তৃতীয় বর্ষ ।। দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ২৫ বৈশাখ ১৪২৯ ।। ৯ মে ২০২২
______________________________________________
আজ ২৫ বৈশাখ। কবিগুরুর জন্মদিনে লেখার কোনো ভাষা নেই আমার। এক সুবিশাল মহীরুহ, যার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে রয়েছে বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই মহীরুহের কাছে আমার অবস্থান ঠিক কোথায়? বাঙালির অবস্থানই বা কোথায়? বাঙালি কি তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে চলতে সমর্থ? যদি সমর্থ নয় তাহলে কি হবে এইসব হিঁজিপিঁজি লিখে?
আমাদের চলার পথে যেসব মূলধনের প্রয়োজন। যা অর্জন করে দিয়ে গেছেন এইসব মহান মানুষগুলো তা হারিয়ে ফেলছি আমরা। হয়ে উঠছি দিশেহারা। যার ফলস্বরূপ পরস্পর পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি ক্রমশ।
জীবনকে নতুন ভাবে বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে বাঙালির। সময় এসেছে অন্যের দিকে আঙুল না তুলে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখার। বাঙালি যতক্ষণ না আত্মবিশ্লেষণ শুরু করে ততক্ষণ তার উত্তরণের পথ যে বন্ধ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
বাঙালির জীবন যাপনে দ্বিচারিতা ওতপ্রোতভাবে ঢুকে পড়েছে। একসঙ্গে সাপ ও ব্যাঙের মুখে চুমু দিয়ে চলার এই প্রবণতা একটা সময় পর্যন্ত চলা সম্ভব। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে দীর্ঘ পথ হাঁটা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সফলতার চরম শিখরে পৌঁছানোও। তাই কেবল অনুষ্ঠান পালন করে আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয় আমাদের সংস্কৃতিকে। একে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে ব্যক্তি সংস্কার প্রয়োজন। প্রয়োজন স্ব সংস্কার।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
নির্মল হালদার / সুজন পণ্ডা / উৎপল চট্টোপাধ্যায় / সুনীতি গাঁতাইত / শ্রীদাম কুমার / কল্পোত্তম / তপন পাত্র
______________________________________________
নির্মল হালদারের কবিতা
আমার নিশান ওঠে পুব দিকে
----------------------------------------------
১.
প্রতিশ্রুতি
--------------
ঘরে ঘরে জল নেই তো কী হয়েছে?
ঘরে ঘরে মরীচিকা
মরীচিকার কাঁপন।
২.
সস্তা--সহজ
-----------------
আকাশের তারা গুনতে পারা
কঠিন হলেও,
গাছের পাতা গুনতে পারা
কঠিন হলেও,
মানুষের গণনা খুবই সহজ।
মানুষ খুবই সস্তা,
ভোটের লাইনে দাঁড়ায়।
সুজন পণ্ডার দুটি কবিতা
১.
এই গোধূলির ম্লান সূর্য ছাপিয়ে
প্রথম নক্ষত্রের আলো তোমাকে দিতে চাই,
যে চাঞ্চল্যে কাটিয়েছি সময়
যেখানে যতো গল্পের ভিড় -
আমাকে বোলো তোমার দিক থেকেও।
কতো গুলি দিন যেন?
ঠিক কতো গুলি চিঠি?
অনাবিল বিষাদ করেছি জমা শুধু
অসহনীয় কিছু ব্যথা...
নাকি স্মৃতি শুধু??
কার রক্তে নীল এই সমুদ্র?
কার অভিমানে হিমালয়?
আমাকে শুনিও তোমার দিক থেকেও
এই নক্ষত্রের প্রথম আলোয় এসো
নতুন করে দেখি
যেখানে যেটুকু বাকি
তোমার অথবা আমার দিকে।
২.
ইতস্তত কিছু পোষ্টকার্ড
ছড়িয়ে ছিটিয়ে অক্ষর কিছু
যেন বা বরফ কুচি
বুকে বেঁধে নিয়েছি
আঃ কি শীত...
অথচ বিঁধেছে কাঁচের গুঁড়ো
আহত রক্তাক্ত সময়ে।
সেই যুবতী বলেছিল
আমাকে হাত ধরে পার করে দাও
এই দহনকাল।
আমি সেই পোড়া গন্ধ মেখে
জেগে আছি এখনো,
বিষণ্ণ আলোর মত
যেভাবে অপরাহ্ণ নিশ্চুপ দাঁড়ায়
ক্ষয়ে যাওয়া গোধূলি জড়িয়ে।
অপ্রাসঙ্গিক
উৎপল চট্টোপাধ্যায়
খুব সহজেই রোদ কুড়াই
অপ্রাসঙ্গিক বৃষ্টি
খুব সহজেই মরা মানুষের হাড় দিয়ে
যাদুককের সুচতুর দৃষ্টিভ্রম
চোখ ঠেলে ক্লান্তির শ্বাস মেশানো আগুনে
কঙ্কাল কঙ্কাল খেলা
অরন্ধন রান্নাঘরে সীমাহীন নিস্তব্ধতায়
শীতল উনুন.........কলঙ্কের কালি
এবার চোর সেজেছেন রাজা
এবার ভগবানের ভূত নিয়ে হবে মাদারীর খেল
আন্দোলনের মাথায় লাথি
সমস্ত চেনা দৃষ্টি.......সমস্তই চেনা চোখ
শুধু দৃশ্যের অন্তরালে পশুবলি
শকুণির পাশায়.........বাজি মানুষ
এ যে সে মানুষ নয়
পেটে গামছা বেঁধে আলু পুড়িয়ে
খাচ্ছে শতাব্দীর পহেলা পোয়াতি .....
যাবো কেন যাবো?
সুনীতি গাঁতাইত
পাতারা চৈত্র মাসে খসে পড়ে
ধূলার ওপর মাখে অনাদর
সময় কান্নাকে করে কেন আশ্রয়?ক্লান্ত ঘামের প্রহর
ছুঁয়ে জীবন ফেরিওয়ালা।
চলে যাবো আগুনের ফাগুন তো নিয়ে শেষবার ইচ্ছেটি জেগে থাকে, কেন যাবো?
কুয়ো-বন্দি
শ্রীদাম কুমার
তিন-চারটে তারা দেখাবে বলেছিলে,
কই? একটা দুটোই
দেখতে পাচ্ছি !
ঘুরপাক খেয়ে দেখি
সেই ছোট্ট আকাশটাই।
আরও তারা, আরও বড় আকাশ
তুমি আর দেখালে না....
এই কুয়ো থেকে
বেরোনো হলো না আমার।
কৃষিতন্ত্র - ৫০
কল্পোত্তম
ধুতি বা গামছা পরে ঠাকুর আনতে যাই।
কুমারীর তীরে আমাদের ক্ষেত
আমি ঠাকুর আনতে যাই শুভ দিনে
শুদ্ধতার সাথে।
জল ছিটিয়ে গোবর দিই
ধূপ-সিঁদুর-আতপ-চিনি, বেলপাতা দিয়ে
প্রণাম করি।
পাঁচটি ধান গাছির মধ্যে দায়ে চারটি কেটে
মাটি-শেকড়সহ তুলে নিই মাঝেরটা
যেটাতে বিজোড় শিস, পাঁচ সাত বা নয়,
মাথায় তুলে নিয়ে ফিরে আসি
কপালে ঝুলে পড়ে শিস
গড়িয়ে পড়ে মূলের কাদামাটি
অন্ধকার জমে ওঠার আগেই ঘরে ফিরি
এভাবেই ঘরে ফিরি প্রতি বছর;
ঠাকুর আসে না
আসে শস্য, আসে
আমার মেয়ের মুখের হাসি।
মানভূমের লোকছড়া
তপন পাত্র
( আগের সংখ্যার পরবর্তী অংশ)
এছাড়াও নানা শ্রেণীর লোকছড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মানভূমের আনাচে-কানাচে । এখনো মূলত ছেলে-মেয়ে ও মহিলাদের কন্ঠে সেগুলি অল্পবিস্তর শোনা যায় । একথা অনস্বীকার্য যে সময় যতো যান্ত্রিক হয়ে উঠছে লোকছড়া ততো অবলুপ্তির পথে পা বাড়াচ্ছে । সাম্প্রতিককালে লোকক্রীড়া তো আর দূরবীন দিয়েও দেখা যায় না বললেই চলে । কিন্তু কিছু লোকক্রীড়ার সঙ্গে যুক্ত ছড়া আজও ছড়িয়ে আছে ।
লোকক্রীড়ার মধ্যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি খেলা "ইকিড় মিকিড়"। এই খেলার সঙ্গে যুক্ত ছড়া টি হল ---
" ইকিড় মিকিড় চাম চিকিড় ,
চামকৌটা মকদ্দমা ।
রাজার ঘরে জগন্নাথ
জগন্নাথ এর হাঁড়িকুড়ি,
দুয়ারে ব'সে চাল কাড়ি ।
চাল কা'ড়তে হ'ল বেলা ,
ভাত খাঁইয়ে যা জামাই ছে'লা।
ভাতে প'ড়ল মাছি ।
কদা'ল দিয়ে চাঁছি ।
কদা'ল রে বঁটা
খা শাউড়ির মাথা ।"
বেশকিছু খেলায় লক্ষ্য করা যায় সেখানে খেলাটির চাইতে ছড়া নিয়ে খেলাটাই প্রধান হয়ে ওঠে এবং সেই ছড়ার যে প্রকৃতপক্ষে অর্থ কী তারও কূলকিণারা নির্ণয় করা যায় না ; কিন্তু একটা আনন্দ মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায় , যা থেকে খেলার আনন্দরস আস্বাদিত হয় । এই জাতীয় একটি খেলার নাম "আটুল বাটুল"। ছড়াটি হল --
" আটুল বাটুল সিমলা সাটুল
সিমলা গেছে হাটে
সিমলাদের বউগিলা
দুয়ারে বসে কাঁদে ।
আটুল বাটুল সিমলা সাটুল
সিমলা গেছে হাট
কড়ি নাই, পাতি নাই ,
দে পড়শী ভাত ।"
খেলাধুলার ক্ষেত্রে 'ফুড়ি'কে মানভূমের লোকজন 'হাঁড়ি' বলে । বিভিন্ন লোকখেলায় হাঁড়ি ও রাজা নির্বাচনের সময় খেলোয়াড়েরা দলবদ্ধভাবে একটি ছড়া আওড়ায় ---
" বোম্ বোম্ শালুক ডাঁটা
এতদিন ছিলে কুথা ?
সেই সেই সিদ্ধর বনে ।
সিদ্ধর বনে বাগ ম'রেচে,
আমাকে যা'তে ব'লেচে
তুমি লাও ঘি কলসি ।
আমি লিই বেজ বাঁশি ।
যে নাই ঘুরে লাচে ,
তার মুহে মুড়ি ভাজে।"
কিৎ কিৎ খেলার দুই চরণের প্রায় সর্ব জনপ্রিয় ছড়াটি হল--
"সামল কিৎ কিৎ ভোগোবান,
চুটকি ধ'রে টা'নে আন।"
পথে-প্রান্তরে বালিকে লম্বাভাবে গাদা করে তাতে কাঠি লুকিয়ে কাঠি খোঁজার খেলার ছড়াটি বেশ মজাদার ---
" লুকুলুকি দাড়ি
শুকু চাল কাড়ি ।"
খেলাধুলার কথা বাদ দিলে এই অঞ্চলে কিছু ঐন্দ্রজালিক ছড়ার ব্যবহারো লক্ষ্য করা যায় । যখন বর্ষাকালে টানা কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি ঝরতে থাকে, চতুর্দিকে মাটির দেওয়াল যুক্ত খড়ের ঘর ও ছাউনিহীন মাটির পাঁচিল ধসে পড়ে, তখন অতিষ্ঠ হয়ে মানভূমের মানুষ বর্ষাবুড়িকে বিদায় নেওয়ার জন্য অনুরোধ করে ছড়ার মধ্য দিয়ে।
" এক পাই মুড়হি
যা বর্ষা উড়হি।"
আবার বৃষ্টির মাঝেই কোন সময় যদি রোদ ওঠে ঝলমলিয়ে, তাহলেও আনন্দে মানভূমবাসীর মন থেকে দু'লাইন বেরিয়ে আসে ---
" রোদ দিচ্ছে, জল প'ড়ছে।
খেঁকশিয়ালীর বিয়া হ'চ্ছে।"
এখানকার মানুষ মনস্তাপে অভিশাপ দেওয়াকে, শাপ-শাপান্ত করাকে বলে 'অড়া' বা 'কিরা' । তারা বিশ্বাস করে ছড়া কেটে কেটে কিরা বা অভিশাপ দিলে সে কিরা লাগবেই অর্থাৎ ফলপ্রসু হবেই । আবার ছড়া কেটে কেটে কিরা কাটাও যায় অর্থাৎ ছড়া কেটে কেটে অভিশাপ ফিরিয়ে নিতে চাইলে সেই অভিশাপ ফিরিয়েও নেওয়া যায়।
রেগেমেগে কাউকে কিরা বা অভিশাপ দেওয়ার সময় বলা হয় ---
" অড়া অড়া অড়া
ঘর গুষ্টি মড়া ।
ছড়া দিয়ে বা'র ক'রব
কুড়ি ঘরের মড়া ।"
আবার খানিক কলহ-বিবাদের পর মনোমালিন্য যদি মিটে যায় তখন অভিশাপ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বা কিরা কাটার জন্যও ছড়ার প্রচলন রয়েছে ---
" একটি ধানের দুটি শীষ,
কিরা কাটে খিশ খিশ ।"
অথবা
" ঘটির উপর বাটি ,
সাত কিরা কাটি ।"
সমগ্র মানভূমের বিস্তীর্ণ ভূগোল সীমা জুড়ে এখনো অসংখ্য ছড়া ছড়িয়ে রয়েছে । এমনকি মা মাসি বুড়ো বুড়ি ঠাকুরদা ঠাকুমায়েরা ছোটদের যে রা'ত কথা বা রা'তক'হনী শোনায় তার শেষেও ছড়া বলার রীতি রয়েছে । এই বিশেষ পরিচিত ছড়াটি হল ---
"আমার কহনী ফুরা'ল ।
ল'টা গাছটি মুড়া'ল ।
এ ল'টা মুড়া'স ক্যানে ?
গরু-এ খায় ক্যানে ?
এ গরু খা'স ক্যানে ?
বাগালে চরায় নাই ক্যানে ?
এ বাগাল চরা'স নাই ক্যানে ?
গুলিনে ভাত দেই নাই ক্যানে?
এ গুলিন ভাত দিস নাই ক্যানে ?
ছে'লা কাঁদে ক্যানে ?
এ ছে'লা কাঁদিস ক্যাঁনে ?
পিঁপড়ায় কামড়ায় ক্যানে ?
তালতলা তে থাকি ।
তালতলাতে ঠাঁই ,
কোঁঅল মাস পা'লে আমি
কুটুস করে খাই।
কুট ক'রে কামড়াব
আর মাটির নিচে সামাব।।"
এই ছড়াটির মধ্যে এক অত্যন্ত বাস্তব ও জীবন্ত সমাজচিত্র প্রস্ফুটিত । মানুষ তো নিজের অপকর্মের জন্য সদা সর্বদা অপরকেই দোষারোপ করে আবার দুর্বলের প্রতি সবলের আক্রমণটিও চিরন্তন। ছড়াটির মধ্যে এই দু'টি বিষয়ই অত্যন্ত সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে । যাইহোক এই ছড়া উচ্চারণের সাথে সাথে আমাদের এই আলোচনারো
"নটে গাছটি মুড়োলো ,
গল্প আমার ফুরোলো ।"
(সমাপ্ত)
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের চিত্রশিল্প : (আন্তর্জাল থেকে)
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন