গ্রামীণ যাত্রাশিল্প _সংকট ও সংশয়ের দোলাচল
গ্ৰামীণ যাত্রাশিল্প__সঙ্কট ও সংশয়ের দোলাচল
সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়
'তফাৎ যাও, তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায় '_মেহের আলীর এই সংলাপে গ্রাম-গ্রামান্তরে রঙ্গমঞ্চ আজ আর সেভাবে আলোড়িত হয়ে ওঠে না। 'অচল পয়সা'র চাঁদু মাস্টারের প্রতিবাদ সেভাবে আর ভাষা খুঁজে পায় না।প্রচারের আড়ালে-আবডালে ভিখারী ঈশ্বর হাহাকার করে কেঁদে উঠলেও,সে কান্না হাইটেক শ্রোতাদের কানে ধ্বনিত হয় না। একে একে নিভে যাচ্ছে স্পটলাইট। থেমে যাচ্ছে আবহসংগীত। অন্ধকার মঞ্চের এক কোণে দাঁড়িয়ে একা একা রং তুলছে চরিত্র। এক গভীর সংকট ও সংশয়ের দোলাচলে আজ গ্রামীন যাত্রা শিল্প। গ্রামীণ শব্দটা অর্থের সংকোচন ঘটালেও ইচ্ছা করেই ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত হল অ্যামেচার বা শখের থিয়েটার। পরিসরের অভাবে শুধুমাত্র গ্রামীণ যাত্রার কথাই যদি উঠে আসে ক্ষতি কী? এমনিতেও প্রচলিত অর্থে গ্রামের সাথে কোথাও যেন যাত্রা শব্দটা জড়িয়ে আছে। পালা গান, রামায়ণ পাঠ, কথকতা, কবিগান _সবই যেন ধীরে ধীরে অবলুপ্তির দিকে পা বাড়াচ্ছে। কেন এই সংকট? কেনই বা এত দোলাচল? উত্তর খুঁজতে যাওয়াটা হয়তো বা বাতুলতা।
সময়ের দুরন্ত এক্সপ্রেসে আরোহী আমরা সবাই। প্রতিমুহূর্তে বদলে যাচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি। বদল হচ্ছে মানসিকতার। বিনোদন ঢুকে পড়েছে গ্রামের অলিতে-গলিতে।ধুলোপথ ঢেকে দিয়েছে কংক্রিট। হারিয়ে গেছে গ্রামীণ শৈশব। আজকের কিশোরেরা লাট্টু জানে না। জানে এন্ড্রয়েড ফোন। কুমির ডাঙ্গা কেমন করে খেলতে হয় জানে না। জানে ফ্রী ফায়ার, পাবজি। মোবাইলে আঙ্গুল ছোঁয়ালেই হাজার রকমের বিনোদন। স্বাভাবিকভাবে যাত্রা তো ব্রাত্য হবেই। রাত জেগে যাত্রা কেনই বা দেখতে যাবে? হাতের মুঠো ফোনেই তো আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চ। টলিউড, বলিউড, হলিউড সবই আছে। আড়ালে আবডালে আছে নীলছবির ইশারা। প্রশ্নাতীতভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে যাত্রা দেখার মানসিকতা। থ্রিজি, ফোরজির প্রতিযোগিতা থেকে যাত্রা আজ মাঠের বাইরে বেরিয়ে গেছে। অনাদৃত। অবহেলিত। জৌলুসহীন অতীতের কথকতা। সাজঘরে কৌতূহলের উঁকিঝুঁকি নেই। সন্ধ্যা থেকে 'হ্যালো টেস্টিং, হ্যালো টেস্টিং' নেই। কনসার্টের প্যাঁ পোঁ নেই। ফাঁকা মাঠে একা পড়ে থাকে ভিলেনের ভয়ঙ্কর অট্টহাসি। হাততালি দেওয়ার হাতগুলোই আজ দূরে সরে গেছে। কাপড় ফেরি করা নিমাই জেনে গেছে _ অভাব, দারিদ্র ভুলে গিয়ে এক রাতের জন্য তার আর রাজা সাজা হবে না।
সাধারণ জনজীবনে আর্থিক অভাব যতই কমে আসছে ততই বেড়ে গেছে ভাবের অভাব। গতিবেগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে ছুটতে আমরা যেন ক্রমশই হারিয়ে ফেলছি আবেগ। আর্থিক প্রতিবন্ধকতা গ্রামীন যাত্রা শিল্পকে আজ বড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আজ থেকে পনের _ষোল বছর আগে ফিমেল, লাইট, মাইক, মিউজিক সহ সাজঘরের খরচ পড়তো প্রায় পাঁচ _ছ হাজার টাকার মতো। এখন সেই খরচটা এসে দাঁড়িয়েছে 25 থেকে 30 হাজারে। অফ সিজনে একটু কম। গ্রামীন যাত্রার মূল সিজন হল দুর্গাপূজা। এছাড়া সরস্বতী পূজা বা শিব গাজনেও অনেক জায়গায় গাঁয়ের যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। বেশিরভাগ যাত্রারই পৃষ্ঠপোষক থাকেনা। অভিনেতারা নিজেরাই চাঁদা তুলে খরচ মেটান। এখন পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে খরচের কথা ভেবে অনেক অভিনেতারই উৎসাহে ভাটা পড়ছে। একরাতের রাজা সাজার জন্য শখ করে কজনই বা ফকির হতে পারে? তবে সবাই না হলেও কেউ কেউ হয়তো হতে চায়। আর তাই টিমটিম করে হলেও মঞ্চের আলোগুলো আজও জ্বলে আছে। ধুঁকতে ধুঁকতে হলেও জেলার অনেক গ্রামীণ যাত্রাদলই আজও ঐতিহ্যটুকু ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ লড়াই কে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
কাহিনী যাত্রার প্রাণ ভোমরা। ভালো গল্প যাত্রাকে পৌঁছে দেয় সাফল্যের শিখরে। নিটোল কাহিনী আর জীবন থেকে উঠে আসা চরিত্রের সমন্বয়ে যাত্রার বেদব্যাস স্বর্গীয় ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় যাত্রাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এখনো সমানভাবে মঞ্চে অভিনীত হয়ে আসছে তার লেখা' মা মাটি মানুষ ',অচল পয়সা ' ভিখারি ঈশ্বর , স্বর্গের পরের স্টেশন, পদধ্বনি, সাত টাকার সন্তান আরো কত নাটক। ভৈরববাবু ছাড়াও নির্মল মুখার্জির মঞ্চ সফল পালাতেও গ্রাম জীবনের কথা বড় বেশি করে উঠে আসতো। বর্তমানে ভালো কাহিনীর বড় অভাব। অভাব মৌলিকত্বের। বেশিরভাগই সিনেমার টুকলি। প্রতিশ্রুতিবান সফল নাট্যকার উৎপল রায়, মঞ্জিল ব্যানার্জি, অনল চক্রবর্তী, ব্রহ্মময় চট্টোপাধ্যায় _এদের কাছে ভালো কাহিনীর দাবি থাকাটাই স্বাভাবিক। অ্যামেচার দলের উপযোগী পালা লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন ডাঃ তাপস কুমার, মহাদেব হালদার, কানন কুমার মাইতি প্রমূখ নাট্যকারগণ। তাছাড়াও যাত্রার প্রয়োজনে যাত্রাপালা লিখতে উদ্যোগী হয়েছেন অনেক অভিনেতাই। এরা প্রচারের আড়ালেই থেকে যান। নিজের দলের প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেরাই রচনা করেন যাত্রাপালা। গ্রাম বাংলার আড়ালে-আবডালে পড়ে থাকা এই অখ্যাত নাট্যকাররাই আগামী দিনের কান্ডারী। যাত্রা কে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে এদের আরো বেশি করে এগিয়ে আসতে হবে। উদ্যোগী হতে হবে সম্ভাব্য ঝড়ের হাত থেকে বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতির নিভু নিভু দীপশিখা কে যতদিন পারা যায় বাঁচিয়ে রাখতে।
সমস্যা আরো অনেক আছে। তবে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অতিমারীর কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি। যাত্রা হচ্ছে না। সাজঘর গুলিতে তালা পড়েছে। পোকায় কাটছে সাজ-পোশাক। নায়িকা বা অন্যান্য মহিলা শিল্পীরা জীবিকার প্রয়োজনে অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ডুগি তবলার বোল ফুটছে না। হারমোনিয়ামে বেজে উঠছে না আবহসংগীত। এক গভীর সংকটের মুখোমুখি গ্রাম বাংলার যাত্রাশিল্প। এই নেতিবাচক আলোচনা শেষ করব ইতিবাচক বিশ্বাস নিয়েই। আমরা আশাবাদী। ঝড় থামবেই, থামবে। নতুন করে সেজে উঠবে মঞ্চ। জ্বলে উঠবে আলো। বেজে উঠবে নেপথ্য সঙ্গীত। রাতের পর রাত মহড়া চলবে। মাঠে কাজ করতে করতে দিনমজুর সুধন বাউরী হয়তো পার্ট মুখস্থ করতে করতে নিজের মনেই সংলাপ বলে উঠবে_ 'হে খোদা, হে দিন দুনিয়ার মালিক, দোজাখের এই আন্ধেরা আর সহ্য করতে পারছি না। এবার বেহেশতের আলো দেখাও মেহেরবান।
________________
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন