জলশ্যাওলার বিরহকথা
বলা চলে অলিখিত এক চুক্তিনামায় সাক্ষর হয়ে গেল দাদু আর আমার নাম । আমরা উভয়ে উভয়কে খানিকটা জীবনের নিশ্চয়তার গোপন দেনাপাওনায় বেঁধে ফেললাম যেন। আমার নানা শূন্যস্থান পূরণে তার সাহারা পেতে থাকা কীভাবে যেন ভুলিয়ে দিল তার আর আমার মাঝখানের তথাকথিত সম্পর্কের দূরত্বকে------।
মানুষের স্বভাব, সে পেলে আস্তে আস্তে নিজেকে ছেড়ে দেয় খানিকটা । মনে করে সত্যিকারের সম্পর্ক তো এটাই ; এবং সেইসব অধিকারে কোথাও যদি ফিরতি পথের কোনো দিশা না দেওয়া থাকে , তাহলে সেই পরিসর বাড়তে বাড়তে ঠিক এতটাই বেড়ে যায় ------ যা আজ বেড়ে গেছে বলে মনে হলো। যেন আজ আর ওদের দেওয়া দুই পাঁচ হাজারকে আমি আর ধার বলেও ভাবতে পারি না। আর এই দাবি , অধিকার বাড়ানোর পেছনে তাদেরই ভূমিকা বরাবরই আমার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে তাদের মতো করে। তাদের এই নিয়ন্ত্রণ আন্তরিক হোক আর বৈষয়িক হোক, যেটাই হোক, আমাকে সে কথা বুঝতে দেয়নি হয়তো নানা আচার আচরণ থেকেও সবটা পরিষ্কার ভাবে।
আর আজ, এই যে এই মুহূর্তে যে ঘটনা ঘটল তার জন্যে কি সত্যিই আমার অভিমান করা চলে ?
বিড়বিড় করে বলতে বলতে যেন এ কথাই বললাম বারবার ------ কয়লা হাজার ধুলেও তার কালি যাবে না। এ কথা তো কথাতে রয়েছেই । এই উপমায় তারা এবং আমি সকলেই যেন একই । আমার মনে হয়, বছরে একবার দু'বার আসি, দুই-পাঁচ হাজার ধার দিয়ে, আমার মাথা কিনে নিয়েছিস নাকি ?
যদিও অন্য কেউ হলে হয়তো সেটাই ভাবতো। এক্ষেত্রে সেকথা ভাবতেও সত্যিই কষ্ট হয়। কারণ শুধু এখানেই তো না, কলকাতাতেও গিয়ে ওরা যেভাবে আমাকে খেয়াল দেয়, ভাবে আমার ভালো মন্দ সব কিছু ,সেটা কি এত তুচ্ছ জিনিসে এমন কোনো কঠিন সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিতে পারে, যে সবটাই ভুল !
এই যে লক্ষ্য রাখা, এই যে এতগুলি দিন, তোমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ওরাও বড় হলো কত ; তোমারও বয়স বাড়ল দেখতে দেখতে ------ তা কি সবটাই বোঝাপড়া, দেওয়া নেওয়া নিয়েই বেড়ে উঠল ? সেখানে কি কোথাও মানবিক সম্পর্কের কোনো গভীরতা ছিল না ?
এই যে এখন, যেখানে চলেছ, সেখানে কী পাও ?
তথাপি , কাউকে কিছু বলা বা কওয়ার আগে, তার বর্তমান, তার অতীত , এই দুটিকেই খুব ভালো করে ভেবে নাও, তাহলে দোষ গুণ দুটোকেই একজায়গায় ফেলে বিচার করে দেখতে পারবে, পাল্লায় কার ওজন কতোটা।
দুঃখ পাও ------ সে জিনিস পাওয়া ভালো। তা না পেলে মানুষ ভেতর থেকে বিশুদ্ধ হতে পারে না। তাই ভেবে নাও , দুঃখ পেয়েছ মানে, তাকে তুমি ভালোবাসো বলেই সে তোমায় দুঃখ দিতে পেরেছে। আর এই ভালোবাসার সম্পর্কে দুঃখ বেদনা না থাকলে, আর কিই বা থাকলো, যা তুমি নিজের জন্যে তুলে রাখতে পারো।
এই যে তুমি মনে মনে এতটাই স্বার্থপর হলে, গালাগাল দিলে, মনে মনে যেন লিখেও ফেললে দিনলিপির পাতায়, "বছরে একবার আসি , পাঁচ দশ হাজার দিয়ে মাথা কিনে নিয়েছিস নাকি আমার, যে কথা দিয়ে কথা রাখিস না ?
কী যে দমচাপা অসহায় লাগছিল তোমায় সেই সময়টাতে, তা আমি জানি মন ; মনে হচ্ছিল এ চরম নিষ্ঠুরতা ! মনে হচ্ছিল বলো যেন, হ্যাঁ রে আমি কি কিছুই বুঝি না ! ভুলে গেলি তোরা সেইসব দিনগুলোর কথা ! আমি কিন্তু ভুলিনি। ভুলিনি বলেই তোদের কাছে যাই। মনে পড়ে দাদুর নার্সিংহোমে থাকা দিনগুলির কথা ! সেই সময়কার সেইসব অসহায় দিনগুলির মুহূর্তে আমার ভেঙে পড়া, মনে পড়ে সেই সময় আমায় অভয় দেওয়া কথাগুলির কথা, "মামা, আমরা বেঁচে থাকলে ,আপনার কোনো অসুবিধা হতে দেব না আমরা।"
অথচ আজ ! আজ তো তোদের দেওয়া সেই সব প্রতিশ্রুতির কথা আর কোথায় থাকলো বল ?
কোথাও আপোষ হলো না। ঠিক করে ফেললাম খুব সকালেই ঢাকায় রওনা হবো। ভেতরের হাহাকার থামতে চায় না কিছুতেই। বারবার মনে মনে বলতে থাকলাম, গৌর তোদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল বল….. ?
সেই রাতেই শ্যালিকার স্বামীর সঙ্গে ঠিক করে ফেললাম সকলে রওনা দেবার সময়।
এই দিনলিপি যখন লিখছিলাম বারবার মনে পড়ছিল সাথীর ঊর্মিকে বলা কথাটা, ওকে দেখিস তুই ---- ও কিন্তু ভেতরে ভেতরে বড়ো একা !
সাথী, তুমি কাদের কি নির্বাচন করছো ? এই দেখতে বলা কি তুমি গৌরদের বলেছো কখনো ? হয়তো ওইভাবে বলোনি। কিন্তু একভাবে না একভাবে তো বলেছিলে নানা আবেগ ঘন মুহূর্তে ; তাই, এখানেও দেখো একদিন ওর এই সমস্ত মোহ কেটে যাবে। ওর এই মোহ কি চিরকালের ? না, তা হওয়াও বাঞ্ছনীয় নয়। মোহ তো চিরকালীন হয় না ! প্রকৃত উৎসর্গ মহাপ্রেমে রূপান্তরিত হলেই হয় সেই মোহের চির নির্বাসন।
তাই আজ যেমন এরা আমাকে মোহ কাটিয়ে নিয়ে অনাথ করে রাস্তায় নামিয়ে দিল, ঠিক সেরকম একদিন তোমার দেওয়া এইসব মানুষের উপর আমার ভার চাপানোও দেখবে একদিন মোহ কাটিয়ে কীভাবে পথের মানুষ করে দিয়েছে আমায় !
এর পরেও কি তুমি ভাববে, বলবে, "আমি কি কাউকে ভুলতে পারি ?"
পঁচিশে নভেম্বর ,অঘ্রাণ
গতকালের ধকল হজম করতে সময় লাগলো একটু। একবার ভাবলাম ঢাকায় যাওয়া বন্ধ করে দি। কিন্তু পারলাম না। সকালেই টিকিট কেটে স্বপনের সঙ্গে বাসে চেপে বসলাম।
আগে পদ্মার পাড়ে ফেরিতে উঠবার আগে, কি লঞ্চে ; একটা হইচই ব্যাপার থাকতো। আস্তে আস্তে সেসব কি মিইয়ে গেল নাকি ? সেইসব হাঁকডাক ---- ' গরম ভাত, পাঙ্গাস মাছ আছে , বোয়াল, রুই মাছ, ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত, একেবারে গরম গরম, লাগবে নাকি, এইদিকে আইসেন স্যার ---- এই যে এই দিকি , দ্যাহেন আইসে ; ও আপা, ও ভাইজান, ও ভাই, দেহেই যান না একবারের জন্যি ---- '
না, এখনো নেই যে তা না, আছে, তবে আগের সেই প্রাণবন্ত হাঁকডাকের বহরটুকু একটু কমেছে এই যা। আবার এও হতে পারে, সবই আছে হয়তো, এখন সকাল বেলা , খাবার সময় নয় তো, তাই ---- একবার দু'বার হাঁকডাক ছেড়েই চুপ করে আছে হয়তো। দুপুরবেলা হলেই বিষয়টার গুরুত্ব বাড়বে। আর ঠিক তখনই আবার--- নদীর পাঙ্গাস ও ইলিশের মোহনীয় টান মানুষকে আকৃষ্ট করবে বেশি করে।
যাই হোক আজ একেবারে সাদামাঠা এদেশের মানুষের মতোই রোজকার যাত্রী সেজে এমনই একটা ভাব নিয়ে লঞ্চে গিয়ে উঠলাম। পদ্মাও পেরিয়ে গেলাম অদ্ভূত এক কুয়াশা জড়ানো অনুভবের ভেতরে। ঢাকায় পৌঁছে এদের আর পাঁচজন ব্যবসাদারের মতোই সমস্ত দিন মশলা, গুড়ো দুধের বাজার , সুতুলি-প্লাস্টিক, কাঁচা বাদাম এইসব করে বিকেলের দিকে কিছুক্ষণের জন্যে একটি বাড়ির আতিথ্য গ্রহণ করলাম। খাওয়া-দাওয়া করলাম। অনেকক্ষণ বকবক করলাম। পরে মন বললো, ধুউস্….. মাথামোটা ধেড়েকেষ্টর মতো ভুসমাল যত সব ; পারেও স্বপন ! টাকা ছাড়া যারা কিছুই বোঝে না ---- সব ব্যাপারেই ভুল দেশাত্ববোধের ঢ্যামনামির চরম ! এই ছাড়া আর কিই বা আছে এদের..! দুই-একবার ধেড়ে ইঁদুরও বললাম।
মাঝে একটা মেয়ে বেশ সাজুগুজু করে এসে বসল ঘট হয়ে চেয়ারে। ভাবলাম এ আবার কী সমস্যায় পড়া গেল রে বাবা ….! স্বপন তো এসব বলেনি একবারও …! পরে বুঝলাম মেয়ে পছন্দ করাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিল এখানে আসার। সেই মেয়েটির মুখের ঘোর, মায়া জাগানো চাহনি, এ যেন এক সংক্রমণ …..!
আমায় ঘোড়ারোগে ধরেছে ! ষোলো-সতেরো বছরের যে মেয়েটিকে দেখলাম, বেশ সরল বলেই মনে হলো। তবে এর সঙ্গে স্বপন তার তিরিশ উর্ধ ভাই-এর বিয়ে দিতে পারবে কী করে ?
সে বেশ সকলের সঙ্গেই কথা বললো। স্মার্ট আছে, ঢাকার মেয়ে তো !
তবে ভ্রান্ত স্বদেশীয়ানা বলি আর যাই বলি না কেন একটা ব্যাপারে তাদের বাড়ির লোকের প্রসংশা করতেই হয়, তা হলো তাদের দোকানের সন্দেশগুলি ভারি স্বাদের। এরপরও স্বপনের জন্য আবার চকবাজার -- জিরে --- ধনে--- মসুরি --- খেসারি করে রাতে সাথীর দাদার মেসে। এখানেও এক মদনমোহন ব্যাপার --- সর্বত্রই খালি টাকার ঝাঁঝ। ছ- ইঞ্চি জায়গার মধ্যে স্বপনের সঙ্গে কুকুর-কুণ্ডলী মেরে পড়ে রইলাম । চোখে তবু ঘুম। ক্লান্তিতে লেটকে গেছি একেবারে যেন। তাও আজিজ মার্কেট, শাহবাগ--- বই কেনা। প্রদীপ ঘোষ না ত্রিদিব ঘোষ কবিতা লিখতো নাকি। চিনি না। নামটি এদেশে এসেই শুনলাম। সে আর আমি কাকেই বা চিনি, এই ভবের বাজারের মানুষজনদের ---- আমাকেই বা কে চেনে --- চেনাচিনির আঠায় তো মন মজেনি কখনো ; তবে এনার কথা যা শুনলাম, এই মানুষটি নাকি সাহিত্যের বাজারে বেশ ঘোরাঘুরি করতেন। অনেকের সঙ্গেই গা মাখামাখি ছিল বেশ। প্রায়ই নাকি এদেশ ওদেশ করতেন। নানা আপ্যায়ন, দাওয়াত খেয়ে-দেয়ে , রাতভোর বেশ মাল-টাল টেনে-টুনে রসে-বসে মজেছিলেন নাকি শিল্পের গলিগালায় মোজ করে। এরপরেই রাতভোর হতে না হতেই ফুডপয়জেন বা অন্য কিছু, সঠিক বলা মুশকিল ----- বিজু বললো। যাই হোক একটা কিছুতে ভবলীলা সাঙ্গ করেছেন এদেশেই ।
বিজুর ( বই বিক্রেতা, তার একটি ছোট্ট দোকান আছে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে ) কাছেই শুনলাম, সে নাকি এইমুহূর্তে কালীবাড়ির শ্মশানে পুড়ছে….।
ভীষণ মনখারাপ হলো কেন জানি না। যে মানুষটাকে চিনিই না তার জন্যে আমার মনটা খারাপ হলো কেন ? আমি কি ভেতরে ভেতরে ওই মানুষটিতে রূপান্তরিত হয়ে গেলাম ? নাকি ভাবছি ? এই তো, কোথায় তার এখন নিজের দেশ, নিজের মাটি ? মানুষটা ছাই হয়ে গেল তার সব স্বপ্ন- আকাঙ্ক্ষা শেষ হতে না হতেই…! ভাবলাম, তার দেশের পরিজনদের ভোগান্তির কথাটাও। একবার না, বারবার ভাবতে লাগলাম। ভাবলাম , এই আমি এসেছি, আর যদি ফিরে যেতে না পারি, তাহলে কী হবে ?
ভালো লাগছিল না কিছুই। পথে ফিরে আসতে আসতে সাথীর দাদার মোবাইল থেকে সাথীর সঙ্গে কথা বললাম কলকাতায়। দশ বছর আগে বা এই সেদিনও কি এসব ভাবা যেত---? এই পরিবর্তনের কথা ভাবতে গেলে অনেক অতীত দিনের জন্যে মনটা যেন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।
এখানে সবকিছু মিলে সংখ্যালঘু শ্রেণীর যে অনিশ্চয়তা বোধ ---- নাকি সেসব প্রাণেরই এক অমোঘ অস্থিরতা খানিকটা ; সে যাই হোক, এখানে ওখানে এইসব গুঞ্জন অনেক কালের ; যার কোনো শেষ নেই --- শুরুও ছিল অনেক খানিক আগে থেকেই ; তাই হৃদয়ে প্রশান্তিও নেই --- !
হৃদয়ে প্রশান্তি নেই কে বললো ? লাক্সারিরও তো কোনো শেষ নেই দেখি। সেসব যেন এদিকে ওদিকে, সবদিকেই সমান ---- সবকিছুর মধ্যেই নগর জীবনের সেই অসার ফাঁপা জায়গাটাই গিলে নিচ্ছে সকল দিকটা। যা একটু চোখ খুলে লক্ষ্য করলেই ধরা পড়বে সবটা। নাকি এর মধ্যে অন্য কোনো প্রেমময়তা আছে কোথাও ?
মনে মনে বলি যেন, একটুখানি টানা নিশ্চয়তা কোথাও নেই এই পৃথিবীতে ! প্রতি মুহূর্তে এই অসারতা দাঁত-মুখ বের করে আমাদের চিবোতে শুরু করেছে যেন। এত কিছুর সঙ্গে ছুটোছুটি করেও কোথাও কেবলই ভেঙেচুরে পড়ে থাকি বুঝি। কোথাও কোনো শান্তি নেই।
যদিও এদের জীবনযাপনের সঙ্গে আমার কিই বা সম্পর্ক ! তবু মনে হচ্ছে সবটাতেই এমন একটা গোদা বিষয়কে প্রতি মুহূর্তে সামলাতে হচ্ছে যে , হাঁপ ধরে যাচ্ছে যেন ভেতরে ভেতরে। একে তো সবটাই মোটা এবং গোদা, তারপর মিথ্যে অহংবোধ। ঠিক যেন কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে এইসব জলে। এত মোহ বেড়াজাল কেবল অর্থ বিষয়টাকে ঘিরে !
ভাল্লাগছে না। পালাতে পারলেই বাঁচি। কিন্তু কোথায় বা যাবো ?
আগামীকাল সকাল সাতটায় গাড়ি। তারপর আবার মাগুরা। স্যালুন কোচ, নাকি কী একটা যেন বললো স্বপন…!
সেলুন বা স্যালুন যাই হোক, কিন্তু কেন ? না, শোয়ানো চেয়ার লাগানো থাকে বলে ? বেশ, ভালো। শুয়ে শুয়ে যাবো তাহলে ? বসতে পারবো তো ? আরামের শেষ নেই ! আরো কতরকমের আরামটারাম আছে যে তার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করে যেতে থাকলো সাথীর দাদা আমাদের বাসে তুলে দিতে এসে।
গাড়ি ছাড়লে কাঁচের জানলায় চোখ রেখে এই দু'দিনের ঢাকা পর্ব ভেবে নিতে গেলাম ----- সেখানে সংগ্রহের মধ্যে একখানি বই ----- যা ওখানে মেলে না। আব্দুল লতিফ চৌধুরী সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ সংগ্রহ। সুশান্তর জন্য আরো একখানি, পাক সার জমিন বাদ। আর মুনাই-এর জন্য বেগম রোকেয়া। সুশান্তর জন্য আরো একখানি ----- হুমাউন আজাদের শেষ সাক্ষাৎকার ।
এইগুলি ব্যাগে পুরেই এবারের মতো ঢাকা ছাড়লাম । কিন্তু এমন কোনো ভাবেই এখানে অদৃশ্য কোনো প্রেরণা অনুভব করতে পারলাম না কিছুতেই যেন। কোনো ভাবে সমৃদ্ধ করতে পারলাম না নিজেকে। অন্তত সুশান্ত যেবার বছর দশ আগে আমার সঙ্গে এসেছিল এখানে প্রথম। গবেষনার বরাত পেয়ে। তখনকার পৃথিবীটাও যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে ডানা গুটিয়ে। কত অন্যরকম ছিল সেই সময়ের অনুভব…! বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তখন একটা ভালো সমব্যথীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। যদিও সেসব কিছুদিন মাত্র টিকে ছিল। তারপর সেসব সব যে কোথায় হারালো তা মনে পড়ে না। হয়তো আমারই স্বভাবদোষ, অনীহা, এইসব স্নায়বিক ঝঞ্ঝাটে সেসব টিকিয়ে রাখতে পারিনি। হয়তো তারা তাদের মতো ঠিকই ছিল, আমিই এক টুকরো কাগজের সেইসব ঠিকানা, ঠিকুজ্জি কুষ্টি, সব দুহাতে ছিঁড়ে ফেলেছি ইউনিভার্সিটির পাশের মেহগনি জারুল শিরিসের ছায়ায় ছায়ায় পথ চলতে চলতে। যেভাবে কত মুখের ঠিকানাই তো হারিয়ে ফেলেছি এই জীবনের পথে পথে….!
আজিজ সুপার মার্কেটে সন্ধ্যার দিকে দেখতে পেলাম বড় ধরণের একটা জমায়েত হয়। আগেও জানতাম ------ তবে নিজেকে খুব একটা ঘেঁসাতে পারিনি সেখানে। পাশে দাঁড়িয়ে চা ও সিগারেট কিনেছি যদিও ---- একটু আধটু কথাবার্তাও কানে নিয়েছি, অথচ তাদের মাঝে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি। কোথাওই উচ্চস্বরে হা হা করতে করতে পারলাম না কেন যে ! সব সময় ভেতরে ভেতরে একটা প্রেম প্রেম খেলার স্বপ্ন-বাসনায় যেন ডুবে থাকতেই ভালবাসি বেশি। এইসব নরকগুলজার ভালোলাগে না কেন যে ?
কেন জানি আজ বারবার মনে হচ্ছে ঈশ্বর মনে হয় একটু কৃপার চোখে দেখেছেন। যদিও আমি কি সেভাবে ডাকতে পারি তাকে ! একটুখানি সচ্ছলতা কে না চায় ? ক'টা দিন একটু সুখ-শান্তিতে কে না চায় থাকতে ? পরিবারের সকলের মুখে একটুখানি নিশ্চয়তার ঢেউ খেলিয়ে দিতে , কে না চায় তাই বলো তো ? অথচ সে বস্তুটি তো কারো অদৃশ্য ছলনায় কেবলই দূরে সরে যেতে থাকে যেন ! তবুও অদ্ভুত একটা বেপার ঘটে বরাবরই দেখেছি --- কোনো সমস্যাই শেষপর্যন্ত আর সমস্যায় থাকে না।
কিন্তু ধার --- হ্যাঁ ---- আবারও ধার ! ধার ছাড়া এদেশে এসে চলার সব দফা তো রফা হয়ে গেছে অনেক আগেই। এ দেশে কেউ থাকতে পারবে না। এক একটা ধাক্কা এসেছে আর দিদিমার শরীর মন খারাপ হয়েছে। আর সে চিঠি লিখেছে কলকাতায় , বলেছে, তোরা শিগগির চলে আয় ------;
আর আসলেই একে একে গাঁয়ের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তের জমি-জায়গা বিক্রি করে দিয়েছে। টাকা ----- একশোয় চল্লিশ ; এই করে করে সমস্তই যখন প্রায় শেষ হয়ে এল, তখন বাকি ওইটুকু ; যার থেকে চলে পুজো, ওইটুকু আর শেষ করতে দিলাম না। পুজো হয়। বছরে একবার দু'বার আসা যাওয়ায় যেটুকু এগোয়, তা ওইটুকুর উপরেই ------ ওটুকু বসত ভিটে, লপ্তের এক একর দেড় একর জমি , বাগান , ওইটুকুই রইলো পড়ে। দিদিমার আর আসা হয় না। তাকে আনার ঝক্কি কয়েক বছর আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থামিয়ে দিয়েছি। সকলেই জানে, সামনে কালীপুজো, এবারে আমার আসার সময় হয়ে এলো। তবু দিদিমার এবারে দেখলাম খুব ইচ্ছা ছিল আসবার।
টাকা পয়সা প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয়, এখানে যারা একটু সচ্ছল হিন্দুধর্মালম্বি, তারা যেন শুধুই ভালো উপার্জনের জন্যই রয়ে গেছে। তাদের ভেতরে দেশের টান কতটুকু সে কথা ভাবতে গেলে যেন একবার থমকে গিয়ে ভালো করে লক্ষ্য করতে হয়, সে বিষয়টা কতখানি খাটি ! এরা যেন সকলেই একটি অর্থের জপের মালা সঙ্গে করে এ ওর দুয়ারে গিয়ে দাঁড়ায় ---জয়গোবিন্দ বলে….।
যেন এ ওকে ছোটো করার একটা ফাঁদ রচনা করে চলেছে অন্তরালে অন্তরালে। এ ওকে নিচু করতে পারলেই শান্তি। বুঝতে পারি না এর আড়ালের আসল রহস্যটা কী।
ঢাকা আর ভালো লাগে না। পালাতে পারলেই বাঁচি যেন ।
চলবে …….
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন