তৃতীয় বর্ষ ।। ষষ্ঠ ওয়েব সংস্করণ ।। ১৯ আষাঢ় ১৪২৯ ।। ৪ জুলাই ২০২২
শিক্ষার স্তম্ভকে ভেঙে ফেলায় যখন সরকারের পরিকল্পিত লক্ষ্য তখন স্কুলে ছাত্রশিক্ষক অনুপাত ঠিক থাকবে এমনটা ভাবা নেহাতই মুর্খামি। বরং কোনো কোনো স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা একেবারেই থাকবেন না সেটাই স্বাভাবিক। কারণে অকারণে বন্ধ করে দেওয়া স্কুল খোলার চেষ্টাতেও একটা রহস্যময়তা একটা ধোঁয়াশা থাকবে। স্কুল খোলার থেকে স্কুল না খোলার চেষ্টাটাই বেশি করে পরিলক্ষিত হবে এই অবস্থাতে।
এর পিছনে যাঁরা সবথেকে বেশি দায়ী তাঁরা হলেন এখানকার জনপ্রতিনিধিদের ভোটে জিতিয়ে আনা সাধারণ মানুষ। এঁরা এমন একদল বানরের গলায় মুক্তোর মালা পরিয়ে দেন যারা মুক্তোর মুল্য বোঝে না। তাই যেন তেন প্রকারেন আমাদের উপর ছড়ি ঘোরানোর লক্ষ্যে জাতির মেরুদণ্ড সোজা করার মূল অস্ত্র শিক্ষাকে ধ্বংস করার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
"এগিয়ে বাংলা" শ্লোগান একটা প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। যখন কোনো জাতি সত্যি সত্যিই এগোই তখন তার শ্লোগানের দরকার পড়ে না। বারবার শ্লোগানের দরকার পড়া থেকেই বোঝা যায় বাংলা আসলে পিছিয়ে। বাংলা আর সেই জায়গায় নেই। বাংলা তার অতীত গৌরবকে ধরে রাখতে পারেনি। আর এর জন্য দায়ী এই বাংলার নীতি নির্ধারক শাসকদল। নিজের ভোটব্যাঙ্ককে জোর করে ধরে রাখার জন্য প্রাইভেট সেক্টরের উপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় প্রাইভেট সেক্টরকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে তারা। তাই, বাংলার উন্নয়নের ভাবনার মাথা খেয়ে শিক্ষাকেও প্রাইভেটাইজেশনের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। উন্নয়নের মিথ্যে বুলি আওড়ে বাংলার সাধারণ মানুষকে মুর্খ রেখে সহজে শাসন ক্ষমতা কায়েম রাখাটাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। তাতে আমার আপনার ছেলেমেয়ে এইচ এস পাশ করেও বাংলা বই রিডিং পড়তে পারুক বা না পারুক কি এসে যায় কার?
সম্পাদক, উত্তম মাহাত
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
দুর্গা দত্ত / পর্ণা দাশগুপ্ত মিত্র / বিপুল চক্রবর্তী / নির্মল হালদার / বিশ্বম্ভর নারায়ন দেব / দেবাশিস সরখেল / উৎপল চট্টোপাধ্যায় / সুরজিৎ পোদ্দার / সুজন পণ্ডা / তপন পাত্র
______________________________________________
স্বীকারোক্তির জানলা : এক
দুর্গা দত্ত
বনবাদাড় মাঠঘাট ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে
বহুদূর হেঁটে গেলে
আমার সামনে ঠিক নয়
একটু আড়াল করে মুখের আদল ঢেকে
আবডালে আবডালে
দাঁতে দাঁতে খুট চেপে
বড় বড় চোখে করে
দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখি আমার সমাজ।
এ আমার ভারতবর্ষ ।
কার কাছে কতটুকু সেসব জানিনা
হাড়ে মাংসে মজ্জায় জড়ানো
এ আমার দুঃসহ নিঃশ্বাস।
লাইক, কমেন্ট, থেকে বহুদূরে
নিজস্বী উন্মার্গ থেকে বহুদূরে
এ আমার ওগগর ভত্তা...
শালবীজ কুড়োনোর শ্রমের আকুল।
এ আমার ধুনো ও আঠায় ভরা
কৌম জীবন।
যাকে আমি রক্তের ভেতরে ডুবে
সমাজ জেনেছি --
আমাকে সন্দেহ করে।
এবং কী অনায়াস,
নাড়িমূল পুঁতে রাখা
আমার বাথান তুচ্ছ করে
দূরে ঠেলে চলে যায় যে যার নিজের মতো
গাছের আড়ালে --
যেরকম হস্তীযূথ গা শুঁকে শুঁকে
নির্বিকার ফেলে যায় অবোধ করভ--
আমাকে সন্দেহ করে।
আড়চোখে দেখে।
আমার গায়ের গন্ধে মিশে গেছে
অহেতু উল্লাস।
আমার শরীর জুড়ে বিজ্ঞাপিত
অশীল জারক।
আমি ঠায় পড়ে থাকি বুলানের
এপারে ওপারে।
মুখ থুবড়ে শুকনো পাতায় ,
বালির ওপরে।
আপাতত
এই আমার বেঁচে থাকার সমাজমাধ্যম--
এই আমার নিজস্বী আহ্লাদ ...
অভ্যর্থনার মঙ্গল ঘট
পর্ণা দাশগুপ্ত মিত্র
মাঝে সাঝে তোমাদের সঙ্গে কথা বলি ।
মনে হয় আমার হাতে সময় বড়ো কম । যদিও তেমন কোনো কথা থাকে না। শুধু যত্ন করতে ইচ্ছে হয় তোমাদের উপস্থিতি।ঠুমরি ভৈরবীর সুর ।
দরজার কাছে অনেক চটির ভীড় ; তোমাদের বিদগ্ধ কথা
চোখ বুজে রবিঠাকুরের গান কবিতা আর কিছু রসালাপ্ ।
মুখগুলোর দিকে চেয়ে ভাবি একদিন থেমে যাবে ; আমিই হয়তো বা।। আমার মাঠ ঘাট ঘর দুয়ার যদি হঠাৎ বানের জলে ভাসে । তেমন কোনো অঘটন হয় যদি । জমানো পুঁজিতে অভ্যর্থনার মঙ্গলঘট সাজাই ..
'আবারও কি যাওয়া যাবে মাটির কাছাকাছি ?'
বিপুল চক্রবর্তী
আপনি ঠিকই বলেছেন যে, আমরা অনেককাল ধ'রে যারা শহরে আছি, তাদের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে শহর ছেড়ে গ্রামজীবনকে গ্রহণ করা আজ সত্যিই কষ্টকর। শহর জুড়ে ডালপালার মতো ছড়িয়ে আছে আমাদের সন্তানেরা, আত্মীয়-পরিজনেরা, বন্ধুরা। তবু, সত্যিই যুক্ত কি থাকা যায় না --- জুড়ে থাকা যায় না কি ধানের মর্মরে আর প্রাণের মর্মরে? এ সবকিছু থেকে বিযুক্ত হয়েই বা কী ঘর আমরা সাজিয়েছি শহরে? আমাদের সন্তানেরা তো আজ কেউই প্রায় ঘরে থাকছে না --- ঘর ছেড়ে তারা কেউ বেঙ্গালুরু, কেউ মুম্বাই, কেউ চেন্নাই। কেউ কেউ আরও দূরে -- ইউ.কে বা ইউ.এস.এ। বন্ধু, পরিজনই বা কোথায় কোথায়! তবু আমাদের মনে হয়েছে, খারাপ কী, চাইলেই তো তাদের ফোনে পাচ্ছি বা স্কাইপে পাচ্ছি। কিন্তু সেই যে অবনবাবুর ফেল্টু মেয়েটার বিয়ে হ'ল অজ পাড়াগাঁয়ে --- শুনেছি সামান্য কী মশার কামড়েই নাকি মারা পড়েছে বেচারা বা সেই নবীনবাবুর ছেলেটা --- কী সুন্দর গানের গলা ছিল --- কী সখেই যে মাস্টারি করতে কোন্ এক গাঁয়ে গেল --- তাকে তো আর দেখতেই পাই না আজকাল। তার কাছে বা তাদের কাছে যাব যে, তা-ও হয় না। বহু বহু গাঁয়ে কাদাজল ঠেলে পথ হাঁটতে হয় আজও। আর মশা-মাছি-ম্যালেরিয়া, সে সব তো আছেই আর আছে ভয় --- আছে ভয়ঙ্কর মাওবাদীরা।
জীবনের এ ব্যাপ্ত প্রান্তরে (যাকে আমরা প্রান্তিক বলে ঠেলে রেখেছি) আমাদের এই অনুপস্থিতিটাই কি খুঁজে নিচ্ছে ফ্যান্টা-স্প্রাইট বা পেপসিকোলার মতো রঙচঙে একদল লোক? ধানের জমি লুঠ ক’রে স্পঞ্জ আয়রনের কারখানা বসাচ্ছে তারা। উন্নয়নের নামে আরও কত কী যে করছে! হ্যাঁ, কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে, 'মানুষের বন্ধু' ব'লে পরিচিত বামপন্থিরাই বা কী করেছে এতকাল, ধ'রে ধ'রে মানুষকে লালজামা পরানো ছাড়া! আবার কেউ এ কথাও জানতে চাইতেই পারেন যে, নীলজামা পরানো ছাড়া 'মা-মাটি-মানুষের বন্ধুরাই' বা কী করছে!
হিং-টিং-ছট্ এইসব প্রশ্ন মাথায় নিয়ে, আমার তবু কেন মনে হয় যে, আমাদের যেতে হবে --- আমাদের ফিরতে হবে ঐ মাটির কাছেই। খেজুরকাঁটার মতো দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি মানুষের ভিতর থেকে পিয়ালকে, পলাশকে খুঁজে পেতে হবে। আন্নাকালী (আর না কালী) নয়, খুঁজে পেতে হবে রবি ঠাকুরের কুমুদিনীকে, মৃণালিনীকে।
আবারও প্রশ্ন আসবে --- প্রশ্ন আসা উচিৎ যে, শহরে কি এই লুঠ চলছে না এবং সেখানে কি আমাদের কিছু আর করারই নেই! উত্তরে এটুকু বলা যাক যে, শহরগুলি আমাদের দিনে দিনে ক্লান্তই করেছে। কিছু ব্যতিক্রমী কাজ, ঘটনার কথা বাদ দিলে, বলতে হয় যে, শহর তার লাল-নীল সত্তা নিয়ে দিব্যি নিজেই এখন কোকাকোলা, পেপসিকোলার প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। জল, জঙ্গল আর জমিনের ছবি কিন্তু আজও তেমন নয়। সেখানে, অনুভব করি, আজও একটা যুদ্ধ আছে।
এত কথা সাধারণত বলতে চাই না আমি। এতসব কথা পেরিয়ে একটি কবিতার ব্যাঞ্জনার কাছে পৌঁছুতে চাই --- বাঁকুড়ার পোড়া মাটির ঘোড়ার কাছে, পুরুলিয়ার ছো নাচের কাছে, শিমুল-পলাশের কাছে, লাল শালুকের কাছে, কুমুদিনীর কাছে পৌঁছুতে চাই...
নির্মল হালদারের কবিতা
হরিতকীর গর্ভের আলোয়
বীজের সঙ্গে
তোর বাবার তিনটে ছেলে
তার মধ্যে তুই একজন।
তোকে আমার কাছে দিয়ে দিলে
আমি যতন করে রাখবো।
তোর মা চুলাতে শুকনো পাত গুঁজতে গুঁজতে
আমাকে বলবে কি, চাইতে হলে অন্য কিছু চাও----আমার ছেলে লক্ষ্মী বড়
ঘরেই থাকবে।
তোর বাবাও বলবে মনে হয়,
আমার তিনটে ছেলে, একজন রুইবে ধান
একজন বাঁধবে আল, আরেকজন
ঘরে নিয়ে যাবে।
তোর বাবাও বলবে মনে হয়,
চাইতে হলে অন্য কিছু চাও।
কী যে চাইব আমি, আমি আমাকেই
রেখে যাচ্ছি তোমাদের কাছে
যদি বছর দিনের বীজের সঙ্গে রাখতে পারো।
একটি গ্রাম
বাথান নামে একটি গ্রাম হাত পেতে চাইছি
একদিন শরবেড়িয়া চেয়েছিলাম।
আরেকদিন হুড়রা চেয়েছিলাম।
আজ হাঁটু গেড়ে চাইছি ডাকা কেঁদু।
মেঘ দুইলে জল পাবো।
পুকুর থেকে মাছ ওঠে
নদী থেকে মাছ ওঠে
আমি দু হাতে ধরবো নক্ষত্র
একটি গ্রামের একটি নক্ষত্র
ধুলো উড়িয়ে হাসে।
ধনী
পশুপতি মাহাত ধনী হলেও
আমার চেয়ে ধনী নয়।
আমার যে কিছুই নেই।
পশুপতি মাহাত পিতা হলেও
আমিও পিতা
আমার একটি সন্তানও নেই।
অনাগরিক
বিশ্বম্ভর নারায়ন দেব
নাগরিক সম্মোহনে মজে রয়
উত্তর- আধুনিক বাংলা কাব্যভান্ডার।
মর্ম জ্বলে
তার ভাপ এসে লাগে
আবহমান প্রান্তিক কবিতার গা-য়।
কালের যাত্রায়
তার ধুলা উড়ানি পথ সহজ নয়
তার সংজ্ঞা দেওয়া
আমার পক্ষে দুঃসাধ্য
অন্য কারো পক্ষেও কি
সুসাধ্য হয়েছে আজও ?
তবু আজ বড় বেশি প্রাসঙ্গিক
সেসব ধূসর কবিতার আকার ইঙ্গিত
তবু আজ বড় বেশি বিজ্ঞাপনময়
তার সংকেতের ভাষা
স্বাদ -রক্ত -ঋণ
যার কোনো নন্দন নেই
যার কোনো জীবনানন্দ সভাঘর নেই।
আছি
দেবাশিস সরখেল
ভালোবাসা বস্তা হাতে তাকায় বারবার ।
শুকনো পলাশ পাতায় ভরে ওঠে বরাটি তাহার ।
তারপর কত কত শঙ্খ ঘন্টা দিনান্তে অজস্র আজান।
শুকনো পলাশ পাতায় সেদ্ধ কত গাঁথা ধান।
প্রেমের সরস্ হঁাডিতে মাছি
প্রেমিক কতবার ভেবেছে, যাবে সোনাগাছি
তা হয় না ।
দামোদরে বয়ে যায় কতশত জল ক্রুদ্ধ ফণা ।
জীবনের সমস্ত পর্যায়ে বেঁচে থাকা প্রেম নয়
অভ্যাসে মায়ায় টিকে থাকতে হয় ।
মায়ার অঞ্জন সতত রাঙায় ।
কলকাতার মাল ভুলসুরে ভাদু গীত গায়।
তোমার বন্ধু বান্ধব দেখি লিখে যায় ক্লান্তিকর করুন কাহিনী ।
ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে, পার হচ্ছ সালবনি
মেচেদা সাঁতরাগাছি
অলক্ষ্যে কে যেন বলছে
আছি আছি আছি
আছি শীতঘুমে ।
আছি মানভূমে
আছি গানভূমে ।
উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
১.
অনাথ জন্ম
সারাদিন কুড়িয়েছে রোদ্দুর
হাট খোলা দরজা
কখনো উঠোনে খোলা চুল মুখ ছোঁয়
লাল মুখ , হাঁটুতে ধুলো
খুটে খুটে কি সব খায়
মাঝে মাঝেই মায়ের উন্মুক্ত স্তন করে শোষণ
শরীরে শরীর স্থান করে নেয়
কেবলই উষ্ণ শ্বাস মায়ের আদর
শেষ সময়
নাড়ীর টানে হাত ওঠে মাথায়
কোটোরে চোখের পাতা স্নেহ ছুঁয়ে যায়
একা বিধবার অন্তিম শ্বাসে বাতাসে ঝড় ওঠে
নীভে যায় তেলের প্রদীপ
পৃথিবীর বুকে অনাথ জন্ম
শিশু মন বোঝে না মরণ
অন্ধকারে নির্ভয়ে শবদেহ করে আশ্রয়
একমনে পান করে স্তন
২.
অভিশাপ
অভিশাপে টুকরো ছিলাম এতোদিন
তবে অতিরিক্ত নয়
এবার যাবার সময় হলে
চারপাশ শুধু চোখের ধাঁ ধাঁ
অতসীর মুখে শূন্যতা রাখেনি রাত
আমার সমস্ত কিছু আর সর্বক্ষণ
তোমার শয্যার উত্তাপে ক্রমাগত
খুলে ফেলি জামা, দেহজ পোশাক
শরীর নয় আজ শুধু ভাঙা চাঁদ
অন্ধ আগুনটির মুখোমুখি
পাহাড়ী আলো
তবু ফণা তুলে আত্মসুখী
আমার এই একা রাজহাঁস
৩.
কুসুমকুমারী
কেমন যেন রয়ে গেছে মাটিমন
দুপুরের চারিদিকে বারো হাত
বাহারি সম্পর্কের নীল পাড়ে
মিশে আছে অদ্ভুত নদীস্রোত
কূলে উপকূলে শর্তহীন বিশ্রাম
বৃষ্টি বিহীন আয়ুর বুননে সমান্তরাল
তুমি যেটুকু আমাকে দেখেছো বিছানায়
নিষিদ্ধ সময়ের মরু ছায়ায়
প্রাচীন সেই মায়া মলাট বিছিয়ে
আমিও কুসুমকুমারী
উদাসীন কবিতার শাসনে এখন
জোড়া লাগে সুখ
স্মৃতির প্রলেপ লাগানো জীবিকার গায়ে
ওড়ে আনমনা তারিখ
সুর ওঠে, নীল জলোচ্ছ্বাসের দিকে আজও
তুমি যেন একান্ত আমার,
কবিতার সেই সাতরঙা বঙ্কিম পুরুষ
সুরজিৎ পোদ্দারের কবিতা
নতুন বিপদসীমা
১.
শহর থেকে দূরে যেতে যেতে
ক্রমশ বদলাতে চাইছিলাম জল আলো আকাশ:
আমাকে ঘিরে রেখেছে যারা
আদতে যাদের চারিদিকে ঘুরছি আমি
একটা সৌরমণ্ডল অতিক্রম করে
আকাশের অন্যদিকে
যেতে যেতে বলছিলাম,
"একা থাকতে চাই
একদম একা"
যদিও প্রতিটি স্বমেহন আদতে সঙ্গম বাসনা
শহর থেকে দূরে যেতে যেতে
সীতার মতো শুধু
শহরের কথাই ভাবছিলাম
একা
সঙ্গে ছিল জল আলো আকাশ
২.
শুধুমাত্র বিদ্যুৎ ছিল না তাই
সে আঁধারে তোমার রং বুঝতে পারিনি
আমাদের মোলাকাত হল
ঘন ধোঁয়ায়, মৌতাতে
শব্দহীন এক জগৎ তখন বাস্তব
শুধুমাত্র বিড়ির আগুন ঘন হচ্ছে মাঝে মাঝে
আকাশ থেকে ঝুলে আছে স্লেটপাথরের মেঘ
তাতে আঁকিবুঁকি কাটছ তুমি
নতুন কোনো অক্ষরের জন্ম হচ্ছে
নতুন কিছু জন্মাচ্ছে
নতুন কিছু
নতুন
বিড়ির আগুন নিভে নিভে জ্বলে উঠছে...
সুজন পণ্ডা
নক্ষত্রের জন্মদিন
আজ কোনোখানে এক নক্ষত্রের জন্ম,
এক নতুন আলোর দিন।
চলো হাওয়ার বুকে
পা রাখি।
চলো মাটিতে কান পেতে
শুনি নতুন বীজের ডাক।
এক নতুন নক্ষত্রের জন্মদিন,
দু হাত বিছিয়ে দাও
চলো চোখ রাখি বিস্তীর্ণ ভবিষ্যতে।
চলো আকাশে আকাশে রাখি
ঠিকানা আমাদের।
আজ যে নক্ষত্রের জন্মদিন।
রহস্যময় ধাঁদা
তপন পাত্র
(আগের সংখ্যার পরের অংশ)
গার্হস্থ্য জীবন :--
লোক সাহিত্যের যেকোনো শাখাতেই সমাজ সংসারের গার্হস্থ্য জীবনের কথা উঠে এসেছে অত্যন্ত সুস্পষ্ট রূপে । সামাজিক সম্পর্ক, আচার-অনুষ্ঠান, দৈনন্দিন জীবন যাপন এবং এই সকল কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন প্রাণী, গৃহপালিত পশুপক্ষী ও আসবাবপত্র ইত্যাদির কথা যেমন লোক সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আমরা লক্ষ্য করি, তেমনি ধাঁদাতেও ফুটে উঠেছে গার্হস্থ্য জীবনকথা । একদা সারা ভারতবর্ষের মতো মানভূম-পুরুলিয়ারও জীবনযাপনে সবচাইতে বড়ো ভূমিকা পালন করেছে কৃষিকাজ ও পশুপালন। স্বাভাবিকভাবেই গাই-বাছুর, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদিও ধাঁধার বিষয়ে হয়ে উঠেছে ।
"অন্নদামঙ্গল" -এর কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় ঈশ্বরী পাটনীর মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন, "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে", সেই ছায়া আমরা লক্ষ্য করছি ধাঁদাতে ।
"সাঁই-সুই-সটকা
তিন মুড় দশ পা।"
ভাঙানীটির মধ্য দিয়ে একটি অত্যন্ত সুপরিচিত পারিবারিক জীবনের বাস্তব ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি । গাই বাঁধা আছে পাঘা দিয়ে খুঁটাতে, বাছুরটি প্রথমে স্তন থেকে দুধ পান করলো, তারপর তাকে সরিয়ে দুগ্ধ দোহন কারী বা দুগ্ধ দোহনকারিনী দুগ্ধ দহন করছেন । সে সময় দুগ্ধ সংগ্রহের পাত্রে দুধ জমছে, শব্দ হচ্ছে 'ছুনুর গুবুর - ছুনুর গুবুর- ছুনুর গুবুর", এই দুগ্ধ দোহণের তালে তালে বাচ্চারা নাচতে নাচতে এইরকম ধ্বনি উচ্চারণ করে । সে যাই হোক এখানে দুগ্ধ দোহনের চিত্রটি থেকে তিন মুড় এবং দশ পা বলতে গাই-বাছুর এবং দুগ্ধ দোহনকারী ; তাদের তিনজনের তিনটি মাথা এবং দশটি পা কে ইঙ্গিত করা হয়েছে ।
কৃষি যন্ত্রপাতিকে ইঙ্গিত করে প্রচুর ধাঁধা পাওয়া যায় । যেমন --
"চামচিকা ভুঁইনিকা
তার দাম চ'দ্দ শিকা।"
---এর উত্তরটি হল "কোদাল"।
আবার কাস্তেকে অবলম্বন করে একটি ধাঁদা পাওয়া যায় ।
"দাঁত আছে আঁত নাই ,
খায় তবে হাগে নাই।"
শুধু কাস্ত, কোদাল নয় কৃষি কাজের ক্ষেত্রে লাঙ্গল , বলদ এবং হা"লা অর্থাৎ লাঙ্গল চালকের ভূমিকা সর্বাধিক ।
"কাঠের কুঠরি লুহাকে ঠোর ,
তিন ঠেনে জড়িবুটি ন কাঠে জোড়।"
--এই ধাঁধার উত্তর -"লাঙ্গল"।
দুটি ছোট্ট চরণে কাঠের তৈরি লাঙ্গলের সম্পূর্ণ রূপটি তুলে ধরা হয়েছে । লাঙ্গলের ফলা বা জিহ্বাটি লোহার তৈরি, যাকে স্থানীয় ভাষায় ফাল বলা হয়। সেটি লাঙ্গলের মূল কাষ্ঠাংশে বিশেষ আকৃতির খাপ ক'রে বসানো হয় । লাঙ্গলের মূল কাষ্ঠাংশটির সঙ্গে ইশ্ জুড়ে দেওয়া হয় এবং সেই কাষ্ঠাংশের সঙ্গে বিশেষভাবে বঁটা কে সংযুক্ত করা হয় । সমগ্র লাঙ্গলটি দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে তিনটি জায়গা সংযুক্ত করে মোট নয়টি কে কাজে লাগিয়ে লাঙ্গলটি তৈরি করা হয়েছে ।
আবার দুটি বলদ এবং লাঙ্গল চালককে ঘিরেও ধাঁধার জন্ম হয়েছে ।
"ঘসর ঘসর ঘসকা ,
তিন মুড় দশ পা ।"
কী অসাধারণ কাব্যসুষমামন্ডিত শব্দমালা ! মাটি ফুঁড়ে লাঙ্গল এগিয়ে চলছে ঘসর ঘসর শব্দ করে এবং সে ঘসকা'চ্ছে অর্থাৎ মাটি খুঁড়ছে। এই কাজে রয়েছে তিন মুড় ও দশ পা অর্থাৎ দু'টি গরু বা কাড়াএবং হা"লা।
কৃষি কাজের সঙ্গে গরুর গাড়ির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সেই গরুর গাড়ির চাকার দাগকে ধাঁদা রহস্যের জালে বলা হয়েছে "ঠুরকু মামার ঢাঙ্গা পাঁজ"। সত্যিই তো , একটি ছোট আকারের গোলাকৃতি চাকা , সেই চাকা মাইলের পর মাইল দাগ রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে; কখনো কৃষকের ঘর থেকে ধান ক্ষেত, কখনো বা ধান ক্ষেত থেকে খামার, খামার থেকে হাট-বাজার।
গৃহস্থলীর নানা কাজের জন্য খড়ের দড়ি বা বিচার দড়ি, পাটের দড়ি বা চেরাটা দড়ি , সনের দড়ি, বাবুই দড়ি ইত্যাদি দড়ির খুবই প্রয়োজন। সেই দড়ি পাকানোর বিষয়টিকে ভাঙানিতে কাব্যরূপ দেওয়া হয়েছে এইভাবে ---
"যতই দিবি ততই খায়,
নে'গড়ালে পে"ছাঁই যায়।"
যে কোন দড়ি পাকানোর সময় উপাদানটি সময়ে সময়ে সংযুক্ত করে যেতে হয়, আর তা না করা হলেই দড়ি পাকানো বন্ধ হয়ে যায়। ঘর সংসারে দড়ির ঘাট তো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী । দড়ির খাটকে ঘিরে একাধিক ভাঙানীর অস্তিত্ব মেলে ।
(১) একটি বুড়ির আঁত গিলাই শুধা ,
(২) চা'র ধারে তার হাড়-গড় মাঝখানেতে আঁতি,
বাঁশবনে তাঁতি।"
( শেষ অংশ পরবর্তী সংখ্যায়)
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলংকরণের চিত্রশিল্প : পাটনা কলম, পাটনা স্কুল, ঊনবিংশ শতাব্দী
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
খুব সুন্দর পত্রিকা। লেখাগুলি যেমন সুন্দর ও উন্নতমানের ,তেমনই সব ছবির ব্যবহার। আমার খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো এবারের অরন্ধন।ছবি গুলিও সুন্দর।
উত্তরমুছুনকবিতা ও ছবি অনবদ্য
উত্তরমুছুন