তৃতীয় বর্ষ ।। দ্বাদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ৯ আশ্বিন ১৪২৯ ।। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২




কয়েকদিন আগেই একটি সম্প্রদায় থেকে ট্রেন অবরোধ চললো। বদলে গেল কর্ম জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারাবাহিকতার অনেক কিছু হিসেব।
 আমার কলকাতা যাওয়া হলো না। বেশ কয়েকজন মানুষের জন্য পূজোর কাপড় নিয়েও আসা হলো না একই কারণে।  
           চুলচেরা আর্থিক হিসেব নিয়ে বেরিয়ে আসা মানুষের হিসেব মিলল না কোনোভাবেই।
           প্রতিদিন যে মানুষটা সময় মতো বেরিয়ে সময় মতো পৌঁছে যেতেন গন্তব্যে। তিনি আর পৌঁছলেন না। 
           সেই সম্প্রদায়ের দাবি পূরণে দায় ঠেলাঠেলি দীর্ঘায়িত করলো যন্ত্রনা। দীর্ঘায়িত করলো আমাদের পথ। অথচ কালীসাধক গাইতে থাকলেন-----

               "দোষ কারো নয় গো মা, 
                আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা  
                দোষ কারো নয় গো মা..."



সম্পাদক : উত্তম মাহাত 



______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
বিশ্বম্ভর নারায়ন দেব / তৈমুর খান / নিমাই জানা / হাবিবুর রহমান এনার / অয়ন জোয়ারদার / মোহাম্মদ বিলাল / রামানুজ মুখোপাধ্যায় / রুমি চৌধুরী / শ্রীদাম কুমার / তপন পাত্র
______________________________________________



বিশ্বম্ভর নারায়ন দেবের কবিতা

১.
আধার


প্রথাগত চেতনার বাইরে 
প্রভাবেও তো ভাবতে পারি
আমাদের দুই বোন  
কাঁসাই কুমারী-কে।

বুকে ধূ ধূ বালি  
বিধবার মত মনে হয়।

ওদের দুই পারে  
গরু চরে ছাগল চরে  
লিরনে লুবুর লুবুর
বিলাতি পাকার চাষ হয়
তখন ভুঁস ফেলে বড় ইঁদুর।

ঘুমন্ত শরীর থেকে  
নিয়ত বালি তাড়ে  
বালি চোরের দল। - ধরা পড়ে না কেউ।
শরত ঋতুতে 
তাদের কাশফুলের কাপড়ে  
বেশ মানায়!

হে আমাদের প্রিয় বাংলা সাহিত্য
এসব তুচ্ছ উপকরণ  
কি ধরা পড়বে সহজে
কাব্যিক মূল্যের আঁধারে!




২.
শ্রীময়ী


খাল পাড়ে ব্যক্তিগত চাঁদ
ওঠে ঠিক চাঁদেরই মতন
লোকালয়ের বাইরে যেতেই
বিপন্ন হয় সে সংবেদন।

ভাবি, বলবো না আর
সময়-অতিরিক্ত কথা
আমাকে যে কবি সাজায়
পল্লবিত আকূলতা!

কী মর্ম কামনা করে
ছায়াপথ করেছো রচনা
একাকী ফুটেছে গভীরে 
শরীরের দানা শস্যকণা।

তাহারি স্বরের ভিতর
বেমালুম করি বসবাস
মুখোশের ভিড়ে মুখ
খোঁজে শ্রীময়ী সুজাতা দাস।


 



তৈমুর খানের কবিতা


আমার নষ্ট হরিণীকে 
                

বাধ্য হয়ে এগিয়ে যাচ্ছি তোমার দিকে 
তুমি তেমন নারী নও, রসের কলসি রাখোনিকো ভরে 
মাথায় তোমার ফোটে না রজনীগন্ধা 
সমুদ্রের ঢেউ থেমে নেই বুকে 

আমার নৌকা শুকনো খাতে পুষছি বারোমাস 
বর্ষাবিহীন বালির মরু কেবল অবিশ্বাস 
উষ্ণ হয়ে উঠছে ধুধু বুকে 
শ্যামলিমা মৃত , অনুচ্ছ্বাস 

কেমন করে তোমার হাতে রাখব এই হাত ? 
স্পর্শগুলি বিদ্ধ করে কাচ 
রক্ত ঝরে, রক্তে সাঁতার কাটে যন্ত্রণার মাছ 
অন্ধকার তুমি এখন চাঁদনিবিহীন রাত 

বাধ্য হয়ে তোমাকে দিই গানের স্বরলিপি 
রত্নাকরের বুকে জমে বল্মীকের ঢিপি 



যিশুজন্ম 
                   
মুঠো খুলে দেখাচ্ছি তোমাকে 
আমার মুঠোয় তোমারই মাথার চুল 
মসৃণ ভোর হয়ে আছে 
একান্ত নিজস্ব ভোর 
এই ভোরে কোনওদিন বিষপান করব না আমি 
মাইল মাইল পথ হেঁটে যাব 
হেঁটে হেঁটে যাব আশ্চর্য পাহাড়ের দিকে 

আমারই প্রেমের ক্রুশকাঠে 
আমাকেই বিদ্ধ করে রাখে
                                              আরও কবিতা পড়ুন







নিমাই জানার তিনটি কবিতা

(১) 
নীল মৃত্যু ও কিছু যুগ্ম স্থাণাঙ্কের গণিত


চৈতন্যপুরে এলেই মায়ের মতো একদল নারী আমাদের সব বৃত্তীয় বন্ধন ভেঙে দেয় এন্টারোমাইসিনের কিছু ক্ষতবিহীন আগুনের তৃতীয় বাকল দিয়ে

আমি তখন দুধ সাদা রঙের এক অগ্নি বলয়
এনাফেজ ১০ এর ভেতরে লাল থকথকে শুক্রানু গুলোই নীল শিবের মুখের ভেতর থেকে ত্রিশূল খন্ডটি নিয়ে নিজের উপবৃত্তের জলীয় উপাংশ খন্ডকগুলো লাল ফুলের কাছে মেলে দেবে
রাত্রির মৃত্যু হলে প্রতিটি মানুষের ভয় জড়িয়ে আসে চাদরের মতো ,  আমি সাদা মরুভূমির পাড়ে বসে থাকা এক অস্থির নপুংসক পুরুষ মাত্র , আগুনের শিখা দেখে মৃত্যুর যুগ্ম স্থানাঙ্ক নির্ণয় করি

আমি যাজ্ঞবল্ক্য ,আমি দময়ন্তী , আমি পরাশর ,  আমি বৈকুণ্ঠ , আমি বিমান  , আমি সহস্রোজনের ভেতরে থাকা এক ব্রহ্ম কুণ্ডলিনী
আমার বিছানার একটি পাখি আদিগন্ত ভৌত ধর্ম নিয়ে কার্বনেট ফুলের চাষাবাদ করছে গম ক্ষেত্রের উপর
হেঁটে যাচ্ছেন থৈ থৈ নৃত্যের বিষ্ণুপদ শর্মার পদাবলী
আমাদের এখনই চৈতন্যপুরুষ জন্মগ্রহণ করবেন শমীবৃক্ষ থেকে অগ্নি বলয়গুলো আগুনের মতো দাউ দাউ আমার শরীরে জ্বলে উঠছে ,
এসো নিষিদ্ধ শহর ,  তোমাকে আরো একবার লিউকোপ্লাস্টের ঘুম জলে ঘুমিয়ে রেখে ছিঁড়ে ছিঁড়ে বিষাক্ত আকন্দ ফুল ঢেলে দেই
তুমি দাউ দাউ জ্বলে ওঠো নিজের ভেতর আমি তোমার জিভকেও টেনে ছিঁড়ে সাপের মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে দিই

একটা পুরুষ রক্ত তঞ্চন জানতো না বলে তার শীঘ্রপতন দেখা দিয়েছিল আদম কালে , এক গর্ভবতী নারী টিমটিমে আলো ঘরের ভেতর শেষ ঋতুস্রাবের তারিখটি বলে আসে ঈশ্বরকে
প্রতিটি ঘরে একবার নিষিদ্ধ শাঁখ বেজে উঠলো মিথারজিন খাবে বলে




(২) 
স্পার্টাকাস ,  গ্রাফাইট ও কিছু অপ্রকৃত ভগ্নাংশের কবিতা


আদিম প্রত্নতত্ত্ব ফেলে আসা তুতেনখামেন আমাদের অযৌন জননের পায়রা গুলো চতুরাশ্রমে নিয়ে যাওয়ার পর সিংহাসন থেকে ফিরে যাচ্ছেন এক কিউসেক মৎস্যগন্ধার অসুখ নিয়ে

দাঁতগুলো টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে আমার পোষা কোন এক ঘোড়ার মাংস ,  মাংসগুলো মাছেদের ডিম্বাকার স্তন আর সরীসৃপ সাপেদের চতুস্তলক
সোনা গাছ আর লেবু ফলের শেকড়ে বেঁধে ঝুলে থাকা লম্বা বৃত্তাকার ক্ষুদ্রান্ত গুলো বায়োপসি করার রসায়ন দ্রবণে ডুবিয়ে রেখেছে আমার লিঙ্গ খন্ডকটির বিনায়ক প্রচ্ছদ
ঈশ্বর নির্বিকল্প সমাধির পরেও আসবেন সূক্ষ্ম কোণে থাকা এক রথচক্র খণ্ডটির থেকে নির্গত আগুন বাহুর মতো ,
কর্দমাক্ত ঠোঁট নিয়ে ফিরে যাবে কোন এক আপেলের নিউটন পুরুষ , আমি শুধু মাধ্যাকর্ষণ আর কিছু পালককে ভয় পেয়ে এক জলাধারের পাশে রাজহাঁস হয়ে বসে আছি
আমি শুধু নীল জলের ভেতর এক তন্ময় পুরুষকে আবিষ্কার করি যার পোশাকে উল্টো দিকে মেলা থাকে বিষাদযোগ ছেড়ে আসার পর
ডয়টেরিয়াম ঠোঁটের শিউলিপুর ইস্কুল ফেরত যুবতীরা দ্বিপদ-উপপাদ্যের পেছনে একটি অগভীর নাভি লুকিয়ে রাখে
অন্তর্বাসের রেখা ধরে আমি শুধু মরচে রঙের শিরাপথের  দৈর্ঘ্য মেপে চলি এক প্রতিবন্ধী বালকের মতো
আমার মুখ দিয়ে সুদীপ্ত মান্না নেমে যাচ্ছে যার ভেতর একটা ভেন্টিলেশনের মানিপ্ল্যান্ট ছায়াগাছটি আজ কতো বার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে যায়,  মৃত মা প্রতিদিন গর্ভবতী হচ্ছে মেহগনি গাছের ঔরস নিয়ে

বাবা একটি গোলাপ গাছের ভিতরে অসংখ্য কাঁটাগাছ গুঁজে দিচ্ছে চোখগুলো বেঁধে , অলিন্দ খন্ডের মতো
আমি আজ রক্ততঞ্চন ,  স্পার্টাকাস ও গ্রাফাইটের হলুদ কবিতা পড়বো




(৩) 
তৃতীয় প্রস্তর ও বিলীয়মান ঘোড়ার জীবনচক্র


মেসোপটেমিয়ার মতো অক্ষরের তঞ্চন নিয়ে নীল রুদ্রাক্ষের গ্রানাইট শিলারা এক একটি বোহেমিয়ান নারী হয়ে বসে আছে সিদ্ধার্থ আসনটিকে আচমন করবে বলে

পবিত্র শুদ্ধির পর চোখ থেকে এক নীললোহিত নারী বেরিয়ে আসছে মধ্যরাতের বেলায়,  সাপেরা আজ নিশ্চল ঠোঁটটিকে স্নানাগারে নিয়ে যাবে কোয়ান্টাম কক্ষ বরাবর , বৃষ্টি শুধু ঘর্মগ্রন্থি বরাবর , বরাহ আসলে ঈশ্বরের অষ্টম বংশধর মাত্র
আমি মাঝে মাঝে থিওফাইলিন বাবলা গাছটিকে ঈশ্বর বলে মনে করি
মাথার উপরের রতিচক্রীরাই মধ্যরাতে উঠে আলগা করে দেয় নবম বংশীয় ক্ষত্রিয় নারীদের গোপনাঙ্গ গুলি ,
কোন কোন পরিচ্ছদ মধ্যরাতে কনিষ্কের মতো কেঁদে ওঠে
প্রতিটি মানুষ ঘুমের আগে খাজুরাহো থেকে ঘুরে আসে
আমি ঈশ্বরের গায়ে লেগে থাকা সাদা রং ঘষে ঘষে জারজ আগুনের গন্ধ পাচ্ছি , জাহাজটি খনিজ বিহীন আমার প্রিয় নারীর মতো
ব্রহ্মানি মা দুই হাত ধরে একরৈখিক হিমবাহের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমার ঠোঁট থেকে ১১ জোড়া পালকহীন পাখি এখনই
আদিম পুরুষ হয়ে জন্ম নিচ্ছে সাদা সাদা বরফ কুচির মতো
তিন দিনের জাগতিক সংসার ছেড়ে ঈশ্বরের পঞ্চম লিঙ্গ খুঁজছেন চৈতন্য রঙের অষ্টম বন্ধনীর স্নায়ুতন্ত্রী জিরাফেরা,

উপুড় বসে থাকা ধারালো তরোয়ালের নিচে প্রতিদিন বৃষ্টিপাতের একটি হলুদ ঘোড়া উলঙ্গ হয়ে নিষিদ্ধ ওষুধের খালি শিশি গুলোকে মুখে পুরে নেয় জ্যামিতিক কাঁচ ছিঁড়ে খাবে বলে
শেফালিক্সিন ৫০০ খাওয়ার পর এক একটি সমুদ্র ক্ষয়জাত চোখ হয়ে যায়, আমি  কৃষ্ণ নদীর ভেতর ইছামতির আবহবিকার আবিষ্কার করে চলি , বাদামি বালকেরা আদিম ইলোরার প্রস্তর খুঁড়ছে

 







হাবিবুর রহমান এনারের কবিতা 

১.
চির নিদ্রা


জীবনের যতো অন্ধকার বুক-পকেটে পুরে, হেঁটে 
হেঁটে পৌঁছাই প্ৰাঞ্জল উপত্যকায়----আচম্বিতে বুক পকেট হতে উপচে পড়ে অন্ধকার, গোগ্রাসে গিলে 
খায় কাঙ্খিত প্রাঞ্জল উপত্যকা!

বড় অসহায়...হাবুডুবু খাই আর অন্ধকারের অথৈ গহ্বরে—ক্রমশ তলিয়ে যাই!

সাপ, বিচ্ছু দংশন করে; মাটির মমতায় বিষ ব্যথা ভুলে---চির নিদ্রা যাই!




২.
দ্রুতগামী


দূর-বহুদূর গমন-সম্ভাবনার সুর লহরি যেই 
কণ্ঠে তুলেছে ভায়োলিন... 
আধিক্য হারায়ে ফেলি প্রিয় পথ-চলার মুদ্রা

আর-
বালিহাঁস দৃষ্টিতে শূন্য সম্ভাবনা কতদূর যাবে

প্রান্তরের যত মুগ্ধতা- তাকে হত্যা করে করে 
কেনো কোনো সম্ভাবনা পান করছি না

বিবস্ত্র...
মধু ভেবে- উন্মাদের মতো ময়লা-আবর্জনা 
চাটি— তাতে কার কি আসে আর যায়

অহেতুক ঘন করছি- কুসুমবাগ আর দিগন্ত

একেকটি পুনরাগমনের অপেক্ষা বাড়াচ্ছে... 
পানপাত্র

অতিক্রমকালে—
যতো পারি শূন্য সম্ভাবনা গলাধঃকরণ করে দ্রুতগামী ... সুর লহরীর সহগামী হয়েছি!







এপিটাফ - ৫

অয়ন জোয়ারদার


তোর বাবা নাকি সুইসাইড করেছিল?
আজ আমার একমাত্র সন্তানের সদ্য গড়ে ওঠা অষ্টাদশী প্রেমিকা জিজ্ঞেস করল এই প্রশ্ন।

আজ পাঁচ বছর হল আমার ছেলে বাবার নামের আগে 'লেইট' লেখে।

অর্যমন বলল, হ্যাঁ, তারপর থেকে উনি আমার আঙ্গুলে থাকেন আর মন খারাপের সময় আমার সারকার্ডিয়াল রিদম-এ বেহালা বাজান।
মেয়েটি হা করে চাইল। আঠারো বয়সী অর্যমন বোধহয় বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করল।

আমার আজ থেকে ওকে স্পর্শ করার ইচ্ছেটা চলে গেল।
একমুখ কংক্রিট, নাকে অপরাজিতা, সারা গায়ে ফার্ন আমার...
দেখতে দেখতে আমার রক্তটা কথা বলা শুরু করে দিল!







মোহাম্মদ বিলাল-এর কবিতা


১.
অমৃতস্য হই


কথাগুলো রেখে এলাম উলটানো কলাপাতায় জবাফুল-সিকি-আধুলি সবকিছু সঞ্চয় 
ওখানে মিলেছে চৌরাস্তা—তোমার নিত্য যাতায়াত
দেখো কিনা দেখো জানি না—কাকপক্ষীরা তবু জানে ওগুলো অশথের তলে কোনও এক মুমূর্ষুর প্রাণভিক্ষার বাওনা
কতকাল ধরে চেয়ে আছে
তোমার তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলির ঐকতান 
একে গ্রহণ করো, দেবী, অমৃতস্য হই। ।

ধরো, গ্রামের মানুষ এক আমি—শহুরে বিপণিবিতানে বিশ্বাস নেই কোনও
তাই
কলাপাতায় রেখে দিই ভালোবাসা— 
এক অশেষ প্রাণ।



২.
করচফুলের নদী


শেষ যেবার দেখা হলো তখন আমাদের বসার মতো কোনও অবসর ছিল না
তবু ঝরনার মতো কবিতা শুনিয়েছ
তোমার গ্রীবা আর অধরপল্লবের মুদ্রায় 
আমি লীন হয়েছি কতবার
শস্য ও শান্তি চেয়েছি বলে শরীরের সীমায় থাকিনি হাওয়াই চুম্বন দিয়েছি করচফুলের মতো অজস্র

তারপর জেনেছি কোথাও কোনও দ্বিধা রাখতে নেই করচফুলের নদীতে যাপন করি নিশিদিন 
ফুলগুলো পড়ে থাকে – ফুলগুলো নদী হয়








তোয়ার আঁকার খাতা

রামানুজ মুখোপাধ্যায়


ওইদিকে মেঘ আঁকে। এইদিকে গাছ।
সামনে পাহাড়। নদী। ডিঙি, জল, মাছ।
সকালে পাখির ডাক। কী যে অপরূপ!
তোয়া বলে: দেখে আসি। আমি বলি: চুপ।

পথ আঁকে। আঁকাবাঁকা। ধূ ধূ ডাঙা। মাঠ।
মাথার উপরে রোদ। এইটুকু হাত
আঁকতে কি পারে নাকি এত বড়ো চিল?
খাতাটি পড়েই আছে। ভাঙা পেনসিল।

কী করে আঁকবে বলো হাতিটির নাক?
পায়রা, শালিক, টিয়া, হাঁসেদের ঝাঁক?
সারিসারি তাল গাছ। বৃষ্টি অঝোর।
থিকথিক কাদা আর কী ঘুমের ঘোর!

আধখানা চাঁদ আঁকে মনে-মনে। ওই
দূরের আকাশে রাখা তারাদের মই।
এই সব সাতপাঁচ ভাবনার রেশ
নিয়ে দেখি জেগে আছে তার গ্রামদেশ।







রুমি চৌধুরীর কবিতা 

১.
বিরুদ্ধ হাওয়া 
    

চেয়েছিলাম মখমলি এক ভোর
তোমার চাওয়া গহন গভীর দোর
হৃদয় আমার মুক্ত প্রজাপতি
তাতেই তোমার প্রবল আপত্তি।

কোলাহলে আমার ভীষণ ভয়
নির্জনতায় বিশ্ব করি জয়
তোমার কেবল মিছিল মাঝেই চোখ
উসকে তোল বিস্ফোরণের শোক।

নীল চাঁদোয়ায় অবাধ মাখামাখি 
বিষণ্ণতায় রাত জাগা সে পাখি
অন্তপুরের গোপন অন্তরালে
চুপকথা কয় গহীন আড়ালে।

তোমার আমার বিরুদ্ধ এই হাওয়া
বিপরীতের স্রোতে ভেসে যাওয়া
একসুরে গায় প্রজাপতির গান
মেলে ধরে নতুন অভিধান।



২.
 বসন্তের শতরূপ 

              
কিছু ভুলচুক, কিছু শুদ্ধতা
কিছু রহস্য, কিছু প্রেমময়তা
জীবনের বয়ে চলা স্রোত
মাঝেমাঝে মেশে কোন ভুল মোহনায়
কখনো সেই ভুল মোহনাতেও থেকে যায়
নবসৃষ্টির অপূর্ব গতিময়তা।

চৈত্রের বকুল ঝরানো পথে
বিদায় নেয় যে বসন্ত
সে কি আর ফিরেছে কোন কালে?
কৃষ্ণচূড়ার আগুন লাগিয়ে ফের যে আসে
সে তো অন্য কেউ, অন্য কোন ফাগুন
হয়তো সে ফাগুনেও থাকে প্রেম
থাকে রঙিন সুখের রোশনাই
তবুতো সে প্রেম অন্য, সে সুখ ভিন্ন।

কে বলে প্রেম একবারই আসে!
প্রতিটি বসন্তের মতো নতুনত্ব নিয়ে
জীবনেও প্রেম আসে বারবার,
শতরূপে শতবার।







জিলিংলহর

শ্রীদাম কুমার 


                        ১.
সেবার রাতে গেছিলাম কীর্তন শুনতে।
পিশেমশাইয়ের সঙ্গে, তাঁরই গাঁয়ে
কিশোরবেলার চাদর মুড়ি দিয়ে....


                         ২.

সব ছাপিয়ে  ছিল  আসর মাত-করা এক  বাঁশি।
থৈ থৈ ভীড় অপূর্ব সম্মোহনের ঘোরে বাঁধা।
কে বাজায় এমন বাঁশি  ?
কোথাকার সে  ?

---   জিলিংলহরের বাঁশিয়াল ও ।


                           ৩.

ভীড় বাঁচিয়ে তখন , আসর শেষে ফেরার তাড়া।
যেতে যেতেই বলেন-- ঠিক তোমায়
নিয়ে যাব একদিন, বাঁশিয়ালের কাছে,
জিলিংলহরে।


                           ৪.
পিশেমশাই চলে গেলেন হঠাৎ। আমার আর
জিলিংলহর যাওয়া হলো না ।

রাত গেল দিন গেল।   কাঁসাই  সুবর্ণরেখায়
গড়ালো বহুজল , অশ্রুপাথার থৈ থৈ
নিঃশব্দবিলীন। 


                             ৫.
এক যুগ পর  
জিলিংলহরের মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে হয়েছে দেখা;
দিয়েছেন বাতলে সেখানের রাস্তার  নিশানা সঠিক।
সেই মতো খুঁজেছি বাঁশিয়ালের বাড়ি...

পাইনি কোনই  হদিশ...


                              ৬.
পথে প্রান্তরে খুঁজে চলি আজও। সেই বাঁশিয়ালকে।
আমার অবোধচেতনা জুড়ে রাস্তা ঘুরে ফিরে চলে যায়
জিলিংলহরের দিকে....






________________________________________________

"মহালয়া" কী ও কেন ...

                    তপন পাত্র
________________________________________________


কথা হচ্ছিল দু'চার জন গৃহবধুর সাথে । প্রসঙ্গ :  "মহালয়া" । তাঁরা তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রী । মহালয়ার ভোরে প্রায় জোর করেই তাঁদের জাগিয়ে দেওয়া হতো । স্কুল মাঠের বকুলতলায় ঢুলু ঢুলু চোখে বসে পড়তেন তাঁরা । ছোট্ট আয়তাকৃতির একটা বাক্স থেকে ভেসে আসতো কী সব গান আর খুব গম্ভীর গলায় যত্তোসব মন্ত্র !


 একসময় সকাল হয়ে যেত । তাঁরা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করতেন , ''তুই আকাশের দিকে তাকিয়ে মহালয়া দেখতে পেয়েছিস ? " উত্তর আসতো --"না" ।

 আর তুই ?

  প্রতিউত্তর --"না" ।

দীর্ঘ কয়েকটা বছর তাঁদের ধারণা ছিল মহালয়া মানে ,  ভোর বেলায় আকাশে হয়তো বিশেষ কিছু দেখতে পাওয়া যায় । তাঁদের দুর্ভাগ্য তাঁরা দেখতে পাননি । কড়া মেজাজের দিদিমণিদের এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করারও সাহস হয়নি । 


পরে ধীরে ধীরে বড়ো হবার সাথে সাথে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো তাঁদেরও ধারণা বদলালো । তাঁরাও ভাবলেন , মহালয়া মানে বাণীকুমার সম্পাদিত গীতি আলেখ্য "মহিষাসুরমর্দিনী" । এক ঝাঁক সংগীত তারকার ভুবনমাতানো গান এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ ।


 সত্যি কথা বলতে কি ,  আপামর বাঙালির কাছে আজও মহালয়া মানে ওই আলেখ্য । মহালয়া মানে পুরানো রেডিও , ভাঙাচোরা রেডিও সারিয়ে সেই বিশেষ ক্ষণটির জন্য দিন গোনা , প্রহর গোনা ।


    সময় বদলের সাথে সাথে দূরদর্শন মহালয়ার ভোরে কতো অনুষ্ঠানই না করলো ,  কতো নাচ  , কতো আঙ্গিক ,  কতো প্রেক্ষাপট , রূপসজ্জা , দৃশ্য সজ্জা , লোকনৃত্যের আমদানি । কিন্তু একটু বয়স্ক বাঙালি "মহালয়া" বলতে ওই বিশেষ আলেখ্যটি নিয়ে কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে যায় । আরো অনেকদিন হয়ে যাবে ।


কিন্তু এ তো অন্য কথা ।

   আসল কথা হল "মহালয়া" টা কী এবং কেন ? 


আমরা অনেকেই বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে । যদিও অনেক কথাই প্রচলিত আছে "মহালয়া"কে অবলম্বন করে ।


তিথিগত দিক থেকে "মহালয়া" হল পিতৃপক্ষ । "মহালয়া" বলতে যে দিনটিকে বুঝি , সেটি এই পক্ষের পঞ্চদশতম দিন । পিতৃপক্ষ বা মহালয়া পক্ষের ১৫ টি তিথি । এগুলি হল প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা । 

এরপরই দেবীপক্ষের সূচনা । মহালয়া পক্ষের শেষ দিনটি আমাদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে হিন্দুধর্ম বিশ্বাস করে এই শুভক্ষণে মা দুর্গা দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে অনুমতি নিয়ে কৈলাস থেকে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন ।


মহালয়ার সর্বাপেক্ষা মাধুর্যমন্ডিত মুহূর্তটি হ'ল এই বিশেষ সন্ধিক্ষণ -- 'পিতৃপক্ষের সমাপ্তি ও মাতৃ পক্ষের সূচনা' , এটি এক পক্ষ কাল ব্যাপী পিতৃতর্পণের শেষ লগ্ন ।


সকলেই অবগত আছেন ,  চিরন্তন ও আসল দুর্গাপূজা টি হ'ল বাসন্তী পূজা , যা অনুষ্ঠিত হয় বসন্তকালে । মহাকাব্য "রামায়ণ" অনুসারে সীতাদেবী কে উদ্ধারের জন্য শ্রী রামচন্দ্র কে অকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করতে হয়। সময়ের সাথে সাথে দেবীর অকালবোধন এই শারদীয়া দুর্গাপূজাই সর্বজনপ্রিয় হয়ে ওঠে । 


ধর্ম মতে কোন মঙ্গল কর্ম করতে গেলে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে হয় । তর্পণ হ'ল তিল- তুলসী- জল, ফলমূল দানের মধ্য দিয়ে তৃপ্ত করা । ভগবান রামচন্দ্র সীতালক্ষ্মীকে উদ্ধারের  আগে মহালয়ার দিন এমন কাজই করেছিলেন ।


এখন প্রশ্ন হলো , এই মুহূর্তটির নাম "মহালয়া" হ'ল কীভাবে ? 

সংস্কৃত "মহ" শব্দটির অর্থ "পিতৃগণ" আর "আলয়" শব্দের অর্থ "আগমনকাল" । মহ+আলয়=মহালয় । তার সাথে স্ত্রীলিঙ্গে "আ" যোগ করে "মহালয়া"।


জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর "বাঙ্গালা ভাষার অভিধান" এ বলেছেন : "শ্রাদ্ধকালে যে সময়    পিতৃলোকেরা শ্রাদ্ধ ভোজনের জন্য আনন্দ সহকারে এসে থাকেন , সেই মুহূর্তটির নাম মহালয়া " ।

শারদীয়া পূজার অব্যবহিত পূর্বে আরম্ভ করে অমাবস্যা তিথিতে এই আগমন শেষ হয়। পিতৃ বিসর্জন মন্ত্র আছে, " যমলোকং পরিত্যাজ্য আগতা যে মহালয়ে" ।


হিন্দু পুরাণ অনুসারে মর্ত্যলোক এবং স্বর্গলোকের মাঝখানে পিতৃলোক নামে একটি স্থান আছে। মৃত্যুর পর মৃতের আত্মা পিতৃলোকে অধিষ্ঠান করেন । সেখানে যমরাজ সর্বময় কর্তা । যমরাজের অধীনে সেখানে তিন পুরুষের আত্মা বাস করেন । শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পূর্ববর্তী তিন পুরুষের তর্পণ করা হয় । পরবর্তী এক পুরুষের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের এক আত্মা স্বর্গলোক গমন করেন । অর্থাৎ পিতৃলোকে সর্বদা পিতা , পিতামহ এবং প্রপিতামহ বিরাজ করেন। তর্পণে এই তিন পুরুষের আত্মাকেই অঞ্জলি দেওয়া হয় ।


কথিত আছে , রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি এই ভব সংসারের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বনে গমন করেছিলেন । গভীর অরণ্যে তাঁরা দু'জন ধ্যানমগ্ন হবার চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু ফেলে আসা জীবনের সুখ-দুঃখ এবং ঐশ্বর্যের চিন্তা ভুলতে পারছিলেন না । তাই তাঁরা মেধা ঋষির আশ্রমে যান ,  সেখানে শ্রীশ্রীচণ্ডী বিষয়ে আলোচনা চলছিল । সুরথ ও বৈশ্য সমাধি ঋষিকে তাঁদের সমস্যার কথা জানালেন । তখন ঋষি বললেন ,এই ভব সংসারের মোহ-বন্ধন এবং মুক্তি ---সমস্ত কিছুই মাতৃ আরাধনার মধ্যে নিবিষ্ট রয়েছে । তাঁরা পরম মাতৃদেবীকে লাভ করার জন্য মাতৃপক্ষের প্রারম্ভ কালে নদী সমীপে তর্পণ করেছিলেন এবং মায়ের দর্শন লাভও করেছিলেন ‌ । এই স্থলে আমাদের ভারতীয় সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে , মহালয়ার পুণ্য তিথিতে অশুভের বিনাশ এবং সৌভ্রাতৃত্বের ভাব বজায় রাখার জন্য বর্তমান যুগেও পিতৃ মহালয়া উপলক্ষে পিতৃতর্পণের মধ্য দিয়ে শুভ ভগবতী মা দুর্গার আরাধনা শুরু হয় । এই তিথিতে সমস্ত জ্ঞানী-গুণীজন নিজের পূর্ব তিন পুরুষ , এবং যে কোন আত্মীয় ,  বন্ধুবান্ধব ---সকলেরই পূর্বপুরুষের পারোলৌকিক আত্মার শান্তি কামনায় এই তর্পণ করে থাকেন ।


পুরাণ মতে ,  কর্ণ যখন মারা যান , তখন তাঁর আত্মা স্বর্গে গেলে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে খাদ্য রূপে স্বর্ণ ও রত্ন দান করেন । কর্ণের আত্মা বিস্ময়ের সঙ্গে ইন্দ্রের এই আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলে   ইন্দ্র বলেন ,  জীবদ্দশায় কর্ণ কখনো পূর্বপুরুষকে কোন খাদ্য বা জল তর্পণ করেননি , যা দান করেছিলেন তা শুধু সোনা । তাই কর্ণকে ১৫ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে এসে এই মহালয়ার তিথিতে পিতৃতর্পণ করতে হয় , এই হল মহালয়ার গুরুত্ব ।


এই তর্পনের প্রভাবে বিশ্বতর্পণ ,  রামতর্পণ , লক্ষণতর্পণ ক'রে  হিন্দুগণ  সমস্ত আত্মীয়বর্গের তর্পণ করেন । শুরু হয়ে যায় মাতৃপূজা । কারণ জগজ্জননী দেবী দুর্গা বলেছেন ---

"সর্ব্ববাধাবিনির্ম্মুক্তো ধনধান্যসুতাণ্বিতঃ ।

মনুষ্যো মৎপ্রসাদেন ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ ।।"

 --অর্থাৎ আমার কৃপায় মানুষ সকল বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত হয় এবং ধন , ধান্য ও সন্তানাদি লাভ করে ।


_________________________________



                          আমাদের বই














সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা 
অলঙ্করণের ছবি : বরুণ রাজগড়িয়া
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪