তৃতীয় বর্ষ ।। প্রথম ওয়েব সংস্করণ ।। ১১ বৈশাখ ১৪২৯ ।। ২৫ এপ্রিল ২০২২
দেখতে দেখতে তিন বছরে পা রাখলো আমাদের প্রিয় অরন্ধন ওয়েব পত্রিকা। করোনা মহামারীতে মানুষ যখন ব্যতিব্যস্ত, পরস্পর পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন, হয়ে উঠছিলেন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, ঠিক সেই সময় মানুষকে হৃদয়ের সঙ্গে জুড়ে রাখতে শুরু হয়েছিল অরন্ধনের ডিজিটাল অধ্যায়। যা আজও পাঠককুলের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়। আজও মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বন্ধনে সমানভাবে সহায়ক হয়ে আসছে। একজনের অনুভূতিগুলোকে অসংখ্য জনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে অনায়াসে।
ওয়েব মেগাজিনের বেশ কিছু অপরিপূর্ণতা রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অসুবিধা এবং নতুন কাগজের গন্ধ না পাওয়া। তথাপি এর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অতি সহজে দেশান্তর রেখা পেরিয়ে প্রিয় মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে যাওয়া। আর যেকোনো সময় সংশোধন, সংযোজন বা বিয়োজনের সুবিধা পাওয়া।
অরন্ধন ওয়েব ম্যাগাজিনের শুরু থেকে নতুন কবি-লেখকদের তুলে আনার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল তা আজ অনেকটাই সফল। এক্ষেত্রে হয়তো বেশ কিছু কাঁচা লেখা পাঠককুলের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে নতুন যে সকল মুখ উঠে এসেছে সকলের সম্মুখে সেইসব মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা করবেন নিজ গুনে।
আমাদের এই প্রচেষ্টা সব সময় ক্রিয়াশীল থাকবে এটা নিশ্চিত। আমার মনে হয় একটা লিটল ম্যাগাজিনের এটাই চরিত্র হওয়া উচিত। যে লিটল ম্যাগাজিন নতুনদেরকে তুলে আনার চেষ্টা না করে কেবলমাত্র খ্যাতির জন্য বিখ্যাতদের লেখা তুলে ধরার কাজেই ব্যস্ত থাকে, সে আর যাই হোক লিটিল ম্যাগাজিন আখ্যার উপযুক্ত নয়। সে কেবল মাত্র চাটুকারিতা করার জন্যই বাজারে এসেছে।
সম্পাদক, উত্তম মাহাত
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
উৎপল চট্টোপাধ্যায় / সায়ন্তন ধর / সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় / ফজলুররহমান বাবুল / হোসনে আরা কামালী / নিমাই জানা / জয়দেব বাউরী / উৎপল দাস / শ্রীদাম কুমার / মধুপর্ণা / তপন পাত্র
_____________________________________________
উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
১.
আমাদের উত্তরাধিকার
আমরা কেউ মাঝরাতে খুঁজিনি চাঁদের ছায়া
বৃষ্টির সম্ভাবনা সংবাদে
গোগ্রাসে গিলে খাইনি নোনা হাহাকার
তবুও অন্ধকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে
সারারাত, জ্বেলেছি মোমের আলো
বৃষ্টি ফোঁটার এমন সঠিক শব্দ চয়নে
আমাদের ধুসর উপন্যাস
আমরা কেও সংসারের পোড়া দায়িত্বে
পাইনি চাবির গোছা
উত্তরাধিকার সূত্রে
নিহিত বর্নমালার এমন তপ্ত আলিঙ্গনে
আমাদের ব্যক্তিগত যাপন
সংক্ষিপ্ত জানালাটির পাশে বসে
শুধু দেখেছি নিষিদ্ধ অন্ধকার
আর শুনেছি শব্দভেদী চাঁদে
আলোর হাহাকার .......
২.
মৃত পাণ্ডুলিপি
আলোক চিহ্ন ছিল
সম্পর্কের ছায়াচাবিটার জংধরা চিত্কারে
ছিল সূর্যের হাত
শান দেয়া আগুনের থাবায় নদীনূপুর
আর সুমহান বজ্রাঘাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
খোলা আকাশের নীচ
ছিল আরও একটা বিছিন্ন শিশুর জগৎ
পৃথিবীর স্পর্শে
এখন মরু বুকে অপরাজিত আলপনা
উজ্জ্বল সন্ধ্যার বিপন্ন শরীর
তবুও সহস্র জন্মের আবেদন রেখে,
জানি,একে একে ফিরে গেছে
আমার মৃত পাণ্ডুলিপির পরিযায়ী আত্মারা
বুদবুদ
সায়ন্তন ধর
প্রতিটি বুদবুদে একটা স্বপ্ন থাকে
সেই স্বপ্ন ভেসে বেড়ায়
অ্যারোসলে ভর করে,
ফুরফুরে বাতাসে সঠিক দিশা পায়,
সূর্যের রশ্মিতে বর্ণালী রঙিন স্বপ্ন।
কখনো বাতাসের খামখেয়ালি চাপে
স্বপ্নের অপমৃত্যু।
প্রতিটি বুদবুদের কিছু না কিছু লক্ষ্য থাকে
কেউ মজা ছড়িয়ে যায়
কেউ মেটায় খুধা।
ছোট বুদবুদেরা খুঁজে নেয়
খেলার সাথী
হাত ধরাধরি করে বড় হয়ে ওঠে,
সযত্নে পাশ কাটিয়ে যায় কেউ
সম্পৃক্ত হৃদয়কে পরিপৃক্ত করবে না বলে।
অনন্তকালের মাঝে মানবজন্ম এক
স্বপ্নভরা বুদবুদেরও প্রাপ্য হোক
আলতো স্পর্শ আর সুমিষ্ট হাসি।
গাছ
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
আচমকা ঘুম ভাঙতেই
মনে হয় বুকের মাঝখানে
কি যেন একটা গজিয়েছে।
গাছ? এক ঘুমে এক গাছ?
শিকড়গুলো এখনও গজাচ্ছে।
টের পাচ্ছি তার বাড়ার
শিরশিরানি....
শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
গাছে পাতাও ফলছে নাকি?
থুতনিটা বুকে চেপে ধরে
দেখার চেষ্টা করলাম।
চোখের কোলে মেঘ জমেছে।
শ্রাবণী এসে গেলে গাছটা
খুব খুশি হবে নিশ্চয়ই।
গাছটা কোনো কথা বলে না।
শুধু শিকড়ের টানাটানিতে
বুঝিয়ে দেয় সে জমি দখলিয়া।
শনশন কনকন দপদপ...।
বাধ্য হই হাত তুলতে, কষ্টসাধ্যে।
হাতের শিরায় শিরায় শিকড়টান।
কোনোক্রমে আঙুলগুলো এসে
গাছটাকে আঁকড়ে ধরে।
গাছের শরীর মসৃণ ও শীতল।
গাছ-পাথর জানি, কিন্তু ধাতুর গাছ?
গাছ কি ধাতুর হয়? হতে পারে?
এই চিন্তা করতে করতে
হৈহৈ নেমে আসে শ্রাবণী
আমার ঘুম পায়
চুম্বক ঘুম
যেন....
ফজলুররহমান বাবুলের এক গুচ্ছ কবিতা
তুমি ছিলে ফুল, আমি পাতা
১
যদি ভুলে যাই
মনে রেখো...
পথের ওপর হারিয়ে তোমায়
লিখছি আমি গান
মনে রেখো
স্বপ্ন ফেলে
নীরব হল উলটো-প্রাণ।
২
আমরা
সম্পাদনা করছি দিনলিপি
আর
সময়ের ভিতর
পাখি ও প্রজাপতি উড়ে চলেছে...
উড়ে চলেছে শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের
রোদ
বৃষ্টি
হাওয়া
উড়ে চলেছে
অন্ধ-স্বপ্ন
দেখা কিংবা অদেখা আগুন
আমরা
লিখে চলেছি
প্রথম ক্ষুধা
শেষ কান্না। আরও কবিতা পড়ুন
হোসনে আরা কামালীর এক গুচ্ছ কবিতা
বাড়ি
বাড়ি আসলে কোনটি!
কোন দৃশ্য পৌঁছায় দেবে আসল বাড়ির ঠিকানায়
এক রবিবার রাতে মার জরায়ুর
লহুজল যে-মাটিতে প্রথম আছড়ে ফেলেছিল
নাড়ির ফুল যে-মাটিতে পোঁতা বহুকাল ধরে
যেখানে কাঁঠালপাতায় লেখা থাকে শৈশবগীতি
সে-ই টা বাপের বাড়ি
মাঝে মাঝে নাইওরের ঠিকানা
বাড়ি আসলে কোনটি!
কীসের বন্ধন লেপে দেবে আপন বাড়ির উঠোন
তিন কবুলের স্বাবলম্বন,
শখ-বায়নার জায়-জেওরাত?
জঠরে হাতধরা শিশুর বাগান,
আর আয়নামহলের ছাদের আকাশ?
এ-ই টা স্বামীর বাড়ি
তিনি চাইলে আমৃত্যুর ঠিকানা
বাড়ি আসলে কোনটি!
কোন স্মৃতিতলানির সুখ পৌঁছে দেবে
গুলতানির মেলায় গড়েতোলা মাটির ইমারতে
ন স্থান, ন খোঁজ বাড়ি
মাঝে মাঝে আত্মায় ঝলকে ওঠে
দেওদানোর পুরা তাকতে
বাড়ির জন্য বাড়ি ছাড়ি
কিন্তু এ-ই টা তো নিজের বাড়ি! আরও কবিতা পড়ুন
নিমাই জানার তিনটি কবিতা
১.
শূণ্য দৈর্ঘ্যের ডানা ও মাংসাশী ওভরাল এল
শূণ্য দৈর্ঘ্যের অচ্যুত বিন্দুর কাছে বসে আছি আমার সব নাভি চৈতন্যের কাটা মুন্ডু ওয়ালা শুক্রাণু দৈর্ঘ্যের সাইমুলটানিয়াস কাকগুচ্ছ পরাগ ফেলে
সকলের জন্য ছিন্নমূল রাখতে নেই
ছয় ফুট হাতের রুদ্র রঙের ডানায় উড়তে থাকা ওভরাল এল কঙ্কাল নিয়েই আমি প্রতি ঘরে বিভক্ত করে চলি প্রতিটি বিজোড় মাংসাশী সংখ্যার গর্ভাশয়
রাতেই তো আজকাল বাঘ নখ গজিয়ে ওঠে সিদ্ধার্থ চলে যাওয়ার পর
একটা পবিত্র মাহেন্দ্র জলাশয়ের পাশে দাঁড়ালে স্ত্রী বর্ণের জলাশয়ের উপর মহামায়া ধ্বনি নিয়েই খন্ডিত করে হিউমেরাস , কশেরুকা বাইফোকাল ক্যাটারেক্ট রক্তের তিন ইঞ্চি পুরু জননাঙ্গদের
কেউ নিপীড়িত হয়েছে গর্ভবতী আম গাছের বাকলের মতো , যাদের তলপেটে ভাঙ্গা কাচের তরবারি রাখা ছিল ঠিক মহেঞ্জোদারোর সময় থেকেও , আমি কতদিন একটি ধারালো গুহার ভেতরে ঢুকে সজনে সাদা কঙ্কাল ঘেঁটে ঘেঁটে অস্ত্রশস্ত্র বের করে আনি
তারা সব ডিমের খোসার মতো উল্টানো নাভি থেকে রাত্রির দত্তক নেওয়া সন্তানকে বের করে আনছে সম্প্রদান কারকের মতো
অথচ তাদের স্তনে একফোঁটা সালফিউরাসের মতো হড়হড়ে জায়মান পৈশাচিক দাগ ছিল না , সাদা রঙের ফুল গুলোই নিঃশর্ত দ্রাঘিমার জলবায়ু খাচ্ছে
২.
ইউসিনোফিল বাবা ও বৈধব্য রবিবার
আমার শরীরে ও আজকাল অসংখ্য ইওসিনোফিলের মাথা গজিয়ে ওঠে
তাদের লোম বিন্দু থাকে না , আমি বিপ্রতীপ বাহুকে নিয়েই সান্দীপন শিক্ষকের একটি শূন্য দৈর্ঘ্যের জীবাণু জিভ দিয়ে প্রতিটি অঙ্কন প্রণালীর শেষ দেখেছি , সেখানে কোন উপপাদ্যই আসলে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার জন্য সঠিক ছিল না
সিন্ধুতীরে বসে বসেই ভেবেছি কতদিন শ্রীরাধিকা গোপন গুহায় আসার জন্য বন্ধ রেখেছিল তমো গুণের কথা
প্রকৃতিরা তিনটি গুণের শক্তি দানা খেয়েছে আজ
আমার নীল জামা পরা সন্তান অন্ধকারে ঢেলে দিয়ে যায় নৌকার ঢলঢলে ভগ্নাংশ , যাদের আমি খুঁজে চলি নারীটির ঘুমের ঘোরে
যতি চিহ্নের ছবি আঁকতে আঁকতে কখন আমার দুইজন ভাই মৃত হয়ে গেছে যেদিন বৈধব্য রঙের রবিবার ছিল
আমাকে নিয়ে পারদের কবিতা লিখে যায় কেউ , একটি বিবাগী নারী কোনদিন গজিয়ে ওঠা ক্লোরোফিল দেখে আঁতকে উঠেনি ,
শুধু সুমেরু বৃত্তের প্রতিটি অঙ্গরাজ্য দেখিয়ে গেছে তিল ফুল জলে স্নান কাপড় ভিজিয়ে
সহবাস আসলে কিছুই নয় শুধু টেস্টোস্টেরনের গ্যাসীয় প্রলাপ মাত্র , যে পুরুষ ফোবিয়া পুষে রেখে রোজ অক্ষম হয়ে যায় এসিড ফস খাওয়ার পরও
আমাদের দৈর্ঘ্য কমে আসে ধ্যানস্থ বাঁশির জন্য , ইছামতি নদীটি কেবল আ উ ম পছন্দ করেন
রাতে সকলেই বাড়ি ফেরার পর ধূপের বৃত্তাকার নিচ থেকে ডান কপাটিকা গুলো খুলে দেয় অন্তিম জানালার কাছে , মা সালবিউটামল খাচ্ছে
দরজাটির নিচে একটি কাপুরুষ অজগর অপেক্ষা করছে পাঁচদিনের আঁশটে জাইলেম দাঁত নিয়ে
৩.
সাদা রাজহাঁস ও টমেটো বীজের কথা
গোলাপি রঙের হাইপোথ্যালামাস টনটন করে নিভৃত পরজীবীর নিন্মাঙ্গে গজিয়ে ওঠা ধ্রুবতারা রঙের মেহগিনি সবুজ পাতা নিয়ে
আমি কি আসলে মুদ্রাদোষের কোন মুদ্রারাক্ষস রবাব বাজিয়ে ফিরছি রাতে
আমার জিভে প্রতিদিন দ্বিমুখী ব্রহ্মা নাচছেন
আজ কিছু বাবার অংকুর টমেটো বীজের কথা হোক
একটি কালো কঙ্কাল আয়তক্ষেত্রাকার উর্বর নরম মাটিতে এক কোমর জলের পাখিরা গলা ডুবিয়ে কীটনাশক জলে স্নান করবে
সকলের দেহে সেবিকার ডান তলপেটের ক্রনিক জ্বর জ্বর ভাব লুকিয়ে আছে অভিশাপ গ্রস্ত সাদা রাজহাঁসের মত
ঈশ্বর হত্যা কখনো হয়তো করেছেন ধ্রুবপদের জন্য
পরাজিত মানুষেরা পিঁপড়ে দানার মত ঢাকা থাকে কবরের নিচে সব শ্বাপদেরাই নিভৃত বৃক্ষের তলায় রেখে দেয় শীতল জলের কাপালিক স্নান
শ্মশান থেকে ফিরে আসা শশ্মানযাত্রীরা দুটো বেগুনি রংয়ের মাংসল পরমাত্মা দেহকে রজনীগন্ধা ভেবে বাড়ি নিয়ে যায়
তাদের মুখেও অ্যালকোহলিক ব্যাঙাচিগুলোই উঁকি দিয়ে নামে সত্যভামার মত
আমি কোনদিন ভুট্টা দানার মতো পরকীয়াকে অস্বীকার করিনি নৈসর্গিক ময়ূরী চরিত্র নিয়ে রাত্রির মধ্যম প্রহরের নর্তক হয়ে যাই
সমুদ্র বৃক্ষের প্রাচীন ক্যাকটাস ফুল গুলো হঠাৎ অরকেরিয়া বৃক্ষটির নাভি থেকে নির্ণয় করবে আমাদের সমগ্র সর্বনাম পদ
ঈশ্বর চুপি চুপি সব দেখে যাবেন নিজের গায়ের হলুদ পোশাকটি ফেলে
স্তনবৃন্তের ঘাসগুলো দূর্বা ঘাসে গজিয়ে উঠছে শিফন মৃত শামুকের ভেতর
সপুষ্পক বিভাজিকারা ক্লোরোফরম খুঁজছে , যাকে ভয় পেয়ে মা চিরদিন চিরহরিৎ হয়ে গেছে
লাল রঙের পরিচ্ছদ আমার থার্টি ডিগ্রী সূক্ষ্মকোণের বরফ শরীর , যাকে নিয়ে রোজ নিষিদ্ধ ক্ষেত্র থেকে আবার ফিরে আসি মঞ্জিরা ও মাধুকরী হাত নিয়ে
জয়দেব বাউরীর কবিতা
আলোর দোতারা
২৭.
ফিউজ বেঁধে, মেন সুইচ যেই ওঠে
অন্ধকার উধাও; আলো ঘরজুড়ে।
তেমনি করে হঠাৎ দুই করপুটে
ছাপিয়ে আলো ঢুকেছে দূর অন্তরে।
জীবন তবে সামিল হল উৎসবে?
নদীর ধার। 'রূঢ়-ভারত'। কারখানা।
ইস্পাতই বানাও। কোন শৈশবের
দুঃখ মুছে আকাশ হলো আটখানা।
কিন্তু দেশ ডুবছে এক সংকটে...
আগুন জ্বলা অন্ধকার এরাজ্যেও।
পঁচাত্তোর তোমাকে দিল ভাত পেটে
কিন্তু কেড়ে নিচ্ছে এক স্বস্তিও।
একার কথা ভাববে নাকি আর কারো?
কারখানার আশপাশেই 'হও জড়ো।'
২৮.
যেখানে বসত করে সুর। রাখালিয়া
চরাচর নির্নিমেষ জাগে সারা বুকে।
সহজ, বাতাসে এসে দূর মরমিয়া...
সেই মাটি সেই জল, গাছ যাকে তাকে
ঠাঁই দেবে, বলো? বিশেষত রণ-হিংসা,
শত্রু ভেবে রক্তপাত,ক্ষয়! সে পারেনি
মনসার সান্ধ্য জাত ভুলে, পার্টি-ভাষা
দল-ভাষা রপ্ত করে নিতে। টানাটানি
শেষ করে সে, শ্রমিক শুধু। শ্রম-ক্লান্তি
ভুলে যেতে যে ধরেছে গান। গ্রাম্য সুর
প্ল্যান্ট ঘুরে উড়ে যেতে চায়। তার শান্তি
কুয়োতলা,বটছায়া, ঘাট থেকে দূর
অরণ্য পেরিয়ে এসে ভাঙা সে-ভিটেয়
মাটি ছেড়ে তারা খোঁজা সেই আকাশেই।
উৎপল দাসের কবিতা
প্রেমের কবিতা
১.
হয়তোবা এখন তুমি গভীর স্বপ্নে হেঁটে যাচ্ছো। ফুলেরা ছুঁতে চাইছে তোমাকে, তুমি তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে সুগন্ধি বাতাস নিচ্ছো।
আমি জানি স্বপ্নে বোনা কোনো ইন্দ্রজাল
তোমার মনে ভালোবাসা জাগাতে পারবে না।
তোমাকে স্বপ্ন থেকে বিদায় দিয়ে
জেগে উঠি প্রতিদিন...
২.
যেই বললে ভালোবাসি
আমি ফাগুন হয়ে গেলাম
আজ আমার রঙিন হবার দিন
আজ আমার ডানা মেলার দিন
তোমাকে নিয়ে ফুলের কাছে যাবো
মধু দেব মুখে
৩.
আবার একদিন তোমাকে দেখতে চেয়ে
ব্যাকুল হবে মন
তখন রাত্রির কাছে আলো চাইব আমি
গাছের কাছে শীতল হাওয়া
সে তো অনেকদিন আগের কথা
তুমি হেঁটে এলেই টের পেতাম
এখন আর্ ঐসব অনুভূতি নেই
সেদিন জল সইতে এসেছিল
তোমার পরিজনেরা যখন
কালবৈশাখী ঝড় উঠেছিল
৪.
তুমি সুখে আছো। তোমারই এক বন্ধু একথা জানিয়ে গেল...
যেন বসন্তের দুপুরে পলাশের রঙ মাখানো বন্ধুর লেখা চিঠি
সুখে আছি হে...
কোকিল ডেকে উঠলো
আমারও আজ কোনো দুঃখ নেই...
শ্রীদাম কুমারের কবিতা
১.
শীতের দিনে
শীতের দিনে
দুঃখের কথকতা নিয়ে
বেঁধে বেঁধে থাকি খুব
শীতের গ্লানি যায় ক্ষয়ে ক্ষযে
বসন্ত রঙ হাসে পাতায় পাতায়
আশ্বাসে বিশ্বাসে ঘরবাঁধা
আশ্রয় বৃক্ষমূলে
কে জানে এ গোপন ফাঁদ
ভিড়েছি কি ভুল ছাতার তলায়
২.
কুয়ো
কুয়োতে কে আর ঝাঁপ দেয়,শখে
পা ফসকেই
পড়ে যায় কেউ কেউ কখনো
প্রাচীর বিহীন হলে,
অসতর্কতায় প্রমাদবশতঃ
কুয়োর জাতক মেঢ়কই
কেবল জীবৎকাল কাটাতে পারে
নিশ্চিত আশ্রয় ভেবে
খন্ডিত আকাশ নিয়ে...
সেরকম বর্ষা হলে, ঘনঘোর
টইটম্বুর চারধার
মত্ত দাদুরিবোল, মৃদঙ্গ বাউলে নাচে
চারপাশ। সৃজনের অমোঘ ডাক আসে...
মুক্তির বিশ্ব, আনন্দ ভুবন
চরাচর জুড়ে..
কে পরাবে আগল
সব কাঁটাতার ডিঙিয়ে, লালসুতোবাঁধন পেরিয়ে
অবাধ আকাশ এসে ছু্ঁয়ে যাবেই
“জীবন কথার নদী"; নদী ও নারীর এক নিবিড় আখ্যান।
মধুপর্ণা
“জীবন কথার নদী” তে ত্রিকূট পাহাড়ের ঢালে জাত ময়ূরাক্ষ্মী নদী এবং সেই পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় ছোট গ্রাম পুনাসির মেয়ে বিজলির জীবনের প্রবাহ থেকে যে কথকথার জন্ম হয়েছে তার উপজীব্য বার্তা হল পিতৃততান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রকৃতি ও নারী উভয়ের নিপীড়ন ও শোষণের উৎস। অধ্যাপক মলয় মুখোপাধ্যায়ের এই উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালে, অক্টোবার মাসে। সোপান পাবলিকেশন থেকে। উপন্যাসটি তিনি উৎসর্গ করেছেন পোর্টালজিস্ট সুতপা মুখোপাধ্যায়কে। বইটির প্রস্তাবনা লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের সভাপতি কল্যান রুদ্র। প্রচ্ছদ করেছেন। দেবাশীষ সাহা। এবছর প্রকৃতিকেন্দ্রিক নারীবাদ নিয়ে যখন অল্প বিস্তর চর্চা করছি, তখন আশ্চর্যভাবেই মলয়দার বাগানে ফেব্রুয়ারীর এক চড়ুইভাতির দুপুরে বইটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। প্রকৃতিকেন্দ্রিক নারীবাদ বিষয়ে পূর্বে পড়া বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ নতুন করে আত্মস্থ হল, এই উপন্যাসটি পাঠের পর।আরও পড়ুন
মানভূমের লোকছড়া
তপন পাত্র
(আগের সংখ্যার পরবর্তী অংশ)
ঘুমপাড়ানি ছড়া :--- মানভূমে ঘুমপাড়ানি ছড়াকে আবার ঘুমপাড়ানি গানও বলা হয় । কারণ এই ছড়াগুলি উচ্চারণের সময় এমন ধীর বা ঢিমে সুর-তাল-লয় ব্যবহৃত হয় যে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা হবে এগুলি না ছড়া, না গান; যেন ছড়া ও গানের এক মোহময় মেলবন্ধন । অনেক চেষ্টা করেও যে শিশুকে ঘুম পাড়ানো যায় না, তার গায়ে খুবই আলতোভাবে চাপড় মেরে মেরে সুরে ছন্দে ছড়া বলে ঘুম পাড়াতে হয় । ছড়ার ছন্দের দোলায় ধীরে ধীরে শিশুর আঁখি পাতে নীদ আসে , নরম নয়নের পাতা বন্ধ হয়ে যায় । মা-মাসি-ঠাকুরমাদের ছড়ায় ঘুমপাড়ানি মাসি পিসিদের এখানে নানা রকম নাম । কেউ বলেন "বনচড়'য়া" কেউ বলেন "নিদচড়'য়া" আবার কারও মুখে উচ্চারিত হয় "ঘুমকরা" । এরা সবাই ঘুমদেশের কল্পিত প্রাণ, পশু-পাখি । কখনো বা এই নিদ্রাদেবী ভালুক, টিয়ে ইত্যাদি নামে আবার কখনও বা শুধুই পাখি বলে, ঘুমানি নামে সম্ভাষিত ।
ঘুমপাড়ানি একটি ছড়া ---
"আয় ঘুমানি আয়,
ভালুক তেঁতুল কুড়াঁই খায়।
ভালুক নুন কুথায় পায়,
বল্অ ত্যাল কুথায় পায়।
আনলা মানলা খাঁইয়ে ভালুক
বনে পালাঁই যায়।"
ছড়াটি থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে একদা মানভূম অঞ্চল সবুজ নিসর্গ প্রকৃতি তথা বনাঞ্চলবেষ্টিত ছিল । কারণ অতি সাধারণ শিশু-ঘুমপাড়ানি ছড়াতেও বার বার ইঁদাড়ে পিঁদাড়ে বন-জঙ্গল, ঝোপ-ঝাড়, বুনো পশু-পাখির কথা এসেছে ।
আরেকটি ছড়া ---
" আয়রে আয় টিয়া,
লাফ ঝাঁপ দিয়া,
খকা আমদের পান খাঁইয়েচ্যা
শাউড়ি বাঁধা দিয়া।"
অন্য একটি ছড়ায় বনচড়'য়াকে এবং আরেকটিতে নিদচড়'য়াকে আহ্বান জানানো হচ্ছে শিশুকে ঘুম পাড়ানোর জন্য ।
(১) "আয়রে আয়, বনচড়'য়া
বনে বনে যাই,
খঁকার মা পান খাঁইয়েছ্যা
পয়সা কুথায় পাই ?"
(২) "আয়রে আয় নিদচড়'য়া
নিতই পাপা খায়,
কন চড়'য়া পাখি মারে
পাপা রুটি খায় ।"
আবার অন্য একটি ছড়ায় বলা হচ্ছে --
" আয়রে টিয়া টশকণা ,
খা'তে দিব রে বড়ধনা ।
খাবি দাবি আর মকমকাবি,
আমদে খকাক্ ঘুম পাড়াবি।।"
প্রায় একই কথা অন্য ছড়াতে ---
" আয়রে পাখি ব'সরে ডালে,
ভাত দিব রে সনার থালে।
খাবি দাবি আর গান করিবি,
আমদের খকাকে ঘুম করাবি।"
এ প্রসঙ্গে একটি অত্যন্ত পরিচিত ছড়াও আমাদের মনে আসে ---
" খকা ঘুমা'ল পাড়া জুড়া'ল,
বর্গী আ'ল দেশে।
বুলবুলিতে ধান খাঁইয়েচে
খাজনা দিব কিসে ?"
(৩) মেয়েলি ছড়া বা পারিবারিক ছড়া :-- মানভূমের ছড়ার ভান্ডারে এমন কিছু ছড়া আছে, যেগুলো সাধারণত মেয়েরাই ব্যবহার করেন এবং যার বিষয় কোন না কোনভাবে মহিলারাই; তিনি মা হতে পারেন, বোন হতে পারে আর ঝিও হতে পারে । ছড়াগুলির সঙ্গে মানভূম সমাজজীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে ।
অভাব-অনটন জর্জরিত মানভূমের অস্বচ্ছল পরিবার । তদুপরি পণপ্রথার জটিলতা । বিবাহযোগ্যা মেয়ের বিবাহের ব্যবস্থা করতে পারেননি মা-বাবা । কিন্তু নিছক মানব জীবনে কেন, সমস্ত প্রাণীর ক্ষেত্রেই যৌবনধর্মের কিছু স্বাভাবিকতা রয়েছে । যুবতি মেয়ের শরীরে যৌবন এসে গেছে । উপযুক্ত বয়সে বিয়ে হয়নি বলে সে নিজের মতো ছেলে পছন্দ করে তার সাথে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাইছে । মেয়ের সেই মনোভাবটি ফুটে উঠেছে মায়ের উদ্দেশ্যে একটি ছড়া কাটার মধ্য দিয়ে ---
"মাই গো মাই , বিহা দিলি নাই,
কন গাড়িতে পালাঁই যাব
দে'খতে পাবি নাই ।"
আবার কেউ কেউ বলেন, "রেলগাড়িতে চা'পে যাব দেখা পাবি নাই।"
নানান সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সাম্প্রতিককালে মানভূমেও মেয়েদের বিয়ের পর শশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য মন কেমন করা হৃদয়বিদারক কান্নাকাটি লক্ষ্য করা যায় না । কিন্তু পুরানো দিনে, বিশেষ করে বালিকাবধূদের শ্বশুর বাড়িতে যাবার সময় কান্নাকাটির রোল পড়ে যেত । সেই নিরানন্দ বিরক্তিকর ভাবটি ধরা পড়েছে একটি ছড়ায় । শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে এসেছে বলে তাদের প্রতি এতোখানি বিরক্ত হয়ে উঠেছে যে একটি প্রচলিত গাল পর্যন্ত ছড়ায় ব্যবহৃত হয়েছে ।
" মাই গো মাই ,মাথা বাঁ'দে দে
সশুর ঘরের খালভরারা
লে'গতে আ'সেচে ।"
শুধু যে মেয়েটির মন খারাপ, সে একাই শ্বশুরবাড়ির প্রতি তিক্ত বিরক্ত তা নয় , তার ভাইটিরও মন ভালো নেই । তাই সে প্রকৃতির কাছে ছড়ার মধ্য দিয়ে প্রার্থনা জানাচ্ছে বেদনাবিধুর চিত্তে । আজ যেন প্রবল বৃষ্টি নামে । যদি আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি আসে, তাহলে তার জামাইবাবু দিদিকে নিয়ে যেতে পারবে না । তার দিদি অন্তত আরো একটা দিন বাপের বাড়িতে তাদের কাছেই থেকে যাবে।
"দে ভগবান গা'দে জল
দিদিক্ লে'গচে সশুর ঘর।"
শ্বশুরবাড়িতে গৃহবধূর সঙ্গে শাশুড়ি ননদের সম্পর্ক কোনোকালেই মিষ্টি-মধুর নয় । অল্প কিছুতেই শাশুড়ি মাতা বৌমা ও তার বাপের বাড়ি প্রতি ঠাট্টা বিদ্রুপ করে কথা বলেন । তার পরিচয় পাওয়া যায় মাত্র দুই চরণের একটি ছড়ায় ।
"ই বাড়ির ঝিংআ লৎ উ বাড়িকে যায় ,
বড় ঘর্যার মাঞাছানা ঝিংআ নাহি খায় ।"
আবার কোন কোন ছড়ায় ছেলে ও বৌমা'র অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা এবং ছেলের মা বাবার প্রতি কর্তব্যহীনতার পরিচয় পাওয়া যায় ।
" হায়রে হায় ! কলির ব্যবহার,
মাইকে দেই কিল দুম্ দুম্ , বউকে নমস্কার।
হায়রে হায় কলির ব্যবহার,
মাইয়ের গায়ে ছেঁড়া ট্যানা, বউয়ের গলায় চন্দ্হার।"
(শেষ অংশ পরের সংখ্যায়)
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের চিত্রশিল্প : ভারতীয় মুরাদ (আন্তর্জাল)
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন