জলশ্যাওলার বিরহকথা
ওবাড়ি থেকে বেরিয়েই পথিক সিগারেট ধরিয়েছিল। তারপর টর্চের এই অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ওপাশে কাটা ফসলের যে মাঠ আছে তারও ওপাশে দূরে চাঁদকে উঠে যেতে দেখা গেছে। ক্ষেতের উত্তর পাশে মুসলমান পাড়া। তার ওপাশে একটু তেরছা করে চাইলে বাজারের দোকানপাটের আলো দেখা যায়। বিদ্যুৎ-এর আলো। সে যখন বিবাহ করে তখনও কেন, গত সতেরো আঠেরো বছরেও আসেনি। এই তো গতবছর কি তার আগের বছর এখানকার বাজারই আলো দেখেছে প্রথম। বাজার থেকেই তার টেনে 'হৃষিকেশ ভবন', গতিদের বাড়ি এবং আরো দু'একটা বাড়িতে আলো জ্বালানো হয়েছে। কিন্তু এইসব পথে সেইসব আলোর ঝলকানির কোনো কথাই আসে না, যা শহর গঞ্জে দেখা যায় পোষ্টের মাথায় থাকা আলোর থেকে। যদিও সেই জন্যেই হয়তো ঝিঁঝিঁর ডাক, ব্যাঙের করর করর, কট কট, কঁ..অ..ক কঁ..অ..ক ডাক মাঝে মাঝে কানে আসে। তা না হলে সেসবও উধাও হয়ে যেত হয়তো ।
সমীর পথিককে এভাবে থমকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে জিজ্ঞাসা করে, ভালো লাগছে না ? একটু দাঁড়াবেন এখানে ? দাঁড়াতে পারেন কিন্তু এখানে, কোনো অসুবিধা নেই।
---- আচ্ছা দাঁড়াই, সিগারেটটা নিভে গ্যালো দেখছি, একটু ধরিয়ে নিই তাহলে, কী বলেন---?
----- হ্যাঁ হ্যাঁ, ধরান না ---- কোনো সমস্যা নেই -- ।
----- আচ্ছা মামা, আপনি এইসব পথে একটু বেশি রাতে বের হন কখনো ?
----- হ্যাঁ বের হই --- তবে খুব একটা একা একা বেরোই না। কেউ সঙ্গে থাকলে বেরোই…. ( তারপর একটু থেমে বলে) , আসলে কার সঙ্গেই বা বেরোনো হবে, এরকম রাত্তির বেলা খালি খালি পথে পথে ঘুরবার মতো মানুষজন নেই এখানে, তা তো আপনি ভালো করেই জানেন। সেসব রোমান্টিক মনের মানুষ খুঁজে বেড়াতে হবে তাহলে!
----- কেন, মামিকে নিয়ে একটু একা একা ঘুরবেন নাহয় দু'জনে, এই নিসর্গ তো আপনাদের হাতের কাছে, তাই বলছিলাম…..
----- আপনি সত্যিই ক্ষেপেছেন, এ কি আপনাদের দেশ, যে কেউ কিছু মনে করবে না, কেউ কিছু ভাববে না!
------ কেন, এর জন্যে আমাদের দেশের প্রয়োজন হবে কেন, এ দেশে কি কেউ রাতের পথে তাঁর প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটে না আর ----- ! তারপর আপনারা তো দু'জনেই বিবাহিত মানুষ। তারপরেও বাধা, না ?
---- তাতে কি হয়েছে ! কেউ যদি এরকম রাত্তিরবেলায় রাস্তায় ঘোরে, তারপর আবার সদ্য বিয়ে হওয়া বউ নিয়ে, তাহলে তো আরো রক্ষে নেই !….. আপনি ঘুরেছেন নাকি কখনো সাথিকে নিয়ে?
----- যদি বলি ঘুরেছি, অন্তত একবার দু'বার তো হয়েছেই ----- তবে এদের বাড়ি থেকে চাপ আসতো।
------ অ্যাই-ই-ই ----- হুঁ-উ-- দেখেছেন তো….. !….. তারপরে আর একটা কথা এর পরেও থাকে ---- উভয়ের ইচ্ছারও একটা বিষয় আছে তো, সেটাও তো দরকার!
----- কেন ? তার কি এসবে মোটেই ইচ্ছে নেই?
---- হ্যাঁ ----- অনিচ্ছা ঠিক না, তবে তাকে আপনি অনিচ্ছাই বলবেন। বাংলাদেশের মেয়েরা একটা সময় অবধি বেশ রোমান্টিক থাকে। তখন গান-বাজনা করে। কবিতা, ছড়া কত কি, তারপর বিয়ে থা হলে উবে যায় সব! সে কি শহর, কি গ্রাম, কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত ,অর্ধ শিক্ষিত, ঠিক ধরে রাখা যাকে বলে তা আর থাকে না। তারপর একটা ইসু হয়ে গেলে তো গেল চেরায়ে !
----- কিন্তু মামা, একথা বললে তো আমি মানবো না! এই দেশেও তো অনেককে অনেক মেয়েকে আমি জানি, তারা বিয়ে থা করার পরেও যথেষ্ট কাজ করেছে! একথা জানেন তো, আমাকে বললে আমি সবকিছু এক কথায় মানতে পারবো না।
------ হ্যাঁ… তা জানি। তবু আপনার এই একটুখানির উপরেই বিশ্বাসটা দিয়ে তো সম্পূর্ণ দেশের চিত্রটাকে জুড়ে দিলে হবে না ! একটা কথা জানবেন, আপনার মতো মানসিকতার মানুষ আছে ঠিকই ,কিন্তু তারা ক'টা? আপনি যা পারেন, যেমনভাবে পারেন, তার সঙ্গে সকলকে এক করে ভাবলে হবে না। সকলে আপনার মতো পারে না বা চায়ও না ।
------ আপনি কখনো মামিকে জিজ্ঞাসা করেছেন ,তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা?
------ না এসব বিষয়েই ঠিক করা হয়নি। তবে আমি জানি, বললেও সে কী বলবে।
----- মনে হয় এটা আপনার ভুল ধারণা। সেবার জয়, মুনাইরা এলে মাসির সঙ্গে মামিকেও নিয়ে সকলে মিলে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে, দোয়ার পাড়ে, ঠাকুর বাড়ি ঘুরেছিলাম আমরা। কই মামি তো একবারও যাবে না বলেনি!
----- সে তো দিনেরবেলায়, তারপর আপনারা কুটুম্ব মানুষ ---- না করতে পারে নাকি? এই যে ধরুন আমরা যখন খুলনায় থাকি, কই ইদানিংকালে তো কখনো কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে না! যদিও বা একটু অবকাশ তৈরি হলো, তাহলে একটা না একটা ঝামেলা সেরে সেই রাত হয়ে গেল! আসলে আমার মনে হয় এই অনীহাটা একধরণের একঘেয়েমি থেকেই মনে আসে।
----- তাহলে একটু নতুন করে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে আবার একটু গুছিয়ে গুছিয়ে দেখলে তো পারেন।
---- বিচ্ছিন্ন! বিচ্ছিন্ন হয়েই বা আর কোথায় যাবেন আপনি? সে দূরত্ব কি তৈরি না হয়ে থাকে নাকি ! এই তো দু'সপ্তাহ পরে বাড়ি এলাম, আমার সঙ্গে তার সময় কই ? এখন তো সবসময় মেয়েকে নিয়েই ব্যস্ত সে।
---- সে না হয় এখন, আমি তো বলছিলাম আগের কথা….
----- একটা কথা তো আপনাকে খুব সহজ ভাবে বুঝে নিতে হবে, ওসব খুব সহজ ভাবে ধরে রেখে চলবার মতো মন বা মানসিকতা তৈরি হওয়া এখানে সম্ভব না। সে আপনি যতই বলেন না কেন।
তারপর একটু থেমে নিয়ে বলে, আপনি বলেন না ওই গৌতমকেই---- দেখেন না, সে কি বলে! ওদের তো নতুন বিয়ে থা হয়েছে, তাই তো, ওরা কি বলে দেখেন !
---- মামা, গৌতম তো এ বোধের মানুষই না ! আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করা এই জন্যে, আপনি তো একজন সংস্কৃতি সচেতন শিক্ষিত অনুভূতিপ্রবণ মানুষ, নানা ধরণের সমাজে বড় হয়েছেন, বই পড়া, গান শোনা, এসব সকলই আপনার অভ্যাস, তাই বলছিলাম ….
----- তাতে কি হয়েছে! সে তো আমার, তার সঙ্গে আর একজনকে এক করে পাই কি করে ! ….. এখানে সব নগদ, নগদ পাওনা, বুঝলেন কিনা, সব নগদ……
নগদ পাওনা শব্দটি সমীর মামা কেন বা কি জন্যে ব্যবহার করলো এ কথা সেই জানে ভালো। জানে মানে, খুব বিস্ময়ের সঙ্গেই জানে। তবে তার ব্যখ্যা করতে পারবে না। জীবনের সঙ্গে, বেঁচে থাকার সঙ্গে , এদের এইসব অনুষঙ্গ জুড়ে আছে হয়তো। যে সব প্রণালীর সঙ্গে এদের ভাব বিনিময় হয়, তার মধ্যে ক্লান্তিহীন একটিই ব্রতকথা যেন জোড়া। তাকে বিভিন্ন পাত্রে রেখে, বিভিন্ন ভাবে সাজিয়ে দেখবার বা দেখাবার মতন গভীর নীরবতাটুকুও এরা উপেক্ষা করে। তাকে নিয়ে কোনোরকম মজা নয় যেন। কোনোরকম শিল্পিত শোভা তার গায়ে লাগানো নয়। যেভাবে তারা চায়, সেভাবেই তারা চেয়ে চেয়ে দেখে সব কিছু। কিন্তু সত্যিই কি খুব গভীর ভাবে পরিষ্কার করে ব্যবহার করা বারবারের সেই মুখটিকে কি দেখে তারা? আহা , যদি একবারও দেখতো, পথিক ভাবে।
' হৃষিকেশ ভবনের ' খামারের উপরের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে তারা এখন । দু'একটি রাতপাখি হয়তো এদিকে ওদিকে ডাকাডাকি করছে। আগে এদের নাম-ধাম ডাকের শব্দ সব জানা ছিল। দু-একবার কান পাতলেই ধরে ফেলা যেত কে কোন্ দিক থেকে ডাকছে। এখন আর সেসব আয়ত্তে নেই। মাত্র এই ক'বছরেই সেসব উধাও হয়ে গেছে। একধরণের অনভ্যাসে তার কাছে সকলেই নাম-হারা হয়ে গেছে যেন। তবে এখন কুব কুব করে যার ডাক কানে আসছে তার নাম তো কুবো পাখি। 'দিনকানা' বলতাম, বলতো কেউ কেউ। দিনেরবেলায় চোখে দেখে না । খামারের পাশের ডোবাটায় মাছেরা ঘাবলা মারল। প্রচুর তেলাপিয়া লাইলনটিকা এবং অল্প বিস্তর কিছু মৃগেল ও কাতলাও আছে নাকি। প্রয়োজনে জাল দিয়ে ধরে সাথির ফুল কাকা। এই মাছ ধরা নিয়ে তার ছেলেটা কি যে আনন্দ পেত, ছোটবেলায় যখন এসেছে। একঝলক মনে পড়ল তার।
এদিকে দরজা পর্যন্ত এসে সমীরমামা বললো, তাহলে আসি, যেতে পারবেন তো এবার?
হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক পথিককে তাল ফিরিয়ে দিল যেন সমীর মামা। সে বলল, তা কি করে হয় ! বাড়ির ভেতরে যাবেন না ?
সে বলল, না না এখন আর না ---- আচ্ছা, চলুন নাহয় আপনাকে দরজা খুলে ঢুকিয়ে দিয়ে আসি, তা না হলে আপনি পারবেন না হয়তো ----
----- না না সেরকম কিছু না। তবে আপনি ভেতরে গেলে একটু ভালো লাগতো যেন, ক'টা আর বাজে বা!
---- না না এখন নয়, কাল হবে ,কাল আসব, এখন কদিন আছি তো ।
সমীর মামা চলে গেলে সে নিঃশব্দে ঢুকে গেল ডান দিকের বারান্দায়। আগে ঠাকুমা শ্বাশুরি বেঁচে থাকতে সে যত নিঃশব্দেই বাড়ির ভেতরে ঢুকত না কেন তিনি ঠিক পশ্চিমের ঘরের বারান্দা থেকে টের পেতেন। আজও তার মনে হল সেরকম কিছু হবে। কিন্তু না। তা হল না। একেবারে নিঃশব্দেই , ও পাশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনের রান্নাঘর থেকে এখন আর সেরকম ভাবে খেয়াল রাখা যায় না। তাছাড়া এখন যারা রান্না ঘরে আছে তাদের এত দিকে নজর দেবার মতন মন নেই বা সময়ও নেই। তাও সে আস্তে করে দরজার শেকলটা নামায় এবং ঘরে প্রবেশ করে।
জানলার কাছে টেবিল পাতা হয়েছে। সে এখানে আসার পরে এটাই তার লেখাপড়া করার জায়গা। অন্য সময় এটি তার বড় শালার বউ-এর সাজগোজের সাজসরঞ্জাম বা তার ছেলের খাওয়াদাওয়ার এটা ওটা থাকত সেখানে দেখেছে। টেবিলের মাথার উপরে এ ঘরের ছোটো মেয়ের এবং জামাইএর বিবাহের পরে পরের ছবি টাঙানো আছে। ডান দিকের আলমারির কাঁচের পাশে এ ধরণের আর একটা যুগল ছবি আছে। সেটি তার বড় শ্যালকদের স্বামী-স্ত্রীর । তার ওপাশে উত্তর দিকের দেওয়ালে, যেখানে তার শ্যালিকার যুগল ছবি, তার পাশে আরো একটি আছে, মেজ শালার ছেলের মুখে ভাতের। এরকম ছবির সংখ্যা প্রতি ঘরে ঘরেই। কোথাও এমন ছবিও দেখা যাবে, যাকে চিনে ওঠা দায়, এটি অমুক শ্বশুরের বা শ্বাশুরির কত বয়সের ছবি! এই ছবি রাখাকে খুব একটা প্রাধান্য দেওয়া হয় এখানে। এ দেশে। যদিও তাতে কি, এ বাড়ির সমস্ত জায়গা খোঁজ করেও পথিক এবং সাথির কোনো সুদৃশ্য যুগল ছবি পাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে তারা যেন ব্রাত্য। এ বাড়ির মেজ জামাই পূর্ণিমার বর, ছোটো জামাই বিউটির বর, এদের সকলের ছবিই যার যার শ্বশুরের ঘরে, শালাশালিদের ঘরে সুন্দর ফ্রেমে শোভা পাচ্ছে। শুধু তাদের কোনো ছবি নেই কোনো ঘরে। এ নিয়ে কখনো কেউ তাকে জোরাজুরিও করেনি। শুধু একজনের চোখেই এই অভাবটা ধরা পড়েছিল দু’হাজার সালে। সেই একটি মুহূর্ত খামারের জবা গাছটার গোড়ায় দাঁড় করিয়ে জ্যৈষ্ঠের সেই দুপুরে তাদের যুগল বন্দী করেছিল কেমেরায়। এবং কলকাতায় ফিরে সে ছবি লেমিনেট করিয়ে তার ঘরে টেলিফোনের টেবিলের সামনে বসিয়ে দিয়েছিল।
সেই একটি মাত্র ছবিই তাদের একসঙ্গে তোলা। বাকি যা তা তো বিবাহের। এ প্রসঙ্গে এই ত্রুটির কথা কোনো একটি হাস্যচ্ছল মুহূর্তে বলেওছিল। তার উত্তরে সাথি এদের সকলের হয়ে এই ত্রুটি ঢাকতে বলেছিল, ওরা সকলেই ছবি তুলে বাঁধিয়ে এখানে রেখে গেছে ,তুমি তো তা করোনি !
সেও জানে এটি সাথির খুব সাধারণ একটি ত্রুটি ঢাকবার অজুহাত মাত্র। সে জানে এরা কেউই সেই মানসিকতার জামাই নয়। কারণ তাদের সব সময়ের চিন্তায় এক টাকাকে চার টাকা করার কৌশল কোন্ পথে খুঁজে পাওয়া যায় সকল সময় তারই চিন্তা।
তাই সেও খুব ভালো ভাবে জানে, যে কারণেই হোক, যেভাবেই হোক তাকে খুব সহজ বা সব সময়ের স্মরণযোগ্য করে এ বাড়ির কেউই কোনোদিন চায়নি। কিন্তু সাথি ? সেও কি তার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাত্য ?
পথিকের মনে পড়ে সাতাশির দিনগুলির কথা । সাথি সন্তান সম্ভবা হল। সন্তান সম্ভবা হলে যে সকল নিয়মকানুন থাকে বাপের বাড়ি থেকে তার কিছুই হল না। সেও সবে একটি ব্যবসা ছেড়েছে। কেন, সেসব পরিবারের নানা জটিলতার কারণ। বেকার হল সে একদম। যা দু' এক পয়সা ছিল তাই দিয়ে আবার নতুন করে ভাবছে কিছু করা যায় কি না। এমনই সময়ে দিব্য এল। ভীষণ এবনরমালিটি লক্ষ্য করে ডাক্তার সিজার করে দিল। জন্ম হল দিব্যর। তারপর নানা উৎকন্ঠা। নানা অপরিণতি অনভিজ্ঞতা মধ্যে দিয়ে বড় হতে লাগল সে ।একটার পর একটা জটিলতা , সমস্যা ডিঙ্গিয়ে মামা পাতিয়ে নিয়ে তার বোনের দেওরকে দিয়ে দিব্যর মুখে ভাত হল। সেখানেও সাথি তাকিয়ে থাকলো তার অসহায় ভাগ্যের দিকে। যেমন ভাবে অসহায় হয়ে চেয়ে থাকত হসপিটালে অন্যান্য পেসেন্টদের সন্তান জন্মের পরে তার মামা-মাসি দাদু-দিদাদের উপস্থিতিতে যখন আনন্দ উচ্ছ্বাসে মুখরিত হয়ে উঠত ভিজিটিং আওয়ার্সের সময়টা। ওয়ার্ডের প্রত্যেককে জবাব দিতে দিতে ক্লান্তি বোধ হত তার --- কেন তার বাপের বাড়ি থেকে কেউ আসে না! সিজার হবার পরে এমারজেন্সি ওয়ার্ডে তাকে যখন প্রথম দেখতে গেছিল পথিক সে কথা মনে পড়লে তার এই সমস্ত ক্ষেত্রের ভীতু মন এখনো দিশেহারা হয়ে পড়ে। সাথির চোখের জল বয়ে যাওয়া অসহায় গালের কথাই মনে হয় তার বেশি করে।
দেখতে দেখতে সেসব দৃশ্যও পেছনে সরে গেল একদিন। দিব্য এবারে মাধ্যমিক দিল। তার এখন ষোলো প্লাস। ইতিমধ্যে যে সব ঘটনা, ঘটনা পরম্পরা তার মধ্যে দিয়ে, আঠেরোটা বছর খুব একটা কম না তো! আবার নতুন করে ব্যবসা পাতা। সাথির এক কাকার ভারতবাসী হবার পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়িত করতে যাওয়া থেকে শুরু করে একের পর এক অধ্যায় ভাবলে অনেকটা। কোথা থেকে সে গল্প শুরু করবে সে, কোথায়ই বা শেষ করবে! নব্বই-এর আগস্টের থেকে কাঁধে করে অফিসে অফিসে বাড়ি বাড়ি শাড়ী জামাকাপড় ফেরি করে বিক্রি করা। কী অপমান! কী লাঞ্ছনা! কী অবজ্ঞা! মনে পড়লে অস্থির লাগে। আলিপুর ট্রেজারি বিল্ডিং থেকে শুরু করে সোনারপুর পর্যন্ত সে পর্বের আসা যাওয়া। ক্লান্তিহীন সেসব অধ্যায়গুলি । তারপর তো চণ্ডি ঘোষ রোডে জাহাজের মতো দোকানে সামান্য ক'টাকার পুঁজি নিয়ে শাড়ি পোশাকের সম্ভারে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দশটি বছর পার করে আজও তার বুকে হাঁটা ফুরোলো না।
প্রতিশ্রুতি মত সাথির কাকাও সরে দাঁড়ালো সহযোদ্ধার ভূমিকা থেকে। একসময় তার সেচ্ছাচারিতা চরমে পৌঁছলে তাকে বাদ দিয়ে সমস্ত দায়টাই নিজের ঘাড়ে নিল সে। তাকে তার বড় ভায়েরা স্থানান্তরিত করল রানাঘাটের কাছে গাঙনাপুর নামের একটি জায়গায়। সে এখানেও দেখল চেয়ে চেয়ে, কি নিষ্ঠুর মানুষ তার সমস্ত ঐতিহ্যের প্রতি। এখন তার মনে হয় সে কি অন্য কোনো ভাষায় কথা বলে ? কেউ যেন তার ভাষাটাই বুঝল না। বুঝল না কেন যে, বার বার তার এই কথাই মনে হয়। তখন দিশেহারা হয়ে পড়ে সে।
চলবে...
এক স্মৃতি রোমন্থনের ভেতর আমরাও ডুবে গেলাম। সাতাশির দিনগুলি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। পারিবারিক সম্পর্ক জীবনযাপনের নিবিড়তা এবং সরলতা কতখানি মহীয়ান ছিল তা উপলব্ধি করতে পারলাম। বর্ণনার এমন সূক্ষ্ম বুনন উপলব্ধির প্রগাঢ় দ্রবণ তৈরি করে দিল। মরমী এবং মেঠো জীবনের প্রচ্ছদ।
উত্তরমুছুনলেখনীর আদ্রতায় পাঠকের মন সিঞ্চিত হয়, যা অনুভূতি পূর্ন...
উত্তরমুছুন