তৃতীয় বর্ষ ।। একাদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ২৬ ভাদ্র ১৪২৯ ।। ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২
কেন যে পাঁচ বছর পর পর পরব আসে? কেন যে বছর বছর পুজো হয়? ছেলেমেয়েদের টাকা দিতে দিতেই শেষ হয়ে যায় ভান্ডার। তারপর অন্যান্য পার্বণ তো রয়েইছে। সংসার কিভাবে চালাই বলো?
যখন আলাদা হইনি। সুন্দর চলে যেত। বাবা চালিয়ে নিতেন সংসার। আমরা ঠেক দিতাম। এখন পটে না। বনিবনা হয়নি কোনোভাবেই। আমারটা চালাতে হয় আমাকেই। চুরিদারিও করতে হয় সে কারণে। লুকিয়ে লুকিয়ে রাখতে হয় টাকা এ ঘরে ও ঘরে সে ঘরে। দিয়েও রাখতে হয় বিশ্বস্ত কাউকে কাউকে। টানপোড়েনের সময় সেগুলোই কাজে আসে। বিপদমুক্ত হয় সংসার।
সাজগোজ করতেই হবে পুজোতে । সবাইকে দিতে হলো ষাট হাজার করে। নগদ। না দিলে বনিবনা থাকবে না। প্রতি পরবে কাউকে ৩০০ কাউকে ৩০০০ কাউকে বা হাঁড়ি-কুঁড়ি, বালতি, ছাতা-গামছাও দিতে হয়। যার যেমন চাহিদা থাকে, তাকে তেমন দেওয়া। ঘরের মালিক হওয়া যে কত ঝকমারির, সে কেবল আমিই জানি। সংসারটাই ভেসে গেল আমার।
বাবা দিল্লিতে থাকেন। এমনিতে গাল দিলেও সেখানে গিয়ে কতবার চেয়েছি। অন্তত ঋণটা মিটিয়ে নেওয়ার মতো টাকা দেন। দেননি। ওঁর কেবলই ইচ্ছা, সংসারটা ওঁর হাতেই থাক। আমরা কেবল খেয়ে পরে বাঁচি। তাও কি আর মানতে পারি এই বয়সে? স্বপ্ন বলেও কিছু তো একটা আছে। সেই স্বপ্নটা পূরণ হতে না দিলে আমারও কি ভালো লাগে বাবাকে?
নাতিদের তলব করেন মাঝে মাঝে। না গেলে নোটিশ পাঠান। লোক পাঠান। জোরপূর্বক নিয়ে যান তাদের। পড়া ধরেন। প্রশ্নের উত্তর চান। এগুলোও মেনে নিতে হয়। গায়ে লাগে। করার থাকে না কিছু। তিনি তো বাবা।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় / সুজন পণ্ডা / কনিষ্ক দেওঘরিয়া / সুনীতি গাঁতাইত / শ্রীদাম কুমার / দেবাশিস সরখেল / সৌরভ লায়েক / মহিউদ্দিন সাইফ / তপন পাত্র
______________________________________________
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
আর একটু
আর একটু এগোলেই
তোমার ঠিকানা, দেখো,
মানচিত্র ভেঙে ঠিক
তোমার সামনে এসে হাজির হবে
আর একটু বললেই
তোমার তপ্ত বাক্যসমূহ
একটা আস্ত অভিধান হয়ে
মলাট মেলে ধরবে তোমার সামনে
আর একটু দেখলেই
বুঝবে তুমি একা নও,
আরও কতজন তোমার মতোই
আত্মঘাতী হতে চায়
আর একটু শুনলেই
শুনবে মানুষের কণ্ঠে
নীল তিমির সাগরপার করা
ব্রহ্মাণ্ড সঙ্গীত আলাপ
আর একটু হাত ধরলেই
বুঝবে স্পর্শে কোনো
দোষ থাকে না,
যত দোষ অভিকর্ষে
আর একটু মূর্ধাগামী হলেই
জিহ্বা ব্রহ্মতালু ভেদ করে
চলে যাবে সমস্ত বিশ্বাস ছেড়ে
মাধ্যাকর্ষণের বিপ্রতীপে
আর একটু ভালোবাসলেই
জানবে হৃদয়ের তলায় লুকোনো
সর্পটি নিছকই এক বাস্তুসাপ যে
শুধু আশ্রয়টুকু চেয়েছিল
নিজস্ব শূন্য
সুজন পণ্ডা
আমার নিজস্ব একটুখানি একাকীত্ব আছে,
আঁধারের মত জমাট,
গ্রীষ্মের দুপুরের মত সর্বগ্রাসী,
অনন্ত...।
বাজপোড়া অর্জুন গাছের তলায়
এই সময়ের সব হিসেব,
বিকেলের বিষণ্ণ নিঃশ্বাসে
ছড়িয়ে জড়িয়ে বেড়ে ওঠা ক্রমশ।
আমার একান্ত ব্যক্তিগত
একটুকরো শূণ্য।
মায়ের কোলের মত উষ্ণ,
ধানের শীষের মতো জীবনদায়ী।
কোনো নারীর চোখেও
এত মায়া দেখিনি কখনো।
এই বিষাদ বিলাসে
আমার সর্বস্ব অহংকার লুকোনো।
কনিষ্ক দেওঘরিয়ার কবিতা
বিপ্লব
কবিতায় বিপ্লব করতে করতে বেরিয়ে পড়ার অভ্যাস হয়ে যাবে একদিন
যেভাবে ফুটপাত ভেঙে তৈরী হয় আবাসন
উদ্বাস্তু হয় কোন এক মা ও সন্তান
যেভাবে তারা বেরিয়ে পড়ে
যেভাবে কুকুর ছানা নিয়ে পালায় চামড়ার ব্যাগ
তারপর ঢিল খায়
যেভাবে শীতের রাতে লুকিয়ে বাঁচে বিদ্রোহ
এভাবেই ঘা খেতে খেতে বেরিয়ে আসবে বিপ্লব
এভাবেই ঘা খেতে খেতে বেরিয়ে আসবে মানুষের কথা ৷৷
কবিতা ও মানুষ
আকাঙ্খা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাই
কবিতার ভেতর ঢুকছে শ্রমজীবী মানুষের ক্ষোভ
মাটি মিলিয়ে আমাদের বেঁচে থাকার স্বর
আন্দোলন জারি রেখে পথ আগলে বসে আছি
বাঁচতেই হবে বাঁচার জন্যই বেঁচে থাকা
কবিতা বাঁচাও
ওরাও চিৎকার তুলে বলছে বাঁচতে দাও
কবিতায় সুর চড়িয়ে সমস্বরে উঠে আসুক মানুষের কথা ৷৷
লাগাতার বৃষ্টি
সুনীতি গাঁতাইত
জল থই থই আশমানে টাঙিয়ে দাও সামিয়ানা।
পারবে না? ঘরদোর ভেসে গেল, বন্যার ভ্রুকুটি তো আছেই। এরা কি মানুষ নয়!
বছর বছর
বাঁধ বাঁধো ধৈর্যের হাস্যকর গল্পে পুষ্টি নেই, আছে নিমতিতা অসুখের খবর।
শ্রীদাম কুমার
ঝুরিমূল
১.
ঝুরিমূল শতাব্দীরও প্রাচীন, নেমেছে
স্মরণাতীত পথ পেরিয়ে। স্নিগ্ধ বটচ্ছায়ায়
গল্প ঝরে দেদার...
২.
আমাদের অক্ষরগুলি প্রোথিত শিকড়ে শিকড়ে--
শিরায় শিরায়। দূর থেকে দূরতর আরো অজানা
গভীরে।
৩.
অশ্বত্থের আলিঙ্গন--অদৃশ্য অন্তরালে
ঢাকা। নীড়ের ওম ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিরাময়ের
বাতাস সুনিশ্চিত। পাখির ঠোঁটে লেখা
যাপনের ধারাপাত।
সফলতা
দেবাশিস সরখেল
যে সফলতায় প্রজাপতি পাখনা বন্ধ করে
সাদা সিঁথির গল্প থাকে
কোল খালি হয়
সেখানে আনন্দ নেই, বিষাদ রয়েছে।
যেখানে কফিনের গল্প
গান স্যালুট
মত্ত মাতঙ্গেরা রাজপথ কাঁপায়
সেখানে তোমার পাথর চাপা বুক,
বুকের ভেতর কোন বিকল্প বাতাস ঢোকে না ।
যে সফলতার পিছনে শিশুর আর্তনাদ
আতিপাতি করে শীর্ণ বধুর অকাল প্রসব
রক্ত জল কাদা মাড়িয়ে বিজয় রথ চলে
সেইখানে ঘোরতর বাদলে মাদলে
তুমি বধিরতা কামনা করেছো।
সৌরভ লায়েকের কবিতা
ঘুণপোকা
কুসুম তোর মন নাই
শরীর সর্বস্ব সব
কিরাতের মুখোশ পরে প্রেমিক নাচে
বন্ধু আমার : বিষ্ণু সহিস
ইতিকথার টানে সেও একথা জানে
শেষ রাতে ছোনাচে খেউড়ের ডাক
অলস বন্ধু আমার মালকোচা খুলে বলে থাক
সকালে দেখেছো তাকে ট্রাকের মাচায় ?
কুসুমের মন চিনে অচেতনে ঘুমায়
এ কথা গোপন নয়, নীরবতা অকুস্থলে ক্ষীণ
পরাভূত অতীত নিয়ত হচ্ছে বিলীন
পুনর্নবা
১.
বারুদের দেশে থেকে পদ্ম তুলে এনেছি
তুমি বলছো, ভালোবাসতে জানি না ?
মাইন পোঁতা জমিতে পুঁতেছি গোলাপের চারা
তুমি সেই প্রেমিকসত্ত্বাকে সন্দেহ করো ?
হায় নাস্তিক !
তোমার ভেতরে ঈশ্বরকে দেখতে পেলে না
কী বলতে পারি বলো ---
গত গৌরব থেকে হত অতীতের ছাই মেখে
যদি কখনো দাঁড়াও বারুদের দেশে, কামানের মুখে
তোপ নয়, গুহা গোমুখের জলে অভিষিক্ত করে
লিখে দেব অনাগত প্রেমের আগামী ...
২.
আমার উত্তরের পর তোমার প্রশ্ন থেমে যায়
অথচ তুমি জানো রাজনীতি নয়
কিভাবে আমি নীল, হলুদ থেকে লালে ফিরে এলাম
আমার উত্তরের পর তোমার প্রশ্ন থেমে যায়
দুটো নির্বাক অবয়ব দাঁড়িয়ে থাকে মুখোমুখি
অথচ তুমি জানো সেখানে কেউ নেই আজ
বর্ষার লিলি ফুটে আছে বাগানে
তোমার শরীর জুড়ে পাহাড়ি হাসনুহানা
একদিন যাবো ঠিক অনাথ পৃথিবীর আশ্রয়ে
যেখানে গেলে বিরহী
কখনো ফেরে না
আমাকে এড়িয়ে যেও ডানে কিংবা বামে
ভালোবাসা উপেক্ষা করে
তুমি বুঝি যাবে না জাহান্নামে ?
মহিউদ্দিন সাইফের কবিতা
১.
একদিন
ইচ্ছে তো ছিল
গল্পের মতো করে সাজাব জীবন।
আমার আশেপাশের মানুষেরা হবে পাখির সন্তান
মৃত্যুর ফাঁদটিকে সমবেত
নিয়ে উড়ে যাব অন্য মহাকাশে…
খেলতে খেলতে পরিশ্রান্ত
ঘুমিয়ে পড়বো স্রোতস্বিনী উঠোনের একদিকে,
মর্মরিত মেঘগুলি এক ঊর্মি থেকে
আরেক ঊর্মির দিকে যেতে যেতে
ভুলে যাবে তাদের দীপ্ত নিশ্চিত খেলা,
আমিও ক্রমশ অঞ্চল প্রসারিত করে বিলিয়ে ভিক্ষান্নগুলি
বৃথা করে দেবো জয়-পরাজয় ও তার স্মৃতি…
কোথাও না পৌঁছানোর কথা বলে শুধু আওড়ে যাব, "শান্তি… শান্তি…"
সারেঙ্গীটা কোলে নিয়ে
বাজাতে-বাজাতে যোগ রাগ পড়ব ঘুমিয়ে,
হঠাৎ সে এসে দেখে যাবে একদিন
নিমগ্ন আমি আরও সুন্দর হয়ে গেছি…
২.
ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ড
পিঁপড়েরা সিংহের মতো গর্জায়
পিছনে পড়ে থাকা অঘোর ডিমগুলি নড়ে ওঠে,
অপ্রস্তুত সন্ধ্যাকাল,
আনেনসেফালিক দিনের বৃষ্টি এসে পড়ছে নিরাকৃত ধূলার উপরে…
ধ্বনি থেকে লাফিয়ে নামছে আনম্র আঁকাবাকা হাওয়া,
এক কিনিয়াপিথিকান বুজুর্গ এসে সে হাওয়ার মগ্নতাটুকু নিয়ে বাজাল ফুলুট,
উঁই আর পিঁপড়েতে ভরে গেল মাটি আর জল…
মানভূমে জিতাষ্টমী
তপন পাত্র
মানভূম-পুরুলিয়ায় ভাদ্র মাসটি ভরা নদীর মতোই উচ্ছল চঞ্চল গতি তরঙ্গময়। এ সময় উদ্ যাপিত হয় করম-জাওয়া, ইঁদ-ছাতা আর ভাদু পূজা। ভাদর না ফুরোতেই আশ্বিন মাসের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে পালন করা হয় জিতা বা জিতুয়া। জিতাষ্টমীর পরদিন কৃষ্ণানবমী তিথিতে কোথাও কোথাও শারদীয় দুর্গাপূজার বোধনের বোধন হয়ে যায়।জিতাষষ্ঠী স্থানবিশেষে বড়ষষ্ঠী নামেও পরিচিত। ষষ্ঠীর দিন গৃহের উঠোনে ছোট পুকুরের আকারে গর্ত করে বটগাছের ডাল, ধান, আখ প্রভৃতি গাছ প্রোথিত করে পূজা করা হয়। এগুলি জীমূতবাহনের প্রতীক। হিন্দিতে একে জীবিতপুত্রিকা ব্রতও বলা হয়ে থাকে অঞ্চলভেদে। উড়িষ্যার পশ্চিমাঞ্চলেও এই ব্রতের সুপ্রাচলন রয়েছে। সেখানে জিতিয়া নামটি ব্যবহৃত হয়। তাঁরা দুই ধরনের জিতিয়া পালন করে থাকেন। এই দুই জিতিয়া হল --পুয়া জিতিয়া এবং ভাই জিতিয়া। মায়েরা তাঁদের সন্তানের কল্যাণ কামনায় দুতিবাহনের পূজা করে থাকেন। এর নাম পুয়া জিতিয়া। আর বোনেরা ভাইদের মঙ্গল কামনায় দুতিবাহনের পূজা করেন, ব্রত পালন করেন। এর নাম ভাই জিতিয়া।
মানভূম-পুরুলিয়ায় ইঁদ পরবের ১২ দিন পর জিতাষ্টমী ব্রত পালিত হয়। এতে সামাজিক বিচারে নিম্ন ও উচ্চ বর্ণ উভয় শ্রেণীর মানুষই অংশগ্রহণ করে থাকেন। তবে শাস্ত্রীয়ব্রত এবং অশাস্ত্রীয়ব্রতগত একটা প্রভেদ লক্ষ্য করা যায় । সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষেরা এই ব্রতটিকে শাস্ত্রীয় ব্রত রূপে এবং নিম্নবর্ণের মানুষজন লৌকিক ব্রত বা নারীব্রত রূপে উদযাপন করে আসছেন। বাংলার হিন্দু সমাজে মূলত অশাস্ত্রীয় বা মেয়েলী ব্রত রূপেই এটি সমাধিক পরিচিত। সন্তানের আয়ু বৃদ্ধি এবং কল্যাণ কামনাতেই এই ব্রতের জনপ্রিয়তা।
জিতা বা জিতুয়া ব্রতের অনুষ্ঠানের সাথে করম পূজার অনুষ্ঠানের বহুলাংশে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। উপকরণগত এবং পদ্ধতিগত দিক থেকেও উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। জিতায় ষষ্ঠীর দিন নখ কেটে ক্ষৌরকর্ম সেরে সপ্তমী অষ্টমীতে নির্জলা উপবাস দিয়ে নবমীর সকালে ব্রত সাঙ্গ হয়। মূলত গৃহবধুরা, মায়েরা এই ব্রত উদযাপন করেন। তবে কোন কোন গৃহে বাড়ির বড় ছেলে বা বিপত্নীকদেরও এই ব্রত উদযাপন করতে দেখা যায়। এর পিছনে কোন না কোন সামাজিক প্রথা বা পারিবারিক সমস্যা লুকিয়ে থাকে।
জিতাষষ্ঠী বা জীতাষ্টমীর ব্রত প্রথার প্রচলন রয়েছে। বাংলা, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা এক কথায় পুরাতন মানভূম এলাকার বিভিন্ন ভূগোল সীমায় অল্পস্বল্প পরিবর্তিত হয়ে যে ব্রত কথাটির প্রচলন তা সাধারণভাবে উপস্থাপন করলে মোটামুটি এইরকম :
কোন এক কালে শালিবাহন নামে একজন রাজা ছিলেন। রাজাশালিবাহন ছিলেন খুব নিষ্ঠাবান। প্রচুর ধনসম্পত্তি ছিল তাঁর। কিন্তু ছিল না কোন সন্তান-সন্ততি । তাই রাজা ও রাণীর মনে কোন শাস্তি ছিল না। সন্তান কামনায় রাজা নানারকম যাগযজ্ঞের আয়োজন করতেন। একদিন রাণী এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন এক দেবতা হংসবাহনে এসে তাঁকে বলছেন, “ শরৎকালে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে জিতাষ্টমী ব্রত উদযাপন কর, তাহলে তুমি সন্তান-সন্ততি লাভ করবে। ঘুম ভাঙার পর রাণী রাজাকে সব কথা বললেন। রাজা অত্যন্ত খুশী হয়ে রানীকে ব্রত উদযাপন করার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন।
ধীরে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি উপনীত হল। রাজার নির্দেশ মতো উঠানে পুকুর কেটে কলাগাছ ও বেলগাছ প্রোথিত করা হল। রাণী ব্রতের প্রথা অনুসারে সারাদিন উপবাস থেকে সন্ধ্যাকালে ভেজা ছোলা , শালুক ফুল ও নানারকম সমকালীন ফলের নৈবেদ্য দিয়ে জীমূতবাহনের পূজা করলেন, নিজে প্রসাদ খেয়ে অন্যান্য সবাইকে প্রসাদ বিতরণ করলেন। পরদিন সকালে উঠে রাণী স্নান করে আসার সময় সেই পুকুরের কাছে গিয়ে নিয়মিত পুজো করলেন ও পুত্র সন্তানের জন্য মানসিক করে এলেন। এভাবে কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর অবশেষে রাজা শালিবাহনের এক পুত্র হল। তার নাম রাখা হলো জীমূতবাহন। আর যে কন্যাটি জন্মগ্রহণ করলো তার নাম রাখা হলো সুশীলা। জীমূতবাহন বিবাহযোগ্য হলে তাকে একটি সুন্দরী কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হল। পুত্রবধূ রূপে গুণে স্বভাবে আচার-আচরণে খুবই ভাল হয়েছে, কিন্তু বেদনার বিষয় তাঁর কোন সন্তান-সন্ততি থাকছে না। কয়েকটি ছেলেমেয়ের জন্ম দিলেও তারা মারা পাচ্ছে। তখন একদিন শাশুড়ী নিয়মমতো উঠানে পুকুর কেটে জিন্তাষ্টমীর ব্রত করবার জন্য উপদেশ দিলেন, কিন্তু তার পুত্রবধূর এসব কথায় কোন বিশ্বাস নেই । বরং ব্রতকথা শুনলে হাসে এবং উপহাস করে। সে এই ব্রত বিশ্বাস করতো না বলেই তার ছেলে হয়ে মারা যেত। ব্রতের উপহাসের ফলে যে কী ভয়ংকর অমঙ্গল হতে পারে, গৃহবধূটি তা বিশ্বাস করতে পারতো না।
এভাবে দিনের পর দিন সপ্তাহ,মাস, পক্ষ ও বছর চলে যায়। একদা আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির আগমন ঘটলো। শ্বাশুড়ী তখন বউকে ডেকে বললেন—“ বউমা, আমার একটি কথা রাখো, এসো এবার আমরা দু'জনে মিলে জিতাষ্টমী ব্রত পালন করি।” কথা শুনে বউমা হেসে অস্থির। সে বলে - “আমি ওই সব মানি না আর বিশ্বাসও করি না। কিন্তু শ্বাশুড়ী সহজে পরাজয় স্বীকার করার পাত্রী নন, তিনি তাঁকে অনেক কথা বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ব্রত পালনে সম্মতি আদায় করলেন।
শেষপর্যন্ত শ্বাশুড়ীর কথামতো সারাদিন নির্জলা উপোস করে সন্ধ্যাবেলা জিমুতবাহনের পূজা করলেন । যাবতীয় লৌকিক প্রথা মেনে পুকুরের কাছে গিয়ে ছেলে হওয়ার জন্য এবং ছেলের দীর্ঘায়ু লাভের জন্য বরং চেয়ে নিল। কিছুদিন পরে যথাসময়ে বউয়ের একটি সন্তান হলো। এবং তারপর আবার কয়েকটি সন্তানের জন্ম দিলেন তিনি। এখন তাঁর যেসব ছেলে মেয়ে হয়, সকলেই বেঁচে থাকে। এই কথা চারদিকে প্রচার হতে হতেই পৃথিবীতে জিতাষ্টমী ব্রতের প্রচার হয়ে গেল।
মানভূম পুরুলিয়া এলাকার মানুষের এখনো লৌকিক বিশ্বাস এই ব্রত নিয়ম-নিষ্ঠ সহকারে পালন করলে বন্ধ্যা মহিলারাও গর্ভধারণ করবে এবং সন্তান লাভ করবে , তাদের সেই সন্তানেরা দীর্ঘ পরমাণুর অধিকারী হবে , তারা দুধে ভাতে থাকবে।
জিতাষ্টমীর ব্রতকে ঘিরে যে সমস্ত রীতি-প্রথা আচার-আচরণ পরিলক্ষিত হয়, তা থেকে বেশ বুঝতে পারা যায় মা দুর্গার আগমনের প্রাক্ লগ্নে এই ব্রত উদ্ যাপিত হলেও এখানে ভগবতী দেবী দুর্গা অপেক্ষা লিঙ্গেশ্ব শিবের গুরুত্বই অধিকতর। আদি কালে মূলত আদিবাসীদের মধ্যেই এই উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির অনুষ্ঠানটির প্রচলন থাকলেও ধীরে ধীরে সামাজিক বিচারে উচ্চবর্ণের নারীরাও এই ব্রত উদযাপনে মনোনিবেশ করেন। শুধু মানভুম, ভারতবর্ষ নয় পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় বৃক্ষবন্দনার প্রচলন রয়েছে। একদা ভারতবর্ষের আদিম আদিবাসীরাই এই ব্রত উদযাপন করতেন । সময়ের সাথে সাথে ব্রাহ্মণ, সদগোপ, বণিক সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন বর্ণের মানুষ এই ব্রত পালনে মনোনিবেশ করেন। যদিও সেক্ষেত্রে ব্রতটি সংস্কৃত হয়ে উপবিত ধারণ করেছে।
ঝাড়খড় অঞ্চলের অরণ্যবাসী বীরহোড় সম্প্রদায়ের মানুষ এই দিন জিতা ভূতের পূজা করতেন এবং আজও করে থাকেন। তবে তারা সন্তান বা ভ্রাতার মঙ্গল কামনায় এই অনুষ্ঠান উদযাপন করেন না, তাঁরা উদযাপন করেন বৃষ্টির প্রার্থনায়। কারণ এই সময় চাষবাসের পর ধান গুলি সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে, উপযুক্ত বৃষ্টিপাত না হলে ফসল নষ্ট হবে , আর ফসল নষ্ট হলে সর্বনাশ। তাদের বিশ্বাস জিতা ভূতকে পূজা করে সন্তুষ্ট না করলে সে বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেয়। জিতা ভূতের পূজাতে তারা অশ্বত্থ এবং পাকুড় প্রভৃতি গাছের ডাল মাটিতে পুঁতে পূজা করেন। শবর খেড়িয়ারা এই দিনটি শিকার উৎসব রূপে আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করেন।ভূমিজ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে এই দিনটি লক্ষ্যভেদের অনুষ্ঠান। এর নাম ভেজাবিঁধা। শবর খেড়িয়াদের শিকার উৎসব এবং ভূমিজদের ভেজাবিঁধার ভাবনাটি যেন বীরহোড়দের ভাবনার পরের স্তর। যখন শরৎকালে ধীরে ধীরে মাঠের ধান পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়, হেমন্তে মাঠ পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে সোনার ধান, তখন নানা রকমের বন্য জন্তু এসে ফসল দলে পিষে নষ্ট করে দেয়। তাই এই প্রতিটি উৎসবের মধ্য দিয়ে বন্য জন্তুদের দ্বারা অরণ্যের নিরাপদ দূরত্বে তাড়িয়ে দিতে চায়।
জিতাষ্টমীর মহালগ্নে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা রঙ্কিনীদেবীর পূজা। এক সময় রঙ্কিনীদেবীর পূজাতে নরবলি দেবার প্রথাও ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস পর্যাপ্ত ফসল এবং ধনসম্পত্তি ও সন্তান-সন্ততি রক্ষা করার দেবীকে নর রক্তে সন্তুষ্ট না করলে তিনি কিছুতেই সন্তুষ্ট হবেন না। তবে কখন নরবলি প্রচলিত ছিল এবং ইতিহাসের কোন পর্যায়ে তা বন্ধ হয়ে গেছে তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। আজও জিতাষ্টমির দিন ঘাটশিলাতে রঙ্কিনীদেবীর মূর্তি পূজিত হন। এই পূজায় দুটি পরস্পর অপরিচিত মহিষের মধ্যে লড়াই চলে। সমস্ত কর্মকাণ্ডকে নৃশংস বলেই মনে হয়। শেষপর্যন্ত উৎসবে অংশগ্রহণকারী সাঁওতাল খেড়িয়া বিরহোড় ভূমিজ ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষ মহিষ দুটিকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে এবং সেই মহিষ দুটির মাংস তারা দেবীর প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করে। জিতাষ্টমীর দিন এই পূজা ও পূজা পদ্ধতি যে করার জনসংস্কৃতির প্রভাব সমন্বিত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সম্প্রতি এই পূজাতেও সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি সমগ্র মানভূম পুরুলিয়ায় জিতাষ্টমী নানাভাবে উদ্ যাপিত হয়ে আসছে। মূল যে অনুষ্ঠান সন্তান ও শস্য কামনায় ব্রত উদযাপন সেই ধারা এখনো উজ্জ্বল রূপে প্রবহমান। মানসিক দিকটির পাশাপাশি এই পরবের একটি সামাজিক বিষয় উল্লেখযোগ্য। অঙ্কুরিত ছোলা, চিড়েমুড়কি , গুড় পিঠা, শসা এবং অন্যান্য ফল মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে মেয়ের শশুর বাড়িতে পাঠানোর পুরানো রীতি আজও রয়েছে কিন্তু ক্রমে তা ক্ষীণ হয়ে আসছে। কৃত্রিম সভ্যতার বাহারি সামাজিকতাকে অনুকরণ করে সাধারণ মানুষও এই সমস্ত পারিবারিক ফলমুলাদী খাদ্যদ্রব্য প্রেরণ না করে নিত্যনতুন অন্য ধরনের উপহার গ আদান প্রদান করে সামাজিকতা রক্ষা করছে। ধীরে ধীরে এই প্রথা বিকৃতির অন্ধকারে প্রবেশ করতে চলেছে।
--------------
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহযোগিতা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের ছবি : বরুণ রাজগড়িয়া
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
মননশীল সুন্দর সংখ্যাটি।সম্পাদকীয় থেকে সব লেখা,রেখায় মুগ্বকর।
উত্তরমুছুনসবচেয়ে ভাল লাগল প্রথম লেখাটিই... সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়ের ... এই কবির আরও লেখা পড়তে চাই ... ...
উত্তরমুছুনপড়লাম সবই ... সবচেয়ে ভাল লাগল সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের লেখাটি... এঁর আরও লেখা পড়তে চাই ... ...
উত্তরমুছুনচমৎকার কবিতাগুচ্ছ ।ভীষণ ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন