দ্বিতীয় বর্ষ ।। একবিংশতি ওয়েব সংস্করণ ।। ১৭ মাঘ ১৪২৮ ।। ৩১ জানুয়ারি ২০২২



সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে এমন ঐতিহাসিক জনসংখ্যা হ্রাস কখনও দেখা যায়নি। করোনা কালের মধ্যে ১০ লক্ষ জনসংখ্যা কমল রাশিয়ার। কোভিডে মৃত্যু লুকনোর অভিযোগ পুতিনদের বিরুদ্ধে।
       রোস্ট্যাটের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ায় করোনাভাইরাসে ৬,৬০,০০০ জনেরও বেশি মৃত্যু হয়েছে। রাশিয়ার সরকারি ওয়েবসাইটের তুলনায় এই পরিসংখ্যান অনেক বেশি। রাশিয়ার সরকারি ওয়েবসাইটে মৃত্যুর সংখ্যাটা হলো ৩,২৯,৪৪৩। 
         শুধুমাত্র রাশিয়া নয়, সারা বিশ্বের সমস্ত দেশের সরকারি ওয়েবসাইটের করোনা মৃত্যুর তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল পাওয়া সম্ভব নয়। তার পিছনে কেবলমাত্র যে মৃত্যু সংখ্যা লুকোনোর বিষয়টি রয়েছে তা নয়, আরও অনেক কিছুই রয়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে সরকারি ব্যর্থতা এবং রোগী ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে অভব্য ব্যবহারের কারণে মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে হাসপাতাল মুখো হতে চাননি সে সময়। এই সময়কালের মধ্যে জ্বর বা অন্য যা কিছু হয়েছে, সবকিছুই চেপে গিয়েছেন অথবা গ্ৰামাঞ্চলের ডাক্তারদের দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে নিয়েছেন। ফলে করোনা হয়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে করোনা না হয়েও অনেক অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যার পরিসংখ্যান সরকারিভাবে পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে সরকারি হিসেবে দেখানো সংখ্যা থেকে বাস্তব সংখ্যাটা কম করে দ্বিগুণ হওয়া সম্ভব। বিশেষ করে ভারতবর্ষের মতো দেশে যেখানে গ্ৰামাঞ্চলের দিকে চিকিৎসা পরিসেবা প্রায় নেই বললেই চলে, সেই দেশে তো নিশ্চিত।
           আসলে এটা একটা পরিকল্পিত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বৈশ্বিক রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয় বলে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে জনমানসে। কিন্তু সত্যিই কি এমনটা দরকার ছিল? নাকি অন্য ভাবেও হতে পারতো, এই একটা প্রশ্ন থেকে গেল অলিগলির ভেতরে ভেতরে জমে ওঠা আড্ডায়। উত্তর কে দেবে তাদের? সরকার আর যাই হোক, দমন ছাড়া আর কিছু বোঝার মানসিকতা রাখে না। ফলে এই প্রশ্নের যে উত্তর পাওয়া সম্ভব না, তা ইতিমধ্যেই পরিস্কার হয়ে গিয়েছে মানুষের কাছে।



উত্তম মাহাত, সম্পাদক



______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
দুর্গা দত্ত / পল্লব গোস্বামী / দেবাশিস সাহা / হাবিবুর রহমান এনার / সৌরভ লায়েক / ব্রততী পরামাণিক /  সুজন পণ্ডা / দীপংকর রায় / রামানুজ মুখোপাধ্যায় / 

______________________________________________


লেখালেখি

দুর্গা দত্ত


দু'চারটে অক্ষর শুধু হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে
চলে যায় বেপথু মানুষ

খানাখন্দে পড়ে থাকে শীতের শুকনো হাওয়া
সাপের খোলস

দুচারটে অক্ষর শুধু গতায়াতহীন  
মুখ থুবড়ে ঘাসের ওপরে ...





পল্লব গোস্বামী-এর তিনটি কবিতা---

১.
সংসার


তোমার সাথে আর সংসার করা হল না এ জীবনে। 
বুকের ভেতর বুনো পায়রার ঝিম, ঊষর দুপুর
সারা দুপুর জুড়ে আমি শুধু, শনি মন্দিরের ছবি আঁকি 

ছবি আমাকে দেয় রং 
আমি ছবিকে দিই রামকিঙ্কর বেইজ 

একটি বজ্রাহত বটের 
একাকী কোটর দেখে ভাবি,

আকর্ষহীন কিছু লতা,কিছু মানুষের জন্য 
মায়ের মতো কিছু সহজ দুঃখই
প্রকৃত সংসার। 




২.
লালন


আমার স্বপ্নের ভেতর,যে মেয়েটি প্রতিদিন 
মেলা ভাঙার পর বেলুন বেচতে আসে 

ইচ্ছে করে,ওর হাত ধরে 
একদিন ভুট্টা খেতের ভিতর দিয়ে হাঁটি 

খড়ের গাদায় পা ছড়িয়ে বসে,
দুজনে দুটো গুড় মুড়ি খাই 

ভুট্টার রেশম দিয়ে,যদি বানাতে পারি 
একখানি দুয়োরানি পুতুল,একখানি ফ্রক

এখন স্বপ্নের ভেতর বেড়াতে এসে 
আমি রোজ এসবই ভাবি  

মনেহয়,পৃথিবীর প্রতিটি শিশু 
এক একটি ঘুমভাঙা ফুটফুটে পাখি 

হাওয়াও হাওয়ায় শুধু খুঁটে বেড়ায় 
সামান্য লালন।



৩.
অন্ধ বাঁশিওয়ালা ও ব্যথা সারানোর দেশ


এখন অসুখ হলেই বুঝতে পারি,
                    এ ব্যথা আর সারবার নয়। 
রোজ ভোর হলেই,এক অন্ধ বাঁশিওয়ালা বাঁশি বাজিয়ে কোখায় যে যায় - কিছুই বুঝিনা!
চুপিচুপি আমিও হাঁটি তার পিছুপিছু-
                  পৌঁছে যাই আলুর ডুঙরি,
                            গভীর গরুর বাথান। 
সংগীতরত অবস্থায় একজন শিল্পীকে 
ঈশ্বরও সহজে খুন করতে পারেননা জানি,
    আমি তাই খুঁজে ফিরি সেই শিল্পীকে 
                                 সেই বাঁশিওয়ালাকে 
অনুপ ঘুমের ভেতর 
             ছায়ার ভেতর 
                    বাঁশির ভেতর 
এই কি তবে সেই ব্যথা সারানোর দেশ?
ঠান্ডা হাওয়া আসে,
দূরে দেখি উত্তুঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা 
    অপূর্ব বরফফুলে সেজে উঠেছে। 
কার জন্য ? কিসের জন্য ? 
আমি তার নাম জানিনা। 




দেবাশিস সাহার কবিতা

১.
সম্রাট


বালিশে-চাদরে যে-ঘোড়াটা দৌড়োয়
তাকে স্তব্ধ করার মতো বাতাস ডানা মেলবে
হয়তো একটু পরে
ব্যাকরণ থাক আজ, আমরা বরং ---
সাদা পাতা জুড়ে আগুন লিখি
কেননা অনিচ্ছাকৃত যতগুলো ময়ূর এঁকেছি
ঠোঁটের গোধূলি বরাবর
থির থির কাঁপছে পৃষ্ঠা জুড়ে
বুঝিনি ---
শব্দ আর নৈঃশব্দ্যের মাঝখানে যে তুমুল ঝড়
নিঃস্ব আঙুলে মুছে দিতে পারে
                                  সে-ই তো সম্রাট


২.
নারী


নারী, তুমি কি কেবলই ফসলের মাঠ?
কেবলই ফুটিফাটা চৈত্রের প্রশান্তি
নারী, তুমি কতটুকু নারী
কতটুকু ছোঁও পুরুষের চৈত্র?



৩.
ধ্বংস বাজাচ্ছিলি তুই


গিটারে ধ্বংস বাজাচ্ছিলি তুই 
তক্ষুনি মূর্ছা গেলেন ভগবান। 
কবির বুকের ভেতর হাঁটতে শুরু করল কলম। ভয়ে জড়োসড়ো ভূমিকম্প। এক কোণে মুখ লুকিয়ে অগ্ন্যুদগীরণ । উধাও সাইক্লোন, সুনামি। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল জুরাসিক পার্ক। আন্দিজ-হিমালয়ে জোর ঠোকাঠুকি। 

এই দৃশ্যের ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করব ভাবছি ----
তখনও ধ্বংস বাজাচ্ছিস তুই 
পথ ভুলেছে বৃষ্টি। নদীরও ভীষণ মন খারাপ 
সব জল বাড়ি গেছে গান শুনতে। 
কোন ফাঁকে মোহনা ছাড়িয়ে সমুদ্র 
উঠে এসেছে পাড়ার মুদি দোকান পর্যন্ত। ধ্বংসস্তূপের ভেতর হঠাৎ দেখি -----
ভালোবাসা ছল ছল চোখে দু'হাত বাড়িয়ে। 
আর দেরি করা ঠিক হবে না 
ভালোবাসাকে পাঁজাকোলা করে আমি দে ছুট। 

আর এই ছবিটা ফেসবুকে পোস্ট করতেই 
সাথে সাথে ভাইরাল। 

ভগবান কখন জেগে উঠলেন কী উঠলেন না সেই খবরটা অবশ্য নেওয়া হয়নি। 

             



হাবিবুর রহমান এনারের কবিতা

১.
যা শোক করে


নদী আমরা পৌরাণিক নদী...
স্বয়ংকে প্রত্যক্ষ করি নদীর অভ্যন্তর দিয়ে,
তার ছায়া পরিপক্ক হয়, ক্রম বদলায় মুকুরের নীরে

পুনরায় হয়...স্বচ্ছ---ক্রম... বদলায় আগুনের মতো

সেই আমরাই তুচ্ছ---আদি নিবৃপিত নদী যা সাগরে ছুটে চলেছে

তাকে আবৃত করে ফেলেছে প্রতিবিম্ব সকল---আর
যাবতীয়...প্রস্থান

স্মরণ আর নিজস্ব মুদ্রার চিহ্ন রাখে না---
সুতরাং
কিছু আছে---যা থেকে যায়---কিছু আছে---যা শোক করে...



২.
দুঃস্বপ্ন


গভীর ঘুমের মধ্যে জাগ্ৰত... আমি এক মাংসাশী...

মধুকালের সুনিবিড় মমতাস্পর্শে এসে---ক্রম প্রবল
আয়েশে আমি আমার সবকটি অঙ্গুলি, দেহ-অস্থি
আর মস্তিষ্ক অতি অল্পতেই করছি সাবাড়...

তারপর
সাধের হৃৎপিণ্ড করবো ভক্ষণ... হৃৎপিণ্ড কোথায়?
আহা---কোনখানে হলো উধাও?

ঘুম ভেঙে দেখি---সফেদ বিছানায় টলটলে শিশির
বিন্দুর মতো---টকটকে লাল একটি রক্তবিন্দু...

তখনই
বুকসেলফ থেকে হাতে নিই খোয়াবনামা... ঘেঁটেঘুঁটে
পাইনি---এহেন খোয়াবের কোনও তরজমা।

ভাবনা... তবে কি এ আমার মৃত্যুর আগাম বারতা...




সৌরভ লায়েকের কবিতা

১.
সময়দ্রোণী

গেলে বুঝে যেতে নেই দূরুদ পাহাড়ে 
বিথানের পথে আলো কুরূপ খোয়াড়ে
লুকিয়েই রেখে দিলে খুশি ও হতাশা
মনমরা হইওনা শুক মরেছে দূর্বাসা

হৃদয় গ্রন্থি থেকে উৎসারিত জল
গ্রামকেই ভুলে গেলে প্রিয় মফঃস্বল
প্রেমিক ভেবেছে যারা , করেছিল ভুল
তাদের সমিপে রাখি সালমা বনফুল

তারো চেয়ে ভয়ানক কিংবা গভীর
খোঁজেরে গোপন রেখো , আজো তাই স্থির
স্বার্থ শূন্য তার পথিকের বেশ
মুদিলে নয়ন পাশে তাকালে নিরুদ্দেশ

বিজ্ঞ বলে গালি দিলে উম্মতেরে কাল
খেদমত করে নিল শব্দের ফাল
ফালাফালা করে দিয়ো বরং শূন্যে
আয়ু তার রেখে যাবে প্রস্থান চিহ্নে



২.
প্রসঙ্গত এ উত্তর নয়


বলো কোন পারে দাঁড়াবো ?
যে পাড় ধসে যাবে ? না চর হবে জমা
ফুটবে শরতে শাদা কাশের আঙিনা

আমারও তো কাঁসাই নদী, বিদ্যমান সাঁকো সেখানেও। 

প্রতিদিন যাই সাঁকোটির পাশে 
দূরন্ত দুই চাকা ক্ষণিক জিরোয়

কতো গল্প ওঠে আর শেষ হয় দেখি 
আজো কেউ গল্প শোনায় না 
সেদিনের মতো
শৈশব কাঁসাই-এর জল হায় ! সব প্রবাহিত




ব্রততী প্রামাণিকের কবিতা

১.
ইচ্ছেগুলোর বিদায়


এ কেমন যাপনের চিত্র!
জীবনের খেলাঘরে শুধু শূন্যস্থান, 
আবর্তনের পালা নেই, সমান্তরাল
রঙের উজ্জ্বলতা নেই,কালোপরদা
সূর্য উঠছে, ডুবছে, দিনাবসান- 
বছর গড়ায়, জীবনপর্যায় অসম্পূর্ণ 
চোখের দৃষ্টি, ঝাপসা-ঘোলাটে 
ইচ্ছেগুলো হেসে বিদায় জানায়।


২.
মানুষের আশ্রয়


অস্থির,বিক্ষিপ্ত,এলোমেলো, জীবনে
আশ্রয় খুঁজতে মানুষের দ্বার-
ব্যস্ত মানুষ মুখ ফিরায়,
আত্ম-অহঙ্কারে অবজ্ঞা করে,
দ্বারে-দ্বারে প্রশান্তির খোঁজ!
সময় যায় মানুষের অন্বেষণে 
বৃথা আকাঙ্ক্ষা-বাসনার লালন
বৃথা চাওয়া মানুষের আশ্রয়।






এই রাত...

সুজন পণ্ডা


আবার এসেছে সেই রাত
তন্দ্রাচ্ছন্ন জ্যোৎস্না দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে
জীর্ণ সভ্যতার পাঁজরে 
মনে হয় এক্ষুনি কোনো শাপ
মনে হয় এক্ষুনি কোনো আঁধার
উঠে আসবে আলো থেকে।
শ্বাপদের চোখ দেখি
অপেক্ষায় অপেক্ষায় অন্তরালে--।

এই রাত, এই ঝাপসা চাঁদ 
আবার সেই রাতের মত। 
আমি একবার শুধু বুক পেতে
দাঁড়াতে চাই এই রাতের মুখোমুখি।
শেষবার।
তারপর আলোর গুঁড়ো হয়ে
ঝরে যাবো।




________________________________________________

ঔপন্যাসিক দীপংকর রায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস---
"জলশ্যাওলার বিরহকথা" --- এবার দ্বাদশতম পর্ব
________________________________

জলশ্যাওলার বিরহকথা

দীপংকর রায়


উনত্রিশ , তিরিশে অঘ্রাণ


         ছাব্বিশ তারিখের পর আর দিনলিপির খাতায় হাত পড়েনি। কেন পারিনি, সে কথা জানি না। লিখতে ইচ্ছে করেনি তাই পারিনি। চলছে শুধুই এলোমেলো বিচরণ, এসব একটি বিষয় যেমন, তেমন হয়তো আরো আছে কিছু যা অজানা। 

        ওদিকে ঢাকা থেকে ফিরেই রফিকভাইএর ভাষা সংখার জন্যে পাঠানো চেক পেলাম। এই একজন মানুষ ----- যার কাছে কত ঋণ রয়ে গেল।
        এর পরের পরের দিন একবার রাড়ীখালী মুখো গেলাম আবারও ------ কেন যে, তা তো জানি না! সামান্য সময়ই ছিলাম, তারপরে আবার মাগুরা। 
         মাগুরা পর্ব এবারের মতো সেরে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে শ্বশুরালয়ের দিকে পা বাড়ালাম। একবারও মন চাইনি যে তা না, চেয়েছে, ভেবেছিলাম অবাধ্য হয়ে প্রথমে আমাকে বাড়ির ভেতরে হাত ধরে নিয়ে যাবে সেই। কিন্তু না। তা আর পারলো কই ----- অভিমান? হয়তো। কিন্তু কিসের? 
        এসবের মধ্যেও নাকি অন্য দরদ আছে! 

         বারবার মনে পড়ছিল সেদিন রাতে রাড়ীখালী থেকে ফেরার সময় নদী পার করে মামার অন্ধকার পথ পেরিয়ে বাসে তুলে দিয়ে যাবার কথাটি। বাকি পথটুকু তার অন্ধকারে একা একা ফিরে যাবার চিত্রটা যেন নিমেষে চোখের সামনে দেখতে পেলাম এই দিনের আলোতেও। কিন্তু কেন, এখন সে কথা মনে পড়লো কেন এভাবে? 
         জানি না মাঝখানে সে চিন্তা ঢুকে পড়লো কেনই বা অমন করে! সে প্রসঙ্গে অন্য কোনো আবেগ কাজ করলো কি এখানে? আরও পড়ুন






______________________________________________

নির্মল হালদারের 'করোনা ডায়েরি' এই দুঃসময়ের মহাকাব্য


রামানুজ মুখোপাধ্যায়


দিন যত এগিয়েছে, প্রযুক্তি যত উন্নত হয়েছে, আমাদের ব্যস্ততা তত বেড়েছে। প্রত্যেক দিন নিয়ম করে দিনলিপি লেখার সময় কই আমাদের হাতে! লিখলেও তো প্রত্যেক দিনের নিত্যনৈমিত্তিক কাজের পুনরাবৃত্তির ক্লান্তিকর বিবরণেই ভরে থাকত আমাদের দিনলিপিগুলি। দিনানুদৈনিকের জীবনকে শিল্পের নান্দনিকতায় মণ্ডিত করে তুলতে আর ক-জন পারেন। শুধু ব্যস্ততা নয়, হয়তো এই আশঙ্কা থেকেও দিনলিপি প্রকাশের ব্যাপারে আমাদের মনে তৈরি হয় একরকমের অনাগ্রহ। লেখেন হয়তো কেউ-কেউ, তাঁরা আর ছাপার অক্ষরে প্রকাশ্যে আনতে চান না সে-সব। দিনলিপি তাই প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল সাহিত্যের আঙিনা থেকে।

চিত্রটি ঈষৎ বদলে সাম্প্রতিক মহামারির সময়ে। করোনা আমাদের জীবনে নিয়ে এলো এক অপ্রত্যাশিত আতঙ্ক। পায়ে-পায়ে ভয়। চারদিকে শুধু নিষেধের গণ্ডী। লকডাউন। বাধ্যতামূলক ঘরবন্দি। বন্ধ দোকান-বাজার, পথ-ঘাট, স্কুল-কলেজ। বিপন্ন শৈশব। সংবাদ মাধ্যমেও ক্লান্তিকর হতাশার সারি। পরস্পরের থেকে দূরে-দূরে, বিচ্ছিন্ন থাকতে-থাকতে, আমাদের মধ্যে কি তবে নতুন করে জেগে উঠল নিজেকে, এবং চারপাশকেও নতুন করে ফিরে দেখার আগ্রহ? এরই মধ্যে ফিরে এলো দিনলিপি লেখার একটা প্রবণতা।

আমাদের দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, ২০২০-র মার্চে শুরু হয়েছিল কোভিড-১৯-এর সংকট। সমকালীনতার উত্তাপ অনেক সময় আমাদের স্পর্শ করে। এমন ক্রান্তিকালে তো সে-কথা আরও বেশি করে সত্য। উত্তাপ কমে এলে পাঠক সে-লেখাগুলির ভিতরে সন্ধান করেন চিরকালীন আবেদন। ২০২০-র মার্চের দ্বিতীয়ার্ধে আমাদের রাজ্যে শুরু হয়েছিল লকডাউন। আর এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে 'সাপ্তাহিক কবিতা আশ্রম' পত্রিকার কলামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল কবি নির্মল হালদারের 'পৃথিবী গ্রহের পুরুলিয়া'-র লেখাগুলি। ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে সেই লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছে গ্রন্থাকারে। এই বইটির উপশিরোনাম ‘করোনা ডায়েরি’। এর লেখাগুলি আসলে দিনলিপি। ১৪২৭-এর ১ বৈশাখ থেকে ১ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত প্রত্যেক দিন লেখা হয়েছিল দিনলিপিগুলি। আমাদের দেশের নগরে-বন্দরে যখন মৃত্যু আতঙ্কের হাহাকার দুয়ারে-দুয়ারে, তখন কেমন ছিল গ্রাম-ভারতবর্ষ? কবি নির্মল হালদার লিখেছেন সেই বিষদের দিনলিপি।

বাংলা কবিতার আকাশে নির্মল পরিচিত নাম। বিশ শতকের সত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন সুদূর পুরুলিয়া থেকে। রুখু লালমাটির বুকে ফুটে থাকা পলাশের মতো তাঁর কবিতাগুলি প্রাণের প্রাচুর্যে উদ্ভাসিত। অবহেলিত অন্ত্যজ জীবন, মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা শিকড়ের মতো আমাদের লোকজ সংস্কৃতি বারবার ভাস্বর হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়। 'অস্ত্রের নীরবতা' (১৯৮০) বইটি দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর যাত্রা। এখন তাঁর কবিতা বইয়ের সংখ্যা তিরিশ ছাড়িয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু গদ্য, উপন্যাস, চিঠিপত্রও। তাঁর প্রথম বইয়ের এই চরণগুলি হয়তো এখনও আমরা ভুলিনি: ‘বাবুমশাই আমি নির্মল হালদার/ এখনও আমার কথায় কথায় গরুর শিং ঢুকিয়ে/ হো হো করে হেসে উঠছে রাখাল বালক’। এই প্রান্তজনের মহাকবি নির্মল হালদের তাঁর ‘করোনা ডায়েরি’-তে তুলে আনলেন সেইসব দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষদের সংকট ও স্বপ্নের ছবি। শহর পুরুলিয়া ও আশেপাশের গাঁ-গঞ্জের সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের জীবনে যে এই করোনাকালে নেমে এসেছে কী ভয়াবহ ও অসহায় অনিশ্চয়তার মেঘ, নির্মলের লেখায় তার বাস্তব চিত্র দেখে আমরা শিউরে উঠি। 

শুধু সমকালের সংকটকে চিত্রিত করেই তাঁর লেখাগুলি ফুরিয়ে যায়নি। ধামসা-মাদল তৈরি করে যে নন্দলাল রুহিদাস, গাঁয়ের হাটে শাক বিক্রি করে যে কৃষ্ণপদ গোপ, চা-দোকানে কাপ ধুচ্ছে যে রজনী হেমব্রম, তাঁরা নির্মলের দরদ ভরা কবিকল্পনায় হয়ে উঠেছে সমগ্র পৃথিবীরই শ্রমজীবী মানুষের সংকটের মুখ। মোহিনী হেমব্রমের ছেলে রজনী হেমব্রমের বসত রুক্ষ পুরুলিয়ার পাহাড়-কোলের অখ্যাত কোনো গ্রামে। মারধর করেও বাবা তাকে ইস্কুলে পাঠাতে পারেনি বেশিদিন। সামান্য মাড়ভাত খেয়ে সকাল থেকে সঙ্গীদের নিয়ে সে ঘুরে বেড়াত জঙ্গলে জঙ্গলে। ‘রজনী মাথা তুলেই বলে দিতে পারে কোন গাছে কোন পাখি আছে।’ তার গুলটির নিশানা ছিল অব্যর্থ। সঙ্গে থাকত কাঁড়-বাঁশও। শিকার করে। এই অংশটুকু পড়ুন আপনারা:
‘রজনীর জল তেষ্টা পেয়েছে। সে জানে, ঝোরা কোথায়। উঁচু-নিচু পা ফেলে জলের কাছে পৌঁছে যায় রজনী। ঝোরার জলে খেলা করছে সূর্যের রঙ। মাছেরা উঠছে নামছে। তার মনে হল, মাছ ধরতেই হবে তাকে।’
পেটের টানে সেই রজনীই একদিন কাজ করতে এসেছিল পুরুলিয়া শহরে, একটি চায়ের দোকানে। গ্লাস ধোবে, দোকান ঝাঁট দেবে। দৈনিক দশ টাকা করে পাবে। খাওয়াদাওয়াও পাবে। রাতে শোবে দোকানের মধ্যে। কোনো জানলা-দরজা নেই, খোলা একটি ঘর। রাতভোর থেকে উঠে গ্লাস ধোয়, মুখ তুলবার সময় পায় না রজনী। সেই সামান্য একটুখানি দোকানও একদিন রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেল লকডাউনে। এবার কেমন করে রজনী ফিরবে তার পাহাড়তলির গাঁয়ে? কবি নির্মল হালদারের এই লিখনের সামনে, আমি এক সামান্য পাঠক, মুখ নিচু করে বসে থাকি একরাশ মনখারাপ নিয়ে:
‘চা দোকানের মালিকও বলে, রজনী ঘর চলে যা রে . . . সে চুপচাপ থাকে। রাতটা কোনও ভাবে কাটিয়ে, যদি পায় বাস। এই ভেবে স্ট্যান্ডে যায়। বাস চলছে না। সে হাঁটতে থাকে . . . হাঁটতে থাকে . . .। ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে . . .। পিছন ফিরে দেখেও না, কে আসছে কে আসছে না। এই তো এসে গেল জঙ্গল পাহাড় নদী। ওই তো মা বাবার মুখ। ওই তো রজনীর মুখে এসে পড়ে আকাশের আলো।’
ছোটোখাটো ভোজকাজে রান্নাবান্না করত আকলু তন্তুবায়। তাদের পারিবারিক তাঁতের কাজ উঠে গিয়েছে কবেই। লোকের মুখে-মুখে তার নামটি হয়ে গিয়েছিল ‘আকলু ঠাকুর’। বিয়েসাদি, শ্রাদ্ধ-মুখেভাত --- বন্ধ হয়ে গেল মহামারির দিনে। কী খাবে আকলু? কী খাওয়াবে পরিবারকে, ছোটো-ছোটো দুই পুত্র এক কন্যাকে? কত সরল তার ক্রোধ আর আক্ষেপের প্রকাশ: 
‘আমার খুন্তিটা ঢের বড়। যদি খুন্তিটাতে মারি, ভাইরাসটা মরবেক নাই? মরলে আমি শ্রাদ্ধ করব। লোক ডেকে খাওয়াব। আমি আমার ডাবু লিয়ে খুন্তি লিয়ে লাচব রে লাচব . . .’
এইখানেই নির্মল হালদারের 'পৃথিবী গ্রহের পুরুলিয়া' বইটি গদ্যে লেখা দিনলিপি হয়েও আত্মরতিময় দৈনন্দিনের গণ্ডীতে আটকে থাকেনি, এনে দিয়েছে চিরকালীন কাব্যের আস্বাদ। চিরকাল কবির হাতেই তো আছে সেই ব্রহ্মবিদ্যা!

আমাদের এই দুঃসময়ের মহাকবি নির্মল হালদারকে এই ধুলোমাটির নগণ্য পাঠকের বিনীত প্রণাম জানিয়ে রাখি।

পছন্দের বই: 'পৃথিবী গ্রহের পুরুলিয়া'। নির্মল হালদার। বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা: কবিতা আশ্রম। ২০২১।



         আমাদের বই







এই সংস্করণের আলোকচিত্র শিল্পী সন্ধানের জন্য আলোকচিত্র শিল্পী শুভাশিস গুহ নিয়োগী মহাশয়ের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।


সম্পাদক:উত্তম মাহাত
সহায়তায়: অনিকেতের বন্ধুরা
যোগাযোগ: হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com



মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। নাচনী শিল্পীদের আলোক-চিত্র ।। সন্দীপ কুমার