জলশ্যাওলার বিরহকথা
জলশ্যাওলার বিরহকথা
দীপংকর রায়
৩য় পর্ব
লেখা প্রসঙ্গে লেখার অন্তর্যামীর প্রশ্ন :
কী ঢ্যামনা লেখক, কি হচ্ছে টা কি, ঢ্যামনামি আরম্ভ করলে তো? এতক্ষণ তো বেশ ছিলে, বেশ তো এপাশ ওপাশ করছিলে, মরা দিনের কথা নিয়ে একটা গল্প বানানোর বাঁধা রেওয়াজের মধ্যেই ঘুরছিলে বেশ, কিন্তু এসব আবার কি আরম্ভ করলে বলো তো? বেশ তো পুচকেপাচকা শালা-শালিগুলোকে নিয়ে রসের গল্প বানাতে গিয়ে বুঝি মনে পড়ে গেল, না----- তাদের ওই অবিবাহিত মাসিটার কথা-----, ওই যে গায়, পেয়ে গেছ বুঝি? গায় যদিও সত্যিই ভালো, কিন্তু তাতে হল টা কি ? সেই তো ধরে রাখতে পারে না-- একটুতেই মুষড়ে পড়ে বিয়ের চিন্তায় । তোমার প্রশ্ন জাগে না, ওর এইসব অনিশ্চয়তা বোধ নিয়ে? শিল্পী মন এত সংসারমুখিন হবে কেন? টোকা দিয়ে দেখনি তা তো না , দেখেছ , কিছুই ছাড়নি । সে পরীক্ষাতেও তো তোমার কত বর্ষা , গ্রীষ্মের দুপুর, শীতের বিকেল-সন্ধ্যা করে দেখা আছে। শুনেছ তার একে একে কত পর্ব-কথা! কী সমাধানে এসেছ তাতে; আসনি কি, এই একাকীত্ব বোধ, এই লম্বা টানা বারান্দাওয়ালা বাড়িটার চারপাশে ঘের দেওয়া পাঁচিলের ভেতরে, বাড়ির পেছনের পুকুরের পাড়ে, কীভাবে একটি কলেজ-ইউনিভার্সিটি করা মেয়ে, ঘরে বসে বসে এইসব টানটান উত্তেজনাময় প্রকৃতির রঙ্গরসে সাড়া না দিয়ে, খালি খালি শুধু রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে, তার প্রেমময় আবেগ নিয়ে, একবারও একজন দেহসঙ্গীর কথা ভাববে না, তা কি হয়? তুমি হলে পারতে, পারতে ওভাবে একাকী বুড়িমার সঙ্গ নিয়ে, কাঁচা টসটসে বউদির নতুন বিবাহিত জীবনের দিনগুলি, শহুরে দাদার সপ্তাহ অন্তর দু'দিনের জন্য আসা , তাদের মিলনের রাত্রিগুলি পাশের ঘরে থেকে নানা ভাবে উপলব্ধি করার পরও সে যে সত্যি সত্যি কোনো পুরুষ-মানুষের কথা ভাববে না তা কি করে হয়? তাহলে তো তাকে সুস্থ বলেও ভাবতে পারা যায় না ? তাই নিজেকে দিয়ে, এই প্রকৃতি, তার সামাজিক অবস্থান নিয়ে, একটি অবিবাহিতা মেয়ের কথাটা একবার ঠিক- ভাবে ভেবে দেখ না, তাহলেই বুঝতে পারবে, এরা কতভাবে কত দিক নিয়ে অসহায় ! কিন্তু কেন পেল না সে তার জীবনসঙ্গী? এ বিষয়ে তোমার ভাবনা বোধহয় ঠিক জায়গায় গিয়েই ঠেকেছে। আসলে শিল্পী মন তো, সব সময় অনিশ্চয়তায় ভোগে। আর তারই শিকার হয়েছে এই মেয়েটি, আর কিছু না। সে যে কি চায় তা সে নিজেই জানে না। তাই তার সমাধানে আসতে দেরি হয়। সম্মন্ধ তো কম দেখা হয়নি ! একটা দেখার সময় তো তুমি ছিলে, কী ঘটেছিল মনে আছে তো সে ঘটনা, একটু মনে করে দেখ তো, 'এই যে আপনি গান করেন, এটাকে একটা এক্সট্রা ব্রেনের কাজ বলে মনে করেন তো, না কি? '
'এক্সট্রা ব্রেন! '
তুমিই প্রশ্ন করেছিলে, বলেছিলে, সেটা আবার কী ভাবে হয় ভাই, একটা মানুষের কটা ব্রেন থাকে?
ছেলেটি বলেছিল, ' হ্যাঁ হ্যাঁ , একে আমি তাইই তো বলবো, এটা একটা আলাদা ব্রেনেরই তো কাজ, তা না হলে হয় নাকি? '
তার কথার ভুল ধরণটি ধরিয়ে দিয়েও তুমি তাকে সংশোধন করে দিতে পারলে না। শুধু বললে, আপনি তো শুনেছি অধ্যাপনা করেন, তাই না?
ছেলেটি এড়িয়ে গেছিল। তার বোন মেয়েকে আড়ালে ডেকে নিয়ে তার পরনের কাপড় তুলে পায়ের পাতার সেফ ও থাইএর গড়ন দেখেছিল। চুল খুলে আলগা করে মেলিয়ে দেখাতে বলেছিল। সেগুলি নকল না আসল।
এসব সব তোমার মনে পড়ছে? সেসবও তো বছর পাঁচ ছয় আগের কথা। তারপরও অন্তত দশবার সে বসেছে মাদুরে দুই-হাঁটু মুড়ে নিজেকে প্রদর্শন করতে। একটির সঙ্গেও গাঁটছড়া বাঁধা হয়নি তার। আসলে সে কি আদেও তা চায় ! সে যা চায় তা হয়তো পায় না। তাকে যেভাবে এরা চায়, সে বেলা হয়তো তার আস্তে আস্তে ফুরিয়ে যাচ্ছে। আয়না বলে দিচ্ছে একাকী মুহূর্তে তাকে--সেসব কথা কানের কাছে ফিসফিসিয়ে যেন।
এই মেয়েটি তোমার বিয়ের সময় কতটুকু ছিল? আঠেরো বছর আগে কতটুকুই বা আর বুঝতে পারে সে? মনে পড়ছে না, এদের তিন বোনের তারও আগের হইহল্লা করা সেইসব দিনগুলোর কথা? ছোটো ভাই খুব মজা করে কথা বলতে পারত। তখন এদের সংসারে নিত্য অনটন লেগে আছে। এদের বাবা, লোকে যাকে ডাকত সুধীর ডাক্তার বলে । কোয়াক ডাক্তার । সেই মানুষটি যখন এদেশে প্রথম আসে; কথাটা এদেশ না বলে বলা ভালো এই অঞ্চলে, এই গাঁয়ে , আসলে গাঁ-ই তো , কাঁচা রাস্তা, এবড়োখেবড়ো ইট বসানো, মনে পড়ছে না তোমার? এই তো সেদিন, যেদিন তুমি প্রথম তোমার সম্মন্ধ করার জন্য এসেছিলে এই অঞ্চলে, সেদিনের কথা বলছি। আর তারও আগে এই ডাক্তার এই অঞ্চলে এসেছিল। সে বর্ণনা তো করেছিল তোমার ঠাকুমা শ্বাশুড়ি--' একটা ভাঙা টিনের সুটকেস আর কাঁচ-ফাটা হেরিকেনে কাগজ গুঁজে দিয়ে সুধীর ডাক্তার এল এই গাঁয়ে । '
প্রথমে তোমার শ্বশুরবাড়িতেই উঠেছিল। তারপর কায়েত পাড়ায়। আসলে মনকাড়া অল্পবয়সী বউ- এর হাত ধরে যেখানে সেখানে তো থাকা যায় না!
সেসব চিত্র পাল্টে যেতে বেশি সময় লাগলো না। একদিন নতুন ইট কেটে পাকা বাড়ি নিজেই তৈরি করল ডাক্তার। পূর্বপাকিস্থান আমলে প্রথম এই অঞ্চলে মোটরসাইকেলও কিনেছিলো সে-ই প্রথম। সবকিছুই হয়েছিল তাঁর হাতযশে । ডেলিভারি কেস-এ সিদ্ধহস্ত ডাক্তার। যশোর হসপিটাল থেকেও তাঁর ডাক আসত নাকি!
বেশ চলছিল। তিরিশ বিঘা মাঠান সম্পত্তি, পুকুর, বাড়ি, মোটরসাইকেল, কোর্ট-প্যান্ট পরা সুধীর ডাক্তারের শেষ অবস্থাটা তুমিও এসে দেখেছো তো! তখন যদিও জমি- মোটরসাইকেল আর নেই। তবে কোর্টটা ছিল। প্রায় ছ'ফুট লম্বা বাবরি চুলে লম্বা জুলপির ডাক্তার যখন ফোলা ফোলা চোখ দুটি নিয়ে তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, তখন তোমার নিশ্চয়ই বিস্ময় জেগেছিল, এই লোকটি এই এঁদো গাঁয়ে কোর্ট ঝাড়বার জন্যে তাঁর এমন বউটিকে কীভাবে অভস্ত করালো?
সেই ভাঙা হাটে প্রেথিড্রিণ আশক্ত ডাক্তারের সঙ্গ, তাঁর কাব্য, প্রেম; তোমার জন্য অতি কষ্টে একটি-দুটি গোল্ডলিফ সিগারেট আনানো, এসব কথা মনে পড়লে আজও তুমি লোকটিকে ভুলতে পারো না!
তোমার স্ত্রীর ন'কাকা, যে কিনা স্কুলের ছাত্রীকে বিবাহ করে একদিন একান্নবর্তী পরিবারের বাইরের লোক হয়ে গেছিল, সেই যখন আবার ঘরে ফিরে এল সম্পর্কের গভীর জোরবন্ধনে ! তারপর প্রেথিড্রিণ আশক্ত শ্বশুরের তিল তিল করে তৈরি করা জমিজমা যখন সবই এ-হাত সে-হাত হয়ে যাচ্ছিল তখন জামাইই এগিয়ে এসে একে একে সব কিনে নেয়। সুধীর ডাক্তারের স্ত্রী একদিন সংসার, ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা, সমস্ত কিছু এই জমিজমা বিক্রি করেই একে একে সামলেছিল সবটা।
সেসব সবই তোমার সামনে একেবারে না ঘটলেও, তার কিছুটা অন্তত তোমার চোখের সামনেই তো ঘটেছিল!
তাই তাঁদের এত অনটনের মধ্যেও তাঁর স্ত্রীকে ডাক্তার বলতো, ‘ ভায়া-কবি এসেছে, ধরো ধরো দেখি, একটা গান ধরো; -এই গোয়ো , তবলাটা ধর দেখি, একটি নতুন লেখা গান শোনাই আমার কবিকে।'
কী বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় সকলে মিলে, ডাক্তার, ছেলে মেয়েরা একে একে সকলে তোমায়, ' কলকাতার জামাই এসেছে বলে কি আনন্দেই না গান শোনাত! তুমিও তেমন, কেমন হুলো বনে শেয়াল রাজা সেজে দুলে দুলে উপভোগ করতে সেই সব দিনগুলো।
মনে পড়ছে না? মনে পড়ছে, আজ যখন সেই মানুষটি নেই-- অথচ তাঁর নিজের হাতে গড়া সংসার দিনের পর দিন ছোটো ছোটো সময়ের লাথিতে ভেঙে, গুঁড়িয়ে, টুকরো টুকরো! সম্বল বলতে শুধু আজ এই বাড়িটা, আর তার গায়ে ঘেঁষা পুকুরটি, আর পশ্চিমে এক টুকরো গাছগাছালি ঘেরা বাগানটুকু।
আজ বড়ো ছেলেটি ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ চাকুরে যদিও। ছোটোটি স্থানীয় স্কুলের মাস্টার। মেয়েদের একে একে সবাইকেই পাত্রস্থ করাও হয়ে গেছে। শুধু এই ছোটো মেয়েটি এখনও অবিবাহিত। যার গান শুনে তুমি মুগ্ধ হও। আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে কত দুপুর, কত সন্ধ্যা, কত জ্যোৎস্না রাত কাটিয়ে দাও। তখন তোমার মনে পড়ে না, এই গত আঠেরো বছরের সম্পর্কটার কথাগুলো ? ----অতি কষ্টে এমন দিনও গেছে যেদিন ডাক্তারের বউ পাশের বাড়ি থেকে চা করবার জন্যে দুধ চেয়ে এনে তোমার যত্ন করেছে। আপ্যায়ন করেছে। তোমার মনে পড়ে না, সেইসব দিনগুলির কথা?
আর আজ যখন সেই ডাক্তারের যুবক বয়সের ছবিটিকে কম্পিউটারে ছেলে কেটে নতুন করে কোর্ট প্যান্ট পড়িয়ে সোনালী ফ্রেমে বাঁধিয়ে তোমার সামনে মেলে ধরলো ,তখন তোমার মনে হয় যেন ডাক্তার বলছেন, কবি এসেছে, চা বসাও-- এই গোয়ো, হারমনিয়ামটা পাড়, ধর দেখি একখান নতুন লেখা গান শোনাই আজ কবিকে…, ধর ধর, নে, ধর দেখি…..
কী বলতে চাইতো ডাক্তার? তা তুমি জানো। শেষটা আর বলতে পারত না সে। কারণ তোমার স্ত্রীকে আদর করে সে কখনো বলতো, সু… ওরে ও আমার শুধু সু….. ওরে, তুই শেষপর্যন্ত দিদিভাই কবির ঘরণী হলি ! ওরে, কবি যে ঘরের মানুষ হয় নারে ! তোর যে এ শূন্যতা চিরকাল বইতে হবেরে দিদিভাই! আর তা যদি না হতো, তাহলে আমার দশা এই হতো নারে….! ওরে, কবি যে ছিকল-কাটা টিয়ে পাখি….' তারপর কিছুটা থেমে নিয়েই ছোটো মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলতো,' ওরে ও টিয়ে, গড়গড়াটা ধরা আজ, কবি আর আমি একটু সুখটান দিয়ে নি….. '
ছোটো মেয়ে উনুন থেকে কাটকয়লা তুলে কলকের মাথায় দিয়ে মুখের বাতাস দিতে দিতে গড়গড়ায় লাগাত। আর ডাক্তার বলতো, নাও, ধরো কবি, আমি গান ধরি…..
দরাজ গলায় ঠিকঠাক সুরে অনেকটা নজরুল ঘেঁষা সেইসব গান গেয়ে যেত ডাক্তার একে একে।
আজ যখন এত বছর পরে সেই বারান্দা, আরাম কেদারা , সেই গানের আসর, সব কিছু নিয়ে তার সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়ে টিয়ে, অত্যন্ত পরিণত গলায় রবীন্দ্রনাথের গানের গভীরে প্রবেশ করায়, তখন মন বলে এখানেই, এই দেশেই, এই ঘাটেই ভেড়াই তরী, আর নয় ফিরে যাওয়া; যদিও তা তো নিতান্ত পাগলামী, সব জীবন কি সকলের কপালে সয়? তার চাইতে তুমি গান গাও টিয়ে, আমি শুনি ---- শুনি আর ঢলে ঢলে ঘুমের এক গভীর রাজত্বে প্রবেশ করি, যেখানে তোমার গলায় গানই শুধু, চোখে নেই এমন ভাষা, যা দেখে আমার সন্দেহ হয়, এই মেয়েটি কি সত্যি সত্যিই সংসার মৌতাতে ডুবতে পারে কখনো! না কি এই ইচ্ছা তার আদ্যোও ইচ্ছা নয়? এ এক নিঃসঙ্গতার কঠিন দিনলিপি লিখবার আয়োজন মাত্র। না কি সব শেষে ভেতরে ভেতরে সব মেয়েই শেষ পর্যন্ত মা--?
অঘ্রাণের এই পড়ন্ত বিকেল, পাশের আম নারকেল সুপুরি বনের মাঝ দিয়ে শেষ বেলার যে আলো এনে উঠোনের মাঝে ফেলেছে প্রকৃতি, ওই গ্যাঁধা ফুল গাছের অনেকগুলি হাত যেন বেরিয়ে এসে সেই আলোদের দু'হাত দিয়ে ধরতে চাইছে, আমি দেখতে পাচ্ছি সেই ডালপালাদের ইচ্ছার হাতগুলি যেন শিশুদের, যেন কিশোর কিশোরীদের মত সারা উঠোন জুড়ে এখানে ওখানে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে আমারও চারপাশে যেন। আমিও ঘুরে ঘুরে সেই খেলায় সামিল হয়ে যাচ্ছি ! ওদিকে আবার ন্যাড়া ইউক্যলিপটাসদের ছায়া ঝাপসাভাবে সামনের অর্ধ সমাপ্ত দালান ঘরের বারান্দায় সরু হয়ে পড়ে আছে। নীলকণ্ঠ ফুলেরাও মিন মিন করছে যেন একে অন্যে তার মা-গাছের ভেতর। রঙ্গনারাও কি গাছে থাকতে চাইছে না আর ফুল হয়ে?
উঠোনের এক কোণায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে কালু নামের কুকুরটি। বড় মামার আদরের ভীষণ, তাকে দেখলেই গড়াগড়ি যায়, কেঁউ কেঁউ করে। লম্বা বারান্দার ওপাশে সদ্য গর্ভবতী ছোটো মামার বউ। যাকে আদর করে সুধীর ডাক্তার ডাকতেন, গোয়ো বলে , তারই বউ। পা তুলে বসে আছে বেঞ্চিতে।
দরজা ঠেলে বাড়ির ভেতর ঢুকে এ সবই দেখল পথিক। গতি এগিয়ে এসে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। তারপর সেই আরাম কেদারায় বসালো। গতি বললো, কি মেশো, ও ছাড়ল তাহলে? এবারে যে একটি বেলাও ঠিক সময় দেখা নেই?
------ কি আর করি বলো , নতুন নতুন তো! ক'দিন যেতে দাও, দেখবে পুরোনো হয়ে গেছি।
----- আপনি পুরোনো হবেন! আর সে বললেই আমরা তা মানবো?
----- কেন, আমি কি অক্ষয়?
------ না, তা না, তবে জামাই বলে কথা ---- তারপর আপনার মতো মানুষ ---
মনে হয়, সে কথাটা অসম্পূর্ণ রাখলো। বললাম, থামলে কেন? বলো, আমার কী এমন কোনো লেজ আছে নাকি?
----- না না ,তা না, লেজ টেজ কিছু না, লেজ থাকতে যাবে কেন? আপনার যে কী আছে তা আপনি নিজেই জানেন না, তা যার চোখ আছে সে দেখতে পায়। যা একজন মানুষের মধ্যে আশা করে মানুষ তা আপনার মধ্যে আছে, এটা আমি মনে করি। আর সেই জিনিসটারই বড় অভাব এ সংসারে।
----- তাই নাকি? সে আমার সৌভাগ্য। কিন্তু সেই বস্তুটি কী? তার খোঁজ তুমি পেলে কী ভাবে? একবার যদি বলো ----
----- তা তো পরিষ্কার করে বলে বোঝানো যাবে না! তবে আছে, এমন কিছু সে জিনিস, আবার এমন কিছুই না , তবে তা অদেখা হয়েও এমন ভাবে এক একজন মানুষকে আকর্ষণীয় করে রাখে, যা ঠিক বলে বুঝিয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু সে জিনিসটাই আকর্ষণীয় ----
------ কার কাছে?
------- যদি বলি আমাদের কাছে ,তাহলে কি আপনি ভুল বুঝবেন?
----- না না ভুল কেন বুঝবো!
----- তাহলে বলছি না, এবার একদম এলোমেলো…..
------ এলোমেলো! কই , না তো…..
------ আছে আছে, ও আমরা বুঝি সবই …..
যদি আপনি বুঝবেন, তাহলে আমাদের জন্যে আর কি রইলো? ….
------ তা হয়তো হবে---
----- বলছি, উর্মি গান শুনিয়েছে?
------ গান ! কই না তো, ও জিনিস তো তুমিই শোনাও শুধু…… ;
----- সে কি, সে গান শোনায়নি!
----- না, একটিও না !
------ তাহলে, কি দিয়ে বাঁধলো …. ?
----- চোখ দিয়ে।
------ চোখ দিয়ে! ও বাবা, তাহলে তো জমে উঠেছে বলতে হবে !
------ তা বলতে পারো, তবে এখনও গলা অবস্থায়ই আছে, জমেনি ,তারপর চারদিকের যা অবস্থা…..
----- কেন , সকলে মিলেই সময় দিচ্ছে নাকি….? …. ও-ও-ও, মাসি এখানে এখন থাকলে যে কী হতো ! আচ্ছা মেসো, মাসিকে কবে আনবেন?
----- আনবো, ধরো আমারও কি বছর অন্তর এভাবে একবার আসা হতো, এ যেন আমি আমার দিদিমার প্রতিনিধিত্ব করার খাতিরে এভাবে বছরে একবার আসি। আসাটা কি কম ঝামেলার? ওরা এত ঝক্কি পোহাতে চায় না। তবুও বাপের বাড়ি তো, আসতে ঠিকই চায়। কিন্তু নানা ঝামেলা থাকে তো, জানোই সংসার নামক বস্তুটির ব্যপার -----
-----দাদুভাই যে , কতক্ষণ ---- ?
গতির মা। সুধীর ডাক্তারের স্ত্রী। বাড়ির ভেতরে এলেন কোথাও থেকে। পথিককে দেখতে পেয়ে তার দিকে তাকিয়ে এই কথাটি জিজ্ঞাসা করলেন। বললেন, আরে, এই টিয়ে, মেসোকে চা করে খাইয়েছিস---?
গতি বললো, এই তো এলো, তুমিই চা টা করে খাওয়াও আজকে।
সে বাধা দিয়ে বললো, এখনি চায়ের দরকার নেই দিদিমা, আজ পরে হবে, এই তো কথাবার্তা বলছি, তাই-ই ভালো লাগছে ।
দিদিমা বললো, তা কি হয়? তুমি জামাই। বলো, কি খাবে বলো?
------ কিছুই না দিদিমা, এখন আমি গান শুনবো।
-----না না মেসো, আজ নয়, আজকে শুধুই কথা ----- আচ্ছা, মুনাই দাদা, জয় দাদা এদের খবর কী? জয়-এর বউ কেমন হলো?
------ বেশ ভালো। যেমন ওরা চেয়েছিল, নাকি তেমনই….।
------- নাকি কেন , আপনি দেখেননি এখনও?
------ হ্যাঁ ---- তবে…. ওসব থাক,
-----ও-ও-ও , আপনি তো আবার ওদের বাড়ি যান না। তা আপনার ওখানে আসে না কখনও ?
------ প্রায়--ই ,
------ তাই তো জানতে চাইছি।
----- ভালো, ভালো, বললাম তো বেশ ভালো।
পশ্চিম দিকে রোদের আভা অনেকটাই ঘুরে গেছে। গ্যাঁদা ফুল গাছ, ইউকেলিপটাস, রঙ্গনা সকলেই ছেড়ে গেছে তাদের সেই শেষবেলার প্রভাব। শীতের বেলা। সন্ধ্যা ঝপ করেই নেমে আসে। তবু যেন এখনও একটু বাকি। হয়তো একটু পরেই তার মনে হতাশার মেঘ ঘন হয়ে আসবে। যদিও এখনো সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বসে। চতুর্দশীর চাঁদ উঁকি মারবে একটু পরেই। তবে এই রেশ কাটাতে মনে হয়েছিল অন্য কথা তৈরি হবে। কিন্তু না, তা আর হলো কই ? ঐ যে বললাম, সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে, তাকে দেখে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই, কোথাও কোনোভাবে তার কোনো দুঃখ আছে।
জয় পথিকের ভাগ্নের বন্ধু। ধনবান বাবার একমাত্র ছেলে। তার এই শ্বশুরদের মতোই জয়েরও একান্নবর্তী পরিবার। তার বাবা-কাকারাও পাঁচ ভাই। এখনো এক সঙ্গে এক অন্নে সকলে মিলে হই হই করে সংসার যাপন করে। এদের সঙ্গে জয়ের পরিবারের অমিল শুধু কাঁচা টাকার আমদানিতে। তাছাড়া বাপ-কাকারা এরা ন ভাই আর তার বাবারা পাঁচ ভাই। জয়দের কাঁচা টাকা মানে জল বেচা পয়সা। আলতা সিঁদুর তৈরির কারখানা। জয়ের নিজের ব্যবহারের জন্যই একখানি টয়োটা গাড়ি আছে। যাতে সে তাকেও চড়িয়ে অনেক জায়গায় ঘুরিয়েছে। মুনাই, মানে তার ভাগ্নে। যে জয়ের বন্ধু। বাংলাদেশ যাদের কাছে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের জায়গা বলেই মনে হয়। এখনো যাদের পরিবার দেশভাগের চরম দুঃস্থতার চিত্র ভুলতে পারেনি। যাদের পূর্বজরা, এখনো যাদের কাছে এই দেশটা পাকিস্থান দেশ বলেই মনে হয়, গত পঞ্চাশ বছরেও পাল্টায়নি সেই ত্রাসের চিত্র, সেই অতীত দিনগুলির কথা।
ভালো লাগলো দাদা।
উত্তরমুছুন