দ্বিতীয় বর্ষ ।। অষ্টম ওয়েব সংস্করণ ।। ১৬ শ্রাবণ ১৪২৮ ।। ২ আগষ্ট ২০২১






শূন্য দশকের আগে থেকেই অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে ভারতবর্ষের জলবায়ু। দেশের বিভিন্ন জায়গাতে বৃষ্টিপাতের যে প্রাকৃতিক বন্টন দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে তা এখন আর সেইভাবে বন্টিত হচ্ছে না। কোনো জায়গাতে হঠাৎ করে অধিক বৃষ্টিপাত এবং কোনো জায়গাতে বৃষ্টিপাতের অভাবে খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে একদিকে যেমন সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে চাষীদের, তেমনই চাষবাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয় অর্থনীতিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বছরের পর বছর। দীর্ঘদিন ধরে চাষবাসের অনিশ্চয়তার কারণে কমে যাচ্ছে এই দেশের জিডিপি। যার ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে আমাদের দেশ।
         জলবায়ুর এই পরিবর্তন হঠাৎ করে হয়নি। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে কলকারখানা প্রতিস্থাপনের পরিমাণ মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া, পেট্রোলিয়াম চালিত গাড়ির পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়া এবং বিভিন্ন কারণে বন জঙ্গল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে পরিবেশের যে ভারসাম্য তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই ভারসাম্যহীনতা এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ভারতবর্ষের স্বাভাবিক জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। যার প্রভাব পড়ছে বৃষ্টিপাতের ওপর এবং বৃষ্টিনির্ভর চাষ-বাসের ওপর। চাষিরা তাঁদের লক্ষ্যমাত্রা পুরণে ব্যর্থ হচ্ছেন। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের মাথাপিছু আয়ের ওপর। অর্থাৎ আমাদের দেশের মাথাপিছু আয় অন্যান্য দেশের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় কমে যাচ্ছে।
           শুধু কি তাই? এই পরিস্থিতির কারণে কমে যাচ্ছে এই দেশের মানুষের সুস্থতার হারও। 
            তাই, উষ্ণায়নের প্রভাব কমানোর জন্য এখনই ব্যবস্থা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা কোথায় গিয়ে পৌঁছাব তা সহজেই অনুমেয়।



উত্তম মাহাত, সম্পাদক





যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
_______________________________________________


তৈমুর খান/ দুর্গা দত্ত/ দীপংকর রায়/ হাবিবুর রহমান এনার/ অয়ন জোয়ারদার/ মহিউদ্দিন সাইফ/ উজ্জ্বল গরাই / মধুপর্ণা / তপন পাত্র

_______________________________________________


তৈমুর খানের গুচ্ছ কবিতা


১.
মৃত্যুর বিরুদ্ধে



আর একবার জিজ্ঞেস করি:
সঙ্গে আছো তো?

শামিয়ানা টেঙেছে সব বাড়ি
পাড়া-প্রতিবেশী সবাই উলুধ্বনি দেয়
সন্ধ্যেবেলা ফিরব কোথায়?
অন্ধকার সব রাস্তা করে নিচ্ছে চুরি!

এটাই দুর্গার বাপের বাড়ি?
এখানেই হোম করেছিলেন দক্ষ প্রজাপতি?
শিউরে উঠছি…

হাসপাতালের দিকে যেতে যেতে
অ্যাম্বুলেন্সটি পাক খাচ্ছে...

গাড়ি থামাও, গাড়ি থামাও
একবার অন্তত একটা ফোন করি!



২.
বিশ্বাস



আমরা বিশ্বাস পুষে রাখি
বিশ্বাস এসে আলো জ্বালে
আলোকিত ঘরে
আমাদের শিশুরা চাঁদ দ্যাখে।

চাঁদ কি টিপ দিয়ে যায়
তাদের কপালে?

দুধ নেই, দুধ খাওয়ার বাটি নেই
তবুও বিশ্বাস আছে আমাদের।
                              আরও কবিতা পড়ুন




আড়বাঁশি : একুশ

দুর্গা দত্ত


মেঘ নেই, বৃষ্টি নেই, বহু দূরে 
অন্য কোনো জন্মের আবছা বিকেলে
তোমার গলায় মৃদু দুলে ওঠা
ফিরোজা বেগম :-

সেই দিন ঘুমভাঙা চোখে গূঢ় 
নদীকে চিনেছি।
মেঘ ,বৃষ্টিধারা, কেয়াবন ,
বালুতটে রোদপোহানো নৌকোর ছেঁড়াখোঁড়া পাল--

সেদিনই চিনেছি ।

অতুল সাঁতার, স্রোত, হাবুডুবু অনন্ত কলস
সেদিন থেকেই রোজ , ঘাট ছেড়ে
আজ অবধি ভেসে যায় 
মাঝদরিয়ায় ...




দীপংকর রায়ের গুচ্ছ কবিতা



১.
কার ডাকের অপেক্ষায় অস্থির কে? 
কার জিজ্ঞাসা জুড়ে ভারি হয়ে আছে ঘরের বাতাস? 

কার অপেক্ষায় অস্থির তাকাচ্ছে মেঘ-বৃষ্টি-রোদ। 

একটা প্রশ্নেরও ঠিকঠাক উত্তর নেই। 
সমস্ত দিন টেবিলের উপর পড়ে আছে ফোনটা। 

বালিয়ারী জুড়ে আছড়ে পড়ছে কতো নোনাজল! 
দিগন্ত থেকে দিগন্ত ছাড়িয়ে যত দূর চোখ যায় 
          ঢেউ আর ঢেউ ....
জলেরা কথা বলছে জলের সঙ্গে। 
ভাবছি, আরো কত সমুদ্র-চিৎকার ----

এক একটা দিন জীবনকে নিয়ে জীবন এমনই অস্থির 
এক একটা দিন এমনই স্মরণীয় 
নিতান্ত সম্পর্ককেও যখন মনে হয় কত প্রয়োজনীয়, 

সকল নুতনই পুরাতনকে হারায় 
তাই বলে হারাবে কেন পরম্পরার স্মৃতি? 
সকল আপন , তোমার স্বজন ব্যথায় , একবারের জন্যেও উঠবে না কেন ডুকরে ----?

মানুষ তো মানুষেরই মুখের ভেতর মানুষকে গড়ে ----
মানুষের দুঃখ - সুখে একই মানুষ সকল অপরিচয়কে পরিচয় করতেই তো যত সব মাঙ্গলিকতা---? 

আমার বিরহে তোমার বিরহ নাই হোক 
আমার কান্নায় তুমি নাই পারো কানতে 
তাই বলে সকল অপেক্ষার 
বার্তা , তোমার অনুভবে পৌঁছয় না কেন? 

আকাশ একটাই, মেঘ বৃষ্টি রোদে 
তোমার মনের ঘরে একই হাওয়া-বাতাসের ঢেউ, 

কার ডাক শোনার অপেক্ষায় উৎকর্ণ কে? 
কার কুশল জিজ্ঞাসার অপেক্ষায় একবারও তাকায়নি কে বাইরের রোদে? 

ঘরের টেবিলটাই জানে, তার বুকের উপর সমস্তদিন পড়ে আছে কেন একটি নিঃসঙ্গ রিসিভার --আরও কবিতা পড়ুন






কবিতা
..........

হাবিবুর রহমান এনার

অশ্ব


বেগবান অশ্ব ছুটছে...
পূর্ণিমালোর মায়াবী নিশিতে—অশ্ব ছুটে চলে যায়...

পায়ের তালে- খসেপড়া বাহারি পল্লবের সংসার ওড়ে

এই অশ্বের নেই কোনো আস্তাবল- নেই কোনো গন্তব্য

স্মৃতিভ্রষ্ট আজ...

সেই নিশিতে- পরিযায়ী পক্ষিরাজটি দ্বিখণ্ডিত হয়েছিলো, কোনসে পাষাণ গুণীনের অঙ্গুলির ইশারায়?
......



ওরাও তো মানুষ


ঈশ্বরের পরম মমতার সৃষ্টি হলো মানুষ-
মর্যাদায়...অতি উত্তম—পরমের কাল কিংবা মহাকালের
বিবর্তনে...সভ্য হলো—হলো মহাজ্ঞানী, মহাজন...

নিত্য দেখি...পাশ দিয়ে- সভ্যতাবরণে...অসভ্য...
নির্দ্বিধায় হেঁটে চলে যায়...ওরাওতো মানুষ?
......




সিগারেট


ক্রমশ-
পোড়ে পোড়ে ছাই-ভস্ম হতেছে- দুঠোঁটের ফাঁকে...
চেপে ধরা সিগারেটটি!
সেতো পোড়ে ছাই-ভস্ম হবেইবা না কেনো,
কারণ-
সেতো পোড়ে ছাই-ভস্ম হবার তরেই জন্ম যে তার!

মোদ্দা কথা-
সিগারেটের প্রতিটি আয়েশি টানের পর টানে,
ছাই-ভস্ম হচ্ছি—আমি তুমি...সবাই!
......



লীলা


লক্ষ কুটি দেবতার চরণ কায়মনে নত মস্তকে ছুঁই...
মননে দ্বিধাবোধ খেলে—কাকে ছেড়ে- কাকে পুজি
কে দেবে আত্মতুষ্টি...আত্মশুদ্ধি?

আনমনে দৃশ্যত- হয় সৃষ্টি জগতের সুশৃঙ্খল লীলা—
অন্তরাত্মা ছটফটায়...লাশরিকের দরবারে- আছে
না-কি বিচার...বেহেস্ত দোজখ—
আরও না-কি রহস্য অপার?



          ছবি : দীপাংশু মাহাত



জাগানিয়া

অয়ন জোয়ারদার


‌জোৎস্না যখন স্নানে নামে ,তারারা পাড়ে বসে,
‌অরূপ নরমে সে শুকিয়ে নেয় কলঙ্ক ..
‌হাওয়া সরে যায় স্মৃতির ইছামতীতে দাগ কেটে..
‌দূরে বৃষ্টি হয় , তার ভেজা ভেজা ভালোথাকা প্রাণ বায়ু নিয়ে আসে।
‌মায়াময় জড়িয়ে থাকা সাদা কালো ছবি গুলো সকালের প্রথম না ওঠা আলোর মত চোখের পাতায় বসে..
কদম্বের গন্ধে প্রেরণা মঙ্গলঘট বসায়; 
কানের লতি ছুঁয়ে জলীয় বাতাস ইত্তিলা পাঠায় মাটিতে পড়ে থাকা মনমরা অজানা বীজ কে।
মান জাগে, প্রাণ জাগে, ধ্যান জাগে, আধো ঘুম থেকে জেগে ওঠে বিনয়.. আর প্রণাম-
‌আমার স্বপ্নের দাম নিজেকে দিয়েও আমি এই অসম্ভবেও প্রেরণা খুঁজি।
‌জোৎস্নার পাতারা সূর্যের আলোয় নিজেকে লুকিয়ে আমাকে দেখে-
‌আমি টানটান চেয়ে থাকি সূর্যের দিকে।




মহিউদ্দিন সাইফের কবিতা


১.
সেই মালীর কথা


গোলাপের দিকে তাকাতেই সেই মালীর কথা মনে এল, নির্গুণ।
ফলে ভেসে এল গোপন মহক।
সে মহকে পুরুষ্টু আঁধার পেতে বসে পড়লাম।


সে কত জন্মের কথা,
প্রদোষ পাথরে বসে বাজাত বাঁশরি।
যত সুর গাঢ় হত, তত বেশি ফুটে উঠত কলি।
ভরাট ফুঁয়ের চোটে নিক্কণ দিয়ে উঠত কুনকুন ধ্বনি।
আমরা একে অপরের মুখোমুখি
আঁচ করতে চেষ্টা করতাম
কার জীবনের দিকে ছুটে যাচ্ছি কে?



২.
সত্য-শালতলে


সত্য-শালতলে অনহা ডমরুর শব্দে জেগে উঠলেন যিনি
তাঁর জন্য রচিত হল বিনতির মালা।
ডুঙরি-ডিহির গ্রাম থেকে এল প্রাচীন দেয়াশি।

বাতাসে ঝংকার তুলে জানাল
যে পাখিটি জন্মেছে
আমরা তারই সন্তান।

পাশে কেশর দুলিয়ে হাঁটা দামোদর
কত কি যে ম্যাজিক দেখাল।
বেশুমার ডালগুলি কিন্নর,
চিত্রিত রূপকের পথ।





উজ্জ্বল গরাই-এর কবিতা


১.
প্রাকবর্ষা


ভাই ছোটবেলা থেকেই কল্পণাপ্রবণ ।
ওর ইচ্ছে ছাদের পাশে একটা পাহাড় থাক
 আর কয়েকটা দোয়েলের বাসা।

মাঝরাতে ট্রেনের শব্দ ভেসে এলে
ছাদের পাশে বৃষ্টি নামুক প্রাকবর্ষার।

প্রিয় বান্ধবীদের দেখেছি 
দামি গাড়ির কাঁচ নামিয়ে পাখি হওয়ার দিনগুলোকে 
তুচ্ছ করে চলে যেতে , 
সেসব দিন যেন অঘটন ছিল সব।

দেখেছি বয়সের আগেই বুড়ো হয়ে যাওয়া বন্ধুদের ...

গানহীন সন্ধ্যে নামে ওদের চোখের উপর।

আমাদের দশফুট বাই সাড়ে আটফুটের ছাদ।

বাবা কিছুদিন আগে একটা সূর্যমুখীর চারা এনে দিয়েছিল

বাবাকে সেদিন দেখে মনে হল
বাবার শরীরের ভেতর সমস্ত শিকড়, শরীর ছাড়িয়ে নেমে গেছে কোন অতলে;

শীর্ণ ডালগুলির নীচে দাঁড়িয়ে 
ভাই একা দোয়েল ডাকছে ,
আর প্রাকবর্ষার মেঘ ধুয়ে দিচ্ছে আমাদের ছাদ।



২.
নিঃস্ব


হে বয়ঃসন্ধি মেঘ,

এই জারজ অন্ধকারে বুড়ো মনে হওয়ার আগেই
আমাকে ভেজাও আরও

দহনকে আজীবন আড়িপেতে দেখতে ভালো লাগে না।

হৃদয়ার শরীর থেকে 
নগ্ন পাপেদের ঘ্রাণ,

এই জারজ অন্ধকারে বুড়ো মনে হওয়ার আগেই

আমাকে নিঃস্ব করো ...



                     ছবি : দীপাংশু মাহাত



শিল্পের অনুপ্রেরণা যখন নারী - একটি লিঙ্গ রাজনীতির বুনট


মধুপর্ণা


শিল্প সাহিত্য চর্চার দিকে তাকালে দেখা যাবে শিল্পী অথবা সাহিত্যিক হিসাবে সংখ্যাধিক্য পুরুষের, অন্তত যারা নিত্য চর্চিত হন। সেখানে চিত্রিত হয়েছেন অথবা বর্নিত হয়েছেন নারী। সংশ্লিষ্ট শিল্পীর মুগ্ধতা অথবা যাবতীয় অনুভূতি সেই নারীকে ঘিরে বর্নিত হয়। কবি সাহিত্যিক আঁকিয়ে যাবতীয় শব্দ গুলাে যেন পুরুষের জন্যই তৈরি। তাহলে কি নারীরা শিল্প অথবা সাহিত্য সৃষ্টি করেন না ? করেন। তাঁরা পরিচিত হন “নারী শিল্পী”, “নারী সাহিত্যিক” বা “মহিলা সাহিত্যিক” হিসাবে। তাহলে শিল্পী বা সাহিত্যিক এই শব্দগুলির ওপর একাধিপত্য কাদের? যার আগে জুড়ে দিতে হয় একটি লিঙ্গবাচক শব্দ। 
             আপাতত আমি যে বিষয়ে বলতে চাইছি, নারীকে অনুপ্রেরণা” বা মিউজ হিসাবে উত্থাপন করার মধ্যে একটি লিঙ্গ রাজনীতি রয়েছে। বিষয় এবং বিষয়ী - এই সম্পর্কটি অত্যন্ত জটিল। নারীকে যখন সাবজেক্ট হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তখন যিনি বর্ণনা করছেন তিনি একটি ক্ষমতার জায়গায় নিজেকে আসীন রেখেছেন। এবং ক্ষমতা কাঠামাের যাবতীয় বিন্যাসের ভিতর থেকে তিনি নির্মাণ করছেন যে শিল্প সেখানে নারী একপ্রকার লিঙ্গ রাজনীতির শিকার হচ্ছেন। সূক্ষ্ম ক্ষমতার জালিক বিন্যাস সেখানে বিষয় এবং বিষয়ী একটি ক্ষমতার সম্পর্ক। শিল্পে বা সাহিত্যে নারীর শরীর, মন, যৌণতা, মনন সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত “ নারীত্ব” এর জারকে সম্পৃক্ত করে পরিবেশন করার যে প্রবণতা তার মধ্যস্থ লিঙ্গ রাজনীতি আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে অনেক সময়ই। অন্তত আমাদের আস্বাদনের যে অভ্যাস নির্মিত হয়েছে তার আদলের মধ্যেও রয়েছে প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গ বৈষম্যের এবং তৎসংলগ্ন রাজনীতির ছাপ। পুরুষ শিল্পীর বা সাহিত্যিকের নির্মিত শিল্পের মধ্যে রয়েছে এই রাজনীতি যা আমরা সাধারণত প্রশংসা ( তােল্লাই) দিয়ে থাকি। বা বলা ভাল এই ভাবে আস্বাদনে আমরা অভ্যস্ত, আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষমতা কাঠামাে আমাদের এই ভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। 
           চিত্রে, চলচিত্রে, সাহিত্যে তথাকথিত শিল্পের যাবতীয় মাধ্যমে নারীকে অনুপ্রেরণা হিসাবে ব্যবহার এবং তার উপস্থাপন কিছু প্রশ্ন তৈরি করে। পরবর্তীতে বিশদে আলচনার পরিসর খােলা রইল।






               মানভূমে মনসা পূজা
          
                      তপন পাত্র


           "পূজা" মানে "আরাধনা", "অর্চনা", " উপাসনা", "শ্রদ্ধা জ্ঞাপন"। পূজা আসে "শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভক্তি" থেকে । তবে ভয় থেকেও যে ভক্তি আসে এবং সেভাবেও পূজার প্রচলন হয় সে কথা সম্পূর্ণ খাটে মনসা পূজার ক্ষেত্রে । "রূপে ভক্তি , গুণে শক্তি" --এ কথা সত্য হলেও "ভয়ে ভক্তি" --এই মূল্যায়ন মনসা পূজা বা সর্প পূজার ক্ষেত্রে সবিশেষ প্রযোজ্য । গ্রামেগঞ্জে লোকসমাজে মাঝেমাঝেই একটি কথা শোনা যায় কলিযুগের "জীয়ন্ত দেওতা" (জীবন্ত দেবতা) মা মনসা । কথাটি মনে হয় মনসা দেবীর বাহন সর্পের ভয়ংকারিতার কারণেই এসে গেছে । প্রকৃতির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানো ছোট্ট শ্রীমন্ডিত এই জীবটি ভারতবর্ষের প্রায় সকল প্রদেশের মানুষকে ভয় দেখিয়ে , আতঙ্কে রেখে , শোকাচ্ছন্ন করে তার দেবীর এবং নিজের পূজা আদায় করে নিয়েছে , নিচ্ছে । মনসা পূজা এবং পূজা উপলক্ষে বলিদান থেকে একটা বিশেষ শিক্ষা পাওয়া যায় বলেই আমার মনে হয় । এখান থেকে আমাদের অগণতান্ত্রিক এবং অসম রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার একটা ইঙ্গিতও মেলে । বাগদেবী সরস্বতীর বাহন হংস একটি নিরীহ , শান্ত-সৌম্য , অহিংস পক্ষীবিশেষ । মনসা পূজায় দিকে দিকে লক্ষ লক্ষ সেই নিরীহ প্রকৃতির অসহায় প্রাণীটিকে বলিদান দেওয়া হয় । এর মধ্য দিয়ে দুর্বলের প্রতি সবলের পরাক্রমের একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় । কারণ মনসা পূজায় হংস বলি হলেও কই সরস্বতী পূজায় তো মা মনসার বাহন সর্পকে বলি দেওয়া হয় না ! বিষয়টি উত্থাপনের কারণ কোন প্রাণী বলির পক্ষেই সওয়াল করা নয় ; শক্তিমান ভয়ংকরের প্রতি না , দুর্বলের প্রতি আক্রমণই আমাদের সমাজে প্রচলিত , ঘটনাটি সেই বিষয়টিকেই ইঙ্গিত করে, এ কথা তুলে ধরা ।

         পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চল ঝোপ-ঝাড়, বন-ডুংরী-পাথর আবৃত অঞ্চল । সাপের প্রকোপ এখানে কম নয় । বিশেষ করে বর্ষাকালের দিকে প্রায় প্রতিদিনই নানা প্রজাতির সাপ ঘরের পাঁচিলে, উঠোনে, সবজি বাড়িতে, ক্ষেতে-খামারে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় । অনবধানতাবশত তার শরীরে কোন প্রকার আঘাত লাগলেই ছোবল মারে । প্রতিবছর বহু মানুষ প্রাণ হারায় এই কাল সাপের আকস্মিক এক-একটি দংশনে । সরাসরি লড়াইয়ের কোন প্রশ্ন নেই , আচম্বিতে বজ্রপাতের মতো এক ফোঁটা বিষ মানুষের শরীরে ঢেলে দিলেই সারা শরীর নীল হয়ে যায় । প্রাণ চলে যায় অদৃশ্যলোকে আর সর্পটিরও
অন্তর্ধান হয় দৃষ্টির অগোচরে । এহেন উপায়হীন করুণ মুহূর্তে সর্পসম্রাজ্ঞী মনসাকে স্মরণ করা ছাড়া মানুষের গত্যন্তর থাকে না ।

              যতদূর জানা যায় ভারতবর্ষের অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদিম মানুষ প্রথম সর্প পূজার প্রচলন করেন । দেশের সকল প্রদেশে তা আজও চলে আসছে । অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীরা সর্প পূজা করেন নি কিন্তু "সর্পটোটেম"-এর অস্তিত্ব সেখানেও বিদ্যমান । "টোটেম" একটি ইংরেজী শব্দ , যার ‌ অর্থ হলো বা যে শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় --" স্বাভাবিক স্বভাবে উৎপন্ন কোন বস্তু বা পশু যার মধ্যে আধ্যাত্মিক অর্থ আছে মনে করে তাকে প্রতীক বলে ধরে নেওয়া হয় , "কুলপ্রতীক" রূপে কল্পনা করা হয়" । এই কল্পনার অস্তিত্ব সেখানে আছে । আফ্রিকার সর্বত্রই সর্পদেবতার কথা আছে ।

                 আমরা দেখি বেদ , পুরাণ থেকে শুরু করে রামায়ণ , মহাভারত কোথাও মনসাদেবীর উল্লেখ নেই । কবে , কোথায় , কীভাবে যে মনসাদেবীর আবির্ভাব ঘটলো , ঠিক করে বলাও বড়ো মুশকিল । তবে একথা সত্য যে মনসা লৌকিক দেবী এবং সর্প পূজার মধ্য দিয়েই একসময সর্পরাজ্ঞী মা মনসার আবির্ভাব । ক্রমশ এই দেবীকে ঘিরে নানা লোককাহিনী দানা বাঁধতে থাকে । শেষ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্যের যুগে দেবী পরিষ্কারভাবে স্বমহিমায় বিরাজ করতে সমর্থ হলেন ।

               সেদিনের আর্যভাষী সমাজ সহজে এই লৌকিক দেবীকে মেনে নিতে পারে নি । এই হৃদয়হীনা , ঈর্ষাপরায়ণী ক্রুর দেবী চাঁদ সওদাগরের চরম সর্বনাশ করেন । দৈবী মহিমা তো দূরের কথা অমানবিকতার পরিচয় দিয়ে , ভয় দেখিয়ে , বাম হস্তে পূজা আদায় করেন । প্রতিষ্টিত ও প্রতিপত্তিশালী , কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চাঁদবেনের পূজা পেয়ে তিনি লোকসমাজে দেবী স্বীকৃতি পেলেন । যদিও সওদাগরের সেই পূজা ছিল তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞায় ভরা । মনসার দিকে পিছন ফিরে বাম হাতে করে ফুল ছুঁড়ে দিয়ে পূজা করেছিলেন তিনি । সমাজে এই ধারার প্রচলন আজও রয়ে গেছে । আজও যেকোনো ধান্দাবাজ ছলে বলে প্রকৌশলে একবার স্বার্থসিদ্ধি করতে পারলেই তিনি এই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান । তখন তাঁকে আর পায় কে ! থামায় কে ?

               এই দেবী শুধু পুরুলিয়া নয় , ঝাড়খন্ড তথা সমগ্র মানভূমের গণদেবী । ঝাড়ফুঁক , তুকতাক , ওঝাগিরির সাথে তাঁর একটি নিবিড় সম্পর্ক । ঝাড়ফুঁকের শেষে মা মনসা দেবীর দোহাই দেওয়া হয় । একসময় যখন বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার প্রচলন হয় নি , হাসপাতাল বলে কিছু ছিল না , তখন শিকড়-বাকড় , ছেঁচা-কুটা ঔষধ আর ঝাড়-ফুঁক , মন্ত্র-তন্ত্রই মানুষকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেছে । ঝাড়-ফুঁকের চিকিৎসা আর মনসা দেবীর পীঠস্থান হিসাবে সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত কামরূপ-কামাখ্যাকেই আদি স্থান ভাবা হয় । ভৌগোলিক বিচারে যে অঞ্চল বেশি জঙ্গলাকীর্ণ , যেখানে সাপ-খোপের উৎপাত উপদ্রব বেশি , সেখানে মনসার প্রভাবও বেশি ।

 
                      

                    এই বিষধর কালসাপগুলিকে এবং তাদের দেবীকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য পুরুলিয়াবাসী ১৩ জ্যৈষ্ঠ রোহিনীর দিন থেকে আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত বিভিন্ন তিথিতে মনসা পূজা করেন । কারণ এই সময় ঝড়-ঝাপটা বৃষ্টি-বাদলের কারণে ও চারপাশ গাছায় আগাছায় ঝোপ-জঙ্গল হয়ে ওঠার জন্য সাপের ভয় বেশি । অতএব এই দেবীকে শান্ত ও সন্তুষ্ট রাখার প্রয়োজনও বেশি । তারপর হেমন্ত ও শীতের আগমনে সাপের প্রাদুর্ভাব কমে যায় তখন আর মনসা পূজার হিড়িকও থাকে না ।

                  রোহিনীর দিন থেকে আশ্বিন সংক্রান্তি পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন তিথিতে মনসার পূজা উদযাপিত হয় নানাভাবে । রোহিনীর দিন প্রত্যুষে ঘরের চারদিকে গোবরের রেখা টানেন মেয়েরা । রাবন আড়ালের লক্ষণ রেখার মতো সরীসৃপ ঠেকানোর রোহিনী রেখা । নিয়ম করে পরিবারের সকলে খান রোহিনী ফল । অন্য নাম "আষা'ড়া ফল" বা "কে'লাকটরা "কে'লাকড়রা"। ঘন সবুজ রংয়ের গোল আকৃতি বিশিষ্ট ছোট্ট এই ফল খেলে সাপে কাটলে বিষ লাগে না বলেই মানভূমবাসীর প্রচলিত বিশ্বাস । এ দিন বিভিন্ন পরিবারের তুলসী তলায় মনসা দেবীর পূজা হয় । 

                  আবার দশহরার দিনও মনসা পূজার রেওয়াজ আছে । দশহরা শব্দটির আভিধানিক অর্থ দু'টি ---"বিজয়া দশমীর উৎসব", "দশেরা" এবং "জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা তিথিতে অনুষ্ঠিত গঙ্গাস্নানের পর্ব " । এই দ্বিতীয় দিনটিতে মনসা পূজা হয় । মনসা পাতা কে দুধে অথবা চন্দন মেশানো জলে স্নান করিয়ে সিঁদুর দিয়ে ঘট স্থাপন করা হয় । নৈবেদ্য হিসাবে দুধ, কলা , পেঁড়া , মিষ্টি, বরফি , জিলিপি সাজিয়ে দেওয়া হয় ; সঙ্গে কিছু ফলমূল , শশাও থাকে । 

              শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথি "নাগপঞ্চমী" নামে সর্বজনবিদিত । তবে মানভূমবাসী আষাঢ় মাসের প্রথম পঞ্চমী তিথি থেকে শুরু করে ভাদ্র মাসের শেষ পঞ্চমী তিথি পর্যন্ত সকল পঞ্চমী তিথিকেই নাগপঞ্চমী তিথি রূপে বিবেচনা করে । এই দিনগুলিতে অষ্ট নাগদেবতা ও মনসা দেবীর পূজা করা হয় । অষ্টনাগ হলেন --অনন্ত নাগ, বাসুকি নাগ, পদ্ম নাগ, মহাপদ্ম নাগ , তক্ষক নাগ, কুলীর নাগ , কর্কট নাগ এবং শঙ্খ নাগ । ধর্মীয় বিশ্বাস এই দিনগুলিতে নাগ দেবতার পূজা করলে রাশিফলে রাহু ও কেতু সম্পর্কিত ত্রুটিগুলি দূরীভূত হয় , সাপের দংশন ও বিষ জ্বালা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ; গৃহস্থের ধনসম্পদ বৃদ্ধি ঘটে । একসময় মনসা পূজা সামাজিক বিচারে নিম্নবর্গীয়দের মধ্যেই প্রচলিত থাকলেও এখন প্রায় সকল বর্ণের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষই মনসা পূজা করেন । পার্থক্য এটুকুই যে নিম্নবর্গীয়রা নির্দিষ্ট কিছু লোকাচার , রীতি-প্রথা মেনে ও লৌকিক গানের মধ্য দিয়ে পূজা সম্পাদন করেন । আর উচ্চবর্ণের মানুষজন ব্রাহ্মণ ডেকে মন্ত্রপাঠ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে পূজা সমাপন করেন । মন্ত্র হিসাবে যা অবশ্যই উচ্চারিত হয় , সেটি হল --

         "ওঁ ত্রৈলোক্যং পূজিতাং দেবীং নাগাভরণভূষিতাম্ স্নাতয়ামি মহাভাগাং পুত্রার্ধন বৃদ্ধয়ে।।"

           ---একদিক থেকে পূজার উদ্দেশ্যটি এই মন্ত্রের মধ্য দিয়েই প্রকটিত হয়েছে । দেবীর কাছে পুত্র ও ধন-সম্পদ বৃদ্ধির প্রার্থনা জানানো হচ্ছে । আমরা শুনতে পাচ্ছি অন্নদামঙ্গলের কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়ের কাব্যে ঈশ্বরী পাটনীর প্রার্থনা ---"আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে"।

              আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির দিন অর্থাৎ মা লক্ষ্মীকে স্বাদ অন্ন নিবেদনের দিন বা জিহুড়ের দিন যে মনসা পূজা উদযাপিত হয় তাও বেশ ঘটা করেই হয়ে থাকে । সাধারণত শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তির মনসা পূজার দিন কোন গৃহস্থ পরিবারে অমঙ্গলজনক কোন ঘটনা ঘটলে প্রথমে তারা সেই দিনের পরিবর্তে আশ্বিন সংক্রান্তিতে মনসা পূজার প্রচলন করেন এবং ক্রমে ওই পরিবারে সেই ধারাবাহিকতাই বজায় থাকে । বিভিন্ন পঞ্চমী তিথিতে যে মনসা পূজাগুলি হয় সেগুলিরও অন্যতম কারণ বিশেষ মনসা পূজার দিনে কোন শুভ বা অশুভ অশৌচ ঘটে যাওয়া । আবার মনসা পূজার সঙ্গে মানুষের মনস্কামনা পূরণার্থে মানত করা আঞ্চলিক ভাষায় মান্সিক করার ও মান্সিক শোধের বিষয় রয়েছে । সে কারণেও বিশেষ বিশেষ তিথিতে মনসা পূজা হয় ।

                   তবে শ্রাবণ সংক্রান্তি তিথিতে যে মনসা পূজা , তার জাঁকজমকটাই আলাদা ! সংক্রান্তির আগের দিন ভক্তগণ নিজেদের মধ্যে শুচিতা আনয়নের জন্য "বার" পালন করেন । সংক্রান্তির দিন গোধূলিবেলায় ঝাঁপান, মন্ত্র , সাকি , ঢাকের বাজনা , ঢাকির বাজনা, ঢোলের বাজনা , শঙ্খ ধ্বনি , উলুধ্বনি এবং সেইসঙ্গে জাঁত গান গাইতে গাইতে মনসার "বারি" বা "ঘট" আনতে যান পুকুর নদী অথবা অন্য কোন জলাশয়ে । সেই সময় একটি আবাহনী জাঁত গান গাইতে গাইতে ভক্তরা এগিয়ে চলেন । পিছু পিছু বাঁশের তৈরি টকার ভিতর প্রদীপ জ্বালিয়ে মা-বোনেরাও যান সর্বজনপরিচিত এই গানটি হল ---

      " চল মাকে আনিতে যাব রে, শিলাই নদীর কূল ।
  হাতে দিব লাল জবা চরণে দিব ফুল।।"

       পুকুর , দিঘি , জোড় ,নদী ---কোন একটি জলাশয়ে গিয়ে ভক্তগণ জলে নেমে বারি তোলেন । মূল ভক্তের মাথায় ঘট, তাঁকে প্রদক্ষিণ করেন অন্য ভক্তগণ পাঁচ , সাত কিংবা নয় বার । তারপর ডুব দিয়ে ঘটে জল ভরতেই শুরু হয় গান ---

      "শনি মঙ্গলবারে উ'ঠল জেলার ঘরে ।
 জেলা বলে জয় মা গো , জয় বিষহরি ।।"

         পুকুর ঘাটে পূর্ব প্রদত্ত গোবর-মাড়ুলি ও আলপনা দেওয়া স্থানে ঘট নামিয়ে ধুনার ধোঁয়া তুলে , ধূপ জ্বালিয়ে প্রাথমিক বন্দনা শেষ করে একটি জাঁত গাইতে গাইতে "ঘট-বারি" মন্দিরে বা মেলায় নিয়ে যাওয়া হয় । এই জাঁত গানটি হল --

       "মাকে পু'জব পু'জব বেল্বি দলে ।
     লাল জবা দিব মায়ের চরণ কমলে ।।"

        মেলায় পৌঁছানোর পর মনসার মূর্তির সামনে ঘট স্থাপন করা হয় ‌। এরপর শুরু হয় জাঁত গান । সেই গানে যেমন কানাহরি দত্ত , কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ , বিজয়গুপ্ত , নারায়ন দেব প্রমুখ মনসামঙ্গলের কবিদের গানের প্রভাব থাকে তেমনি মানভূমের সাধারণ লৌকিক জীবনের দুঃখ-কষ্ট-জ্বালাও ফুটে ওঠে । এই জেলার মানুষ যে আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোয় দাঁড়িয়ে দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করে , উপাখ্যান বহির্ভূত গানে তার ছবিও সুস্পষ্টরূপে ফুটে ওঠে । 

            এক সময় মধ্যরাতে , বিশেষ প্রহরে শুরু হয় মূল পূজা । পূজার সামগ্রী হিসাবে পদ্ম ফুল, পদ্ম পাতা ,কেয়া ফুল ,কেয়া পাতা, বিভিন্ন ফলমূল ও মিষ্টি দ্রব্য , চিঁড়ে, গুড় ,বাতাসা, গুড় পিঠা, খই-মুড়কি ইত্যাদির সমাহার । নানা মন্দিরে নানা ধরনের লোকাচার । নানা রকম পূজা পদ্ধতি । বেশিরভাগ পূজাই হয় অব্রাহ্মণ পূজারীর দ্বারা । পূজাকে ঘিরে অনেক রকম লৌকিক অলৌকিক কাহিনীও শোনা যায় । বিভিন্ন মন্দিরে পূজা সাঙ্গ হলে পশুপক্ষী বলিদানের রীতি আজও সমানভাবে প্রচলিত । সারারাত পূজা আর জাঁত গান । মাঝে মাঝে বিশ্রাম । বিশ্রামের সময় উৎসাহ এবং উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য সিদ্ধি , গাঁজা এমনকি মদেরও ভরপুর মৌতাত । 

                  পরদিন পান্না । সারা জেলাজুড়ে উৎসবের মেজাজ । বনধের পরিবেশ । মনে হয় অঘোষিত বনধ্ । হরতাল । দোকান-পাট , যান-বাহন সর্বত্রই খাঁ খাঁ । যথাসাধ্য ভালো-মন্দ খাবার আর নতুন পোষাকের আলোড়ন । সন্ধ্যাবেলায় , কোথাও কোথাও আবার ঊষাকালেই শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে "মনসা মা-ই কি জয়" --ধ্বনি দিয়ে , বাজি ফাটিয়ে , সমবেত কণ্ঠে ভক্তি বিজড়িত বিরহের গান গাইতে গাইতে নিরঞ্জনের পালা ।

       "কুথা যাবি গো মা , যেতে দিব না ।
 ধরেছি রাঙ্গা চরণে ছেড়ে দিব না ।।"

          আমাদের স্মরণে আসে শাক্ত পদাবলীর হৃদয় বিদারক বাণী --
        "এসো মা, এসো মা উমা বলো না আর যাই যাই ..."



       অথবা আর এক ঋষি কবির উচ্চারণ ---
         "যেতে নাহি দিব" ... হায় ! "তবু যেতে দিতে হয়।"
          চোখের জলে মৃন্ময়ীর ভাসান আর ভক্তদের কন্ঠে গান ---

    "ওরে রক্তমুখে চুমুক চুমুক দিচ্ছে সাঁতার রে ।
  ফুঁক দিতে উড়ে গেল , ভাই রে ।।"

             যেন বড় অল্পক্ষণেই ফুরিয়ে গেল মা মনসাকে ঘিরে আনন্দ উৎসব ! তখন আশায় বুক বেঁধে পরের বছরের জন্য অপেক্ষা এবং প্রস্তুতিই একমাত্র সান্ত্বনা । 

              প্রসঙ্গত একটি কথা উল্লেখযোগ্য , মানভূমের যাঁরা ধীবর জাতির মানুষ, তাঁদের কিন্তু মনসা পূজার "বারি" আসে শ্রাবণ সংক্রান্তির দিন নয় , তার আগের দিন অর্থাৎ ভক্তদের "বার" পালনের দিন বা শুভ্র শুচি হবার দিন । ধীবর তথা কে'য়ট জাতির এই বারি তোলাকে বলে "ক্যায়টা বারি" । মানে বিশেষভাবেই কেয়ট জাতির বারি । আবার সংক্রান্তির পরদিন অর্থাৎ পহেলা ভাদ্র তাঁদের দেবী নিরঞ্জনও হয় না । পূজার পঞ্চম, সপ্তম অথবা নবম দিনে কিংবা তারও পরে কোন বিজোড় সংখ্যক দিনে প্রতিমা নিরঞ্জন হয় । কোনভাবেই মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবারে নিরঞ্জন হয় না । তাঁদের বক্তব্য, সামাজিক সংস্কার অনুসারে যে দিন মানে বার গুলোত মেয়েকে বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠাতে নেই, সেই দিন আমরা মাকেও বিসর্জন দিই না । 

               যাই হোক, এই শ্রাবণ সংক্রান্তির মনসা পূজার প্রায় এক মাস আগে থেকেই মনসা পূজা উপলক্ষে দলবদ্ধভাবে যে গানগুলি গাওয়া হয় মানভূমের আলো-হাওয়ায় সেগুলি "মনসা পূজার গান" বা জাঁত গান নামে পরিচিত । সেই সমস্ত গানে মনসামঙ্গল কাব্যের মূল কাহিনীর বাইরেও লৌকিক জীবনের দুঃখ-কষ্ট-জ্বালা-যন্ত্রণা স্থান করে নিয়েছে । সেই সমস্ত গানের মধ্যে অনেক গানই আকৃতি এবং প্রকৃতিগত দিক থেকে অনেকটাই করম নাচের গানের মতো । 
    
               এই অঞ্চলের মানুষ যে আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোতে দাঁড়িয়ে দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করে , উপাখ্যান বহির্ভূত সেই সব গানে তার ছবি সুস্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে । শ্রাবণ ভাদ্র মাসে পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় জনহার (ভুট্টা) একটি সহজলভ্য, দিন চালানোর খাবার । কাক , কুকুর, শেয়ালের উৎপাতে পরিণত জনহার নষ্ট হয় । কুকুর , শেয়ালকে তাড়ানো সহজ । কিন্তু কাক বিভিন্ন দিক থেকে উড়ে এসে ছিঁড়ে খায় । তাই অভাবক্লিষ্ট পরিবারের ছোট ছেলেমেয়েরাও কাকের হাত থেকে তাদের প্রাণের খাদ্য রক্ষা করার জন্য মাসীর কাছে আবেদন জানায় ---

     "মসি দড়বি , দড়বি গ , কাওয়ায় জনহার খা'ছে ।
  বাড়ি বাটে খে'দতে গেলে পিঁদাড় বাটে যা'ছে।।"

      একদা পিয়াল পাকা এই অঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য বনজ ফল ছিল , যা সুস্বাদু এবং খাদ্যাভাব মোচনে আংশিক ভূমিকা পালন করতো । ছেলেরা সকলে বনে গিয়ে পিয়াল পাড়তো । হৈ হট্টগোল করতো ।

      "বনে পা'কল পা'কল পা'কল পিয়াল ।
  যত ছানার গন্ডগোলে পালা'ল শিয়াল ।।"

       এ সময় তালের পিঠে উপাদেয় খাদ্য সন্দেহ নেই । কিন্তু শুধু তালের আঁটি ছেলে-মেয়ে, বউ-বুড়ি সকলেই চুষে খায় ; নিছক ফলের স্বাদ গ্রহণ নয় , ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যও । প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে তাদের শরীর অমসৃণ । এ দেশে অর্থের অসমবন্টন আজও খড়্গ উঁচিয়েই রেখেছে । তাদের স্বাস্থ্যের জন্য দরকার মতো খাদ্য থেকেও বঞ্চিত তারা । 

      "মশা কামড়া'ল কামড়া'ল খরখ'স্যা গায় ।
   যত ছে'লা মে'লে তারা তাল কুড়া'তে যায় ।।"

                 শ্রাবণ মাস । তখনও "গড়াধান" ঘরে আসে নি । ভাতের চাল নেই । সজনে শাক একটি বারোমেসে সবজি । সেই গাছ পোকার আক্রমণে নষ্ট হলে এতদঞ্চলের মানুষের মনে বড়ো ব্যথা লাগে । সে কথাও গান হয়ে বেজে উঠেছে ---


       "ঘরে ভাত নাই, ভাত নাই, শাগ তু'লতে গ্যাছে ।
        বাড়িয়্ আছে সঁনলা মূঢ়া গাড়র লা'গে গেছে।।"

         অর্থনৈতিক অবস্থার প্রশ্নে সর্বস্বান্ত মানুষ কিন্তু সামাজিকতার প্রশ্নে সর্বহারা নয় । আত্মীয়-স্বজন, কুটুম্বাদির সম্মান রক্ষায় তারা সর্বদা যত্নবান । 

    "বিহাই যা'ছ , যা'ছ হে বা'স্যাম খাঁইয়ে যাও । 
  ক্যাঁদ কুঁঢ়া , মরিচ গুঁড়া গাঁ'ঠে বাঁ'দে লাও ।।"

                 শুধু বৈবাহিক মহাশয়ই নয় , জামাই এলেও তাকে শুধু শুধু ফিরিয়ে দেওয়া যায় না । অভাব থাক না গোখরার মতো উদ্ধত ফণা তুলে , তবু জামাই যে পেটের ছেলে তার প্রতি স্নেহ মমতা আদর যত্ন তো থাকবেই । তাই জামাইয়ের বিদায় বেলায় শাশুড়ি মাতা স্নেহভরে বলছেন ---

     "জামাই ভাত খাঁইয়ে যাও, ভাত খাঁইয়ে যাও, লৈতন তরকারি ।
   নঢ়া ভাতে , শিল পঢ়া কদা'ল চড়চড়ি ।।"

        লোকগানে এমন কিছু শব্দ চলে আসে, যা নিছকই ছন্দমিলের জন্য , অথবা আরও নিরর্থক-ই । যেমন "কদাল চড়চড়ি" বলতে ঠিক কী বলা হলো বোঝা দায় ! জামাইকে যে কোন কারণেই হোক তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে হবে । নঢ়া ভাতে অর্থাৎ আলু ভাতে বা একটু বড় আকারের আলতি, কচু ভাতে ; শিল পড়া অর্থাৎ যে কোনো বেটে পুড়িয়ে খাবার পাতা , যেমন গাঁদাল পাতা, শশা পাতা বেটে পুড়িয়ে ভাত খেতে দেওয়া হচ্ছে গভীর মমতায় । কিন্তু "কদাল চচ্চড়ি" ? ...মনে হয় অতি নিম্নমানের চচ্চড়ি তরকারি হতে পারে বেশ অনেকটা পরিমাণে ।

          এক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন যে, স্থানভেদে গানটিতে জামাই এর পরিবর্তে বিহাই শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায় । সে ক্ষেত্রে "কদাল চড়চড়ি" রঙ্গ করেই বলা হয়েছে ধরে নেওয়া যেতে পারে ।

                     এই অঞ্চলের মানুষ সারাদিন ঘাম ঝরিয়েও পেটের ক্ষুধা নিবৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারে না । নাহ্য মজুরি তারা পায় না । কারণ কর্মসংস্থান কম । দীন দিনমজুর বেশি । মনসামঙ্গলে বর্ণিত বেহুলা-লখিন্দরের বিয়ের জন্য যে লোহার বাসর তৈরি হয়েছিল , তার শিল্পী ছিলেন স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা । তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে সাধারণ শ্রমিকের গান ----

    "আমার লুহা পিটা বিষম তিতালি গো ।
   তবু না মিটিল আমার পেটের কলকলি।।"

        পরিশ্রমী মানভূঞা যুবক কর্মক্লান্ত । সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেললেও পেটের "কলকলি" মেটে না । পাকস্থলি শূন্য হলে কলকল শব্দ করে ডেকে ওঠে । মানুষ বেশ ক্ষুধার্ত বলে বোঝা যায় । "পেটের কলকলি" বলতে চরম ক্ষুধাকেই বোঝানো হয়েছে । পুরুলিয়া তথা মানভূম তথা পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গবাসীর শ্রমজীবী মানুষের সেই ক্ষুধা মনসামঙ্গলের কালেও মেটেনি আর আজও না ; ভবিষ্যতে যে মিটবে, আশু তেমন কোনো আশার আলোও দেখা যাচ্ছে না ।
                              


_______________________________________________

একটি কবিতা সন্ধ্যা     দু'টি গ্রন্থ প্রকাশ
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""''''""

মাঝে মাঝে সবাই মিলে ছুঁতে চাই এক উঠোন, এক আকাশ ; শ্রাবণ মেঘের কাছে শিখে নিতে চাই মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে চলার মন্ত্র ---এই আশা ও ভরসা নিয়েই গত ২৫ জুলাই মানবাজার মানবীর ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছায়া সুনিবিড় সবুজ সুন্দর মুক্ত প্রাঙ্গণে "জন্মভূমি" পত্রিকার উদ্যোগে এক ঝাঁক কবি সাহিত্যিক ও শিল্পীর মহামিলন ঘটলো । প্রকাশিত হলো---




                      আমাদের বই







সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
মনসা দেবী ও মনসা ডালের ছবি : তপন পাত্র
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com













মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪