জলশ্যাওলার বিরহকথা

জলশ্যাওলার বিরহকথা

দীপংকর রায়



১৭ তম তথা শেষ পর্ব


               বাড়ির দরজায় পা ফেলতে না ফেলতে বাড়িশুদ্ধ লোকের যেন এক সঙ্গে নানা অভিযোগের মাঝখানে পড়ে সে শুধু বললো, ইদ্রীশ কাকার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাই কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল । 
               চেতন ফকিরের কথাটা সে বেমালুম চেপে গেল। কারণ সামনে, একটু দূরে সাথীর বাবা দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি ওই মানুষটিকে আবার খুব একটা ভালো চোখে দেখতে পারেন না। এর আগে তার এই বহেমিয়ানা  নিয়ে, তার ঘরসংসারের প্রতি দায়দায়িত্বের কথা নিয়ে যে সব আলোচনা সামান্য একটু হয়েছিল, তাতে তেনার নানা অভিযোগ আছে তার প্রতি । তাই সে ভাবলো তার কথাটা বলা যাবে না একেবারেই। এরপরে আরো যদি শোনে এরা ----সে তার ওখানে আতিথ্য গ্রহণ করতে চেয়েছে, তাহলে তো তার প্রতিক্রিয়া সামলানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এবং তার বিবাহ সংক্রান্ত আরো বিষয় উঠে এসে সে এমন এক ঝামেলা বাধিয়ে দেবে যে, তখন তার আর কোনোদিকেই সমর্থনের জায়গা থাকবে না। তাই  ঘরে এসে সে তার এই মুহূর্তের প্রাপ্ত অস্থায়ী টেবিলের সামনে বসে পড়লো। অনেকটাই স্থির হতে চাইলো। এবং একেবারেই একা। ভাবছে, এতক্ষণ শুনে আসা কথাগুলি নিয়ে। ভাবছে, ইদ্রীশ আলী যতভাবে দেশের বর্তমান অবস্থা, চালের দর, কৃষকেরা ফসলের দাম পেলে তবেই তো একটু সচ্ছলতার মুখ দেখবে, তারা ভালো থাকতে পারবে। এইসব প্রসঙ্গ নিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু সমাধানের সূত্র বা আরো কিছু সুদূরপ্রসারী কথাবার্তা ‌নিয়ে ভাবে; চেতন ফকিরের সাধন মার্গ আর ইদ্রীশ আলীর যাত্রার ঢঙে কথা বলার ভেতরেও প্রচন্ড আবেগ থাকা সত্ত্বেও সে যতটা জীবনমুখিন বা রাজনীতি সচেতন, তার থেকে চেতন ফকিরের জগত কত আলাদা! কিন্তু এতটা সময়  এই দুই পিঠের দুটি মানুষকে নিয়ে কাটাতে এতটুকুও ক্লান্তি এল না তো তার! 

               বারবারই ভাবছে সে সেসব। ভাবতে ভাবতে এক সময় দুটি মানুষেরই সমান গুরুত্ব উপলব্ধি করে চেতন ফকিরের সঙ্গে আরো একবার দেখা হওয়া দরকার বলে মনে করে। 

             খানিকক্ষণ এইসব ভাবতে ভাবতে স্নানের কথা মনে হওয়াতে সে দক্ষিণমুখো বাগানের পাশের বাথরুমের দিকে  রওনা  হলো গামছাটি কাঁধের উপর ফেলে দিয়ে।
              চেতন ফকিরের সঙ্গে তার আর দেখা করা হলো না এই পর্যায়ে। দু'দিন থাকা সত্ত্বেও না। এর পরের দিনগুলি এতটাই উতকন্ঠায় কাটলো যে তা বলার নয়। আবেগে নিরাবেগে কেটে গেল কেমন ভাবে তাও বলার নয়। সে এইসব প্রেম অপ্রেম নিয়ে ভেবে দেখেছে, তাতে কোণোটাতেই দীর্ঘকালের কোনো ইশারাই নেই-যে এ তো বড় সত্য ! একদিন সব উচ্ছ্বাসেরই বয়স বাড়বে। নুয়ে পড়বে সব কিছু নিয়ে সব অনুভব এমনই এক গতিতে, তখন এইসব আবেগ উচ্ছ্বাস সব কোথায় মুখ ঢাকা দেবে,  তাদের আর কোনো অস্তিত্বই তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদিও এত কিছু ভাবনা মাথায় এলেও আবার কখন যে সেসব কোথায় ঘুরে গিয়ে অন্য ভাবধারায় ভেসে পড়ে, তার গতিবিধিও ধরে রেখে দেওয়া যায় না। 

               সে ভেবে দেখেছে সেসব নিয়ে। আবার ধরাও দিয়েছে সব কিছু জেনে শুনেও। যদিও তাকে ঠিক ধরাও বলে না। তাতে সংগৃহীত হয় শুধুই বিষাদ যেন, শুধুই গত দিনের পুনরাবৃত্তি। অথচ এমন কিছুই হয় না যা থেকে সে বা তার অন্তরাত্মা খুব একটা প্লাবিত হতে পারে। 

                যদিও চোখের জল ছিল। আবেগের ঘষ্টানিও ছিল। ছিল ক্রমাগত নিজেকে শপে দেওয়া এক অমোঘ সময়ের হাতে। যার বেশিরভাগটা জুড়েই একটি পুরোনো মুখ যেন এ বাড়ির আর দশজনের মধ্যে যে একা একা থাকে। একা একা ঘোরে। বারান্দায়, ঘরে, উঠোনে, ছাদে, একেবারেই একা একা যেন ; সেখানে কেউ তাকে খুব একটা গুরুত্ব দিয়েও ভাবে না। সেখানে কেন যে সেই তাকে এত গুরুত্ব দিয়ে ফেলে তার অল্প বয়সের নানা খেলায়, তা সে নিজেও ভেবে পায় না। 
                 যদিও কেনই বা এত ভাবতে যাচ্ছে, কেনই বা এত! সেও কি তার সাময়িক মুগ্ধতা পর্বের অমুগ্ধতার সংলাপ সেসব ---- ?

                কথাগুলি ছিল এই রকম : আচ্ছা, জামাইবাবু একটি কথা জানতে ভীষণ ইচ্ছে করে, যেদিন আপনি দিদির সঙ্গে বাসর ঘরে গেলেন, তখন আপনাদের পরিচয় পর্বের প্রথমটায় কে আগে এগিয়ে এসে কার দুটি হাত ধরে ছিল প্রথম? 
                ও.... হো.... এই কথা কি মনে আছে আজ! সে সব তো কতকাল আগের কথা! এ তো তোর অদ্ভুত সব প্রশ্ন রে ........; 
                সে যেন বিস্মিত হয়। বলে, এ কথা মানুষ ভুলে যায় নাকি? এ সব তো মানুষ সমস্ত জীবনেও ভুলতে পারে না! সবারই মনে থাকে, কিন্তু আপনার মনে থাকলো না কেন? 
         ---- দ্যাখ, হ্যাঁ.... তোর কথা ঠিক হয়তো, আমারও যে মনে ছিলো না তা না, ছিলও হয়তো অনেক দিন, তারপরে এখন হয়তো সঠিক করে আগে পরেটা আর সেরকম ভাবে ঠিক মতো মনে করে বলতে পারবো না। আসলে সেখানে তো একটা স্বাভাবিকতা ছিল, যাকে বলে অনন্ত স্বাভাবিকতা, তাই হয়তো আগে পরেটা মনে রাখতে দেয়নি সময়। কিন্তু তা তো হলো, আমার মনে একটা অন্য প্রশ্ন জেগে উঠছে যে, তোর এ সব নিয়ে ভাবনা চিন্তা জেগে উঠলো কেন, তাই বলতো ভাই আগে! 
            ----- না না দরকার ছিল, তাই ; মনে করুন বেশ খানিকটা বিশেষ ধরনের প্রয়োজন বলতে পারেন। যে কথাটা ঠিক আপনাকে আমিও বোঝাতে পারবো না হয়তো। 
             ----- আমার মনে হয়, সেদিন তুই যেমন কথায় কথায় হঠাৎ বললি, ঝেড়ে কাশুন তো, আমি হতচকিত  হয়ে গেলাম, ভাবলাম ও এভাবে ঝেড়ে কাশার কথাটি কেন বলছে বারবার! বুঝতে পারলাম না। জানিস তো, আমি না ঠিক এই সব জীবনের স্পষ্টাস্পষ্টি দিকগুলি নিয়ে খুব একটা দক্ষ মানুষ নই বলেই হয়তো ঠিক তোদের অন্তরালের ভাষাটা আমি খুব একটা বুঝি না। হ্যাঁ, একে তুই যা খুশি তাই বলতে পারিস, সত্যিই আমি সবটা ঠিক বুঝি না। একে হয়তো তুই আমার তোদের প্রতি কম বেশি ভাবনা বললেও বলতে পারিস, হয়তো আমার আত্মকেন্দ্রিকতাও বলতে পারিস। 
          ----- হ্যাঁ, হয়তো বেশিটাই সেটাই, আপনি বোঝেন না তা নয়, বোঝেন ঠিকই, নিজে নিজে কষ্টও পান বেশ, তাও কেন যে অন্য কারোর এইসব জায়গাগুলোকে একটুও গুরুত্ব দিয়ে অনুভব করে নিজেকে স্পষ্ট করেন না, সেটা ভেবে আমি যে কতটা নিরুপায় হয়েছিলাম সেদিন! বেশ অপমানিত হয়েছিলাম যে, সেটা আপনি একবারও অনুভব করলেন না !
                এই কথাগুলি একটানা বলে গিয়ে হঠাৎই সে উঠে দৌড়ে একরকম ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল। 
                এই ছুটে চলে যাওয়ার অর্থ সে বুঝতে পারলো কি?  হয়তো বুঝতে পারলো, হয়তো বুঝেও কিছুই বলতে পারলো না সে। এই ইশারা তার যেন বুঝবার নেই কিছুই। 
                  মনে মনে নানা দিক থেকে ভীষণ মনখারাপ নিয়ে সে শুধু তার যাবার পথের দিকে তাকিয়েই থাকলো স্থির হয়ে। হয়তো সে তাকিয়ে দেখতে থাকলো এর আগে যেভাবে সে দেখেছে তার থেকেও আরো এক অন্য তীব্রতাকে অসহায়ের মতো চোখ মেলে চেয়ে। দেখেছে তার সমস্ত শ্বাসপ্রশ্বাসের রঙ ও রঙিন করা অনুভূতি দিয়ে কিভাবে এই ক'দিনের সমস্তটা মুহূর্ত, পল ---- আরো বেশি করে তাকে ভাবিয়ে তুলতো ; ভাবিয়ে তুলতো না বলে বলা ভালো হয়তো, কাঁদিয়ে তুলতো, কথায় কথায় দু'চোখ বেয়ে নেমে আসতো জল। 

                বাগানের ধারের বাথরুমের মাথার খোলা আকাশ, ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা বাড়িটার এই বিশুদ্ধ প্রকৃতি, দেবদারু গাছেদের মাথা, কাঠাল গাছের ডালে ঝুলে থাকা নিঝুম মুহুর্তগুলো, সব তাকে অন্য এক মাত্রায় অনুরণিত করতে লাগলো কত কথায় যে তা সেই জানে। ভুলিয়ে দিতে লাগলো, না আরো বেশি করে মনে করিয়ে কষ্ট দিতে থাকলো, সে কথা আর কারো জানবার নয় যেন। সে যেন এই যাবার আগে দু'কানে দুই হাত চেপে ধরে এক ধরণের মনখারাপকে থামাতে চাইছে যেন সে তার সেই অনন্ত হই-হট্টগোলের থেকে!  কিন্তু কোথাও তো কোনো সোরগোল নেই এখন, তাহলে তার কানে এত শব্দ অবতাড়না চলতে থাকলো কেন, তা যেন সে নিজেও জানে না স্পষ্ট করে। 

                সন্ধ্যাবেলায়  আর সে উপরে উঠবে না বলেই ভেবেছিল। কিন্তু বাধ্য হলো প্রয়োজনীয় ব্যবহারের জিনিসপত্রের গোছগাছ করতে গিয়ে গামছাখানির খোঁজে। এবং গামছা আনতে গিয়ে আবারও ধরা দিয়ে বসলো তারই হাতে। এবারে সে একেবারে হিড়হিড়িয়ে টেনে নিয়ে চললো তাকে, কিছুটা যেন পাজাকোলে করে। এবং কি এক ছায়াছবির গানের সুর গুনগুনিয়ে গাইতে গাইতে তাকে কোমরের ধাক্কা দিতে থাকলো। আজ আনন্দ যেন ধরছে না তার আর কোথাও। মেঝেতে বসা ছোটোকাকিশাশুড়ি তো বলেই বসলো এসব দেখে, আরে, এত বড় ধাক্কা কি সয় তোমার জামাইবাবুর কোমরে! 

                 খানিক হাসাহাসির মধ্যে হারিয়ে গেল যেন তার এই আনন্দ উপভোগ করার চূড়ান্ত পর্যায়গুলি। 
               এরপরও সকলের সামনে গলা জড়িয়ে ধরে বললো, এইরকম ভাবে আপনার সঙ্গে একটা ছবি তোলার স্বাদ থাকলো জামাইবাবু কোনো একদিন। এবারে তো আর হলো না, পরের বার ঠিকই হবে দেখবেন, ঠিক তুলবো আপনাকে সঙ্গে করে কোথাও নিয়ে গিয়ে। 

                এসব উচ্ছলতায় সেরকম সাড়া না দিতে পারলেও বললো, সে না হয় হবে। 
                শুধু এইটুকু বলেই থেমে গেল। কোনো বাড়তি আবেগ বা চাঞ্চল্যই দেখালো না। কেবলই উদাসী অন্য এক ধরণের ছদ্মবেশ ধারণ করে অন্য কোথাও তলিয়ে রইলো। কিন্তু কি সেই ভাবনা, কি তার গভীর কান্না, সে কথা তাকে তো বুঝতে দেওয়া যাবে না! কিন্তু তার এইসব মনখারাপের দিকে নজর নেই। সে গলা জড়িয়ে ধরে সজোরে আবার আর একটি ধাক্কা দিল কোমরে। দিয়েই মুখ ভেংচে বললো, ক্যলানচন্ডি ......, এর থেকে পরিষ্কার করে আর কিভাবে বোঝাবো তুমি আমার কে গো.....! তুমি তো  কোনো কিছুই বুঝলে না মদনমোহন আমার!
                   আজ সে এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে নিচে নেমে এলো আস্তে আস্তে। এসেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। আপন মনে চেয়ারে বসে থাকলো জানলা খুলে অনেক রাত অবধি। যদিও রাত পোহালেই তো তার যাবার দিন ধার্য হয়েছে। শাশুড়িরা এটা ওটা বিকেল থেকেই জড় করে রেখে গেছে তার এই থাকার ঘরের মেঝের এক কোণায়। সেও বুঝতে পারছে এতদিন ধরে, যাবার আগের দিনগুলি তো এমন সব আয়োজনেরই হয়! যদিও এবারে যে দিনগুলির সঙ্গে বসবাস করলো , এই মুহূর্তে যাকে সে ছেড়ে এলো এমন একটি পরিস্থিতির ভেতর, তার সঙ্গে কি অন্যান্য  বারের তুলনা করা যায়! 

                 ঠিক হলো গৌতম তাকে বর্ডার পর্যন্ত  পৌঁছে দিয়ে আসবে একটা গাড়ি ভাড়া করে। 
                 মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে যাবার আগে সকল সুর-মূর্ছনা, কান্নাকাটি মিশে যেমন হয় তেমনই হয় তার বেলাতেও। অথচ সে তো জামাই ছাড়া মেয়ে নয়; তবু এই সময়গুলি যেন মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাবার মতোই ---- পার্থক্য বলতে যেটুকু তা এই, সেখানে একই রকমভাবে মেয়েটির কান্নার চেহারাটি দেখা যায় ---- আর এখানে জামাইয়ের অন্তর কাঁদলেও তার কোনো শব্দ শোনা যায় না।  

               ওদিকে আড়ালে আড়ালে ভাঙতে থাকে ধান ভর্তি ধানগাছের মাথার চেহারা । গভীর জঙ্গলের মাথায় প্রচন্ড ঝড়ের গতিবেগ লক্ষ করা যায় যেন। মনে হয় সমস্ত প্রকৃতি আজ  নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে  বুঝি। খুব ছোটবেলায় সে এই রকম সব মুহূর্তগুলিতে যাবার বেলায় গাছগাছালির কাছ থেকেও চোখের জল ফেলে বিদাই নিয়ে আসত ।  এই তো ,সেদিনও তো তাইই করলো, বলে এলো, তাহলে আর কি, চলি, কি বলো ----
                  এইরকম সব ধারণা বাগানের বাথরুমের কলতলার মাথার উপরের গাছগাছালির ছায়া পথে আজও এই চলে যাবার আগের মুহুর্তে পৌঁছে গিয়ে উপলব্ধি করার পর থেকে কি এক অদ্ভুত প্রশান্তি মুহুর্তের মধ্যে ভেঙে যেতেও সময় লাগলো না, যখন সে পুনরায় উর্মির দিকে তাকালো। এই মুহুর্তে তার ছলছলে চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে আবার যেন সে ভীষণ বিমর্ষ হয়ে পড়লো। যাবার আগে কোথায় সে নিজেকে একটুখানি ভাসিয়ে দিয়ে অদ্ভুত এক অনুভবের কাছে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল, তখন কখন সে আবার এসে ছলছলে চোখ দুটি নিয়ে কাছে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখেই তার সমস্ত ভাবনারা নিমেষে কোথায় পালালো। কিন্তু কেন, কেন তার এই টান ---- নাড়িছেঁড়া টান ; জন্মসূত্রে সে তো এই দেশটার কেউই না! শৈশব কৈশোরের কয়েকটি বছর কেটেছে এই যা। বেশি দিন তো না, সামান্য ক'টা বছর, এরপর তো এসেছে এবং গেছে চলে। এই আসা আর যাওয়ার মধ্যেই দেখা, আর টানাটানি, যেন এতেই শেষ হয়ে গেল কতটা বেলা, তাই না! আর তাতেই এত টান! 

                   এই তো ক'দিন আগে সেই রাড়িখালী থেকে বিদাই নেবার সময়ও তো এরকম সব শূন্যতা, হাহুতাশ পর্ব ; সে যাই হোক, সেখানের কথায় না হয় হতেই পারে, কিন্তু এখানেও কেন একই জিনিষ আজ তাকে দুর্বল করে ফেলছে ভেতরে ভেতরে ভীষণ! হৃদয়ের এই আকুতি কাকে যে বোঝায় সে! হৃদয়ও কি খুব পরিষ্কার করে জানে সেসব! যদি জানতো পরিষ্কার ভাবে, হয়তো বলে দিতে পারত, অন্তত এইটুকু  খোলনলচে খুলে, জানা যেত , আজ তোমার দশা অন্য এক আশক্তিতে প্রবেশ করিয়ে ফেলেছ পথিক ----- যে অন্ধকারের কোনো সঠিক দিশা তোমাকে তোমার মনও দিতে পারবে না যে, আর পারবে না বলেই এইসব আবহে তুমি হু হু করে ভেঙেচুরে যেতে দেখছ এই প্রকৃতিকে পথে পথে অবলীলায়। 

                 হয়তো মানুষ যখন কোনো অবলম্বন পায় না তখন তার একমাত্র নির্ভরতা দেয় এই প্রকৃতি ; আর তার মহাশূন্যতা, সেদিকেই মানুষ দু'হাত পেতে যেন তাকিয়ে থাকে! হয়তো তখন প্রকাশ্যে তার কাছ থেকেও সঠিক কোনো উত্তর সে পায় না, তবু তার কাছেই খুঁজে চলে সে তার এইসব অসহায়তার ভাষা। 

               যদিও এইসব ধারনা, বোধ, একশ্রেণীর মানুষের মধ্যেই চলাচল করে। এই অনুভবের সঙ্গে সকলেরই দেখাসাক্ষাৎ হবেই যে এমন কথা নেই। জানাও যায় না তা জনে জনে জিজ্ঞাসা করেও। তবু কেউ কেউ যেন আছে এইসব অনুভবের কাছেই নতজানু বেশি। তাদের একমাত্র অব্যক্তকে তুলে দেয় তার হাতে। যেখান থেকে সে একটা টানা শ্বাস নিয়ে আবার পথ চলে।  
                  যাবার সময় দু'হাত তার স্পর্শ করেও, বিদায় পর্বটুকু যে মমতায় সে সারতে চেয়েছিল, তা যেন হলো না সেভাবে । সে কখন বাথরুমের ওখান থেকে চলে এসে দোতলায় তার ঘরে বিছানায় মুখগুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল যে সে, পথিক দেখতে পেল উপরে উঠে। তার সেই দু'চোখের লাল হয়ে ঝরে পড়া জলের সব অর্থ করা সম্ভব না তার পক্ষে। তাই তাকে ডেকে বললো, কি রে নিচে যাবি না? 
                 সে কোনো কথা না বলে তার দু'কাঁধের উপর দুই হাত তুলে দিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো তার দিকে। পথিকও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তার দিকে চেয়ে। তারপর ছোট্ট শিশুর মতো তার দুচোখ মোছাতে মোছাতে বললো, এটাই নিয়ম, কাঁদবি কেন বোকা ---- চল, আমাকে এগিয়ে দিবি না........! 


                                     সমাপ্ত





মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪