দ্বিতীয় বর্ষ ।। সপ্তম ওয়েব সংস্করণ ।। ২ শ্রাবণ ১৪২৮ ।। ১৯ জুলাই ২০২১



লাভ, লোকসান, নাম, দুর্নাম, মহামারী, অতিমারী বা সামাজিক অবনমন, কোনকিছুর জন্যই থেমে থাকে না জীবন। থেমে থাকে না তার দুর্বার গতি। সবকিছুর মধ্যেই সে তার পথ খুঁজে নেয়। খুঁজে নেয় এগিয়ে যাওয়ার রসদ।
       এই যে অতিমারীর চোখ রাঙানো, অসংখ্য জীবনকে ধরাশায়ী করে ফেলা, তারপরও কি গতি কমেছে জীবনের? বরং সে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নতুন নতুন কৌশল খুঁজেছে। খুঁজেছে অতিমারীর উপরে উঠে আলাদা একটা জগৎ তৈরি করতে।
        জীবন কখনোই বিফল হয় না। যে বিফলতা চোখের সামনে দেখা দেয় আমাদের, সে বিফলতা সাময়িক, আপাত। সেই বিফলতাকে জয় করতে বার বার ফিরে আসে সে। ফিরে আসে পৃথিবীর বুকে।
        চাষার ছেলে যেভাবে একটার পর একটা মৌসম জয় করতে করতে তুলে আনে এক একটা ফসল। জীবনও তেমনই এক একটা পর্যায় পার করতে করতে এগিয়ে যায় পরিপূর্ণতার দিকে। পরিপূর্ণতাই তার একমাত্র লক্ষ্য। পরিপূর্ণতাই জীবনের শেষ পর্যায়। সে চাষ করে অর্জিত হোক বা কবিতা লিখে।



উত্তম মাহাত, সম্পাদক




_______________________________________________

                            এই সংস্করণে যাঁরা লিখছেন
_______________________________________________
তপন পাত্র/ দীপংকর রায়/ দেবাশিস সাহা/ বিশ্বজিৎ  লায়েক/ দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়/ সৌরভ লায়েক/ডরোথী দাশ বিশ্বাস/ সুবোধ পরামানিক/ অয়ন জোয়ারদার/ শক্তিপদ মাহাত/ পল্লব গোস্বামী/ দেবাশীষ সরখেল/ব্রততী পরামাণিক/ সুজন পণ্ডা
_______________________________________________





ইতস্তত প্রক্ষিপ্ত পলাশের মতো মানভূমের এখানে ওখানে সিন্ধুবালার নামে লোক উৎসবের মঞ্চ হচ্ছে । সমঝ্দারদের সভাও হচ্ছে মাঝেমধ্যে । নাচনি , খেমটি , বাঈ ইত্যাদি নামে সমাজ উপেক্ষিতা নৃত্যশিল্পীদের এই সম্মান বড়ো কম কথা নয় । তবে যদি কোনদিন সরকারিভাবে সিন্ধুর মহাপ্রয়াণের দিনটি "ঝুমুর দিবস" হিসাবে ঘোষিত ও উদযাপিত হয়, তাহলে শিল্পী ও শিল্প উভয়ই যথোচিত সম্মানিত হবে ।

                     সিন্ধুবালার মহাপ্রয়াণের দিনটি "ঝুমুর দিবস" হিসাবে ঘোষণার অনুনয়-বিনয় জানালেন --
  
               
                                তপন পাত্র

                            সিন্ধু : একটি তরঙ্গ
              


                              ছবি : তপন পাত্র
              
                অতি সুপ্রাচীন কালে এবং এই অর্বাচীন কালেও রমণী চরিত্রের অহংকারের একটি বিশেষ দিক একই রকম রয়ে গেছে । এই বিশেষ দিকটির কোন রকম পরিবর্তন ঘটে নি । ঋগ্বেদ সংহিতার ৮৬ সূক্তে ৬ সংখ্যক শ্লোকে ইন্দ্রাণী শচীর উক্তি --
 "না মৎস্ত্রী সুভসত্তরা ন সুযাশুতরা ভুবৎ ।
 না মৎপ্রতীচ্যবীয়সী ন সক্থ্যুদ্যমীয়সী বিশ্বস্মদিন্দ্র উত্তরঃ ।।"
                
      --যার অর্থ হল , কোন মহিলাই আমার চাইতে অঙ্গসৌষ্ঠবে অধিকতর সুন্দরী নয় , কোন মহিলাই আমার চেয়ে অধিক বিলাসপরায়ণা নয় , কেউই আমার চেয়ে উৎকৃষ্টরূপে স্বামী সহবাস করতে পারে না , প্রণয়াবেশে আলিঙ্গনও করতে জানে না ।

               প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে যে কোন রমণী আজও মনে মনে এই ধারণা লালন করেন । আজও কোন না কোন ভাবে বা কলায় নিজেকে উন্মুক্ত করতে চান , অপরের চোখে আকর্ষণীয়া রূপে উপস্থাপন করতে চান , মেলে ধরতে চান । নৃত্যশিল্পী নাচনীরাও বোধ করি এর ব্যতিক্রম নন । বরং পেশাগত কারণেই পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন ; তা যেমন দেহ সম্পদের আবেদনে , তেমনি কণ্ঠ সম্পদের লালিত্য ঝংকারে , অঙ্গ সঞ্চালন রূপ নৃত্যকলাতেও ।

               একটি নিতান্ত সাধারণ সজ্জায় সজ্জিত মঞ্চে ঢোল, মাদল, সানাই, মন্দিরা, ডুগি-তবলা , জুড়ি-নাগড়া ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের সুর ও তালের ছন্দে ঝুমুর গানের প্রথম কলিটি ধরে গাইতে থাকেন । আর গানের অন্তর্নিহিত বক্তব্যটি উপস্থাপনের তাগিদেই কখনো ঘাগরা ধরে , কখনো রুমাল বা ওড়না উড়িয়ে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে নেচে চলেন নাচনী । সঙ্গীত ও নৃত্য শিল্পের অঙ্গনে এর শিল্পসুষমা , কলাগুণ আদৌ উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে দেখার মতো কিছু নয় । তবুও বিভিন্ন কারণে "নাচনী" নামে চিহ্নিত এই নর্তকী সম্প্রদায় ভারতীয় নৃত্যশিল্পের আঙ্গিনায় আজও নন্দিত নয় ; ব্রাত্য এবং নিন্দিত ।

                 এই শিল্পীদের জীবন প্রকৃতপক্ষে স্নিগ্ধ মধুর কি না জানি না । তবে বেদনাবিধুর নিঃসন্দেহে । এঁদের না আছে স্বামী না সংসার সুখ । আছে শুধু উন্মুক্ত নৃত্যাঙ্গন । আছে শুধু রসিক । নাগর । জীবনে তাঁদের সন্তান কাম্য নয় , তবুও কেউ কেউ মা হন সন্তান প্রতিপালন করেন । 

                    কোন কিশোরী প্রেমিকের সাথে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে প্রেমিক হারিয়ে পথ হারা পাখির মতো একা একা ফিরতে ফিরতে , কেউ বা প্রবলের দৌর্দন্ড প্রতাপে জাত-কুল-মান খুইয়ে , কেউ বা অভিভাবকের অসহায় অবস্থার করুণ কারণে রসিকের কাছে এসে হাজির হন । অন্যান্য শিল্পীর মতো বালিকাবেলায় একজনও নাচনী হবার স্বপ্ন দেখেন নি । গতানুগতিকতায পথভ্রষ্ট নারী ঘটনাচক্রে পৌঁছে যান এই শিল্পের অঙ্গনে ।

                   সিন্ধুবালাও এর ব্যতিক্রম নন । মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি ঘরছাড়া । তৎকালীন সমাজের চোখে অকুলে ভেসে যাওয়া এক কুলত্যাগিনী কন্যা । ঘরের দিকে পিছন ফিরে তাকালে দেখেন ঘরের কপাট বন্ধ । সামনে শুধু নাচনী জীবনের দুয়ার অবারিত । সে পথ ধরেই তাঁকে এগিয়ে যেতে হবে । অন্তত যতোটা যাওয়া যায় । প্রথমে তালিম নিলেন গৌরচন্দ্র কুঁইরীর কাছে । রসিক পুরুলিয়ার বরাবাজার থানার ছোট গ্রাম গুঢ়াডাং -এর মহেশ্বর মাহাতো ।ডাকনাম --চ্যাপা । ক্রমে সিন্ধুবালার এক এবং অদ্বিতীয় পরিচয় হয়ে গেল --"চ্যাপা মাহ্তর লাচনী" ।

             সিন্ধুর জন্ম ১৯১২ সালে , বান্দোয়ান থানার শাল পলাশ মহুয়া ঘেরা মাঘলা গ্রামে । মায়ের নাম রমন মাঝি । বাবা গৌর মাঝি । ১৪ থেকে ১৯ বছরের সিন্ধুবালা কৈশোর ও যৌবনের এই সন্ধিক্ষণে চ্যাপা মাহাতোর দেহ-মন আউলানো ঝুমুরের সুরে আর ঢোল, নাগড়া , কত্তাল কেড়মেড়ি , সানাই , জুড়িনাগড়ার তালে তালে দাপিয়ে বেড়ালেন সারা মানভূম । 
                     
                           তখন যেখানেই উৎসব, গাজন, মেলা সেখানেই সিন্ধুবালা । বামুনডিহা , হুলহুলি কাঁটাডি সুকলাড়া যেখানেই নতুন হাটের সূচনা সেখানেই উদ্বোধন নৃত্যে সিন্ধুবালা । হাটের মুক্তমঞ্চে সিন্ধুর গানের তান আর নৃত্যের সুচারু ভঙ্গিতে আশপাশ মত্ত , উদ্ভাসিত । উপস্থিত দর্শকের মন যমুনার ছন্দে ছন্দে ভাবতরঙ্গে আনন্দরস কানায় কানায় পূর্ণ । 

                           একদিন কাশীপুরের রাজা জনার্দন কিশোর সিং দেও -এর গ্রামের সাপ্তাহিক হাট উদ্বোধনের জন্য ডাক পড়লো সিন্ধুবালার । তাঁর গানের সুরে আর নাচের ছন্দে রাজা বিমুগ্ধ , বিস্মিত , আনন্দ বিহ্বল । বেনারস থেকে যে সকল বাইজি আসতেন রাজদরবারে , সেই শিরোমণি , ফুলকুমারী , আশালতা , বেগমতাজ , পটলি , রাজলক্ষ্মী ; নাচে গানে তাঁদের সকলের ঊর্ধ্বে স্থান করে নিলেন সিন্ধুবালা । নাচলেন কমলা ঝরিয়ার সঙ্গে একই মঞ্চে । রাজার পরামর্শ অনুসারে ঢোল , ধমসা বাদ দিয়ে শ্রীবৃদ্ধির জন্য , উৎকর্ষতা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সংযোজিত হলো বেহালা , এসরাজ , ফুলোট ,কর্নেট , বাঁয়া-তবলা । তাঁর নাচ-গানের আসরে বিভিন্ন সময় উপস্থিত থেকেছেন বরাবাজারের ভোলানাথ দাস , রঘুনাথপুরের বৈদ্যনাথ সেন , মানবাজারের ব্যোমকেশ গাঙ্গুলী , গড় পাথরমহড়া রাজবাড়ির যদু নারায়ণ দেব , বড়জোড়ার গোউরবাবু , বেনারসের চন্দ্রমোহন বাবু সহ অনেক অনেক সুবিখ্যাত গায়ক , বংশীবাদক , তবলাবাজিয়ে , সঙ্গীত শিল্পী ও সমঝ্দার ।

                  সে সময় অন্য কোথাও নৃত্য প্রদর্শন করতে হলে রাজার অনুমতি দরকার হতো । তবে বিহারের জরিয়াগড় , বনয় , উড়িষ্যার বামড়া। বারিপদা , সনপুর , রাজখরসনা প্রভৃতি স্থানের রাজবাড়ীতে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে , বিশেষ করে উপনয়ন অনুষ্ঠানে যেতে বিশেষ কোন বাধা পেতেন না । নাচ বাদ দিয়ে ঠুংরি , ভজন আর শাক্ত পদাবলী ও বৈষ্ণব পদাবলী গানের আসর বসতো সেই সকল অনুষ্ঠানে ।

                         সময় তো নদীস্রোতের মতোই প্রবহমান , সেই প্রবাহধারায় একদিন ভারতবর্ষের মানচিত্র থেকে মুছে গেল মানভূম নাম । সে সময় এই তল্লাটে নানান দুর্যোগের ঘনঘটা । অবশেষে ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর পুনর্জন্ম হলো পুরুলিয়ার । কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সিন্দুবালার নাচের গতি থামলো না ‌। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার যেখানেই বিশেষ গাজন , মেলা , হাট সেখানেই সিন্ধুবালা । হঠাৎ অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসে ১৯৬০ সালে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন চ্যাপা মাহাতো । একটি পাখির দু'টি ডানার একটি কাটা পড়লো । এক বছরের মতো নৃত্য-গীত-বাদ্য স্তব্ধ । এ কথা বলতে গিয়ে সিন্ধুবালা বলতেন , "আমি যেমন আধঘুমে স্বপুন দে'খতম সানাইয়ের সুরে সুরে আমার রসিক রাঁই রাঁই করে কাঁ'দচে "। 
                  
                   মহাকালের স্রোতে একদিন সব কিছুই গা সওয়া হয়ে যায় । পুনরায় শুরু হলো নাচ চ্যাপার ভাইপো হৃষিকেশ মাহাতোর তত্ত্বাবধানে । একে একে প্রশিক্ষণ নিতে এলেন মাঝিহিড়ার গীতারাণী , আড়শা থানার সটরা গ্রামের বিমলা দেবী , রাজখরসনার মালাবতী । এলেন ধানবাদ এস. এস. এল. এন. টি. মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের অধ্যাপিকা বীণাপাণি মাহাতো । 

                       ১৯৮২ সাল । সিন্ধুর বয়স সত্তর উত্তীর্ণ । জীবনের অসংখ্য ঘূর্ণিঝড় ও কালো রাত অতিক্রম করে অবশেষে শুরু হলো পুরস্কার-সংবর্ধনার পালা । ১৯৮২ ও ১৯৮৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ লোকসংস্কৃতি উৎসবে যোগদান করে সম্মানিত হলেন সিন্ধুবালা । ১৯৮৬ সালে হুটমুড়া হাই স্কুলের হীরক জয়ন্তী অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল নুরুল হাসান তার হাতে পুরস্কার ও মানপত্র তুলে দিয়েছেন । ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিন মুক্তধারা সম্মানিত করে । রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়১৯৮৭-'৮৮ সালের "লোকসঙ্গীতে আকাদেমি সম্মান" দেয় সিন্ধুবালা কে । 

                 পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ তাঁকে তুলে দিলো লালন পুরস্কার --১৯৯৪ । ১৯৯৫ সালের ২৭ মে তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেন সুসজ্জিত শিশির মঞ্চে । ওই বছরই বর্ধমানের সোদপুর সম্মিলনী তাঁকে "চামু পুরস্কার-১৯৯৫" -এ সম্মানিত করে ।

                   ২০০৩-এও সিন্ধুবালা ৯২ বছরের তরতাজা মহুয়া বালিকা । পুরুলিয়া থেকে চাকলতোড় এর উপর দিয়ে বরাবাজার যাবার পথে টকরিয়া বাস স্টপেজে নেমে পশ্চিম মুখে হাঁটলেই ধানাড়া গ্রাম । তারপর ভালুকডুংরি । শেষে কেঁদরী । প্রায় চার কিলোমিটার রাঙ্গামাটির পথ । ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট্ট গ্রাম । সাজানো-গোছানো লোক সংগীত চর্চা কেন্দ্র "সিন্ধু সংগীতালয়" চ্যাপা তথা সিন্ধুর ভাইপো হৃষিকেশের পাঁচিল ঘেরা বাড়ির মধ্যেই ।

             সেখানেই আপন ছন্দে মাতোয়ারা সিন্ধুবালা প্রাণ ঢেলে শিখিয়ে চলছিলেন গান আর নাচ একের পর এক শিল্পী কে ‌। বারো বছরের পথহারা পাখি অসহায় বিন্দু নৃত্য-গীত-তরঙ্গময় সিন্ধু হয়ে সুরের সুষমায় প্লাবন আনলেন সারাবাংলায় , বিহার , উড়িষ্যায় । নাচনী নাচ ও ঝুমুর গান আয়ত্ত করা কি খুবই কঠিন (?) , এর জন্য শিল্পীর কী প্রয়োজন (?) --এই সব প্রশ্ন করলে সিন্ধুবালা দেবী তাঁর জাদুকন্ঠে গেয়ে উঠতেন রাইরাজেনের লেখা একটি ঝুমুর গানের প্রথম কলি ---
    "সুর স্বর তাল মান লয় ভাব রসজ্ঞান
          রাগ-রাগিনী আছে ভারী ।
গলার স্বর চাই মিষ্টি চাই ভাব-ভঙ্গি দৃষ্টি
          সম মাত্রা চাই বরাবরই ,
         ঝুমুর গাওয়া বড়ি ঝকমারি..."

                  এই বছরটি সিন্ধুবালার জন্মের শতোত্তর দশম বর্ষ । আমরা চাই দিকে দিকে তাঁকে নিয়ে , তাঁর শিল্পী জীবন নিয়ে আলোচনা হোক । গঠনমূলক আলোচনা । সভা হোক তাঁর নামে । ধান্দাবাজ ও স্বার্থান্বেষীদের সভা নয় , প্রকৃতপক্ষেই সমঝ্দার ও নামজাদাদের সভা । ২০০৪ সালের ৫ জানুয়ারি তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন । আমাদের দাবি এই ৫ ই জানুয়ারি, তাঁর মহাপ্রয়াণের দিনটি "ঝুমুর দিবস" হিসাবে স্বীকৃত ও পালিত হোক সরকারিভাবে ।



                   চিত্রশিল্পী : চিত্ত বৈরাগী



দীপংকর রায়ের কবিতা


সে আমার কত অপরিচয় যে, সে আমার কত অপরিচয়


১.
শরীরের বয়স হ'ল, মনের বয়স হ'ল কই ?

টের পাই না । অসম্মান অপমান বড় দেরি করে ধরা দেয়। 
বুঝি না অবহেলা ।
বুঝি না কে কখন এড়িয়ে নিঃশ্বাস চায় ভদ্রতাবসত। 

নিজের যুক্তি ধর্ম কি চাপিয়ে দিতে চায় মন, অন্য কারো উপরে? 

যদি চায় তবে তো যে শিক্ষাকে সতস্ফূর্ত বলে পরম্পরায় বইয়ে দিয়েছিলাম, বুঝতে চেয়েছিলাম ধর্মাধর্ম, লোকশিক্ষা, প্রেম 

মহাপ্রেমের চিৎকার পোঁছোয়নি তো কোনো বিশুদ্ধতায় 
বৃষ্টিও আসেনি 
এত মেঘে মেঘে যে বেলা অতিক্রম করলো এই পথ, পথমধ্যের হাওয়া-বাতাসে যে রুখু মাঠ ধরে 
গান গাইতে গাইতে চলে গ্যালো সেই পরিব্রাজক 

সে কি সবটাই ভুল আলেয়ার আলো? 

আজ যখন চেয়ে থাকি কারো উপস্থিতি ঘিরে, 
সামান্য একটু সহমত চেয়ে, সামান্য একটু অনুভব,'

ঘুরে দেখি অন্তিম হাঁকছে 

শরীরের বয়স হয়েছে, বয়স হয়নি মনের? 

কে তুমি দরজার আড়ালে 
লজ্জায় লাল হও খালি ?

ছায়া হয়ে হাওয়া সরে যায়  

সে আমার কত অপরিচয় যে ,
সে আমার কত পরিচয়--? 

 


২.
কার ডাকের অপেক্ষায় অস্থির কে? 
কার জিঞ্জাসায় ভারি হয়ে আছে ঘরের বাতাস? 

কার অপেক্ষায় অস্থির তাকাচ্ছে মেঘ-বৃষ্টি-রোদ। 

একটারও উত্তর নেই। 
সারাদিন টেবিলের ওপর পড়ে আছে ফোনটা। 

বালিয়ারী জুড়ে আছড়ে পড়ছে কত নোনাজল !
দিগন্ত থেকে দিগন্ত ছাড়িয়ে যত দূর চোখ যায় 
    ঢেউ আর ঢেউ.....
জলেরা কথা বলছে জলের সঙ্গে। 
ভাবছি, আরো কত 
               সমুদ্র-চিৎকার --

এক একটি দিন এমনই অস্থির 
এক একটা দিন এমনই স্মরণীয় 
যখন নিতান্ত সম্পর্কগুলিকেও মনে হয় 
কত প্রয়োজনীয়,'

সকল পুরাতনই নুতনে হারায় ।
তা বলে হারাবে কেন পরম্পরার স্মৃতি? 

সকল আপন, তোমার স্বজন ব্যথায় একবারের জন্যও উঠবে না কেন ডুকরে ---?

মানুষ তো মানুষেরই ভেতর মানুষকে গড়ে ---
মানুষের দুঃখ-সুখে একই মানুষ সকল অপরিচয়কে পরিচয় করতেই তো যত সব মাঙ্গলিকতা---? 

আমার বিরহে তোমার বিরহ নাই হ'ক
আমার কান্নায় তুমি নাই পারো কানতে ,
তা বলে সকল অপেক্ষার বার্তা তোমার অনুভবে পৌঁছায় না কেন ?

আকাশ একটাই, মেঘ-বৃষ্টি-রোদে 
তোমার মনের ঘরে একই হাওয়া-বাতাসের ঢেউ ,' 

কার ডাক শোনার অপেক্ষায় উতকর্ণ কে ?
কার কুশল অপেক্ষায় একবারও তাকায়নি কে 
বাইরের রোদে? 

ঘরের টেবিলটাই জানে, তার বুকের উপর পড়ে আছে একটি নিঃসঙ্গ রিসিভার -----




দেশলাই কাঠি

দেবাশিস সাহা


' কবিতার জন্য একটা জীবন যথেষ্ট নয় '
আগুন জ্বলে উঠবার আগে দেশলাই কাঠি বলল 
কোনো প্রশ্ন করার আগেই দৌড়ে এল মেঘেরা 
দেয়াল থেকে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সূর্য 
তুমুল বৃষ্টির ভিতরে কথাটা যাতে হারিয়ে না যায় 
শুধু এই জন্যে ছোট্ট একটা বিড়ি ধরিয়ে রাতের পর 
রাত পার হচ্ছি পেরিয়ে যাচ্ছি লক্ষ কোটি বছরের পুরোনো হাওয়া
পাথরে মাথা কুটছে মর্মরিত বাতাস
প্রাণপণ বুকের ভেতর ধরে রাখতে চাইছি 
আদরিনী, তোর মুখ...


আঙুলগুলো দীর্ঘ হোক আকাশ ছোঁয়ার মতো 
ভীষণভাবে চাইছি।
কিন্তু হাত থেকে খসে যাচ্ছে আঙুল
ধুলোয়  পড়ে ছটফট করছে যা কিছু ধরা ছিল 
শক্ত মুঠোয়।
মনে হয়, ঠিকই বলেছে দেশলাই কাঠি
কবিতার জন্য একটা জীবন যথেষ্ট নয়





বিশ্বজিৎ লায়েকের একগুচ্ছ কবিতা

১.
আমাদের গ্রহের রঙ নীল


কিছুটা নিয়েছি অভাব। অব্যয় মুক্ত ব্যক্তিগত হিম নিয়ে এবার একটু নেচে উঠব। বাকিটুকু ছড়িয়ে ছিটিয়ে 
জলের অক্ষরে লিখব সুর ও অসুর। তারপর সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ডাইনির গল্প। তাজা রক্ত আর নীল নীল
মাংসপিন্ডের গল্প।
ভোর ভোর উঠে যিনি খেয়াল গাইছেন তিনি কি জানেন বসন্তে পলাশ 
কতটা রঙিন কতটা আগুন!
একটি একটি করে মানুষ পুড়ে গেল একটি একটি মনোনয়নে 
একটি একটি নির্বাচনে একটি একটি অনির্বাচনে।

আলাপচারিতায় উঠে আসছে যে বধির হাওয়া ও বাতাস 
মহাকাশ থেকে আমাদের গ্রহের রঙ নীল
বিজ্ঞান এই সব শিখিয়েছে আমাদের 
আর আমরা জেনেছি লাল নীল হলুদ সবুজ গোলাপী গেরুয়া মাফিয়া 
এই সব কোন রঙ নয় তামাশা মাত্র আমাদের রঙ শুধু বেঁচে বর্তে থাকা      
                             


২.
অনিশ্চয়তার পোষা বেড়াল


না না সত্যি নয় এই চলন ও গমন
ঘুরতে ঘুরতে এক দেওয়াল উঁচু মাথা ঘাড় উঁচিয়ে গোটা দুনিয়াকে উচ্চস্বরে 
কাঁদতে বলছে মৃদুস্বরে বিড়বিড় করতে করতে ওই দেখ পালিয়ে গেল 
বোসদের বাড়ির পোষা বেড়াল 
আজ নিশ্চয় দুধে মুখ দেয় নি থুতনিতে কি লেগে ছিল সাদা রঙের হাসি

কিলবিল করছে চাপা অন্ধকার
নিঃসাড় হাহাকারে মুখ ডুবিয়ে পুড়ে যাওয়া মেঘের মতো 
এক মিনিটের নীরবতা পালনই আমাদের নিয়তি
আমরা কেউ গুণ করিনি দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ শুধু কাটাকুটি খেলা 
নিয়ে নুন হলুদ ফোড়ন দেওয়া সংসারে আটশো স্কোয়ার ফুট চিৎকার করেছি 
হাতের তালুতে  উল্টেপাল্টে বিষাক্ত করেছি ফুরফুরে মেজাজ

না না সত্যি নয় এতদিন বলে গেছি অনবরত অগ্রাহ্য করেছি ঘরের ভেতরে যে ঘর 
বলয় পথে দাপিয়ে বেড়াল যে বেড়াল
ঘষাকাচের আড়ালে উঁকি দিয়ে দেখল জলের শরীরে এখন অন্য অসুখ                                                                 



৩.
গানের ওপারে আমাদের ঘরকন্না


ঘুম থেকে জেগে উঠছে অহেতুক বিলাসী ঈষৎ ধূর্ত স্বপ্ন 
দ্যাখো এইরকম আবহাওয়া আমি চাই নি
সর্বস্ব দিয়ে-থুয়ে আমার এখন উল্লম্ব গতি 
দেওয়ালের গায়ে লিখেছিল কারা আদিম দীর্ঘশ্বাস 
কারা গেয়েছিল মৃত ঘিলুর গান
এইসব কিছু না জেনেই আমি আজ হাঁটতে শুরু করেছি 
না আমার কোনও তাড়া নেই আপাতত আমি কোথাও যাচ্ছি না

এখন কি দুপুর বেলা 
সূর্য ঢলে পড়ছে ‘আখরি তামাশায়” আর একটু অপেক্ষা করলেই দেখবে
‘তুমি দাঁড়িয়ে আছো আমার গানের ওপারে’

ততক্ষণ শুয়ে থাকি ততক্ষণ তুমি আমাকে রান্নাবান্না করো



৪.
সময় ও পৃথিবীর স্থানাঙ্ক


দুদিকের অক্ষরে লেগে ছিল বর্ষা মাটির মন 
তাকে তুমি জানান দিলে খোলা জিভে 
আমন্ত্রণ বৃত্ত নেই আলগা হচ্ছে লেপ্টে থাকা শাসন 
একটু একটু করে মরে যাচ্ছে সকরুণ হাসি 
দৃশ্যটি এই রকম ছিল না জ্যোৎস্না লাফাতে লাফাতে এসে নামল তেপান্তরে 
সাদা জ্যোৎস্না নীল জ্যোৎস্না ধান জ্যোৎস্না খই জ্যোৎস্না এত এত চাঁদ 
গলে গলে নিঃশেষ হচ্ছে অবসাদ মাখা তলপেটের নীচে 

এই সময় বৃষ্টি এল এক পশলা দু পশলা বজ্র এল তোয়াক্কা বিহীন ছাপার অক্ষরে
এল অন্ধকার নীরব নিয়তির পেট সব খেল হাঁস মুরগি তেল জল গরু গাধা 
ছাগল হাতি ঘোড়া শামুক বিশ্বজিৎ আর নয় এবার বাড়ি চল বৃষ্টি থেমে গেছে      



৫.
সাদা রঙের পৃথিবী


ঘর থেকে বাইরে বাইরে থেকে ঘরে লেগে ছিল লেগে থাকে গল্পের মুড়ো মৃত অন্ধকারের 
মতো তোমাকে ক্লান্ত বেহুশ এইসব আঁকিবুঁকি গল্পের দুদিকে জুড়ে দিতেই মহিষ ভাবল বেশ 
আরামে মুড করে ঘাস আর বিচালি খাবে ছেলেমানুষী করবে বডিল্যাংগোয়েজে বলবে ঘর নয় 
বাইরেও নয় শিং ওয়ালা মহিষ বাইপাশে উড়াল দিলো শৃঙ্গারে নামল আততায়ী 

লিখতে লিখতে ভুল লিখল করোটি ও কঙ্কাল আবার সিঁড়ি ধরে নামল সিঁড়ি ধরে উঠল আলস্যে 
লিখল ঘৃতাহুতি ঘর থকে বাইরে বাইরে থেকে ঘরে ঘরের খেয়ে মহিষ চলে গেল অন্য কৃষিকাজে              



৬.
সমীহ শোকের পৃথিবী


নাভির মুখে জ্বেলে দিলাম বসন্ত ও খড় 
আমার পরিশ্রম হু হু করে ঢুকে গেল ইছামতীর জলে 
জল কি লিখে দেয় অমুদ্রিত বইয়ের প্রচ্ছদ শূন্য সংগীত 
ব্যক্তিগত ঘাম ও নুনের এই সংসারে উড়িয়ে দিচ্ছ নিরক্ষর মানুষের আহ্নিকগতি 
কী ভাবে লিখবে এই আরোপণ মানুষের সমীহ শোক ও পরিতাপ



             ছবি : দীপাংশু মাহাত



দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

১.
আয়ু


অঘ্রান। ধানখেতের ভেতর দিয়ে হাঁটি চলো। এই
আলপথে হেঁটে গেছে ব্যথিত খরিশ, একদিন। 

ভয়ার্ত ইঁদুর, নীচে, থাবা তার ডুবে আছে ধানের শিকড়ে। 

ওই জ্যোৎস্না গাঢ় হল ওই প্যাঁচার কর্কশ কালো ডাক। 
চলো ধানের উত্তাপ নিয়ে আশরীর দামামা বাজাই। আজ
নাভী থেকে শুরু হোক। সমস্ত কন্দরে এসো গলিত দেহের সারাৎসার। 

শ্রাবণের রাত্রিশেষে এইখানে ফুড়কি ছাতু ফুটে উঠবে একদিন
অল্প একটু আয়ু আর অফুরান হাসি হাসি হাসি। 


২.
যুদ্ধ-২


যুদ্ধ যে অমর, তুমি মানতে পার না। আর সেজন্যেই
ছুটে আস অঘ্রানের প্রসন্ন সীমায়। 

আজ দীপাবলি। কার্তিকের শেষ রোদ সঙ্গে করে নিয়ে গেছে
হারানো বাছুরগুলি, আমাদের, শ্যামাপোকা-ঝিঁঝি-ফড়িঙের ডিম। 
কী যে শান্ত, কী যে কী সহজ। 
ধানের সোনালি রং, নিহত খড়ের ধূসরতা--- দেখো, আকাশের
নীলে মিশে ভাষাহীন, স্থির। 

এসো, সূর্যাস্তের দিকে হাঁটি, হেমন্তে নিশ্চল শালবনের দিকে।

মালিন্য নামুক, আজ চাঁদ উঠবে না।




সৌরভ লায়েকের কবিতা

১.
লালন


একবেলা খোঁজ নিতে পারতে তুমিও 
জল সরিয়ে কাঁসাইয়ের মতো মেলে ধরতে পারতে কাশের আঁচল 

অদূরে কোথাও কোনো খাঁড়ি নেই ডিঙি নেই 
সব ঢুকে গেল সন্ত্রস্ত পৃথিবীর গভীরতম কোথাও !


সেতুটি বাঁধার পর মাঝির অবস্থা ঠিক যেরকম হয়
নদী আছে , নৌকা আছে , নেই খেয়া পারাপার

সেরকমই
কৌশলী হাতের নৈপুণ্য হারিয়ে যায় ধীরে ধীরে
হারিয়ে যায় ভালোবাসা
অযত্নে , অব্যবহারে ।


২.
বর্ষা দিনে


ঝাপসা কাঁচের আড়াল থেকে 
তোমায় দেখি শুদ্ধ মতো 
বর্ষামুখর আলো-আঁধারি 
বারোয়ারি আর ব্যক্তিগত 

মাটির ঘরের দেওয়াল জুড়ে 
বেহায়া আমার প্রতিকৃতি 
মনে পড়ে তোমার আমার 
সুরম্য দিন ঠুনকো স্মৃতি 

সেসব কথা বিস্মৃত প্রায় 
দৈবে কিংবা ইচ্ছে করে 
বৃষ্টি পাগল খুলল আগল 
ভিজলো কপোল মাটির পরে

বর্ষা দিনে বনবাসে যাই
খুঁজে বেড়াই পাথরটা কে ?
ক্ষ্যাপার মতো রামকে বসাই
ঘুম ভাঙাতে অহল্যাকে





পারাবারের সঙ্গসুধায়...

ডরোথী দাশ বিশ্বাস


ঐ যে দূরে সাগর জলে 
রুপোলি জলের ঠেউ
ছোট্ট একটি জেলে ডিঙি 
আর আছে কেউ কেউ,  ধনি

উঁচু নীচু নির্জন এক
সাদা বেলাভূমি
জোয়ারে ঢেউ যায় যে চলে 
পায়ের পাতা চুমি,  ধনি

শোঁ শোঁ বাতাস শিষ দিয়ে যায়
ঝাউয়ের ক্যানভাসে
কেয়াগাছের বনবনানী
মুখ টিপে ঐ হাসে,  ধনি

নির্জন এই সাগরতটে
অথৈ নোনা জল
পায়ের কাছে খেলা করে
লাল কাঁকড়ার দল,  ধনি

অনেক দূরে বিস্তৃত এই
নিরালা বালিয়াড়ি
পারাবারের সঙ্গসুধায়
ডরোথী দেয় পাড়ি,  ধনি

                           ( ঝুমুর গান)

 


সুবোধ পরামানিকের কবিতা

১.
অজুহাত


তোমার অজুহাত এবং জুজুহাত জোড়া করে দেখা
সর্বত্রই কেমন আমিষ আমিষ গন্ধ বেরুচ্ছে
তা তুমি যতই হাত ধুয়ে ফেল না কেন
গন্ধ কিছুতেই যেতে চায় না আর।

পদ্মপাতার টলমল জলে ধুতে চাইলেও
তোমার চার হাত জুড়ে লেপ্টে থাকে
নিশিপদ্মের আঠা, আমিষ গন্ধ।

এবার তোমার দুটো হাতে
দুটো মেরু চেপ্টে যেতে যেতে
রসাতলে ঢুকে পড়তে চাইছে।


২.
রসাতল


তোমার কোনখানে
এক টুকরো মায়া-মমতা নেই জানি।
তাই তোমার জন্য কৃষ্ণগহ্বর খুঁজতে বেরিয়েছি
এবার হয়তো সব কীর্তি রসাতলে যাবে বলা যেতে পারে।

লিঙ্গ ভেদে রসাতল নিয়েও মাপা জোকা
শুরু হয়েছে যখন;
তখন তোমার আর কতটুকু ক্ষয়।

আমাদের আঁশ বঁটিতে, আমিষ ও নিরামিষ দুইই রান্না হয় যখন
তোমার ঝালে ঝোলে অম্বলে তখন
রসাতলে রস মিশে যায়।


                  ছবি : দীপাংশু মাহাত



অয়ন জোয়ারদারের অনুগল্প

১.
পুজো শুরুর গপ্প
সার্থক পালি


বছর দুয়েক বিয়ে হয়েছে পালি ও সার্থকের। দুজনেই কেজো, একজন সরকারের আরেকজন সরকারধন্য আধিকারিক। সার্থকের সাবেকি বাড়ি, কাকা কাকিমা ভাই নিয়ে যৌথযাপন , এক হেঁশেল। পালির আপত্তিটা একসাথে থাকা নিয়ে নয়, রবিবারের রান্নায় কাকিমাকে সাহায্য করা নিয়ে! একটি মাত্র ছুটির দিনে নিজের মত করে থাকাটা, বিশেষ করে সার্থকের সাথে থাকাটা সে চায়। সার্থক বোঝে কিন্তু যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠে, এ নিয়ে কথোপকথন ভালো লাগে না। প্রথমে সে এড়িয়ে যায়, পরে পালিকে বোঝায়, শেষে ঝগড়া করে। এমনিতেই ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্স চলছে, সর্বক্ষণ মুখ ঢাকা, হাত কচলানো। 
আজ চার মাস হলো পালি সার্থক একই বাড়িতে সামান্য কথাবার্তা সম্বল করে আলাদা থাকে, মানে পালি কাকিমার মেয়ের সাথে, সার্থক নিজের খাটে, নিজের ঘরে অফিসে দুতিন দিন করে যেতেই হয় সার্থককে, পালিকে প্রায়ই। পুজো আসছে, আবহাওয়ায় বেনিয়ম, গরম ঠান্ডার ককটেল চলছে পূব শারদে।
অতিমারীতে সবাই খুব সাবধানী। ওষুধের অপ্রয়োজনীয় খরচ লাফিয়ে বাড়ছে। আয়ুর্বেদ হোমিও, টোটকা সব তো আছেই। এ সময়েই কাকিমার মেয়ে মানে এ পরিবারের ছোট্ট সদস্য মোম এর জ্বর এলো, সাথে কাশি এলো সন্দেহ নিয়ে। দেখ দেখি পুজোর আগে কি আপদ! দ্বিতীয় দিন এলো পালি ও কাকিমার। ডাক্তার ওষুধ লিখে আলাদা ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়ে, কোভিড পরীক্ষার কথা বলল। সার্থক দেখতে গেলো দূর থেকে।
-টেস্ট পাচ্ছো? গন্ধ পাচ্ছো?
উত্তর এলো- সাবধানে থাকো, এ ঘরে ঢুকবে না।
কাকুর কথায় টেস্ট হলো সবার। হ্যাঁ প্রায় হুকুম করে সবার।
সার্থক খুব একটা ভক্ত নয়, তবুও, যেদিন টেস্ট রিপোর্ট আসার দিন, অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়ি থেকেই বেলুড়ের দিকে মুখ করে একটা প্রণাম করলো।
বাড়ি এসে ঘরে ঢুকে দেখলো তার ঘরে পালি বসে আছে। কাকু কাকিমা মোম কারুর দেখা নেই। ইশারায় জিগ্গেস করলো সার্থক...
-আমি তুমি পজিটিভ, একঘরে থাকতে হবে ১৮ দিন।
-আর সব?
নেগেটিভ।
-খাদ্য খাবার?
 কাকিমা দরজার বাইরে রেখে যাবে।
কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
- তা বুঝবে কেনো! একসাথে থাকতে হবে এখন এতদিন, তাও তোমার সাথে!!
সার্থক তার ছোটবেলার বড়বেলার ঘর ভরিয়ে হেসে উঠলো।
ও ঘর থেকে মোম বলে উঠলো "বেশ হয়েছে, থাকো এবার পুজোয় একসাথে, একঘরে, আমরা সেজেগুজে পুজোয় বেরোব, তোমরা বাড়িতে।"

পালির চোখে জল, সার্থক এগোয়;

দুটো করোনা ততোক্ষণে জড়িয়ে ধরেছে পজিটিভ।

 

২.
পুজো শেষের গপ্প
বিজয়া


একটা গো গো শব্দ , ডাস্টবিনে বাচ্চাটা পড়েছিলো।
দশমীর রাতে অশক্ত রতিকান্ত, তুলে এনে বউকে দিল।
নাম দিলাম বিজয়।
মন্দিরা বুকে চেপে রাখে, তার বুকে দুধ নেই কখনও।
একবছর আগে পুজোর দিনে ফূর্তিতে এসে ছিল বোধহয় বিজয়!
অপরাধ কারো নয় মা! অপরাধ বিজয়ের।




মাড় ভাত

শক্তিপদ মাহাত


মাড়ে ভাতে এক ডুভা
নুইড়ে নাইড়ে চইখ নুবা
                মরদ গেল কামে,
সুয়াঁগ বলে পাখর ভাঙ্গা
পেটের দায়ে মন চাঙ্গা
               রোদ বাসাত ঘামে।
বাবু ঘুরে ছাতা ধইরে
খাটালি দেই হিঁসাব কইরে
                টানটুনের সংসার,
নাই হামদের চাষবাড়ি
খাটা চাটা ভাতের হাঁড়ি
                ডেরা উচার নাচার।
রকত শুখা খাটনির ধন
ধনিমানের সুখের জীবন
                 আকাশ ছুয়া দালান,
গরিবের ঘর ভাঙা বুচা
মান সনমান কাঠকুচা
               ধুলাই যে ভগবান।





প্লুটো

পল্লব গোস্বামী


লাস্ট বেঞ্চ 

মুখে ভুষোকালি মেখে 
ম্লানমুখ এক 
বহুরুপী 

হীরে গলানো জোৎস্না 
বামনের চাঁদ

ক্রমশ ছোটো হয়ে আসি 
             
ছিটকে পড়ি 

দেখি,
   ছোটো ছোটো শিশুরা 
   তালের গাড়ি নিয়ে 
   শুকনো পুকুর

ঠোঁটে হাসি 
ডানায় আনন্দ 

কেঁপে কেঁপে ওঠে 
আমার 
কেয়াপাতার ক্লাসরুম ...




দেবাশীষ সরখেলের কবিতা

১.
অমরত্ব


 অমরত্ব বলে কিছু নাই
 যা আছে অন্তরমহলে  ,আনন্দ বৈরাগী ।
 সূরা  ও নারীর দিকে যায় নাই
                                   কিছুটা তো তাগী।

 এক অদৃশ্য সুন্দর 
মধ্যরাতে  
                   দরজায় টোকা
        জোনাকির মহোৎসব  
         অমরত্ব গিলে খায় পোকা ।


২.
রাজার জামাই
 

 স্বপ্ন বিলোতে গেলে  দম লাগে
 চাকরি ছেড়ে দিলে বউ রীতিমতো সমাজতান্ত্রিক
 সে এক দৃষ্টান্ত ।

 বলে আমি ত্যাগ 
আমিই লড়াই
 মহিশিলা ঘাটশিলা কোথাও যেও না আমাকেই দেখ ।
 সসাগরা বসুন্ধরা এই দেহে
 ফালগুনীর সন্দেহে  জল ঢেলে আমি
 হে সুদামসখা  মুক্তির কান্ডারী ।

 দেখে দেখে বিভোর সকলে ।

 নব মেঘদলে  সাক্ষাৎ বরুণদেব
 কথার প্রাসাদ  কথা জাদু কথাশিল্প
 কথামৃত গিলেছে সকলে ।

 হাতে এলো রংদার ছডি
 উপযোগিতার প্রশ্নে গাড়ি এসি
 সমাজের মহার্ঘ সম্পদ সে ।

 মানব সম্পদের সেরা মুখ ।

 বস্তুর ভেতরে দেখে বস্তুত দ্বন্দ্ব নাই
 আহ্লাদ রয়েছে ।

 আহ্লাদে নাতিকে খেলায়
 পোল্ট্রি মুরগি সব ভাতুয়ারা বলে
 ডিম ডিম ডিম দিব ।

 দশ আনা ছয় আনা রেটে পোস্টার লেখে
 তুষার সিংহের পদতলে 
শেকল ছেঁড়ার  খোঁজে
  যে আদাব দিয়েছেন সমরেশ ।
 তার লেশ মাত্র  নাই
 স্বপন বপন করে রাজার জামাই ।


৩.
প্রাকৃতিক
 

 দু চাকা ভিজছে
  চালক  সিক্ত হচ্ছে
 গরম হচ্ছে
  মুঠো ভরা  নয়া মেঘভার ।

 আলো জ্বলে গেল 
আধার আসিল ।

 দিনের  ধডমুন্ড বাকী এখনো  ।

 চা দিতে এলো
 বলল  মাথাব্যথা
 হতে পারে কার্সিনোমা ।

 বেরসিক আলো চলে গেলে
 দুখানা  দৈত্য নেমে আসে
 ভয় নয়
 চারপাশে বরাভয় মুক্তদানা ।

 তোমার জন্য দুজন প্রতীক্ষারত
 না না প্রেম নয়
 প্রেম-ট্রেম উবে গেছে আকাশগঙ্গায় ।

 টাকা পাবে
 দিতে বড় কষ্ট হয়
 পেতে ভালো লাগে
 ভালো লাগে মেঘবার্তা  চা মুক্তদানা ।

 কার্সিনোমা অপেক্ষা  
 দৈত্যের হাতে দিকচিহ্নহীন আধার
 তবে কোন পথে গমনাগমন চেতনা  ?




ব্রততী পরামাণিকের কবিতা

১.
উৎসের সন্ধান


জীবন শিক্ষার আধার 
একের পর এক পাঠ নিতে নিতে 
শৈশব থেকে বৃদ্ধ
তারপর জীবন তরণী মৃত্যুমোহনায় 
পিপাসার্ত আত্মা খোঁজে উৎসের সন্ধান
জিজ্ঞাসার পর জিজ্ঞাসা -
বয়সের ভারে ন্যুব্জ, ঝাপসা দৃষ্টি 
তবু যেন অজানা গহ্বরেই কাটে প্রহর।



২.
অন্তিম ভাবনা


সবুজের হাতছানিতে, মন সবুজ 
হাত বাড়ায়,স্পর্শজনিত-
হেসে লুকায় সবুজ-
বদলে ফিরে আসে,ধূসর 
চোখ ধূসর, মনও ধূসর
তবু ভেসে যায়, নীলাকাশে 
পাখনা গজায় না ওড়বার,
সাধ জাগলেও, জানি,সাধ্য নেই- চুপচাপ বসে ভাবি অন্তিমের।


৩.
ওগো বৃষ্টি


ওগো বৃষ্টি, ধুয়ে দাও, সারা অঞ্চল 
ঝরঝর,ঝর্ণাধারায় নৃত্য করো,তা-থৈ
পুঞ্জিভূত মেঘমালাদের বুকে থাকে জল
ওগো বৃষ্টি, ধুয়ে দাও সারা অঞ্চল 
শুষ্ক মাটিকে সিক্ত করো,হাসুক খলখল 
নদী জলে ভরপুর,ধেয়ে আসে ওই 
ওগো বৃষ্টি, ধুয়ে দাও, সারা অঞ্চল 
ঝরঝর, ঝর্ণাধারায় নৃত্য করো, তা-থৈ।


                     ছবি : কল্পোত্তম


সুজন পণ্ডার কবিতা

১.
ছুঁয়ে থাকো


ছুঁয়ে থাকো...
যেভাবে আঙুলে লেগে থাকে
ফুলের পরাগ।
যেভাবে ধ্রুবতারা ছুঁয়ে থাকে
উত্তরের আকাশ...।

একেকটি নক্ষত্র
একেক দেশের রূপকথা। 
ঘুম না হওয়া রাত্রে
সেই রূপকথার গল্পে
অতীতের সত্যিরা জড়িয়ে জড়িয়ে থাকে

আমার বুকের ওপর হাত রাখো
যেভাবে জল জমে
ফুলের পাঁপড়িতে..
যেভাবে জড়িয়ে না গিয়ে
শুধু নির্মোহ লেগে থাকা।
ছুঁয়ে থাকো
শুধু ছুঁয়ে থাকো।



২.
বহুকাল


আজ বহুকাল
এই শীর্ণ আকাশের তলায়
শুয়ে আছি
শান্তির এই চার পাশ
গভীর রাতের মত শান্তি
হলুদ চাঁদ আরো শীর্ণকায়
শুকনো নদীর মত
জেগে আছে পাশে
কিছু এলোমেলো বক ফুল
কিছু নুড়ি পাথরের মত
আকাশে ছড়িয়ে
শান্ত শ্রান্ত ছায়াপথ
আর নীহারিকা

বহুকাল চেয়ে আছি
অপেক্ষার শীর্ণতায়



                আমাদের বই





সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com





মন্তব্যসমূহ

  1. সত্যি- সিন্ধু: একটি তরঙ্গ...অরন্ধন-এর সার্বিক প্রকাশ একটি অসাধারণ...অরন্ধন পাঠে মুগ্ধ হলাম!
    ধন্যবাদ- উত্তম মাহাত
    সম্পাদক: অরন্ধন
    ❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️

    উত্তরমুছুন
  2. সময় নিয়ে সম্পূর্ণ সংখ্যাটি পড়লাম ও ছবি প্রদর্শ- শালা দেখলাম | চমৎকার গোছানো কাজ হয়েছে | সব লেখাই ভালো লেগেছে | বিশেষ ভাবে ভালো লাগল , দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বজিৎ লায়েকের কবিতা | অরন্ধন এখন আমাদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে |

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪