দ্বিতীয় বর্ষ ।। সপ্তদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ১৯ অগ্ৰহায়ণ ১৪২৮ ।। ৬ ডিসেম্বর ২০২১
কোনো দেশের উন্নয়নের পিছনে সেই দেশে বসবাসকারী নাগরিকদের একটা অভূতপূর্ব ভূমিকা থাকে। কোনো দেশের নাগরিকরা যত বেশি সচেতন এবং চিন্তাশীল হয়ে থাকেন সেই দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিয়ম নীতি তত সুচারুভাবে নির্মিত হয় এবং তত সুন্দর একটা অনুশাসন গড়ে ওঠে। যার ফলে সেই দেশ উন্নয়নের দিকে সুন্দর ও সাবলীল ভাবে এগিয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে আমাদের ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থা খাতায় কলমে উচ্চ শতাংশে দেখানো হলেও তার বাস্তব পরিস্থিতি কি, তা যে কোনো রাজ্যের গ্ৰামাঞ্চলে এমনকি শহরতলিতে গেলেও টের পাওয়া যায়।
বিশেষ করে পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহের অবস্থা তো আরও করুন। আর এই অবস্থাকে আরও করুন করে তোলার জন্য একটা নোংরা রাজনীতি সব সময় ক্রিয়াশীল। এই রাজ্যসমূহের জনগণকে শিক্ষার আলো থেকে দূরে সরিয়ে রেখে, কি করে খাইয়ে বশ করিয়ে রাখা যায় সেই চিন্তায় মগ্ন এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো। আর এখানকার অচেতন জনগণ তাদের সেই টোপ গিলে গিলে নিজেদের নায্য অধিকারগুলো আদায়ের পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। যার ফলে নিজেদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হওয়ার পরিবর্তে আরও স্তিমিত হয়ে উঠছে।
এইভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এইসব রাজ্যগুলো দেশের অন্যান্য রাজ্যসমূহ থেকে এতটাই পিছনে পড়ে যাবে যে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলবে। তখন এইসব অঞ্চলের মানুষদের পর-নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকাটাই একমাত্র ভবিতব্য হয়ে উঠবে। অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবন যাপনের জন্য অপরিহার্য দু'মুঠো অন্নের জন্য চেয়ে থাকতে হবে সরকারের উপর আর সামান্য কাজের জন্য ছুটে যেতে হবে দূর দূরান্তরের রাজ্যে।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
এই সংস্করণে যাঁরা লিখছেন
______________________________________________
নির্মল হালদার / তন্ময় সরকার / উৎপল চট্টোপাধ্যায় / হাবিবুর রহমান এনার / সুপ্রিয় দেওঘোরিয়া / কল্পোত্তম / সন্দীপ মুখোপাধ্যায় / শ্যামাপদ মাহাত বাঁশি / সৌরভ লায়েক / মধুপর্ণা / তপন পাত্র / দীপংকর রায়
______________________________________________
পাহাড়তলির মাঠ
নির্মল হালদার
১.
প্রদীপ জ্বলছে।
হাওয়া এলে, কেঁপে কেঁপে ওঠে।
প্রদীপ জ্বলছে।
হাওয়া এলে, কেঁপে কেঁপে ওঠে,
প্রদীপ শিখার মায়া।
২.
গাছের গায়ে হেলে পড়েছে গাছ
গাছ জানে না, কে কেঁদ কে পিয়াল
নদীর গায়ে হেলে পড়েছে নদী
নদী জানে না, কে কাঁসাই কে শিলাই।
গাছের গায়ে হেলে পড়েছে গাছ
গাছ জানেনা,কে প্রেম কে পরিণয়।
নদীর গায়ে হেলে পড়েছে নদী
নদী জানেনা, কে প্রেম কে পরিণয়।
৩.
ধানের আঁটি বাঁধছো
কে গো তুমি,আমাকেও বাঁধছো?
কে গো তুমি,আমাকেও বাঁধছো?
বন্ধনে মুক্তি আছে জানি
আমারও মুক্তি আছে জানি
কে গো তুমি, সকল ব্যথা বাঁধছো?
বন্ধু এনে দাও
তন্ময় সরকার
আমায় বন্ধু এনে দাও
জীবনের অর্ধেক পার করে
কিশোরবেলার সব স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছি -
সেও অনেকদিন হয়ে গেলো।
যে মেয়েটিকে চেয়েছিলাম,
যেসমস্ত মেয়েদের চেয়েছিলাম,
তাদের নিঃশ্বাসের গন্ধ পেয়েছি সবার।
বিশ্বাস করো
সব গন্ধ একই রকম লাগে।
সবার নিঃশ্বাসে ঠিক একই গন্ধ পেয়েছি ।
ফেরোমেন...
অথবা সেই গন্ধ আমার মাথায় কোনো চোরাকুঠুরিতে বাসা বেঁধে আছে ।
জানিনা ঠিক।
খুব যে ব্যাথ্যা পেতে চাই তেমনও নয়।
আমি কি বৈজ্ঞানিক হবো এসব জেনে ?
এই জ্ঞানে আমার কী প্রয়োজন ?
এসব আমার ভালো লাগছে না আর।
আমায় বন্ধু এনে দাও।
গল্প করি!
যা মনে চায় তাই বলি !
মন খুলে দিই তার কাছে !
জড়তাহীন…….
উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
১.
সঞ্চয়
অসম্ভবের দূরত্ব থেকে স্থির আমি
সম্ভবের নৈকট্যে এসে কেবলই তোমার বিচরণ লক্ষ্য করি
অহেতুক আমার ভ্রান্ত কল্পনা জুড়ে ছায়া পড়ে
নিঃস্ব নির্জনের একমুঠো মেঘছায়া
খড়কুটো উড়ে গেলে আমার শূন্য উঠোনে ঝড় থামে
থামে রাত, সুদীর্ঘ অপেক্ষার
এ যেন কোনো পবিত্র শ্বেতবিন্দু.....নিরাকার
আমি দেহে বিলীন কোনো এক পার্থিব সৃজন
তুমি সাক্ষাত বসুধা...... তোমার মাটিরঙ
এরপর সমানে সমানে জড়ো করি আমাদের সঞ্চয়
একে একে দুর্বার
জড়ো করি দিন রাত আর হাতে গোনা সব অশান্ত প্রহর
তোমার সন্ধিক্ষণের মাটি
তোমার ভরা যৌবন
আমার নীল শরীরে লেলিহান আগুনের সর্পিল শিখা
আরো আরো জড়ো হতে থাকে
শত শত ক্ষুধার্ত জীবন
অসম্ভবের দূরত্ব থেকে স্থীর আমি
মৃত্যু সঞ্চয়ে তোমার থেকে একটু একটু করে বড় হতে থাকি
২.
এমন অস্বস্তির বিকেলে
সভ্যতার পিছলানো পায়ে মাটি
আগুনের শব আঁকা বিষাক্ত রোদ্দুর লেগে থাক
সিক্ত চোখের দেয়ালে
নিয়মের আগল ভেঙে নগ্ন শিশুটির
মুখের হাসি অত্যন্ত ফ্যাকাশে
কেমন যেন অস্বস্তির বিকেল
রোদ পোড়া পথিকের চলার ছন্দে
সত্যের আঁচ
আমি চোখ ফেলে তুলে আনি মেঘ
একটু ছায়ার জন্য
আমার ঘুমচোখে প্রজাপতি ঋণ
আলো শুধু আলোর হতাশায়
এখন পার্থিব যত সূত্র
তবুও কেও যেন নিভন্ত সূর্যের গায়ে
কাদা ছিটিয়ে প্রমাণ করছে ব্রহ্মাণ্ডের
কাঙ্খিত সৌরবয়স
হাবিবুর রহমান এনারের কবিতা
১.
বেঁচে আছি দুঃসহ জীবন স্কন্ধে
স্থিরচিত্তে আমি দু'চোখ নিবিষ্ট করি রূপালি চাঁদে।
শরৎ-হাওয়ায় প্রষ্ফুটিত হয় আর ভাসে... প্রশান্তির
পুষ্প-সুবাস। দ্রুত রাতের নীল আকাশ ভেদ করে
সূর্যোদয় হবে। নবীনালোর ঝলকানিতে পালাবে
নক্ষত্র রাশিরাশি।
নির্মম বদ্বীপে বেঁচে আছি দুঃসহ জীবন স্কন্ধে...
ব্যথার বোঝা বয়ে বয়ে!
এহেনো দুর্দিনে আজ-- কার কাছে কী যাচনা করি?
বলো ও নিয়তি--শাপ দিয়ে আমি কী প্রার্থনা করি?
যার প্রেক্ষিতে স্বস্তি আসবে... বেদনা ক্লিষ্ট প্রাণে!
২.
আতরমাখা
যাপন কালের দেহজুড়ে জ্যোতি-আঁধারের খেলা চলে--
যেমন খেলা চলে দ্বিধা দ্বন্দ্বের-- আঁচিলের অন্তরালে...
স্মরণ-বাতায়নের আচ্ছাদনটা সরিয়ে দিয়ে, কেউ একজন
যেনো কানে কানে বলে যায়-- আজও হারায়নি বা হারিয়ে
যায়নি, সেইসব আতরমাখা যাপিত যত দিনগুলি ; দেখো--
নদীর স্বরলিপিও কেমন সুখ ছড়ায়--- জীবন-যৌবনে!
যুগান্তরের বিষন্নময় স্মরণের সব সৌন্দর্য--মিলিয়ে যায়---
শিউলি ঝরা ভোরের বাতাসের গহ্বরে; আবার ভরা পূর্ণিমায়
দেহজুড়ে মেখে নেয় জোছনা অলৌকিক!
সুপ্রিয় দেওঘোরিয়ার কবিতা
অপত্য
২৭.
ছোট ছোট কথার ভিতরে যাই
কথার ভিতরে হাঁটি অনেক দূর।
কথার ভিতরে খেলা করে আমার শৈশব
পাতি হাঁসের পুকুর, মাছের ডোবা,
ঘাটের পাথর, তাতে শুয়ে থাকা গাছের গুড়ি।
বেমালুম ভুলে যাই সেসব কবেকার কথা,
সেসব দূর অস্ত।
কথাগুলো তবু নিয়ে যায়,
কথাগুলো আমার অনেক পরিচিত
আরেক জীবনের পরিচিতি,
ফিরে আসে বার বার,
আমি কথার ভিতরে হেঁটে চলি ক্রমাগত।
২৮.
'ড 'এ শূন্য 'ড়' -র বদলে এক ল আসে,
আর ত গুলো মিশে যায় একেবারে,
বাক্যে কোনো মিল নেই, কোনো সংগতি নেই,
শুধু মজাদার শব্দগুলি নেচে নেচে বেড়ায়,
দ্রুত পা'গুলির মতোই!
আমি শব্দগুলিকে বন্দি করে ফেলি
স্মৃতিঘরে আলোকিত উঠোনে।
দেখি আমার সেই ঘরের আঙিনায়
একটা 'ল' একটা 'ত' নীল লাল ছোটো ছোটো
আলোর মতো ঝিকমিক জ্বলছে আর নিভছে।
ওম
কল্পোত্তম
যার কাপড় নেই
তার পাথর আড়াল
কিসের জাড়, কিসের জাড় ?
দু'হাত মুঠো করে বসে আছি
গুটিসুটি মেরে গাছতলায়।
ওম দরকার
শরীরে, মনে ওম দরকার।
বাতাস বয়ে যাচ্ছে যাক
হিম পড়ছে পড়ুক চরাচরময়
আমার ওম দরকার
ওম যদি দিতে না পারো
দিয়ে দাও পাথর আড়াল।
সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
১.
আকাশ
প্রতিদিন একটু একটু করে
এগিয়ে যাওয়া
প্রতিদিন দিন -যাপন
প্রতিদিন সূর্য ওঠা
ঝলমলে আকাশ
আকাশ... নীল আকাশ
মিশে আছে কত রঙ্
আমিও কি মিশেছি তাতে
আমিও কি ভেসেছি তাতে
মহাভাসমান মহাবিশ্বরথে!
২.
পাখি
ঐ যে দেখা যাচ্ছে
আলো আঁধারী ছায়া
আলো - আঁধারী ছায়ায়
ভেসে যাচ্ছে একটি পাখি !
কে ! কে তুমি !
তোমাকে ধরতে ধরতে
কত যুগ বসে আছি
তোমাকে ধরতে ধরতে
এক জীবন যথেষ্ট নয়
এক অন্য জীবন
জন্মান্তর !
৩.
মাটি
বাগানবাড়ির বেলগাছটি
কেমন যেন ঝুঁকে আছে
বেলপাতাগুলি যেন
মাটি স্পর্শ করতে চায়
মাটি...
মাটি তো মা
মা এর স্পর্শ পেতে
বসে আছে
বহু যুগ ধরে!
আমরাও
মাটির টানে
শিকড়ের টানে
বহুযুগ ধরে
বসে আছি
বিল্ববৃক্ষতলে !
ধামসাদার
শ্যামাপদ মাহাত বাঁশি
সাধুদাদা আর কাশীনাথ দুই বন্ধু
এরা কোনো বিদ্যালয়ের সহপাঠী নয়,
এদের পাঠ ওস্তাদের কাছে।
দুজনেই ধামসা বাজায়, ছো-নাচের আখড়ায়।
তালে তালে ভাব জমে,আখড়া জমে।
ওস্তাদ যেমন সুর ঘুরাবেক
সেই তালেই খাড়ি ফেলতে হয়।
তবে ত নাচ হবেক।
নাচের ওস্তাদ আছে
তাদের সুরেই ..
পাবলিকের পা নাচে
পেটও নাচে।
আসরের বায়না যত কম,
পেটের বায়না তত বেশি।
আজ দুটো পেটচামড়ায় সমান দবড়
দবড়ে দবড়ে কাঠি পড়ে ।
সৌরভ লায়েকের কবিতা
১.
হে সান্নিধ্য
হে সান্নিধ্য -
সেই সন্ধে গুলির কথা নির্ভুল ভাবে ভুলে গেলে
অবিশ্বাসের আতর মেখে নির্দয় হতে পারো
কৌপিন বিহীন সাধকের প্রতি
তোমার মর্ম বেদনা লুকিয়ে দিও গুপ্ত মন্ত্র বলে
কাল যে মরে গিয়েছিল একবার
আজ সে আবার বেঁচে ফিরিয়াছে
নতুন বৃষ্টির পর নবস্নানে নবজলে মাছেরা যেমন
ছুটে যায় , উঠে যায় আধারের ধার হতে
ভালোবাসা তেমনি কুহক , নিজেকেই চেনো
এসো পাশাপাশি বসি , অনেক হয়েছে মান-অভিমান
শেষবারের মতো মরিবার আগে অন্তত একবার
অন্তত একবার বেঁচে যাই বাঁচার মতন ।
২.
প্রদীপের নিচে
মানুষের কাছে হাঁটু মুড়ে বসলেই
একদিন তারা দূরে চলে যায় সুদেষ্ণা
এটুকু বুঝেছি এতোদিনে
সুদে - মূলে
ক্ষণিকের আবেগ থেকে ফিরে এসে
বিপন্ন হৃদয়ে দেখি
বাস্তব হাততালি দিচ্ছে বৃহন্নলার মতো
সাত সূর্যের আলো গায়ে মেখেও অন্তরে
যেন কৃষ্ণগহ্বরের অন্ধকার
যে কথা আলোও জানবেনা কোনোদিন
যে কথা জানবেনা তুমিও
ইতু ব্রত
তপন পাত্র
মানভূম-পুরুলিয়ার বহিরাবরণের অন্তরালে আনন্দ বিজড়িত অফুরন্ত প্রাণশক্তি ফল্গুনদীর মতো সতত প্রবহমান । দারিদ্র তার পোশাকে , চেহারায় অন্তরে লোকসংস্কৃতির বনমালা । এই ব্রহ্ম-ধূসর ভূগোলসীমায় প্রাণশক্তির সুন্দর ও স্বতঃস্ফুর্ত বহিঃপ্রকাশ এর বিভিন্ন উৎসব , পা'লপরব , মেলা ও গাজনগুলি । স্বতোৎসারিত প্রাচীন পূজা পার্বণগুলির বেশির ভাগেরই মূল কথা উৎপাদনের জন্য আরাধনা , সন্তান-সন্ততিদের দুধে ভাতে রাখার মনোবাসনা । তাই যেমন ভাদু , টুসু , জাওয়া , জিতা , করম , বাঁদনা , ইঁদ্ , ছাতা আর চড়ক তেমনি ইতুও ।
পুরুলিয়ার বিভিন্ন জাতির অনেক পরিবারেই সারা অঘ্রাণ মাস জুড়ে চলে এই ইতু পূজা । তবে অন্যান্য পালা-পার্বণগুলিতে তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের অগ্রাধিকার , ইতুর বেলায় উচ্চবর্ণের প্রাধান্য ।
কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন ইতু পূজার শুভারম্ভ । স্থানীয় মানুষজন বলেন "ইতি" বা "ইরতি" । এটি সম্পূর্ণরূপেই গৃহস্থ মেয়ে ও বধূদের ব্রত , এয়োতিদের ব্রত । পণ্ডিতেরা বলেছেন, "নারীব্রত" । কুমারী মেয়েরা এবং এয়োতিরা সৌভাগ্য কামনায় এই ব্রত পালন করে । কুমারীদের প্রার্থনা ---ভালো বর । আর এয়োতিদের প্রার্থনা সন্তান ও সমৃদ্ধি ।
পূজার সূচনার দিন সৌভাগ্য কামনায় ঘট প্রতিস্থাপন করা হয় । মেয়েদের বিশ্বাস ইতুলক্ষ্মীর পূজা করলে অর্থের অভাব দূর হয় । গৃহস্থের কল্যাণ হয় । সৌভাগ্যের উদয় হয় । বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই পূজার প্রচলন ।
এখন প্রশ্ন হলো এই ইতু পূজা কী ? কী , কী প্রয়োজন এই পূজায় এবং কীভাবে হয় এই পূজা ?
ইতু পূজা হল সূর্য পূজা , আবার লক্ষ্মী পূজাও বটে । সূর্যের অন্য নাম মিত্র । এই "মিত্র" থেকে এসেছে "মিতু" , "মিতু" থেকে "ইতু" । মূলত বৈদিক দেবতা বা দেবী এই মিত্র বা ইতু ।
অঘ্রাণ মাসের সূর্যের নাম "মিত্র" বা "রবি" । এই কারণে অঘ্রাণ মাসেই রবিবার গুলোতে ইতুর পূজা হয় । প্রাচীনকালে পারস্য দেশেও একসময় ইতু পূজা হ'ত । তখনই কুমারীরা পতিলাভের আশায় আর বিবাহিতারা সাংসারিক মঙ্গল কামনায় সূর্য পূজা করত । পরবর্তীকালে শাক্তধর্মের প্রভাবে "ইতু" ক্রমশ দেবতা থেকে দেবী -তে পরিণত হন । "মিত্র" সূর্য দেবতা , "ইতু" শস্য দেবী । এই কারণে ইতু পূজা মানে লক্ষ্মী পূজা । করম-জাওয়ার সঙ্গে এর আন্তরিক মিল ।
ইতু পূজার জন্য প্রয়োজন মাটির সরা , ছোট মঙ্গলঘট , ধান , হলুদ , কচু গাছ , মান গাছ , মটর , সর্ষে , কলমি লতা , শুশনি শাক , ফুল , দূর্বা , বেলপাতা , তিল , হরিতকী , ধূপ , নৈবেদ্য , কুল , আতপ চাল , কলাই ভাজা , পঞ্চ শস্য , ধানের শীষ , আম ডাল , গুঁজা ও তিসির গাছ বা ফুল ইত্যাদি ।
কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন জলাশয় থেকে পাঁক তুলে এনে একটি মাটির সরাতে সেই পাঁক রাখা হয় । কেউ কেউ অবশ্য পাঁকের বদলে গোবর মাটি রাখেন । সরাটি ও মঙ্গল ঘটটি লাল ও সাদা রংয়ের কালি বা রং দিয়ে সাজানো হয় । ফুল আঁকা হয় , আলপনার মতো ছবি আঁকা হয় । সাধারণত ঘটটিতে পাঁক ও জল দিয়ে একটি পঞ্চপত্র যুক্ত আমডাল রাখা হয় । তার সাথে স্থাপন করা হয় কলমীলতা , শুশনি শাক , ধান গাছ , গুঁজা ও তিসি গাছ ইত্যাদি ।
ঘটের ভিতরে রাখা হয় একটি হরিতকী । আর সরার ভিতর গোবর মাটি অর্থাৎ উর্বর মাটি রাখা হয় , তাতে গম , ছোলা , ধান , মটর , তিল , তিসি , গুঁজা প্রভৃতি শস্যবীজ ও তৈলবীজ ব্যপন করা হয় । সরা ও ঘটের গায়ে তেল , সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয় । পঞ্চশস্য নির্দিষ্ট স্থানে রেখে অর্থাৎ বাড়িতে কুলদেবতার মন্দির থাকলে মন্দিরের কলঙ্গায় আর না থাকলে গৃহস্থের তুলসীথানে পঞ্চশস্য রেখে তার উপর সরা ও ঘট স্থাপন করা হয় ।
পুরুলিয়ার বাইরেও এই পূজার প্রচলন আছে । কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলের সাথে এই অঞ্চলের ইতু পূজার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পার্থক্যটি হল সর্বত্র ইতু পূজা হয় শুধু রবিবার , কিন্তু পুরুলিয়ার কোন কোন অঞ্চলে সারা অঘ্রাণ মাসের রবি ও বৃহস্পতিবার ইতু পূজা হয় । রবিবার সূর্যজ্ঞানে পূজা আর বৃহস্পতিবার মা লক্ষ্মী জ্ঞানে পূজা । বৃহস্পতিবার কে এই অঞ্চলের মানুষ লক্ষ্মীবার বলে থাকেন ।
সারা অঘ্রাণ মাসের প্রতি সপ্তাহে দু'দিন এই পূজা করে নারীরা । পূজার দিনগুলি ব্রতকিরিণীরা নিরামিষ ভোজন করেন । সকালে স্নান ক'রে পূজা সেরে ফলাহার করেন । দুপুরে ভাত এবং সেদ্ধ তরকারি , তেল-হলুদ ছাড়া রান্না । রাতে রুটি , সবজি ; জুটলে মিষ্টি ।
প্রথা মেনে পুজা সাঙ্গ ক'রে বাড়ির , কোথাও কোথাও বা সারা পাড়ার মেয়েরা গোলাকারে ব'সে ইতু লক্ষ্মীর ব্রত কথা শোনেন । সকলের হাতে আটটি আতপ চাল ও আটটি দূর্বা ধরা থাকে । শুরু হয় ব্রত কথা : ---
"অষ্ট চাল অষ্ট দূর্বা ধ'রে,
ইতু কথা শোনো প্রাণভরে।"
---ব্রত কথাটি দ্বিপদী ছন্দে রচিত ; ঠিক রচিত বলা যায় না । কারণ এটি বংশানুক্রমে শ্রুত হয়ে আসছে । যাইহোক , ব্রতকথাটির অতি সংক্ষেপে গদ্যরূপ এইরকম :---
একদা একটি গ্রামে একজন ব্রাহ্মণ ও এক ব্রাহ্মণী বাস করতো । তারা ছিল বেজায় গরিব । ভিক্ষা করে তাদের দিনাতিপাত হ'ত । তাদের দু'টি কন্যা ছিল , নাম -- উমনো আর ঝুমনো । একদিন ভিখারি ব্রাহ্মণের খুব পিঠে খাবার সাধ হ'ল । বহু কষ্টে ভিক্ষা করে সে পিঠার প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি জোগাড় করলো । সন্ধ্যায় এনে তা ব্রাহ্মণীকে দিল । আর বললো , তার খুব শখ সে পিঠে খাবে , কিন্তু এই পিঠের ভাগ কেউ পাবে না । এই ব'লে ব্রাহ্মণ পাশের ঘরে বিশ্রাম করছে , কিন্তু ধ্যান তার সেই পিঠাতে । একটু পরে ব্রাহ্মণী পিঠা বানাতে শুরু করলো। একটি করে পিঠা করে আর এক একবার ছ্যাঁক্ ক'রে শব্দ হয় । ব্রাহ্মণ ছ্যাঁকগুলি গুনতে থাকে ।
অল্পক্ষণ পর খাবার পালা । ব্রাহ্মণী পাথরের থালায় পিঠে সাজিয়ে ব্রাহ্মণ কে ডাকলো । ব্রাহ্মণ গুনে গুনে পিঠে খায় , শেষে দেখে দুটো পিঠে কম । ব্রাহ্মণী ভেবে ছিল দুই মেয়েকে যে দুটো পিঠে খেতে দিয়েছে, তা হয়তো ব্রাহ্মণ বুঝতে পারবে না । কিন্তু ব্রাহ্মণ তা বুঝতে পেরে রেগে আগুন । ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণীকে বললো -- ওই মেয়েদের তো আমি পেট ভরে খেতে দিতে পারছি না , তাই কিছুদিনের জন্য ওদের মাসি বাড়িতে রেখে আসি । ওখানে অন্তত দু'টি পেট পুরে খেতে পাবে । আর আদরও পাবে ---এই বলে দুই কন্যাকে নিয়ে ব্রাহ্মণ বেরিয়ে পড়ে । পথে বনের মধ্যে একটি গাছের তলায় বিশ্রাম নেয় । মেয়ে দু'টি ঘুমিয়ে পড়ে , ব্রাহ্মণ তাদের ছেড়ে পালিয়ে যায় । ঘুম ভাঙতেই তো মেয়ে দু'টি দিশেহারা ! প্রথমে "বাবা -- বাবা -- --" করে চিৎকার করে , পরে সত্য বিষয়টি অনুমান করতে পারে । বিপদের মুখে পড়ে তারা দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে হাঁটছে আর হাঁটছে । একদিন পর হাঁটতে হাঁটতে এক ব্রাহ্মণ বাড়ির সামনে উপস্থিত হয় । ওই বাড়ির গিন্নি মেয়ে দু'টিকে দেখে তাদের বিপদের বিষয়টি অনুমান করতে পারে । সব শুনে গিন্নি তাদের ইতু ব্রতপালন করতে বলে । নিষ্ঠা সহকারে সারা অঘ্রাণ মাস ইতু ব্রত পালন ক'রে তারা ভালো বর লাভ করে আর তাদের মা-বাবার সংসারেও সৌভাগ্য - সমৃদ্ধি নেমে আসে ।
ব্রতটির মূল উদ্দেশ্য ব্রত কথাটিতে অনেকটাই সুস্পষ্ট । মিত্র পূজা বা সূর্য পূজা বা ইতুলক্ষ্মী পূজার মূল লক্ষ্য ভালো বর এবং সাংসারিক সুখ-সমৃদ্ধি । সামাজিক দিক থেকে তাই-ই । কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে ইতু পূজার ভাবনা আরো গভীর । সূর্য পূজার অর্থ সৃষ্টির উৎসের পূজা । বিজ্ঞানও বলে উৎপাদন এবং জীবদেহের সকল শক্তির মূলাধার সূর্য । সূর্য ও মৃত্তিকার পরম মিলনেই সকল কিছুর উদ্ভব । কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় মানুষের জীবনযাপনের প্রধানতম অবলম্বন কৃষি উৎপাদন । শস্য তো দু'রকম ---খারিফ শস্য এবং রবি শস্য । খারিফ শস্যের সঙ্গে কৃষিদেবী ভাদুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক । করম-জাওয়ারও নিবিড় সম্পর্ক আর রবিশস্যের প্রাচুর্যের দিনে টুসু । কিন্তু টুসুর আগের মাসে ইতু । ইতু পূজার মধ্য দিয়ে শস্যবীজ ও তৈলবীজ সংরক্ষণের বিষয়টিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে । রবিশস্যের গুরুত্ব যে কতোখানি , তাও ধ্বনিত হয়েছে এর বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে ।
অঘ্রাণ সংক্রান্তির রাতে ইতুলক্ষ্মীর শেষ পূজা গাঁদা ফুল আর এসকা পিঠা অথবা পুর পিঠা দিয়ে । ভোরবেলায় পুকুরে , দিঘিতে , নদী অথবা যে কোন জলাশয়ে ভাসান । পুরুলিয়ায় এর নাম "ছটমকর" । ইতু ভাসানে জলাশয়ে যে সকল শস্য গাছ , ফুল , পত্র পল্লব ভাসিয়ে দেওয়া হয় জল থেকে সেগুলি কেড়ে এনেই সন্ধ্যাবেলা টুসু পাতা । অর্থাৎ টুসু পূজার সূচনা । এককথায় ইতু-র যেখানে বিসর্জন , টুসুর সেখানেই আবাহন । ইতু বিসর্জিত হয় আর পুরুলিয়ার কনকনে বাতাসে ভেসে ওঠে চির চেনা সেই সুমিষ্ট সুর --- " আ'সচে মকর দু'দিন সবুর কর . . . "
(ইতু ব্রতের ছবি : তপন পাত্র)
আমার বিবাহিতা বান্ধবীরা
মধুপর্ণা
একটা শব্দ হঠাতই খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে মেয়েদের জীবনে। "বিয়ের বয়স”। এই বয়স সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী বদলায়। এই 'বয়স' এসে পড়লে সব কাজ ফেলে দিয়ে মেয়েদের বিয়ে করে নিতে হয়। এই 'বয়সের' সঙ্গে সমাজ আপোষ করতে দেয় না। এ এক অনিবার্য নিয়তির মত, অকস্মাত বজ্রাঘাতের মত এসে পড়ে। তার হয়তো পড়াশুনা শেষ হয় নি, হতে পারে তার সংসারজীবনের ইচ্ছা তৈরি হয় নি, হতে পারে 'বিবাহ' প্রতিষ্ঠানটিকে সে পছন্দ করছে না। হতে পারে চারপাশের অভিজ্ঞতা দেখে শুনে তার 'বিবাহিত' পরিচয়ে পরিচিত হতে অ্যাবসার্ড, হাস্যকর মনে হয়। অনেকিছুই হতে পারে। হতে পারে কারণ না জেনেই একটি আবর্তে পড়ে যাবার আশংকা তৈরি হয়েছে। অথবা সে এতদিনে পড়ে ফেলছে বেশ কিছু বিপজ্জনক বই। অথবা জেনে ফেলেছে বিবাহের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। অথবা জেনে ফেলেছে 'ওম্যান আর দ্য লাস্ট কলোনি'(শিলা রোবথাম) অনেক কিছুই হতে পারে। আরও পড়ুন
________________________________________________
ঔপন্যাসিক দীপংকর রায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস---
"জলশ্যাওলার বিরহকথা" --- এবার অষ্টম পর্ব
________________________________
জলশ্যাওলার বিরহকথা
দীপংকর রায়
সাতাশে কার্তিক, বারোই নভেম্বর :
সন্ধ্যা লাগিয়ে কি এক বিষণ্ণতা নিয়ে সেই যে নবগঙ্গার পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছিলাম খেয়ার জন্যে ------ এই বিষণ্ণ বিমূর্ততার দেবীকে সত্যিই আমি বর্ণনা করে ধরে রাখতে পারি না কোনো রকমভাবে। তাঁর স্বরূপ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন থাকি অবচেতন মনে। চাক্ষুষ তো তাকে করা যায় না, তার অন্তরালের প্রেরণা অনুভব করি। এখানে থাকতে তার সঙ্গেই তো ছিল আমার যত কথা ! কোনোদিন না ধরা দিলেও সেই আমার অনুভবের সকল প্রেরণা। কতভাবে যে তাকে অনুভবে গড়েছি, তা তো ভাষা দিয়ে বলতে পারবো না ! আর এক প্রস্থ সেসব টুকরো টুকরো কথা কোনো সময়ে বলার ইচ্ছা রইলো ------
ভোরবেলায় উঠে অনেকদিন পরে আবার এখানকার অন্ধকার জড়ানো সকালবেলা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করলাম। মামীমা ডেকে দিয়ে বললো, উপবাসের জন্য চিনির সরবত খেতে। এটা খেলে সমস্ত দিন উপবাসে নাকি জল পিপাসা পায় না। আরও পড়ুন
আমাদের বই
ছবি প্রদর্শ-শালার ছবি পেতে সহায়তা করেছেন আলোকচিত্র শিল্পী শুভাশিস গুহ নিয়োগী মহাশয়। ওনার কাছে আমরা বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। ওনার ছবি প্রদর্শ-শালা দেখতেপ্রবেশ করুন এখানে।
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহযোগিতা : অনিকেতের বন্ধুরা
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com








মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন