পুঞ্চার লোকশ্রুতি / তপন পাত্র


পুঞ্চার লোকশ্রুতি
                      
                  তপন পাত্র


                    "লোক" শব্দটি দিন দিন জনপ্রিয়  হয়ে উঠছে । এর অন‍্যতম বড়ো কারণ একশ্রেণীর মানুষের মেধায় ও মজ্জাতে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে উঠছে যে, লোকসাহিত্য বা লোকসংস্কৃতি, লোকজন ও লোকযান নিয়ে একটা কিছু করতে পারলে লোকসমাজের কী কল্যাণ হবে সে কথা বড় নয়, কিন্তু কর্তা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠলে উঠতেও পারেন। তাই কতকিছু শব্দের পূর্বে "লোক" জুড়ে দিয়ে কত শব্দবন্ধ যে দিনরাত তৈরি হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই । এমনিতেই "লোক" শব্দের সঙ্গে "আয়ত" শব্দটি যুক্ত করে "লোকায়ত" শব্দটি বহু পুরাতন কাল থেকেই চলে আসছে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন "লোকহিত" শীর্ষক প্রবন্ধ । সেখানে "লোক" বলতে তিনি কাদের বোঝাতে চেয়েছেন, প্রবন্ধ পাঠান্তে আমরা তা বুঝতে পেরেছি। অক্ষয় কুমার দত্তের "পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা বর্ণনা" পাঠ করে পাঠকের মনে হয় দুরবস্থার শিকার পল্লীগ্রামস্থ প্রজারাই বুঝি প্রকৃতপক্ষে "লোক", লোক সাধারণ । নানাভাবে আমাদের মনের মধ্যে একটি ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মোটামুটিভাবে সভ্যতার মূল স্রোত থেকে সুদূরে অবস্থিত,  সুসভ্যতার আলোকবর্জিত নিরক্ষর কিন্তু সুসঙ্ঘবদ্ধ জীবনে বিশ্বাসী মানুষ গুলোই "লোক" । যারা ব‍্যষ্টি অপেক্ষা সমষ্টিতে বিশ্বাসী, যারা "আমি"র চেয়ে "আমরা" বলতে বেশি ভালোবাসেন, তারাই প্রকৃত পক্ষে "লোক" ।


                              আর "লোকায়ত" শব্দটি সময়ের সাথে সাথে তার অর্থ নানা পথে পরিবর্তিত করেছে । বিবর্তনের পথ ধরে শব্দটির অর্থ বিস্তার ঘটেছে এবং সংশ্লেষ বা রূপান্তরও ঘটেছে বলা যায় । আভিধানিক অর্থে "লোকায়ত" শব্দটির মানে "বেদবিরোধী চার্বাক মতাবলম্বী" বা "নাস্তিক"। প্রচলিত অর্থ বলে বেদ বর্জিত, চার্বাক শাস্ত্রানুসারী, অনাত্মবাদী বিষয়-ই হল লোকায়ত । কিন্তু প্রচলিত ও পুরাতন অর্থ বাদ দিয়ে এর বুৎপত্তিগত অর্থটিই আজকের দিনে বেশি বেশি করে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে । ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে এই শব্দটি সপ্তমী তৎপুরুষ সমাসবদ্ধ । এর ব্যাসবাক্য ---"লোকে আয়ত"।আবার বলা যায় "লোকের মধ্যে বিস্তৃত" , "লোকের মধ্যে ব্যাপ্ত", "লোকের মধ্যে প্রসারিত", "লোকের মধ্যে প্রচারিত", "সাধারণ লোকের মধ্যে প্রচলিত"। জনসাধারণের অধীন, জাতি -ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিক এক বলে স্বীকৃত যেখানে, যা ধর্মনিরপেক্ষ; তাই-ই লোকায়ত । একালে তো লোকায়ত রাষ্ট্র, লোকায়ত সরকার, লোক আদালত ইত্যাদি প্রভৃতি শব্দগুলির অধিক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং সব মিলিয়ে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে যে একেবারে সাধারণের মধ্যে প্রচলিত , সাধারণ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের , প্রয়োগ-অপ্রয়োগের বিষয়ই হলো "লোকায়ত"।
                           পশ্চিম বাংলার মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত, পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গবাসীর মনচিত্রে সদা সর্বদা সতত অনুরণিত মানভূম তথা পুরুলিয়া জেলার একটি ব্লক বা থানা পুঞ্চা এলাকার লোকায়ত বিশ্বাস নিয়ে দু'চারটি কথা লিখতে গিয়ে এত বড় ভূমিকাকে অনেকেরই অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে , কিন্তু আমার মনে হয়, যে বিষয়টির ওপর আলোকপাত সেই বিষয়টি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা লিপিবদ্ধ করা সমীচীন। 
                         পুঞ্চা থানার অন্তর্গত পাকবিড়রা এবং বুধপুর দুটি সর্বভারতীয় স্তরে ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান , লোকউৎসব ও লোকসংস্কৃতির লীলাক্ষেত্র রূপেও সবিশেষ পরিচিত । প্রত্নতাত্ত্বিক আলোচনাতেও এই দু'টি নাম বারবার উঠে আসে। এই দু'টি স্থানের মন্দির জৈন মন্দির নাকি ভৈরব থান ও শিবথান সে নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই । পাকবিড়রার আরেকটি বিশেষত্ব আন্তর্জাতিক ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত মানভূমের ভাষা আন্দোলনের ইতিবৃত্তে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে । কিন্তু যে কাহিনী তুলে ধরতে চাই তা হোল, পাকবিড়রার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দু'টি প্রচলিত লোককাহিনী ,বা লোকশ্রুতি এবং বুধপুর মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথক একটি লোককাহিনী বা  লোকগল্পকথা বা লোকবিশ্বাস ।


                    সে অনেককাল আগের কথা, তখন পাকবিররা ভৈরবথান ঝোপ জঙ্গলে ভরা । সেখানেই থাকতেন বাবা ভৈরব এবং তার মাসীমা । ভক্তেরা মাঝে মাঝে ভৈরব ঠাকুর দেখতে আসতেন ।পূজা দিতে আসতেন । একদিন সকালবেলা কয়েকজন মহিলা ভক্ত এসে দেখলেন বাবা ভৈরব এর দু'পায় কাদা লেগে আছে । একেবারে ক্ষেতের কাদা। মাসীমাকে ভক্তরা জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা ভৈরবের পায়ে কাদা কেন? মাসীমা কোন উত্তর করলেন না । ভক্তদের মধ্যে একজন অন্যান্যদের বললেন, "তরা  জানিস নাই ,বাবা ভৈরব বর্ষা পার হবার পর শরৎকালে প্রতিদিন ভোর বেলায় ধান ক্ষেতের আ'ড়ে আ'ড়ে ঘুরে বেড়ান যদি দেখেন কারো ক্ষেতের জল আ'ড়ের কলে ভুলুক দিয়ে নিচের খেতে না'মে যা'ছে, তাহলে নিজেই পা টিপে টিপে সেই ভুলুক বন্দ করেন । তারপর সকালের আলো ফোটার আগেই তিনি নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন । সে কারণেই তার পায়ে কাদা লেগে থাকে ।"কিছুদিন আগেও এলাকাবাসীর মধ্যে যাঁরা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছিলেন তাঁরা  গল্পটি জোর বিশ্বাসের সঙ্গে প্রচার করতেন।
                           আর একটি গল্প হল ---তখন কাঠের উনুনে মুড়ি ভাজার চাল উলানোর জন্য মাটির বড়ো কড়াই চাপিয়ে ভৈরবের মাসী কাঠের চললাড়া চাটু দিয়ে চাল লাড়ছেন । তার পর মাটির খলাতে মুড়ি ভাজাবেন । সে দিন ছিল ছাতা পরব । চাকলতোড়ের  ছাতা পরব । মানভূমে ছাতা পরব অত্যন্ত জনপ্রিয় উৎসব । হঠাৎ বাবা ভৈরব ইচ্ছে হলো আমি ছাতা পরব দেখতে যাব । রাজা কীভাবে ঘোড়ায় চেপে ছাতা তুলতে  যান সেই দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে । কিন্তু বাবা ভৈরবকে নেহাত বালক কল্পনা করে মাসীমা অনুমতি দিলেন না । তখন বাবা ভৈরব বললেন, আমাকে তো যেতে নিষেধ করছো, তুমি দ‍্যাখো আমার কীর্তি, আমি এখান থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চাকোলতোড়ের ছাতা উঠানো দেখব । এই বলামাত্র বাবা ভৈরব তর তর করে লম্বা হতে শুরু করলেন । বিপদ বুঝে অতি দ্রুত মাসী সেই গরম চালভর্তি কড়াটা ভৈরবের মাথায় চাপিয়ে দিলেন । তখন ভৈরব আর লম্বা হতে পারলেন না এবং সে কারণেই ভৈরবের মাথায় একটা চেপ্টা দাগ আছে ।


                           বুধপুর এর বুদ্ধেশ্বর প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধেশ্বর কি না বলা মুশকিল।  হয়তো  জৈন মূর্তি স্থাপনের জন্য জৈনরাএকটি চৌকো আকৃতির প্রস্তুর এনেছিলেন । পাথরটি খোদাই করে মহাবীরের মূর্তি স্থাপন হত পারতো ।   কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মহাবীর রূপান্তরিত হলেন মহাদেবে । এগুলি মানভূম এলাকার প্রস্তর নয়। অন্য কোনো দূর-দূরান্ত থেকে কংসাবতীর জলপথে যে প্রস্তরগুলি আনা হয়েছিল তা দিয়েই বানানো হয়েছে মন্দির । চতুর্দিকে ছড়ানো-ছিটানো ছিল অনেকগুলি বিভিন্ন ধরনের মূর্তি, গইরা ,হাঁড়ি এবং কুমোরদের চাকার আকৃতির চাকা । তখন এই এলাকা ছিল জঙ্গলে ভর্তি । এক রাতের মধ্যেই নাকি বুধপুর সুন্দরভাবে বৃন্দাবন হয়ে উঠছিল । কিন্তু হঠাৎ কাজ শেষ হতে না হতেই ভোরবেলার কিছুটা আগেই সেদিন একটি কুঁখড়িষাঁড়া  কুক্ কুক্ কুক্ কুকুক্কুক্ করে ডেকে ওঠে। ফলে আর বৃন্দাবন গড়ে উঠলো না । ধীরে ধীরে জায়গাটি ঊষর মরুভূমিতে পরিণত হল । এই গল্পকথা শুধু বুধপুরে নয়  পশ্চিম সীমান্ত বাংলা এবং রাঢ় অঞ্চলের বিভিন্নস্থানে যতো প্রাচীন দেব দেবতার মন্দির আছে , তার অনেকগুলো দেবস্থানকে ঘিরেই এজাতীয় গল্পগাথা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে । তবে একথা সত্য যে সময়ের সাথে সাথে আজ বুধপুরের বুদ্ধেশ্বরের মন্দির  মরুভূমিতে পরিনত হয়ে গেছে । সেখানে যেভাবে মন্দির কে কংক্রিটের দেয়াল দিয়ে আবৃত করা হয়েছে, তাতে আর অন্তত এই জাতীয় কোন গল্পকথা মানানসই বলে মনে হবে না । লোকবিশ্বাস যাই থাকুক , বর্তমানে বুধপুরের বিরাট সেই পুরাতন কৌলিন্য আর নেই । যে পুরাতন প্রস্তরগুলি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বিশাল ভূমিকা পালন করতে পারত , সেগুলি সময়ের সাথে সাথে এলাকায় কিছু কিছু দুষ্টু ব্যক্তির ঘর ও প্রাচীর নির্মাণের বনেদের ভিতরে ঢুকে গেছে । কোন কোন প্রস্তর  আবার প্রাচীর নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এই সমস্ত লোকবিশ্বাস অবিশ্বাসের গাঢ় ও গূঢ় কৃষ্ণ অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে । কে করবে সৎ গবেষণা, রক্ষণাবেক্ষণ ? সরকার বাহাদুর ? সময় কোথা সময় নষ্ট করার !!!



ছবি : তপন পাত্র



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। নাচনী শিল্পীদের আলোক-চিত্র ।। সন্দীপ কুমার