দ্বিতীয় বর্ষ ।। পঞ্চদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ২১ কার্তিক ১৪২৮ ।। ৮ নভেম্বর ২০২১



আধার কার্ড, পেন কার্ড, ভোটার কার্ড, ই-শ্রম কার্ড, জব কার্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। এক একটা সরকারি প্রকল্পের জন্য এক একটা আই ডি বা পরিচয় পত্র বানাতে হবে। নচেৎ সেই প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হবে সেই সুবিধার আওতায় পড়া সাধারণ মানুষকে। যার জন্য একেক সময় একেকটা লাইনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষকে। নিজেদের কাজকর্ম ছেড়ে এক প্রকার বাধ্য হয়েই লাইনে দাঁড়িয়ে, টাকা খরচ করে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের আই ডি বা পরিচয় পত্র বানাচ্ছেন তাঁরা। এবং আই ডি কার্ড বানিয়ে বানিয়ে ভরিয়ে তুলছেন নিজেদের বাক্স প্যাঁটরা। আর সেইসব আই ডি বা পরিচয় পত্র সামলে রাখতে হিমসিম খাচ্ছেন। হারিয়ে গেলেই বঞ্চনা। সরকারি অফিসাররা হাত উল্টিয়ে দেবেন। মনে হবে, যেন হাত ওল্টানোর জন্যই বসে আছেন অফিসে। কিন্তু মজার বিষয় হলো ভোটের সময় ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য (সোজা করে বললে ভোটটা কোনমতে নেওয়ার জন্য) লম্বা একটা লিস্ট দেওয়া হয় বৈধ আই ডি কার্ড বা পরিচয় পত্রের। যাতে করে কেউ বাদ না পড়ে যায় ভোটদান থেকে।
            ভোটের সময় যেভাবে ভোট দানের জন্য সুযোগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়, ঠিক সেভাবেই সাধারণ মানুষকে দেওয়া বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করার জন্য সুযোগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় না কেন? প্রশ্নটা এখানেই। 
             আসলে সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের সমস্ত তথ্যই রয়েছে। তথাপি এইভাবে লাইনে দাঁড় করানোটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে তাদের। এবং সেই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না কোনভাবেই। না হলে এত আই ডি কার্ড বা পরিচয় পত্র বানানোর কোন অর্থ আছে কি বর্তমানে? একটা কার্ডের মধ্যে সমস্ত তথ্য রাখতে পারছে না কেন সরকার? তাহলে তো সরকারি প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা পেতে অসুবিধা হওয়ার কথাই নয় সাধারণ মানুষের। তাছাড়া এত এত কাগজ পত্র সামলে রাখার ঝামেলা থেকেও মুক্তি পাবেন।


উত্তম মাহাত, সম্পাদক
             



______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
দুর্গা দত্ত / কমলেন্দু সরকার / উমা মাহাতো / বিশ্বম্ভর নারায়ন দেব / সৌরভ লায়েক / বহ্নি শিখা / মধুপর্ণা / তপন পাত্র / দীপংকর রায় /
______________________________________________



দুর্গা দত্তর কবিতা

আখর : তিন


কার সঙ্গে কে যে বাঁধে ঘর
একচালা ঘর উড়িয়ে দিল ঝড়ে--
রইলো না আর নিঝুম বাতিদান,
কার সঙ্গে কে যে ডোবে রোজ !

কার সঙ্গে কে যে কী সুর সাধে
হাতের মুঠোয় অলীক দারুচিনি --
কে যে কোথায় লুকিয়ে রাখে ডানা
কার তীরে যে কার তরণী ভাসে !!

কেউ জানে না সমুদ্রনীল শাড়ি
কার হাতে ! কে বুনছে অবিরত !
রাতবিরেতে অবোধ তন্তুবায়
মাকু-র শব্দে ফুলকে ফোটায় রোজ ...



আখর : চার


অর্ধেক দেখেছি আর
বাকিটুকু আড়ালে রয়েছে।

আকাশ ছুঁলেও যেমন
নীলটুকু অধরাই থাকে
তোমাকে ছুঁয়েছি তেমনি জলে জলে 
গন্ধরাজ আকাশ কুসুমে --

অর্ধেক জীবন নিয়ে বেঁচে উঠি প্রতিদিন 
প্রতিটি সকালে

বাকিটা জীবন আমি খুঁজে যাই প্রতি রাতে 
হাতড়ে হাতড়ে
অন্ধ বাতিদানে





কি'বা যায় আসে

কমলেন্দু সরকার


সুগন্ধে নয়, সোঁদা গন্ধে রাত নামে দরজার বাইরে
মাঠ জুড়ে জ্যোৎস্নার ভরা কোটাল
ভূতেরা নামতে ভয় পায়
শরীরে শিকড় নেমেছে চক্রবৃদ্ধি সুদে
চাবির গোছা কেউ লুকিয়ে রেখেছে পুরনো পোশাকে।
শুশনিশাকে ভরে ওঠা খেত কুয়াশায় জমে
শরীরে কোনো উৎসব নেই
আলকাতরা মাখা রাত নির্জীব বুকের ভিতর।
নগ্নতার সংলাপ আগুনের পাশে বসে থাকে চুপচাপ।

কি'বা যায় আসে নদীর ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল শব্দে
খোলস পড়ে আছে রাতের গায়
বিষণ্ণতার অন্ধকারে মুঠো ভরা শোক থাক না
লোভী প্রেম ফোয়ারর নীচে পড়ে আছে, পড়ে থাক...







উমা মাহাতোর কবিতা

দূরত্ব

বরফে পচন ধরে না জানি।
এও জানি, আমাদের নরম শীতে-
কোনদিন বরফ জমবে না।

 দুই নক্ষত্রের মাঝে 
শুধুই কী কালো?



বাঁদনা

শাল-পিয়াল, মহুয়া ছাড়াও,কার্তিকের মাসে আর একটি চর আছে সুবর্ণরেখার।
আতবের চাল ভেঙে গুঁড়ি হয়,
সন্ধের কুয়াশা আর অন্ধকার জল,
আল্পনার উঠোন হয় শ্যামাঙ্গিনী রাতের অলঙ্কার। 
ফসল আমাদের অহংকার , আমরা উৎসব করি কৃতজ্ঞতার।



নাগরিক

সেতু তৈরি করেছি। 
বহুজন্মের পলিমাটির ঋণ শরীরে আমার।
জল না ছুঁয়ে নদীকে পেরোতে চাই বারবার।





যেতে যেতে

বিশ্বম্ভর নারায়ন দেব

আর কত নিদ্রা যাও তুমি 
সঙ্গমশেষে দুফাঁক হয়ে 
পড়ে আছে বিধ্বস্ত উরু
বাঁধের পাড়ে সুবাবুল গাছের পাতার ফাঁকে 
দুপদুপ করে জ্বলে রাতের জুনপুকি।

                 কোনোদিন মানুষের ছায়রা দেখে 
                  মানুষকে চিনতে চাইনি বলে 
                  রাতের মৃদু আলোয়
                  নিজের ছায়া দেখে নিজেই আঁতকে উঠি 
                  গায়ে বড় জাড় লাগে।

তবু অপেক্ষায় থাকি আমি 
কখন অক্ষরকে বসাবো এনে শাদাপাতায় 
আলাপ করবো নতুন শব্দের সাথে

                    অক্ষরের জন্য অপেক্ষা 
                    শব্দের জন্য অপেক্ষা 
                    বোধের জন্য অপেক্ষা।

ঘুঘি-ঝাড়া মাছের মতো 
শুকনা ডাঙ্গায় তড়পাতে থাকে বোধ 
বোধের ভেতর কত যে আগড়া-মথরা 
পাছুড়তে পাছুড়তে যাই।

                    প্রকৃত কবিতার দিকে যেতে যেতে 
                    টের পাই 
                    চাঁদের গা থেকে চুইয়ে পড়ছে চাপচাপ রক্ত।






সৌরভ লায়েকের কবিতা

১.
আমার কোনো অনন্ত নেই


অলকানন্দা জলে ভেসে গেল কার বুক 
সে খবর জানি , তবু নির্ভার হতে পারলাম কই

" কারো প্রতি কোনো দায় নেই " যদি বলি
তাহলে তা সমূহ মিথ্যে কথা 

যেহেতু
আমার কোনো অনন্ত নেই 

তাই , দায় - দয়া - দাক্ষিণ্য সব আছে 
ঠিক যেমন আছে মানুষের ছুঁতে চাওয়ার গিমিক

ফিরে আসি আস্তিন বিহীন খোয়াড়ে
'মুখে মনে এখনো সেই এক' মানুষের খোঁজে

পাই না তো খুঁজে , তাই নিজেকে হারাই
আরো ঢের দিন ভালোবাসবার পর ফিরে যাই

একটি জনমে কত শত মৃত্যু আমাদের 
কতজন তার এজীবনে ঠিকমতো টের পাই

আমি মরে গেলে বুকের বাঁ পকেটে খুঁজে দেখো 
আততায়ীর চিরকুটের লেখা আছে 'বোধ'

                                          

২.
ক্ষুধা পৃথিবী


অন্ধকমল দীঘল সরোবরে ভেসে আছে
দেখে মনে হল দশরথ পুত্রের উৎপাটিত চোখে
রাম রাজত্বের কথা কৃত্তিবাসের মিথের মতন 

ঠিক যেরকম আমি নিভে গেলে 
তুমি জলে উঠবে শোকতপ্ত প্রদীপের ন্যায়

এই রাষ্ট্র তোমাকে সেরকম আলো দেবে

হতবাক হয়ে নেই লাভ
যদি জানতে পারো , যদি জানতে চাও 
তাহলে এসো -


তোমার চোখের সামনে থেকে নাকাব টা সরিয়ে
ততক্ষণে আমি আমার মৃত্যুটি রচনা করি 



                                           
                                          
                                    
বহ্নি শিখা (ঊষা দত্ত)-র কবিতা


১.
সাজানো ইতিহাস


নাহ,আজও হয়নি। 

হয়নি কোনো কাজ কোন যোগাযোগ।  

মুহূর্তগুলো নীলাভ অন্ধকার,

দৃষ্টির ওপারে শুধুই শূন্যতা, 

খুঁজে পাবো না অরণ্য ঘেঁটে, 

শাল সেগুনের ঝরা পাতা-

সরিয়ে দেখা হবে না,

কালের বধ্যভূমির গভীর বিষাদ,

মিলিয়ে দেখা হবে না, 

কি করে এবেলা ওই বেলা হয়ে যায়।

অস্বস্তি গুলো কি করে সেজে ওঠে,

 স্বস্তির নির্মাল্য সাজানো ইতিহাসে । 



২.
অভ্যাস


ইচ্ছে গুলো কাস্তের মতো 
ধারালো হওয়া চাই,

কথা বলতে বলতে
জেগে উঠবে  প্রেম,

প্রশ্নপত্র পড়তে পড়তে পাশ, 
অভ্যাস উত্তর খুঁজে দেয়।






কথাবার্তা ৩

মধুপর্ণা

পিতৃতন্ত্র সফল এবং খুশি নারী অপছন্দ করে। তার কাছে খুব পছন্দের হয়ে ওঠে “ সাত চড়ে রা না কাড়া" নারী। কারণ সেখানে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীণ হবার সম্ভবনা নেই। ভঙ্গুর পুং অহং প্রশ্ন পছন্দ করে না। কারণ প্রশ্ন তার হীনমণ্যতাকে বিদ্ধ করে। বিকৃত পুং অহংয়ের যেহেতু কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই, পুরোটাই বস্তুত দাঁড়িয়ে আছে একটি ক্ষমতালিপ্সা এবং বাড়তি সুবিধাভোগের আকাঙ্ক্ষার উপর সেকারণে তার অন্তবর্তী শূন্যতা ঢাকার জন্য নির্মাণ করতে হয় উচ্চস্মৈণ্যতার বর্ম। যা আসলে তীব্র একটি হীনমন্যতার অনিবার্য বহিঃপ্রকাশ। এই ছদ্ম উচ্চস্মৈন্যতার পক্ষে প্রশ্ন সহ্য করতে পারা কঠিন। কারণ তা অন্তস্থ হীনমণ্যতাকে কান ধরে টেনে বের করে নিয়ে আসে। তখন পুং অহং আহত জন্তুর মত উচ্চস্মৈন্যতার আড়ালে নিজেকে ঢেকে আত্মরক্ষা করতে চায় এবং হয়ে ওঠে হিংস্র। তার কাছে আর কোনো উপায় কার্যত খোলা থাকে না। তাই সে নিজের চারদিকে অনুগত নারীর উপস্থিতি পছন্দ করে এবং তাতে নিরাপদ বোধ করে। পুং অহংয়ের এই করুণ পরিস্থতির জন্য তাকে নির্মাণ করতে হয় একটি স্বাচ্ছন্দ্যের পরম্পরা যাতে তার কোনোভাবেই বিদ্ধ হবার সম্ভবনা তৈরি না হয়। যে নারী ক্ষমতার দর্পের সঙ্গে সমঝোতার পাঠ গ্রহণ করে নি বা সুযোগ পায় নি এবং বিচিত্র ধরণের অসহায়তা, সমস্যায় জর্জরিত, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষের কাছে আবেদনময়ী হয়ে ওঠে। কারণ মানসচক্ষে পুরুষতন্ত্র তাদের অন্তর্বাহির স্ক্যান করে এই আশ্বাস পায় যে তার হীনমণ্যতার এখানে ঘা খাবার সম্ভবনা নেই বা তুলনামূলক কম। বরং নারীটিকে ক্রীড়নক হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। সেখানে পুরুষতন্ত্রে জারিত পুং আত্মার অনুরাগ আছড়ে পড়ে।

খুশি নারী এবং আত্মনিমগ্ন নারী আরোই অপছন্দের পুরুষতন্ত্রের কাছে। অপছন্দ শুধু নয়, এক্ষেত্রে তারা বস্তুত বোধ করে আতঙ্ক। এখানে তার ফাঁপিয়ে তোলা, পুরুষতান্ত্রিক ভণিতা ঘোর বিপদের সম্মুখীণ হয়। নারীটির খুশি তাকে নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করতে বাধা দেয়, বা ছদ্ম আত্মবিশ্বাসের বুদবুদের কাছাকাছি একটি ফুৎকারের উপস্থিতি সে টের পায়। যা তার অস্তিত্ত্ববোধকে করে তোলে সংকটের মুখোমুখি। তাই খুশি নারীটি তার কাছে থ্রেট। তার খুশি সে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় নিজের কাছে যতটুকু সহনযোগ্য এবং যতটুকু তাকে বিদ্ধ করার আয়োজন করবে না। যে নারী নিজের কাজে বিভোর থাকে এবং মূলত মানসিক ভাবে স্বনির্ভর, পুরুষের সাপেক্ষতায় নিজেকে প্রতিফলিত দেখার থেকে নিজের কাজের মধ্যে নিয়োজিত থাকে সেখানে পুরুষতান্ত্রিক মানসকাঠামো সব থেকে বড় ধাক্কাটা খায়। সেখানে তার সর্পিল গতিতে ক্ষমতা বিস্তারের সম্ভাবনা কম। তাই সেখানে সে নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। শিলা রোবথাম লিখেছিলেন নারী হল সর্বশেষ উপনিবেশ। যার ওপরে ক্ষমতা কায়েম করতে চায় পুরুষতন্ত্র। বিভিন্ন সমাজ বদল, বিপ্লবে বিশ্বাসী ইত্যাদি স্বঘোষিত সংস্কারকগণ এ বিষয়ে নিরাপদ নীরবতা বজায় রাখেন অথবা এক ধরনের “ধরি মাছ না ছুঁই পানি" পন্থা অবলম্বন করেন।

পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো মূলত মর্ষকামী। নারীর খুশি, আনন্দ তার কাছে পছন্দসই না। পুরুষটির খুশিতে মেয়েটি খুশি হবে, পুরুষের আনন্দে মেয়েটি হবে আনন্দিত। এই হচ্ছে প্রচলিত ছক। তার নিজের আনন্দ, খুশি থাকতে পারে এইটা খুবই অসহনীয় মনে হয়। মেয়েটির মধ্যে রয়েছে এমন একটি অঞ্চল যেখানে সে কোনো ভাবেই সম্পর্কিত নয়, তার কোনো প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ সেখানে খাটে না। বস্তুত সেখানে সে কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক নয় এই পরিস্থিতি পুং অহংকে করে তোলে বিদ্ধ। স্বনির্ভর এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ নারী যেখানে পুরুষের পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। সে কারণে সেই নারীরাই হয়ে ওঠে পিতৃতন্ত্রের আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু। অনধিকৃত অঞ্চল গুলিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার মরিয়া চেষ্টা করতে থাকে।

সাপেক্ষতা একটি মাইক্রো পলিটিক্স তৈরি করে। সফল, স্বয়ংসম্পূর্ণ নারীটি নিজের জীবন রচনা করে নিজে। নিজের ইচ্ছা, অনুভূতি, জীবনপ্রবাহ তথা রিসোর্স সবকিছুর ওপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকে। কোন দিক থেকে সে নির্ভরতা বা অবলম্বন হিসাবে পুরুষকে চায় না। পিতৃতন্ত্র মূলত সাপেক্ষতা তৈরি করতে চায় তার কারণ সাপেক্ষতা অপব্যবহার, শোষণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। নিদেনপক্ষে একটি পাওয়ার প্লে চালিয়ে যেতে পারলে বিভিন্ন ভাবে স্বনির্ভর নারীটিকে উত্যক্ত করা যায়, ক্ষতি করা যায়। এই আবর্ত গুলো চিনতে হবে নারীদের। হীণমণ্য ক্ষমতালিপ্স পুরুষদের ঈর্ষা যা মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে উৎপন্ন তার আঁচ থেকে বাঁচার জন্য নারীদের তৈরি করতে হবে নিরাপত্তা বলয়। এবং এই পিতৃতান্ত্রিক স্পর্ধাকে ধুলিস্যাৎ করার দৃঢ় মনোভঙ্গি নির্মাণ করতে হবে। শোষণ এবং অপব্যবহারের রকমফের গুলো স্পষ্ট ভাবে চিনতে হবে যাতে যে কোনো ধরনের অপব্যবহার এবং অনুপযুক্ত আচরণ মোহহীন ভাবে বরদাস্ত না করার ক্ষমতা তৈরি হয়। বিশেষত যে সমাজ গুলি অশিক্ষা আর ধর্মীয় গোঁড়ামির কালো গর্তে আকণ্ঠ ডুবে আছে,সেখানে পিতৃতান্ত্রিক কদর্য অনুশীলন এখনও নগ্ন ভাবে বিদ্যমান। পিতৃতান্ত্রিক অপব্যবহার আর শোষণের সূক্ষ্ম আয়োজন এবং তার দৈনন্দিন প্রতিফলনকে চিনে তার উপযুক্ত জবাব দেওয়া রপ্ত করতে পারলে নারীরা অনেকাংশে মানসিক মুক্তি লাভ করবে।







বাঁদনা, মানভূমের গো বন্দনা


                          তপন পাত্র


আমাদের দেশে ঠিক কবে গো-বন্দনা শুরু হয়েছিল, তা সঠিকভাবে বলা বড়ো মুশকিল , তবে একথা সত্য যে গরু পরম কল্যাণকারী বলেই মানুষ তাকে দেবতারূপে পূজা করতে শুরু করেছিল এবং আজও করছে । কৃষিজীবী সমাজের পক্ষে গো-জাতি বিশেষ উপযোগী বলেই তার ওপর দেবত্ব আরোপিত হয়েছে । পশ্চিম-সীমান্ত-বাংলায় কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথি গো-বন্দনার তিথি রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে । এই অমাবস্যার রাতে ধমসা-মাদল বাজিয়ে গান গেয়ে গোরুকে অভিনন্দন জানানো হয় । এই গানই "অহিরা গান" স্থানভেদে "আহিরা গান" আবার "বাঁধনা পরবের গান" নামেও পরিচিত । আর গো-বন্দনাকারীদের বলা হয় --"ধাঙ্য'ড়া" বা "ধাঙড় দল" অমাবস্যার রাতে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে গোয়াল এর কাছে গিয়ে তারা গান করে । এর জন্য পায় ---পয়সা , পিঠে , মুড়ি । এসকল নেহাতই প্রীতি-উপহার বা ভালোবাসার দান । মহুয়া মদের নেশায় হেলে দুলে সুর করে তারা সহজ সরল লৌকিক আটপৌরে ভাষায় মন মাতানো গান গেয়ে ওঠে প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিমায় । সে সমস্ত গানগুলির মধ্যে যে আর্থ-সামাজিক চিন্তাভাবনা , কৃষি ভাবনা এবং নিম্ন 
-মধ্যবিত্ত,নিম্নবিত্ত মানব সমাজের পারিবারিক জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে , নর-নারীর পারস্পরিক সম্পর্কের কথা, হৃদয়ানুভূতির মধু নির্যাস চিত্রিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্যে তা বিরল বললেও অত্যুক্তি হবে না ।

                       যারা কার্তিকের অমাবস্যা রাতে গ্রামের কুলি কুলি ঘুরে ঘু্রে, ঘরে ঘরে প্রবেশ করে সকল পরিবারের গোয়ালের কাছে গিয়ে গরু জাগানোর গীত গায়, তাদের বলা হয় "ধাঙড়" । মানভূম এলাকায় ব‍্যক্তি-নামকে অল্পস্বল্প বিকৃত করে উচ্চারণের রেওয়াজ রয়েছে । তাই "মধু" হয়ে যায় "মধা" , "শিশির" হয়ে যায় "শিশ্ রা"। সেই সূত্রে "ধাঙড়" হয়ে গেছে "ধা'ঙড়া"। মূলত "ধাঙড়িয়া" শব্দটি থেকে "ধাঙড়" শব্দটি এসেছে । শব্দটি নানা অর্থে ব্যবহৃত হয় । "ধাঙড়" মানে "দলপ্রধান" বা "দলপতি" , "জমাদার" , "ঝাড়ুদার" , "অত্যন্ত আপনজন" আবার "যে 'রিঁঝে' অর্থাৎ "নিতান্ত সহজ পুলকে পুলকিত হয়ে নেচে-গেয়ে ওঠে" তাকে বোঝাতেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে । এক্ষেত্রে প্রত্যেকটি অর্থের তাৎপর্যই সম্পর্কিত । 

                    আর একটি শব্দ "বাঁধনা" । "বন্দনা" থেকে "বাঁদনা", তা থেকে ঝাড়খন্ডী ভাষাতত্ত্বের নিরিখে অল্পপ্রাণ ধ্বনির মহাপ্রাণ ধ্বনিতে উচ্চারণ প্রবণতা থেকে "দ" হয়ে গেছে "ধ"; সঙ্গত কারণে "বাঁদনা" হয়ে গেছে "বাঁধনা"। কেউ কেউ বলেন "বন্ধন" থেকে "বাঁধনা" এসেছে, সে ক্ষেত্রে যুক্তি দেখিয়েছেন, গরু-মহিষ কে বেঁধে খুঁটানো হয় বলে সেই বন্ধন বা বাঁধা থেকে বাঁধনা । এই বাখ‍্যা ততখানি যুক্তিগ্রাহ্য নয় ।
                                                                             মানভূম- পুরুলিয়া-ঝাড়খণ্ডের লোকজীবনে মনসা পূজা, টুসু পরব আর কালীপূজা দেশের সর্বত্র প্রচলিত দুর্গাপূজাকে টেক্কা দেবার ক্ষমতা ধরে । আজ এই একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকেও পুরুলিয়ার নিতান্ত মফস্বল গৈ-গেরামে গেলে দুর্গাপূজার তেমন কোন উন্মাদনা নজরে আসে না । কিন্তু কালীপূজা পাড়ায় পাড়ায়, ঝোপেঝাড়ে বনে-বাদাড়ে , পাহাড় কোলে , টটক-কুমারী-কাঁসাই-সুবন্নখার তীরে তীরে অনুষ্ঠিত হয় । সকলে অনাবিল আনন্দধারায় অবগাহন করে, নানান রীতি-প্রথা পালন করে যে যার সাধ্যমতো । কালী পূজার দিনগুলি এতদঞ্চলে বাঁধনা পরব নামেই সমধিক প্রচলিত, যা প্রমাণ করে আধ্যাত্ম ভাবনার চেয়ে মানবপ্রেম ও সমাজ-লৌকিক বন্ধনের দিকটি-ই এখানে পাল্লাভারী । দেবতা এখানে মানুষ হয়ে পর্ণকুটিরে প্রবেশ করেছেন, আর আত্মীয়-স্বজন ,গরু-বাছুর হয়ে উঠেছে দেব দেবী, ভগবতী ।

                   বাঁধনা পরব সুবিস্তৃত ভূগোল সীমায় অনুষ্ঠিত হয় । বহু আদিবাসী , অনাদিবাসী , জাতি ও উপজাতির মানুষ এখানে বসবাস করেন । তাই অঞ্চল ভেদে এই উৎসব উদযাপনের ইতর বিশেষ লক্ষ্য করা যায় । তবে একথা সত্য যে বাঁধনা পরবের মূলগত ঐক‍্যটি নজরে আসে পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গের সমগ্র ভূগোল সীমায় ।


                 বাউরি, হাঁড়ি, ডোম মাহাত ,মুচি ,বাগাল, বাগদি, তেলি, তামলি, সূত্রধর থেকে শুরু করে পাত্র, মিত্র, ঘোষ, বৈদ্য, রজপুত, ব্রাহ্মণ ,ক্ষত্রিয় ইত্যাদি --- প্রায় সকল পরিবারেই বাঁধনা পরবের মূল ক্রিয়া-কর্মগুলি তিন দিন ধরে পালিত হয় । প্রথম দিন অর্থাৎ অমাবস্যায় কালী পূজার দিন কে বলে "জাগান" , পরেরদিন প্রতিপদের দিন "বাঁধনা" বা "চুমান" বা "গর'য়া" আর তৃতীয় দিন "খুঁটান" বা "বুঢ়ি বাঁধনা" ।

                       অশ্বিন সংক্রান্তির দিন অর্থাৎ জিহুড় দিনের পর পয়লা কার্তিক থেকেই হাতির পারা বাঁধনা পরবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় । বর্ষায় মাটির দেওয়াল যুক্ত খড়ের ঘর নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । সেই সমস্ত দেওয়াল ধারী, উঠোন গু'ছাটি মাটির প্রলেপ দিয়ে তার সৌন্দর্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলে । পুকুর থেকে ছাই রঙের পাঁক তুলে এনে দেওয়ালে লেপন করা হয় নিপুন হস্তে । নানারকম প্রাকৃতিক রং আর খড় পুড়িয়ে গোবরের সঙ্গে মিশিয়ে কালো রং তৈরি করে , খড়িমাটি, গিরিমাটি ,বিভিন্ন সবুজ পাতা, নীল বড়ি ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে সুচারু হস্তের নিপুন অঙ্গুলি রেখায় অঙ্কিত হয় দেওয়াল চিত্র । উৎসবের প্রথম দিন কালী পূজার রাতে মা লক্ষ্মীর আবাহন । লক্ষ্মীর আবাহনের ওপ্রান্তে রয়েছে অলক্ষ্মীকে বিতাড়ন । এই উপলক্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া-কলাপের প্রচলন রয়েছে । এদিন সন্ধ্যাকালে প্রায় সকল গ্রামেই ছেলেমেয়েরা "ইঁজোপিঁজো" করে । কয়েকটি পাটকাঠি নিয়ে কাঠির মাথায় বিভিন্ন লতা-পাতা ও শন দিয়ে মোটা করে বাঁধা হয় । সন্ধ্যাবেলায় তাতে আগুন জ্বালিয়ে অথবা তার দিয়ে তৈরি একটি অগ্নিবলয় নির্মাণ করে আগুন নিয়ে সুদৃশ্য খেলা চলে । এই আগুন নিয়ে খেলার সময় ছেলেমেয়েরা ছড়া কাটে ----
     
      (১) "ইঁজোরে পিঁজোরে ,
                   ধোরে মশারে ;
      আমদের পাড়ার মশাগুলা'ন            
            উয়াদে পাড়াক যা রে ।"

        (২) "ধা মশা ধা, 
                    যথা খুশি যা ।
                  মশা গেল বনকে 
                লক্ষ্মী আ'ল ঘরকে ।"

           (৩) " ধা মসা ধা ,
                 লক্ষ্মী আ'ল ঘরকে    
                   হাভাত রে তুই যা ।"
              
                     
          ইঁজোপিঁজোর ধা-মসা পর্ব শেষ হবার পর বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীরা গাঁয়ের বাইরে কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে পুরানো ভাঙা-চুরা কুলা-ডালা নিয়ে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় । সেই জ্বলন্ত আগুন তারা লাফ দিয়ে পার হয় আর ছড়া বলে --

           "দাইদা বুড়ি দাদ লে 
            খইশা বুড়ি খোশ লে"

           এই প্রথার মধ্য দিয়ে নানান চর্মরোগসহ অন্যান্য রোগ তাড়ানোর একটি সংস্কার পালিত হয় । এরপর তারা প্রথমে ফিরে আসে খামারে, তারপর গোবর কুড়ে এবং সবশেষে ঘরে । সর্বত্রই নিভে যাওয়া পাটকাঠিগুলির একটি করে নিয়ে মাটিতে , গোবরে প্রোথিত করে ।

                  একটু রাত গভীর হলেই গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে এসে ধাঙড়িয়ারা ভগবতী বন্দনা করে, গাই-গুরু জাগানিয়া গান ধরে, বেজে ওঠে ঢোল ,ধামসা, মাদল ,সানাই ।


                   এই দিন বাউরী সম্প্রদায়ের মানুষের একটি পবিত্র মধুর অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়, যার নাম "হাঁড়িকাড়া" । কী হয় এই হাঁড়ি কাড়ায় তা সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে কোন এক মানভূমবাসীর লেখা একটি কবিতায় । এখানে সম্পূর্ণ কবিতাটি তুলে ধরছি ---

    " আ'জ বাউরীর হাঁড়িকাড়া কাল বাউরীর বাঁধনা...
      বাঁধের সাদা পাঁক তুলে এনে ঘরের দেওয়াল ;
     দোআঁশ মাটি, গোবর দিয়ে মাটির উঠোন তকতকে করেছে ।   
     আতপ চালের গুঁড়িতে পা'নালতার রস মিশিয়ে উঠোন ভর্তি আলপনা ,
    মা লক্ষ্মীর পদচিহ্ন ।

    আজ হাঁড়িকাড়া

    পুরানো যতো মাটির হাঁড়ি-কুঁড়ি-খলা ফেলে দেওয়া ।
    নদী, জোড় , কিংবা পুকুর থেকে 
     মাথায় ক'রে নতুন হাঁড়িতে জল আসে ।
     গোবর দেওয়া মাটির উনুনে ভাত রান্না হয় ,ডাল ও বেসাতি ।    
    সাত পুরুষের উদ্দেশে ষোল পাতায় চাল সিজা ।
     ডাল ,তরকারি ,পান, খৈনি, বিড়ি, মাংস, মদ 
     সাজিয়ে দিয়ে আগুড় ঠেসিয়ে দেয় আশা ।
    
   বাইরে দাঁড়িয়ে সব চুপচাপ ।  
   ভিতরে পিদিম জ্বলে, ষোড়শ নৈবেদ্য 
    খেয়ে যায় সাত পুরুষের প্রেত।

       তারপর আত্মীয় বান্ধব সহ চেটেপুটে প্রসাদ খেয়ে হাঁড়ি কাড়া সাঙ্গ হয় ।
        সারাবছর ওই হাঁড়িতেই ভাত ,
    ওই খলাতেই সজনে শাগ সিঝা।

    রাত পোহালেই বাঁধনা পরব ।
    গাই-গরুর বিয়া আর জামাই উত্থানো ।
        
     আশা বউ ।
     মানে আশালতা বাউরী
     সন্ধ্যাবেলা দাঁড়িয়ে থাকবে   
     ভালোবাসার সাজিয়ে নিয়ে উত্থন থালায় ,
     ঘরের খুঁটায় বেঁধে দেবে ধানের মুকুট ,
      শোভা পাবে সর্ষে তেলের প্রদীপ দূর্বাঘাস আর এক মুষ্টি আলো ধান ।

আজ বাউরির হাঁড়িকাড়া , কা'লকে গরুর বিয়া।"

                      পরবের দ্বিতীয় দিন "বাঁধনা" বা "চুমান" বা "গর'য়া" । সকাল থেকে প্রতিটি পরিবারে সাজো সাজো রব । কুলি বা পথ থেকে আঙিনা দিয়ে গোয়াল পর্যন্ত আতপ চালের গুঁড়ির সঙ্গে পা'নালতার রস মিশিয়ে বিচিত্র আলপনা অংকনের পালা । গোধূলি বেলায় সেই আলপনার উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হবে লকলকে সবুজ ঘাস । সকাল থেকেই তো গাই গরু বাছুর কে যত্ন করে সাবান মাখিয়ে স্নান করানো হয়েছে । সিঙে ঘষে ঘষে মালিশ করা হয়েছে সরষের তেল । ধলা-শ‍্যামলা বর্ণের গাই-গরুর সারা গায়ে লাল, নীল আর কালো রঙের হ'লে তাদের গায়ে সাদা রংয়ের বিচিত্র অংকন , গোল গোল ছাপ-ছোপ । বিকেলের আগে মাঠে গিয়ে গাই-গরুদের চরিয়ে নিয়ে আসে রাখাল বালক অথবা বাড়ির মালিক সং , যখন গোধূলি বেলায় সেই আলপনার উপর দিয়ে সবুজ ঘাস চিবোতে চিবোতে তারা গোয়ালে প্রবেশ করবে তখন ঘরের মহিলারা কাঁসার থালায় হলুদজল, ধান,দূর্বা নিয়ে তাদের পায়ে ছিটিয়ে দেবে । তার আনন্দের সঙ্গে ধীরে ধীরে গিয়ে গোয়ালে পৌঁছাবে । রাত্রিবেলায় গৃহবধূরা নানান পূজার সামগ্রী আর প্রদীপ সহ ভালোবাসা সাজিয়ে নিয়ে উত্থন থালায় তাদের সম্মান জানাবে । গাই-গরুর বিয়ে দেবে । উলু ধ্বনি ও শঙ্খধ্বনিতে সারা ঘর-বাখুল আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠবে ।

        হঠাৎ করে কার্তিকের অমাবস্যা রাতে গরুদেব প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান জানানোর কেন এই ঘটা ? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে অবতারণা করতে হয় প্রাসঙ্গিক একটি লোকগল্পের ।

              " সে অনেক প্রাচীনকালের কথা , সেকালের একটি গাছপাথরেরও অস্তিত্ব নেই এখন । গরু-মোষ ইত্যাদি গৃহপালিত জন্তু একদিন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিল । মানুষের বড়ো অত্যাচার, শোষণ,পীড়ন , নির্যাতন ! তাই আমরা আর মানুষের উপকার করবো না । বিষয়টি তো অত্যন্ত কঠিন । এরা যদি মানুষের ঘরে পরিশ্রম না করে, তাহলে তো সৃষ্টি রসাতলে চলে যাবে !

                রসাতলের যাক আর জাহান্নামেই যাক, তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল আর মানুষের ঘরে খাটবে না । দিনরাত রোদে পুড়ে, জলে ভিজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটু ভালো খাবার দাবার পর্যন্ত পায় না । উপরন্তু ক্লান্ত , অবসন্ন, কঙ্কালসার দেহ নিয়ে লাঙ্গল , গাড়ি টানতে না পারলে উপর্যপুরি চাবুক মারে নিষ্ঠুর মানুষ । আর তাদের গৃহবধূদের কথা তো বলারই নয় । তাদের দুরবস্থার , মাতৃ হৃদয়ের যন্ত্রণার অন্ত নেই । বেঁধেছেঁদে সবটুকু দুধ দুয়ে নিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে । আর তাদের ছেলেমেয়েরা শুকিয়ে প‍্যাকাটি কাঠির মতো নীরস, ঠুনকো হয়ে যায় । তাই তারা এবার সকল কাজ ও সেবা বন্ধ করে সর্বাত্মক ধর্মঘটে সামিল ।

              খবরটা নারদের মধ্যস্থতায় দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে গিয়ে পৌঁছালো । একে একে সকল গরুবাছুর মহাদেবের দরবারে গিয়ে একই নালিশ জানালো । দেবাদিদেব মাথা ঠাণ্ডা রেখে তাদের বোঝালেন , এতো অল্পে অস্থির হলে তো চলবে না বাবা , তোমরা শান্ত হয়ে আপাতত কাজে যোগ দাও । আমি সরজমিনে তদন্ত করে যথোপযুক্ত ব‍্যবস্থা নেবো । আগে নিজের চোখে না দেখলে শুধুমাত্র তোমাদের কথা শুনেই মানুষকে অপরাধী বলে শাস্তি প্রদান করা তো আমার ঠিক হবে না । এ তো কখনো দেবতার কাজ নয় । 

                    কথাটির যুক্তি আছে বুঝে তারা পুনরায় কাজে যোগদান করে । দিন যায়--- রাত যায় --- অবশেষে একদিন এগিয়ে এলো কার্তিক মাসের ঘোর অন্ধকার অমাবস্যার রাত্রি । 

                       গভীর রাতের অন্ধকারে বৃষবাহন পশুপতি তাঁর ষাঁড়ে চেপে মর্ত‍্যে অবতীর্ণ হলেন । এসে যা দেখলেন তাতে তো তিনি গরু-মোষের প্রতি বিব্রত হলেন, বি
বেজায় ক্রুদ্ধ হলেন । কারণ কারো না কারো মাধ্যমে মানুষ খবর পেয়ে গেছে যে, এই দিন রাত্রিবেলা মহাদেব আসবেন গরু বাছুরদের অবস্থা পর্যবেক্ষণে । আর মানুষ তো বড় ধুরন্ধর প্রাণী । দুষ্টু বুদ্ধিতে স্বর্গ-মর্ত‍্য-পাতালের কেউ-ই তার সমতুল্য নয় । তাই তারা আগের থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দেয় । ঝকঝকে উঠান, তকতকে গোয়াল , চকচকে তাদের শরীরে নানা বর্ণের সুদৃশ্য অলংকরণ, সিং দু'টি সরষে তেলের ঘর্ষণে ঘৃৎ প্রদীপের আলোর ছটায় জ্বলজ্বল করছে । কপালে সুশোভিত ধানের মুকুট, সিঁদুরছর বিন্দু । তাদের উদরপূর্তির জন্য ছানি, খোল, ঘাসের ছড়াছড়ি , দনে সুমিষ্ট চুবি ।


                   মহাদেব এসে যা দেখলেন , তাতে তিনি অকৃতজ্ঞ প্রাণীগুলির উপর বেজায় চটে গেলেন । তাঁর মাথার সর্প পর্যন্ত পশুপতির ক্রোধের কারণে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো । মাথার জটা খাড়া হয়ে গেল । তিনি ওই পশুদের অভিশাপ দিলেন, "যা বাছা ,তোরা চিরকাল পরের ঘরেই খেটে মরবি" আর মানুষকে আশীর্বাদ জানালেন , "তোমাদের লক্ষ্মী লাভ হোক । তোমরা পাঁচপুতা দশ ধেনু গাই নিয়ে সুখে ঘরকন্না করো ।" 

                     সেই সে কাল থেকেই গো বন্দনা চলে আসছে কার্তিক অমানিশার অন্ধকারে । এদিক থেকে এক বিচারে এই উৎসব মানুষের কূটনীতির বিজয় স্মৃতি । তবে ধীরে ধীরে মানুষের এই কূটনীতির বিজয় পর্ব প্রাণীকুলের প্রতি কৃতজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে । শুধু গরু-মোষ নয় , মানভূমের মানুষ সকল কৃষি যন্ত্রপাতি যথা ---লাঙ্গল, মই, জোঁয়াল, গাঁইতি, কোদাল, শাবল, এছাড়া ঘরের খুঁটি, দরজা-জানালা গো-গাড়ি সমস্ত কিছুর প্রতিই কৃতজ্ঞতা জানায়, বন্দনা করে, পূজা করে ধানের মোড় পরিয়ে ।

                 পরবের তৃতীয় দিন -- খুঁটানো । মানে গরু খুঁটা , কাড়া খুঁটা । সে এক অদ্ভুত উন্মাদনা । নিজের চোখে না দেখলে কিছুতেই বোঝা যায় না পশু ও মানুষের আনন্দ মিলন মেলায় কোন্ উদার অভ্যুদয় ঘটতে পারে । এই দিনই আবার ভাইফোঁটা । ভাইকে ফোঁটা দিয়ে ফোটার সময় বোনেদের হৃদয় নিঙড়ানো উচ্চারণ ---

        "ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
       যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা ।   
       যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা
       আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা ।"

               অঞ্চল ভেদে, স্থান ভেদে পাঁচ দিন ধরে উৎসব চলে এবং সমগ্র মানভূমের নানা প্রান্তে বিভিন্ন দিনে নানারকম টুকরো টুকরো সংস্কার, রীতি -প্রথার প্রচলন রয়েছে ; যেগুলির এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের কোন মিল নেই । সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই তিথিতে উৎসবের আনন্দঘন উদ্বেলতা পরিলক্ষিত হয় । তাদের উৎসব "সহরায়" বা "সঁহরই" বা "সহরাই" নামে পরিচিত । তাঁদের তো বারো মাসে তেরো আনন্দ-বিনোদন লেগেই আছে । তবুও তাঁরা নিজেরাই স্বীকার করেন এই সহরায় তাঁদের "হাতির লেকিন পরব" অর্থাৎ সবচেয়ে বড়ো পরব । সহরায় শব্দটির অর্থ প্রশংসা বা প্রশস্তি । এখানে ভগবতীর প্রশংসা । দৈনন্দিন জীবনে গাই গরুর অতুলনীয়, অনুপম অবদান । সেই কারণে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উৎসব । পাঁচদিন ব্যাপী চলে এই আনন্দধারা । পাঁচ দিনের জন্য কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীরা খুঁজে পায় বাধা বন্ধনহীন মুক্ত প্রাণের উল্লাস । 

                  প্রথম দিন "উম" । এটি ঘরদোর উঠান প্রাচীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সংস্কার করার দিন । দ্বিতীয় দিন-"বঙা বুরু" বা "বঙা-মাহা"। এদিন মূলত পূজা-অর্চনা । তবে কম-ঝম নাচ-গানও হয় । সারারাত চলে ভগবতীর বন্দনার গান । তৃতীয় দিন "খুন্টাও মাহা"। এ দিন খুঁটিতে বেঁধে গরু কাড়া খুটানো হয় । চতুর্থ দিন "জালে মাহা"। দিনটিকে "খুন্টি তোৎ"ও বলা হয় । আগের দিন যে খুঁটিতে বেঁধে বলদ মোষকে খুঁটানো হয়েছে , সেই খুঁটি উৎপাটনের দিন এটি । পঞ্চম দিন অর্থাৎ উৎসবের অন্তিম দিনটির নাম "গাদয় মাহা"। এটি সর্বত্র উদযাপিত হয় না । কোন কোন এলাকায় পালিত হয় । এদিন শুধু যুবক-যুবতীরাই নয় , বুড়ো-বুড়িরাও একত্রে বাড়িতে বাড়িতে হাস্যকৌতুকে মেতে ওঠেন।
   
                  উৎসব ফুরিয়ে গেলেও মানভূমের আকাশে বাতাসে তখনও আনন্দের রেশ , কান পাতলে তখনও শোনা যায় পৃথিবীর এক ব্যতিক্রম কাব্য সুষমামণ্ডিত সরস সংগীতের অনুরণন ----

    " জাগো মা লক্ষ্মীনি, জাগো মা ভগবতী 
    আজি ত আমাবস‍্যার রাতিরে  
   (আর )জাগেকা প্রতিফল দিবে গো মহাদেবে
     পাঁচপুতায় দশ ধেনু গাই রে---"

সমস্ত পরিবারের পিতা-মাতার অন্তরে অন্তরে ধ্বনিত হয় ঈশ্বরী পাটনীর শাশ্বত প্রার্থনা ---"আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে"।




________________________________________________

ঔপন্যাসিক দীপংকর রায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস---
"জলশ্যাওলার বিরহকথা" --- এবার ষষ্ঠ পর্ব
________________________________

জলশ্যাওলার বিরহকথা

দীপংকর রায়

          এই সব নিয়ে সাথিকেও কম অশান্তি পোহাতে হয়নি। কারণ তার দুর্বলতার জায়গাটা হয়তো সেও ঠিক মতো বুঝতো না। কারণে অকারণে সে যে ভাষায় এই সংশোধন চাইত সে কথা কেউই কারোর সঙ্গে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছবার মতো মন তৈরি করতে পারতো না। পথিকের ধারণা তার একান্ত মনের কথাটা এরা কেউই বুঝছে না। সাথির ধারণা তার দায় মিটবে কিসে! অথচ কেউ তাকিয়ে দেখতে চায় না, কাকা এলে সেই আনন্দ পায় বেশি। ভরসা পায়। সে চলে গেলে তার মনখারাপ হয় । 

         এই নিয়ে সাথির ঠাকুমাও যথেষ্ট অশান্তি নিয়ে চলে গেলেন। শেষ বার পথিকের সঙ্গে দেখা হলে বড় ভরসা করে তিনি বলেছিলেন, তুই থাকলি ভাই, তুইই দেখিস ওকে। ওর জন্য তো কিছুই করে যেতে পারলাম না! 
        বৃদ্ধার অন্তিম কালের এই কথা আজও তার কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়। 

        দরজা খুলে যায়। গুনগুন করতে করতে ঊর্মি, ছোটো শ্যালকের স্ত্রী আসে । কি যে সে গান! কি যে তার সুর! এবং কি যে কথা, তা এ ক'দিনেও সে বুঝল না ! এসেই দুই কাঁধে দুই হাত। মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে, এই যে, কখন এলেন? আরও পড়ুন





                       আমাদের বই








এই সংস্করণের ছবি পেতে সহায়তা করেছেন আলোকচিত্র শিল্পী শুভাশিস গুহ নিয়োগী মহাশয়। ওঁর কাছে আমরা বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ।



সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের ছবি : আন্তর্জাল
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪