বাবুরা মিলিত হতেন,সান্ধ্য আড্ডার সাথে পুজোর পরিকল্পনা চলতো। বাগানের বাবুদের পরিবারের মহিলারা নতুন মাটির উনুনে নিরামিষ পাত্রে চিনি ও নারকেল দিয়ে নাড়ু তক্তি বানাতেন। পুজো মন্ডপ পাক দেওয়া নারকেলের গন্ধে ম ম করতো। এই নারকেলের নাড়ু মায়ের প্রসাদী হয়ে উঠতো। বিজয়া দশমী পর্যন্ত চলতো সেই মিষ্টি।ষষ্ঠীর দিন বেলতলায় দেবীর বোধনের পর সন্ধ্যায় লুচি, সুজি খাবার চল ছিলো। সপ্তমীর সকালে মেয়ে বৌ-রা সংসারের কাজ থেকে কিছুটা অব্যাহতি নিয়ে পালা করে পুরুতমশাইয়ের নির্দেশ অনুসারে পুজোর কাজ করতেন। খুব সকালে তরুণ তরুণীর দল সমবেতভাবে ফুল বেলপাতা আমের পল্লব তুলসী দূর্বা সংগ্রহ করতো। মাইকের কোন ব্যবস্থা না থাকলেও কাঁসর ঘন্টা ঢাকের আওয়াজের কোন ঘাটতি ছিলো না। নির্ঘন্ট মেনে নিষ্ঠাভরে পুজো হতো। আবালবৃদ্ধবনিতার সমাগমে পুজো মন্ডপে ভিড় উপচে পড়তো। উপোবাস করে পুজোর অঞ্জলি প্রদানের সময় ঠেলাঠেলি লেগে যেত। পাঁচ থেকে বারো বছর বয়সীদের হাতে খেলনা বন্দুক, বাজী ও পটকার অনবরত শব্দবর্ষনে পুজো মন্ডপ হয়ে উঠতো সরগরম। অনেক বাগান যেমন ওদলাবাড়ি, জুরন্তী, রানীচেরায় মন্ডপ সংলগ্ন স্থানে খোলা মাঠে বাজী,গাদা বন্দুক, হ্যান্ডবোম, লঙ্কাবোম, রকেটবোম, বেলুন, চা, পানের দোকান বসতো। তবে যে বাগানগুলি মফঃস্বল শহর বা ছোট ছোট শহর ঘেঁষা সেই বাগানগুলিতেই মেলা বসতো। সন্ধ্যায় আরতি হতো যখন তখন পার্শ্ববর্তী বাগান থেকে কোম্পানীর গাড়ি করে দর্শনার্থীরা আসতেন। দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাতে বর্ষীয়ান বাবুরা পুজো মন্ডপেই থাকতেন। সব বাগানের পুজোরই এই একই চিত্র পরিলক্ষিত হতো। এভাবেই প্রতিটি বাগানের স্টাফদের মধ্যে পুজোর সময়, আলাপচারিতা ও মিষ্টিমুখ করার মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতো। মহাঅষ্টমীর প্রধান আকর্ষণ হলো সন্ধিপুজো। বাগান ভেদে মহাষ্টমীতে বা মহানবমীতে মা-কে খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হতো, সাথে নানা সব্জী সহকারে ঘ্যাঁট তরকারী, ভাজা, চাটনী, পরমান্ন, লুচি। ঐ দিন বাগানের কোন বাড়িতেই রান্না হতো না। মহাপ্রসাদই গ্রহন করত সবাই।এরপর আসে দশমী। মহালয়া ভোরের আগমনী গান সুর বদলে হয়ে যায় ভাসানের বিষাদী সুর। ডুয়ার্সের আকাশে লাগে মনখারাপি রঙ। হু হু বাতাসে বয়ে যায় বিচ্ছেদ বেদনা। বিসর্জনের ঢাক হয়ে ওঠে মর্মভেদী। একচিলতে মেঘ যেন একফোঁটা অশ্রু বর্ষণের জন্য প্রস্তুত। সিঁদূর খেলার আবহে মায়ের মূর্তি হয়ে ওঠে বিষাদপ্রতিমা।
ডুয়ার্সের এক একটি বড় নদীতে একসাথে অনেকগুলি বাগানের প্রতিমা ভাসান হয়।ট্রাকে করে প্রতিমা আনা হয় নিরঞ্জনের ঘাটে। চেলনদীর বিসর্জন ঘাট ডুয়ার্সের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিমা নিরঞ্জন ঘাট। এই ঘাটে ভাসান দেখতে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়।ঘাটে বসে মেলা। সেখানে জিলিপি, বোঁদে, খুরমা, নানারকম মিষ্টি এবং নিমকি বিক্রী হয়। ভাসান শেষে ফিরে আসা সেই শূন্য মন্দিরে। সেখানেই বিজয়া সম্মীলনী হতো। ডুয়ার্সের চা-বাগানগুলিতে এখনো সেই একই ছবি। শূন্য মন্ডপে সব শূন্যতা বুকে ধরে বিষাদকে জাগিয়ে রাখে ম্লান প্রদীপ শিখা। হয় তো বা সেই আলোতে কোথাও লেগে থাকে আগামীর অপেক্ষার আভাস। একালে ইন্টারনেটের দৌলতে কোলাকুলি প্রণাম মিষ্টিমুখের বদলে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন চলে হোয়াট্স অ্যাপের ম্যাসেজে। ক্লান্তির অজুহাতে শহুরে কায়দায় কোথাও কোথাও মন্ডপের সেই বিজয়া সম্মীলনী উধাও।
একটা আশ্চর্য ব্যাপার হলো, আগে বাগানে বাবুদের এই পুজোয় কোন শ্রমিক যোগ দিতো না। তার একটি কারণ, হয় তো বেশীর ভাগ শ্রমিকই ছিলো ক্রিশ্চান। ইংরেজরা এদের দারিদ্র্যতার সুযোগে একাধারে ধর্মান্তরিত করেছিলো। পাদ্রী বা ফাদারের হাত ধরে গড়ে উঠেছিলো গীর্জা (ক্যাথলিক বা প্রোটেস্ট্যান্ট)। কারণ দরিদ্র শ্রমিকদের আবাসিক শিক্ষা প্রদানের দৌলতে পাদ্রীরা ভালো অঙ্কের স্টাইপেন্ড পেতো এদের নামে। সেই অর্থের কতটা এদের কল্যাণে ব্যবহার হতো তা জানা নেই। শ্রমিকেরা হয় তো ধর্মের ভিন্নতার কারণেই বাবুদের এই পুজো থেকে স্বেচ্ছায় সরে থাকতো। তবে সবটাই অনুমান। এ নিয়ে কেউ কখনো কথা বলেনি। অতীতে চা শ্রমিকেরা যে সংস্কৃতির ধারা বহন করতো সেটা চা-বাগানের আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে আর ধরে রাখতে পারেনি। কোম্পানী থেকে বিভিন্ন ধরণের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হলেও উপযুক্ত বেতন না পাওয়ার কারণেই কতকগুলি সামাজিক ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে চলতে ব্যর্থ হয়। স্থায়ী শ্রমিক হওয়া সত্বেও বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। অপরদিকে বাগানের বাবুদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে বেশী স্বচ্ছল। প্রশাসনিক কারণেই বাবুদের প্রতি শ্রমিকদের বহুকাল ধরেই ক্ষোভ সঞ্চিত হতে থাকে। অপরদিকে শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ সুবিধাগুলো নেওয়ার মতো মনোভাবও হারিয়ে ফেলে তারা। খুব স্বল্প সংখ্যক শ্রমিকই পেরেছিলো একটু স্বতন্ত্র্যভাবে উন্নত হতে। তাদের পরিবারের পুত্রসন্তানেরা অনেকেই উচ্চশিক্ষা লাভ করে বড় বড় শহরে সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী নিয়েছে এমনও দেখা যায়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক বংশপরাম্পরায় শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে না পারায় বিপথে চালিত হতো। এই বিপথে চালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থাগুলি কোনভাবেই তাদের দায় অস্বীকার করতে পারে না। যেহেতু বাবুদের মধ্যে নব্বই শতাংশই পূর্ববঙ্গ থেকে আগত বাঙালী, তারা খুব সহজেই সাম্প্রদায়িক কার্ড চালাতে সফল হতো। বাংলাদেশ থেকে আগত বেশীরভাগ মানুষেরই দুর্গাপুজোর আনন্দের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হতো। ফলে আজ থেকে প্রায় একশো বছরেরও বেশী অতিক্রান্ত হলেও নিজেদের উদ্যোগে দুর্গাপুজোর রীতি আজও অটুট। তবে সময় বদলেছে। চা- বাগানের ভিতর বিভিন্ন নামের শ্রমিক বসতি রয়েছে, যেগুলি লাইন নামে পরিচিত। যেমন বড় লাইন, ডিভিশন লাইন, হাটখোলা লাইন, মুন্ডা লাইন - ইত্যাদি। বাবুদের আদব কায়দা, রীতি নীতি কিছুটা হলেও তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। তারা বাবুদের সহৃদয়তা ও আন্তরিকতাও উপলব্ধি করতে পেরেছে। মিডিয়ার দৌলতে উৎসবের রঙ লেগেছে তাদের আড়ম্বরহীন জীবনেও। তারা ধীরে ধীরে মিশে গেছে বাবুদের এই দুর্গোৎসবে। উৎসবের দায়িত্ব কিছুটা স্বেচ্ছায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে।বর্তমানে অনেক বাগানে তারা সামর্থ অনুযায়ী নিজেদের মতো করে তাদের বস্তিলাইনে স্বতন্ত্র পুজো চালু করেছে।
ডুয়ার্সের সাথে জলপাইগুড়ি আর আলিপুরদুয়ার সম্পর্কযুক্ত। জলপাইগুড়ির উত্তর সীমা ডুয়ার্সের দক্ষিণ সীমা নির্ধারণ করছে। ডুয়ার্সের একমাত্র রাজবাড়ির পুজোর প্রসঙ্গ মানেই বৈকুন্ঠপুর রাজ এস্টেটের পুজো। বৈকুন্ঠপুর বা জলপাইগুড়ির আবহাওয়া হলো প্রকৃত ডুয়ার্সের আবহাওয়া। এই আবহাওয়ার গুনে ভুটানীরা ভূটান থেকে পশমের গরম জামা কাপড় ডুয়ার্সের হাটে বেচতে আসতো এই শরতেই। জলপাইগুড়ি শব্দটির উৎপত্তি ভূটানী শব্দ Je - le - pe - go - ri (জে-লে-পে-গো-রি) যার অর্থ গরম পোশাক বিপণনকেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গে সমগ্র ডুয়ার্সের দক্ষিণ সীমা নির্ধারিত হচ্ছে এই জলপাইগুড়ি জেলা দ্বারা। ডুয়ার্সের চা-বাগানগুলির হেড কোয়ার্টার্স জলপাইগুড়ি শহর। এখনো সেই শতাব্দী প্রাচীন ইমারত এই শহরে আছে। তাই ডুয়ার্সের পুজোর কথা বলতে গেলে বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর কথা বলতেই হবে। এবারে আসি ডুয়ার্সের বৈকুন্ঠপুর রাজ এস্টেটের (অন্যতম শহর জলপাইগুড়ির রাজবাড়ীর) দুর্গাপুজোর ডালি নিয়ে। ১৫২৩ খ্রীষ্টাব্দে এই রাজ এস্টেটের পত্তন হয়। এর চৌদ্দ বছর আগে ১৫০৯ খ্রীষ্টাব্দে কোচবিহার রাজপরিবারের সদস্য বিশ্ব সিংহ ও বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির সদস্য শিষ্য সিংহ মিলে বৈকুন্ঠপুরের রাজপরিবারের পুজো শুরু করেছিলেন। কথিত আছে এই দুই রাজপরিবারের বংশধর বৈকুন্ঠপুরের গহন জঙ্গলে মা ভগবতীর মাটির মূর্তি গড়ে দুর্গা পুজো শুরু করেছিলেন। পুজোর রীতি অনুযায়ী ছাগ-পাঁঠার পরিবর্তে, পরিবারের কোনও এক সদস্যকে দেবীর উদ্দেশ্যে নরবলি দিয়ে উৎসর্গ করেছিলেন। মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপরিবারের দুর্গা পুজোর প্রচলন হয়েছিল বলে আজও বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির প্রতিমার রং তপ্তকাঞ্চনবর্ণা। রাজার শহরে ঢুকতেই নজরকাড়া সিংহদুয়ার যেখানে উৎসবের সময় নহবত বসতো। আজ রাজা নেই সেই রাজ্যপাটও নেই। স্মরণাতীত কালে নরবলি দেওয়ার ঘটনা আজ রাজপরিবারের ক্যানভাসে যেন এক বিবর্ণ ইতিহাস। কিন্তু তা সত্ত্বেও অষ্টমীর গভীর রাতে পুরোহিত পুজো চত্বর লাল শালু দিয়ে ঘিরে নিজ ডান বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ চিরে রক্ত দেন, আতপচালের গুঁড়ো দিয়ে মানুষ পুতুল গড়ে প্রতীকী নরবলির ব্যবস্থা করেন। চালোনকুলায় ধান, দুর্বা, কলা, চালকুমড়া হাঁসের ডিম সহযোগে কালীকাপুরাণ মতে এই রাজবাড়ির দুর্গাপুজো হয়।
দেবী দুর্গার পাশে তাঁর সন্তান সন্ততি ছাড়াও ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, মা মহামায়া ও জয়া বিজয়ার বিগ্রহ দেখা যায়। একজন সধবা রমনী বঁটিতে বসে আঁশওয়ালা মাছ কাটছেন এমন একটি মূর্তিও দেবীর বাম পার্শ্বে শোভা পায়। অতীতে অষ্টমী ও নবমীর দিন রাজবাড়ি চত্বরে বড় আকারে মেলা বসতো। বৈকুন্ঠপুর রাজপরিবারের পুজা ও মেলা উপলক্ষ্যে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্ত ও স্থানীয় মানুষ সামিল হতেন। বর্তমানে দুর্গাপুজার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আজ আর মেলা বসে না। রাজদুর্গার বিসর্জন হয় না, যেহেতু মা এখানে নিত্যপূজিতা। হয় নিরঞ্জন। রাজবাড়ির প্রবীনতম সদস্য শ্রী প্রণত কুমার বোস। রাজবাড়ির সদস্যদের সাথে এলাকাবাসী সবাই হাতে হাত মিলিয়ে মায়ের প্রতিমা সহ রথ টেনে নিয়ে যান রাজবাড়ির দীঘি পর্যন্ত। বাজে বিষাদের সুর, হয়ে যায় নিরঞ্জন। মাথায় শান্তিবারি ছিটিয়ে চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে পরের বছরের জন্য প্রতীক্ষা।
রাজপরিবারের সদস্য প্রনত বসু জানান, রীতি মেনে আজও প্রতিমা নিরঞ্জন চাক্ষুস করেন না পরিবারের সদস্যরা। নিয়ম নীতি মেনে জন্মাষ্টমীর দিন হয় কাঠামো পুজো। যে মণ্ডপে পুজো হয়, সেই মণ্ডপেই প্রতিমা তৈরির নিয়ম। স্থানীয় মানুষ আজও শহর ও শহরতলির পুজো দেখার ফাঁকে বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির পুজো দেখে যান। ১৫০৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে এখন পর্যন্ত এই পুজো হয়ে আসছে। যদিও সেই পুজোর আড়ম্বর বা জৌলুষ এখন আর তেমন নেই,তবু অতীত ঐতিহ্য নিয়েই আজও ধিকধিক করে চলছে ৫১১ বছরে উপনীত বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির পুজো যা জনজীবনে প্রবহমান। পুজো ঘিরে অতীতের অষ্টমী থেকে দশমী মেলার চল না থাকলেও প্রতীকী নরবলীর জন্য আজও রাজবাড়ির পুজো সমান আকর্ষণীয়। রাজবাড়ির বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই প্রবাসী। শুধু পুজোর সময় এখানে আসেন।
এবারে ডুয়ার্সের বারোয়ারী পুজো প্রসঙ্গে আসছি। ডুয়ার্সে বারোয়ারী পুজোর বয়স আনুমানিক ৬৫ - ৭০ বছর। প্রতিটি পরিবার, ব্যবসায়ী সমিতি ও ক্লাব মেম্বারদের সহযোগিতায় এ পুজো হয়। এগুলো প্রায় সবই বিগ বাজেটের পুজো। বিভিন্ন ক্লাব পুজো মন্ডপসজ্জায় ও মূর্তি তৈরিতে প্রতিবছরই অভিনবত্ব আনে, এতে বিভিন্ন শিল্প মান্যতা পায়। যেমন : বাঁশের মন্ডপ ও মূর্তি, পাটের মন্ডপ ও মূর্তি, ঝিনুকের মন্ডপ ও মূর্তি। এগুলি মানুষের যথেষ্ট চিন্তাভাবনা প্রসূত সৃজন। থিমের পূজোও ডুয়ার্সের বারোয়ারী পূজোয় একটা বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। থিমের পুজোগুলো যথেষ্ট শিক্ষামূলক এবং জনমানসে আনন্দদানের সাথে সাথে সবসময় শুভবার্তা প্রেরণ করে। যেমন : থাইল্যান্ডের বৌদ্ধমন্দিরের আদলে নির্মিত পুজোমন্ডপ তৈরী করে দেখানোর উদ্দেশ্য হল পুরো প্যান্ডেল ও মন্ডপে শান্তির পরিবেশ বজায় থাকবে। কারণ গৌতমবুদ্ধ স্বয়ং শান্তির প্রতিরূপ। মা-দুর্গার প্রতিমাতেও বুদ্ধের শান্তিময় চিত্রই ফুটে উঠবে। গতবছর আলিপুরদুয়ার জংশনের শিববাড়ি ক্লাবের সাতাশিতম বর্ষে পদার্পণ করেছে যে পুজো তার বিশেষ আকর্ষণ ছিলো পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরের আদলে তৈরি মন্ডপ ও বাঘের ছাল পরিহিতা দুর্গা প্যান্ডেলের ভেতরে ছিলো আধুনিকতার ছোঁওয়া। বাইরে ছিলো চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা। শুধু বহিরঙ্গের জাঁকজমক নয়, পুজোর তিনদিনই অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। অষ্টমীর দিন দুপুরে এলাকাবাসীর বাড়ি বাড়ি অন্নভোগ পৌঁছে দেওয়া হয়। পুজো হয় যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে। সর্বজনীন পুজোর মানচিত্রে অন্যতম উজ্জ্বল ও নিজস্ব আঙ্গিকে বর্ণময় আর একটি পুজো যার কথা এখানে তুলে না ধরলেই নয়, সেটা হলো জলপাইগুড়ির কদমতলা দুর্গাবাড়ির পুজো যাকে 'জলপাইগুড়ির ম্যাডক্স স্কোয়ার' বলা হয়। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে শুরু হওয়া এই পুজো আজ শত বর্ষে পদার্পণ করলো। শহরের আট থেকে আশির কাছে এই পুজোর টান ও মান - দুইই অন্যরকম। এই পুজোমন্ডপ পুনর্মিলন উৎসবের সার্থক ক্ষেত্র।
বারোয়ারী পুজো ছাড়াও ডুয়ার্সের শহরে বসবাসকারী কিছু বনেদী পরিবারেও পারিবারিক কল্যাণ কামনায় ও আভিজাত্যের অঙ্গ হিসেবে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। জলপাইগুড়ির কদমতলার ভুঁইঞা বাড়ির পুজো এমনই একটি পুজো। পূর্বে অধিকাংশ বনেদী পরিবার একান্নবর্তী পরিবারই ছিলো। আভিজাত্যের নিদর্শণ হিসেবে বারো ঘর এক উঠোনের সাথে একটি দুর্গামন্ডপ থাকতো। এখন কর্মসূত্রে সবাই দূরে দূরে থাকায় একান্নবর্তী পরিবারের ধারণা বদলে গেলেও বৎসরে একবার এই পুজোকে কেন্দ্র করেই হয় ঘরে ফেরা। তাই পুজোর সেই জৌলুস হয় তো তেমন নেই, তবু টিঁকে আছে সেই পারিবারিক পুজো।
চা-বাগানে দুর্গাপুজো যেমন প্রথমদিকে বাঙালীবাবুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো তেমনই ডুয়ার্সের মফস্বল শহর ও জেলাশহরের মধ্যে রাজপরিবারের পুজোর মধ্যেই ছিলো সর্বজনীনতা।আর রাজপরিবারের পুজো মানেই বৈকুন্ঠপুর রাজ এস্টেটের পুজো। মূলতঃ স্ট্যাটাসের ভিন্নতাজনিত কারণে সাধারণ মানুষ বা স্থানীয় জোদ্দার বা জমিদারেরাও এ দুর্গোৎসবের সাথে একাত্ম হতে পারতেন না সেভাবে। তাই রাজপরিবারের পুজোকে যথাযোগ্য সম্মান ও মান্যতা দিয়ে দশমীর বিসর্জনের পর শুরু হতো স্থানীয় বৃহদাংশ রাজবংশী সম্প্রদায়ের জমিদার ও সাধারণ মানুষের আরাধনা। এই পুজো ভান্ডানী পুজো নামে খ্যাত। দুর্গাপুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে যায় মা ভান্ডানীর পুজো। এই পুজো বনদুর্গা নামে পরিচিত। কথিত আছে বাঙলায় মা দুর্গা পূজিতা হবার পর দশমীতে যখন কৈলাসের পথে অগ্রসর হন তখন তিস্তা তোর্ষা বিধৌত ডুয়ার্সের অপরূপ মনোরম স্থানে বিশ্রাম নেবার সিদ্ধান্ত নেন। সেই অবসরে তিনি দেবী ভান্ডানীরূপে ডুয়ার্সের রাজবংশী সম্প্রদায়ের জোদ্দার বা জমিদার ও সাধারণ মানুষের পুজো গ্রহণ করেন। দশমীর দিন দেবীর বোধন হয়। একাদশী থেকে পুজো শুরু। তিনদিন চলে এ পুজো। ডুয়ার্সের মেটেলি ব্লকের দক্ষিণ ধূপঝোরার মিলন সঙ্ঘ ক্লাব বারোয়ারী পুজো হিসেবেই মা ভান্ডানীর পুজো করে। এবছর এই পুজো একচল্লিশতম বর্ষে পা রাখলো। দুর্গাপুজোর দশমীর দিন এখানে মা ভান্ডানীর প্রতিমা স্থাপণ করা হয়। একাদশীতে পুজো ও মেলা হয়। কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমার রাণীরহাট অঞ্চলে মা ভান্ডানী পুজো ও মেলা তিনশো দশ বছরের পুরোণো। এই নয় দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী মেলায় নাগরদোলাসহ অন্যান্য অনেক বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। এখানকার দুর্গাপ্রতিমার সাথে কার্তিক গনেশ থাকে না। প্রচলিত কিম্বদন্তী হলো মা দুর্গা যখন তিস্তা অতিক্রম করে কৈলাসের পথে যাচ্ছিলেন, তখন তিস্তার পাড়ে ঘন অরণ্যে কার্তিক গনেশ মা দুর্গার থেকে পথ হারিয়ে আলাদা হয়ে যান। তবে মা ভান্ডানীর প্রতিমা সর্বত্র এইরকম নয়। সপরিবারেই সাধারণতঃ পূজিতা হন।
তবে দেবীর বাহন সিংহের পরিবর্তে বাঘ। অর্ধ শতাব্দী আগেও ডুয়ার্স ছিলো গহন অরণ্য আচ্ছাদিত। সেখানকার বাস্তুতন্ত্রে খাদ্যশৃঙ্খলে প্রধান শিকারী প্রাণীটি হলো বাঘ। তাই দেবী ভান্ডানী বাঘকেই তাঁর বাহন নির্বাচন করেছেন।
ডুয়ার্সের বিখ্যাত ভান্ডানী মেলা বসে আলিপুরদুয়ারের কুমারগ্রামের পশ্চিম নারারথলি গ্রামে, জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের বার্ণিসে (এই মেলায় রাজবংশী ছাড়াও সর্বজাতিধর্ম নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়) অসমের কোকরাঝাড়ের গোঁসাইগাঁও-এর ভাড়াগুঁড়ি গ্রামের ডাঙাইগুঁড়িতে।
দুর্গা পুজোর পরিসমাপ্তির সাথে সাথে মনখারাপির বাতাবরণ সরিয়ে কর্মমূখর জীবনে প্রবেশ করার আনন্দ উৎসব হলো এই মা ভান্ডানীর পুজো ও মেলা।এভাবেই উৎসব শেষে ছন্দে ফেরে আপামর ডুয়ার্সবাসী।
গড় পাথরমহড়া রাজবাড়ির ১৭ দিনের দুর্গাপূজা
তপন পাত্র
"শক্তির রূপ ভারতে ও মধ্য এশিয়ায়"গ্রন্থে ডক্টর ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেছেন , পূর্ব ভারতে দুর্গাপূজা প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে । দ্বাদশ শতাব্দীতে সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর "রামচরিত মানস"গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন শরৎকালে কখনো কখনো উমার পূজা উপলক্ষে উৎসব উদযাপিত হয় । আমাদের এবঙ্গের অলংকার কীর্তিবাস কবি কৃত্তিবাস শরৎকে "অকালবোধন" আর বসন্তকে "শুদ্ধিময়" বলে উল্লেখ করেছেন । "মার্কেন্ডেয় পুরাণ"- এ দেবীর বাৎসরিক পূজা বসন্তকাল বলেই উল্লেখ আছে। ষোড়শ শতাব্দীতে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে দশভূজা চণ্ডীর মহিষাসুরমর্দিনী রূপের বর্ণনা আছে , এসময় দুর্গা পূজার প্রচলন হয়েছিল বলে মনে হয় ।
তবে সঠিক কবে থেকে এদেশে শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রচলন , তা নিশ্চিতভাবে বলা খুব মুশকিল । পূর্ববঙ্গের রাজা হরিবর্মা দেবের প্রধানমন্ত্রী ভবদেব ভট্ট একাদশ শতাব্দীতে দুর্গাপূজার পদ্ধতি রচনা করেছিলেন । দ্বাদশ শতাব্দীতে দুর্গাপূজা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন জীমূতবাহন এবং শূলপাণি । চতুর্দশ , পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত দূর্গা পূজা বিধান বিষয়ক নানা পুঁথি পাওয়া যায় । চতুর্দশ শতকে বিদ্যাপতি "দুর্গা ভক্তি তরঙ্গিনী" রচনা করেন । তাছাড়া বাচস্পতি মিশ্রের "বাসন্তী পূজা প্রকরণ" রঘুনন্দনের "দুর্গোৎসব তত্ত্ব প্রকরণ" ইত্যাদি গ্রন্থে দুর্গাপূজার বিবরণ আছে ।
তাহলে যতদূর আন্দাজ করা যায় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক থেকে এদেশে দুর্গাপূজা প্রচলিত হয় । কিন্তু শরৎকালের যে শারদ উৎসব তার প্রচলন ষোড়শ শতাব্দীতে।
জানা যায় উত্তরবঙ্গের তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ আধুনিক রীতিতে তৎকালীন নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রতিমায় দুর্গাপূজা করেছিলেন ।
১৫১০ সালে বাংলার কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কোচবিহারে দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন । ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার
রায়চৌধুরী পরিবার দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিল। এতসব প্রসঙ্গের অবতারণার মূল কারণটি হল আমাদের আলোচ্য রাজবাড়ীর অর্থাৎ পুরুলিয়া জেলার মানবাজারের গড় পাথরমহড়া রাজবাড়ীর দুর্গাপূজাও শারদীয়া পূজার সূচনাকালের সমসাময়িক ।
এই রাজপরিবারের প্রথম পুরুষ রাজা শ্রীশ্রী পরিমল সিংহ দেব ঠাকুর দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজস্থানের মোহব্বায় গড়নির্মাণ করেন। মান বংশের রাজপুরুষেরা গড় মোহাব্বা থেকে বর্ধমান জেলার কোটা মানকর -এ কিছুদিন অবস্থান করেন । তারপর ক্রোশজুড়ি হয়ে বুধপুর এবং পরে মানবাজার পাথরমহড়ায় আসেন। রাজা অনন্ত মানের গড় ছিল বুধপুরে। মানবাজারের শেষ রাজা পঞ্চম হরি নারায়ন দেব চুয়াড় বিদ্রোহের নেতা ছিলেন । অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে ফার্গুসন সাহেবের অতর্কিত আক্রমণে মানবাজারের পুরাতন রাজবাড়ী ধ্বংস হয়ে যায় । বন্দী অবস্থায় হরিনারায়ণ মেদিনীপুর জেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । হরি নারায়ণের পুত্র মানাবনিনাথ রাজা শ্রীশ্রী মুকুন্দ নারায়ন দেব ১৭০০ শকাব্দে পাথর মহড়ায় গড় নির্মাণপূর্বক দুর্গা মন্দির সহ অন্যান্য দেবতাদের মন্দির নির্মাণ করেন ।
রাণী কালি কুমারী পট্ট মহাদেবী পাথরমহড়ার মন্দির চত্বরটি শ্রী শ্রী দূর্গা মাতা কে অর্পণ করেন।
রাণী রাজবালা দেব্যা , রাণী মেনকা সুন্দরী দেব্যা , রাণী চারুবালা দেব্যা পাথরমহড়া মৌজায় ২৬ শতক জমি ও রানী লাবণ্যপ্রভা দেব্যা মধুপুর মৌজায় বড়পুকুর পুষ্করিণী শ্রী শ্রী দুর্গা মাতা কে অর্পণ করেন। দুর্গা পূজার জন্য এক হাজার চুরাশি টাকা পুরুলিয়া কম্পেন্সেশন অফিস থেকে perpitual annuity পাওয়া যায় ।
গড় পাথরমহড়া রাজবাড়ির দুর্গাপূজার পূর্ব ইতিহাস প্রায় চার শ বছরের পুরানো ।
কিন্তু পাথরমহড়ায় পূজা শুরু হয় দুশ কুড়ি বছর আগে।
কালিকাপুরাণ মতে নবম্যাদি কল্পারম্ভবিধায় মানরাজবংশের শারদীয়া দুর্গাপূজা ১৭ দিনের। মান রাজবংশের বিধান অনুসারে দেবীপক্ষের শুক্লা চতুর্থী তিথিতে মানচতুর্থী ব্রত পালিত হয়। দেবীপক্ষের তৃতীয়াতে মানচতুর্থীর অধিবাস ও বিল্ববরণ । মান পাতা , বেল , ডালিম , ধান ---এই চারটি দ্রব্য দিয়ে চতুর্থ পত্রিকা বাঁধা হয় । শুক্লা চতুর্থীতে শোভাযাত্রা সহকারে দোলা নিয়ে যাওয়া হয় মানবাজার মাঝপাড়ার বলরাম সায়েরে । মন্দিরে চতুর্থ পত্রিকা আনার পর ষোড়শোপচারে পূজা , আখ বলি , নতুন মাটির ঘৃত প্রদীপ প্রজ্বলন ও প্রসাদ বিতরণ হয় । প্রদীপটি জ্বলে দেবীর বিসর্জন পর্যন্ত । পরের দিন পঞ্চমীতে আরতি ও এই দেবীর বিসর্জন হয়। এতদঞ্চলের লোক এই দেবীকে "মেজ ঠাকরুণ" বলে।
পাথরমহড়া রাজবাড়ির দুর্গাপূজায় প্রতিমা হয় না। নবপত্রিকায় পূজা হয় । সপ্তমীর দিন নবপত্রিকার আগমনী অনুষ্ঠান মহাসমারোহে উদ্ যাপিত হয়। নবপত্রিকা দশদুর্গার প্রতীক। একে "ছোট ঠাকরুণ" বলে।
প্রতিবছরই শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রাকলগ্নে মানবাজারের পন্ডিতমন্ডলী ও মেলা কর্তৃপক্ষ একসঙ্গে বসে শারদীয়া দুর্গা পূজার নির্ঘণ্ট তৈরি করেন ।
জিতাষ্টমী থেকেই শুরু হয়ে যায় পূজার নানা কর্মকাণ্ড । জিতা অষ্টমীর রাত্রিতে মন্দির সংস্কার , হোম ও বোধনের অধিবাস হয় । পিতৃপক্ষের নবমীতে বোধন পূজা , বোধনের ঘট ভরিয়ে আন হয় বলরাম সায়ের থেকে । এই বোধন কে বলা হয় "বড় ঠাকুরুণ"।
মূল পূজায় রাজলক্ষ্মীর ঘট আসে রাজবাড়ী থেকে । গঙ্গা দেবীর ঘট ও একটি তলোয়ার আসে রাজবাড়ীর বলরাম জিওয়ের মন্দির থেকে । একটি নিরবচ্ছিন্ন ঘৃত প্রদীপ এই দিন থেকে জ্বলে বিজয়া দশমী পর্যন্ত । দেবীপক্ষের সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত পৃথকভাবে আরও দুটি ঘৃত প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং সন্ধিপূজার সময় জ্বালানো হয় ১০৮ টি ঘৃতপ্রদীপ । কৃষ্ণানবমী থেকে বিজয়াদশমী পর্যন্ত প্রত্যহ পূজা , ভোগারতি , চণ্ডীপাঠ ও হরিনাম সংকীর্তন চলতে থাকে । সপ্তমী , অষ্টমী , নবমীতে প্রথানুসারে আঁখ , কুমড়া ও ছাগ বলি হয় ।
সপ্তমী ও বিজয়ার দিন রাজবাড়ী থেকে মানবাজারের অন্যান্য পারিবারিক ও গোষ্ঠীবদ্ধ সাতটি পূজার একসাথে দোলা তোলার অনুষ্ঠান হয়ে আসছে । রাজবাড়ীর সংকেত ধ্বনি শুনে সন্ধিপূজায় বলিদান মানবাজারের শারদীয়া পূজার চিরন্তন ঐতিহ্য । আগমনী ও বিসর্জন অনুষ্ঠান দেখার জন্য মানবাজার নামোপাড়ার গোপাল সায়েরে অগণিত মানুষের ভিড় হয় । রাজপুরোহিত আগমনীর দিন আগমনীর ও বিসর্জনের দিন বিসর্জনের মন্ত্র পাঠ করেন । এই পবিত্র মুহূর্তের রূপবৈচিত্র্য মানুষকে আজও আকর্ষণ করে । সারা মানবাজারে বেজে ওঠে সংহতি , মিলন ও ঐক্যের সুর । শারদ-উৎসব অনেকাংশে একটি প্রসিদ্ধ লোক-উৎসবের রূপ পেয়ে যায় ।
বিজয়া দশমীর দিন দুর্গা মন্দিরে অপরাজিতা পূজা , শুভ পুণ্যাহ , রাজলক্ষ্মীর রাজগৃহে প্রত্যাবর্তন , বিকালে দিক্ বিঁধা অর্থাৎ দ্বিগবিজয় , শ্রী শ্রী তালবাসিনিদেবীর বিশেষ পূজা , বলিদান এবং রাত্রিতে দুর্গা মন্দিরে রায় মহাশয় পাতর (পাত্র) সরকার আত্মীয় কুটুম্বদিগকে খিলিপান বিতরণ করা হয় । অধিক রাত্রিতে খেটুয়া বোধনে ঘট দু'টি বিসর্জন দেন এবং ১৭ দিনের শারদীয়া দুর্গা পূজার পরিসমাপ্তি ঘটে।
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
যোগাযোগ - হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার-৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল-uttamklp@gmail.com
ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনভালো থেকো
মুছুনআন্তরিক শুভেচ্ছা, ভালো-লাগা মেশানো।
উত্তরমুছুনআপনাকেও শুভেচ্ছা জানাই। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
মুছুনসুন্দর বলছি। শুশ্রূষাও।
উত্তরমুছুন