প্রথম বর্ষ ।। দ্বাদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ৪ মাঘ ১৪২৭



ভয়ঙ্কর করোনার দু'দুটা সুদ্ধ ভারতীয় ভ্যাকসিন আসায় স্বস্তির নিশ্বাস নিল সরকার। আর যাই হোক, বিরোধীদের, সবচেয়ে বড় কথা সাধারণ মানুষের সামনে কিছু একটা বলার সুযোগ এলো আগেভাগে। একুশের ভোটের আগে রামলালা তাকালেন। তীরে এসে তরী ডোবার অমঙ্গুলে ঘটনাটা ঘটতে ঘটতে ঘটলো না। কি যে জবাব দেওয়া যায় এতশত মৃত্যুর, এই ভাবনাটা কুরে কুরে খাওয়ার আগেই জবাব এনে দিলেন তিনি। বা রে কপাল! একেই বলে সৌভাগ্য।
          স্বস্তির নিশ্বাস কি ফেলতে পেরেছেন সাধারণ মানুষ? ভ্যাকসিন নেওয়ার মতো করে তৈরি কি হয়েছেন তাঁরা? নাকি খেটে খাওয়া মানুষের শরীরকে সেইভাবে হাইজ্যাক করতে পারবে না করোনা এই বিশ্বাসে নিশ্চিন্ত হয়েছেন তাঁরা?
          ঘটনা যাই হোক, যেদিকেই গড়াক, স্বস্তির নিশ্বাস দেখা যাচ্ছে সমস্ত পলিটিক্যাল শিবিরেই। মিটিং, মিছিল, রেলি, বাইক মিছিল আর সামাজিক, ইলেকট্রনিকস বাকি সব মাধ্যমে প্রচার চালানো যাবে অনায়াসে। এটাই খুশির হাওয়া। কি আর চাই?


উত্তম মাহাত, সম্পাদক




বাঁদর নাচের গানে জীবন-জীবিকার ছবি

                      তপন পাত্র



এখন হাজার মনস্তাপে মাথা কুটলেও তাঁদের আর খুব একটা দেখা মেলে না । আজ থেকে দশ-পনের বছর আগেও দু'চারজন নজরে আসতেন । বিশেষ করে কৃষকের ক্ষেতের ধান খামারে , খামার থেকে ঘরে এলে এরা বাঁদর নাচ দেখিয়ে দেখিয়ে এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন ।
                 
                      পশ্চিমবাংলার পশ্চিম-সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বীরহোড় উপজাতির একটি শাখা যাযাবরের মতো জীবন যাপন করতেন । এই উপজাতিদের বৈশিষ্ট্য ছিল, এরা বন জঙ্গল থেকে বাঁদর ধরতেন , বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঁদর সংগ্রহ করতেন ; তারপর সেই বাঁদর-বাঁদরিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নাচ শিখিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে নাচ দেখিয়ে বেড়াতেন । ভিক্ষা করতেন । সেই বাঁদর নাচানোর জন্য বাঁধা হত নতুন নতুন গান । সেই গান উঠে আসতো তাঁদের জীবন-জীবিকার অন্তর্স্থল হতে । কারণ গানগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেগুলি জীবন-জীবিকার সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত ।

             তুলনামূলকভাবে বাঁদর নাচের সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা অল্প । বাঁদর নাচের গানের সংখ্যাও বড়ই স্বল্প । এইগান আসলে পটগান, সাপ খেলানোর গান, পুতুল নাচের গানের মতোই জীবিকাশ্রয়ী গান । এক বিশেষ আর্থ-সামাজিক পরিবেশ থেকেই গানগুলি উঠে এসেছে বা তৈরি হয়েছে ।


         বাঁদর নাচের সর্বাপেক্ষা পরিচিত গানটি আজও  এই অঞ্চলের অনেক গ্রামীণ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মুখে মুখে ফেরে । তাঁরা নাতি-নাতনিদের সঙ্গে রঙ্গ-তামাশা করতে করতে গেয়ে ওঠেন । অনেক সময় বাবা কাকারাও তাঁদের ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে হাস্য-কৌতুকের ছলে এই গান গেয়ে বসেন । গানটি হল ---

      "নাচ বাঁদরি নাচ
       পয়সা দিব পাঁচ ।
       আর্-অ দিব এক মুঠ চাল
       ঘুরে ঘুরে নাচ ।

       কী খাবার মন বাঁদরি
       কী খাবার মন ,
       হাটের্-অ চিঙ'ড়্ মাছ   
      বাড়ির্-অ বাগ'ন ।।"

            গানটিতে বা'জকার 
বাঁদরিকে উদ্দেশ্য করে যা বলতে চেয়েছেন, তাতে তাঁর নিজের জীবনকথাই বলা হয়ে গেছে । যে সমাজ ব্যবস্থায় তার দু'মুঠো ভাতের একমাত্র পথ বাঁদর নাচ দেখিয়ে বেড়ানো , সেখানে অতি আদরের ধন বাঁদরিকে বলছে , নাচলে পয়সা পাবে । এক মুঠো চালও পাবে । সামান্য পয়সার বিনিময়ে হাট থেকে কিনে আনবে চিংড়ি মাছ আর বেগুন । তাই দিয়ে তরকারি বানাবে । এখানে যেন 'বাঁদরি'--এই ছদ্মনামে তাঁর ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পেটের ক্ষুধা বাঁদরটিকেই আশ্বস্ত করা হয়েছে ।

              আলোচিত গানটি বহুকালের প্রাচীন । তুলনায় অর্বাচীনকালের একটি গান উল্লেখ করা যেতে পারে ; যে গানটি ওই পুরাতন গানেরই নবতর সংস্করণ বলে মনে হয় ---


    "নাচ বাঁদরি নাচ 
     কুঁঢ়া খাঁইয়েই বাঁচ ,
     ফল-পাকু'ড় সব ফুঁরাই গেল 
     নাই রে হাতের পাঁচ ।     

    কী খাবার মন বাঁদরি
    কী খাবার মন ,
    কাটে-কু'টে ফুরাঁই গেল
     ক্যাঁদ ভুড়রুর বন ।।"

    পশ্চিম-সীমান্ত-বাংলার খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ একসময় নানারকম বনজ ফলমূল এবং তা থেকে তৈরি সাধারণ মানের খাবার খেয়েও দিনাতিপাত করতো । ক্রমে সেই বন  ফুরিয়ে এলো । বসত বাড়লো । তথাকথিত সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে অরণ্য নিধন হলো ।"... ফুরাঁই গেল ক্যাঁদ-ভুড়রুর বন "। ক্ষুধা নিবৃত্তির "হাতের পাঁচ" অর্থাৎ নিতান্তই শেষ সম্বল যা ছিল এই জঙ্গলমহল এলাকায় , সেই "ফল-পাকু'ড়  সব ফুরাঁই গেল ...।"

         পশ্চিম-সীমান্ত-বাংলা থেকে ক্যাঁদ-ভুড়রু-পাকু'ড় গাছ ক্রমশ বিলীন । দুঃখ জাগে মনে । বনের ফলমূল ছিল বলিষ্ঠ ও উপাদেয় খাবার ।  ক্যাঁদ থেকে ছাতু তৈরি হয় ---' ক্যাঁদকুঢ়া ', যা অতি সুস্বাদু ও লোভনীয় খাবার । তা নেই আর । তাই সাধারণ ছাতু অর্থাৎ নিম্নমানের কোনও ধান , গম থেকে তৈরি ছাতু খেয়ে জীবনধারণের কথা বলা হয়েছে ।


              অঘ্রাণ-পৌষ-মাঘ-ফাল্গুন ---এই চারটি মাস সীমান্তবঙ্গে মোটামুটিভাবে স্বচ্ছলতার মাস । তাই এখানে এমন লোকপ্রবাদের জন্ম হয় --"পৌষ মাসে চু'টারও সাতটা বহু" । এই অতুলনীয় প্রবাদটির তাৎপর্য বিশাল ! তবে নির্যাস এটুকুই যে , এ সময় সাধারণত অভাব থাকে না । সর্বশ্রেষ্ঠ সামাজিক অনুষ্ঠানের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় মাঘ ও ফাল্গুন মাস । নতুন ধান উঠেছে অগ্রহায়ণ মাসে । ঢেঁকি ছাঁটা চাল প্রস্তুত । ফাগুন মাসে বিবাহ অনুষ্ঠান । চৈত্রমাস ফি-বছরই মলমাস । তখন আর বিবাহের মতো পবিত্র সামাজিক অনুষ্ঠান হবে না । 
            ---এসব কৃষিনির্ভর বাংলার আর্থ-সামাজিক প্রসঙ্গ চলে এসেছে বাঁদর নাচানোর গানে ।

      " আঘন কুটা ছাঁটা চাল
       ফাগুন মাসে বিহা ,
       চৈৎ মাসের বাউ প'ড়ল্য
        নাই হ'ল্য বিহা ।। "

                  আর একটি গানে অভাব-অনটনের বাস্তব চিত্র । ক্ষুধার জ্বালায় সেদ্ধ-ধান শুকিয়ে ভাতের চাল প্রস্তুতের অবকাশ নেই । ক্ষেত থেকে ধান কেটে এনে ঝেড়ে শুকিয়ে আতপ চাল তৈরি করে তা-ই সিদ্ধ করে খাবার ব্যবস্থা । আতপ চাল কে এই এলাকার মানুষ "আলোচাল" বা "আলচাল"  বলে , উজ্জ্বল শুভ্র বর্ণের জন্য । আবার হ'তে পারে এই চাল দ্রুত ক্ষুধার অন্ধকার দূর করতে পারে ,সেই কারণে । আতপ চালের ভাতের সঙ্গে সবজি বলতে "কানা শাক",  ক্ষেতে খামারে আপনি গজিয়ে ওঠা এক ধরণের ভোজ্য পত্র । অনেকে একে বলে --- "কানছিঁড়া শাক "।

          "আল চালের মাড় রাঁ'ধেছি 
 কানা সাগের বেসাতি ,
  সাঁঝেরবেলা দেওয়র শালা
   লুচকাঁই খায় বেসাতি ।।"

         অভাব থাকতেই পারে, তবুও একান্নবর্তী পরিবারে দেবর-বৌদির মধুর সম্পর্কটি ফুটে উঠেছে এই গানে ।

      আবার সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তনের, আধুনিকতার ছবিও ধরা পড়েছে এইসব ছোট ছোট গানের মধ্যে । পশ্চিম-সীমান্ত বাংলা , তথা পুরুলিয়ার মানুষ বর্ধমান যায় ক্ষেত মজুরের কাজ করতে । সম্ভবত বর্ধমানে যখন বিধবা বিবাহের প্রচলন শুরু হয়েছিল,  তখনও পুরুলিয়ায় তার প্রভাব পড়ে নি ‌। বাঁদর নাচের গানে সেই প্রসঙ্গটি এসেছে এইভাবে ---

    "আম ফলে থকা থকা
    তেঁতুল ফলে বাঁকা,
    নামাল দ্যাশে দে'খ্যা আ'লম্
    রাঁঢ়ীর হাতে শাঁখা ।।"

             বলা তো মুশকিল  --- নারীর প্রথম বিবাহ আমের সাথে আর স্বামীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বিবাহ তেঁতুলের সাথে তুলনীয় কি না ! তবে "নামাল দ্যাশে" অর্থাৎ "পূব দেশ" তথা বর্ধমান এলাকায় বিধবা বিবাহ দেখেই এই গানটির সৃষ্টি --এই অনুমান বৃথা নয় ।

       এইসব গান আর সৃষ্টি হয় না , মানুষের মুখে মুখে ফেরে না । সেই বাঁদর-বাঁদরি আজ আর খুব একটা নজরে আসে না । যাযাবরদের সেই রূপে দেখা মেলে না বললেই চলে । কোন কোন "বা'জকারে"র সঙ্গে সঙ্গী হিসাবে দু'একটি বাঁদর থাকলেও তারা আর নাচ দেখিয়ে বেড়ান না । কথা বলে দেখেছি, বাঁদর নাচানোর গানও তাঁদের এই প্রজন্মের স্মৃতিতে-সংস্কৃতিতে নেই , নাচের আঙ্গিক ও গতি-প্রকৃতি নিয়েও তাঁরা মুখ খুলতে নারাজ । বাঁদর নাচ এখন এক ইতিহাস মাত্র । গানগুলিও লুপ্তপ্রায় । অথচ গানগুলির শব্দে শব্দে কৃষিভিত্তিক পশ্চিম-সীমান্ত-বাংলার আর্থ-সামাজিক জীবনের ছবি সুচিত্রিত । সময়ের সাথে সাথে যাযাবরদের জীবন ও জীবিকার বদল ঘটে গেছে । এটাই বাস্তব । এটাই মহাকালের নিয়ম । তথাকথিত উচ্চতর সভ্যতার আলোর ঝলকানিতে প্রাচীন লোকজীবনের সংস্কৃতি টিকে থাকতে পারে না । টিকে থাকা সম্ভব নয় । বড়জোর কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার একটি কৃত্রিম রূপ কিছুকাল রক্ষা করা সম্ভব।



যৌথতা ভেঙে যায় (নবম কিস্তি)

নির্মল হালদার

কখনো কখনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। মনে হয়, কি মধুর কি মধুময় দিন।
            আজ যেমন, চন্দন ও তনুজা তাদের দু' বছরের মেয়ে তরজমাকে নিয়ে এসেছিল।
             চন্দনের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে, হোয়াটসঅ্যাপ। সেও মাঝেমধ্যে। সম্পর্কের ধারাবাহিকতা নেই। কিন্তু সে যে আমার প্রতি একটা চোরা টান অনুভব করে, আমি টের পাই।
             দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে আমার জন্য সংগ্রহ করেছিল একটি ঝোলা ব্যাগ। যেদিন দিতে এসেছে, আমি তো অবাক। কেন না তার আগে তার সঙ্গে 
বিন্দুমাত্র ফোনাফুনি হয়নি। এখনো তাই। পুজোর আগে আসতে পারেনি বলে, আজ আমাকে দিয়ে গেল লুঙ্গি পাঞ্জাবী এবং টাকা।
              ঢাকঢোল পেটানো যৌথতায় এবং সম্পর্কে না থেকেও আমাকে রেখেছে তাদের সঙ্গে।
             চন্দন আমার কাছে কোন কিছুই আশা করে না। সেই কবে সাধনের মাধ্যমে তার সঙ্গে আলাপ। প্রায় ১০/১২ বছর হয়ে গেল। সেই আলাপ সম্পর্কে বেঁধেছে। ভালোবাসায় বেঁধেছে। নিঃশব্দে।
             তো আজকে চন্দনের আগমন যেন বা সকালবেলায় আমার ললাটে চন্দনের ফোঁটা।
             যাদের কাছে যৌথতা বোধ দিতে চেয়েছিলাম, তারা নিজের নিজের জায়গায় বিচ্ছিন্নতাবোধ নিয়ে কাজে-কর্মে ব্যস্ত। অন্যদিকে চন্দনরা যে সুতো
বুনন করেছে তার ও আমার মধ্যে, আশা করি অটুট থাকবে।
             বিশ্বজিৎ মাহাত যখন পাড়া স্কুলে এগারো ক্লাসে পড়ছে, তখন তার সঙ্গে পরিচয়। তার সুবাদেই, শুভ্রনীল রায় তাপস চক্রবর্তীকে পেয়েছি। আজ বিশ্বজিতের সঙ্গে শুভ্রনীলের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। তারা কোথায় থাকে কি করে, কিছুই জানা নেই আমার। কিন্তু তাপস বা তাতান আজও আমার সঙ্গে ।তাতানের সঙ্গে নিয়মিত মনের আদান-প্রদান। সে এখন কাজে ব্যস্ত হলেও বছরে এক কিংবা দু'বার আমার কাছে এসে ঘুরে যায়। যখনই আসে আর্থিক সাহায্য করে। তাহলে বলতে পারি, ঘোষিত যৌথ-খামারের কোন মূল্য নেই। অঘোষিত যৌথতায় আমি আজো বেঁচে আছি।
             চুনারডি থেকে এসেছিল  স্কুলের ছাত্র প্রভাস মাহাত। সে আজ এক সন্তানের পিতা। তার সঙ্গেও আমি আজও আছি। অথবা সে আমার সঙ্গে আছে আজও। কোজাগরী পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ তাকে জানালাম, তোর কাছে যাচ্ছি।
              বিশু বাপি আর আমি চলে গেলাম। জোসনার মাঠে সবাই মিলে পান করেছি, জোসনার ধারা। প্রভাস বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল রাতের খাবার।
              এই প্রভাসও আমার কাছে কিছুই প্রত্যাশা করে না। বরং কাজে-অকাজে শহরে এলে, আমার কাছে এসে দু'দণ্ড বসে যায়। সঙ্গ দিয়ে যায়।
              অন্তর থেকে অন্তরে ভালোবাসা বহমান হলেও সব সময় সব জমিতে ফসল ফলে না। কোথাও কোথাও কারোর ভেতরেই শুধু বইতে থাকে প্রেম ভালোবাসা। আমরা শব্দ পাই না।
              চোখের জলেরও কোনো শব্দ নেই। অথচ, কখনো কোথাও চোখের জলই হয়ে ওঠে আগুন।


                                             (চলবে......)


গরিয়সী

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়


সমস্ত রং নিয়েই বস্তুত অমর্ত্য দোলাচলে
উত্তরায়ণ থেকে দক্ষিণায়ণে পায়চারি করছে
রােদের পদধ্বনি

শীতকাতুরে মানুষও বড়াে একটা দেখা যাচ্ছে না,
যে-জামডু সাপ একদিন ইস্পাত-বর্ণের প্রথম পুরুষ
হয়ে উঠবে দেখা নেই তারও

দর্শন নেই বলেই ঈশ্বর সারাক্ষণ অদৃশ্য
আর সমস্ত শস্যই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গেছে
অসামাজিক রূপে

ধান্যক্ষেত্র ইক্ষুখেত সকলই অনিয়তাকার

ফসল নিগৃহীত না হলে হাতিচলা পথের সন্ধান
পাওয়া বড়াে যে অসম্ভব
হাঁসের পথ গৃহস্থে উঠে না এলেও চিন্তা

স্বর্গের রাস্তায় গা গুলিয়ে পড়ে গেলেও মুশকিল

আমাকে ডিঙিয়ে চলে যাবে
কুকুর-পায়ের জলছাপ

কারণ স্বৰ্গটা পৃথিবীর চেয়েও আদিম...


বড়দিন

উজ্জ্বল রায়


আলাে ফুটার আগে
দু-দশ টাকার শাক-পাত বিকতে যাওয়া
                                               ইস্টিশনের হাটে,
বারােমাস গাে, বাবু বারােমাস, তিরিশ কাল,
ছিঁড়া কাপড়ের ফাঁকে ফাঁকে
ঢাকতে লারি প্রসূতি যৌবন, কাঁসাই-কুমারীর
বালিতে ফাটা পায়ের রক্তদাগের পাশে
বাবুদের বনভুজনার এঁঠো পাতপালা পড়ে থাকে,
ডিঙাতে ডিঙাতে কবে যে মুছে গেছে
                                    সধবা আলতা, টের পাই নাই
দিন আসে দিন যায়,
ছােট-বড় বুঝতে লারি, বাবু গাে!
নুনুটা কাঁদতে কাঁদতে চুপ করে, বাবু,
আমার বুকের দুধ বুকেই শুকায়।


জগন্নাথ দত্তের কবিতা

১.
প্রশ্নপত্র


আক্রান্ত শিশুর দিকে
ছুঁড়ে দিচ্ছি প্রশ্ন পত্র
জাতীয় পশুর নাম,
ফুল ও পাখীর নাম
লিখে ফেলছো দ্রুত
                         উত্তর পত্রে তুমি।
 
আক্রমণে দেওয়ালে ঠেকিয়ে পিঠ
বাধ্য শিশুর মতাে বাড়িয়ে রেখেছাে হাত
আক্রমণ বদ্ধতার-দেওয়ালের,
দেওয়ালের ভেতর থেকে আরেক দেওয়াল।

উত্তর পত্রে তুমি লিখে ফেলছে
ফুল ও পাখীর নাম
তৎসহ যাবতীয় উত্তরগুলি দ্রুত
প্রশ্ন তবু, চিনেছাে কি প্রকৃতই
                                     এ মাটির ঘ্রাণ !


২.
হেমন্ত


এখন হেমন্ত---  
তাই ফসলের গান
এখন নতুন ধ্বনি এসেছে সন্তান
নামাঙ্কন এখনও বাকী
খুঁজে ফিরি নাম
আকাশ সমুদ্র কিংবা নক্ষত্রের ভীড়ে
খুঁজে আনাে নাম তার
ঝুলিয়ে রেখেছি ফলক
এসো তাতে ভ'রে ফেলি
                            আগতের নাম।



শ্যামাপদ মাহাতোর কবিতা

১.
গনেশ


সুদর্শন খুড়া গনেশ নাচে
চার চারটা হাত
মুখে শুঁড়

নাচতে নাচতে 
তারও মনে পড়ে
হরপার্বতীর কথা,
লক্ষ্মী সরস্বতী র মুখ

কার্তিক বুক চিতায় আসর সামালে 
হদকে উঠে উয়ারও বুক।

মুখোশ খুললে মনে হয়
বিধবা মায়ের দুখ


পালা শেষে পয়সা পাই যত
রিঝ কুড়াই 
তার চেয়ে অনেক বেশি।

ই বছর আসর নাই
পোশাকের ঝলমলানি নাই
পোশাক ও মন 
সব  ঘুণপোকায় খেয়েছে।

ইঁদুর টা যে কতদূর গেল কেজানে
মহুল্যার সাথে উয়াকেও গিলেছি নাকি?
 
উ হয়তো আসর পৌঁছিল,
আমার আর আশা নাই


২.
কার্তিক


বর্ষা হলে
কাম জাগে,

ময়ূর নাচে
পেখম তুলে

আমার ময়ূরের কাম নাই,
আছে রিঝ

রিঝে রিঝে পিঠে চাপায়
আমিও নাচি,সেও নাচে

বর্ষা না হলে বাঁধও শুখায়
আখড়া না হলে মনও দুখায়।


৩.
সাধনা


সমস্ত সম্পর্কের জালে
     জল হতে হয়

জালের সমস্ত ফাঁক
            সমস্ত গিঁট
  চিনে নিতে হয়

আকাশ চিনতে সমস্ত মেঘকে
               জল হতে হয়
                      বারবার

আজীবন 
আকাশের সাধনা আমার।



সুজন পাণ্ডের কবিতা


ব্যবসা, বানিজ্য ও দরদাম

১.
অনেক রাত্রে
যখন জোনাকিরা ঘুমিয়ে পড়ে
যখন চাঁদ নেমে আসে কার্নিসে
আমি দুই আঙুলে আকাশ ছুঁই
কিছুটা হিম
কিছুটা বিষাদ

ভর দুপুরে
যখন শ্বাপদের জীভ চাটে শুকনো ঠোঁট
যখন ফুটপাথ জুড়ে ক্লান্তির রোদ
আমি হাত রাখি পৃথিবীর বুকে
কিছুটা তাপ
কিছুটা অবসাদ

পৃথিবীর অবসাদ
আকাশকে বিক্রি করে
কিনে আনি তার বিষাদ পৃথিবীর কাছে....

প্রতি শ্রাবণে
 বর্ষা নামে


২.
আমার উঠোন জোড়া এক প্রকাণ্ড কাঁঠাল গাছ 
দাদু লাগিয়ে ছিলেন, তাঁর বিয়ের প্রথম বার্ষিকীতে 

এক শীতের দিনে কিছু তোতা পাখি এসে বসলো সেই গাছে 
আর এলো ভারী বুট পরা একদল হনুমান 

একটি তোতা বললো 
গাছে যেহেতু ফল নেই তাই এই গাছ ফালতু 
শুনে আরেকটি বললো 
ফল হলেও তার গন্ধ ভালো না... 
অতএব গাছটি এক্কেবারে ফালতু 
দলের সর্দার তোতা বললো 
ফলটি খুব ঝামেলার.. 
কোয়া বেছে খাওয়া খুব দুষ্কর 

অতঃপর সিদ্ধান্ত হল গাছটি কেটে ফেলার 
হনুমানের দল তৎক্ষণাৎ কাজ সমাপন করল

বিকেলের দিকে দেখা গেল 
একদল পাঁঠা মহানন্দে কাঁঠাল পাতা খেতে খেতে তোতা ও হনুমানের গুনগান করছে


৩.
এই মাটি
এই আশীর্বাদ আমার
আমার পূর্বপুরুষের পায়ের ছাপে
আমার ভালোবাসার দুই হাত এখানে

আমার ভালোবাসার ওজন হয় না
আশীর্বাদের মজুত-দার হয় না



দর্পন


কারোর চলে যাওয়ায় আমি
দুঃখিত নই
কেউ আসবে ভেবে 
আনন্দও পাইনি বিশেষ

কয়েকটি সন্ধে আমার এমনি কেটেছে
একা, জোনাকির খোঁজ করে

কয়েকটি ভোর আমার এমনি কেটেছে
ছাদে, শুক্ তারার খোঁজ করে

আমার পুরোটাই আমি
তাই নিজে আমার খোঁজা আলোক বিন্দুটি হওয়ার চেষ্টা করিনি কখনো



দেবজ্যোতি রায়ের কবিতা


বিরহ


মধ্য রাত আর মধ্যিখানে নেই

শোয়ার ঘরের জিরো পাওয়ারের বাল্ব
বাইরের জমাট অন্ধকারের থেকেও স্বার্থপর

মনের মধ্যে আছড়ে পড়ছে নদী ও উপত্যকা
শুধু স্বপ্ন নয় চুরমার করে নানান স্মৃতি

আঁচল আঁকড়ে বুকের কাছে হাঁটু মুড়ে বাঁচা যায়
তবুও বড় নিঃসঙ্গ লাগে। 
কবে যে ফুটবে পলাশ  ? বোকা মন ভাবতে থাকে

মিলে অমিলেও কোন এক পাখির বাসায় আমাদের ঠাঁই, 
যদি সে ফিরে আসে মানে-অভিমানে-ভালোবাসায়।



সায়ন্তন ধরের রহস্য গল্প

স্কুলবাস রহস্য


শহরের উপকন্ঠে নীলাদ্রিদের বাড়ি। নীলাদ্রির বাবা নীলাভ্র বসু ও মা নীলাঞ্জনা দু'জনেই স্কুল টিচার। নীলাদ্রিরা এই নতুন পাড়ায় এসেছে বছর দশেক হলো। কলেজের পাট চুকিয়ে এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বাড়ি থেকে পঞ্চাশ কিমি দূরে ইউনিভার্সিটি। সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরে। আজ শুক্রবার,বিকেল চারটেতে ক্লাস শেষ হবে। হস্টেল থেকে একেবারে বাড়ি যাবার জন্য তৈরি হয়েই ক্লাসে এসেছে। ইউনিভার্সিটির পাশেই এশিয়ান হাইওয়ে। চারটায় ছুটি হলে পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই সিটিবাস পেয়ে যাবে। ইউনিভার্সিটির বাস থাকলেও চারটে ত্রিশ অবধি অপেক্ষা করার মতো সময় নেই তার। কারণ বড়ো শহরে পৌঁছে আবার নিজের শহরে ফেরার বাস ধরতে হবে। এই পাঁচ ছয় কিলোমিটার রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। এটুকু পথ পেরোতেই চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লেগে যায়। তারপর বাকি পঁয়তাল্লিশ কিমি যেতে আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট। এভাবে বাড়ি পৌঁছতে ছ'টা বেজে গেলো। শীতের সময় সূর্য মাঝ রাস্তায় করতোয়ার জলে ডুবে গেছে। শহরের ভিতরের বাস বা বাইপাসের বাস যেকোন একটাতে চাপলেই হয়। আজ বাইপাসের গাড়ি আগে পাওয়া গেছে বলে, সেটাতেই উঠেছিলো সে। বাইপাসে নেমে মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথে বাড়ির গেট। বাড়ি পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে টিফিন করে নিলো সে।এরপর মা-কে কাছে বসিয়ে সারা সপ্তাহের গল্প। পড়াশুনার গল্প,খেলাধুলার গল্প। নীলাদ্রি পড়াশুনাতে বেশ ভালোই। কোন পজিশন না পেলেও নিজ বিষয়ে তার জ্ঞান অগাধ। আবার খেলাধুলাতেও বেশ ভালো। সদ্য ইন্টার ডিপার্টমেন্ট দশ ওভারের ক্রিকেটে ক্যাপটেন্সি করেছে সে। দলকে এনে দিয়েছে সেরার তকমা। সেইসব গল্পে মেতে থাকলো সে। ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়েও পড়লো সে তাড়াতাড়ি। পরদিন সকাল সকাল স্নান সেরে খেয়ে বন্ধু সুজনের বাড়ি যাবে বলে মনস্থির করছে, এমন সময় সুজন হন্তদন্ত হয়ে হাজির। চোখ মুখ উদ্ভ্রান্ত,চুল উস্কোখুস্কো,প্রচন্ড হাঁপাচ্ছে। বড় শ্বাস নিয়ে সুজন বললো,"একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে ....." ঘটনাটি হলো, সুজনের পাশের বাড়ি চিত্রাদির বাড়ি, সকালে চিত্রাদি টিউশন পড়াতে যায়। চিত্রাদির মা সে সময়টা একাই থাকেন বাড়িতে। সেখানে সকাল সকাল দুঃসাহসিক ডাকাতি হয়েছে। দুটি ছেলে এসেছিলো, তারা বললো যে পাঁচশো টাকার বিনিময়ে সোনারূপোর গহনা থাকলে সেগুলো তারা ধুয়ে পরিষ্কার করে পালিশ করে দেবে। সহজ সরল চিত্রাদির মা বাড়ির যাবতীয় গহনা এনে দিয়েছিলেন। একটা বড় প্রেসার কুকারে সেগুলি রেখে ছেলেদুটি ফুটন্ত জল চাইলো। চিত্রাদির মা জল গরম করতে ভিতরে গিয়েই কি ভেবে সাথে সাথেই ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যেই গহনাসহ ছেলেদুটি উধাও। ওদের এখন পাগল পাগল দশা। চিত্রাদির বিয়ের জন্য একটু একটু করে গড়িয়ে রাখা গহনা সেগুলি। আজকাল গহনা পরিষ্কারের নামে এ ধরণের ডাকাতির ঘটনা খুব ঘটছে। টিভিতে তো প্রায়ই দেখায়, এমন কি এই শহরেই মাস দু'য়েকের মধ্যে এই নিয়ে তিন চারটি ঘটনা ঘটলো। তবু যে কেন মানুষ সচেতন হয় না!! নীলাদ্রি বাইরে থাকে বলে এ সম্পর্কে অবগত ছিলো না। সুজন বললো সব। পুলিশ খোঁজ করছে,কিন্তু কোন কিনারা হচ্ছে না। আসলে জায়গাটা এমন যে এশিয়ান হাইওয়ের মসৃন রাস্তা দিয়ে আততায়ীরা সহজেই পগারপার হচ্ছে। নীলাদ্রি সব শুনে বললো, "আচ্ছা চল, চিত্রাদিদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি, তারপর লাঞ্চটা তোদের বাড়িতেই হবে।" সুজন শুনে খুব খুশী। ওরা দুই বন্ধু সেই ক্লাস সিক্স থেকে। সুজন বয়সে বছর দেড়েকের বড় হলেও একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ার জন্য বন্ধুত্ব হতে দেরী হয় না তাদের। এক সাথে স্কুল যাওয়া, খেলাধুলা সব চলতো। সুজন গ্র্যাজুয়েশনের পর চাকরীর জন্য কোচিং নিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে এলো চিত্রাদির বাড়ি। হাসিখুশী চিত্রাদির কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলে গেছে। তবু স্মিত হেসে ওদের বসতে বললো। চিত্রাদি চা খুব ভালো বানায়। অন্ততঃ প্রকৃত চা-বিলাসীদের জন্য, অল্প চিনি দিয়ে দার্জিলিং চা-এর লিকার,স্বাদ ও সুগন্ধে ভরা। তাই চা-এর অফারটা ওরা দু'জনেই সানন্দে লুফে নিলো। চিত্রাদি চা নিয়ে এলে এক চুমুক দিতেই মন ভালো হয়ে গেলো ওদের। চিত্রাদি নিজেই আজ সকালের ঘটে যাওয়া ঘটনাটি উত্থাপন করলো। নীলাদ্রি অপরাধীদের চেহারার বর্ণনা জানতে চাইলো। চিত্রাদি মায়ের মুখে শুনেছিলো,চেহারা দেখে মনে হয় ভদ্রঘরের অভাবী ছেলে। তারা নাকি বলেছিলো এই শহরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনস্টিটিউটে পড়ে। বাড়ি মালদা জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে। গঙ্গার জলে জমি জমা তলিয়ে যাওয়ায় তাদের অভিভাবকেরা সেমিস্টারের ফিস দিতে পারেনি। তাই তারা তাদের লব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে সেমিস্টারের টাকা জোগাড় করতে চেষ্টা করছে। একজনের মাথায় কোকড়া চুল,মুখখানি তার ভারী মিষ্টি। অপরজন একটু শ্যামবর্ণ, একদম ভূমিপুত্র। নিষ্পাপ চোখ দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। নাম বলেছিলো রতন ও আলম। এই বলে চিত্রাদি আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ওরা দু'জনেই বললো, "তুমি ভেঙে পড়ো না দিদি। আমরা আছি তো, কিছু একটা বিহিত হবেই।" -পরক্ষণেই চোখ মুছে শান্ত হলো চিত্রাদি। এরপর ওরা ফিরে এলো। নীলাদ্রি দেখলো,সুজনদের বাড়িটা খুব সাজানো গুছানো। সামনে অনেকটা বাগান,সুদীপ্ত কাকু মানে সুজনের বাবা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরী করেন। তাই বাগান করার শখটা রয়েছে। ফুলগাছগুলির যত্ন তিনি নিজেই করেন। মরশুমী ফুল ছাড়াও কিছু ফার্ণ, যেমন অফিওগ্লসাম, এছাড়া পেপেরোমিয়া, পিলিয়া, একমেল্লা, সায়ানুটিস, কোমেলিনা - এই গাছগুলিকে আগাছা ভেবে উপড়ে ফেলে দিতে পারেন না। নিলাদ্রী উদ্ভিদবিজ্ঞানের চোখ দিয়ে দেখে বলে তারও ভীষণ ভালো লাগে এই বাগানটিকে। তন্দ্রা কাকিমা মানে সুজনের মা হোমমেকার, মানুষজনকে আদরযত্ন করে খাওয়াতে ভালোবাসেন। দরজা খোলাই ছিলো, সোফায় গা এলিয়ে দিতেই খাবার জলপূর্ণ গ্লাস নিয়ে ঘরে এলো ত্রিহানা, সুজনের বোন। এইচ.এস. পাশ করে সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। মিষ্টি হেসে বললো, "বসো, দুপুরের খাওয়ার জন্য ডাক পড়লো বলে।" ত্রিহানা চিত্রাদিদের বাড়ির ঘটনাটা জানে,স্বভাবতঃই এই নিয়ে দু'একটা কথাবার্তা চললো। এরপর দুপুরের খাবার খেয়ে নীলাদ্রি বাড়ি ফিরে এলো। বাবা-মাকে সব কথা জানিয়ে তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো ক্লুএর আশায়। চটজলদি কোন ক্লু পাওয়া না গেলেও সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে মিললো উৎসাহ। দু'জনেই বললেন, "সাবধানতা অবলম্বন করে এই কেসের যদি কোন সুরাহা করা যায় তাহলে তা করা উচিত। নীলাদ্রি সুজনকে ফোন করে বলে দিলো যে রবিবার ত্রিহানাসহ তিনজনে পাড়ারই দেব কুটিরে দেখা করবে। দেব কুটির দেবদের অব্যবহৃত বাড়ি, সঙ্গে অনেকটা জমি। ওরা সবাই বিদেশে থাকে, বহুদিন আর এমুখো হয় না। কেয়ারটেকার ফটিক কাকুর বয়স হয়েছে, মাসে একবার আসে, কিছুক্ষণ থেকে চলে যায়। ল্যান্টানা, মেলাস্টোমার জঙ্গল বাড়ছে। বড় বড় ঘোড়ানিম, গামারি, সেগুন, তুনগাছ রয়েছে। আর আছে একটা পুরোণো জামরুলগাছ। ছোট থাকতে ওরা এখানে ক্রিকেট খেলতো। শীতকালে ব্যাডমিন্টন। ত্রিহানা আর নীলাদ্রি ছিলো মিক্সড ডাবলস্-এর পার্টনার। পাড়ার কেউ আজ পর্যন্ত ওদের হারাতে পারেনি। পাড়ায় তখন ওদের সমবয়সী ষোল সতেরো জন ছিলো। বিকেল থেকে সন্ধ্যে গমগম করতো জায়গাটি। এখন সবাই প্রায় বাইরে, কেউ পড়ছে, তো কেউ চাকুরীসূত্রে অন্য শহরে। ওরা তিনজন ছাড়া আর দু'একজন পাড়ায় থাকলেও খেলতে বা আড্ডা দিতে কেউ আর আসে না। নীলাদ্রি এলে এই তিনজন একত্রিত হয়। একদিনে সারা সপ্তাহের অক্সিজেন নিয়ে নেয়, তারপর নীলাদ্রিদের বাড়িতে খেয়ে সুজন ও ত্রিহানা ফিরে যায়। এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে নীলাদ্রি। রবিবার সকালে ওরা তিনজন দেবকুটিরের পথে যাচ্ছিলো। এমন সময় একটা নীল সুইফ্ট পাশে এসে দাঁড়ালো। চিনতে ভুল হলো না, প্রীতমদার গাড়ি। গাড়ি সাইডে রেখে হাসিমুখে বেরিয়ে এলো প্রীতমদা। প্রীতম সেন নীলাদ্রিদের থেকে দু'বছরের সিনিয়র। তবে পড়াশুনায় ইতি সেই মাধ্যমিকেই। বাড়ির রোজগারের দায়িত্ব ও ছোট ভাইএর পড়াশুনার খরচ চালাতে জোয়ালের ন্যায় গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে তুলে নিয়েছিলো। আর পা দিয়ে দুরন্ত ড্রিবলিং করে ফুটবল নিয়ে। স্কুলের হয়ে ডিস্ট্রিক্ট খেলেছে। সেন্ট্রাল মিড ফিল্ডার হলেও গোল করতেও সে দক্ষ। অবসর থাকলে কোথায় ম্যাচ হচ্ছে তা জেনে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আর ওকে দলে পেয়ে বর্তে যায় তাবড় তাবড় টিম। প্রীতমদার সাথে এই তিনজনের দারুন বন্ধুত্ব।ওরা গন্তব্য জিজ্ঞেস করলে প্রীতমদা বললো, স্ট্যান্ডে যাচ্ছিলাম, কোন ভাড়া নেই আজ। আজকে না হয় দেব কুটিরেই আড্ডা মারা যাক। সবাই একমত। ওরা এসে সবে ধুলো ঝেড়ে বসতে যাবে তখনই একটা স্কুলবাস রাস্তা দিয়ে চলে গেলো। প্রথমে কারো কিছু মনে হয়নি। কাছেই সেন্ট মেরি স্কুল, সেই স্কুলের বাসগুলো হামেশাই এ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে। কিন্তু আজ তো রবিবার, রবিবারে স্কুলবাস কেন ?প্রশ্নটা মাথায় খেলতেই নীলাদ্রি দৌড়ে গেলো গেটের কাছে। যদি গাড়িটার নম্বর দেখতে পাওয়া যায়! কিন্তু ততক্ষণে বাস চলে গেছে। কথাটা সবাইকে বলতে প্রীতমদা বললো যে, সে প্রায় দেড় দু'মাস ধরে লক্ষ্য করছে যে একটি বাস মাঝে মধ্যেই নষ্ট হয় আর ক্লীনার ছেলেটি তার নীচে শুয়ে মেরামতির কাজ করে। অথচ পুলকারের দুর্ঘটনায় পড়া নিয়ে যখন হৈ চৈ হয়েছিলো তখন এই স্কুলটি বলেছিলো যে তাদের সবকটি বাস নতুন এবং কোনটিই নষ্ট নয়। তাহলে একটি নির্দিষ্ট বাস কেন মাঝে মধ্যেই খারাপ হয়। এই দুটি ঘটনা ভাবালো তাদের। ত্রিহানা হঠাৎ প্রীতমদাকে জিজ্ঞেস করলো যে ক্লীনার বা ড্রাইভারকে কি দেখেছে সে ? প্রীতমদা জানালো, ক্লীনারকে দেখেছে সে, তবে দূর থেকে। অল্পবয়সী কিন্তু মাথায় সবসময় কাপড় বেঁধে রাখে। "হুঁ"- বলে গুম হয়ে রইলো নীলাদ্রি। ত্রিহানা, সুজন ও প্রীতমদা চিত্রাদির বাড়ির ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছিলো। শুনতে শুনতে হঠাৎ নীলাদ্রি বলে উঠলো, "চিত্রাদিদের বাড়ির কেসটার সাথে এই স্কুলবাসের কি কোন যোগাযোগ আছে ? বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখতে হচ্ছে তো!!!"প্রীতমদা বললো যে তার একটা বিশ্বস্ত সূত্র রয়েছে, যার মাধ্যমে ঐ বাসটি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পারবে সে। একথা শুনে চারজনেই প্রীতমদার গাড়ি করে হার্ট অব দ্য টাউনে প্রীতমদার বন্ধু নরেশদার বাড়িতে এলো। নরেশও ঐ একই স্কুলের বাস চালায়।সে জানালো যে স্টুডেন্ট সংখ্যা বাড়ায় মাস তিনেক আগে একটি নতুনবাস যুক্ত হয় পুলকার হিসেবে। একমাস চালানোর পরে গাড়ির মালিক চোখে কম দেখে এই অজুহাতে প্রৌঢ় ড্রাইভার অমলকাকুকে সরিয়ে দেয়।অমলকাকুর ছেলে বিমল ক্লীনারের কাজ করতো। প্রতিবাদ করলে তাকেও বরখাস্ত করা হয়। তারপরেই নতুন দু'জনকে কাজে বহাল করা হয়,যারা স্থানীয় নয়। এরপর ওরা চারজন যখন নরেশদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো,তখন প্রায় সন্ধ্যে। ওরা ঠিক করলো এবার সেন্ট মেরি স্কুলের রাস্তাটা দিয়ে বাড়ি ফিরবে। তেমন কোন সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লো না। প্রীতমদা তখন ওদের সবাইকে যার যার বাড়িতে নামিয়ে দিলো। সোমবার নীলাদ্রি ফিরে যাবে ইউনিভার্সিটিতে। বাড়ি এসে সব ঘটনা নীলাদ্রি তার বাবাকে জানালো। ঐ স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল রহমান আঙ্কেল তার বাবার বন্ধু। কায়দা করে নীলাদ্রির বাবা তাঁর কাছ থেকে জেনে নিলেন যে নরেশদার বয়ান একশো শতাংশ সত্যি। তার সাথে আরো জানা গেলো যে সেই বাসমালিকের বাড়ি শহর থেকে দশ কিলোমিটার দূরে একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশনের কাছে। সেখান থেকে স্কুলের ত্রিশটি বাচ্চার সাথে সাথে তিনজন শিক্ষকও যাতায়াত করেন। সব শুনে নীলাদ্রি,সুজন ও প্রীতমদাকে ফোন করে জানালো, এ ব্যাপারে আর কারো সাথে যেন কোন আলোচনা না করা হয়। এ পর্যন্ত যত তথ্য জানা গেছে, তা সবটাই গোপণ রাখতে হবে। আগামী পাঁচদিন ঐ স্কুলবাসের ওপর সাবধানে নজরদারি চালাতে হবে। নীলাদ্রি আগামী শুক্রবার আসবে, তারপরই আশা করা যায় কিছু একটা সমাধান হবে। আর ঐ ধরণের চুরি বা ডাকাতির খবর পেলেই যেন তারা নীলাদ্রিকে জানায়। নীলাদ্রি এবার শহরের পুলিশের সর্বময় কর্তা যে কি না সম্পর্কে নীলাদ্রির নিজের পিসো হয়, সেই রক্তিম গুহর সাথে যোগাযোগ করলো এবং সংক্ষেপে সহজে সব ঘটনা খুলে বললো। তার পিসো তাকে খুব বিশ্বাস করেন এবং এই ধরণের অ্যাডভেঞ্চারে পাশে থাকেন। দিন তিনেক পর হঠাৎ ত্রিহানার ফোন। সে জানালো, পাশের পাড়াতে আবারও এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে। নীলাদ্রি বুঝতে পারলো,যদি তাকে এই ঘটনার বিহিত করতেই হয় তবে কাল-বিলম্ব না করে আজই বাড়ি যাওয়া উচিত। বাকি তিনদিন তাকে ক্লাস কামাই করতে হবে। একটা লিভ অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে নীলাদ্রি বাড়ি ফিরে এলো দুপুরেই। বাস চলাকালীনই প্রীতমদা, সুজন, ত্রিহানা ও পিসোর রক্তিম গুহর সাথে নীলাদ্রিদের বাড়িতে গোপন মিটিং হলো। প্রীতমদা জানালো একটা চাঞ্চল্যকর খবর। সে সেন্ট মেরি স্কুলের রাস্তার একটা ভাঙা অংশে একটা সোনার কানের রিং কুড়িয়ে পেয়েছে, রোদে সেটা চকচক করছিলো। একটা স্বর্ণকারের দোকানে সেটা যাচাই করে নিশ্চিত হয়। তাতে খোদিত আছে RJ. যা রত্নাকর জুয়েলারীর ট্রেড মার্ক। তাদের দোকানে গিয়ে প্রীতমদা জেনেছে যে এটি শহরেরই একটি পরিবারের গহনা। রক্তিম গুহ বললেন,"দিন কুড়ি আগে সেই বাড়িতেও এ ধরণের চুরি বা ডাকাতি হয়। দুইএ দুইএ চার মেলাতে অসুবিধে হয় না তাদের। আজকের ঘটনাটা সকালেই ঘটেছে, এখনো ঐ স্কুলবাসটি শহর ছাড়েনি। তাই হয় তো আজ বিকেলেই ছাত্রছাত্রীদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবার সময় তা পাচার হবে। তাই আজই অ্যাকশানে নামতে হবে। নীলাদ্রি অ্যাকশান প্ল্যান বোঝাতে লাগলো সকলকে। আসুন আমরা এখন এই চারজনের সাহসের উৎস খুঁজে বের করি। নীলাদ্রি, সুজন, প্রীতম ও ত্রিহানা চারজনই সৎ। সততাই হয় তো সবচেয়ে বড় সাহসের কারণ। ওরা চারজনেই পড়াশুনোয় ভালো, সর্বোপরি বুদ্ধি নিয়ে চলে। নীলাদ্রি ও সুজন ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট। প্রীতম অত্যন্ত পরিশ্রমী ও জীবনযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ। চারজনেই স্পোর্টসম্যান। বডি চূড়ান্ত ফ্লেক্সিবল। নীলাদ্রির উচ্চতা কিছু কম হলেও সুজন ও প্রীতমের উচ্চতা ছ'ফুটের কাছাকাছি। ত্রিহানা কম্পিউটার ও কোডিং নিয়ে পড়াশুনা করছে। তাই আধুনিক প্রোগ্রামিংটা তার কাছে জলভাত। তার অবজার্ভেশন পাওয়ারটাও প্রখর। সুজন ও ত্রিহানা নাট্যদলের সাথে যুক্ত। তাই অভিনয়টাও জানে ভালো। এসবের পরেও রয়েছে রক্তিম গুহর প্রচ্ছন্ন সহযোগিতা। অ্যাকশান প্ল্যান তো তৈরী।প্ল্যান "এ", প্ল্যান "বি"। পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া নিজেদের স্বাধীন চিন্তা অনুযায়ী রহস্য উদ্ঘাটন করা হলো প্ল্যান "এ"। প্রথম থেকে পুলিশের সাহায্য নিয়ে নামলে সেটা প্ল্যান "বি", সেক্ষেত্রে পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ঘড়িতে বিকেল তিনটে। স্কুলবাসটি আর পনেরো মিনিটের মধ্যে বটতলায় আসবে। নীলাদ্রি কালভার্টের আড়ালে অপেক্ষারত। বটতলায় সুজন ত্রিহানা প্রেমিক প্রেমিকা সেজে অপেক্ষারত। বাসটি আসছে।সুজন হাত দেখালো বাসটিকে। বাসটিকে চালক অনিচ্ছাসহ থামালো। ওরা বললো,"আমরা যেখানে যাবো সেখানে কোন দূরপাল্লার বাস থামবে না বলছে।তাই দয়া করে যদি পৌঁছে দেন, ন্যায্য ভাড়া দেবো। "ক্লীনার উঠতে বললে তারা গিয়ে বসলো ফাঁকা সীটে। লুকিং গ্লাসে ড্রাইভারের মুখটা দেখা যাচ্ছে। ড্রাইভার ও ক্লীনার দু'জনের চেহারাই চিত্রাদির বর্ণনার সাথে মিলে গেলো। বাস চলতে শুরু করলো। এদিকে এক ফাঁকে নীলাদ্রি গাড়ির নীচে বিশেষ দক্ষতায় নিজেকে আটকে নিলো। হাতে একটি ট্র্যাকার। সেটিকে গাড়ির নীচে গোপনীয় ভাবে লাগাতে যাবে,এমন সময় দেখতে পেলো সেখানে একটা থলে রাখা। ট্র্যাকারটি লাগিয়ে অন করে দিয়ে থলিটি অনেক কষ্টে খুলে দেখে তার তো চোখ ছানাবড়া। প্রচুর সোনার গহনা রয়েছে তাতে। নীলাদ্রি তার মধ্য থেকে একটি গহনা ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য স্যাম্পল হিসেবে সন্তর্পনে নিজের রুমালে বেঁধে পকেটে ভরে নিলো এবং "Done"- লেখা ম্যাসেজটি সুজন ও প্রীতমদাকে ফরোয়ার্ড করে দিলো। এইবার গাড়িটা থামার অপেক্ষা। এদিকে বাসের মধ্যে সুজন একটা সিগারেট ধরালো।অনভ্যাসে কাশলো খানিক, তবুও নিজেকে সামলে নিলো। শিক্ষকেরা রে রে করে উঠলেন। তাঁরা বললেন, "শিশু শিক্ষার্থীদের সামনে বাসে এভাবে ধুমপান চলবে না ... এটা গর্হিত কাজ ... শিক্ষা নেই বুঝি আপনার ?" সুজনও ছাড়বার পাত্র নয়, সেও সমানে তর্ক জুড়ে দিলো। শিক্ষকেরাও বলতে লাগলেন,"একে তো এই বয়সে প্রেম করছে, তারপর সিগারেট, উপরন্তু মুখে মুখে তর্ক! এরা দেশের কলঙ্ক। বাচ্চারা এদের দেখে খারাপ হয়ে যাবে। এদের নিয়ে আর একটুও এগোবে না বাস। এরপর শিক্ষকেরা তিনজনেই গাড়ি থামাতে নির্দেশ দিলেন ও বেয়াদপ ছেলেমেয়েদুটিকে মাঝপথে নেমে যেতে বাধ্য করলেন। ত্রিহানা সুজন তো এটাই চেয়েছিলো, বাসটা যাতে থামে। ওরা ভাই-বোন, সিগারেটের পরোক্ষ স্মোকিংএও থাকে না কেউ, ওদের বন্ধু বৃত্তের কেউই স্মোক করে না - এসব বোঝানোর ইচ্ছা ওদের ছিলো না। বাস থামলে ওরা কপট রাগ দেখাতে দেখাতে নেমে এলো। নীলাদ্রিও এই সুযোগে নিজের বন্ধন খুলে বাসের তলদেশ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলো। বাস তাকে ফেলে ধীরগতিতে স্পীড তুলে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো।ড্রাইভার যদি একবারও লুকিংগ্লাসের দিকে দৃষ্টিপাত করতো তাহলে নীলাদ্রিকে হয়তো দেখে ফেলতো।কিন্তু ঘটনার ঘনঘটায় একটু হলেও সে হয় তো অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো। এ ব্যাপারেও সুজন ত্রিহানার অভিনয়কুশলতা প্রশংসার দাবী রাখে। নীলাদ্রি উঠে এলে তিনজনেই দেখলো প্রীতমদার নীল সুইফ্ট যথারীতি এসে গেছে। প্রীতমদার গাড়িতে রক্তিম গুহ ট্র্যাকিং মনিটরে চোখ রেখে বসে আছেন। ওরা দ্রুত উঠে এলো গাড়িতে। নীলাদ্রি সংগৃহীত সোনার গহনাটি ওদের দেখালো। ত্রিহানা জানালো, ঐ বাসের ড্রাইভার ও ক্লীনার চিত্রাদির বর্ণিত সেই দুইজন। শুধু কোঁকড়া চুল রতনের মাথা কাপড়ে ঢাকা, যেমনটি প্রীতমদা বলেছিলো। কিন্তু যতক্ষণ নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা এ বাসে আছেন ততক্ষণ কোন অ্যাকশান নেওয়া যাবে না। ত্রিহানা বাসে উঠেই সেল্ফি তোলার সুবাদে ক্লীনারের ছবি তুলে নিয়েছে। কিন্তু ড্রাইভারের ছবি তোলা যায় নি। সেই ছবি ও সোনার গহনাটি রক্তিম গুহর কাছে জমা দিলো। রক্তিম গুহ কিছু বিশ্বস্ত সহকর্মীকে বাসমালিকের বাড়ি ও স্টেশনের আশেপাশে আগে থেকেই মোতায়েন করে রেখেছিলেন। ওরা পাঁচজনও স্টেশনের কাছে এসে অপেক্ষা করতে লাগলো। শেষ ছাত্রটিকে নামিয়ে দিয়ে বাসটি যখন মালিকের বাড়ির দিকে গেলো তখনই রক্তিম গুহ আদেশ দিলেন অ্যাটাক করার। হতচকিত তারা বিনা প্রতিরোধে ধরা পড়ে গেলো। বাসমালিক রামনিধি পালানোর চেষ্টা করতেই একটা অসাধারণ ট্যাকল্ করলো প্রীতমদা। সঙ্গে সঙ্গে লালকার্ড দেখতে হলো রামনিধিকে। এরপর একটি পুলিশের ভ্যান বাসমালিকের বাড়ির সামনে এসে থামলো। রামনিধির বাড়িটা তল্লাশ করে কোটি কোটি টাকার গহনা উদ্ধার হলো। এদিকে হুইসল্ বাজিয়ে একটা ট্রেন এসে থামলো স্টেশনে। সেখানে মোতায়েন করা পুলিশ ট্রেন চেকিং করলো। গহনা চোরাচালানের মূলচক্রী শ্রীনিবাসন সাঙ্গপাঙ্গ সমেত ধরা পড়লো। আজ বুধবার ছাড়াও ত্রিশ তারিখ, মাসের শেষ। তাই আজ সমস্ত গহনা নিধিরামের বাড়ি থেকে পাচার হওয়ার কথা ছিলো। এসব কথা সুজন নীলাদ্রিদের মাথাতেও আসেনি। কিন্তু স্বল্প প্রচেষ্টায় এতো বড় সাফল্য যেন তাদের সততা ও সাহসিকতারই পুরস্কার। ক্রমে রাত বাড়লো। রক্তিম গুহ অত্যন্ত খুশী। তিনি সবাইকে "জনপ্রিয় হাইওয়ে ধাবা"-য় ডিনারের উদ্দেশ্যে নিয়ে গেলেন। ডিনার সেরে সকলে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে এলো। অভিভাবকেরা যেমন চিন্তামুক্ত হলেন, তেমনি হলেন গর্বিত। "গহনা উদ্ধার হয়েছে, উপযুক্ত প্রমাণ দেখিয়ে থানা থেকে নিয়ে যান"-এই মর্মে ঘোষণা করা হলো। চিত্রাদি তার খোয়া যাওয়া গহনা ফিরে পেয়ে আনন্দে আবার কেঁদে ফেললো। ওর বিয়েতে তিনদিন আগে থেকে নীলাদ্রি সুজন প্রীতমদের থাকতে নিমন্ত্রণ করলো। পুলিশ প্রশাসন থেকে ওদের চারজনকে সংবর্ধনা দিতে চাইলেও ওরা সেটা নিতে চায়নি। কারণ এতে ওদের পরিচিতি গোপন থাকবে না, যা কিনা পরবর্তীতে কোন ঘটনার কিনারা করতে সমস্যা তৈরি করবে। দু'দিনেই সব মিটে গেলো, নীলাদ্রির হাতে আরো তিনদিন ছুটি। ওরা ঠিক করলো খুব আনন্দ করবে এ ক'দিন। প্রীতমদা নীল স্যুইফ্টটা গ্যারেজে রেখে কালো সাইকেলটা বের করলো। সুজন ও নীলাদ্রির সবুজ সাইকেল এবং ত্রিহানার লাল সাইকেলকে সাথী করে চারজনে বেরিয়ে পড়ল লং সাইক্লিং এ।




পলাশ মাহাতর গল্প

আমি ইস্কুলে যাব না


সকালের চা জল খেয়ে আবার দু- তলায় ওঠে গেল মনোহর । তখনও অঘোরে ঘুমাচ্ছে অয়ন আর অবন্তিকা । মনোহরের ছেলে, মেয়ে । অবন্তিকার বয়েস ছয় বছর , অয়নের চার । অবন্তিকা একটা প্রাইভেট ইস্কুলে পড়ে । এই বছর ওয়ান । অয়ন সবে স্কুল যেতে শিখছে ।
মনোহরের কাজ , সকাল সন্ধে ছেলে মেয়েকে পড়তে বসানো । বিকেলেও একটা প্রাইভেট মাস্টার আছে তাদের ।
পাড়ার ছেলে মেয়ে যখন খেলাধুলার আনন্দে মেতে থাকে তখন এদের ডুবে থাকতে হয় জ্ঞানসমুদ্রে । যা অল্পও ভাল লাগে না । ইচ্ছে করে পাড়ার সঙ্গী সাথীর সঙ্গে একটু আধটু খেলা করতে । নিজের মত করে সময় কাটাতে । কিন্তু উপায় নেই । বারবার বাবা মার কাছে আর্জি জানিয়েও ব্যর্থ হতে হয় ।
মনোহর দোতলায় যেতেই পুস্পিতা কলতলা থেকে থালা বাসন মাজতে মাজতে হাঁক পাড়ে , ছেলে মেয়েকে ঘুম থেকে ওঠাও । কখন পড়তে বসাবে ?
 মনোহরের বউয়ের নাম পুস্পিতা । বউকে ভয় করে মনোহর । ভয়ে ভয়ে বলে , তারা এখন ঘুমাচ্ছে ।
- ঘুমাচ্ছে বললে হয় ? এখনই তো নটা বেজে যাবে । পড়বে কখন ? শুধু ইস্কুল গেলেই কি পড়া হয় নাকি ?
মনোহর ছেলে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে । আঃ কী সুন্দর ফুটফুটে ছেলে মেয়ে দুটো । কী সুন্দর মুখ , যেন ভোরের শিশির স্নাত পবিত্র ফুল । কোন পাপ নেই এই মুখে । এই মুখ জানেই না বাস্তবতার বিরুদ্ধে কি কঠিন সংগ্রাম করতে হয় । কত ক্ষত বিক্ষত হওয়ার মুহূর্ত , জ্বালা যন্ত্রনার লড়াই অপেক্ষা করছে তাদের জন্য । ভাবতে ভাবতে পিতৃস্নেহ উথলে ওঠে মনোহরের বুকে । ইচ্ছে করে না ছেলেমেয়ের ঘুম ভাঙাতে । তবু না ডেকেও যে উপায় নেই । আস্তে করে ডাকে মনোহর , এই বাচ্চাগুলো ওঠ রে , কতক্ষন সকাল হয়েছে । আর কত ঘুমাবি , ওঠ ?
অবন্তিকা গা মোড়া দিতে দিতে ওঠে । আর উঠেই বলে , বাবা আজ আমি ইস্কুল যাব নাই ।
- কেন , মা আমার , যাবি না কেন ?
- রোজ রোজ যেতে কি আর ভাল লাগে ?
- ইস্কুল না গেলে বাড়িতে কি করবি ?
- আজ শুধু খেলব । আমি তুমি আর অয়ন ।
- ইস্কুল না গেলে মা বকবে । তাছাড়া সারা দিন কি খেলা যায় ?
বাপ –বেটির গল্প কলতলা পর্যন্ত চলে যায়। শুনে পুস্পিতা বলে, অবন্তিকাকে নিচে পাঠাও, ব্রাশ করবে ।
 মার গলা শুনে অবন্তিকা মনোহরকে শক্ত করে ধরে । বলে , বাবা তুমি বলে দাও আমি ইস্কুলে যাব নাই ।
মনোহরও বলতে পারবে না সেটা । সে-ও শুধু মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে । মেয়ের অসহায় পাংশু বর্ণ মুখ দেখে দয়া আসে তার । বলে , ঠিক আছে , পরে বলে দেব তোর মা’কে । এখন তুই যা মুখ ধুবি।
অবন্তিকা অনিচ্ছুক মনে মুখ ধুতে নিচে নেমে যায় । তারপর চা রুটি খেয়ে আবার উপরে আসে দোতলায় , বাবার কাছে । এসেই ওই এক আবদার , বাবা আজ আমি ইস্কুল যাব নাই ।
- কেন ? যাবি না কেন ?
মেয়ে আর মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারে না । হয়ত জানে কেন তার স্কুল যেতে মন করে না ।
মনোহর জিজ্ঞেস করে , ইস্কুলে গিয়ে পড়তে পারিস না ?
মেয়ে মাথা নাড়ে ।
বাবা আবার বলে , মাস্টার মারে বুঝি ?
এ বারও মাথা নাড়ে ।
- তবে যাবি না কেন? 
মেয়ে অসহায় ভাবে বলে , রোজ রোজ ভাল লাগে না । কত ছেলে কত কামাই করে । আর তোমরা আমাদের একদিনও কামাই করতে দাও না । রোজ রোজ যেতে বলো । একদিন না গেলেও কিছু হবে না ।
- তখন যে পিছিয়ে যাবি মা । অন্য কেউ ফার্স্ট হয়ে যাবে ।
- কেউ ফার্স্ট হতে পারবে না । কেউ আমার অত পারে না । জানো বাবা , মাস্টার যখনই আমাদের অঙ্ক করতে দেয় না, তখন আমি সবার আগে খাতা দেখায় । আর আমার সব অঙ্ক রাইট হয় । 
বলতে বলতে হাতেও রাইট চিহ্ন এঁকে দেখায় অবন্তিকা । কিন্তু তখনও চলতেই থাকে তার মুখ । বলে , মাস্টার আমাকে বলে গুড গার্ল ।
- সে তো বলবেই । তুই পারিস কত ! যারা পারে তাদের মাস্টার কেন সবাই বলবে গুড গার্ল । আর এই জন্য তো রোজ রোজ ইস্কুল যেতে হয় । না গেলে পিছিয়ে যাবি মা ।
 ইস্কুল যাওয়ার কথা শুনলেই অবন্তিকার মুখ চোখ দুঃখে ভারাকান্ত হয়ে যায় ।
গেল বছর অবন্তিকা আপার থেকে ওয়ানে ওঠে । প্রথম হয় । বাংলায় একশোর মধ্যে একশোই পায় । গনিতে নব্বই , ইংরাজিতে পচ্চানব্বই । জি কে ‘তেও নব্বইয়ের ঘরে । মোট কথা , তিরানব্বই পার্সেন্ট নাম্বার পেয়েছে অবন্তিকা , তবু মনোহরের মনঃপূত রেজাল্ট হয়নি । শুধু বাংলায় একশো পেলে চলবে না । গণিতেও পেতে হবে , ইংরাজিতেও । মেয়ের এমন রেজাল্ট হওয়া চাই যেন লোকে শুনে প্রশংসা করার সঙ্গে সঙ্গে বলে , আদর্শ বাবার মত দায়িত্ব পালন করছে মনোহর। ছেলে মেয়েকে তৈরি করছে জালিম পেয়াদার মত ।
মনোহরের শিক্ষাগত যোগ্যতা বি এ পাস । সাধারন পাশ । তাই কোন কম্পিটিশনে যেতে পারেনি । চাকরির খরার বাজারে তাই একটা কাজ জোটাতে পারেনি । দালালদের পাল্লায় পড়ে কিছু টাকাও গেছে চাকরির আশায় । শেষে হতাশ হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে । কিন্তু স্বপ্ন দেখা ছাড়েনি । ছেলে মেয়েও এখন তার স্বপ্ন । নিজের মত শুধু সার্টিফিকেট পাওয়া পাস করাবে না নিজের ছেলে মেয়েকে । প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম করাবে । যা কম্পিটিশনের যুগ তাতে পাস সার্টিফিকেটের কোন মূল্য নেই । এখন পার্সেন্টেজ চাই । পচানব্বই , আটানব্বই এমন কি নিরাব্বই , তবে দাম । নাহলে মূল্যহীন । সেভাবেই সে ছেলে মেয়েকে তৈরি করতে চাই । সে জন্য পড়াশোনার সঙ্গে কোন আপোস নেই । সে বুঝতে পারে না বাচ্চার মাথার ধারন ক্ষমতা অত নেই । সব সময় পড় পড় করলে তাদের চাপ সৃষ্টি হয় । মাথা ব্যথা করে । ছেলে মেয়ে চাই আর একটু বিশ্রাম । রবিবার বাদ দিয়েও আর একটা দিনের বিশ্রাম । একটু খেলা ধূলা করতে । নিজের মন ও শরীর ভাল রাখতে । কিন্তু তা বোঝে না মনোহর । হয়ত বা বোঝে । কিন্তু প্রতি ক্ষেতে প্রতিযোগিতার কথা ভেবে আমল দেয় না নিজের ভাবনাকে , আমল দেয় না ছেলে মেয়ের কথাকে । ছেলে মেয়েকে শিক্ষিত করতে হবে । এমন শিক্ষিত , যাতে করে লোকের চোখে ধাঁধা লেগে যায় । লোকে যেন বলে মনোহরের ছেলে মেয়ে জিনিয়াস বটে ।
বাইরে তখন মেঘ করছে । হালকা মেঘ ভেসে যাচ্ছে আকাশের গায়ে । সূর্য ঢেকে গিয়ে ছায়া নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে । মনোহরদের ঘরের জানলা দিয়ে বন্ধ হয়ে যায় আলো ঢোকা । তাই অবন্তিকার মনে স্ফূর্তির সীমা নেই । সে ভেবে নিয়েছে জল পড়লে তাকে আর ইস্কুল যেতে হবে না । কি মজাই না হবে । যা তার বাবা মা দিচ্ছে না সে অপার আনন্দ দেবে এই মেঘ । এই প্রকৃতি তাকে রক্ষা করবে বাবা মায়ের নির্দয় অত্যাচার থেকে ।
সে বাবার মুখের দিকে চেয়ে বলে , বাবা মেঘ করেছে । যদি জল পড়ে ।
- পড়ুক ।
হাসিতে মুখ ভরে ওঠে অবন্তিকার । হয়ত মনে মনে ঈশ্বরের কাছে কাতর প্রাথর্না জানায় যেন জল পড়ে । কিন্তু হতভাগি দুঃখী মেয়েটা বোঝে না ওপর বাদলের মেঘে জল আসে না , আর এলেও সামান্য । যা তাকে ইস্কুল যাওয়া থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে না ।
অয়নও ওঠে গেছে । উঠেই সে বাবা আর দিদির মুখের দিকে তাকায় । দেখে দিদির মুখ ভার । সে বলে , বাবা দিদি এমন মুখ করে আছে কেন ?
- বলেছে ইস্কুল যাবে না ।
- ঠিক তো বলছে ।
অবন্তিকা ইস্কুল না গেলে সেও পেয়ে যাবে সারা দিনের খেলার সঙ্গী । যা তার কাছে আনন্দের ব্যাপার । 
মনোহর বলে , ইস্কুল না গেলে হয় বাবা । ইস্কুল যেতেই হবে । তোদের খুব খুব পড়া শোনা করতে হবে । অনেক পড়তে হবে । আর পড়ে ভাল চাকরি করতে হবে । আমার মত বেকার থাকলে হবে না । তোরা যদি চাকরি না পাস তবে তোদের ফোনে গেম খেলার জন্য রিচার্জ পর্যন্ত করতে পারবি না । 
আর একটু পরেই নটা বেজে যায় ।  
পুস্পিতা নিচের থেকে তাগাদা মারে , অবন্তিকাকে নিচে পাঠাও স্নান করবে । আর অয়নকে বলো মুখ ধুতে । অয়ন্ও তো কাল ইস্কুল যায়নি । আজ সে-ও ইস্কুল যাবে ।
মনোহর ছেলে মেয়ের দিকে তাকায় । দুজনের মুখে নারাজ ভাব । কেউ চাই না ইস্কুল যেতে ।
মনোহর বলে , তোদের আজ দশ টাকা করে দেব ।
অবন্তিকা বলে , না আমাদের পয়সার দরকার নেই ।আজ আমরা ইস্কুল যাব না ।
- তা কি করে হয় ? দেখ , ইস্কুল না গেলে তোর মা খুব রাগ করবে ।
অয়ন বলে , বাবা তুমি মাকে মারতে পারো নাই ? সব সময় আমাদের ধমকায় ।
- সে তো তোদের ভালর জন্যই ।
আবার অয়ন বলে , এই বার আমাদের ধমকালে তুমি মাকে মারবে । 
- মারতে নেই কাউকে ।
- তাহলে সেদিন কেন দিদিকে মেরেছিলে?
অয়নের কথায় মনোহরের চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে । সেই দিন বার বার বোঝানোর পরও যখন অবন্তিকা বুঝতে পারছিল না তখন নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি মনোহর । রাগের বশে মেয়ের গায়ে হাত তুলে । মেয়ে কেঁদেছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে । সে কান্না দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি মনোহরও । সে-ও ছেলেমেয়ের আড়ালে কেঁদেছিল । অনেকক্ষন ধরে কেঁদেছিল । আর সেই দিন সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কোন দিন মেয়ের গায়ে হাত তুলবে না । তাতে যা হয় হবে ।
তারপর থেকে সে আর হাত তোলেনি । একবার না পারলে মেয়েকে বারবার বোঝায় । তবু বুঝতে পারে না যখন , তখন রেগে যায় , কিছুক্ষন চুপ করে থাকে , নিজেকে বোঝায় , শান্ত করে । তারপর আবার বোঝানোর চেষ্টা করে ।
নিচের থেকে আবার পুস্পিতার রাগ ভরা গলা শোনা যায় , অবন্তিকাকে নিচে পাঠাও তো কি ?
অবন্তিকা বাবাকে শক্ত করে ধরে । মুখের দিকে তাকায় ,। মনোহরও চেয়ে থাকে মেয়ের মুখের দিকে । দেখে , মেয়ের মুখে যত ভয় ঠিক ততটায় দুঃখ । আর মুখে ওই এক অভিব্যক্তি বাবা আমি ইস্কুলে যাব না ।
বাবার কাছে সে যেন একদিনের ছুটি চাইছে । বিশ্রাম চাইছে । পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে তার থেকে মুক্তি চাইছে । অবন্তিকা আবার কাতর স্বরে বলে , বাবা শুধু আজকের দিনটা আমাকে যেতে বলো না , আমি কাল থেকে আবার ইস্কুল যাব । প্রমিস বাবা ।
মেয়ের এমন কাকুতি মিনতি শুনে মনোহর আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না । তার চোখের তলায় জল এসে জমা হয় । কিন্তু সে - ও আর বলতে পারে না ,ঠিক আছে মা আজ আর ইস্কুল যেতে হবে না ।
আবার অবন্তিকা বাবার হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে , বাবা বলো না আজ আর ইস্কুল যেতে হবে না । তুমি তো আমার ভালো বাবা । আমার সব কথা শোন , তবে এটা শুনছ না কেন ?
মনোহর অশ্রু গোপন করে বলে , এ কথা বলিস না । এটা আমি রাখতে পারব না ।
তখন অবন্তিকা আর একটা কথাও বলে না । গম্ভীর হয়ে যায় । তার নিজের মনে চলে যায় নিচে । নিজেই কলতলা থেকে জল নিয়ে স্নান করে । তারপর নিজে খাওয়া দাওয়া করে ইস্কুল যাওয়ার জন্য রেডি হয় ।
মনোহর রোজকার মত বাইক নিয়ে বেরোয় । মেয়েকে বলে , বাইকে ওঠ মা ।
মেয়ে অভিমানী গলায় বলে , আমি যেতে পারব ।
মনোহরের চোখে জল চলে আসে । এইটুকু মেয়ে , ঘর থেকে একা একা কোথাও বেরুতে চাই না । আজ সেই মেয়ে কত দুঃখে এই অভিমান করছে । নিজেরও কাঁদতে ইচ্ছে করে কিন্তু মেয়ের সামনে কাঁদতে পারে না । বলে , দেখ মা এমন করিস না ।
মেয়ে আরও অভিমানী গলায় বলে , বাবা তুমি বাড়ি যাও , আমি যেতে পারব ।
মনোহর বাইক থেকে নামে । মেয়ের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। গালে কপালে চুমু খেতে খেতে আদরে ভরিয়ে দেয় , নানা রকম প্রলোভনের কথা বলে ভোলায় । তারপর বাইকে নিয়ে ইস্কুলে পৌঁছে দেয় । বাইক থেকে নামার পর মনোহর মেয়েকে একটি দশটাকার নোট দেয় ।
মেয়ে আগের অভিমান ভুলে যায় । টাকা নিতে পরম আনন্দে হাসে । হাসতে হাসতে বলে , আমার লক্ষী বাবা ,আমার সোনা বাবা । আমাকে কত ভালবাসে ।
কথা শেষ করে সে ইস্কুল গেটের দিকে ছুটে যায় ।
 মনোহর চেয়ে থাকে একদৃষ্টে । 
                        ___________________




সম্পাদক - উত্তম মাহাত
সহযোগিতায় - অনিকেতের বন্ধুরা
বাঁদর নাচের ছবি - তপন পাত্র
যোগাযোগ - হোয়াটসঅ্যাপ ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। নাচনী শিল্পীদের আলোক-চিত্র ।। সন্দীপ কুমার