হোসনে আরা কামালীর এক গুচ্ছ কবিতা


বাড়ি


বাড়ি আসলে কোনটি!

কোন দৃশ্য পৌঁছায় দেবে আসল বাড়ির ঠিকানায়
এক রবিবার রাতে মার জরায়ুর
লহুজল যে-মাটিতে প্রথম আছড়ে ফেলেছিল
নাড়ির ফুল যে-মাটিতে পোঁতা বহুকাল ধরে
যেখানে কাঁঠালপাতায় লেখা থাকে শৈশবগীতি

সে-ই টা বাপের বাড়ি
মাঝে মাঝে নাইওরের ঠিকানা

বাড়ি আসলে কোনটি!

কীসের বন্ধন লেপে দেবে আপন বাড়ির উঠোন
তিন কবুলের স্বাবলম্বন,
শখ-বায়নার জায়-জেওরাত?
জঠরে হাতধরা শিশুর বাগান,
আর আয়নামহলের ছাদের আকাশ?

এ-ই টা স্বামীর বাড়ি
তিনি চাইলে আমৃত্যুর ঠিকানা

বাড়ি আসলে কোনটি!

কোন স্মৃতিতলানির সুখ পৌঁছে দেবে
গুলতানির মেলায় গড়েতোলা মাটির ইমারতে
ন স্থান, ন খোঁজ বাড়ি
মাঝে মাঝে আত্মায় ঝলকে ওঠে
দেওদানোর পুরা তাকতে
বাড়ির জন্য বাড়ি ছাড়ি

কিন্তু এ-ই টা তো নিজের বাড়ি!




বড়ো চাচিআম্মা


সুখপাঠ্য বইয়ের মত আমাদের শৈশবের বড়ো চাচিআম্মা
ফুলগুটি খেলার মতই সতেজ, দুধভাতের সুঘ্রাণে মাখা মমতা

যখন শৈশব হারিয়ে যায়, পিছুটানের পরোয়া থাকে না
কতপথ চলে গেছে, দূরপথে কত গৃহত্যাগীর ছদ্মবেশ
তবু আবুখালের হাঁটুজলে ভিজতে থাকে থোকা-থোকা শৈশব
যখনই ছুঁতে যাই তাঁকে, বড়ো চাচিআম্মা উঠে আসেন তটস্থ

বড়ো চাচিআম্মা কত যুগ ধরে দূরকে আপন করে নিয়েছেন
আন্তর্জাল হালে পৌঁছে দেয় বড়ো চাচিআম্মার নৈকট্য
পৌঁছে দেয় বিচ্ছেদের বেদনা, স্মৃতির পাহাড়ের নৈঃসঙ্গ্য
চাচিআম্মা আমাদের চিনতে ভুলে গেছেন, কাঁদতে ভোলেননি

জানালার কার্নিশ ছুঁইছুঁই একটি উইলোগাছ
চাচিআম্মার নিকট প্রতিবেশী, পাতায় জমা রাখে তাঁর অশ্রুকণা
লিখে রাখে কান্নার সমস্ত সুরস্বরলিপি
আমাদের কৈশোর, দুধভাতের বড়ো লোকমার স্বাদ

আমাদের দীর্ঘ পুকুরগোসল, ডুবে ডুবে লাইখেলা—
গড়িয়ে পড়া বিকেলে, পড়ার টেবিলে দীর্ঘঘুম আর
চাচিআম্মার কোলঘেঁষা রাত, কতশত স্মৃতির পাহাড়
বড়ো চাচিআম্মা কেঁদে কত শেষ করবেন আর!

আমাদের বিশাল স্মৃতির নির্ভুল স্বরলিপি
স্নেহের ব্যাকরণে তিনি গেয়ে চলেন নিরবধি
উইলোপাতায় কত আর ছাপা হবে তা অগুনতি!




মায়া


মায়া-জংলায় সাপ ফণা তোলে
কেবল রাতের চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার বিষ
পক্ষিণীদেরও নাকি আলাদা রাজ্য আছে
আছে স্বঘোষিত এক মহারাজা
তবু কেউ মাখে না কারও গায়ের সুঘ্রাণ
কেউ জানে না কারও চোখে
কতটা গভীর জলের নদী
রাজরসিক মাপে শুধু জ্বরের উত্তাপ
কোনও এক ঘোর পূর্ণিমায়
সমান্তরাল স্ফটিক রাস্তা
আকাশের তলে থেমে যাবে যেদিন
সেদিন পক্ষিণীর পায়ের তলায়
একমুঠো মাটি জমা হবে
যেদিন স্পষ্ট হবে নদীর ভাষা
সমবেত পক্ষিণীরা নেবে পাঠ অবিশ্বাসের

যে-জীবন শুধু নিজেকে দেখে
রাজপ্রতাপে নিবিষ্ট আন্তর্জাল
প্রেম ও বিশ্বাসের সালতামামি
আয়নাঘরে জমা কেবল কাঁচের জঞ্জাল
প্রেমে শেষসত্য বলে কিছু নেই
বিশ্বাস এক ভাওতাবাজির গেঁয়ো নাম

যে-সাপের বিষদাঁত নেই
তার ছোবলে নিহত অতীত
মায়ার বাগানে অমাবস্যা কাটে না
পক্ষিণীরা জানে না আয়নাকরা কাকে বলে
কত পূর্ণিমার আলো
ঘোলাজলে ধুইয়ে নিল ঢোঁড়াসাপ
পক্ষিণীর চোখে কেবলই সিসিফাস জ্বলে...




গেল না তাকে একটু ছোঁয়া


একলা আকাশটাকে 
একলা পাওয়া গেল না
নিঃসঙ্গ পাওয়া গেল না 
সঙ্গীহীন ক্রন্দসীকে

বোশেখের কালো সন্ধ্যায় 
ক্রোধান্বিতার বজ্র নিনাদে
ঝমঝম বৃষ্টিতে 
কান্নার সুখে 
এক বিকেলের, একলা ছাদে
কোনওদিনও না।

খুব ভোরে 
পৃথিবী জাগার আগে 
চুপিচুপি 
একদিনও না
গেল না তাকে 
একটু ছোঁয়া। 




একবেলাকার বৃষ্টিজলে


নিস্তর নদীর ওপর দাঁড়িয়ে 
একলা পুলটির ওপারে 
আমিই ছেড়ে দিয়ে এলাম একলা আমাকে

রুপোর মতো অঝর বৃষ্টিতে
একলা একলা পুলটি ভিজল কত 
ঠিক তোমার মতো— আমার থেকে মাত্র দুগজ দূরে। 


 

মন্তব্যসমূহ

  1. কবিতাগুলো ভালো লেগেছে। 'একবেলাকার বৃষ্টিজলে' বিশেষ ভালোলাগা। অভিনন্দন, কবি!

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪