‘নেই বাড়ির মেয়েরা’; মেয়েদের ‘বাড়িবোধ’ এর এক আশ্চর্য উপাখ্যান।
‘নেই বাড়ির মেয়েরা’; মেয়েদের ‘বাড়িবোধ’ এর এক আশ্চর্য উপাখ্যান।
মধুপর্ণা
অঙ্কন রায়ের উপন্যাস ‘নেই বাড়ির মেয়েরা’ প্রকাশিত হয় পৌষমেলা, ২০১৯ সালে। প্রকাশক বই ওয়ালা বুক ক্যাফে, রতনপল্লী, প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন অর্চিতা মুন্সী। লেখক বিহারের পূর্ণিয়া থেকে শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্রসংগীতকে নিত্যসঙ্গী করে এখানেই রয়েছেন শান্তিনিকেতনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে, পরিবারে নির্যাতিত মেয়েদের নিজেদের জীবনের আত্মবিশ্লেষণ এবং তাদের আশ্রয়স্থল ‘আলোকবর্তিকা’ নামে একটি বাড়ীর অন্দরমহল – এই উপন্যাসটির উপজীব্য। এই উপন্যাসটি তিনি উৎসর্গ করেছেন টিঙ্কু খান্নাকে, যিনি ‘ঘর হারা’ মেয়েদের নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। লেখকের আরো অন্যান্য বই – ‘কিছু পলাশের নেশা’, ‘রাংতাকুচির ভোর’, ‘বন্ধ বাড়ির রহস্য’ ইত্যাদি।
এই উপন্যাসটির নাম “নেই বাড়ীর মেয়েরা” আশ্চর্যভাবে তাৎপর্যময়। নির্যাতিত, 'পরিত্যক্ত' মেয়েরা যাদের ‘বাড়ী’ বলে কিছু ‘নেই’ তারা বাস করে একটা জায়গায় সেটিও একটি বাড়ী অথবা সেটি কি তাদের বাড়ী? বাড়ী বলতে আসলে আমরা কি বুঝি? এবং বিশেষ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে বদলে যায় ‘বাড়ি’র সংজ্ঞা। নিরাপত্তা, আশ্রয়, ভরসা, ভালোবাসার সমন্বয়ে যেখানে স্বজনদের নিয়ে বসবাস করে এবং প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে চলে তাকে যদি বাড়ী বলা যায়, তাহলে এই মেয়েদের কাছে বাড়ীর সংজ্ঞা ভিন্ন। না, তাদের জন্য বাড়ী কোনো সদর্থক পরিষেবা নিয়ে আসে নি। এই উপন্যাসে লেখক দেখিয়েছেন কিভাবে বাড়ি হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর, কিভাবে ‘স্বজন’ হয়ে ওঠে অত্যাচারী। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার কাঠামোয় পরিবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘নিজের’ হয়ে উঠতে পারে না। কারো কারো বাড়ি নেই, কারো থেকেও নেই, তারা আইনী সাহায্যে এবং ঘটনাচক্রে এসে পড়েছে ‘আলোকবর্তিকা’য় যেটা তাদের স্থায়ী বাড়ী নয়, কিন্তু এখানে তারা ভালোবাসায়, স্নেহে , সাহচর্যে পেয়েছে বাড়ীর স্বাদ। ‘বাড়ি’ তাদের কাছে স্থায়ী বিষয় হিসাবে প্রতিভাত হয় নি, প্রথমত তাদের হারিয়ে যাওয়া বাড়ী, সেই বাড়ীর সঙ্গে তাদের মানসিক বিচ্ছিন্নতা অন্যদিকে আশ্রয়স্থল ‘আলোকবর্তিকা’য় তাদের অস্থায়ী বসবাস অথচ নিশ্চিন্ত আশ্রয়। এই বিচিত্র মাত্রার ভিতর ‘বাড়ী’ তাদের কাছে স্থানিক নয়, বায়বীয় অনুভূতি। তাই লেখক যখন উপন্যাসের নাম দেন ‘নেই বাড়ীর মেয়েরা’ তখন পরিসর হিসাবে বাড়ীর ধারণা হয়ে ওঠে বিমূর্ত।।
আমাদের বিভাগ ( মানবীবিদ্যা চর্চাকেন্দ্র, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে জাতীয় মহিলা কমিশনের গার্হস্থ্য হিংসা ও তার প্রতিরোধে ২০০৫ সালের আইনের বলবত বিষয়ক একটি গবেষণা প্রকল্পের সূত্রে বীরভূম জেলার বিভিন্ন স্বাধার গৃহে আবাসিকদের সঙ্গে গত কয়েকমাস ধরে কথাবার্তা বলার সূত্রে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে আসছিল পরিবারের সঙ্গে মেয়েদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক ভাবে জটিল। এই আবাসিকারা পরিবার, সমাজ থেকে বিচিত্র কারনে ‘বিতাড়িত’, ‘পরিত্যক্ত’, ‘উপেক্ষিত’ হয়ে এই স্বাধার গৃহে এসে পড়েছেন অদ্ভুত ঘটনাচক্রে, যে চক্র থেমে নেই। ক্রমাগত তাদের নতুন ভোগান্তির দিকে ঠেলে ঠেলে এগিয়ে চলেছে। অধিকাংশজন মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, কারো চিকিৎসা চলছে, কারো কোর্টে কেস চলছে – মোটকথা কেউ আর সমাজকে তো নয় ই, পরিবারকেও নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। সেখানে তাদের শারিরীক, মানসিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। তাদের সম্পত্তি, সমানাধিকার, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কোনো কিছুই সেখানে নিরাপদ নয় । তাই বিচিত্র সব হিংসার সম্মুখীন হয়ে তারা ‘ঘর’ ছেড়েছেন। সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত ‘নিরাপদ’, ‘সংরক্ষিত’ জায়গা ছেড়ে তারা পালিয়ে এসেছেন অন্যত্র। অথবা বিতাড়িত হয়েছেন। এই লড়াই এ অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, এখন ঠিক কি জন্য ঘর ছেড়েছিলেন মনে করতে পারেন না, আদালতে ঠিক কি বিষয়ে অধিকারের দাবী করেছিলেন ভুলে গেছেন। ছেড়ে আসা ‘ঘর’ এর ঠিকানা ও মনে নেই। অনেকের মনে আছে, বেশিরকম মনে আছে বলেই ফিরতে চান না একেবারেই।আর যারা সুস্থ আছেন তারা স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহে সামিল হয়েছেন, পড়াশুনা করছেন, স্বনির্ভর হওয়ার জন্য বিভিন্ন কাজে দক্ষতা অর্জন করছেন।
বিগত কয়েকমাসের এই আলাপচারিতার পর এই বিষয়ে পরিসংখ্যান, প্রবন্ধ ইত্যাদির সন্ধান চলছে তখন অঙ্কন রায়, আমাদের অঙ্কনদার ‘নেই বাড়ির মেয়েরা’ বইটি লেখকের কাছ থেকে আমার সংগ্রহে এল রবীন্দ্রসংগীতের ক্লাসে। আষাঢ়ের গান গাইছিলাম আমরা সেদিন - ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এল আমার মনে’। বাইরে ঘন কালো মেঘ আর তুমুল ঝড় উঠেছে তখন। এক স্বাধার গৃহের আবসিকাদের গানের তালিম দেন অঙ্কনদা, পূর্ববর্তী বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা থেকে তাদের মানসিক ভাবে বের করে আনার জন্য বিভিন্ন কাজে তাদের যুক্ত রাখার প্রয়াস চলতে থাকে সারা বছর ধরে। মিউজিক থেরাপির মাধ্যমে ক্রুরতার অভিজ্ঞতা লাঘব, ভয়াবহ স্মৃতিগুলির ক্ষতবিক্ষত জায়গায় নতুন সুন্দর স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার জায়গা করে দেবার চেষ্টা চলতে থাকে । গান গেয়ে, গান শুনে, অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তাদের জীবন যাতে একটা নতুন গতি পায়, নতুন প্রবাহে চলতে শুরু করে তার আয়োজন। ভয়াবহ জায়গা থেকে বেরিয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেলেও অভিজ্ঞতার অবসাদ তাদের পিছু ছাড়ে না, সেই অবসাদকে লাঘব করার জন্য গানের ভূমিকা বিষয়ে চর্চা, গবেষণা হয়ে চলেছে অনেকভাবে। সেই গানের তালিমের সূত্র ধরে “নেই বাড়ির মেয়েরা” র লেখক এই আবাসিকাদের অভিজ্ঞতার, যন্ত্রণার, কাছাকাছি গেছেন, খুব কাছ থেকে দেখেছেন তার বিষাদ, আনন্দ। তিনি যখন সেই আবাসিকাদের নিয়ে উপন্যাস লেখেন ‘নেই বাড়ির মেয়েরা’ তখন সেই উপন্যাসের প্রতিটা লাইন আগ্রহের জন্ম দেয়।
সোনাঝুরি আর ইউক্যালিপটাসের বনের মাঝে সবুজবাগে একটি বাড়ি “আলোকবর্তিকা”। যেখানে সামাজিক ভাবে “লাঞ্ছিত” “বহিষ্কৃত” মেয়েরা আশ্রয় নিয়েছে। পরিবার ও সমাজের তথাকথিত ‘নিরাপদ’, ‘সুরক্ষিত’ পরিসরে যারা শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, আবেগগত ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ তাঁরা আইনী সাহায্যে সুস্থ জীবনে ফেরার আকাঙ্ক্ষায় এখানে থাকেন। এই সামাজিক ‘নিরাপদ’ পরিসর রেয়াত করে নি কাউকেই, বালিকা থেকে বৃদ্ধা বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন অবস্থানের মেয়েরা এখানে এসেছেন। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, কেউ হারিয়েছেন নিরাপত্তার বোধ, কেউ হারিয়েছেন জিজীবিষা। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই আবার ফিরতে চান জীবন প্রবাহে। পরিবার, ‘স্বজন’ ব্যতিরেকে ‘নিজের’ জীবনে বাঁচতে চান। ক্রুরতা, শঠতা আর অত্যাচারের স্মৃতি পিছু না ছাড়লেও এই বাড়িটিতে তারা নতুন ভাবে বেঁচে থাকার আশ্বাস পান।
“সেই বনের দিকে জানলা হাট করে খুলে রেখে আমি আর আমার মত আরও মেয়েরা ওই সুদূর নিরিবিলিতে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকি। ...আমরা মেয়েরা যখন খুশি ওই জানলায় দাঁড়িয়ে ইউক্যালিপটাস আর সোনাঝুরির ফাঁক গলে দূরের নিশ্চহ্ন গ্রামে হারিয়ে যাই মনে মনে”। (পৃ – ৭) রূঢ় বাস্তব তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই কিন্তু তারা গান গায় – “কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা... মনে মনে মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা ...” কল্পনায় হারিয়ে যেতে বাধা নেই, কেউ নিষেধ করার নেই।মানসিক ভাবে মুক্ত পরিসর খুঁজে নেবার জীবনী শক্তি তাদের বাঁচিয়ে রাখে। পঁচিশটি মেয়ে পঁচিশটি ভিন্ন দূর্ভোগের স্মৃতি নিয়ে চলতে থাকে ।স্বাভাবিক জীবন স্রোতে ফেরানোর জন্য আনন্দ আয়োজনে তারা সামিল হয়। রবি ঠাকুরের জন্মদিন পালন করে তারা। গান, পড়াশুনা, কখনও পিকনিকে যাওয়া, গল্প, স্বনির্ভর হওয়ার জন্য বিভিন্ন দক্ষতার অনুশীলন –এর ভিতর দিয়ে তাদের জীবনকে একটি ছন্দে ফেরানোর চেষ্টা চলতে থাকে। ক্লাশ নাইনের ছাত্রী অহনা এই উপন্যাসের কথক।সে আলোকবর্তিকায় থাকে।তার আত্মকথনের ভিতর দিয়েই ‘আলোকবর্তিকা’র অন্তর্জীবনের ছবি উঠে এসেছে তার সমস্ত বৈচিত্র্য সহ। চিত্রভানুদাদার অনুরোধে অহনা লিখতে শুরু করে তার নিজের এবং তাদের জীবনের কথা, ‘আলোকবর্তিকা’য় থাকার অভিজ্ঞতার কথা। চিত্রভানুদাদা তাকে উৎসাহ দেয়, “... তোদের জীবন আর পাঁচটা সাধারণ আদরযত্ন পাওয়া নিরাপদ বাঙালি মেয়ের জীবন নয়। তুই লেখা শুরু কর।‘ (পৃ -৯)
আলোকবর্তিকায় স্বাভাবিক আনন্দময় জীবনের ভিতরে তার পূর্ব স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ফ্ল্যাশব্যাকে তার জীবনের ঘটনা মনে পড়ে। ভানুদাদার উৎসাহে লিখতে শুরু করলেও সে বুঝতে পারে না দাদা এই লেখা গুলি পছন্দ করবে কিনা। তার মনে হয়, “ দাদা কি খুব নিন্দে করবেন আমার লেখার ? কিন্তু আমি কি আর লিখবো? আমার, আমাদের ছোটবেলা তো এমনই। আর আর যে সব ছোটদের লেখা, গল্প, কবিতা পড়ি, তার সঙ্গে যে মেলে না আমাদের জীবনের গল্প”। (পৃ -১২) আলোকবর্তিকায় গান শেখাতে আসেন চিত্রভানুদাদা। শর্মিলা, চানা, পদ্মা, মিনটিদের সঙ্গে অহনা গান শেখে। ভানুদাদা শেখান , “আগুনের পরশমণি ছোঁওয়াও প্রাণে... এ জীবন পূণ্য করো দহন দানে” তাদের জীবনের বিভীষিকার ক্রমপর্যায়ের সঙ্গে মিশে যায় গানের অনুভব। সপ্তমীর হাট গ্রামে প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টারের মেয়ে অহনা আনন্দেই বড় হচ্ছিল। প্রাইমারী স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে হাইস্কুলে পড়তে গেলে তাকে স্কুলে নিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যেত তার বাবার ছাত্র ঋজুদাদা। সে ধীরে ধীরে অহনাকে ম্যানিপুলেট করে নিজের লালসার ছত্রছায়ায় নিয়ে আসে। তার সারল্যের সুযোগ নিয়ে তাকে লাগাতার যৌণহেনস্থা করতে থাকে ঋজু নামের ছেলেটি। তারপর একদিন নির্জন ধানক্ষেতে অহনাকে ধর্ষণ করে ঋজু । বাচ্চা মেয়ে অহনা বুঝে উঠতে পারে না তার সঙ্গে কি ঘটছে, কিন্তু সে বুঝতে পারে তার ভাল লাগছে না। ঋজু তাকে এই সব “ভালোবাসা” বলে চালায়, আর কাউকে বলতে বারণ করে। সেদিন স্কুলে গিয়ে পড়াশুনায় মন দিতে পারে না অহনা। তার মনে প্রশ্ন ঘুরতে থাকে – “... মেয়ে বলেই আমাকে আদর করার ধরনটা অন্য রকম হয়ে যাবে? হয় কেউ ভালবাসবে না, আর না হয় ঋজুদার মতো ভালবাসবে ?” (পৃ -১৫) তার স্কুলে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামে জানাজানি হলে মানসম্মান থাকবে না এই কারনে তার বাবা মা সতর্ক হয়ে যান। অহনা তার নিজের দোষ বুঝতেই পারল না, কিন্তু তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেল। মা তাকে নজরবন্দী করে রাখে। আলোকবর্তিকার আরেক আবাসিক সবুজবাগের পুষ্পিতার কাহিনী ভিন্ন। তার স্বার্থলোভী বাবা এগারো বছর বয়সী পুষ্পিতার বিয়ে দেয় একটি জঘন্য লোকের সঙ্গে। কালিতলায় সিঁদুর দিয়ে বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে লেখক লিখছেন, “ ব্যাস, পুষ্পিতা ওর সম্পত্তি হয়ে গেল। এখন ওকে নিয়ে যা খুশি করা যায়। আদর করা যায়... পেটানো যায়... বিক্রি করে দেওয়া যায়...!” (পৃ -১৭) লোকটি তাকে বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল। সেখান থেকে পালিয়ে পুষ্পিতা আশ্রয় পেয়েছে এই আলোকবর্তিকায়। তার বাবাও তাকে ফিরিয়ে আনে নি। “বিয়ে” তার কাছে বিভীষিকাময় অন্যদিকে তার নিজের “পরিবার” ও নিরাপদ, সুরক্ষিত নয়। পুষ্পিতার বাবা তাকে ফিরিয়ে আনে না। লেখক লিখছেন সামাজিক, পারিবারিক ক্রুরতার কথা – “...পরিবারে আরও গন্ডায় গন্ডায় ছানা পোনা, বউ। তার মাঝে একবার বিয়ে দিয়ে ফেলা মেয়েকে আবার ফিরিয়ে নেওয়া যায় নাকি!!” ( পৃ – ১৭)
পুষ্পিতার বাবা নিরক্ষর কিন্তু অহনার বাবা শিক্ষিত, প্রাইমারী স্কুলের হেডস্যার। কিন্তু পিতৃতন্ত্রের বিষে সমান ভাবে জারিত। নিজেদের অত্যাচারিত মেয়েদের সমস্যা তারা সমাজের চোখ দিয়েই দেখে। ঋজুর লালসার শিকার অহনার বাইরে বেরোনো, পড়াশুনা করা সব বন্ধ হয়ে যায়, অহনা কিছুতেই বুঝতে পারে না “ আমার কোথায় দোষ ? আমি কি করেছি যে আমার এত শাস্তি পেতে হচ্ছে?” অত্যাচারিতের ওপর অত্যাচার ও হয় আবার তাকে দোষী সাব্যস্ত করাও হয়। মেয়েদের ওপর যৌণ অত্যাচারে সমাজের এই মনোভঙ্গিটি বদ্ধমূল পুরুষতান্ত্রিক সংস্কার প্রসূত। যৌণ হেনস্থার স্মৃতি অহনাকে পিছু ছাড়ে না। যখন ভানুদাদা শরতের গান শেখান, ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা...” তখন সেই ধানক্ষেতের কথা মনে পড়ে যায় যেখানে তাকে গণ ধর্ষণ করা হয়েছিল। সবাই যখন গায় “ আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে, নেচে বেড়ায় আলোয় মেতে”... অহনার অত্যাচারের স্মৃতি মনে পড়ে যায়, ঘৃণায় উথাল পাথাল করে তার অন্তরাত্মা। নিজেদের দূর্ভোগের বর্ণনা সে লিখতে থাকে, তাতে রোমন্থন হয় অতীত আর পুরাতন ক্ষত আবার মনে পরে যায়। ভানুদাদা তার লেখা পড়ে বলেন “ একেবারে বাস্তব জীবন থেকে উঠে আসা তোদের নিজস্ব কথা। তুই লিখতে থাক। অকপটে লিখতে থাক বোন”। (পৃ-২০)
পঞ্চটিয়া গ্রামের চন্দনা গণিকার কন্যা,ঋতুমতী হবার পর তাকেও নিজের পেশায় যুক্ত করতে চেয়েছিল তার মা। যে লোকটিকে তার মা “বাবা” বলতে শিখিয়েছিল, সেই একদিন তার মায়ের পরিকল্পনা মত চন্দনা ওরফে চানাকে ধর্ষণ করে।
সেদিনের কথা সে ভুলতে পারে না। সেইসব দিন গুলি পেরিয়ে গেলেও তার স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে বারবার। মনের মধ্যে বিভীষিকাময় স্মৃতি ঘুলিয়ে উঠলে তারা ভানুদাদার শেখানো গান গায় – “ বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, ভাঙো...!” সন্ধ্যা অনাথ। একটি পরিবারে সে কাজ করত আর থাকত। সেই পরিবারটি পূত্রবধুর সন্তান না হওয়ায় সন্ধ্যাকে তারা সারোগেট মাদার বা ভাড়াটে মা হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কোনো আশ্রয় না থাকার পরও সে পালিয়ে আসে সেখান থেকে। তারপর ঘটনাক্রমে আলোকবর্তিকায় আশ্রয় পায়। শর্মিলা সৎ মায়ের হাতে বড় হলেও বাবা মারা যাবার পর সৎ মা আবার বিয়ে করলে সেই লোকটি শর্মিলাকে মারধোর করত। তাই তার সৎ মা তাকে আলোকবর্তিকায় রেখে যায়।“বুরা না মানো হোলি হ্যায়” এর বিশ্রী অজুহাতের অস্বচ্ছতার মধ্যে মিনটিকে যৌণ হেনস্থা করে ,পরবর্তীতে তাকে ঘুমের অসুধ খাইয়ে তারি দাদা স্থানীয় একজন ধর্ষণ করে। তারফলে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়। তারপর তার গর্ভপাত করিয়ে তাকে সমাজের ভয়ে রেখে যাওয়া হয় আলোকবর্তিকায়। অতসীকে এক তান্ত্রিক তার ধার্মিক ক্রিয়াকর্মের জন্য সম্ভোগ করে, বলা ভাল ধর্ষণ করে অতসী তখন বারো তের বছরের বালিকা।নগর হাভেলী থেকে তারও ঠাঁই হয় এই বাড়িতে।আশমা গার্হস্থ্য হিংসা এবং আরো নানান কদর্য বিষয় দেখে শুনে বড় হয়েছে। তার মা তাকে রেখে দিয়ে গেছে এই বাড়িতে সুস্থ ভাবে বাঁচার জন্য। শৈশব আর কৈশোর পেরোনো এই মেয়েদের জীবনে হঠাৎ নেমে এসেছে বিপর্যয়। উপন্যাসে কথক অহনার কথায় – “মনে হচ্ছে যেন এক রূপকথার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসেছে, যেখানে ওর চারিদিকে ঘিরে থাকতো শুধুই রাক্ষস আর খোক্কস”। (পৃ -৪৪) জীবনের নোংরা দিকগুলো খুব কম বয়সে দেখে ফেলার কারণে এই আবাসিকা দের মন গুলো নির্মিত হয়ে গেছে বিষাদ আর যন্ত্রণার স্মৃতির মিশ্রণে। আলোকবর্তিকায় তারা পুনরায় বেঁচে ওঠার আশ্বাস পায়। স্বাভাবিক জীবনের মূলস্রোতে ফেরানোর জন্য আলোকবর্তিকায় বিভিন্ন কর্মশালা চলে, সেলাই, কাঁথাস্টিচের কাজ, ব্যাগ তৈরি,চাদর কুশন তৈরি, আচার বানানো, গান শেখা। একদিকে যেমন তাদের মনের উপশম হয় তেমনি স্বনির্ভর হওয়ার জন্য কিছু দক্ষতা তারা শিখতে পারে। পৌষমেলায় তাদের স্টল হয়, তার প্রস্তুতিতে চলে আনন্দের আয়োজন।
লেখক লিখছেন, “এ ভাবেই কাটে আমাদের দিন। নতুন নতুন মেয়েদের নতুন নতুন গল্প এসে জুড়ে যায় আলোকবর্তিকার দেওয়ালে। অনেক কষ্ট, অনেক কান্না লেগে থাকে সেই দেওয়ালের গায়ে। আবার আমাদের নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দও আমাদের দিয়ে কত নতুন নতুন কাজ করিয়ে নেয়। এ ভাবেই বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম আসে ... আসে শরৎ আসে শীত...” (পৃ – ৩৭) অহনা আলোকবর্তিকার আবাসিকাদের গল্প একটা একটা করে বলে যায় । তাদের জীবনের বীভৎস অভিজ্ঞতা পড়তে পড়তে শিউড়ে উঠতে হয়। প্রত্যেকে এই আলোকবর্তিকায় এসে ‘স্বাভাবিক’, ‘আনন্দময়’ জীবনে সামিল হয়েছে কিন্তু তাদের ক্রুর, ভয়ঙ্কর ‘অতীত’ তাদের চেতনা থেকে মুছে যায় নি। ফিকে হয়ে যায় নি তাদের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার ছবি। অহনা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বাকীদের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখে আর বুঝতে পারে কি পরিমাণ মানসিক চাপ আর তিক্ততা তারা চেপে রাখে অথবা বয়ে বেড়ায়। আলোকবর্তিকায় এসে তারা বাঁচবার আশ্বাস পায়, জীবনের ইঙ্গিত পায় কিন্তু আবগাহন করতে পারে না সব স্মৃতি দূরে সরিয়ে। ভানুদাদা বলে –“ তোরা হলি একটা একটা স্ফুলিঙ্গ। ঐ জোনাকিদের মতো। দেখ কত ছোট প্রানী ওরা । কিন্তু নিজের বলে কেমন বলীয়ান।নিজের আলোয় আলোকিত। ঠিক তেমনিই আলোকবর্তিকার মেয়ে তোরা। ছোট তবু ছোট নোস। তোদের অসীম শক্তি। তোদের অপার ক্ষমতা। আমি তোদের খুব ভালোবাসি রে। আর শ্রদ্ধা করি, স্যালুট করি”। ( পৃ -৫০)
তিনি রবীন্দ্রনাথের গান থেকে লাইন তুলে এনে তাদের বোঝান । অহনা নিজেদের সঙ্গে গানের কথা গুলো উপলব্ধি করতে পারে । তার মনে হয় –“ তোমার যা আছে তা তোমার আছে... তুমি নও গো ঋণী কারো কাছে... তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে তারি আদেশ পেলেছো...’ এ তো আমার কথা। জবার কথা... অতসী,চাঁদনী,মিনটি, শর্মিলা সবার ... সবার কথা। (পৃ – ৫০) অহনা বুঝতে পারে, “আমাদের শরীর, মন, মান, সম্মান সব কিছুকেই কেটে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে রেখে যাওয়া সেই পুরুষের দল নিজেরা কালিমামুক্ত শরীরে অবাধে বিচরণ করে বেড়ায় আমাদেরই আসেপাশে” (পৃ -৫১) সে আরো বুঝতে পারে, “আমার না লিখতে লিখতে এবার ক্লান্তি এসে যাচ্ছে। লেখার জন্য নয় কিন্তু।ক্লান্তি আসছে আমাদের সবার জীবনের পুরনো কথা, পুরনো ইতিহাস লিখতে। মনে হচ্ছে আমাদের সবার গল্পই যেন এক। ...আমাদের শরীর গুলো তো একই। সেই মেয়ে শরীর। আর ঐ লোকগুলোর চোখও এক। লোভ লালসা আর কামে ভর্তি। তাই গল্পগুলোও তো এক হতে বাধ্য। কতজনের কথা লিখব...!” (পৃ -৫১)
ভানুদাদা আলোকবর্তিকায় ‘নারী দিবস” পালনের আয়োজন করেন এবং তাদের জানান এই আন্দোলনের ইতিহাস। বৈষম্যের বিরুদ্ধে অধিকার অর্জনের জন্য নারীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং লড়াইয়ের কথা তারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে। নারী দিবসের জন্য তাদের গানের তালিম দেন। তিনি বলেন, “আজ আমরা যে গানটা শিখব, সেটা তোদের সারা জীবনের নিজস্ব গান।আগামীকালই নারী দিবসের দিন। কাল তো গানটা গাইবিই, আর সারাটা জীবন জুড়েও গাইবি” ( পৃ – ৫৫)তারপর তিনি গান শেখাতে শুরু করেন –
“অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো... সেই তো তোমার আলো... সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত ভালো... সেই তো তোমার ভালো...”
সমগ্র উপন্যাসটিতে অজস্র রবীন্দ্রসংগীতের উল্লেখ এসেছে ঘটনা পরম্পরার সঙ্গে সাজুয্য রেখে, ঘটনার গুরুত্বের সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে। প্রতিটি গান এই মেয়েদের জীবনপ্রবাহের টানাপোড়েনের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। লালনের একটি গান ব্যবহৃত হয়েছে।“ মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষের সনে...”। আলোকবর্তিকার মেয়েরা যারা সমাজে, পরিবারে অত্যাচারিত তাদের মন এবং জীবন স্বাভাবিক আনন্দময় খাতে পুনরায় বইয়ে দেবার জন্য ভানুদাদা রবীন্দ্রসংগীতের সুর ও কথার আশ্চর্য ক্ষমতা দিয়ে তাদের মানসিক শুশ্রূষা করে চলেন । একটি সাংগীতিক আবহের ভিতর অহনার জবানিতে লেখক আলোকবর্তিকার মেয়েদের জীবনের বীভৎসতার কাহিনী বলে চলেন, গানের ভিতর দিয়ে তাদের মানসিক উত্তরণের চেষ্টা করে যান ভানুদাদা। আলোকবর্তিকা তাদের দিয়েছে আশ্রয় আর ভানুদাদা অক্লান্ত ভাবে তাদের দিয়ে চলেন মানসিক, আবেগগত শুশ্রূষা। যে কঠিন বাস্তবের ক্রুর আঘাতে তাদের মনের ল্যাবণ্য দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল, ভানুদাদা তাদের গান গেয়ে , গানের অর্থ বুঝিয়ে আরেক বৃহত্তর আনন্দময় জগতের সন্ধান দেন, ক্লেদ আর গ্লানি মাখা নির্যাতনের স্মৃতি ভুলে যাতে তারা সুস্থ , স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকতে পারে, যাতে সাবলীল গতি পায় তাদের জীবন প্রবাহ।
উপন্যাস জুড়ে গানের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার জীবনের প্রবহমানতাকে দ্যোতিত করেছে , লাঞ্ছনা, নির্যাতন সত্ত্বেও সেই সব স্মৃতি ভুলে মানুষকে বেছে নিতে হয় চলমানতা – ভানুদাদা যেন সেই পথের পথপ্রদর্শক। ভেঙে চুরে যাওয়া কিশোরীদের গানের জাদুস্পর্শে ক্ষত সারিয়ে নিয়ে জীবন প্রবাহের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেন, সামিল করে দেন মূলস্রোতে। ভানুদাদা খর বাস্তবের মধ্যে থেকেও সুকোমল, মানবিক বৃত্তি গুলির চর্চা করে চলেন। এই দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কিশোরীরা তাই ভানুদাদাকে ভয় পায় না , ঘৃণা করে না, একান্ত নিজের জন বলে জানে। ভরসা করে, নির্ভর করে।তাদের কুঁকড়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস, মর্যাদাবোধ ভানুদাদা পুনরায় গড়ে তুলতে সাহায্য করেন যত্ন করে। তাদের রবীন্দ্রনাথের গান বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দেন সারমর্ম –
' তোমার যা আছে তা তোমার আছে, তুমি নও গো ঋণী কারো কাছে, তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে তারই আলো জ্বেলেছ, ও জোনাকী কি সুখে ঐ ডানা দুটি মেলেছ।‘ ভানুদাদা অন্ধকার থেকে তাদের ধীরে ধীরে গানের ভেলায় নিয়ে এগিয়ে চলেন আলোর উৎসের দিকে। ক্লেদ, মালিন্য একে একে খসে পড়ে যায় সেই যাত্রাপথে। উপন্যাসটি শেষ হয় অপূর্ব একটি সম্মিলনে। যেখানে নারী দিবস পালনের মাধ্যমে মেয়েরা নারীর অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে অন্যদিকে ভানুদাদা তাদের শেখাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের গান , যা প্রায় মন্ত্রের মত হয়ে উঠেছে মেয়েদের কাছে –
“ অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, সেই তো তোমার আলো... সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো... সেই তো তোমার ভালো...” অনুসঙ্গে মনে পরে যায় উপনিষদের একটি শ্লোকের অংশ -"... তমসো মা জ্যোতির্গময়,মৃত্যর্মা অমৃতং গময়..."।
পরিচিতি
মধুপর্ণা কর্মকার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যা চর্চাকেন্দ্রে গবেষণা করেন। লিখেছেন - ' গার্লস হস্টেল ; আবাসিক নারীর মানসভূমি।'(২০১৮)
তাঁর ব্লগ লিঙ্কে প্রবেশ করুন
তাঁর লিঙ্কট্রি লিঙ্কে প্রবেশ করুন
মধুপর্ণার আগের সংস্করণের লেখা পড়ুন
মধুপর্ণার আগের সংস্করণের লেখা পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন