প্রথম বর্ষ ।। সপ্তম ওয়েব সংস্করণ ।। ২৩ কার্তিক ১৪২৭

আমাদের এই জীবন আমাদেরই নয়। আমরা নিজেদের জীবনের সাথে সাথে অন্যের জীবনেরও গাথা গেয়ে চলি সব সময়। 
          এই যে শীত নেমে আসছে। মাঠ থেকে ফসল তুলছে চাষিরা। ফাঁকা হয়ে আসছে মাঠ। অথবা হালকা হয়ে আসা ধূলায় ভরে উঠছে আকাশ। এ সবই আমাদের কারো না কারো জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা কখনও এ সবের বাইরে নয়। এইসব জীবনের জয়গান গাইতে গাইতেই উন্নত প্রযুক্তির দিকে এগোতে হবে আমাদের। তবেই পূর্ণ হবে আমাদের পথ চলা।

উত্তম মাহাত, সম্পাদক


যৌথতা ভেঙ্গে যায় ( চতুর্থ কিস্তি)

নির্মল হালদার

আমি যদি চিৎকার করে অথবা নিঃশব্দে উচ্চারণ করতাম, আমার হাতে নাই ভুবনের ভার------তাহলে কী বিষ্ণুপুর থেকে এক জনৈক কবি আমার খামারে আসতে পারতো? বাঁকুড়া শহর থেকে স্বরূপ চন্দ্র আসতে পারতো?
          এরা দুজনেই আমাকে ভুলে গেছে। যা স্বাভাবিক।
         বিষ্ণুপুরের ঐ জনৈক কবি আমার সর্বনাশও করেছে। আমার কাছ থেকে একবার দু ফর্মার কবিতা নিয়ে গেল। সে প্রকাশ করবে আমার একটি বই। বই তো হলোই না পান্ডুলিপি খুঁজতে গেলে অন্য কথার দিকে চলে যায়।
বাংলা কবিতার বাজারে এই নোংরামিও চলে।
           সেই কবিতাগুলিও আমার কাছে নেই।
বিশ্বাস করে দিয়েছিলাম তার ফল, এই। বিশ্বাস করতে করতে কেবলই ঠকছি। পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে, তারপরও বিশ্বাস করছি। কেননা যে কদিন আছি আমাকে বাঁচতে হবে।
           আমার কাছে এসেছে রাম কুমার আচার্য। সন্দীপ দাস। এই দুজনও বাঁকুড়ার ছেলে। এই দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। 
           একসঙ্গে থাকলে সংঘাত হতেই পারে।একসঙ্গে থাকলে ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। একসঙ্গে থাকলে মান অভিমান হয়। মান অভিমান হয়েছে বলে কথা কাটাকাটি হয়েছে বলে আমার সম্পর্কে কুৎসা করবে নানা জনের কাছে? 
           কারো ভাতে ধুলো দিইনি আজও। বরং সবসময় চেষ্টা করেছি, সবার হাসি মুখ দেখতে। আর তাই, দুর্গার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাকে দিলাম। গণেশের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাকেও দিলাম। দিলাম এজন্য যে, তাদের দরকার। দুর্গা জানে গণেশ জানে আমি টাকাটা নিয়েছি আমার দরকারে।
"আমার ভান্ডার আছে ভরে,
তোমা সবাকার ঘরে ঘরে"
একথা বলে আমি নিশ্চয়ই ভুল করছি না। তোমার ১০ টাকা থেকে ৫০ পয়সা আমাকে দিলে তোমার কমে যাবে না। আমি তো অন্যের জন্যেও হাত পাতি সব সময়। কার বই লাগবে, ফর্ম ফিলাপের জন্য কার টাকা লাগবে, কার বোনের বিয়ে, কার বাবার শ্রাদ্ধ-----আমাকে এসে বললে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করি। এই কিছুদিন আগেই, কিছু লেবার আমার কাছে আবদার করেছিল, খাওয়াতে হবে। আমার বন্ধু দুর্গাকে বললাম। সে সঙ্গে সঙ্গে ২০০০ টাকা পাঠিয়ে দিলো আমাকে। 
          কোনো মহত্ব নেই এখানে, কেবল বলতে চাই , আমার মেধা ও মননের আমার আবেগের আমার স্বপ্নের যৌথ খামার কোনো না কোনো ভাবে চলছে বৈকি।
           সোমেনরা খোঁজ খবর না নিলেও , অতনু যোগাযোগ না করলেও, আমি আছি আজও।
সোমেন যদিও আমার ঋণ স্বীকার করে অন্য কেউ কেউ তো তাও করে না। চেষ্টা করে নিন্দামন্দ করার।রানা ভোম্বল বাবন এরাও আমার তরুণ বন্ধু। আজও এদের সঙ্গে আছি। ভোম্বল ফোন করে না একদম। তবে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠায়। রানা ফোন করে ক্বচিৎ কখনো। ছত্রিশগড় থেকে মহারাজ বছরে একটা ফোন করে আমার জন্মদিনে। আমার আত্মীয় বলতে এরাই। এই যে রিকু কখনো কোনোদিন মেসেজ করে জানতে চায়, খেয়েছি তো। ঋজু ও রিকু দুজনেই কোনো স্বার্থ থেকে আমার সঙ্গে মেলামেশা করে না। বেশিরভাগ জন আমার কাছে এসেছে ধান্দাবাজি করতে। ধান্দাবাজিতে সফল না হলে, বাইরে গিয়ে গালাগাল করেছে।
         দিন বয়ে যায়। চড়ুই পাখিদের দেখা যায় না।
কাকের সংখ্যাও কমে গেছে। শান্তি গোপাল আছে। নিরাময় আছে। নিশ্চয়ই ভালো আছে তারা। আমার খবরা খবর না নিলেও ভালো থাকুক সবাই।আকাশকেও ভালো রাখা প্রয়োজন। মাটিকে ভালো রাখা জরুরি। আর জনৈক কবির উদ্দেশ্যে জানাই, আমার মৃত্যুর পর আমার কবিতার বই প্রকাশ করে বাহবা পাবার ধান্দা করো না। তোমার নোংরামি আগেই জানিয়ে রাখছি তাই।
            ঐ জনৈক কবি আমার কাছ থেকে আলোক সরকারের একটি গদ্যের পান্ডুলিপি নিয়েছিল প্রকাশ করার জন্য। সেও বোধহয় ১০ কপি ছেপে  আর ছাপেনি। ঐ কবির মত  যুবকেরা তাদের খ্যাতির জন্য যা ইচ্ছে করতে পারে। যতটা নিচে নামার নামতে পারে।মোটকথা, পিছনে খ্যাতির  লেজ চাই। এই এদের প্রতি আমার ধিক্কার জানাই।
         আমাদের সময়ের এক কবি আমার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,আমার সঙ্গে তিনি কি কথা বলবেন আমি তো পড়াশোনা করিনি। সত্যিই তো পড়াশোনা করিনি। আমি ভিক্ষে করে বেড়াই। লেখাপড়া করার সুযোগ পেলাম কই?




উজ্জ্বল রায়ের কবিতা

অন্য পথ

১.
পথের সমীপে রেখে আসি গোপন অশ্রু সম্পাত। 
পথ বড়ই আপন। এপথ ধরে পূর্বপুরুষের 
চলে যাওয়া দেখতে দেখতে 
অক্ষিগোলকের ব্যস রচনা হয়েছে একদিন। 
এ পথের ধূলোয় বিন্দু বিন্দু প্রহরের পাশে 
কীর্তনীয়ার পায়ে পায়ে আমার উঠোনের আলপনা, 
শালিকের, চড়ুইয়ের না-খোঁটা খুদকুঁড়ো, 
হরিধ্বনির সঙ্গে ক্রমশঃ ছোট ও
অস্পষ্ট হয়ে এসেছে একদিন, দেখেছি। 
এ পথের দুই প্রান্ত দৃষ্টি অগোচর, 
                                            কেবল করতাল সঙ্গত, 
এ পথের সমাগমে অন্তমিল কথা, 
জাতক কাহিনীকার, অন্য হাতছানি। 

২.
এ পথে ফিরে ফিরে দেখা, 
ফিরে না আসা বৃক্ষশাখে অমলিন পুষ্প রাগ কথা। 
এপথে সংপৃক্ত অজপা জপ মালা, 
ছিন্ন ভিক্ষাপাত্র, অসম্পূর্ণ মন্ত্র উচ্চারণ নিয়ে
জন্মান্তরে সাক্ষাতের ব্যর্থ প্রতিশ্রুতি। এ পথের
ভিক্ষান্ন থেকে অনির্বাণ আলো কল্প রূপকথার, 
শতচ্ছিন্ন বস্ত্রের গায়ে নিদাঘপীড়িত সময়;

এ পথের বাউল পরিপাটি জনান্তিকে স্থির।


নিরুত্তর

১.
যে কথা সঙ্গপনে হয়েছিলাে কখনাে মুখােমুখি,
কিংবা অহেতুক শুকনাে অর্জুন গাছের পাতা
                                              ‌‌                বিনিময়ে
টের পাওয়া গিয়েছিল হৃৎ স্পন্দনের মতাে
বাতাসের কলরব,
শিকারি পাখিদের ধারালাে চঞ্চুতে
সেও যে ক্ষতবিক্ষত হতে পারে, তুমি তাে বলনি
নীরব পৃথিবী!

সেসব স্পন্দন থেকে আজ যদি ঝরে পড়ে
সক্রেটিসের বিষাক্ত অন্ত্রের কণা, সূর্যোদয়ের নীচে
যদি পদপিষ্ট ভিক্ষাপাত্র তুলে ধরে ছিদাম কালিন্দী,
কিভাবে বােঝাবে তাদের
একই মৃত্তিকা দিয়ে পৃথক অবয়ব গড়ার বিফল
                                ‌                    কৌশল তােমার!

২.
খােলামকুচির মতাে ইতস্তত ছড়ানাে
মানব সভ্যতার দিনলিপি গুলি গােছাতে
ভুলে যাও কেন? শালুকের মতাে, গুগলির মতাে
বদ্ধ জলাশয় থেকে যদি এ প্রশ্ন উঠে আসে
বারবার, যদি শেষ অনুচ্ছেদের গায়ে জেগে ওঠে
ভূমিহীন কৃষকের ঋণগ্রস্ত লাঙল;
তবু কি ক্ষতশূণ্যই থেকে যাবে
তােমার চক্রাকার পরিক্রমার পথ!


ছড়া

প্রতুল মুখোপাধ্যায়


বেঁচে আর কী করবে গুরু,
শুনছে কে আর তোমার কথা?
মরলে তবু জুটতে পারতো
এক মিনিটের নীরবতা।

দাঁড়াও, একটু সবুর করো,
ঠিক এখনই মরতে চাইনে।
শুনতে পাচ্ছি নীরবতাও
পালন হচ্ছে অনলাইনে।

তবু বলছি যদি তুমি
বড্ড বেশি দেরি করো,
কখন চলে যাবে তুমি
রাখবেনা কেউ সেই খবর ও।
শুনতে পেলেও বলবে লোকে-----
"গেছে বুঝি? যেতে দিন
জানতামইনা ওই লোকটা
বেঁচে ছিল এতদিন"।

কী করে আর বলবো বলো,
উড়বে কখন,পরাণ পাখি।
থেকেও নেই এখন আমি।
ইচ্ছে হয়, না থেকেও থাকি।


অমিত সাহার কবিতা

ধুলোর মোহনা ছেড়ে

১.
ধুলোদেরও উপাচার আছে,
পথিক জানে কি?
সূর্য মুখাপেক্ষী গোধূলির মায়া
যেন ধুলোদের সৌধচর!
পায়ে পায়ে জড়ানো আগুন ঠেলে ঠেলে
পথিক নাবিক আর
সন্ধ্যাতারা ফোটে...
জল তো কামনা আনে শুধু!
নৌকা যেন আঘাত না পায়!
নদীটিও বয়ে যায় পথের ওপাশে
            যতটা সম্ভব ধীরে...
মাঝির ছেলেটি বলে
নৌকামাসি, দেখো বাবা যেন না যায় গভীরে!

২.
ওই দ্যাখো, গাছের পেয়ারা যুবতী হয়েছে
পাখির ঠোঁটের অপেক্ষায়...
পেয়ারা পাতারা হাসিখুশি
উৎসব লেগেছে ডালে ডালে।
পেয়ারাটির ধুলোপ্রেম পায়
পাখির অপেক্ষা...
ধুলো মানে সম্ভাবনা
ছাই হয়ে যাওয়ার নতুন আগুন!
সূর্যাস্তের মিহি মায়া মেখে
পাখিরা বাসায় ফিরছে, দেখেছ ফাগুন!




সুজিৎ দাসের কবিতা

১.
বাংলাদেশ

সমূহ কোলাহল থেমে গেলে নৈ:শব্দ্যের অতল থেকে
বেজে উঠে এক মন্দ্র সরোদ

ওই দ্যাখো
স্মৃতি ও দু:খের অসীম হাহাকার নিয়ে
মায়ের দীর্ঘ আঁচলের মতো
পড়ে আছে
সীমান্তের ধু ধু পথ ও প্রান্তর

আমার করুণ বাংলাদেশ ।

২.
আত্মপরিচয়

এখন ই সবকিছু বলা যাবে না। ইতিহাস ও নয় । এই ইতিহাস এক রূঢ় সত্যের কথা বলে। ইতিহাস চিরকাল এরকমই , সত্য বৈ তো অন্য কিছু নয়। ঠিক সে রকমই আমার আত্মপরিচয় । হাজার চেষ্টাতেও তাকে মুছে ফেলা যাবে না।

৩.
লিগ্যাসি

বটবৃক্ষের ও সে এক দীর্ঘ জীবন। তার ও , তার ও চেয়ে
আরও বহু যোজন গভীরে প্রোথিত আমাদের এই বিপুল চিহ্নরেখা ।


রাহুল পুরকায়স্থের কবিতা

১.
মৃত্যুর দিকে

গিয়েছি ভুলের থেকে আরও আরও ভুলের ভিতরে,
দেখেছি ফুলের পোকা নেচে নেচে গান গায়
                                         ফসলের ক্ষেতে,
আমি তো ভাগের চাষি,
                            শব্দের ফসলে তারা গুনি,
ঘর ভাসে, পথ ভাসে অনিশ্চিত
                               স্বরহীনতায়

এইরূপে ক্রমে ক্রমে কবিতা মৃত্যুর দিকে যায়


২.
শিল্প

আমার প্রস্তাব, তুমি উন্মোচিত হও
সহজ বৃক্ষের মতো তোমাকেও দেখি

এই কথা আমি আজ তোমাকেই বলি
এমন বর্ষার দিনে জাল ফেলি আমারই

কী কী উঠে আসে?
গতজন্ম, গতক্ষুধা, গতপ্রেম, গতহাহাকার

তৈরি করো আমার আকার


দেবাশিস চন্দের কবিতা

১.
আগুন

আগুন কি জানে অগ্নির ঠিকানা?
অগ্নি কি জানে আগুনের বসত?
আগুন কি পোড়ায় অগ্নি তা জানে?
অগ্নি কি পোড়ায় আগুন সে খবর রাখে?


২.
সম্পর্ক

ভেসে যাওয়া ডুবে যাওয়া
ডুবে যাওয়া ভেসে যাওয়া
           সমুদ্রখেলা নিরন্তর
 

৩.
অদৃশ্য

আলো পৃথিবীর কথা কেউ আর বলে না
অন্ধকারে আঁকা ভয়ের ডোরাকাটা দাগ
চোখ অস্থির, পাথরের মতো নিশ্চল মুখ 
দুয়ার আঁটা ঘরের বারান্দায় বসে থাকা
অদৃশ্য দ্বাররক্ষী শোঁকে বিদায়ের তর্জনী

 
শমিত মন্ডলের কবিতা

১.
জীবন পিপাসা

স্হলপদ্ম গাছের নিচে খাপ পেতে বসে আছে কেটু।
উদ্দেশ্য মহৎ নয়। একটু দূরে,সন্ধ্যামালতীর ঝোপে স্হির--- একটি গিরগিটি- শিশু। হায় নবীন এ প্রাণ ! সে বুঝেছে ঘাতক কাছেই। আপাত শান্ত ও‌ই বিড়াল শিকারে দড়। ছাতারে পাখির দল ভয় পায় ওকে।
সবুজ গাছের নিচে, সবুজ গাছের ঝোপে এভাবেই জীবন ও মৃত্যু ঘোরেফেরে।

২.
ছায়া,আলোছায়া

ডোবার জলে সাদাকালো মেঘের ছায়া।

পরিযায়ী শ্রমিকেরা সকলে‌ই নয়,কেউ কেউ ফিরে এসেছে স্বদেশে। সবে মাত্র আসা শুরু হয়েছে তাদের। অনেকেই এখনও পথে।যারা ফিরে এসেছে তারা বলছে পথের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। বিষাক্ত কীটনাশক ছুঁড়ে দিয়েছে তাদের গায়ে--- তাদের‌ই মতো মানুষ। আবার তাদের‌ই মতো মানুষ হাসিমুখে তাদের শিশুদের দিয়েছে দুটো- একটা রুটি।

এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা ভাবছে জীবনের চলাচলের কথা। এখন ডোবার জলের দিকে তাকিয়ে তারা দেখছে সাদা ‌ও কালো মেঘের ছায়া।




বলে দাও প্রিয় স্বদেশ

রুদ্র সুশান্ত

তোমার গায়ে আগুণ লাগলে তবেই কি তুমি সুখে থাক? প্রিয় স্বদেশ।

তবে বলে দাও,
দাও বুক ছিঁড়ে শিখা লেলিয়ে,
তোমার অহংকারে জ্বলে যাক,
ঘুমন্ত শিশু
মৃত ঈশ্বর, দূর্বাঘাস, রমনীর ঠোঁট,
যুবকের পেশী,
কিংবা পুড়ে ভষ্ম হোক... ... নগর, নগর,
সহস্র অট্টালিকা।

বধু বরণের ঘরটা পুড়ে গিয়ে হোক শ্মশান,
শ্মশানঘাটে আগুন জ্বলুক তোমার কলিজার।

তুমি কি তাতেই আনন্দ পাও(?) প্রিয় স্বদেশ।
তবে বলে দাও,
আমরা আগন্তুক হই, তোমার কেউ নই
তোমার বক্ষ আমাদের লালন করেনি,
আমাদের ধারণ করেনি, করবে না।

আসমানে সর্বময়ীর আরশ ছিদ্র করে দিব,
বুক পেতে নিব অদৃশ্য দুঃখ, ঈশ্বরের কান্না।

বলে দাও, প্রিয় স্বদেশ ----
সংখ্যালঘুরা তোমার সন্তান নয়,
চামচিকা এসে লাথি মেরে যাক ওষ্ঠে,
ঘৃণা হোক তোমার অহংকার।

তুমি বুক পেতে নাও কথিত ধার্মিকদের,
যার... ... মুখোশ পরে সহস্রবার তোমার হৃদকমলে আঘাত হেনেছে।
তোমায় ছিন্নভিন্ন করার জন্য এখনো উদ্যত,
এখনো বিশ্রী সুযোগের অপেক্ষারত।

তবে বলে দাও,
সংখ্যালঘুরা কেহ নয়।
রাতের অন্ধকারে তাদের মস্তক ছিঁড়ে তুমি রক্তগঙ্গায় স্নান করো,
শাব্বাশ দিবে আকাশের দেবতারা,
তুমি গাল খেলিয়ে হাসিও।

বলে দাও, প্রিয় স্বদেশ।


সুপ্রিয় দেওঘরিয়ার কবিতা

১.
পূজা


নৈবেদ্য সাজাও

আতপ ছড়িয়ে দাও

দেখো ঈশ্বর কালিন্দী ঢোল বাজায়

মালতী দাস তার ফুলের ডালি আর
খঞ্জীপোসে রেখে দিয়ে যায়

কোমল অর্চনা 

২.
হাজারিবাগের লেখাগুচ্ছ 


সাইকেলের চাকার ঘোরে শহরটা ঘুরত আমার ছোট্ট পৃথিবীতে। শহরের মাঝে কোঁকড়ানো দুটো তেঁতুল গাছের ফাঁকে সিনেমার পোষ্টার আর সব্জী আড়তের মাঝে উঁকি দিত দূরের পাহাড়ের রেখা। বৃষ্টির দিনে রাস্তাগুলোর পাশে জলের নালা বয়ে যেত। রাতগুলি তখন বড়ো মোহময় -বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি, ভেতরে লোডশেডিং, ক্যাণ্ডেলের আলো। রাতভর হইচই। বহুতলের লাইটগুলো জ্বল-জ্বল করত, পাল্লা দিত আকাশের তারার সাথে। পাশের দোকানের গরিব কর্মচারী তিওয়ারী তখন উনুনে ধূপ আর জল দিয়ে ঘুমোতে যেত। ভোরে আবার পুরি আর চোখা বানাতে হবে যে!


মেয়েদের হস্টেল আর হস্টেলের মেয়েরা

মধুপর্ণা কর্মকার

নারী শিক্ষা সূত্রপাতের বন্ধুর পথ পেরিয়ে যখন মেয়েরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে শুরু করল এমনকি বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় অন্য জেলায় অন্য রাজ্যে গেল পড়াশুনার জন্য, সেইখানে থাকতে শুরু করল বছরের পর বছর, ক্রমে মেয়েদের হস্টেল হয়ে উঠল তাদের জীবনে তথা সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সেখানে  শুধু তারা  পরিবার ছেড়েই থাকছে না, নতুন জায়গা- নতুন শহর দেখছে, বিভিন্ন মানুষজনের সংগে মিশছে, পরিবারের কয়েকটি ভুমিকার বাইরে গিয়ে পড়াশুনার মধ্যে দিয়ে নিজেদের চিনছে। এই সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে যেমন বদলে যাচ্ছে, তেমনি ধীরে ধীরে ঘটছে একটি সামাজিক রূপান্তর। এদেশে মেয়েদের আবাসজীবন খুব বেশিদিনের পুরোনো নয়, নারী শিক্ষার সমান্তরালে প্রায় দেড়’ শ বছরের কি তারও কম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেই প্রথম যুগে যে কয়েকটি মেয়েদের হস্টেল তৈরী হয়েছিল বিশ্বভারতীর ‘শ্রীসদন’ (১৯০৯ সাল) তাদের মধ্যে একটি। নানা প্রতিবন্ধকতার পাহাড় পেরিয়ে যাঁরা শিক্ষালাভের জন্য পরিবারের নিগড় কেটে বাইরে আসতে পেরেছিলেন সেই নারীরাই সমাজকে এগিয়ে দিয়েছিলেন কয়েক ধাপ। আবদ্ধ গার্হস্থজীবন থেকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে নারীর পরিচিতির ইতিহাস বেশ প্রতিকুলতার।  পরিবারের বাইরে  ভিন্ন একটি সামাজিক পরিসরে নারীর বসবাস-  এই বিষয়টা মেনে নিতে এবং অভ্যস্ত হতে অনেক সময় লেগেছিল পুরুষশাসিত সমাজের। নির্ধারিত কিছু পারিবারিক ভূমিকার বাইরে হস্টেলে এসে তারা নিজেদের দেখল নতুন ভূমিকায়। নিজেদের দেখল, অন্যদের দেখল, পরস্পরকে দেখল। একদিকে পড়াশুনা করার নতুন অভিজ্ঞতা অন্যদিকে পরিবারের বাইরে সমবয়সীদের সাথে থাকার অভিজ্ঞতা। এর ভিতরেই  নতুন সাপেক্ষতায় ঘটল নারীর আত্মআবিষ্কার। নারীর সামাজিক ভূমিকায় এল বদল, শুধুমাত্র গার্হস্থ্য জীবনে কন্যা, স্ত্রী, মাতা এই ভুমিকার জায়গায় দেখা দিল নতুন  পরিচয়, তারা ছাত্রী, তারা আবাসিক। সাংসারিক কাজকর্ম ছাড়াও তাদের এখন নতুন কাজ পড়াশুনা, যে মগজে কেবলই গৃহকর্ম আর পরিবারের সদস্যদের পরিষেবা দেবার চিন্তা পাক খেত সেখানে ঘটল তুমুল পরিবর্তন, বাইরের পৃথিবী, অনেক মানুষের সঙ্গে, আলাপ তাদের সাহচর্য জন্ম দিল নতুন মননশীলতার, চর্চিত হতে থাকল নতুন জগত, আর সম্ভবনাময় ভবিষ্যতের কথা। পারিবারিক কয়েকটি সম্বন্ধ ছাড়াও মেয়েরা পরিচিত হল আরো নানা মাত্রার সম্পর্কের সঙ্গে।  বদলের এই সন্ধিক্ষণ খুব সাবলীল ভাবে আসে নি।
                পরিবার ও হস্টেল একই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর অন্তর্গত দুটি প্রতিষ্ঠান। তারপরও দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। হস্টেলে সমবয়সী বা প্রায় সমবয়সীদের সঙ্গে বেড়ে ওঠে ছেলেমেয়েরা। পরিবারের প্রত্যক্ষ নজরদারীর বাইরে তাদের নিজস্ব জীবনবোধ তৈরি হয়।  ধীরে ধীরে নিছক পড়াশুনা করার জায়গার থেকেও হস্টেল আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। যা ছাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গি  মানসভূমি নির্মাণে বিশেষ ভুমিকা নেয়। হস্টেল জীবনের প্রভাব থেকে যায় সারাজীবন। পরিবারের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার বিকল্প হিসাবে দেখা দেয় হস্টেলজীবন। মেয়েদের হস্টেলে  থাকা ও পড়াশুনা করার মধ্যে একটি বিশেষ মাত্রা আছে যা তার অস্তিত্ববোধের সঙ্গে, চেতনার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এত বিশাল এক একটা বাড়ি, তার মধ্যে শত শত মেয়েরা একসাথে থাকে, সামাজিক অবস্থান ভেদে প্রত্যেকের রুচি আলাদা, বোধ আলাদা, উদ্দেশ্য আলাদা, সমস্যা আলাদা, প্রতিকুলতা আলাদা, তা থেকে রেহাই পাবার সংগ্রাম আলাদা। গ্রাম থেকে মফস্বল থেকে মেয়েরা শহরে আসছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। তাদের শ্রেনী, ধর্ম, জাতি, বর্ণ সবই আলাদা। কিন্তু তারা হস্টেলে নিচ্ছে একত্রবাসের পাঠ। এই একত্রবাসে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে, সমঝোতা করতে শিখছে, পাচ্ছে স্বাধীনতার স্বাদ। শুধু তাই নয় প্রচন্ড রক্ষনশীল পরিবারের মুসলিম পরিবারের মেয়েটি এখানে এসে পাচ্ছে ধর্মীয় জীবন যাপন না করার অবকাশ। নিজের পছন্দের পোশাক পরার অবকাশ। অত্যন্ত অস্বচ্ছ্বল পরিবারের মেয়েটি এখানে পাচ্ছে একটা পড়ার জায়গা, পড়ার টেবিল, নিজের জন্য  সময়। এমনকি অনেকে হস্টেলে এসে প্রথম ব্যবহার করছে শৌচাগার, আলো, পাখা। পরিবারের কাজে ,পরিবারের জমিতে চাষের কাজে সময় দিতে গিয়ে যার সময় থাকত না পড়াশুনা করার সেই  মেয়ে হস্টেলে এসে পাচ্ছে পড়ার অবসর। বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় তারা সমৃদ্ধ হচ্ছে, নিজেদের ইচ্ছা অনুভূতির প্রকাশে ধীরে ধীরে অকপট হয়ে উঠছে। সামাজিক গোঁড়ামি, কুসংস্কার ইত্যাদি থেকে নিজেদেরকে বের করে নিয়ে তারা নিজেদের জীবন নির্মাণ করে তুলছে। ছেলেদের হস্টেলের তুলনায় তাদের হস্টেলে কেন ভিন্ন নিয়ম চর্চা হবে, নিয়মে কেন বৈষম্য থাকবে  - আরো অনেক দাবী নিয়ে ভারতের নানা প্রান্তের হস্টেলের মেয়েরা আন্দোলনে সামিল হচ্ছে। সার্বিকভাবে আবাসিক মেয়েদের  জীবনের উদযাপনে হস্টেল আগেও যেমন ভূমিকা নিয়েছে, অনেকখানি এখনও নিয়ে চলেছে।




 ছবি - বিশ্বভারতীর প্রথম মেয়েদের হস্টেল ‘শ্রীসদন’( প্রতিষ্ঠা -১৯০৯ সাল)। প্রসঙ্গত বলি এই হস্টেলে আমার প্রথম আবাসজীবনের সূচনা আর কেটেছে বেশকিছু বছর। 




সম্পাদক : উত্তম মাহাত
আয়োজক : অনিকেতের বন্ধুরা
লাইন ড্রয়িং : দেবাশিস সাহা
যোগাযোগ- হোয়াটসঅ্যাপ ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল-uttamklp@gmail.com
  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪