জলশ্যাওলার বিরহকথা
জলশ্যাওলার বিরহকথা
দীপংকর রায়
১৩ তম পর্ব
একার যা তা তো স্বার্থপরের। সেখানেও কি দু'জন আছে কিছু?
তাহলে, তার পরেও যা যায়, তাতে কি নিয়োজিত হন সেই মহান ? যদি তা নিরাকারের, তাহলে সে তো সেই অসীমেই ধাবমান ---- তা তো অসীমে যায়, সে সব তো তাহলে সবই সেই মহানের ;
ভাবছি, এতটা উপরে তাকে ওঠাই কী করে? সে সব কি আমার চোখেরই ভাষা শুধু ; তার সবটুকু কি সেই আক্ষেপেই ধরা দিয়ে থাকলো!
যদি এসব কিছুর প্রকৃত কোনো অর্থ থাকে তাহলে সে তো কোনো কিছুই ভ্রুক্ষেপ করছে না ! যে ভাব রসে ডুবতে চাইছি আমি।
তাহলে কোথায় লুকিয়ে আছে সেই অর্ঘ্যের ভাষা? সত্যিই কি কিছু প্রাপ্য ছিল কোথাও কিছু!
সেই জন্যেই তো মনে মনে বলতে ইচ্ছে করে, হে অপদার্থ, এই সহজ জিনিসটাকে কেন এত জটিল করছ? সব স্থিতিস্থাপকতাতেই তো এই জীবন; এইটুকু সংঘর্ষ নিয়েই তো বেঁচে থাকা।
তাহলে আর কান্না কিসের এত?
বাঃ! কান্না থাকবে না! সবেরই কান্না থাকবে। আপন আপন কান্না সেসব। খুব গোপোনের সে সব ; এই অ-আলাপচারী মন নিয়ে কি করবে তুমি? যা কিছুর জন্যে এই ঘুরে চলা, তাহলে সেসবের প্রাপ্তি শুধুই চোখের জল? চোখের জলেই কি সব শেষ হবে বারবার ?
কে যেন আড়াল থেকে বলছে, স্থির হও হে, একটু স্থির হয়ে এই পথক্লান্তি ভুলে যাবার চেষ্টা করো এবারও। ভুলে যাও না তোমার চারপাশে কিছু ছিল যে ; ওই অসীম শূন্যের দিকে তাকাও একটু ; এই অন্ধকার আকাশের দিকে চাও একবার ; চাও সেই দিকে, যা তোমার একমাত্র পাথেয়। ফেলে যাও শুধুই স্মৃতি, কেউ যদি সেই পথ মাড়াতে আসেই কখনো ;সে ভাবুক, এরপরের ভাবনা তুমি সেই দ্বিতীয় জনের জন্যে তুলে রেখে যাও আজ ----
ভাববার আশা তাহলে রাখো তুমি? কী ভাববে কে? কেউ কি কারো ভাবনায় ডোবে কখনো? এসব সব তো আপন আপন আনন্দ অশ্রু--- যা অহেতুক দ্বিতীয় জনের বলে ভেবে ভেবে আমরা সাময়িক একটা প্রশান্তি পাই। মনে মনে ভাবি, আহা, কত অন্তরঙ্গ মূর্ছনা এসব আমাদের!
এসব নাটকের মহড়ায় আমরা সকলেই কম বেশি ধরা খাই। তাই এই নিয়ে বেশি না ভেবে বলো, কে একজন জল চেয়েছিল দু'হাত পেতে ; জীবনের জল, সে কি আঁজলা ভরা জল চাওয়া ছিল?
তাহলে শুধুমাত্র জল চেয়ে সে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছে?
এত কৃপন তুমি!
----- না তোমরা?
তোমরা কেউ কাউকে কিছু উজাড় করে দিতে পারো না যেন ; চাইতে কি পারো কিছু ঠিকঠাক? সে কথাটাই বলো না কেন; বলো না, ভেবেছ কি কখনো ?
তাহলে এতক্ষণের সব ভাবনাই শিল্পীত সুষমা এক?
এসব সবই শিল্পের খেলা শুধু!
চব্বিশে কার্তিক থেকে তিরিশে অঘ্রাণ---- এতগুলি দিনলিপির পাতা উলটে সে কি পেল তাহলে? কি কি করেছে, কি কি ভেবেছে, শুধু এইটুকুই !
তাহলে পরিষ্কার কি হিসেব খুঁজে পেল কে? সে কি কিছু খুঁজে পেলো? না কি শুধুই পাতার পরে পাতা উলটে ক্লান্তিই উঠে এলো!
কোথাও ভালোলাগা, কোথাও অবসাদ, কোথাও মুগ্ধতার অবসাদ, কোথাও নিজের প্রতি ঘৃণা, দুর্বলতার নানা দিকগুলো নিয়ে এলোমেলো হতে হতে দমবন্ধ অবস্থায় এই ঘরের ভেতরে পায়চারি করলো শুধুই?
ঘরের ভেতরটা শুধুই তামাক পোড়া গন্ধে ভরিয়ে তোলা হলো। একনাগাড়ে অক্ষরগুলির দিকে চেয়ে চেয়ে একটা দমচাপা ভাব নিয়ে তাই ঘরের মধ্যে পায়চারি করলো কিছুক্ষণ। আবারও আর একটি গোল্ডলিভ বের করে ধরালো। এরপরেই দরজাটা আস্তে করে খুলে উঠোনে নেমে দাঁড়ালো। সদর দরজা খুলে বাইরে যাবারও ইচ্ছা জাগলো। কিন্তু পারলো না খুলতে সদর দরজাটি । মনে হলো যদি আওয়াজ হয় খুব বেশি ; তাহলে তো সর্বনাশ সব। মাঝরাতে জামাইকে কি ভূতে পেয়েছে নাকি। এসব ভাবনা একটুও অবান্তর না। তাই উঠোনের উপরেই এলোমেলো ঘুরতে লাগলো। পশ্চিমের টিনের ঘরটির দিকে বারকয়েক চেয়ে সাথির ঠাকুমার কথা মনে পড়লো।
পথিক সাথির ঠাকুমার কথা ভাবতে গিয়ে এ বাড়ির অন্যান্য মানুষগুলির কথাও বারকয়েক ভাবতে চাইলো। তাদের নানা মানসিক গড়নের কথাগুলিও। কিন্তু যতবার ভাবতে গেল ততবারই মনে হলো যৌথ পরিবারের এমন কতো জটিলতাই তো থাকে, তাছাড়া এত বড় একটি পরিবার, ন ন ভাই এরা। তাদের একমাত্র বোন। যে কিনা আলমডাঙা নামক একটি জায়গায় থাকে।
একেবারে দক্ষিণ কোন থেকে শুরু করলে প্রথমেই আসে সাথির নোয়াকাকার কথা। তিনি চিনির মিলে চাকরিরত । অপ্রয়োজনে একটি পয়সাও ব্যায় করতে রাজি নয়। তার দুই সন্তান। শ্রাবণী ও লাবনী। তার বিবাহও হয়েছে এই পাড়াতেই । যার ছোটো শালিকার নাম গতি। যে গান গায়। তাই নোয়াকাকার বোধের সঙ্গে বিচিত্র সব মেলবন্ধন জড়িয়ে আছে। ঠিক অর্থে তাকে আধুনিক না বলতে পারলেও একটু যেন শহুরে আদবকায়দা মেশানো তার ধরণধারণ।
ঠিক নোয়ার গা ঘেঁষে রয়েছেন মণি। অর্থাৎ নোয়ার পরের জন। বেশি সময়ই মানসিক অবসাদে ভোগেন। কেন যে, তা তিনি নিজেও বুঝে উঠতে পারেন না। প্রাইমারী স্কুলের এসিস্টেন্ট হেড মাস্টার। তার দুই সন্তান । ছেলেটিকে ভালো ভবিষ্যতের চিন্তায় ভারতবাসী করে দিয়েছেন খুব ছোটো থাকতে। তাই সে এখন তার বাবার ছোটো ভাইএর আগের জনের কাছে রানাঘাটের পাশে একটি স্কুলে পড়াশোনা করছে।
এদের দু'জনের থেকে একটু এগিয়ে আসলে সেজো। যে খুব সকালে উঠে চণ্ডীপাঠ করে গলা ছেড়ে। তার উপার্জন বলতে চাষবাস। আগে পাড়ার ছোটোছোটো ছেলেপেলেদের পড়াতেন। এখন সেসব ছেড়ে দিয়ে চাষের কাজে যে দুটি বলদ লাগে, তাদের দেখাশোনা ও গাইগোরু দুটির দেখাশুনা করেই তার বাগান-টাগানের পরিচর্যায় দিন যায়। একা একাই তাদের সঙ্গে বকবক করেন। তাদের সহবত শেখান বকাঝকা করে সন্ধ্যে অবধি। একটু তুতলে ফেলেন জোরে কথা বলতে গেলে বা রেগে গেলে। তখন তার ভাষা বুঝে ওঠা দায়। অন্তত সে বুঝতে পারে না, তিনি কি বলছেন তখন। তার বিবাহিত জীবন বেশি দিন টেকেনি। কথিত আছে তার অত্যচারেই নাকি তার স্ত্রী আত্মঘাতী হয়েছিল সে সময় ।পুনরায় বিবাহের স্বাদ থাকলেও কেউ সে কাজে এগিয়ে আসেনি কোনো দায়িত্ব নিয়ে।
ঠিক তারই ছাদের সঙ্গে ছাদ লাগিয়ে যার ঘর, তাকে সকলে এরা সোনাকাকু বলে। বাজারে মুদিখানার দোকান। তার একটিই সন্তান। নাম সন্তু।
এদিকে তার গায়ে গা লাগিয়ে যে ঘর থেকে এখন সে বেরিয়ে এলো, সে ঘর তার শ্বশুরের। বাড়ির বড় ছেলে। পল্লীচিকিৎসক । বেশিরভাগ সময় সংসারের এটা ওটা দায়িত্ব মিটিয়ে বাকি সময়টা প্র্যাকটিস করেন। রোগীরা সেধে টাকা দিলে ভালো, না হলে নিজে চেয়ে নিতে পারেন না। বড়জোর আর্থিক অবস্থা ভালো জানলে বলেন, ঠিক আছে বিশ টাকা দেও না বাপু।
তাই এখানে সকলেরই সমীহের পাত্র হয়ে আছেন বেশ খানিকটা। যখন তখন রাতবিরেতে ডাকলে অমনি ডাক্তারি ব্যাগটা হাতে করে ছোটেন।
সকলের ছোটো ঢাকায় চাকরিরত। মাঝে ফুল, সে স্থানীয় মাদ্রাসার হিন্দু মাস্টার।
তার নিজের দুই শ্যালক। একজন ঢাকায় থাকে। আর একজন স্কুল শিক্ষক। বোনেদের মধ্যে বড় সাথি। ছোটো পূর্ণিমা। যার ওখানে মাগুরাতে কয়েকদিন কাটিয়ে এলো সে।
মেজো গৌতমের বাবা। তার তিনটি সন্তান। ছেলে তাদের মধ্যে একা গৌতম। যে কারণে সু্যোগ পেলে সে কথায় কথায় সকলকেই বলে, আমি হলাম গিয়ে এক বাপের এক ছেলে।
পথিক তা শুনে হেসে কুটিকুটি হয় একেবারে। বলে, ও গৌতম, এক বাপের এক ছেলেটা কিরে? দুই বাপের কি এক ছেলে হয় রে? তুই তো হাসালি ভাই একদম, কী মনে করবে রে লোকে... ?
পথিক আর একবারও ভাবে সাথীর পিসির বাড়ির কথা। এখন যে জায়গাটি চুয়াডাঙ্গা জেলার মধ্যে পড়েছে।দেশ ভাগের আগে যা ছিল নদীয়া জেলার মধ্যে। পরে দেশ ভাগ হলে কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত হলো।এরশাদ সাহেব এসেই মনে হয় মহকুমা শহরগুলিকে জেলা করে দিলেন। আর তাতেই আলমডাঙ্গা হয়ে গেল চুয়াডাঙ্গার মধ্যের থানা টাউন।
কেন জানে না এই পিসির বাড়িতেই তাদের বিবাহের পরে যেক'টা দিন লাগামহীন ভাবে কেটেছিল । সেই প্রথম দেখা তার রবীন্দ্রনাথের কুঠি বাড়ি শিলাইদহ। লালনের সমাধি ছেউরিয়া কুষ্টিয়া শহরের পাশে। নতুন বিবাহিত লাগামহীন ক'টা দিনের মধ্যে এই একটি দিন সেই যে কেটেছিল তার শিলাইদহের দিগন্তপ্রসারী মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা নির্জন একখানি ছোট্ট বাঙলা বাড়ি। যার চৌহদ্দি ঘেরা ঢেউ খেলানো সাবেকী ইটের প্রাচীর। দূরে সেই কুঠি বাড়ির মাথায় যে ঘরে বসে কবি লিখতেন দূরে পদ্মাকে সামনে রেখে ---- সেই নারকেল গাছের সারির ভেতর দিয়ে দেখা পদ্মার বিস্তৃতি ; তার পরে যতবার গেছে দেখেছে, কি ভাবে আস্তে আস্তে সব পাল্টে যেতে লাগলো!
যাইহোক, সবকিছু মিলে সেই দেখা। সেই যে নতুন বউকে সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে পৌঁছনো। এবং দেখা দুচোখ মেলে, যত দূর চোখ যায় ডাইনে বাঁয়ে শুধু ফসলের মাঠ। আর উত্তর-পূর্ব কোণ জুড়ে বিস্তৃত পদ্মার খানিকটা কুয়াশা মাখা রূপ দেখে কত কথা মনে পড়ে, কবির ছিন্নপত্রাবলীর এক একটি অধ্যায় যেন ওই দূরে ভাসমান পদ্মার জলরাশীরা মনে করাতে থাকলো, তাকে কত কথায়ই না !
সে সব সবই তো সাথির ওই একমাত্র পিসি বাড়িতে ক'দিন কাটানোর দৌলতেই ! কই ,তারপরেও তো কতবার যাওয়া হলো, কিন্তু সেই সুখস্মৃতি আর তো তেমন করে ফিরে পাওয়া হলো না !
একদিন এই সব ভাবাবেগের কবলে পড়ে, সে সব কিছু হয়তো খানিকটা ভেবে, হয়তো খানিকটা না ভেবেই গ্রহণ করেছিল, এই পরিবারের সকল মানুষগুলোকে। অহংকার করে কাউকে কাউকে বলতোও, এমন শ্বশুরবাড়ি ক'জনের হয় আজকের দিনে! ন' ন'টা ভাই এখনো এক অন্নে সংসার জীবন যাপন করে!
তা ভালো তো, সে কথা কি এখন আর বলে না ?
না, বলে না আর সেভাবে যেন। বলতে গেলে কেন জানি বেশ সঙ্কোচ বোধ হয় ।
কেন?
ওই যে , কথায় বলে না, 'বজ্র গেঁড়োয় ফসকা আঁটুনি .... !'
যেখানে যত বাধ্যবাধকতা, সেখানেই তত আলগা সব।
হাঁড়ি এক থাকলেও হিসেব আর এক নেই। ভেতরে ভেতরে সেই চুলচেরা হিসেব। যার যার তার তার।
এর আগে এ ব্যবস্থা ছিল না। থাকলেও সে তা টের পায়নি। কিন্তু এখন সাথির ঠাকুমার মৃত্যুর পরে, এখনো এক হাঁড়িতে রান্না হলেও, সকলের আত্মীয় আসলে সকলেই বাজার খরচা করতো। কিন্তু এখন সে ব্যবস্থা পাল্টে গেছে। আত্মীয় যার খরচা তার। এই যেমন, এখন সে দেখছে সে আসলে তার শ্বশুরমশাইকেই মাছ তরিতরকারি কিনে আনতে হয় বেশি করে। এর আগে তো এই রেওয়াজ ছিল না!
ব্যবস্থাটি পাল্টে দিয়ে গেছে বিউটি। মেজো কাকা-শ্বশুরের নব্য ভারতবাসী হওয়া মেয়ে।
এর আগে তার শ্বশুর বাড়ির যৌথ পরিবারের থেকে ভেঙ্গে তারা যখন ভারতবাসী হলো, তখন তার ভাগের খাট আলমারি গ্যাস ওভেন পর্যন্ত সে ভাগাভাগি করে তার ভাগেরটা তার বাপের বাড়ির মানুষজনের কাছে রেখে দিয়ে গেছে। তবু একান্নবর্তী পরিবারের জিনিসপত্র একান্নে থাকুক, এই মানষিকতায় বিশ্বাসী হতে পারেনি সে।
ভারতবর্ষ একসময় ভাগ হয়েছিল বলে এইসব যৌথ পরিবারও ভাগের ঘরে চলে গেল, এমন একটা ধারনা আমাদের রয়েছে যে, সে কথা সেও জানে। কিন্তু সে ধারণার বিশদ আলোচনায় এই মাঝ রাত্তিরে সে আর যেতে চায় না। তবে এই কথাটি বলতে ইচ্ছা হয়, এরা সকলেই , কী এমন কারণে এদেশ ছাড়ছে, যাতে সব একান্নপরিবারের সেই যে যৌথ আবেগটুকু, তাও যেন আর একটুও রেখে যেতে চায় না তারা কেউই? পারলে যে যেখানে আছে, তাদের সকলকেই তাদের এই বাড়তি আবেগটুকুকে , পারলে চেপে ধরে আর একবার যেন বুঝিয়ে দিতে চায়, ওসব ছাড়ো , এখন আর ওসব ধরে রেখে জীবন চলে না, যার যার তার তার, এই কথাটা ভালো করে ভাবতে শেখো, এখনো সময় আছে, ভুলে যাও ওসব পাতি আবেগ, সংশয়, যে যার মতো ভালো থাকো।
চলবে........
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন