দ্বিতীয় বর্ষ ।। একাদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ২৭ ভাদ্র ১৪২৮ ।। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
ভাদ্র মাস, উৎসবের মাস, অসুস্থতার মাস, উদাসীনতার মাস। এই মাস যেমন করম, জাওয়া, ইঁদ, ছাতা নিয়ে আসে তেমনই নিয়ে আসে ঘরে ঘরে, জনে জনে জ্বর, অসুস্থতা। তাই শ্রাবণ মাস পেরিয়ে যেতেই গ্ৰামাঞ্চলের মানুষের মনে আশঙ্কা জন্মায়, এবার সম্ভবত একবার অসুস্থ হয়ে পড়বার সময় উপস্থিত। খুব সাবধান, খাওয়া দাওয়া, স্নানের জায়গা বদল, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাওয়া, এসব ব্যপারে খুব সাবধান। পা ফুঁকে ফুঁকে চলা। তার পরও রেহাই নেই কারোর। শয্যাগত না হয়ে উপায় নেই। প্রকৃতির সঙ্গে পেরে উঠেছেন ক'জন? কোনো না কোনো অনিয়মের মধ্যে পড়তেই হয় মানুষকে। পড়তে হয় অসুবিধার মধ্যে। আর এইসব অসুবিধা কাটিয়ে উঠেই ভাদরের দুধভরা ধানের দিকে তাকানো। তাকানো আশার আলোর দিকে। এগিয়ে যাওয়ার দিকে। ভবিষ্যতের দিকে। যেদিকে না তাকিয়ে উপায় নেই আমাদের।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
_____________________________________________
এই সংস্করণে যাঁরা লিখছেন
_____________________________________________
বিশ্বম্ভর নারায়ণ দেব/ দীপ্তিশিখা দাস/ সুজন পণ্ডা/ সৌরভ লায়েক / মহিউদ্দিন সাইফ/ বিদুৎ পরামানিক/ কুমারেশ তেওয়ারী/ সন্দীপ বাউরী/ মধুপর্ণা/ তপন পাত্র/ দীপংকর রায়
_____________________________________________
প্রেমদিবস
বিশ্বম্ভর নারায়ণ দেব
আরও একটু হাওয়া উঠুক
ফুরফুরে হোক বেশ
এলেবেলে ওড়ে উড়ুক
প্রণয়-প্রবণ কেশ।
সময়কালের ঊর্ধ্বে ছোটে
মধুক্ষরা বয়েস লুটে
ফুল পল্লবে সেজে ওঠে
অন্তরোজ্জ্বল আলো।
এই মাত্র লিখে মনে হলো
বসন্তে তা অনুমোদন পেলো।
আরও একটু হাওয়া উঠুক
ফুরফুরে হোক বেশ
ওষ্ঠাধরে ধরছে কাঁপন
কথা নিরুদ্দেশ!
কোন নিশ্চুপ নিঃস্ব অভিমুখ সে.....
দীপ্তিশিখা দাস
কিবা গেল তাতে যদি ভিজতে না দিয়েই অসীম অনুভবকে ভেঙ্গে দেয় ক্লান্ত শরীর।
প্রকাণ্ড শূন্যতা বইতে বইতে চুপচাপ ছিনিয়ে নেয় কত চোখ-মুখ ভালোলাগা।
অসম্পূর্ণতা ছড়িয়ে আছে
কত ঝোপ-ঝাড়ে লুকোনো জোনাকীর মতো ।
বুঝি সেই আলোতেই শত শত চাঁদ দাঁড়িয়ে থাকে
কারও মুখ চেয়ে
বুকের ভেতর সমগ্র সাগর উতলে !
সে কি চলে যায় এই নিথর দেহ পেরিয়ে?
ঘরের ভেতর যাকে নিত্য দিয়েছি ঠাঁই
সেই তো নিভিয়ে দিয়েছে সব সূর্যের আলো।
অজানা কোনো নামে ডাকলে পাবো কি সাড়া তার?
ডানা ভাঙ্গা মেঘ ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে।
ভেতরে ভেতরে কাউকে ছুঁতে চাওয়া?
তার জন্যেই হয়তো
শিশিরে শিশিরে গড়িয়ে পড়ে নিঝুম পাহাড় ;
কোন নিশ্চুপ নিঃস্ব অভিমুখ সে?
দাদু
সুজন পণ্ডা
কোনো এক জৈষ্ঠ্যের
দীর্ঘতম অপরাহ্নে দেখেছিলাম...
অন্তর্লীন দুঃখের মত
আর্দ্র, ক্ষমাশীল চোখ।
দুই হাতে অশ্বত্থের প্রশান্তি
আম বন জুড়ে প্রলম্বিত ছায়া।
ওই কোল নিশ্চিত জানে আমার অতীত,
ওই হাতের বরাভয়ে লেখা ভবিষ্যত।
শীর্ণ পাঁজরে আমার বাস্তু ভুঁই...।
দীর্ঘতম দিনের অবসানে
গভীরতম আঁধার...
ঝুপ করে সরে যায় শৈশব।
মন থেকে শৈশব মুছে গিয়ে
এক বুক শূন্য তৈরি হয়..,
কোন বেদনায় তা পূরণ হওয়ার নয়।
সৌরভ লায়েকের কবিতা
১.
অভিশাপ
শত প্রদীপের শিখা
জ্বলে উঠুক জীবনে তোমার
আরো বেশি বেশি করে
শুভেচ্ছায়
উপহারে
পাহাড় জমুক তোমার প্রাসাদে
আমি চাই তোমার দিনটিতে
একটি নদী সেই পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসুক
আমি চাই তোমার জন্মদিনে
আমার মৃত্যু হোক
২.
প্রথম দেখা
আজকে তাদের প্রথম দেখা
প্রথম কোনো রেস্টুরেন্ট
শরীর জুড়ে প্রিয়র শাড়ি
মনমাতানো ডিওড্রেন্ট
এ শহর এক প্রেমের শহর
প্রিন্সেপ ঘাট স্মৃতির ট্রাম
এই শহরেই একসাথে গায়
কবির সুমন বব ডিলান
এই শহরেই দিনের শেষে
থাকছে যে কেউ ভীষন একা
সেসব কথা ছাই চাপা থাক
আজকে তাদের প্রথম দেখা
অনেকখানি স্তব্ধতা পর
বললো মেয়ে " কেমন আছিস ?
হাজার লোকের মধ্যে থেকেও
একলা থাকার কষ্ট জানিস ? "
শীতল ঘরের কফির কাপে
উঠছে তখন নম্র ধোঁয়া
হটাৎ করেই হাত চলে যায়
এই ছেলেটির প্রথম ছোঁয়া
হাতের মাঝে হাতটি রেখে
বললো ছেলে কানের কাছে
সবার মাঝে একলা হয়েই
আস্ত একটা প্রেমিক বাঁচে
অলুক্ষণে এসব কথা ?
প্রথম দিনেই কাব্য করিস
কাব্যি করা ছেলে আমার
পছন্দ নয় ভালোই জানিস
প্রেমেই মানুষ মিথ্যেবাদী
মিথ্যে কথার জাল ছড়ায়
এই বাংলার সব যুগলই
কবির কাছে হার মেনে যায়
কবিই জানে এই মেয়েটির
কাব্যি করা প্রেমিকটি - কে
সময় কালের চক্রে পড়ে
হারিয়েছে পথ পথের দিকে
হারছে হারুক কিংবা জিতুক
বিশ্বে প্রেমের মন্দা খুব
অতীত ঘেঁটে ক্ষতির চেয়ে
দিক না নতুন প্রেমের ডুব
আমার তোমার কী এসে যায়
কী এসে যায় ওই বালিকার
স্টেশন অব্দি সঙ্গে ছিল
ছায়ার মতো যে নায়িকার
মেয়েটি ধরো আর কেউ নয়
নায়িকাটির এক সুহৃদ বোন
স্টেশন থেকেই ফিরছে বাড়ি
অনেক প্রশ্নে - মনকেমন
দেখছো কেমন অবান্তরে
ডাইভার্ট হই বিষয় থেকে
কফির পর্ব শেষ হয়েছে
ঘটনা এগোক সামনে দিকে
বললো ছেলে ট্যাক্সি ডেকে
কফির থেকে বেরিয়ে দুজন
এই যে দাদা , আর্জেন্ট খুব
চলুন না প্লিজ বিকাশ ভবন
মেয়েটির আজ পরীক্ষা তো
সেকেন্ড শিফ্ট , তৃতীয় তলায়
ফাইলপত্র গুছিয়ে প্রেমিক
ফুটপাতের ওই একলা দাঁড়ায়
বাস চলে যায় ট্রাম চলে যায়
যায় চলে যায় আস্ত শহর
পরীক্ষা শেষ , বেরোয় মেয়ে
সুখী দেখায় প্রেমিকপ্রবর
পুরুষ চোখে ঢেউ খেলে যায়
ঘন্টা চারের অপেক্ষা পর
খিদের জ্বালায় দুজন এখন
ফেলবে খেয়ে আস্ত শহর
সামনে ছিল মস্ত হোটেল
মেয়ের আবার খাইয়ে সুখ
দুজনে মিলে সেথায় গিয়ে
আহার শেষে তৃপ্ত মুখ ।
প্রথম দেখা ! বলবে কে তা
দেখে বোঝার উপায় তো নেই
তিরিশোর্ধ দুজন মানুষ
মেলছে ডানা কোলকাতাতেই
মুঠোর ফোনে অনেক ছবি
গঙ্গার পাড় , ওষ্ঠে অধর
কথার পরে কথার মাঝে
ছেড়ে যাবার আসলো প্রহর
ইচ্ছে তো নেই সঙ্গ ছাড়ার
বিচ্ছেদেরই সময় এখন
চললো হেঁটে দুজন মানুষ
গন্তব্য সেই রেলের স্টেশন
আকাশে তখন মেঘ জমেছে
ঘোষণা এলো ট্রেন ছাড়ার
দুটি মনেও বাদলা ভীষন
কেউ জানে না স্টেশন পাড়ার
ট্রেন চলে যায় মেয়েকে নিয়ে
প্রেমিক হাঁটে বাড়ির পথে
আকাশ তাদের দুঃখ জানায়
মেঘ গুরগুর বিদ্যুতে
এরপর সেই বৃষ্টি এলো
ভিজলো শহর - মফঃস্বল
ছাতা মাথায় সেই মেয়েটি
বললো এবার বাড়িতে চল
মেয়ের সাথে ফিরলো মেয়ে
উথাল পাথাল মনের কোনে
কে ছিল সেই পুরুষ প্রেমিক
জানলো না কেউ পাশের জনে।
৩.
ফেরেব
মাংসের গায়ে কোথাও ছিলনা লেখা -
' হালালের গোস্ত '
খেয়েছি তৃপ্তি করে তারপর জেনেছি
নিষেধের বাণী
এইতো আমার পাপবিদ্ধ শরীর
ঘটেনি কোনো দৈব অঘটন
খুলতে দেখিনি ধর্মের কোনো পর্দা - কাপড় - আব্রু
আল্লাও আসেনি - ভগবানও গেল কই
ও ফেরেবি
অভুক্তের কোনো ধর্ম হয় না
তার কাছে খাদ্যই ঈশ্বর ।
মহিউদ্দিন সাইফের কবিতা
১.
সাঁওতালদের দেয়ালে
সাঁওতালদের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা গাছ
লতান মানুষগুলো হাত-পা মেলে গান গাইছে।
কোনোটা কুঠার হাতে ক্ষমাপ্রার্থী,
কারো কাঁধে পাখি
ঠোঁট গুঁজেছে ঝাঁকড়া চুলের বাগিচায়।
এক একটা বৃক্ষের নীচে একেক বাঁধনের মানুষ।
মাথায় জিহু উড়ছে,
দিগম্বর মাটির পুতি ও পুত।
সহস্রার নিয়ে খেলতে খেলতে ছুটে যাচ্ছে গোধিকার পিছে।
এতসব দেখতে দেখতে বৃষ্টি নামল, মুষলধারে।
দেয়াল থেকে সব বেরিয়ে এসে জমা হচ্ছে শালতরুমূলে।
জান তর করা গন্ধে মাতাল এ-ভুবনে
দেখি আমার দেহেও উজিয়ে উঠছে স্বপ্নে দেখা কচি কচি পাতা।
২.
সাধ
যদি তাঁর সাথে দেখা হয়
শিখে নেব ঊষাসুক্ত,
শিখব মরুৎবন্দন, কুয়াশাউড়ানি মন্তর।
শিকারে গেলে শুধাব কস্তুরী ষাঁড়ের কথা।
তারপর বলগা,
চাঁদ-সুরুজ-শীত-ক্ষুধা-বরফ-শীল,
সিন্ধুঘোটকের বিষয়ে কথা হবে।
গতশক্তি বুড়ো শিকারির দুঃখে হাত বোলাতে বোলাতে
তুলব সেই হাতফেরতা গানের বোল।
তিনি গলা মেলাবেন
আর আমরা ঘূর্ণ্যমান জগতে
তাঁকে ঘিরে রচনা করব নতুন অয়ন।
বিদ্যুৎ পরামানিকের কবিতা
১.
মেহফিল
কিভাবে অবিশ্বাস করি এই জন্মগান
আঁধারের ডানা চড়ে তস্যগলি যেয়ে
তখনো ভেসে এলো বেগম আখতার।
আতরের গন্ধ ক্ষীণ, স্তব্ধ কোঠাবাড়ি
ক্ষয়রোগ চিহ্ন আঁকে খাট ও বিছানায়
অভুক্ত জঠরে তাও সুরের নিবাস
সমস্ত বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হতে রাজি।
২.
জন্মবৃত্তান্ত
বরফ গলনের পর কেটে যাওয়া ক্ষণগুলি
আলোকবর্ষে মাপি। ভাবি বংশবিস্তারের কথা
আপেলের প্রথম কামড় থেকে উদ্ভুত কি না
ধরো যদি মনুষ্য জন্মের আগে
আবিস্কৃত হতো কাগজ ও কলম
তাহলে অনায়াসেই জন্মবৃত্তান্ত
লিখে যেতো আদম ও ইভ।
পাতাবাঁশি
কুমারেশ তেওয়ারী
অন্ধকার এসে পড়তেই আলো চলে যাচ্ছে দূরে।আলপথ দিয়ে এঁকেবেঁকে তার দৌড়ে যাওয়া দেখে রাধামাধবের চোখ। পাতা বাঁশি ঠোঁটে ফিরে আসে ঘরে। যশোদা মন্ডল ভাত বেড়ে দেয় পুরনো থালায়। ভাত খেতে খেতে রাধামাধবের চোখ দেখে, ভাতের ভিতরে কার নুপুরের ধ্বনি পড়ে আছে! চোখের ভেতর থেকে তার, একটি ময়ূরী বের হয়ে উড়ে গিয়ে বসে বাড়ির সামনে থাকা কদম গাছের ডালে। এসব কিছুই দেখতে পায়না মা'ৱ চোখ। রাত্রিবেলা রাধামাধব ময়ূরীকে নিয়ে যায় ময়ূর বনের দিকে।
উন্মোচিত
সন্দীপ বাউরী
একখন্ড কালো মেঘ সূর্যকে আড়াল করেছে ,
রূপালি জরির পাড় দেওয়া নীলাম্বরীর আঁচলে।।
পশ্চিম দিগন্তে সূর্যের রক্তিম আভা মূল্যহীন, নিস্তেজ ।।
চোখ ঝলসানো নীল আকাশ যেন জলরঙের-
তৈরি এক স্রোত প্রবাহের প্রতিচ্ছবি।।
বিস্তীর্ণ শুভ্র বালু কেটে বয়ে চলেছে কালো নীল জলের ধারা ।।
বনে ঢাকা পাহাড় খানিকটা কালো পাথরে মোড়া ,
অতি পাতলা নীল ওড়নার মতো ফিকে নীল কুয়াশায় ঢাকা ।।
পাহাড় ভুলেছে সঙ্গীদের নদী পথে আত্ম পরিচয় দিতে।।
'খুব বাড় বেড়েছে!' এই বেড়ে যাওয়া "বাড়" নারী-স্বাধীনতার লক্ষ্যে জরুরি সোপান।
মধুপর্ণা
"খুব বাড় বেড়েছে দেখছি!”
এই বাক্যটা জীবনে সহস্রবার শোনেনি এমন মেয়ে আমাদের সমাজে খুঁজে পাওয়া মুসকিল। এমনকি যারা সমাজের, পিতৃতন্ত্রের বেঁধে দেওয়া নিয়মের পান থেকে চুন না খসিয়ে তথাকথিত 'সুশীলা' হিসাবে বিরাজ করেন তাঁরাও এই বাক্যবন্ধ শোনেন কখনও না কখনও। কারণ নিয়মের নিগড় বড় কড়া। এবং বিপজ্জনক কথা হল পিতৃতন্ত্রের সুবিধামত তা বদলায়। তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে নিতে সারাজীবন শিক্ষানবিশি চালিয়ে যেতে হয়। তারপরও অসম্পূর্ণ শিক্ষার অপমান নিয়ে তাদের বিদায় নিতে হয়। আর বাকি যারা 'বেয়াদপ', 'আংশিক বেয়াদপ" 'সহবতহীন', 'যাচ্ছেতাই' নারীরা রয়েছেন, প্রতিনিয়ত অথবা কখনও কখনও সীমা লঙ্ঘন করে পরিবার, সমাজ এবং ঘনিষ্ঠজনেদের বিরাগভাজন হয়ে থাকেন তাদের বাড় বেড়ে যাওয়া কেন এত গাত্রদাহের কারণ পিতৃতন্ত্রের? কেন এই বেড়ে যাওয়া বাড় হজম করতে পারা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়? কেন বাড় বেড়ে না যাওয়া "ভালো মেয়ে" আর গ্রহনযোগ্য হয়ে ওঠার শীলমোহর?
“বাড়" বলতে বোঝায় বৃদ্ধি, অগ্রগতি, বিস্তার। কিন্তু এই শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্র এবং ভঙ্গী শব্দটির ওপর একটি স্ল্যাং বা অশিষ্ট শব্দের অর্থ আরোপ করেছে, যা সীমা ছাড়ানোর জন্য নিন্দাসূচক ভাবে নঞর্থক একটি প্রতীতি তৈরি করে। খুব বাড় বেড়েছে", "এত বাড় ভাল না' এই বাক্যগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত।
কেউ জোরে হাসলে বা কথা বললে বাড় বেড়ে যায়, কারো লিপস্টিক গাঢ় হলে বাড় বেড়ে যায়, কেউ অবদমন পছন্দ না হওয়ায় চিৎকার করলে বাড় বেড়ে যায়, কারো জামাকাপড় সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নর্ম ছাড়িয়ে গেলে বাড় বেড়ে যায়, কারো ইচ্ছা-আকাংখা একান্তই নিজের হলে তাতেও বাড় বেড়ে যায়, কারো বক্তব্য ধারালো হলে বাড় বেড়ে যায়, কারো নিজেকে উদযাপন করার ইচ্ছা হলে বাড় বেড়ে যায়, কেউ নিজের ব্যক্তিগত বন্ধু নিজে খুঁজে নিলে বাড় বেড়ে যায়, কারো কয়েকজন পুরুষবন্ধু থাকলে বাড় বেড়ে যায়, আমাদের সমাজে মেয়েদের নিজের মত কিছু ইচ্ছা হওয়াটাই মূলত বাড় বেড়ে যাওয়া।
এই বাড় বা বৃদ্ধির সঙ্গে সীমার ধারণা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আমাদের সমাজ মেয়েদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে। যে সীমা গুলো লঙ্ঘন করে গেলেই সমাজের রোষের মুখে, হেনস্থার মুখে পড়তে হবে মেয়েদের। আর আমাদের সমাজে মেয়েদের হেনস্থার জন্য আয়োজিত আছে ভাষার বিস্তীর্ণ পরিসর। আপাতভাবে কিছু যৌণগন্ধী গালিগালাজকেই আমাদের মনে হয় নারীর বিরুদ্ধে তৈরি করা বিদ্বেষের একমাত্র বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু নারীবিদ্বেষের বীজ আরো গভীরে প্রথিত আছে। দৈনন্দিনের ভাষা ব্যবহারের মধ্যে, শব্দের মধ্যে, উচ্চারণের মধ্যে ছড়িয়ে আছে। সীমার সামান্যতম বিচ্যুতিতে নারীকে শুনতে হয় যাবতীয় কুৎসিত আক্রমনাত্মক কথা। 'বাড় বেড়ে যাওয়া সেই সীমা নির্ধারণের সাবধান বাণী। সেই সীমা ছাড়ালে বা ছাড়ানোর চেষ্টা করলে আক্রমণ নেমে আসবে। বহু ব্যবহারে ক্লিশে একটি উদাহরণ আবারো উল্লেখ করি - সীতাকে গন্ডী কেটে দিয়ে রামের বিপদের আশঙ্কায় লক্ষণ মায়ামৃগের পিছু ধাওয়া করেছিল। এদিকে সীতা ছদ্মবেশী রাবণের ছলনায় তাড়িত হয়ে গন্ডী থেকে বেরিয়ে তাকে ভিক্ষা দেয়, তারপরের গল্প আমরা সবাই জানি। যুদ্ধ, লংকাদহন, সীতা উদ্ধার ইত্যাদি। রাময়ণের কেন্দ্রীয় সংকটের সূত্রপাত সেই সীতার নিরাপত্তার গন্ডী ছেড়ে বেরিয়ে আসা থেকে। “লোকশিক্ষার্থে" এই ঘটনা আপামর সাধারণের উদ্দেশ্যে এই বার্তা দিয়েছিল কি? যে পুরুষের তৈরি করা নিরাপত্তার বলয় থেকে নারী বেরিয়ে গেলেই বিপদ। যে বিপদ শুধু তাকে নয়, সংকটে ফেলবে গোটা সমাজকে। এইরকম ছোট বড় ব্যাসার্ধের গন্ডী দৃশ্যমান ভাবে বা অদৃশ্যভাবে আমাদের সমাজে মেয়েদের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। একটা থেকে আরেকটা গণ্ডী বদলে যাচ্ছে কিন্তু সেখান থেকে বেরোতে পারছে না কেউ। যারা বেরোতে চেষ্টা করছে তাদের শুনতে হচ্ছে “খুব বাড় বেড়েছে" অথবা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ। বাড় বেড়ে যাওয়া আসলে স্পর্ধা বেড়ে যাওয়া। সমাজের নির্ধারিত ছাড়পত্রকে অস্বীকার করার একটা ক্ষমতা। বাড় বেড়ে যাওয়া নারীরা সমাজে নিন্দিতা। এবং নারী স্বাধীনতার ইতিহাসে তাঁরা অথবা তাঁদের নামগোত্রহীন সমষ্ঠিই হবে একদিন নন্দিত।
এই সীমা আবার শ্রেণী, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, বয়স, লিঙ্গ, এলাকা এবং অবস্থান ভেদে ভিন্ন। একজন শ্রমজীবি নারী, একজন গৃহবধূ, একজন ছাত্রী, একজন আবাসিকা, একজন গণিকা, একজন বালিকা, একজন তরুণী সবার আলাদাভাবে সীমার বন্দোবস্ত আছে। তাদের সীমা ছাড়ানোয়, বাড় বেড়ে যাওয়ার মাত্রা ভিন্ন। সামাজিক স্তরভেদে সীমা লঙ্ঘনের মাত্রায় হয় তারতম্য। প্রতিটি সামাজিক স্তরের নিজস্ব তন্তুবিন্যাস অনুযায়ী পিতৃতন্ত্র বহাল রাখার জন্য ভিন্ন ভিন্ন সীমা নির্ধারণ করে। এই বিভিন্ন স্তরের ভিন্ন অবস্থানের বাড় বেড়ে যাওয়া" মেয়েগুলো একদিন একযোগে চিৎকার করবে। সেদিন তাদের বাড় শুধু বেড়ে যাবে না, সব সীমানা ছাড়িয়ে চলে যাবে পিতৃতন্ত্রের নাগালের বাইরে। এতটাই দূরে যেখান থেকে কোনো প্রত্যুত্তর আসে না, কেবল অট্টহাসির প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
____________________________________________
বাংলার ব্রতগুলি সুপ্রাচীন । মহাকালের ধারায় বেশিরভাগ ব্রতই ক্রমে ক্রমে শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে । কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্ত বাংলার কিছু ব্রতধারা আজও ব্রাহ্মণ্যবাদের শাস্ত্রীয় রীতি মেনে পৈতে পরে ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠেনি । সেগুলি এখনও একান্তভাবেই এক একটি লোকসমাজের মধ্যে জাগ্রত রয়েছে । এমনই একটি ধারার নাম ----
করম
লিখছেন ---
তপন পাত্র
___________________________________________
করম : কৃষিকথা
"""""""''"""""""'""""""'"''''''""""""'"""
সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে অদ্যাবধি যুগ যুগ ধরে মানবসমাজের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে প্রথম এবং আবশ্যিক প্রয়োজন খাদ্য ও প্রজনন । এই দু'য়ের অভাব মানে তো জীবনশূন্য বসুন্ধরা । আদিম যুগের মানুষের ধারণা ছিল কোন এক অজানা যাদুমন্ত্রবলে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি । পরবর্তীকালে ভাবনা একটি নতুন মোড় নিল, হয়তো বিশ্বচরাচর নিয়ন্ত্রণ করছে এক অজ্ঞাত মহাশক্তি এবং দেবতাগণ সেই মহাশক্তির সর্বময় কর্তা । রোদ , বৃষ্টি, মেঘ --সকল কিছুর নিশ্চয়ই একজন করে দেবতা আছেন । সঙ্গত কারণে কল্পিত দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য আচার-অনুষ্ঠান ব্রত পূজার সূচনা হলো ।
দেশ ভেদে, অঞ্চল ভেদে দেবতারাও হলেন ভিন্ন ভিন্ন । শস্য এবং সন্তান তো মানুষের দুর্বলতম কামনা , স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শস্য-সন্তান কামনায় ও মঙ্গল চিন্তায় লোকদেবতা কল্পিত হয়েছে । লৌকিক দেবী ও দেবতাদের ক্ষেত্রে হোম যাগ-যজ্ঞ সহ জাঁকজমকপূর্ণ অভিজাত পূজার্চনা প্রচলিত না হলেও লৌকিক নিয়ম-নীতি মেনে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের ধারা সুপ্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে । বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনকে ঘিরেই সৃষ্টি হয়েছে ঋতু উৎসব । রক্ত-মাংস, হাড়, শিরা-উপশিরায় গড়া মানুষ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্ভোগেই পরিতৃপ্ত নয় তার নিবিড় অভীপ্সা সন্তান এবং পবিত্র চাওয়া সেই সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে । তাই শস্য উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশের আকাঙ্ক্ষায় আর শস্যোৎসবকে ঘিরে কিংবা পরিণত শস্যকে অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা করার প্রয়াসে জন্ম নিয়েছে প্রাচীন ব্রতধারা । ব্রতধারা লোকসাধারণের সৃষ্টি, লোকসাধারণের সম্পত্তি । এটা বেশ বোঝা যায় যে সারা বছরের ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের স্বাভাবিক অবস্থায় যে বিপর্যয় ঘটতো, সেগুলিকে সামলানোর ইচ্ছা এবং প্রয়াস থেকেই ব্রতক্রিয়াগুলির উৎপত্তি । ব্রতর মূল উদ্দেশ্যই হলো দেবতা বা লৌকিক দেবতার কাছে ভক্তি ও পূজার বিনিময়ে কিছু প্রার্থনা এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ।
বাংলার ব্রতগুলি সুপ্রাচীন । মহাকালের ধারায় বেশির ভাগ ব্রতই ক্রমে ক্রমে শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে । কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় কিছু ব্রতধারা আজও ব্রাহ্মণ্যবাদের শাস্ত্রীয় রীতি মেনে পৈতে পরে ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠেনি , সেগুলি এখনও একান্তভাবেই একেকটি লোক সমাজের মধ্যে জাগ্রত হয়ে রয়েছে, এমনই একটি ধারার নাম --- করম ।
এ কথা না বললেও চলে যে , যে কোন দেশের যে কোন অঞ্চলে এই সকল ব্রত অনুষ্ঠানে মেয়েরাই অগ্রবর্তিনী । করমের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি । পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় যখন মাঠে মাঠে সবুজের সমারোহ ; ক্ষেতের আলে আলে, বা'দ-বহালে, বহমান নদীর দুপাশে জমে থাকা বালুর চরে দুলে দুলে ওঠে সাদা কাশফুল , নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, চতুর্দিকে কলকে ও ঝিঙ্গে ফুলের চটকদারি রূপের বন্যা , ভোরবেলায় শিশিরের ছোঁয়ায় টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে শিউলি তখন গড়াধান বা ষাটচালি ধান ঘরে তোলার ধুম । এই ফসল তোলার আনন্দে আর অঘ্রাণের আমনের কামনায় করম দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে করম দেবতার পূজা । এই প্রসঙ্গে বহু মতামত এসেছে গেছে কিন্তু এ কথাটি সকালের আলোর মতোই সুস্পষ্ট যে করম কৃষি উৎসব ছাড়া আর কিছুই নয় , এটি মূলত উৎপাদিকা শক্তির আরাধনা ।
সাধারণত কুমারী মেয়েরাই করম উৎসবের ব্রতচারী । কুমারীদের সাথে উর্বরতা, প্রজনন ক্রিয়া, শস্যোৎপাদন ইত্যাদির একটি ব্যঞ্জনাময় সম্পর্ক বিদ্যমান । উড়িষ্যার রাজারা করম উৎসবে রাজা ও রাণীর বিয়ে দেন । দু'টি করম গাছকে পাশাপাশি মাটিতে পুঁতে একত্রে বেঁধে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই অনুষ্ঠান সম্পাদিত হয় । এতে মিলন ও উৎপাদনের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট । কোথাও কোথাও আবার পূজা প্রাঙ্গণে করম ঠাকুরের ব্রত উদযাপন কারিণীদের মাঝখানে জীবন্ত সাপ ছেড়ে দেওয়ার রেওয়াজ আছে । এইভাবে কুমারী মেয়েদের মাঝখানে সাপ ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টির সঙ্গে বৃষ্টি, কৃষি আর উর্বরতার নিবিড় যোগ রয়েছে বলেই সাধারণ মানুষের ধারণা ।
সীমান্ত বাংলায় করমের যে সকল বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তাতে শস্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার রূপ প্রকাশ ঘটে । উৎসবের কয়েক দিন আগে মূলত অবিবাহিত যুবতীরা নিকটবর্তী নদীর থেকে বালি নিয়ে এসে একটি সরা বা টুপাতে সেই বালি রেখে পাঁচ রকমের শস্য বীজ ছড়িয়ে দিয়ে চারাগাছের জন্ম মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষায় থাকে, এই ঘটনার নাম জাওয়া । জাওয়া অর্থাৎ জন্ম বা জাত । এই জাওয়ার দেবতা করম গোঁসাই বা করম ঠাকুর । পূজা প্রাঙ্গণে এই চারাগাছগুলো যত্নসহকারে রাখা হয় করম ডালটির পাশেই । বিসর্জনের সময় মেয়েরা সরা অথবা টুপা ভর্তি বালিতে চারাগুলি করম ডাল সহ নিকটবর্তী নদী অথবা অন্য কোন জলাধারে ভাসিয়ে দেয় । আর চারাগাছগুলো ডালা থেকে তুলে নিয়ে এসে বাড়িতে ধানের গোলায় ছড়িয়ে দেয় । এলাকার মানুষের বিশ্বাস এর ফলে আগামী বছর শস্য ভান্ডারে তাদের গোলা উপচে পড়বে ।
করম উপলক্ষে করম নাচ হয় । করম নাচের গানের আবার একাধিক নাম -- দাঁড়শা'লা, দাঁ'ড়ঝুমুর , দাঁ'ড়শাল , দাঁড়গীত , পাঁতাশা'লা , ঝিঙ্গাফু'লা , পাতা নাচের গান ভাদরিয়া গীত ইত্যাদি । নামের বৈচিত্রের মতোই গানের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র পরিলক্ষিত হয় । সাদা মেটে কয়েকটি শব্দ দিয়ে গড়া এক একটি গান । জীবনধারণের সমগ্র পরিবেশ প্রতিবেশ ঠাঁই পেয়েছে এই গানে । চাষবাস , খাদ্য-পানীয় , ছোটখাটো শিল্প , সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান সবই জড়িয়ে আছে এই গানে ।
পশ্চিম সীমান্ত বাংলার কৃষক কাকভোরে ক্যাঁদ পিয়ালে ঢাকা কানালী ক্ষেতে লাঙ্গল দিতে গেছে । সকাল গড়িয়ে দুপুর । প্রখর রৌদ্র কিরণে তার মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে । ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছে সে । তার প্রিয়তমা নারী ননদীকে বলে নিজেই মাঠে যায় বা'সাম নিয়ে । একথা ঝুমুর গানে উঠে এসেছে ---
" আমার বঁধু হাল বাহে ক্যাঁদ কানালির ধারে
গরা গায়ে খরা লাগে, বড় দয়া লাগে ।
মুড়ের ঘাম টুঁড়ে পড়ে দেখে নয়ন ঝুরে ।
ননদী গো আমি নিজেই যাব বা'সাম দিতে । "
সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি আর শরীর চলছে না পেটের ক্ষুধায় মন জ্বলে ওঠে, জলখাবার নিয়ে অতি বিলম্বে আগতা বধুকে দেখে যুবক কৃষক বলে ---
" টেনা ছ্যাঁড়ার করম দড়ি
হাল বাইতে প'ড়ে মরি ,
এত কেনে বা'সামের ডেরি
মনে করে দিবো এক লঢ়ি"
পশ্চিম সীমান্ত বাংলার প্রান্তিক গৃহবধূর জীবনকে ক্রীতদাসীর সঙ্গে তুলনা করলে খুব বড় ভুল হয় না । যথাসম্ভব দৈহিক পরিশ্রম করা সত্বেও গালমন্দ , এমনকি মাঝেমধ্যে উত্তম-মধ্যমও জুটে যায় । একটু নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় সত্যিই "অভাবে স্বভাব নষ্ট" । স্বামী সীমাহীন পরিশ্রম করেও অভাব মেটাতে পারেনি । মনের মধ্যে যে ক্ষোভ জন্ম নেয় মানুষ তা অন্যের উপর বর্তাতে চায় । সংগত কারণে স্বভাবে যুক্ত হয়ে যায় স্ত্রীকে পেটানোর বিষয়টি । এটি শতকরা শতভাগ নিন্দনীয় ; নিন্দনীয় আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরোক্ষ ফসল । মননজাত তিক্ততা নয় । তাই এই প্রহার তো এই প্রণয় । প্রেম প্রণয়োচ্ছ্বাসে বিন্দুমাত্র ঘাটতি থাকে না ।
"বালি ছাতুর তরকারি বা'সাম দিতে যাব লো।
খালভরার হাল কত ধুরে
খালভরাকে খা'তে দিলে চুলহা শালে বসে লো
উচিৎ কথা বলতে গেলে পহ্ না লিয়ে ঘুরে ।"
করমের এই ঝুমুর গান শুনে "অসাধারণ" ছাড়া আর কী বা বলার আছে ! জীবনযন্ত্রণার শিকার হয়ে যে স্বামী হয়তো অল্প আগেই প্রহার করেছে, তার জন্যেই প্রাণ ডুকরে কেঁদে উঠছে প্রিয়তমা বধুর । মফঃস্বল প্রান্তিক বাংলার কোন স্ত্রী-ই না চায় পরিশ্রমী স্বামীকে সঠিক সময়ে খাবার দিতে ? কিন্তু অর্থাভাব অন্নাভাব মানুষের সকল সাধ , সকল আশাকে , সুখস্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দেয় । ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় । আগের দিনে পর্যাপ্ত খাবার ছিল না ঘরে ছেলে খিদে সইতে না পেরে সারারাত কান্নাকাটি করেছে ।
" একবাটি আমানি
তলে দুটি ভাত রে,
সেই দেখে ছানাপনা
কাঁদে গ'টা রা'তরে ।"
সকাল থেকে আবার ---
" ছানা দুটা হরল গরল
গহা'লে গবর ভরল
শাশুড়ি ননদি রঙ্গ দ্যাখে।
শিকড় বাকড় কাঠ বঁধু
চুলা ধরে না হে
কী ক'রে বা'সাম দিব
ছানা রহে না হে "
নিছক কাব্য সুষমামণ্ডিত হওয়া লোকগীতির ধর্ম নয় , আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডলে নর-নারীর সুখ দুঃখের নিখুঁত ছবি প্রতিবিম্বিত হওয়াতেই এর চরম সার্থকতা । পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলের লোকসাহিত্যের অন্যতম অঙ্গ পাতা নাচের গানে তথা করম গানে এই বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট ।
যেমন-তেমন পেটভাতা খাবার টুকু গ্রহণের পর যুবকের মনে নূতন করে কর্মোদ্যম জন্ম নেয় । পুনরায় সে লাঙ্গল চালনায় মন দেয় । কিন্তু ভারতবর্ষের বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা কৃষি উৎপাদনের প্রতিকূল । কথাটি এই অঞ্চলে একটু বেশি পরিমাণেই খাটে ।
"আষাঢ় শরাবন মাসে নবীন মেঘে ঘেরলি ,
পানি কা বুঁদা না বরষে
ও পরান ধরম বাঁচে কেইসে
কেমনে বাঁচে পরাণ দারুণ আকালে
সিকি পুয়া চাল নাহি মিলে । "
তবুও মানুষ আশাবাদী ।দুঃখে যাদের জীবন গড়া বোধ হয় তারাই দুঃখকে তুলনামূলক বেশি উপেক্ষা করতে পারে । এই অঞ্চলের ভুখা চাষাভুষার দল চিরদিনই নৈরাশ্যের আঁধারে দাঁড়িয়ে আশায় বুক বাঁধে ঈশানে মেঘ জমলে কাঁধে কোদাল তুলে নেয় । ধীরে ধীরে মাঠের দিকে এগিয়ে যায় । অসমতল ডাঙ্গা জমি থেকে যাতে জল বয়ে চলে না যায় তাই তারা বা'দ জমির আলের যত্ন নিতে বেরিয়ে পড়ে ---
"হাতে লিব বু্ঁদিটি
কাঁধে লিব কদা'লটি
টিক্ মলাই বনাই লিব চুটিটি
লহকে ধরিব হালটি"
মায়া মেঘ মাঝেমধ্যে আকাশে ভেসে বেড়ায় । নিয়মিত বৃষ্টি হয়ে ঝরে না মাটিতে । ডাংগা ডহরে চাষ হয় না । কানালি বহালে অংশত হয় । মরাপাপড়া যে ক'টি ধান ওঠে তাতে বারো মাসের খাবার চলে না । অনিবার্যভাবে আকাশ ভাঙ্গা বিপদ নেমে আসে । অঞ্চলটি খরা ঘোষিত হয় ।
"দু-একটা গুঢ়া লাগাই ছিলি ফুরা'ল ধান পোষ মাসে ,
বছর দিনটা কাটে কিসে উপায় নাই হে ধারে পাশে ।
রিলিফ সড়প খু'লল যদি কাজ করি মিলে মিশে,
ইবছর ভাই সবাই গরিব কাজ হল মোট দিন দশে।
সড়প খা'টে এক টাকা , গম দিল তুষে ভুষে,
একবেলা ভাই গহম ঘাটা
এক বেলা খাই ময়দা থাঁসে ।
ই বছরের আকালে গহম পিঠা সকালে,
বল বল বঁধু কী লুকা'লে আঁচলে ।
ভেঁড়া ছাগল বিকে খালি ,আর খালি মুরগি হাঁসে।
ঘটি বাটি প'ড়ল বাঁদা ইবার মরি গাছে ঘেঁষে ।"
প্রয়োজনমতো বৃষ্টির অভাবে অতি অল্প জমি চাষ হয়েছে । ক্ষেতমজুরেরা কাজ পেয়েছে বড় কম দিন । সকলের অবস্থাই এবার খারাপ । সরকার রিলিপের কাজ শুরু করেছে ত্রাণকার্য হিসেবে , সে তো মাত্র দশ দিনের কাজ । সেখানেও অর্থনৈতিক শোষণের ইঙ্গিত । নির্ধারিত প্রাপ্য মজুরি তারা পায়নি , তুষ ভুসি মেশানো গম যা পাওয়া গেছে তাই একবেলা ঘেঁটে খায় । আর একবেলা দু'চারটা আটার রুটি খেয়ে কোনমতে দিনপাত করে । ঘরে যে দু একটা হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া ছিল; তাও বিক্রি করতে হয়েছে । ঘটি-বাটি বন্ধক দিতে হয়েছে সুদখোর মহাজনের কাছে । তাই "গাছে ঘেঁষে মরা" ছাড়া গত্যন্তর নেই । এই এলাকায় নিরুপায় কর্মহীন হলে কাঁথে ঠেস দিয়ে মরা , গাছ ঘেঁষে মরা কথাগুলো বলনের চলন আছে । একেবারে কর্মহীন বসে থেকে অনাহারে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া ব্যাপারটিকে ইঙ্গিত করা হয় এসব কথার মধ্য দিয়ে ।
যে এলাকার অর্থনৈতিক বুনিয়াদ কৃষির উপর দাঁড়িয়ে , সেখানে গানে গল্পে কৃষিকথা তো থাকবেই । তবে শুধু কৃষিকথাই নয়, ইতিহাসের ছোঁয়া লেগে আছে কোন কোন গানের সারা গায়ে ।
মুসলিম যুগে তৎকালীন ঝাড়খন্ড এলাকা তার স্বাধীনতার পতাকা উচিয়ে ধরে রাখতে পারলেও পাঞ্চেত সিংভূম পর্যন্ত মুসলমানেরা এগিয়ে এসেছিল । সম্ভবত তখন কোন এক করম নাচের আখড়ায় হানা দিয়েছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ।
"আঁখড়ায় সামা'ল দা'ড়া মুসলমান
দেখ ভগবান , নিশিদাড়ি ছাতির সমান ।"
আবার এই অঞ্চলে বর্গীরাও হানা দিয়েছে কখনো সখনো ---
"উপর কুলহি ছল ছল নামো কুলি কিসের গল্
মাজ কুলি-এ দাদা বরগি সামা'ল রে ,
উপর কুলহি হড়হ'ড়ানি
নাম কুলিই ঢড়া
কি করে পাঁইরাব দাদা দুই ঠ্যাং যে খঁড়া ।"
প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা আর বহিরাগত আক্রমণে এই ছায়া সুনিবিড় শান্ত অঞ্চলে বিপর্যয় নেমে এসেছে বারংবার । এই জঙ্গলমহলে যারা অন্নের অন্বেষণে জঙ্গল সাফ করে হাতুড়ি , শাবল, গাঁইতি চালিয়ে ডুংরি কেটে ; পাথর ভেঙ্গে চাষ জমি তৈরি করল, ঘটনাচক্রে তারাই একদিন সুদখোর মহাজনদের কেনা গোলাম পরিণত হল । কাউকে কাউকে আসাম কিংবা উত্তরবঙ্গের চলে যেতে হল কাজের সন্ধানে । তখন অভাগিনী প্রেমিকা বা প্রিয়তমা বধূর বিরহবিধুর কণ্ঠে ধ্বনিত হলো ---
" সাহেব দিল কদালেরই কাম
টিপিকি-টিপিকি পড়ে ঘাম
হে বাঁকা শ্যাম, ফাঁকি দিয়ে পালালে আসাম ।"
অথবা
"তুমি আমার কে বা ছিলে
আমায় বিকে টাকা লিলে
পাকা খাতায় লেখাইলে সাত পুরুষের নাম
হে কালিয়া শ্যাম
ফাঁকি দিয়ে পালালে আসাম ।"
যারা কোথাও যেতে পেল না বা যেতে পারলো না, মাটি কামড়ে এখানেই পড়ে থাকতে হলো তাদের । অভাবের কড়া চাবুক আর মহাজনদের কাছে ঋণ ভারের যন্ত্রণা ভুলতে মুখে তুলে নিল মদ । ফলত নতুন মহাজনের জন্ম হলো । সুদের দায়ে মদের দোকানদার ঘরের শেষ ঘটিটি পর্যন্ত দখল করে নিল । বাংলার পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে মদের কারবারকারি সুঁড়িদের সুদের কারবার লাফিয়ে লাফিয়েই বেড়েছে চিরকাল । এই জটিল আর্থ-সামাজিক অবস্থার শিকার অসহায় কৃষক-শ্রমিকের সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস , হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বেরিয়ে এসেছে গান হয়ে ---
" যা ছিল গুড়াগুড়ি
ভাঁ'ড়ে লিল ল'খা শুঁড়ি,
এখন আ'ড়ে ব'সে ঝুরত নয়ান
মহাজনকে কি দিব জবান ।"
______________________________________________
ঔপন্যাসিক দীপংকর রায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস--
"জলশ্যাওলার বিরহকথা" - এবার দ্বিতীয় পর্ব
_______________________________
জলশ্যাওলার বিরহকথা
দীপংকর রায়
আরো আরো সম্বোধন, ভাব বিনিময়, লৌকিক আত্মীয়তার জটিল সব সরণী পার করে চেয়ারে বসে বসে যাকে দেখবার তাকেই দেখছিল। উভয়ের এই দেখাদেখির পর্ব যেন চলতেই লাগল। একজন ছেচল্লিশ আর একজন সতেরো কি আঠেরোর সদ্য বিবাহিত তরুণী। সঙ্গে নধরকান্ত স্বামী। কোট-টাই এঁটে একেবারে নাড়ুগোপাল। বারবার কি যেন পরখ করছিল সেও। পরখ করছিল সত্যি সত্যি এরা কেউ কারো পরিচিত কি না। মেয়েটি একভাবে তাকিয়ে কি যেন গিলছিল । নধরকান্ত ছেলেটি মুচকি মুচকি হাসছিল এবারে।
পথিকের সংলাপ : না না আমি এদের কাউকেই ঠিক মত চিনতে পারছি না তো-----তাছাড়া চেনার প্রয়োজনই বা কী? আরও পড়ুন
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
করমের ছবি : তপন পাত্র
ছবি : সন্দীপ কুমার
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
প্রিয় অরন্ধন, মহিউদ্দিনের দুটো লেখা পড়ে বড়ো ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনতন্ময় মৃধা
উত্তরমুছুনবেশ ভালো লাগলো।সৌরভের কবিতা ।তপনদার গদ্য। দীপঙ্করদার লেখা।
উত্তরমুছুনচমৎকার! পাঠে মুগ্ধ- ❤️❤️
উত্তরমুছুন