দ্বিতীয় বর্ষ ।। দ্বাবিংশতি ওয়েব সংস্করণ ।। ১ ফাল্গুন ১৪২৮ ।। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২
মানুষ এতখানি ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠার পেছনে কেবলমাত্র মানুষের অমানুষিক কার্যকলাপই দায়ী। সে অতিমারি প্যানডেমিক করোনা হোক বা অন্য কিছু। আসলে মানুষ তার লোভ থেকে কখনোই বেরিয়ে আসতে পারেনি। যার ফলে অন্যের জীবনকে গুরুত্ব না দিয়ে কেবলমাত্র নিজে বাঁচার নেশায় মগ্ন হয়ে থেকেছে সব সময়। কিন্তু পৃথিবীর এই প্রাকৃতিক গঠন এমন ভাবে তৈরি করা রয়েছে যে, এখানে একটার সঙ্গে আরেকটা বিষয় দারুন ভাবে সম্পৃক্ত এবং সম্পর্কযুক্ত। যার ফলে গুরুত্ব না দেওয়া বিষয়গুলো কার্যত পক্ষে নিজের ঘাড়েই এসে নিঃশ্বাস ফেলে শেষমেষ। অন্যকে অবহেলা করতে গিয়ে নিজেকেই অবহেলার শিকার হতে হয় এক সময়।
শিল্পোন্নয়নের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘটে চলেছে ধারাবাহিকভাবে। তথাপি শিল্পপতিরা তাদের লাভের অঙ্ক মাথায় রেখে পরিবেশ বাঁচানোর জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার তার কোনটাই নেয়নি। যার ফলস্বরূপ উষ্ণতা বৃদ্ধির গ্ৰাফরেখাও ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। খরা এবং অতিবৃষ্টিতে পেয়ে বসেছে আমাদের প্রকৃতিকে। আমরা প্রায় প্রতিবছরই তার ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হচ্ছি। শিল্পপতিরাও এর থেকে বাদ থাকছে না। তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নানাভাবে।
গত কুড়ি বছরের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলেও এ বছরের মতো বৃষ্টিপাত লক্ষ্য করা যাবে না। প্রায় সারা বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে অতিবর্ষণ ঘটে চলেছে সপ্তাহে সপ্তাহে। শুকনো হওয়ারও সুযোগ পাচ্ছে না পৃথিবীর মাটি। কৃষকের কৃষিকাজের উপযুক্ত হয়ে উঠছে না কোনভাবেই। কৃষিকর্ম ছেড়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে কৃষকদের। সবজির টান পড়েছে বাজারে। এই টান শুধুই কি একজনের বা একটা বিশেষ শ্রেণীর মানুষের জন্য?
প্রকৃতির উপর নির্যাতন চালিয়ে মানুষ ভুলে গেলেও প্রকৃতি তা কখনোও ভুলে যায়নি। সে সময় মতো ঠিক তার জবাব দিয়ে গেছে এবং যাচ্ছেও। ভবিষ্যতেও দিয়ে যাবে। সেই জবাব বোঝার ক্ষমতা মানুষের থাকুক বা না থাকুক।
রোজগার করার সময়ে মানুষ সব সময় বলে, সে তার সন্তানের জন্য সঞ্চয় করছে। অথচ তার সন্তানের বেঁচে থাকার যে জায়গা তাকে কলুষিত করে তোলার জন্য এতটুকুও কার্পণ্য করছে না। তাহলে কোন জায়গায় বসবাস করে সেই সন্তান তার বহু কষ্টার্জিত সম্পদ ভোগ করবে? এ কথা কি কেউ ভেবেছে তারা?
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
নির্মল হালদার / নিমাই জানা / সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় / শ্রীদাম কুমার / সুজন পণ্ডা / বাঁশি / সুপ্রিয় দেওঘরিয়া / কল্পোত্তম / মধুপর্ণা / তপন পাত্র / দীপংকর রায়
______________________________________________
আঁকাবাঁকা শিকড়ের ছায়া
নির্মল হালদার
১.
জিইয়ে থাকা
আর কতদিন?
আর কতদিন
আধপেটা হয়ে থাকবে নুনা নুনিরা?
এ যে এক হাঁড়ি জলে
মাগুর মাছকে জিইয়ে রাখার মত
জলে হাত নেড়ে নেড়ে দেখতে হয়
মাছটা খেলছে তো?
২.
বিছে
যে যার আব্রু নিয়ে থাকে।
যেমন রূপার বিছা
কোমরেই থাকে
কেউ দেখতে পায়না।
নিমাই জানার তিনটি কবিতা
১.
মাধ্যাকর্ষণ ও ছটফট বারান্দা
ঈশ্বর ক্রমশ জ্যামিতিক হয়ে পড়বেন জলঘোলা রূপান্তর পাথরের মতো ,
আমাদের বাবা তখন প্রোটিনোসুরিয়ায় আক্রান্ত মূলত সংখ্যা
বীজগাণিতিক ধুতির বাঁধন খুলে উড়িয়ে দেবে তিনটি মাধ্যাকর্ষণ কোকিল , কোন সূত্রাকার পরজীবী নেই ছটফট বারান্দায়
তিনটি বিছানার চারপাশে অবিরত বৃত্তাকার ঘুরছে প্রাচীন কিছু অঙ্গুরীমাল আর বৃন্তহীন শ্বাপদের দল ,
সকলের যোজ্যতা
পারদের নিচে দাঁড়ালেই ইসোফেগাস ঈশ্বরকে ক্রমশ অসদ বিম্বের মতো দেখায় ,
কেউ কেউ আত্ম সংহার যজ্ঞপাহাড় দেখেছে অনেক আগে
প্রতিটি পাতাবাহার একটি অচৈতন্য সন্ন্যাসের নাম
বিরজা ক্ষেত্রের পর সুমিত্রা ও আমার পাশে বসে থাকে নির্মল সাবিত্রী হয়ে , কৃষ্ণ তোমার অক্ষর কোথায়
তোমাকে কালো রঙের গ্রাফাইট মনে হয় , অথচ তোমার ঠোঁটে ধাতুর বিষ লেগে আছে
অমৃতসরের আগুন খাও সারারাত ডালিম ফল ভেবে
২.
বিনীত গর্ভকেশর ও মৃৎশিল্পীর চোখ
নৈঋত হাওয়া আর ভ্যাজাইনাল পালক খসিয়ে দেওয়ার পর ঘুমের ঘোরে নিজেরাই সমকোণে দাঁড়াই সন্তানের প্রতিটি ডিম্বাণুহীন উপপাদ্যের উপর,
আমার বাবা চতুর্থ বিবাহ করেছিল এই প্রদ্যুৎ সংসারে নেমে
একটি মরচে রঙের রাত সাইকেল আর তার বিনীত গর্ভকেশর চতুর্মুখী হতে হতে রাত্রিকালীন বিষাদগ্রস্ত হয়ে যায় বিছানার তিনটি রোমান্টিক স্নানঘরে ঢুকে
আমার স্নান ঘরে ধোঁয়া ওঠে দিনরাত , আমার মাথায় তিনটি ছত্রাক ফুটে আছে বিভাজিত মৃৎশিল্পীর মতো
আননেসেসারী উদ্ভিদরা ক্লোরোফরম বিছানা আর নিরাকার নিষেকের পর থ্রি ফিঙ্গার দৈর্ঘ্যটিকে একটি ভ্রূণের প্রস্থান চিহ্ন করে , চরক বৈদ্য উড়িয়ে চলে স্খলন ও মধু
চৈতন্যের নাম কখন অমল আলোক হতে পারে পরজীবীর শরীর ভেঙ্গে, ব্রহ্মার মৃত্যু হয় সহস্রবার সমকোণ বৃক্ষের কাছে
প্রতিটি যুবক গোধূলিকে ডাংগুলি খেলে বাড়ি ফেরে
৩.
ফিজিওলজিক্যাল শুক্রাণু ও আদিম সাধক
পরাশ্রয়ী বাবা আমাদের চেতনা এনে দেওয়ার পর নিজেই উড়ে চলে আকাশের দিকে
পিঠের প্রতিটি স্থানাঙ্ক হলুদ পাপড়ির মতো ঘর্মগ্রন্থিময় বাকলের ভূষণ ,
আমাদের তখনও জ্ঞানচক্ষু খুলেনি মায়ের গর্ভাশয়ে থেকে
প্রতিদিন ভোর বেলায় নৈঋতের ভাত খেয়ে নেমে যায় তৃতীয় পর্যায় সারণির আহত পাখির ঠোঁট ,
ডিম্বাণু ঝরে পড়ে আর আমি আলগা হরিণ হয়ে দৌড়ে বেড়াই পাথরের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায়
আমাদের এখনও সংসার জুড়ে অজস্র বাষ্পমোচন দাগ , জগডুম্বর ও পঞ্চপল্লব জানে প্রতিটি পোশাক ধনুকের মতো মৃত হয়ে ঝুলে আছে নীল সরোবর নিচে জানালার সাথে
মানুষের কতোবার মৃত্যু ঘোরে ঘুমোতে যায় জলখাবার নিয়ে
সহাস্য ফিলোজফিক্যাল ডার্কনেসের শুক্রানুরা দৌড়াতে দৌড়াতে কখন পুরুষ মানুষটি বাবা হয়ে গেল
রাত্রিকালীন বীজমন্ত্রটি আদিম সাধক জানে
বলিনি
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
তোমাকে বলিনি ভালোবাসি।
রোদের কিরণ-সুতো জানালার
পা চেপে ধরে। গোড়ালিতে
গোধূলির জং। রং মাখে সময়ের সং।
ছড়ানো তাসের মত পড়ে থাকে দুর্-
ঘটনার আখ্যান-বিন্যাস। চুলের দলার
মত মাটি ছোঁয় ভুলে যাওয়া ক্রোধ।
কথাসার খাওয়া শেষ হয়। ঢেঁকুর।
মাছি খায় এঁটোর বরাৎ। অনুরোধ
অনুযোগ অনুরাগ শ্যাওলা জমা
বালিশের, তোষকের খাঁজে।
নক্ষত্র খসে পড়ে ঠোঁটের কোনায়।
কপালের আল ভাঙে স্মৃতির কর্ষণ।
চোখের গাঙুড়ে জল ছলছল ছলাৎ
মান্দাস বয় বানভাসি...
বলতে পারিনি ভালোবাসি।
কক্ষচ্যুত
শ্রীদাম কুমার
মৃদুল কান্নার অ্যালবাম
জমে আছে কত।
অলিগলি খুঁজে ফেরে
ডাইরির পাতা ....
কুয়াশার আড়ালে ঢেকে যাওয়া মুখ ,
সামনে কী আর আসবে কখনো ?
কবিতার জন্য
সুজন পণ্ডা
শুধু কবিতার জন্য
নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকেছি দিগন্তের দিকে
কান পেতে শুনতে চেয়েছি
ফুল ফোটার শব্দ।
শুধু কবিতার জন্য
দু হাতে ভর্তি
ফসফরাস উড়িয়ে দিয়েছি
জোনাকির দিকে তাক করে।
কিছু কবিতা বসেছে
আমার অসুস্থতার পাশে,
বুকের ব্যথার মত লেগে আছে কেউ।
কয়েকটি কবিতা হয়েছে
অভিমানী ছায়ার মত,
নিশ্চুপ সহযাত্রী ।
পলাশ
বাঁশি
জাড়ের চাদর
আড়ের পিরিত
খুঁজে ফেরে কবোষ্ণ উত্তাপ।
পলাশের মনে মনে ফাগুন।
ফাগুন রাধারও বুকে ।
মাঠার বন থেকে অযোধ্যার মন পায়
পলাশের শিকড়।
পলাশ, তবু ফুল ফোটাবে।
সুপ্রিয় দেওঘরিয়া
অপত্য ৩৮
অনেক কথা রাখা আছে তোর কাছে,
তাই তুই যখন কথা বলিস
আমি ছন্দ খুঁজে পাই।
কথাগুলো আমাকে আনন্দ দেয়,
আনন্দরাগে আমি নিজেকেই খুঁজি।
তোর মধ্যে দেখি চাঁদের মিষ্টি আলো,
চুঁইয়ে পড়ে খেজুর পাতায়,
ছায়া ফেলে দীঘির শান্ত জলে।
অপত্য ৩৯
মধুর আলিঙ্গনে তোর কোমল শরীরে
জড়িয়ে যায় আমার ভালোবাসা।
এই স্পর্শসুখে আছে জন্মান্তরের টান।
আমি তাই বহুজন্মে বিশ্বাসী।
তোর কাছে রাখা আছে আমার
আগামী দিনের গল্প -
আমি অদৃশ্য তারার মতো
এক আকাশ চলার পথ।
অপত্য ৪০
অপত্য আকাশ ছেয়ে আছে
অজানাকে জানার কৌতূহল,
অপত্য আকাশময় পাখি ওড়ে,
গান গায়, ভোরের বাতাসে ফুলের রাশি।
আমি আকাশের নীচে
মাথা তুলে দেখে যাওয়া একটি তৃণ।
অপত্য ৪১
আলোয় ভরেছে চারদিক
শুধু আলোর কথা বলি।
আলোর ছবি লিখি,
আলোর গান গাই।
আলো দেখিয়ে নিয়ে যাস তুই।
আমার সব দুঃখ দৈন্যতায়
তাইতো তুই চাঁদ, তুই সূর্য-
প্রতিদিন ঘুম ভাঙানো
অনিঃশেষ আলো।
অপত্য ৪২
তুই আমার আনন্দ ভৈরবী,
সুরের বাঁশি, সুরেলা কোকিল,
মন্দ্র তারের আলাপ,
তারস্বরেরে উচ্ছাস,
আর মাঝামাঝি তান-বিতানের খেলা।
সন্ধায় ইমনের সুরে
তোর কল্যাণ চেয়েছি শুধু-
শ্রাবণ দিনের জাতাক তুই
আমার বিশুদ্ধ মল্লার।
রাত জাগা পাখি
কল্পোত্তম
সূর্য ঢলে পড়তেই
পা পড়ে আমার আঙিনায়
সূর্য ওঠার আগেই
চলে যাও বিদায় নিয়ে
সারা রাতের পরিশ্রমে
ঘুমিয়ে পড়ো সারাটা দিন
তুমিই আমার রাত জাগা পাখি
ডানায় ডানায় ঢেকে রাখো
বেদনার সাত কাহন।
তোমার গল্প শুনবে বলে
জেগে থাকে পেঁচা
জেগে থাকে সপ্তর্ষিমণ্ডল
ছায়াপথ, নিশিপালক;
তোমার গল্প শুনবে বলে
জেগে থাকে জোনাকি জননী।
তুমি দিক চেনাও
চেনাও পথ, মেরুগমনের।
বাইরে নৈঃশব্দ, ভিতরে হৈ চৈ
মধুপর্ণা
দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউন তখন। বাইরে নৈঃশব্দ, ভিতরে হৈ চৈ। হঠাৎ খবর পাওয়া গেল একজন গৃহবধু 'পালিয়ে গেছেন'। কোথা থেকে কোথায় পালিয়েছেন? পরিবারের 'সুরক্ষিত', 'নিরাপদ' আশ্রয় ছেড়ে বাইরের বধ্যভূমিতে। তিনি কোথাও যান নি, কোথাও পৌঁছোন নি, তিনি পালিয়ে গিয়েছেন। একা। অথবা নিজে। একা একা পালিয়ে গেছেন--- বলছিল একজন। কানে অনুবাদ হয়ে বাজল-- নিজে স্বেচ্ছায় চলে গেছেন। মৃনালকে মনে আছে ? ‘স্ত্রীর পত্র’ এর মৃনাল । চলে গিয়েছিল 'চরণতলাশ্রয়ছিন্ন' করে। আর এই গৃহবধু, সারাজীবন যিনি কোনদিন বাইরে 'একা' যান নি। ঘরকন্নার কাজ সামলে উচ্চবর্ণীয় উচ্চবর্গীয় পরিবারটির সামাজিক উন্নাসিক সম্মান ধুনো দিয়ে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন, স্বামী পুত্রদের ভীড়ে প্রায় অদৃশ্য হয়ে বেঁচে ছিলেন (হয়তো)। সেই তিনি হঠাৎ ‘পালিয়ে গিয়ে’ খবর হলেন, হলেন আলোচ্য বিষয়।
কেউ বলল-- মাথা ঠিক নেই। কেউ বলল-- কোথায় আর যাবে! গোয়ালের গরু ঠিকই ফিরে আসে। কেউ বলল-- আগে একবার মরতে গেছিল, এবার পালিয়েছে। কেউ বলল-- বিবেচকের মত কাজ এটা হল? পরিবারের মান সম্মানের কথাটা একবার ভাবল না বাড়ীর “বড় বৌ” হয়ে!? কেউ বলব-- পাগল তো ! আমি আগেই জানতাম, গন্ডগোল আছে মাথায়। কেউ কেউ বেজায় খুশি হল পরিবারের 'সম্মান’ টি তো গেল! যাক। খানিকটা তৃপ্তি। আগে গ্রামের মোড়ল 'জাত মেরে' যেমন তৃপ্ত হতেন, সেইরকম একটা ঢং মুখে খেলছিল তার আর চোখে ছিল পৈশাচিক একটা আনন্দ। পরিবারটির কর্তার সঙ্গে পুরোনো বিবাদের খানিকটা শোধ যেন এমনিতেই মিটে গেল। মাথার উপর ভগবান আছেন কিনা!
কিন্তু যিনি চলে গেলেন, তার চলে যাওয়ায় দুঃখের থেকে ক্রোধ হল সবার। প্রচন্ড ক্রোধ। ফিরে এলে নিশ্চয় তাকে দেখে নেওয়া হবে। যে কারনে তিনি চলে গেছেন তা বেড়ে যাবে বেশ কয়েক গুন। চলে যাওয়া আসলে সবার কাছে ধরা দিল 'পালিয়ে যাওয়া' হয়ে। আর সারাজীবনের শক্তি সঞ্চয় করে তিনি যে সাহসী কাজটা করলেন তা ছড়িয়ে পড়ল ‘কেচ্ছা' হিসাবে।আরও পড়ুন
ছো নাচের বাদ্যযন্ত্র
তপন পাত্র
শিল্পচর্চায় সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে । রামায়ণ , মহাভারত এবং বিভিন্ন পুরাণেও তার উল্লেখ আছে । বাদ্য ছাড়া নৃত্য-গীত কিছুই সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয় না । মানবশরীরের যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে কাজে লাগে সেগুলি হল -- হাত, পা ,জিভ, ঠোঁট, গাল, বগল ইত্যাদি । পণ্ডিতেরা বলেন, আগে সঙ্গত অর্থাৎ বাদ্য , তার পর সঙ্গীত , নৃত্য । নাচ -গান -বাজনা --- এই তিন কলার জন্যই বাদ্যযন্ত্রের বিভিন্ন প্রকার সৃষ্টি ও তার ক্রমবিকাশ ঘটে চলেছে আজও ।
সঙ্গীত শাস্ত্র অনুসারে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রকে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয় । এগুলি হল ---
(১) ততবাদ্য :— যে সকল বাদ্যযন্ত্রে তার থেকে ধ্বনি উৎপত্তি হয় , অর্থাৎ তারে আঘাত করে স্বর উৎপাদন করা হলে সেই সকল বাদ্য যন্ত্রকে ততবাদ্য বলে । ততবাদ্য আবার দু’রকম । যথা--- (ক) তবাদ্য এবং (খ) বিতবাদ্য ।
যে সকল তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্রে অঙ্গুলি, মিজরার দ্বারা আঘাতের ফলে ধ্বনি উৎপন্ন হয় সেগুলিকে তবাদ্য বলে । যেমন— তানপুরা, সেতার ,সরোদ,বীণা প্রভৃতি ।
আর যে সকল তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্রে ছড় বা ছড়ি বা ধনু দ্বারা আঘাত বা ঘর্ষণের ফলে ধ্বনির উৎপত্তি হয় তাকে বিতবাদ্য বলে । যেমন--- বেহালা, সারেঙ্গী, দিলরুবা ইত্যাদি ।
(২) সুশির বাদ্যযন্ত্র--- যে সকল বাদ্যযন্ত্র বাঁশ, কাঠ ও বিশেষ ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয় এবং তা থেকে স্বাভাবিক বাতাস অথবা মুখের ফুঁ দ্বারা ধ্বনির উৎপত্তি করা হয় তাকে সুশির বাদ্যযন্ত্র বলে । যেমন— সানাই, মদন ভেরি , বাঁশি, ফ্লুট, হারমোনিয়াম ইত্যাদি ।
(৩) অনবদ্ধ বা আনদ্ধবাদ্য— যেসব বাদ্যযন্ত্র চামড়া দ্বারা আচ্ছাদিত এবং চামড়ার উপর হস্তাঙ্গুলি অথবা কাঠের দন্ড দ্বারা আঘাতের ফলে ধ্বনির উৎপত্তি হয় তাকে অনবদ্ধ বা আনদ্ধবাদ্য বলে। যেমন— শ্রীখোল, বাঁয়া- তবলা , মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ, ঢোল, ধমসা , চেড়েপেটে, ঢাক ইত্যাদি ।
(৪) ঘনবাদ্য— যেসব বাদ্যযন্ত্র ধাতুনির্মিত অর্থাৎ পিতল, কাঁসার তৈরি, যেগুলিতে ধাতুগত আঘাতের ফলে ধ্বনির উৎপত্তি হয় , অথবা কোন আঘাত না করে শুধু ঝাঁকুনি দিয়েই ধ্বনি উৎপাদন করা হয় ,তাকে ঘনবাদ্য বলে। যেমন— করতাল, মন্দিরা, জলতরঙ্গ, ঝুমকা বা মেরাকস, ঘুঙুর, কাঁসর-ঘন্টা প্রভৃতি ।
পুরুলিয়ার ছো নাচে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র গুলি হল --- ঢোল, ধম্ সা , চেড়েপেটে বা চেড়েপেটি, সানাই ঝুমকা, ঘুঙুর, মদন ভেরী ,ট্রাম্পেট, অর্গান ইত্যাদি । এছাড়া সরাইকেল্লা ও ময়ূরভঞ্জের ছো নাচে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলি হল -- মৃদঙ্গ , বাঁশি , বেহালা, সেতার , শঙ্খ প্রভৃতি । এখন ছোনাচে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র গুলি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করা যাক ।
ধমসা :---
""""""""""
ধমসা একটি অতি প্রাচীন লৌকিক বাদ্যযন্ত্র । ছো নাচ , ঝুমুর নাচ, দাঁড় নাচ, করম নাচ ,বিভিন্ন সাঁওতালী নাচ প্রভৃতিতে এই যন্ত্রটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড এবং উড়িষ্যার গ্রামগঞ্জের নাচে-গানে বাদ্যযন্ত্রটির বহুল ব্যবহার । ছোট থেকে বিশালাকার বিভিন্ন ধরনের ধমসা লক্ষ্য করা যায় । তবে অন্যান্য নৃত্য-গীতে ব্যবহৃত ধমসার তুলনায় ছোনাচে ব্যবহৃত এই যন্ত্র সবচাইতে বড়ো । যেমন আকারে বৃহৎ তেমনি এর শব্দধ্বনিও কর্ণ বিদারক । বৃহৎ এই ধমসা একজন বাদক অথবা কখনো কখনো দু'জন বাদক একজোড়া করে কাষ্ঠ দন্ড নিয়ে ধ্বনি বা বোল তোলে । এই বাদ্যযন্ত্রটি ঢোল অথবা মাদলের সহযোগী যন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয় । একটি উন্নত মানের ধমসার আওয়াজ ঝোপ-জঙ্গল , ডুংরি-টিলা ভেদ করে প্রায় দশ কিলোমিটার এলাকায় শব্দ বিস্তার করে ।
ধামসার বিভিন্ন অঙ্গের :---
(১) কুঁড়ি বা খোল -- ধমসার প্রধান অঙ্গটি কুঁড়ি বা খোল নামে পরিচিত । সাধারণত খন্ড খন্ড লোহার পাত রিপিট দিয়ে সংযুক্ত করে এই খোলটি তৈরি করা হয় । কর্মকারেরা এই খোল তৈরির কাজটি সম্পন্ন করেন , আকৃতিতে খোলগুলি অনেকটাই প্রসারিত চোঙের মতো দেখতে । রুহিদাসেরা পশুর চামড়াকে সুর উৎপাদনের উপযোগী করে তুলে এই খোল ছাউনির পুরো কাজটি করে থাকেন । ধমসার গোলাকার মুখটির ব্যাস বিভিন্ন মাপের হয়ে থাকে ।
(২) ছাউনি -- ধমসার মুখটি মূলত মোষের চামড়া দ্বারা ঢাকা থাকে । মৃত মোষের চামড়া সংগ্রহ করে এনে বিশেষ পদ্ধতিতে সেটিকে বাদ্যযন্ত্রের উপযোগী রূপে গড়ে তোলা হয় ।
(৩) বাধি -- ছাউনির মুখ থেকে খোলের পিছন পর্যন্ত অর্থাৎ আগাগোড়া চামড়া কেটে তৈরি করা সরু ফিতের বিনুনি থাকে । চামড়ার এই ফিতের লৌকিক নাম বাধি ।
(৪) ডোরাগাঁথনী --- ছাউনির প্রান্তদেশে চামড়ার তৈরি মালার মতো একটা বিনুনি থাকে । এই বিনুনিটিকে ডোরাগাঁথনী বলে । যে অংশটি বাদ্য হয় সেই ছাউনির চামড়াটিকে শক্তভাবে খোলের সঙ্গে জুড়ে রাখার সহায়ক এটি ।
(৫) বিঁড়া -- ধমসার নিচের দিকে চামড়ার তৈরি মালার মতো বিনুনি দেখতে পাওয়া যায় , এর নাম বিঁড়া । ছাউনির চামড়াটিকে সুন্দরভাবে খোলের সঙ্গে জড়িয়ে রাখার জন্য বিঁড়াটির প্রয়োজন হয় ।
(৬) থরহরি -- ধমসার মুখের বিপরীত দিকে অর্থাৎ শেষ প্রান্তে একটি ছোট্ট ছিদ্র থাকে । এই ছিদ্রটিকে কেন্দ্র করে বিঁড়ার নিচ পর্যন্ত যে চামড়া দ্বারা খোলটিকে আবৃত রাখা হয় , তাকে বলে থরহরি ।
(৭) আংটা ও ডোর -- খোলের মুখ থেকে প্রায় তিন ইঞ্চি নিচে দু'দিকে দু'টি লোহার তৈরি রিং আটকানো থাকে খোলের গায়ে । এই রিংগুলিকে বলে আংটা । দুটি আংটার সঙ্গে সুতোর তৈরি ফিতে বেঁধে দেওয়া হয় । এই ফিতেটির নাম ডোর । এগুলির সাহায্যে বিশাল আকারের বাদ্যযন্ত্রটি বহনের সুবিধা হয় এবং ছোট আকারের বাদ্যযন্ত্র হলে বাদ্যটিকে বাদ্যকার কাঁধে ঝুলিয়েও বাজাতে পারেন ।
(৮) বিড়ি বাঁজ -- বাঁধি টান দেওয়ার পর অতিরিক্ত অংশটিকে পাশে টান দেওয়া বাধি গুলির সঙ্গে পিছিয়ে রাখা হয়, যাকে বলে ববিড়ি বাঁজ ।
ঢোল :--
"""""""""""
ঢোল বাংলার একটি জনপ্রিয় লোকবাদ্য । ঝুমুর , টুসু গান, জাঁত মঙ্গল, দাঁ'ড় নাচ, করম নাচ প্রভৃতি নৃত্য ও নানান সঙ্গীতে এই বাদ্যযন্ত্রটি ব্যবহৃত হয় । এটি একটি অত্যন্ত প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র । রামায়ণে, মনসামঙ্গলে এই বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে । এর দুই মুখ দুই হাত দিয়ে বাজাতে হয় । কখনো কখনো বামদিকে বাঁশের সরু কাঠি দিয়েও বাজান ওস্তাদেরা । ছো নৃত্যে অবশ্য কাঠির ব্যবহারই অধিক । ঢোলের ডান দিকের আওয়াজ বেশ তীক্ষ্ণও মধুর এবং বাম দিকের আওয়াজ গম্ভীর ।
ঢোলের বিভিন্ন অঙ্গের বর্ণনা :---
(১) খোল ---ঢোলের খোল তৈরি হয় কাঠ দিয়ে । গামার, কাঁঠাল , আম প্রভৃতি গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি হয় ঢোলের খোল । খোলের দৈর্ঘ্য সাধারণত এক ফুট দশ ইঞ্চি থেকে দু'ফুটের মতো । খোলের ভিতর দেশ ফাঁপা হয় । বামপাশের পরিধি ২.৭০ বর্গফুট । মধ্যভাগের পরিধি চার ফুট এবং ডান প্রান্তে পরিধি ২.৩৫ বর্গফুট। বামদিকের মুখের চেয়ে ডান দিকের মুখ কিছুটা বড়ো । তবে ঢোল যে সব সময় একই মাপের হবে, এমন কোন কথা নেই।
(২) ছাদন বা ছাউনী --- ঢোলের মুখ যে চামড়া দ্বারা আবৃত থাকে, তাকে বলা হয় ছাদন বা ছাউনী । ঢোলের দুই মুখের ছাউনিতে সাধারণত ছাগলের চামড়া ব্যবহৃত হয় । বামদিকের চামড়াটি পুরু এবং ডান দিকের চামড়াটি তুলনামূলকভাবে পাতলা ।
(৩) বিঁড়া ও চাক -- ঢোলের বাম দিকে মুখটিতে এক ইঞ্চি ব্যাসের চামড়ার তৈরি গোলাকার যে বস্তুটি সংযুক্ত থাকে তার নাম বিঁড়া । অনুরূপভাবে ডানদিকে লোহার পাত দিয়ে তৈরি একটি গোলাকার বস্তু থাকে এর নাম চাক । চাকটির চতুর্দিকে সমদূরত্বে ১১টি বা ১৩টি ছিদ্র থাকে । এই ছিদ্রগুলিতে বাধি পরানো হয় ।
(৪) বাধি -- মোষ বা গরুর চামড়া থেকে আধ ইঞ্চি প্রস্থের লম্বা ফিতার মতো যে জিনিসটি তৈরি করা হয় তাকে বলে বাধি । বিঁড়া ও চাকের ছিদ্রে এই বাধি পরিয়ে ছাউনি কে টান দেওয়া হয় ।
(৫) কড়া --- দুটি বাধির অন্তর দু'টি বাধির মধ্যে লোহা বা পিতলের তৈরি সাধারণত দেড় ইঞ্চি ব্যাসের রিং পরানো থাকে । এই রিংগুলিকে বলা হয় কড়া । সুর ওঠানামা করার জন্য কড়াগুলির ব্যবহার করা হয় ।
(৬) রূপসী বা পাতি --- ছাউনির চামড়া দ্বারা আবৃত গোলাকার লোহার চাকের মুখ বরাবর এক ইঞ্চি প্রস্থের লাল রঙের যে চামড়াটি দেখা যায়, তাকে বলা হয় রুপসি বা পাতি ।
(৭) দোয়াল ও নাসা -- ঢোলকে গলায় ঝুলিয়ে বাজানোর জন্য সুতোর তৈরি ফিতে ব্যবহার করা হয় । এই ফিতেটিকে আঞ্চলিক ভাষায় দোয়াল বলে । ফিতের দুই প্রান্ত বাঁধার জন্য বাদির তৈরি গোলাকার বস্তুর নাম নাসা ।
চেড়েপেটে :--
"""""""""""""""""""
চেড়েপেটে বা চেড়পেটি নামক বাদ্যযন্ত্রটি সম্প্রতি অবলুপ্তির পথে । এই যন্ত্রটি সুদীর্ঘকাল ঢোলের সহযোগী বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে এসেছে । বর্তমানে স্টিল ও ফাইবারের তৈরি টাসা নামক বাজারজাত বাদ্যযন্ত্রটি এসে যাওয়ায় চেড়পেটির কদর কমে গেছে ।
চেড়পেটির অঙ্গ বর্ণনা :---
(১) খোল --- চেড়পেটির খোলটি মাটির তৈরি । কুমোরেরা কাঁচামাটির খোল আগুনে পুড়িয়ে এটি তৈরি করেন । এর আকার অনেকটা রান্নাবান্না করবার কড়াইয়ের মতো । মুখটির ব্যাস প্রায় এক ফুটের মতো হয়ে থাকে ।
(২) ছাউনি -- খোলের মুখটিকে যে চামড়া দিয়ে ঢাকানো হয় তাকে বলা হয় ছাউনি । ছাউনির চামড়া হিসাবে সাধারণত ছাগলের চামড়া ব্যবহৃত হয় ।
(৩) কুঁড়ল্ --- খোলের ব্যাস বরাবর বাঁশের তৈরি একটি কুণ্ডলী থাকে ,যা ছাউনির প্রান্তদেশের চামড়া দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয় , এর নাম কুঁড়ল্ ।
(৪) বিঁড়া -- খোলের নিচের দিকে কয়েকটি বাধিকে পাক দিয়ে গোলাকার ভাবে বসানো হয় , এই গোলাকৃতির বস্তুটির নাম বিড়া ।
(৫) বাধি -- ছাউনির শেষপ্রান্তে কুঁড়ির পাশাপাশি চারদিকে ছোট ছোট ছিদ্র করা থাকে । এই ছিদ্র ও বিঁড়ার মধ্যে ফিতার মতো সরু চামড়া দিয়ে পেঁচিয়ে ছাউনিকে টান দেওয়া হয় ,টান দেওয়া সরু চামড়াটি কে বলা হয় বাধি ।
সানাই :---
"""""""""""'''''''
সানাই হলো এক ধরনের বাঁশি । সানাইয়ের লৌকিক নামটি পেঁপটি । এর সুর অত্যন্ত তীব্র । ঢোল , ধমসার আওয়াজকেও এই স্বর গ্রাহ্য করে না । ঢোল, ধমসার গুরুগম্ভীর আওয়াজ সানাইয়ের স্বরকে ঢেকে দিতে পারে না । ঝুমুর, টুসু সঙ্গীত, নাটুয়া নাচ, ছো নাচ ---সমস্ত কিছুতেই সানাই এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় । সাধারণভাবে গ্রাম গঞ্জের ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ এই যন্ত্রটি বাজানোতে সবিশেষ পটু ।প্রত্যেকটি ছো নাচের দলে দু'জন সানাইবাদক থাকেন ।
সানাইয়ের অঙ্গ বর্ণনা :---
(১) সানাইয়ের কাঠ -- সানাইয়ের মূল কাঠামোটি কাঠের তৈরি । এর দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে সাত ইঞ্চি । কুড়চি, কুল, কেন্দ, গামার, সেগুন প্রভৃতি কাঠ থেকে ছুতোরের কাঠামোটি তৈরি করেন । অন্যান্য বাঁশীর মতোই এরও ভিতরটি ফাঁপা । কাঠটির উপরিভাগে পরপর সাতটি ছিদ্র থাকে । এ গুলিকে বলা হয় রিড বা টিপ ।
(২) ফের -- কাঠটির শেষ প্রান্তে চুঙ আকৃতি ধাতুর তৈরি একটি বস্তু লাগানো থাকে , এই বস্তুটির নাম ফের । ফেরটি লম্বায় থাকে তিন ইঞ্চি এবং মুখটির ব্যাস তিন ইঞ্চি থেকে সাড়ে তিন ইঞ্চি । যদিও বাঁশির আকারের কমবেশি হতেই পারে , এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট বাঁধাধরা দৈর্ঘ্য নেই ।
(৩)কাহলি -- সানাইয়ের মুখটির দিকে দুই ইঞ্চি লম্বা এবং সরু পিতলের তৈরি অংশটির নাম কাহলি ।
(৪) জিহ্বা -- কাহলির মুখটিতে চারটি তালপাতার টুকরো একসঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় । একে বলা হয় জিহ্বা । এই জিহ্বাতে ফুঁ দিয়ে সানাই বাজানো হয় ।
এই সমস্ত বাদ্যযন্ত্রগুলো এছাড়াও ছো নাচের অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রগুলি হল ঘুঙুর, মদন ভেরী, অর্গান, মৃদঙ্গ, শ্রীখোল, বাঁশি, বেহালা সেতার, শঙ্খ, কর্নেট ইত্যাদি ।
(বাদ্যযন্ত্রের ছবি : তপন পাত্র)
________________________________________________
ঔপন্যাসিক দীপংকর রায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস---
"জলশ্যাওলার বিরহকথা" --- এবার ত্রয়োদশতম পর্ব
________________________________
জলশ্যাওলার বিরহকথা
দীপংকর রায়
একার যা তা তো স্বার্থপরের। সেখানেও কি দু'জন আছে কিছু?
তাহলে, তার পরেও যা যায়, তাতে কি নিয়োজিত হন সেই মহান ? যদি তা নিরাকারের, তাহলে সে তো সেই অসীমেই ধাবমান ---- তা তো অসীমে যায়, সে সব তো তাহলে সবই সেই মহানের ;
ভাবছি, এতটা উপরে তাকে ওঠাই কী করে? সে সব কি আমার চোখেরই ভাষা শুধু ; তার সবটুকু কি সেই আক্ষেপেই ধরা দিয়ে থাকলো!
যদি এসব কিছুর প্রকৃত কোনো অর্থ থাকে তাহলে সে তো কোনো কিছুই ভ্রুক্ষেপ করছে না ! যে ভাব রসে ডুবতে চাইছি আমি।
তাহলে কোথায় লুকিয়ে আছে সেই অর্ঘ্যের ভাষা? সত্যিই কি কিছু প্রাপ্য ছিল কোথাও কিছু!
সেই জন্যেই তো মনে মনে বলতে ইচ্ছে করে, হে অপদার্থ, এই সহজ জিনিসটাকে কেন এত জটিল করছ? সব স্থিতিস্থাপকতাতেই তো এই জীবন; এইটুকু সংঘর্ষ নিয়েই তো বেঁচে থাকা।
তাহলে আর কান্না কিসের এত?
বাঃ! কান্না থাকবে না! সবেরই কান্না থাকবে। আপন আপন কান্না সেসব। খুব গোপোনের সে সব ; এই অ-আলাপচারী মন নিয়ে কি করবে তুমি? যা কিছুর জন্যে এই ঘুরে চলা, তাহলে সেসবের প্রাপ্তি শুধুই চোখের জল? চোখের জলেই কি সব শেষ হবে বারবার ?
কে যেন আড়াল থেকে বলছে, স্থির হও হে, একটু স্থির হয়ে এই পথক্লান্তি ভুলে যাবার চেষ্টা করো এবারও। ভুলে যাও না তোমার চারপাশে কিছু ছিল যে ; ওই অসীম শূন্যের দিকে তাকাও একটু ; এই অন্ধকার আকাশের দিকে চাও একবার ; চাও সেই দিকে, যা তোমার একমাত্র পাথেয়। ফেলে যাও শুধুই স্মৃতি, কেউ যদি সেই পথ মাড়াতে আসেই কখনো ;সে ভাবুক, এরপরের ভাবনা তুমি সেই দ্বিতীয় জনের জন্যে তুলে রেখে যাও আজ ----
ভাববার আশা তাহলে রাখো তুমি? কী ভাববে কে? কেউ কি কারো ভাবনায় ডোবে কখনো? এসব সব তো আপন আপন আনন্দ অশ্রু--- যা অহেতুক দ্বিতীয় জনের বলে ভেবে ভেবে আমরা সাময়িক একটা প্রশান্তি পাই। মনে মনে ভাবি, আহা, কত অন্তরঙ্গ মূর্ছনা এসব আমাদের!
এসব নাটকের মহড়ায় আমরা সকলেই কম বেশি ধরা খাই। তাই এই নিয়ে বেশি না ভেবে বলো, কে একজন জল চেয়েছিল দু'হাত পেতে ; জীবনের জল, সে কি আঁজলা ভরা জল চাওয়া ছিল?
তাহলে শুধুমাত্র জল চেয়ে সে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছে?
এত কৃপন তুমি! আরও পড়ুন
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের ছবি : প্রকাশ কর্মকার( আন্তর্জাল)
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com







অসাধারণ সংখ্যা। অনবদ্য রচনাশৈলী।
উত্তরমুছুন