জলশ্যাওলার বিরহকথা

জলশ্যাওলার বিরহকথা

দীপংকর রায়



২য় পর্ব



আরো আরো সম্বোধন, ভাব বিনিময়, লৌকিক আত্মীয়তার জটিল সব সরণী পার করে চেয়ারে বসে বসে যাকে দেখবার তাকেই দেখছিল। উভয়ের এই দেখাদেখির পর্ব যেন চলতেই লাগল। একজন ছেচল্লিশ আর একজন সতেরো কি আঠেরোর সদ্য বিবাহিত তরুণী। সঙ্গে নধরকান্ত স্বামী। কোট-টাই এঁটে একেবারে নাড়ুগোপাল। বারবার কি যেন পরখ করছিল সেও। পরখ করছিল সত্যি সত্যি এরা কেউ কারো পরিচিত কি না। মেয়েটি একভাবে তাকিয়ে কি যেন গিলছিল । নধরকান্ত ছেলেটি মুচকি মুচকি হাসছিল এবারে।
           পথিকের সংলাপ : না না আমি এদের কাউকেই ঠিক মত চিনতে পারছি না তো-----তাছাড়া চেনার প্রয়োজনই বা কী? 
           মেয়েটি : চেনেন না যখন তখন আমাদেরই বা জোর করে চেনা দেওয়ার দরকার কী? 
            তারপর একটু থেমে স্বামীর দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলল , 'এই চলো চলো, এখান থেকে ওঠা যাক.....।' 
      ‌       ছেলেটি: ধ্যাত, ছাড়ো তো, উনি ওরকম বলেন, তাছাড়া ওনার অভিমান তো হতেই পারে, আমাদেরই তো ভুল হয়েছে, সামান্য দশটা টাকা, তাও কেন যে ব্যায় করলাম না......! 

             এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা। মুখ চাওয়া চাওয়ি ----বসে থাকা। 
             একসময় মেয়েটি খপ করে পথিকের হাত ধরে তাকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে গ্যালো। এর পর এই মফস্বল শহরে  একেবারে হাতধরে ঘোরাঘুরি। রিক্সায় চড়া। কার্তায়ণী পুজো মণ্ডব ঘোরা, মানুষের ঢলের মধ্যে একাকী দু'জন। ঝিম ঝিম ঠাণ্ডা নাকে কানে। পথিক ভাবে, মুসলমান প্রধান দেশে একি পৌত্তলিকতার উল্লাস? মেয়েটির কাছেও বিস্ময়! পথিক ভাবে, একি, এখন আমি ইন্ডিয়াতে, কলকাতার রাস্তায় ঘুরছি, মনে হচ্ছে কলকাতার পুজো মণ্ডপ? মেয়েটির কাছেও বিস্ময়! কারণ, এর আগে সে তো এদেশে জন্মেও এমন উৎসব এইভাবে দেখেনি। তাই এই উৎসবটা ভীষণভাবে উপভোগ করছে। তাদের এই দু'জনের দু'জনকে হাতধরে ,জড়িয়ে, কখনো মাথায় মাথা লাগিয়ে আহ্লাদ করাকে দেখে রিক্সাওয়ালা ভাবছে, এরা পরস্পরের কী হয় রে বাবা! 



            এবার মনে হয় সম্পর্কটা বলে নেওয়া প্রয়োজন। এই গল্পের আগা মাথা জুড়ে দেওয়া দরকার। এখন রিক্সা চলুক। আমরা আর একটু আগে, বছর কয়েক, না হয় এখুনি, এখনকার কথা বললেও ক্ষতি নেই। একটু বলেনি, না সেভাবে না, একটু ঘটা করে এই সূত্রবদ্ধ দিনের প্রথম থেকেই বলি। 
           সাতাশির সেই পড়ন্ত বিকেল, শ-খানেক মানুষজন বোঝাই গাড়ি। ধুলো ওড়া পথ। মাঠ। গোরুগুলির চুপচাপ ঘাস খেয়ে যাওয়া সেই গ্রীষ্মকালের আবহ। বাড়ির কাছে পৌঁছতে সানাই, ব্যাণ্ডপার্টির পোঁ পোঁ করে বেজে ওঠা, হোই হোই ঊলু..... শঙ্খের আওয়াজ। দরজা পেরোনো । একে একে এ ওর মুখ লুকোচুরি! সেইদিন.... হৃদয়ে কম্পন....! ......প্রথম নারী হৃদয়ের ওঠাপড়ায় শ্বাস-প্রশ্বাসের একাকার সুবাস জুড়ে যে অবস্থা হয় আর কি, তেমনই কিছু।  বাসরঘর, সমস্ত রাত একটি অপরিচয়কে সঙ্গে করে কীভাবে যে পরিচিত হওয়া, সে যে কী অবস্থা এক! তারপর তালপাতার পাখার হাওয়ায় ঘুম এসে যাওয়া; সেসব যেন এই তো সেদিনের কথা, তাও কতদিন হয়ে গেল সেসব.....!


          
             আর সেই সূত্রে এই ছেলেটি তার খুড়তুতো শ্যালক এবং তার থেকে অর্ধেক বয়সের তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী। তাদের বিবাহের বছর এখনো ঘোরেনি । আর  এখন যে বাড়িতে এরা সকলে আতিথ্য নিয়েছে, সেটি পথিকের শ্যালিকার বাড়ি। এই পুজো উপলক্ষে এই সময় এইখানে প্রত্যেকের বাড়িতেই আত্মীয়-স্বজনের সমাগম হয় নাকি। সমস্ত দেশে যার যেখানে যে আছে তাদের সকলের কাছে পুজোর নিমন্ত্রণ চলে যায়, এবং এটাই রেওয়াজ আছে এখানের, বছরে এই কয়েকটি দিনের জন্যে এই কার্তায়নী পুজো উপলক্ষে। ভাই বোনকে আনে। জামাই, শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তিন চার দিন একেবারে হই হই ব্যাপার রই রই কাণ্ড! পথে-ঘাটেও ওই ক'দিন রাতের বেলাটা একেবারে যেন কলকাতার পুজোর দিনগুলির মত। পথের দুধারে বাঁশ বাঁধা, মানুষজন লাইন দেয় তার ভেতর দিয়ে চলাচলের জন্য ।



               নাটক জমে উঠল বুঝি? নাটক এবারে ঘাম বের করে ছাড়ছে ? এ কি ছেলেমানুষী ----- হাতের মধ্যে হাত, হৃদয় ঘুম চাইবে নাকি এরপর? হৃদয় সব নিয়ে এই অযাচিত সময়ের হাঁড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দিতে চায় বুঝি? কিন্তু না ----- রাত বিছানার হলে, ছেলেটি মেয়েটিও সেখানে যায়। 
             তাহলে এই কিছুক্ষণ আগের ছোটো ছোটো আবেগঘন কথাবার্তা --- গদগদ ভাব, ঢলাঢলি, গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে চলা, হাতের মধ্যে হাতের শীত, কার্তায়নী পুজো মন্ডবে মন্ডবে ঘোরা দু'জনে একাকী, মফস্বল শহরের রাতের রিক্সার পথ, ঝাঁকি, ' তুমি যে আমার কত প্রিয়.... ' , এইসব গুনগুনানো গান....এসব নেহাতই যৌন মৌতাত! না শুধু গড়িয়ে পড়বার আগের  একটুখানি জলকথা?
            লেখকের মনের কথা : এসব কেবলই শাদা চোখের নৈঃশব্দ্যে ধানগাছের মাথায় ঢেউ খেলে যাওয়াই যেন শুধু -----বয়ে চলেছে ..... বয়ে চলেছে...... বয়ে চলেছে..... , এ একেবারে নদীকথার মতন দুপুর ----- সন্ধা ----- বিকাল ----- রাত্রি -----!
          তারপর আর এক বাস যাত্রা। গোপন স্পর্শ! যেন থাই, জননেন্দ্রিয় ছুঁয়ে যাওয়া শিহরণ, গালের ঠোনাঠুনি ---- একেবারে  নিজের করে ঘুমপাড়ানো, খাওয়ানো। এসব সবই নতুন শালা বউ-এর  আদর-আপ্যায়ন ----- আর এভাবেই নাকি এদেশের রেওয়াজ এসব! 

    কিন্তু পাঠক তুমি এতে নতুন কী পেলে? 

            পাঠক তোমার শিশ্নদেশে কোন প্রগতিশীলতার স্বচ্ছ বা অস্বচ্ছ অনুভবের শিহরণ জাগালো ? তুমি কি মনে কর গত একশো বছরে বা পঞ্চাশ বছরের প্লট চিন্তায় এ ধরণের কোনো অসম বয়সের যৌন সুড়সুড়ির ছড়াছড়ি দেখানো হয়নি? 
            কত কিছুই তো তুমি দেখেছ! মাসির সঙ্গে বোনপো। কাকিমার সঙ্গে ভাইপো।  ভাই-এর সঙ্গে পিসতুতো মাসতুতো ভেদাভেদ, শ্যালিকা জামাইবাবু,---- কিন্তু এখানে তো এসব কিছু না!  কিছুই তো নেই সে অর্থে। গন্ধ নেই...., স্পর্শ নেই.....! তাই, এত ভনিতা করবার কী আছে?  এখনো তো এমন কিছু তুমি দেখাতে পারোনি, যাতে করে  আমরা  মনে  করতে পারি, একশো বছর পরে এসে সব তুমি এক ধাক্কায় পুকুরের জলে ফেলে দিয়ে, পথের মধ্যে, মেয়েটি প্রধান চরিত্রের সঙ্গে গ্রীষ্মের  ভেনাস রূপ দেখিয়ে ফুল ফেলছে তারই পায়ে ! কিম্বা এক ছুটে দৌড়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরে সে চুমু খাচ্ছে সকল জনতার সামনে? 

      না, এসব ভাবাও পাপ?  বলছে লেখক নিজেই। 

            আসুন তাহলে পরিচয় করাই। দরজা ঠেলে পথিক  যেখানে এখন হই হই করে প্রবেশ করল,  তার পুব দিকের এই দরজার মাথায় লেখা আছে পাকা করে, ' হৃষিকেশ ভবন। '
             হৃষিকেশ তার দাদাশ্বশুরের নাম। তার বিবাহের সময় তিনি প্যারালিসিস হয়েও বেঁচেছিলেন। তখন এ বাড়িতে ঢুকতে ডানদিকের যে ঘরে এখন তার শ্বশুর থাকেন, সেখানে মাটির উঁচু দাওয়া ছিল। তারই এক কোনায় তিনি শুয়ে থাকতেন। ওপাশে পশ্চিমের কোনে টিনের ঘরটি আগের মতই আছে। তাতে রঙ পড়েছে এই যা। উত্তর-পশ্চিম কোনে এখন যেখানে দোতলা উঠেছে, সেখানে ছিল একখানি ভাঙা টিনের ঘর ---- তার সামনে পূর্ব কোনেও মাটির ঘর ছিল। এখন সেখানেও পাকা ঘর উঠেছে। ছাদ ঘুরিয়ে সমস্ত বাড়িটাতেই এক চক্কর মারা যায় এখন, এ ছাদ থেকে ও ছাদে। 
             দোতলায় যেখানে ' বীণা কুঞ্জ ' লেখা রয়েছে, সে  তার  ঠাকুমাশাশুড়ির নাম। তিনিও বছর তিন হলো লোকান্তরিত হয়েছেন। সাথী, পথিকের স্ত্রীর নাম। এ ছাড়াও এ বাড়ির এরকমই আর একটু ছোটো তালিকা আপাতত দেওয়া যাক : ডান পাশ থেকে, সাথীর  বাবার ঘর। তারপর মেজোকাকা। এরপর সেজো। যিনি স্ত্রী বিয়োগের পরে আর দ্বিতীয় বিবাহ করেননি। অনেক সকালে উঠে অং বং ছং করে চণ্ডী পাঠ করেন। গলায় পৈতে নিতে পারে সকলে, তাই তিনিও পৈতা ধারণ করেছেন। বলেন, শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত আমি। বাড়ির গোরু-বাছুর, দশ বিঘা জায়গার উপরে যে কাঠাল বাগান তার সবটাই তাঁরই তত্বাবধানে। নোয়া, কালীগঞ্জ সুগারমিলে চাকরি করেন। একটু সাজানো-গোছানো। মণি, তিনি থাকেন খাড়া দক্ষিণে। প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার। তারপর ফুল, একটু অত্যাভিমানী , স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় হিন্দু মাস্টার। এরপর, সোনা, তাঁর মুদির দোকান । মেজো আর সোনা এই দু'জনই ব্যবসা বানিজ্য করেন। মেজোর এক ছেলে দুই মেয়ে। এক মেয়ে ভারতবাসী। ছোটো, অবিবাহিত কলেজ পড়ুয়া। বড় জনের দুই ছেলে, অর্থাৎ পথিকের নিজের শালা শ্যালিকাদের হিসাব এরকম, দুই ভাই, দুই বোন। পথিকের শ্বশুর পল্লী-চিকিৎসক । সাথীরা  দুই বোন, ছোটো বোনেরই বাড়িতে পথিকের সঙ্গে তার খুড়তুত শালা বউ-এর দেখা হলো প্রথম। পথিকের দুই শ্যালকই  এখন শহরবাসী। তার মধ্যে বড় শ্যালকের স্ত্রী এখানেই থাকে এখনো। তাই  বীণা দেবীর নয় ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ে এখান থেকে পঞ্চাশ ষাট কিলোমিটার দূরে আর একটি মফস্বল শহরে সে তার সন্তান-সন্ততি নিয়ে সংসার ধর্ম করে। এই সমস্ত কিছু দেখে-টেখে  বীণাদেবী নিশ্চিন্তে পরলোক যাত্রা করেছেন। এবং তাঁর রেখে যাওয়া একান্নবর্তী পরিবার এখনো নানা ছোটোখাটো ঝুটঝামেলা বাদ দিয়ে নিশ্চিন্তেই বসবাস করে যাচ্ছে। 
           এ বাড়িতে তার শালা-শ্যালিকাদের জন্ম এখনো ঘটে চলেছে। তার মধ্যে এখন যারা একটু বড় হয়েছে, তারা বেশ কয়েকজনই তার বিবাহের সময় নিতান্তই শিশু ছিল। একমাত্র এখন সে যাদের সঙ্গে এ বাড়িতে প্রবেশ করল, তার মধ্যে সে-ই শ্যালকই তখনকার কথা অনেকটাই জানে। তাদের বিবাহ---- এইসব কিছু। আর এইরকমের একটি শ্বশুরালয়ের নিশ্চয়তা এবং দিদিমার প্রতিষ্ঠিত কালীপুজো, এই সব, আর তার বাল্যকালের স্মৃতিবিজড়িত ফেলে যাওয়া দেশের বাড়ি-ঘর, বাগান, জমিজিরেতের একান্ত নিশ্চয়তাটুকুর এ ধরণের পটভূমি পথিকের; প্রয়োজনে বছরে দুবারও আসা যাওয়া করতে হয় তাকে। আর এই পর্বে সেই পুজো সেরে শ্বশুরালয়ের পথে এই ভাবে তার আগমন। আর তারই এই মুহূর্তের কিছু সংলাপ এই রকম, মেজ কাকিশাশুড়ি জিজ্ঞাসা করলেন, ' তাহলে বাবা, পুজোপাঠ সব ঠিকঠাক মিটলো তো? '
             পথিক ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ সূচক সাড়া দিল। তিনি এরপরও বললেন,  'তাহলে এবার কিছুদিন তুমি এখানে থাকো, একটু বিশ্রাম নাও।'
           বিশ্রাম মানে বাড়ির পেছন দিকের বাগানে ঘোরাঘুরি। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একাকী। 
            কী খুঁজে  চলা সেখানে? 
            মজে যাওয়া নদী বেগবতী। এককালে এটাই ছিল নাকি এখানকার প্রধান যোগাযোগের  মাধ্যম। এখানকার বিখ্যাত  রাজা প্রমথভূষণ দেবরায়, দত্তক পুত্র। তাঁর রাজত্বের শেষ ক'দিনের গল্প সে তার ঠাকুমা-শাশুড়ির মুখে শুনেছে যেরকম, শুনেছে পোষ্টমাষ্টার জহুরুল হকের মুখেও একইরকম ভাবে। সে গল্প এরকম, প্রমথভূষণ দেবরায়ের বাবা, ইন্দুভূষণ দেবরায় কি তাঁর বাবা, যাই হোক, শোনা যায় তাঁর নাম ছিল নাকি শ্রীমন্তভূষণ। তিনি ছিলেন একজন ভবঘুরে মানুষ। নানা জায়গায় নানা সঙ্গ করে এই নলডাঙ্গার উত্তর কোনে যে একটি কালীবাড়ি ছিল, নিতান্তই কুড়েঘর , সেখানে এক সন্যাসী  থাকতেন, তারই সেবাদাস হয়ে গেলেন তিনি। দিন যায়, বছর যায়, একদিন সন্যাসী নির্দেশ দিলেন পাশের কালীকাদহ থেকে স্নান সেরে এসে মায়ের মন্দিরে প্রণাম করতে। এবং তিনি এও বললেন, এখন তিনি যা করবেন, এমন কি মারতেও পারেন, সে মার খেয়ে তিনি যেন উঃ আঃ কিছু না করেন । সন্যাসীর কথামত তাই-ই করলেন সেবক। এরপর তাঁর প্রণাম করার সময় সন্যাসী তাঁর পিঠে কিল মারতে লাগলেন। কিন্তু সেবক সে কিলের ঘা বেশিক্ষণ সহ্য করতে না পেরে একসময়, উঃ আঃ, করে ফেললেন। তখন সন্যাসী বললেন, না, তোকে মা সবটুকু  দিলেন না। যে তিনটি কিল তিনি সহ্য করেছিলেন, সেই তিন কিলের উপর নির্ভর করে তিনি তিন পুরুষ রাজত্ব করতে পারবেন। তারপরে শেষ হয়ে যাবে তাঁর বংশের রাজত্ব। 
           সন্যাসীর কথা মতো সেটাই হয়েছিল নাকি দেবরায় পরিবারের। আর একটি মতে সন্যাসীই নাকি ঈশা খাঁর যুদ্ধ ক্লান্ত অবস্থায় প্রচুর সেবা যত্ন করে এই রাজত্ব পেয়েছিলেন। এবং তাঁর সব চাইতে প্রিয় সেবককে সেই রাজত্ব দান করে তাকে সংসার-ধর্ম পালন করার নির্দেশ দিয়ে তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। 
            এই সব গল্প-কথার নিদর্শন স্বরূপ কালিকাদহের পাশে এখনও গম্বুজ আকৃতির মন্দিরগুলো দাঁড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা অবস্থায়। পর পর পাঁচ ছটি  মন্দির। কিন্তু একটি কালী মন্দিরের পাশে একটি গনেশ মন্দির কেন? বাকিগুলি তো শিব মন্দির। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ওখানেই কেটেছে তার। তবু ভাবনা যেন ঘুরে ঘুরে প্রশ্ন জাগাত, কেন এইসব মন্দিরের গায় যেসব টেরাকোটার স্থাপত্যশৈলী তাতে বেশিরভাগটাই অবাঙালী প্রথার প্রধান চরিত্র। যেমন, গড়ুর পাখি। হনুমান। রাম-সীতা। আরো কতো সব অজানা অচেনা দেব-দেবীর মূর্তি।  যেগুলি বাঙালি লোকাচারের নয়, বা এভাবে তো আসেনি! তাহলে কি আদি স্থাপত্যে এসব এভাবেই ছিল?  
            রাজবাড়ির অস্তিত্ব সে দেখেছে কালিগঞ্জ থেকে আসা যাওয়ার পথে ভাঙাচোরা অবস্থায়। হয়তো মাঝে মাঝে উঁচু ঢিবি ইটের কয়েকটা। বাকি তো পুরোটাই এখন চাষ করা ফসলের ক্ষেত! কখনো কলা বাগান তো কখনো আলু কচু রোয়ার জায়গা। একটি ছোটো দীঘি মতো আছে, তার উপরে আগের দিনের ইটের ব্রীজ, সেটা নাকি রাণীবাঁধ। ওখানে নাকি রাণী সাহেবা বৈকালিক ভ্রমণ করতেন। তার ঠাকুমা শাশুড়ি নাকি কত গল্প করেছেন শেষ রাণীর সঙ্গে। আবার এও শুনেছে,  এখান দিয়ে সাধারন মানুষজন নাকি জুতো পরে রাজবাড়ির সামনে দিয়ে চলাফেরা করতে পারত না। এমন কি প্রখর রোদ্দুরে ছাতা মাথায় দিয়ে রাজবাড়ির সামনে দিয়ে সাধারণের চলাচলও নিষিদ্ধ ছিল। 
          এইসব গল্পগাছায়, জঙ্গলে, বাজারে , মাঠে, কালিকাদহের পাশে,  এইসব নিয়েই এখানে এলে প্রথম প্রথম অনেকটাই সময় কেটে যেত। আর তার লেখা-জোখার অভ্যাসের কথায়, বা দু'একটা বইপত্র যা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ হয়েছে, তা জেনে গিয়ে, ন'শ্বশুরের ছোটো মেয়ে লাবণি যেমন বলে, ' ও জামাইবাবু, যদি আপনি আমাকে নিয়ে কিছু লেখেন, তাহলে যেন সেখানে একটু নাচ গান থাকে, দেখবেন। ' 
           অন্তু বলে, ও জামাইবাবু, আমার ছিপ-বঁড়শিতে একটা বড় মাছ ধরেছি, একটা এরকম কিছু হয় কি না দেখবেন তো! ' 
          শ্রাবণীর মাসি,  যাদের বাড়ি পূর্ব দক্ষিণ কোনে,  এ বাড়ি থেকে কয়েকটি বাড়ি পরে , তার গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে আরামকেদারায় শুয়ে শুয়ে, সে যখন অন্য এক মূর্ছনায় প্রবেশ করে, তখন  লেখা-জোখার কথা এলে, মাসি বলে, ' মেসো , আমার বড় ইচ্ছা, আমাকে নিয়ে আপনি যদি বড় একটা উপন্যাস লেখেন তো খুব আনন্দ পাবো। ' 
        ‌‌   সে তাকে প্রশ্ন করে,' আচ্ছা মাসি , এই যে  তুমি একটির পরে একটি রবীন্দ্রনাথের গান গাও, এর সব  কটি লাইনের অর্থ কি তুমি বুঝে গাও? '
         পরমুহূর্তেই আবার একটু সংশোধন করে নিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,  'ও হো , তাই বা বলি কি করে, তা যদি নাই বোঝ তাহলে এত ভালো গাও কী করে!'
             আবার খানিকটা থেমে বলে, ' তুমি যদি এভাবে সমস্ত রাত ধরে গান গাও, তাহলে আমি এই চেয়ারটায় বসে থকতে পারবো।' 

             তখন চারদিকে জোস্না রাতের আলো উঠোন বারান্দা ছাপিয়ে ভেসে চলেছে। বাতাসে হাসনুহানার গন্ধ। শিউলিরা অল্প অল্প করে শিশিরে ভেজা শুরু করেছে। ওপাশে পুকুরের দিকটায় যেতে সন্ধ্যামালতিদের কি দেখা যাচ্ছে? গন্ধরাজ ফুলেরা এই জোস্নার আলোয় একটু দূরের গাছটার পাতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে থাকলেও দেখা যাচ্ছে বেশ। এমনই এক পরিবেশে এই গ্রামবাংলার এক একটি সন্ধ্যা উতরিয়ে কত রাত যে হয়ে যেত এ বাড়িতে ফিরতে, সেসব যখন মনে পড়ে, তখন সেখানে গিয়ে আবার সেই নির্জন বাড়িটার উঠোনে গিয়ে একাকী দাঁড়ায়।


                                                                চলবে....




মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ একটি উপন্যাস। এক ভিন্ন জীবন-দর্শনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪