গ্রন্থালোচনা : হাজারীবাগের কবিতাগুচ্ছ





'দক্ষিণের বারান্দা' প্রকাশিত ফর্মা- সিরিজের কবিতা -বইয়ের সম্ভারে  এক ধ্রুপদী 
মানের বই - 'হাজারীবাগের কবিতাগুচ্ছ'।
কবি সুপ্রিয় দেওঘরিয়া। 
প্রচ্ছদ- দিনকর কৌশিক।
মুদ্রণ বিন্যাস সম্পাদনা গর্ব করার মতো।

১৬টি নিটোল কবিতা  মলাটবদ্ধ ।  নিঃসন্দেহে কবিতা-প্রিয় পাঠকের অবশ্য সংগ্রহযোগ্য।

নজরকাড়া সবুজের গতিময় প্রচ্ছদ-জড়ানো   ' হাজারীবাগের কবিতাগুচ্ছ ' কাব্যগ্রন্থটি। আমার কাছে এটি কবি বন্ধুর নিজ হাতে তুলে দেওয়া এক সানন্দ  প্রীতিউপহার।

গদ্যের আঙ্গিনায় সাবলীল  পদচারণার মধ্য দিয়েই কবিতার অনন্য বিচ্ছুরণ তুলে আনার সফল ও সার্থক প্রয়াস কবি সুপ্রিয়  দেওঘরিয়ার এই কবিতা-বই।

আটপৌরে গদ্যে কথা বলতে বলতেই কবি পাঠক শ্রোতাকে এক লহমায় নিয়ে যান কবিতার দিব্যভুবনে। নানা দিক দিয়েই এই কবিতাগুলি   যে সুপ্রিয় দেওঘরিয়ার ,কবি হিসাবে পরিণত মনস্কতার চিহ্নবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এযাবৎ তিনি যেসব কবিতা লিখে এসেছেন ,নিরীক্ষামূলক গুটিকয়েক বাদ দিলে, কবিতায় মেধাবী-স্বাক্ষর ও রসোজ্জ্বলতা দেখে বহু কবিতাপ্রেমী ও গুণীজনেরা মুগ্ধ। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই, সৃজন-দক্ষতা স্বতোপ্রকাশমান।

এই কবিতা গ্রন্থের পাতায় পাতায় এক মগ্ন-কবির স্মৃতিমেদুরতা মাখানো । অনুভব করা যায় হাজারীবাগের প্রতি কবির এক আন্তরিক টান। এই টানেই স্মৃতির পটে থাকা নানান ছবি লিপির তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিসত্ত্বার  সঙ্গে চিত্রশিল্পী সত্ত্বার পরিচয়টিকে চিনে নেওয়া যায় সহজেই।

 প্রবেশক বা  ১-সংখ্যক কবিতা যাই বলি না কেন , পড়লেই এই কাব্যগ্রন্থের স্বরূপের খানিকটা আভাস মেলে--
"  ১. 
জঙ্গলের মাঝে একটি রাস্তা শহরে চলে যায়। সাথে আমাদের জীবন। বুকের মাঝেও একটা শহর গড়ে ওঠে, জীবন থেকে যার উৎপত্তি। তাকে সাজিয়ে রাখি স্মৃতি দিয়ে। যা কিছু দেখা-যা কিছু শোনা সব অজানা বুনো ফুলের গন্ধের মতো ফুসফুস থেকে অলিন্দে ঘুরে বেড়ায়। সেই অরণ্য, সেই মানুষের শহর, সেই আনন্দরাজি, সেই অভাব অনটনের যৌবন আর বাকি সমস্তকিছু - সবই পুরনো দিনের ফেলে আসা গল্পের বইয়ের থেকে যেন একটা একটা উঠে আসে। মনে পড়ে সব আঁকা চিত্রপটের মতো। কেমন আছো, প্রিয় শহর ? "

--একটি শহরের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা দেওয়ার সময় বা রাস্তার কথা বলতে গিয়ে ভাষা হয়ে উঠেছে মনোময়। একটি শহরের প্রতি কবির গভীর ভালোবাসার  প্রাণময়তায়  সবকিছু তরঙ্গিত হয়ে উঠেছে। হাজারীবাগের প্রতি কবির হৃদয়ের প্রগাঢ় প্রলেপে শহরটি ব্যক্তিসত্তা লাভ করেছে। সাহিত্য রসিকেরা একেই Personification বলে থাকেন। কবির কাছে হাজারীবাগ এক প্রিয় পুরনো বন্ধু।


এই কাব্যগ্রন্থের টানাগদ্যেই(breakless lines)           ভাষার ভাব-প্রবাহে কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছে সাঙ্গীতিক মূর্ছনার আবহ । যেমন ৮ সংখ্যক কবিতাটি--

".... দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা মৎসকন্যারা আমাদের  যেন গোপন ইশারায় ডাক দিত, রূপালী দুনিয়ার নায়কদের মতো। আমাদের সদ্য যৌবনের আভিজাত্য আর বাড়িয়ে বলার বিষয়টুকু হয়ে তুমি এখনো মনে হয় যেন গিটারের কর্ডস, বুকের মাঝে জবানি জানেমন, হাসিন দিলরুবা! "

হাজারীবাগ কবিতাগুচ্ছের এক  অন্তর্লীন ঘোরের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে মনে হয় দক্ষ গিটার বাদকের মতই কবি সুপ্রিয় আমাদের মনে কবিতা দিয়েই গিটারের  ধুন বাজিয়েছেন--

"....শুধু অদূরে পাহাড়ের কোলে যেন বাজছিল প্রাণচঞ্চল সুর—তা না না তা না না না না'...

প্রকৃতিপ্রীতি স্মৃতিচারণা শহরটির প্রতি লালিত দুর্নিবার আকর্ষণ গুচ্ছকবিতার ভাষাকে দিয়েছে এক আশ্চর্য স্বাদুতা । আর  আমাদের নিয়ে যায় আখ্যানের মায়ামাখা এক অন্য আকাশে, যেখানে--

" শহরটাকে অনেকটা স্বপ্নের মালগুড়ির মতো মনে হত। একটু দূরেই সরজু নদী যেন সুবর্ণরেখা, আর মেম্পি হিল কেসের মতো কানহারি পাহাড়ের গোপন পাথরগুলি।..."

  সামগ্রিকভাবে আমাদের চেতনাপ্রবাহে 'হাজারীবাগের কবিতাগুচ্ছ' কাব্যগ্রন্থটির   অভিঘাত প্রসঙ্গে  মনে হয় কবি  বোদল্যেয়রের অভিমত খুবই প্রাসঙ্গিক ও প্রণিধানযোগ্য। 

তাঁর গদ্যকবিতা সংকলন Paris Spleen-এর প্রকাশককে তিনিএকটি ব্যক্তিগত চিঠি লেখেন যা বইটির ভূমিকা হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। সেখান থেকেই তাঁর প্রাসঙ্গিক কথাটি তুলে আনা হলো  । কবি সুপ্রিয়র আলোচ্য বইটির  টানাগদ্যও  --

"..... musical without rhythm and without rhyme, supple enough and choppy enough to fit the soul's
lyrical movements, the jolts of consciousness?....."

কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা  ঘটনা  মানুষের গল্পের কথা কবি মেলে ধরেছেন। একটি হকারের কথা কিছুতেই ভোলা যায় না। মানুষের দৈহিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার কোন দুর্জয় নিশান যদি থেকে থাকে তবে তা, এই চাওয়ালা ব্যক্তিটি--

" ১০.
............
 বুঝতে পারি না কি করে লিখব সেই সব কথা।
মাথায় গামছার পাগড়ি পরা সেই হকারটির কথা—রোজ সকালে যে ইউনিভারসিটির
গেটে দাঁড়িয়ে চায়ে চায়ে ডাক দিত। বিকল ছিল যার শরীরের একটা দিক, তবু কি এক
প্রত্যয়ের সাথে বাম হাত দিয়ে চায়ে দো চমচ্-শক্কর তিন চমচ্ আর পানীমে দুধ  মিলাকে ডাক দিত-‘স্যার চায়ে’। নাহ্ এই কথাগুলো বলা যায় না সহজে! "

মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস মর্যাদাবোধ ও অপরিসীম ভালোবাসায় কবি এই মানুষটির ছবি উজ্জ্বল রঙে আমাদের চোখে এঁকে দেন।


     প্রিয় শহরের কথা বলতে গিয়েও কবি আদিবাসী মেয়ে টুসু পার্বণ উৎসব আর গ্রামের কথা তুলে এনেছেন। যা এক ঝলক মুক্তির বাতাস বইয়ে দেয় শহরের বুকে, ছড়িয়ে দেয় এক গহন অনাবিল আলো। বিষয়টা স্পষ্ট হবে  ৪-সংখ্যক কবিতাটিতে --

" 8.
আদিবাসী মেয়েগুলি বসত তাদের সমস্ত টুসু কন্যাগুলিকে নিয়ে। আঁটসাঁট করে পরা
শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে হিম লাগত। কুয়াশার সাথে গান ভেসে আসত জঙ্গলের মাঝে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঝুপড়ি গ্রামগুলি থেকে। পাশের মফস্বলের ঠেকগুলিতে উদ্দাম
গান, মাদল, খেজুরগুড়,দেশী মদ আর আনন্দ উপচে পড়ত। সরু নদী, ভাঙা ব্রীজ, পিচ
ওঠা সড়ক, টুকরো পাহাড়, শাল জঙ্গল হয়ে টুসুগান আমাদের শহরে প্রবেশ করত।
শহর পিঠে জানত না, গান জানত না। তবু বাতাসের সাথে টুসু গান শহরের মাঝেও
যেন একটা গ্রাম নিয়ে আসত। হোটেলে, বাসস্টপে, রেস্টুরেন্টে দলছুট কাজের
লোকেরা সব ভিড় বয়ে নিয়ে যেত গ্রামে। শহর পাহারা দিত শুধু লাইটপোস্ট এবং
সবচেয়ে বিলাসবহুল রেস্তরাঁর পাইন গাছের দল। শাড়ির ঝলমলে পাড়ের মতো পৌষ
পার্বন নামত শহর ঘিরে থাকা গ্রামগুলিতে। "


 সত্যি এই কবিতার বইটিতে গল্পের খেই পাওয়া যায় না, থৈ হারিয়ে যায়। কত বিচিত্র আর হৃদয় নিংড়ানো রঙে তাদের নাম দিতে চেয়েছেন--

" ১০.
গল্পগুলো শুরু করাটাই মুস্কিল। চোখের সামনে এত কিছু দেখেছি, সবই তো গল্প।
        *      *     *
 ........ ....... ....   ....... .......

লিখতে গেলে সব ছবি হয়ে যায়, ছবিগুলি পুরনো অ্যালবামে সেজে থাকে যার নাম বৃষ্টিদিনের গল্প,তরুণ কিশোরের গল্প,পলাশঝরা প্রথম বিরহের গল্প, রাজপথে ফেলে দেওয়া প্রথম চিরকুটের গল্প,ফাগুন বাতাসে প্রথম নেশার চুমুকের গল্প। "

বস্তুত "গল্পগুলি সাজিয়ে লেখা খুব কঠিন।"
একটা কথাও বলা যায় না সহজে! 


এখানে  কাব্যভাষায় কোথাও কোথাও কবির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে। 'বাউন্ডুলে মেঘ ' , 'জামরুল  বর্ষার নীচে 'এগুলোতে অবকাশ ও উপাদান  থাকা সত্ত্বেও খুব একটা দানা  বাঁধতে পারেনি। এই বইটিতে তা দানা বাঁধতে শুরু করেছে, ভাষাকে দিয়েছেন পরাবাস্তবতার ছোঁয়া--

'' ১২.


 ...........শীতের সকালে খেজুর রস নিয়ে বসে থাকা বুড়ি মাসিমা- নাহ্ ছবি হোল না একটাও, গল্প হোল না একটাও, সেলফি
হোল না একটাও...ব্রিটিশ রাজের জেলের পুরনো শক্ত ইটগুলি আমাদের বুকের ওপার
থেকে এপারেও একটা দীর্ঘ পাঁচিল দিয়ে গেল- যার ভেতরেও বন্দী আছে একটা শহর
বাস্তব থেকে অনেক দূরে আরেক বাস্তবের আলোয়! "


চারপাশের বস্তু গাছপালার সঙ্গে কবির  অন্তরে আলাপচারিতা জমে উঠেছে--

"তেঁতুল গাছের দিকে চাইলেই তারা যেন বারবার জানান দিত আমরা সুখেই আছি। তবু তারজালির আঁচের নিচে পোড়া লিট্টি আর ছাই মাঝে মাঝে যেন বলে উঠত, ছুটি কতদূর?"
ভাষার এক ভিন্ন ধরন সহজেই চোখে পড়ে।  

  এই কাব্যগ্রন্থটি হাজারীবাগ শহরকে ঘিরে এক স্বাতন্ত্র্যদীপ্ত মরমী আলেখ্য হয়ে উঠেছে।
এটি যে কাব্যপ্রেমী পাঠকদের রসতৃষ্ণা মিটাবে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।


                             --- শ্রীদাম কুমার







মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪